কই সে?

কই সে?

রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাত্মবোধ, গ্যোটের ভূয়োদর্শন, শেপিয়রের মানব-চরিত্রজ্ঞতা সামান্য জনও কিছু না কিছু উপলব্ধি করতে পারে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে দিয়েছেন মাত্র একটি হিমালয়; আমাদের মানস-লোকে এই তিনজনই তিনটি হিমালয়। সাধারণ জন দূরে থেকেও এদের গাম্ভীর্য-মাধুর্য দেখে বিস্ময় বোধ করে চূড়ান্তে অধিরোহণ করেন অল্প মহাত্মাই। আরও হয়তো একাধিক হিমালয় এ-ভূমিতে, অন্যান্য ভূমিতে আছেন– ভাষা ও দূরত্বের কুহেলিকায় আজও তাঁরা লুক্কায়িত।

এছাড়া প্রত্যেক পাঠকেরই আপন আপন অতি আপন প্রিয় কবি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো বিশ্বজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি হয়তো তাদের সে মেধা নেই; এদের স্বীকার করে নিয়েও আমরা এদের নাম বিশ্বকবিদের সঙ্গে এক নিশ্বাসে বলি না।

আমি দু জন কবিকে বড় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। আমারই সৌভাগ্য, এদের একজন বাঙালি- চণ্ডীদাস, অন্যজন জর্মন, নাম হাইনে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বড় বড় কবিদের ছেড়ে এঁদের প্রিয় বলে বরণ করেছি কেন? কারণটা তুলনা দিয়ে বোঝালে সরল হয়। রাজবাড়ির ঐশ্বর্য দেখে বিমোহিত হই, বিনোবাজির ব্যক্তিত্ব দেখে বাক্যস্ফূর্তি হয় না, কিন্তু রাজবাড়িতে তথা বিনোবাজির সাহচর্যে থাকবার মতো কৌতূহল যদি-বা দু-একদিনের জন্য হয়, তাঁদের সঙ্গে অহরহ বাস করতে হলে আমার মতো সাধারণ জনের নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসবে।

চণ্ডীদাসকে নিয়ে মোল, আর হাইনেকে নিয়ে সতের বছর বয়েস থেকে ঘর করেছি। একদিনের তরে কোনও প্রকার অস্বস্তি বোধ করিনি। আমি জানি, এ-বিষয়টি আরও সরল করে বুঝিয়ে বলা যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রত্যেকেরই আপন আপন প্রাণপ্রিয় ঘরোয়া কবি আছেন- শেকসপিয়র গ্যোটে নিয়ে ঘর করেন অল্প লোকই তারা এতক্ষণে আমার বক্তব্যটি পরিষ্কার বুঝে গিয়েছেন। নিজের পিঠ নিজে কখনও দেখিনি, কিন্তু সেটা যে আছে সে-কথা অন্য লোককে যুক্তিতর্ক দিয়ে সপ্রমাণ করতে হয় না।

চণ্ডীদাস ও হাইনের মতো সরল ভাষায় হৃদয়ের গভীরতম বেদনা কেউ বলতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ আর গ্যোটেও অতি সরল ভাষায় কথা বলতে জানতেন, কিন্তু তারা সৃষ্টিরহস্যের এমন সব কঠিন জিনিস নিয়ে আপন আপন কাব্যলোক রচনা করেছেন যে সেখানে তাঁদের ভাষা বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুয়ে হতে বাধ্য। চণ্ডীদাস, হাইনে তাদের, আমাদের হৃদয়-বেদনালোকের বাইরে কখনও যেতে চাননি। তাঁরা গান গেয়েছেন, আমাদের আঙিনায় তেঁতুলের ছায়ায় বসে– তারা-ঝরা-নিঝরের ছায়াপথ ধরে ধরে তারা সপ্তর্ষির গগনাঙ্গন পৌঁছে সেখানকার অমর্ত্য গান গাননি।

চণ্ডীদাসকে সব বাঙালিই চেনে, হাইনের পরিচয় দি।

আমাদের পরিচিত জনের মাধ্যমেই আরম্ভ করি।

যারা গত শতাব্দীতে ইয়োরোপে সংস্কৃতচর্চা নিয়ে কিঞ্চিত্র আলোচনা করেছেন তারাই আউগুস্টু ভিলহেলম ফন শ্লেগেলের সঙ্গে পরিচিত।

জর্মনির বন্ বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বপ্রথম সংস্কৃতচর্চার জন্য আসন প্রস্তুত করা হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আসনে অধ্যাপকরূপে বিরাজ করতেন। একদিকে তিনি সংস্কৃতের নাট্যকাব্যের সঙ্গে পরিচিত, অন্যদিক দিয়ে তখনকার গৌরবভাস্কর ফরাসি সাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্য ভোগ করেছিলেন বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যসম্রাজ্ঞী মাদাম দ্য স্তালের সখা ও উপদেষ্টারূপে। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাড়াও পড়াতেন নন্দনশাস্ত্র বা অলঙ্কার। এক বৎসর যেতে না যেতে হাইনে বন এলেন আইন পড়তে। শ্লেগেলের বক্তৃতা শুনে তিনি এমনই অভিভূত হয়ে গেলেন যে আইনকে তিনি নির্বাসনে পাঠালেন।

শ্লেগেল অলঙ্কার পড়াবার সময় নিজেকে গ্রিক লাতিন ফরাসি জর্মনের ভিতর সীমাবদ্ধ করে রাখতেন না। ঘন ঘন সংস্কৃত কাব্যোপবনে প্রবেশ করে গুচ্ছ গুচ্ছ গীতাঞ্জলির সঞ্চয়িতা তাঁর শিষ্যদের সামনে তুলে ধরতেন। হাইনের বয়স তখন একুশ বাইশ। সেই সর্বজনমান্য প্রবীণ জ্ঞানবৃদ্ধ রসিকজননমস্য শ্লেগেলের কাছে হাইনে একদিন নিয়ে গেলেন তার একগুচ্ছ সরল কবিতা।

উত্তম, উত্তম কবিতা, কিন্তু তোমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। বড়বেশি পুরনো অলঙ্কারের ছড়াছড়ি, নিজের কথার আড় কবিতাকে কৃত্রিম করে ফেলেছ। দুরুদুরু বুকে হাইনে মৃদু আপত্তি জানালেন। শ্লেগেল নির্দয় সমালোচক। বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু তোমার কাব্যরানি এখনও পরে আছেন জবরজঙ্গ জামাকাপড়, তার মুখে বড্ডবেশি কালো তিল, তার ক্ষীণ কটি আর কত ক্ষীণ করবে, তার খোঁপা যে আকাশে উঠে গেছে। একে ভালোবাসার যুগ তোমার পেরিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু বন্ধু, তোমার ভাস্কর কাব্যলক্ষ্মী ঘুমিয়ে আছেন কে জানে কোন ইন্দ্রজালের মোহাচ্ছ মায়ায় উত্তর দেশে। নিভৃতে নির্জনে। প্রেমাতুর, বিরহবেদনায় বিবর্ণ কত না তরুণ রাজপুত্র বেরিয়েছেন তার সন্ধানে। হয়তো তুমিই, তুমিই বন্ধু সেই ভানুমতী মন্ত্র পড়ে তাঁকে দীর্ঘ শর্বরীর, দীর্ঘতর নিদ্রা থেকে জাগরিত করবে। ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে। চতুর্দিকে বনস্পতি গান গেয়ে উঠবে, প্রকৃতিও জেগে উঠবে আপন জডুনিদ্রা থেকে। জর্মন কাব্যলক্ষ্মীর চতুর্দিকের প্রাকার ধ্বংসাবশেষ রূপান্তরিত হবে স্বর্ণোজ্জ্বল রাজপ্রাসাদে। গ্রিসের সুরপুত্রগণ আবার এসে অবতীর্ণ হবেন তাদের চিরনবীন দেবসজ্জার মহিমায়…প্রার্থনা করি আপোল্লো দেব তোমার প্রতি পদক্ষেপের দিকে অবিচল দৃষ্টি রাখুন।

হাইনের জীবনীকার বলেন, কোনও সুরা তরুণ হাইনেকে এতখানি উত্তেজিত করতে পারেনি সে যুগের আলঙ্কারিক-শ্রেষ্ঠের কয়েকটি কথায় তাকে যতখানি সোমাচ্ছন্ন করেছিল। রসরাজ শ্লেগেল স্বহস্তে হাইনের মস্তকে কবির রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছেন।

এর কিছুদিন পরে হাইনে তখনও কলেজের ছাত্র বেরল তার কবিতার বই, বুখ ড্যার লিডার, গানের বই, কিন্তু এর অনুবাদ গীতাঞ্জলি করলেই ঠিক হয়। আমরা অঞ্জলি বলতে যা বুঝি সেটা ইয়োরোপেও আছে, কিন্তু ঠিক শব্দটি নেই। গানের বইখানা পড়ার পর স্পষ্টই বোঝা যায়, অঞ্জলি শব্দটি ইয়োরোপে থাকলে হাইনে অতি নিশ্চয় ওইটেই ব্যবহার করতেন- কারণ এর অনেকগুলিই তাঁর প্রথমা প্রিয়ার পদপঙ্কজে অর্পিত প্রণয়প্রসূনাঞ্জলি।

সমস্ত জৰ্মনি সাত দিনের ভিতর এই কলেজের ছোকরার জয়ধ্বনি গেয়ে উঠল। হাইনে জর্মন কাব্যে আনলেন এক নতুন সুর। অথচ সত্য বলতে কী, এ সুরে কিছুমাত্র নতুনত্ব নেই, কারণ গীতিগুলো সরলতম ভাষায় রচিত। সরল ভাষা ব্যবহার করা তো আর বিশ্ব-সাহিত্যে কিছু নতুন নয়। কিন্তু জর্মন কাব্যে ওইটেই হল এক সম্পূর্ণ নবীন সুর কারণ জর্মনদের বিশ্বাস তাদের ঐতিহ্য তাদের সংস্কৃতি এমনই এক অবর্ণনীয় কুহেলিকাঘন আত্মোপলব্ধি প্রচেষ্টা এবং অর্ধ-সফলতা-অর্ধনৈরাশ্যে আচ্ছাদিত যে সেটা সরল ভাষায় কিছুতেই প্রকাশ করা যায় না। হাইনে দেখিয়ে দিলেন সেটা যায়। যেরকম সবাই যখন বলেছিল, অসম্ভব, তখন মধুসূদন দেখিয়ে দিয়েছিলেন, অমিত্রাক্ষরে বাঙলা কাব্য সৃষ্টি করা যায়!

হাইনের কবিতা সরল। সকলেই জানেন সরল ভাষায় লেখা কঠিন। সে-ও আয়ত্ত করা যায়। আয়ত্ত করা যায় না– সরল কিন্তু অসাধারণ হওয়া। সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল–সরল অথচ বিরল লেখা।

ইংরেজিতে হাউসমানের সঙ্গে হাইনের তুলনা করা হয়। শুনতে পাই, হাউসমানের এপ শা ল্যাডের মতো কোনও ইংরেজি কবিতার বই এত বেশি বিক্রয় হয়নি– প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। সাধারণ জন পড়েছে বইখানা সরল বলে, গুণীরা কিনেছেন বিরল বলে। পাঠককে অনুরোধ করি, দু জনারই লেখা তলিয়ে পড়তে। হাইনে অনেক উঁচুতে।*[*Edmund Wilson মার্কিন সমালোচক। আমি যে তাকে শ্রদ্ধা করি তার প্রধান কারণ তিনি এলিয়েটকে অপ্রিয় সত্য বলতে জানেন। হাইনে-হাউসমান সম্বন্ধে তিনি বলেন, There is immediate emotional experience in Housman of the same kind that there is in Heine, whom he imitated and to whom he has been compared. But Heine, for all his misfortunes, moves at ease in a large world. There is in his work an exhilaration of adventures, in travel, in love etc. Doleful his accents may sometimes be, he always lets in air and light to the mind. But Housman is closed from the beginning. His world has no opening horizons etc. The Triple Thinkers. p. 71.]  

হাইনের কবিতা বাঙলায় অনুবাদ করেছেন প্রধানত সত্যেন্দ্র দত্ত তীর্থ সলিল ও তীর্থ রেণুতে এবং হয়তো অন্যান্য পুস্তকেও কিছু কিছু আছে। আর করেছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী।*[* ২. পরে জানতে পারি, বাঙলায় সর্বপ্রথম অনুবাদ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে।]

এর বই যোগাড় করতে পারিনি, আমি ১৩১৭ সনের প্রবাসীতে পড়েছি। ডি রোজে, ডি লিলিয়ে, টাউবে দি রোজ, দি লিলি, দি ডাভের অনুবাদ করেছেন :

গোলাপ, কমল, কপোত, প্রভাত রবি
 ভালোবাসিতাম কত যে এসবে আগে,
 সেসব গিয়েছে, এখন কেবল তুমি,
তোমার মূর্তি পরাণে কেবল জাগে।
 নিখিল প্রেমের নিঝর তুমি সে সবি
 তুমিই গোলাপ, কমল, কপোত, রবি।
—(বাগচী, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩১৭)

 এবারে সত্যেন দত্তের একটি :

জাগিনু যখন উষা হাসে নাই,
 শুধানু, সে আসিবে কি?
 চলে যায় সাঁঝ আর আশা নাই,
সে ত আসিল না হয়, সখি?

নিশীথে রাতে ক্ষুব্ধ হৃদয়ে
 জাগিয়া লুটাই বিছানায়;
আপন রচন ব্যর্থ স্বপন
দুখ ভারে নুয়ে ডুবে যায়।

ভারতবর্ষের প্রভাব হাইনের কবিতায় খুব বেশি আছে বলা যায় না। তার পূর্ববর্তী হিমালয় গ্যোটেই যখন হাইনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি চণ্ডীদাসের উপর কার প্রভাব! তখন সে আশা দুরাশা। তবু একটি কবিতার উল্লেখ করি

গঙ্গার পার- মধুর গন্ধ ত্রিভুবন
আলো—ভরা
 কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতি-ধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
—(লেখকের অনুবাদ)

একদিক দিয়ে হাইনে গীতিকাব্য রচয়িতা, অন্যদিক দিয়ে তিনি সমস্ত জীবন লড়েছেন জর্মনির সাধারণ জনের ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য। সেই দোষে তাঁকে যৌবনেই নির্বাসন বরণ করতে হয়। জীবনের বেশিরভাগ তিনি কাটান প্যারিসে। সেখানে তিনি কী রাজার সম্মান পেয়েছিলেন, সে কথা লিখেছেন ভিক্টর হুগোর গুরু ফরাসি সাহিত্যের তখনকার দিনের গ্র্যান্ডমাস্টার গোতিয়ের। আর হাইনের সখা ও সহচর ছিলেন সঙ্গীতের গ্র্যান্ডমাস্টার রসৃসিনি। যদিও পরের কথা, তবু এই সুবাদে একটি মধুর গল্প মনে পড়ল।

জীবনের শেষ আট বছর হাইনের কাটে ওই প্যারিসেই, রোগশয্যায়, অবশ অথর্ব হয়ে অসহ্য যন্ত্রণায়। কার্লমার্কস যখন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তখন হাইনের চোখের পাতা আঙুল দিয়ে তুলে ধরতে হয়েছিল যাতে করে তিনি মার্কসকে দেখতে পান। এর কিছুদিন পর হাইনের বাড়িতে আগুন লাগে। বিরাট বপু দরওয়ান রোগজীর্ণ হাইনেকে কোলে করে নিয়ে গেল নিরাপদ জায়গায়। আগুন নেভানোর প্র যখন তাকে দরওয়ান আবার কোলে তুলে নিয়ে এল তখন হাইনে মৃদুহাসি হেসে তার এক সখাকে বললেন, হামবুর্গে মাকে লিখে দাও, প্যারিসের লোক আমাকে এত ভালোবাসে যে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

সেই সরল দরওয়ান কথাটির গভীর অর্থ বুঝেছিল কি না জানিনে। শুনতে পেয়ে সে বলেছিল, হা, মঁসিয়ে, তাই লিখে দিন।

ঘটনাটির ভিতর অনেকখানি বেদনা লুকনো আছে। নির্বাসিত হাইনে যতদিন পারেন তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন যে তিনি আর নড়া-চড়া করতে পারেন না।

পাশ্চাত্য কবিরা মায়ের উদ্দেশে বা স্মরণে বড় একটা কবিতা লেখেন না। ইহুদি হাইনের গায়ে প্রাচ্যদেশীয় রক্ত ছিল বলে তিনি ব্যত্যয়। অল্প লোকই হাইনের মতো মাকে ভালোবেসেছে। প্যারিসে থাকাকালীন মাত্র দু বার তিনি গোপনে জর্মনি যান। দুবারই মাকে দেখবার জন্য। আমার নিজের মনে সন্দেহ আছে, পুলিশ জানতে পেরেও বোধহয় সাধারণের কবি হাইনেকে ধরিয়ে দেয়নি। পুলিশ কবিতা না লিখতে পারে, কিন্তু পুলিশেরও তো মা থাকে।

মাতার উদ্দেশে লেখা হাইনের কবিতা অদ্বিতীয় বলার সাহস আমি না পেলেও বলব অতুলনীয়। এবং আশ্চর্য, কবিতাটি করুণ এবং মধুর সুরে রচা নয়। ভাষা অবশ্য অত্যন্ত সরল, কিন্তু মূল সুরে আছে দার্ট এবং দম্ভ। কাইজারের সঙ্গে প্রজা-মিত্র হাইনের ছিল কলহ- আমার মনে প্রশ্ন জাগে হাইনের সখা রজকিনী-সাধক চণ্ডীদাসকে কি মুকুটহীন কাইজার ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়নি এবং তাই তিনি কবিতা আরম্ভ করেছেন,

উচ্চশির উচ্চে রাখা অভ্যাস আমার
আমার প্রকৃতি জেনো অতীব কঠোর
রাজারো অবজ্ঞা দৃষ্টি পারে না তো মোর
দৃষ্টি কভু নত করে। কিন্তু মাগো—

 আর তার পর কী আকুলি-বিকুলি! তোমার সামনে, মা, আপনার থেকে মাথা নিচু হয়ে আসে। স্মরণে আসে, কত না অপরাধ করেছি, কত কিছু না করে তোমার পুণ্য হৃদয়কে বেদনা দিয়েছি বার বার। তার স্মৃতি আমাকে যে কী পীড়া দেয়, জানো মা?

সত্যেন দত্তের অনুবাদ তুলে দিতে ইচ্ছে করছে না, প্রত্যেক অনুতপ্ত জনের মতো আমারও মন আঁকুবাকু করে, হাইনে মাতৃমন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমিও আমার মাতৃমন্ত্র উচ্চারণ করে যাই।

কবিতাটির দ্বিতীয় ভাগে অন্য সুর।

তোমাকে ছেড়ে মা, মূর্খের মতো আমি গিয়েছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ভালোবাসার সন্ধানে। দোরে দোরে ভিখিরির মতো ভালোবাসার জন্য করেছি করাঘাত। আর পেয়েছি শুধু নিদারুণ ঘৃণা। তার পর যখন ক্ষত-বিক্ষত শ্লথ চরণে বাড়ি ফিরেছি তখন দোরের সামনে তুমি মা এগিয়ে এসেছ আমার দিকে

হার মানলুম। সত্যেন দত্তের অনুবাদটিই পড়ুন।

আশ্চর্য লাগে, এই হাইনে লোকটি সরল ভাষায় কী করে রুদ্র করুণ উভয় রসই তৈরি করতে জানতেন। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তার হাসি-কান্নায় মেলানো লেখাগুলো। তারই হ্রস্ব একটি শোনাবার জন্য দীর্ঘ এই ভূমিকা। আমি নিরুপায়। হায়, আমার তো সে শক্তি নেই যার কৃপায় লেখক মহাত্মাজনকেও স্বল্পে প্রকাশ করতে পারে।

সম্রাট ম্যাকসিমিলিয়নের কাহিনী বলতে গিয়ে হাইনে অনুতাপ করছেন, যে কাহিনীটি তার ভালো করে মনে নেই- অনেককালের কথা কি-না। আপসোস করে বলছেন, এসব জিনিস মানুষ সহজেই ভুলে যায় বিশেষ করে যখন তাকে প্রতি মাসে প্রফেসরের রোকা মাইনে দেওয়া হয় না, আপন ক্লাস-লেকচারের নোটবই থেকে মাঝে-মধ্যে পড়ে নিয়ে স্মৃতিটা ঝালিয়ে নেবার জন্য।

ম্যাকসিমিলিয়ন পাষাণ প্রাচীরের কঠিন কারাগারে। তাঁর আমীর-ওমরাহ, উজির-নাজির সবাই তাকে বর্জন করেছে। কেউ সামান্যতম চেষ্টা করছে না, তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার। কী ঘেন্নায়ই না ম্যাকসিমিলিয়ন তার গৌরবদিনের সেই পা-চাটা দলের কথা মাঝে মাঝে স্মরণ করেছিলেন।

এমন সময় সর্বাঙ্গ কম্বলে ঢেকে এসে ঢুকল কারাগারের নির্জন কক্ষে একটা লোক। কে এ? এক ঝটকায় কম্বল ছুঁড়ে ফেলে দিতেই সম্রাট দেখেন, এ যে রাজসভার ভাড়, সঙ, বিশ্বাসী কুন্স্ ফন্ ড্যার রোজেন। আশার বাণী, আত্মবিশ্বাসের মন্ত্র নিয়ে এল শেষটায় রাজসভার মূৰ্থ– সঙ কুনত্স!

ওঠো, মহারাজ, তোমার শৃখল ভাঙবার দিন এল। কারামুক্তির সময় এসেছে। নব-জীবন আরম্ভ হল। অমানিশি অতীত– ওই হেরো, বাইরে প্রথম ঊষার উদয়।

ওরে মূর্খ, ওরে আমার হাবা কুনৎস্! ভুল করেছিস রে, ভুল করেছিস। উজ্জ্বল খড়গ দেখে তুই ভেবেছিস সূর্য, আর যেটাকে তুই উষার লালিমা মনে করেছিস সে রক্ত।

না, মহারাজ, ওটা সূর্যই বটে, যদিও অসম্ভব সম্ভব হয়েছে– ওটা উদয় হচ্ছে পশ্চিমাকাশে–ছ হাজার বছর ধরে মানুষ এটাকে পুব দিকেই উঠতে দেখেছে–এখনও কি ওর সময় হয়নি যে একবার রাস্তা বদলে পশ্চিম দিকে উঠে দেখে কীরকম লাগে!

কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, বল দেখি তো হাবা আমার, তোর টুপিতে যে ছোট ছোট ঘুঙুর বাঁধা থাকত সেগুলো গেল কোথায়?

দুঃখের কথা তোলেন কেন, মহারাজ! আপনার দুর্দিনের কথা ভেবে ভেবে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ঘুঙুরগুলো খসে গেল; কিন্তু তাতে টুপির কোনও ক্ষতি হয়নি।

কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, ওরে মূর্খ, বল তো রে, বাইরে ও কিসের শব্দ? আস্তে, মহারাজ। কামার কারাগারের দরজা ভাঙছে। শীঘই আপনি আবার মুক্ত স্বাধীন হবেন– সম্রাট।

আমি কি সত্যই সম্রাট? হায়, শুধু রাজসভার মূর্খের মুখেই আমি এ-কথা শুনলুম।

ওরকম করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবেন না প্রভু! কারাগারের বিষের হাওয়া আপনাকে নির্জীব করে ফেলেছে। আপনি যখন আবার ম্রাট হবেন তখন ধমনিতে ধমনিতে অনুভব করবেন সেই বীর রাজ-রক্ত, আপনি আবার হবেন গর্বিত সম্রাট, দম্ভী সম্রাট। আবার হবেন দাক্ষিণ্যময় এবং আবার করবেন অন্যায় অবিচার, হাসিমুখে, এবং আবার হবেন নেমকহারাম রাজাবাদশাদের যা স্বভাব।

কুনৎস্ ফন্ ড্যার রোজেন, বল তো হাবা, আমি যখন আবার স্বাধীন হব, তখন তুই

কী করবি?

আমি আমার টুপিতে ফের ঘুঙুর সেলাই করব।

আর তোর বিশ্বস্ততা প্রভুভক্তির বদলে তোকে কী প্রতিদান, কী পুরস্কার দেব?

 আঃ। আমার দিলের বাদশাকে কী বলব! দয়া করে আমার ফাঁসির হুকুমটা দেবেন না।

এইখানে হাইনে তার গল্পটি শেষ করেছেন।

আমরা বলি হা হতোস্মি, হা হতোস্মি! রাজসভার ভাড়ই হোক, আর সঙই হোক, সভা-মূর্খ হোক আর পুণ্যশ্লোক গর্দভই হোক, কুনৎস্ বিলক্ষণ জানত, রাজারাজড়ার কৃতজ্ঞতাবোধ কতখানি!

কিন্তু কাহিনীর তাৎপর্য কী?

 হাইনে সেটি গল্পের মাঝখানেই বুনে দিয়েছেন। সে যুগের গল্পে দুটো ক্লাইমেকস চলত না বলে আমি সেটি শেষের-কবিতারূপে রেখে দিয়েছি।

হে পিতৃভূমি জর্মনি! হে আমার প্রিয় জর্মন জনগণ! আমি তোমাদের কুনস্ ফন ড্যার রোজেন। তার একমাত্র ধর্ম ছিল আনন্দ, যার কর্ম ছিল তোমাদের মঙ্গলদিনে তোমাদের আনন্দবর্ধন করা, তোমাদের দুর্দিনে কারা-প্রাচীর উল্লম্বন করে তোমাদের জন্য অভয়বাণী নিয়ে আসা। এই দেখ, আমার দীর্ঘ আচ্ছাদনের ভিতর লুকিয়ে এনেছি তোমার সুদৃঢ় রাজদণ্ড, তোমার সুন্দর রাজমুকুট- আমাকে স্মরণ করতে পারছ না, তুমি মহারাজ? আমি যদি তোমাকে মুক্ত না-ও করতে পারি। সান্ত্বনা তো অন্তত দিতে পারব। অন্তত তো তোমার কাছে এমন একজন আপন-জন রইল যে তোমার সঙ্গে তোমার দুঃখ-বেদনার কথা কইবে; তোমাকে আশার বাণী শোনাবে; যে তোমাকে ভালোবাসে; যার সর্বশেষ রসের কথা সর্বশেষ রক্তবিন্দু তোমারই সেবার জন্য। হে, আমার দেশবাসীগণ, তোমরাই তো প্রকৃত সম্রাট, তোমরাই তো দেশের প্রকৃত প্রভু। তোমাদের ইচ্ছা, এমনকি তোমাদের খেয়াল-খুশিই তো দেশের প্রকৃত শক্তি এ শক্তি বিধি-দত্ত রাজদণ্ডকে অনায়াসে পদদলিত করে! হতে পারে আজ তোমরা পদশৃঙ্খলিত, কারাগারে নিক্ষিপ্ত কিন্তু আর কত দিন? ওই হেরো, মুক্তির নব অৰুণোদয়!

***

হে বাঙালি, আজ তুমি দুর্দশার চরমে পৌঁছেছে।

কোথায় তোমার কুৎত্স ফ ড্যার রোজেন? যে তোমাকে আশার বাণী শোনাবে?

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *