ঔষধে মন মানে না
মৃত্তিকার ছোটবেলা কেটেছে লাভপুরে। বাবা সেচ দফতরে কাজ করতেন। বাবার অফিস ছিল বোলপুরে। কিন্তু বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় নিয়েছিলেন লাভপুরে। পরে ওখানেই জমি কিনে ওদের বাড়ি হয়। ছোটবেলায় বুঝত না, কিন্তু একটু বড় হতেই ও অনেকবার মাকে জিজ্ঞেস করেছে, কেন বোলপুরে ওদের বাড়ি হল না! মা বলত যে মা জানে না, কিন্তু একটু চাপাচাপি করলেই বেরিয়ে আসত আসল তথ্যটা। মৃত্তিকার বাবা মনে করতেন যে, বোলপুর বা শান্তিনিকেতনে থাকলে ছেলে-মেয়েরা মানুষ হয় না, বখে যায়।
বোলপুরে থাকলে ছেলে-মেয়েরা বখে যায়? কিংশুক হতভম্ব হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করত ওর বাবার ধারণা শুনে।
হ্যাঁ, বাবা মনে করে রবীন্দ্রনাথের গান গাইলে, কবিতা আবৃত্তি করলে মেয়েদের মন উড়ুউড়ু হয়ে যায়, তারা বিয়ে-থা করে ঠিকঠাক সংসার করতে পারে না, মৃত্তিকা মাথা একটু নিচু করে বলত।
আর ছেলেদের কী হয়?
ছেলেরা মেয়েলি হয়। নাচের দলে ভিড়ে ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’ করে, মৃত্তিকা নাচের ভঙ্গি করে দেখাত।
হেসে গড়িয়ে পড়ত কিংশুক। হাসতে হাসতেই বলত, তোমার বাবাকে দেখলে আমি কী বলতাম জানো? আপনাকে তো কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!
হ্যাঁ, বাবা তোমাকে উলটে আলুখেতে পেড়ে ফেলে বলদ চালিয়ে দিত তোমার ওপর দিয়ে।
কিংশুক চুপ করে যেত। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে আরও কাছে সরে এসে ওর কাঁধে মাথাটা রাখত। কিংশুকের মনে হত যেন সব ভার নেমে যাচ্ছে। এবার ও একটা ঘুড়ির মতো উড়ে যেতে পারবে যেখানে খুশি। চোখ বন্ধ করে ফেলত মৃত্তিকা। জিজ্ঞেস করত, তুমি চণ্ডীমঙ্গল পড়েছ?
কেন বলো তো?
না, ওই যে ফুল্লরা, কালকেতু…
যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এভাবে কিংশুক বলত, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই কালকেতু লোকটা শিকার করত তো?
সেই ফুল্লরার নামে একটা বড় মন্দির আছে আমাদের ওখানে। কত লোকে মানতের সুতো বেঁধে আসে।
তোমারও যাওয়ার ইচ্ছে?
ইচ্ছে তো। কিন্তু পঞ্চমুণ্ডির আসনের পাশেই যে-বটগাছ, সেটাতে বাঁধতে হয় অমাবস্যার রাতে।
তাতে কী হল?
আমার ভয় করে না বুঝি? ওই প্রায় গ্রাম এরিয়া, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, শেয়াল ডাকছে দূরে…
মৃত্তিকাকে থামিয়ে দিয়ে কিংশুক বলে, তো? তোমার বাবা তো পুলিশ।
মৃত্তিকা কিছু না বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওর সেই ঘুরিয়ে নেওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে কিংশুক দেখে দু’ফোঁটা জল টলটল করছে চোখে। সেই অশ্রুবিন্দু ওর গাল বেয়ে নামতে শুরু করলেই কিংশুক ঠোঁট দিয়ে তা তুলে নেয়!
পার্কে বসে পরস্পরকে আদর করতে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকারা অন্যদের খেয়াল করে না। স্বল্প সময়ের জন্য সবাই নিজেদের ঘিরে একটা নিরুদ্দেশ তৈরি করে নেয়। সেই নিরুদ্দেশের ভিতরেও একটা পঞ্চমুণ্ডির আসন আছে, অমাবস্যা আছে। মৃত্তিকাকে আদর করতে করতে কিংশুকের মনে হত ওর জিভ শুধু যে মৃত্তিকার জিভের সঙ্গেই জড়িয়ে যাচ্ছে তা নয়, জড়িয়ে যাচ্ছে মৃত্তিকার ভিতরের কোনও অমাবস্যার সঙ্গে যার হদিশ ও আগে পায়নি।
কিংশুকের যত্ন করে আদর করার ধরন ভাল লাগত মৃত্তিকার। দুটো পাহাড়ের মধ্যে উপত্যকার মতো দুটো চুম্বনের মাঝখানে ‘স্পেস’ তৈরি করতে জানত ও। সেই পরস্পরকে ছুঁয়েও আলগা থাকার মুহূর্তগুলোয় কিংশুকের গভীর দুটো চোখ ওর ভিতরের জটিলতাগুলো পড়ে নিতে চাইত। বুঝতে চাইত উদ্দাম একটা মেয়ের গোপন রূপান্তরের কারণ। মৃত্তিকা নির্লিপ্ত চোখে তাকাত সেই দৃষ্টিতে লুকোনো জিজ্ঞাসার দিকে…
মেসে কিংবা হস্টেলে থাকাকে মৃত্তিকার বাবা সন্দেহের চোখে দেখতেন বলে ইছাপুরে ওর পিসির বাড়িতে থাকত মৃত্তিকা। তাতে সুবিধেই হয়েছিল ওর। হস্টেল বা মেসে থাকতে হলে যেরকম কড়াকড়ির মধ্যে থাকতে হয়, এখানকার নিয়মকানুন তার তুলনায় অনেক নমনীয় ছিল। মৃত্তিকা যদি কোনওদিন ওর কোনও বন্ধুর বাড়িতে কিংবা হস্টেলে থেকে যাবে মনে করত, পিসিকে একটা ফোন করে দিলেই চলত। পিসির দুই মেয়েই বাইরে। একজনের বিলাসপুরে বিয়ে হয়েছে, আর একজন প্রেম করে কাছেই বিয়ে করেছিল, কিন্তু তার বর এয়ারফোর্সের ইঞ্জিনিয়ার, এখন রাজস্থানের কোনও প্রত্যন্তে এরোপ্লেনের ডানা সারাচ্ছে। পিসেমশাই রিটায়ার করে সারাদিন ঘরে লোক ডেকে এনে হাঁক পাড়েন, ‘মায়া, চা দিয়ে যা।’
মায়া এ-বাড়ির বহুদিনের কাজের লোক। একটু চেঁচিয়ে কথা বললেও মানুষটা ভাল। বলতে গেলে এই বাড়িতে মায়ারই হুকুম চলে। মৃত্তিকা হাসিমুখে আগ বাড়িয়ে সেই অধীনতা মেনে নিয়েছে বলে মায়ার সঙ্গে ওর নেহাতই সুসম্পর্ক। মাঝেমধ্যে পিসির মেয়েরা বেড়াতে এলে একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করে, তা নইলে ইছাপুর সত্যিই মৃত্তিকার ইচ্ছাপুর। ওর কোনও কাজে কেউ নাক গলাতে আসে না।
মৃত্তিকা সেই স্বাধীনতার কোনও সুযোগ নেয়নি। এমনকী কিংশুকের সঙ্গে আলাপের পরপরও নয়। মিথ্যে করে বলেছে যে, ওর বাবা পুলিশে বড় চাকরি করেন। এমন একটা ভাব দেখিয়েছে যেন কোনও শক্তিশালী টেলিস্কোপ ওকে পর্যবেক্ষণে রাখছে, একটু কক্ষচ্যুত হলেই ধুন্ধুমার বেধে যাবে। কিন্তু সেই বলার ভিতর দিয়ে ‘না’-এর চাইতে বড় হয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা ‘হ্যাঁ’। একটা যুদ্ধ, যেটা খোলাখুলি লড়ার সামর্থ্য ওর এই মুহূর্তে নেই।
কীসের যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে? মৃত্তিকার বাবা? নাকি কৃষ্ণগোপাল, যার সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আজ চার বছরের ওপর?
কলকাতার কলেজে ভরতি হওয়ার পর প্রথম মৃত্তিকা বাড়ি গিয়েছিল পুজোর ছুটিতে। তখনই ওর সঙ্গে দেখা হয় কৃষ্ণগোপালের, মানে দেখা করানো হয়। বাবার এক সময়ের সহকর্মীর ছেলে কৃষ্ণগোপাল তখন এমএসসি ফাইনাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পড়াশোনায় দুর্দান্ত, কিন্তু পড়াশোনা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে নেহাতই গাড়ল। তো সেই কৃষ্ণগোপালের সঙ্গে মৃত্তিকার বাবা নিজের বড় মেয়ের সম্বন্ধ করলেন। কৃষ্ণগোপালের বাবা সুধাংশুবাবুর মৃত্তিকাকে দেখে ভারী পছন্দ হয়ে গেল এবং উনি একটা সোনার চেন মৃত্তিকার গলায় পরিয়ে দিয়ে তখনই ব্যবস্থা পাকা করার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে রাখলেন।
মৃত্তিকা কিছু বুঝতেই পারছিল না। এত তাড়াহুড়ো, এত পাকাপাকি সব কী জন্য, ওর মাথাতেই আসছিল না। বিহ্বলতা ঝেড়ে ফেলে যখন ও ঘাড় বেঁকিয়ে বসল, তখনই রুদ্রমূর্তি দেখা গেল ওর বাবার। মৃত্তিকা বুঝতে পারল, এই বিয়েতে সম্মতি না দিলে আর কলকাতায় যেতে দেওয়া হবে না ওকে, চাই কী পড়াশোনা বন্ধ করিয়ে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হবে! সেসময় বলা ওর বাবার একটা কথা এখনও চাবুক মারে ওর সর্বাঙ্গে। ও বলেছিল, আমার কীই বা বয়স। আমি এখনই এত বড় অঙ্গীকার করতে যাব কেন? যদি এর চেয়েও ভাল ছেলে আসে আমার জীবনে?
মৃত্তিকার বাবা উত্তরে বললেন, ভাল ছেলেরা নিজেদের থেকে মেয়েদের কাছে যায় না। যারা যায়, তারা ভাল ছেলে নয়। অবশ্য তারা সেসব মেয়েদের কাছেই যায়, যারা অন্ধকারে গলিতে দাঁড়ায়। তুমি কি গলিতে দাঁড়াবে?
এত ঘেন্না হয়েছিল ওর যে ঠিক করেছিল, গলিতে গিয়ে দাঁড়াব তবু এই বাড়িতে আর নয়! কিন্তু কৃষ্ণগোপালের বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই গনগনে রাগের ওপরে একটা স্নিগ্ধতার প্রলেপ পড়েছিল। সেই স্নিগ্ধতায় স্নাত মৃত্তিকা একসময় সুধাংশুবাবুকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, আপনার ছেলের নাম কৃষ্ণগোপাল কেন?
সুধাংশুবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, আসলে ওর আগে আমাদের আর একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল, সে বাঁচেনি। ও হওয়ার আগে আমাদের ওখানকার কৃষ্ণগোপাল মন্দিরে আমার মা মানত করেছিল, ছেলে যদি সুস্থভাবে জন্মায়, তা হলে ঠাকুরের নামে নাম রাখবে। তাই…
মৃত্তিকার বাবা ওদের কথার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ওইরকম নামই তো ভাল। আমার মেয়ের অত ফ্যাশনেবল নাম আমি রাখতাম নাকি? আমার গিন্নির ছোটভাই কাব্যচর্চা-টর্চা করে, সেই ওরকম আঁতেলমার্কা একটা নাম রাখল, বুঝলেন?
সুধাংশুবাবু হেসে বললেন, মৃত্তিকা তো মাটি। মৃত্তিকা তো ফ্যাশনেবল নয়।
তারপর মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সদ্য-সদ্য কলেজে ঢুকেছ, আমি বুঝতে পারছি, তোমার মনের ভিতর কী চলছে। তুমি এসব কিছু মাথার ভিতরে ঢুকিয়ো না। পড়াশোনা করো, কৃষ্ণও ফাইনাল দিয়ে রিসার্চ করুক, আমরা তিন-চার বছর পরের একটা ঘটনার সূত্রপাত করে রাখলাম মাত্র।
মৃত্তিকা শুনল, আবার শুনল না। ওর মাথায় তখন অন্য অনেক জিনিস শুরু হয়ে গেছে। ও ভাবছে, এই যে তিন-চার বছর সময় পাবে এর মধ্যেই ওকে অন্য একটা পৃথিবীর ব্যবস্থা করে নিতে হবে নিজের জন্য। শিবাজি যেমন ফলের বাক্সর ভিতরে চেপে পালিয়ে গিয়েছিলেন, ওকেও তেমনি ওই তিন-চার বছর সময়ের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে যেতে হবে। ওই সময়টাই ওর অস্ত্র। নিজের পছন্দসই একটা জীবনের কাছে লুকিয়ে পৌঁছে যাওয়ার বাক্স।
কিন্তু হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা-পরীক্ষা-পুজো-ফ্যাশন সবকিছুর মধ্যে পাক খেতে খেতে ওর অন্য কোনও জীবনের কাছে পৌঁছোনোর স্বপ্নে জং ধরে গিয়েছিল। সেই উত্তরণ যেন নেহাতই একটা স্টেশন, যেখানে না নামলে পরের স্টেশনে নেমে যাওয়াই যাবে, এরকম একটা গয়ংগচ্ছ ভাবের শিকার হয়ে মৃত্তিকা কুর্তি আর জিন্সে যতটা মন দিল, অন্য কোনও সম্পর্ক তৈরি করায় ততটা নয়। কৃষ্ণগোপাল দিল্লিতে গেল রিসার্চ করতে। যাওয়ার আগে তিনদিন-চারদিন বেরোল ওরা। কেনাকাটি ঘোরাফেরা করতে করতে মৃত্তিকার মনে হল, এমন কিছু অসহ্য নয়! কৃষ্ণগোপাল অনেক গল্প করল ওর সঙ্গে। আরামবাগ থেকে বিষ্ণুপুর যাওয়ার পথে ওদের গ্রাম ধবলপুর, সেখানকার সব মন্দির কিংবা আটচালার টেরাকোটার কাজ কীরকম অননুকরণীয়, তাই নিয়েই বকে গেল ঝাড়া পনেরো মিনিট। মৃত্তিকা শুনতে শুনতে বলল, তাজমহলের ডিজাইন কি ওখান থেকেই চুরি করা হয়েছিল?
কৃষ্ণগোপাল কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল, মানে?
ব্যবহারিক জীবনের একটা মলম আছে। প্রাত্যহিক কাটা-ছেঁড়াকে সে নিজের মতো করে সামলে নেয়। মৃত্তিকার মনে হল যে, ও কৃষ্ণগোপালকে সামলে নিতে পারবে। লোকটা কেমিক্যাল বায়োলজির এত কিছু জানে, ওষুধ বানায়, যে-ওষুধ হয়তো কত কত মানুষের প্রাণ বাঁচাবে, শুধু জানে না কথা বলতে। সেটা কী এমন ঘাটতি?
কিছুই না। কিংশুককে যখন ওর ভাল লাগতে শুরু করেছে একটু একটু, তখনও কিছুই নয় বলেই মনে হত মৃত্তিকার। ও গোপন রাখতে চাইত ওদের দেখাসাক্ষাৎ, কারণ ও বিশ্বাস করত শেষমেশ কৃষ্ণগোপালই ওর গন্তব্য, ওর পরিণতি।
তা হলে তুমি কী করতে এসেছিলে আমার সঙ্গে? মস্তি? কিংশুক জিজ্ঞেস করল।
কিংশুককে সমস্ত কিছু জানানোর অভিঘাতে মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কান্না থামিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারিনি, বিশ্বাস করো। আমার তোমায় খুব ভাল লেগেছিল।
তাই আমাকে এই শাস্তি দিলে?
আমি তোমায় শাস্তি দেব বলে কিছু করিনি, শাস্তি কি আমি নিজেও পাচ্ছি না?
তোমার আবার কীসের শাস্তি! বড় সায়েন্টিস্ট তোমার বর, তুলোর বিছানায় রাখবে তোমাকে।
তুলোর বিছানা আর লোহার বিছানাতে কোনও ফারাক নেই। ফারাক তখনই হয়, যখন আমি লোকটাকে ভালবাসি। ভালবাসা ব্যাপারটাই এমন যে, মনে হয় তুলো দিয়ে মুড়ে রেখেছে, মৃত্তিকা বলল।
পাকা পেঁপের ভিতরে কাঁচা আমড়া? কিংশুক জিজ্ঞেস করল।
কী উলটোপালটা বকছ? মৃত্তিকা জিজ্ঞেস করল।
কিংশুক বিড়বিড় করে বলল, এ ছাড়া আর কীভাবে ভাবা যায় তোমার আর কৃষ্ণগোপালের সম্পর্কটাকে? গলা তুলে বলল, আমি তো উলটোপালটাই বকি।
চুপ করে গেল মৃত্তিকা। আলাপের কদিন পরে ফোন করে ও যখন কিংশুককে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে কেমন লাগল জানালেন না তো, কিংশুক চুপ করে ছিল।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মৃত্তিকা একই প্রশ্ন আবারও করল।
কিংশুক গম্ভীর গলায় বলল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয়।
কী বললেন? মৃত্তিকা হতভম্ব।
পৃথিবীতে যতগুলো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে, তাদের সত্তর-পঁচাত্তরভাগ গলার মালা কিংবা কোমরের মেখলার মতো প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে রয়েছে। আমেরিকার উপকূল থেকে জাপান হয়ে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত। এটাকেই বলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয়, কিংশুক থেমে থেমে বলল।
আমি আপনার কাছে ভূগোলের ক্লাস করব বলে ফোন করিনি, মৃত্তিকা বিরক্ত গলায় বলল।
আমিও আপনাকে ভূগোল পড়াচ্ছিলাম না। শুধু জানাচ্ছিলাম যে নামে প্রশান্ত হলেও ওই মহাসাগরের ভিতরে যেমন অনেক আগুন, নামে মৃত্তিকা হলেও আপনার ভেতরটা পুরো মার্বেল, কিংশুক বেশ জোরের সঙ্গে বলল।
জলের ভিতর পা ডুবিয়ে রাখলে কুমির যদি পা কেটে নিয়ে যায়, মানুষ নাকি কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারে না। মৃত্তিকাও বুঝতে পারল না, একটা অসহ্য ভাললাগায় কখন ওর ভিতরে ফিনকি দিয়ে রক্তপাত শুরু হল। যখন বুঝল, তখন সেই রক্তপাত থামানোর জন্য কিংশুককে আঁকড়ে ধরা ছাড়া ওর সামনে আর কোনও উপায় নেই। আঁকড়ে না ধরতে পারলে ও রক্তশূন্য, সাদা হয়ে মরে যেত এতক্ষণে। না মরে গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাকেই কি ‘মস্তি’ বলে?
ভাবছিল মৃত্তিকা। সন্ধের অন্ধকার যত ঘনই হোক না কেন, পাখিরা ঠিক বাসায় ফেরার রাস্তা পাবেই। কিন্তু ও কোথায় ফিরবে? কার কাছে?
তোমার হবু বর কী ওষুধ বানায়? কিংশুক খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল।
জানি না, মৃত্তিকা বলল।
আহা বলোই না! কিংশুকের গলায় দুষ্টুমি।
মৃত্তিকা মনে মনে বলল, ও তোমার মতো কথা দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে পারে না কিংশুক। যে-কাঁপনে হিম ধরে না, যে-দৃষ্টিহীনতায় ঝাপসা লাগে না চারপাশ, সেই কাঁপন, সেই অন্ধত্বের কোনও ওষুধ ওর কাছে নেই। মুখে বলল, আমি অন্য কোথাও, অন্য কারও কাছে চলে যাব। তোমার ভাল লাগবে?
একেবারেই লাগবে না। ভাল কি লাগে?
তা হলে তুমি এত শান্ত আছ কী করে?
কারণ এই পরিস্থিতিতে আমি একমাত্র শান্ত থাকতেই পারি!
আমি পারছি না কিছুতেই। বলতে-বলতে মৃত্তিকা কিংশুকের ডান হাতটা টেনে নিয়ে ওর বুকের বাঁ দিকে রাখল। কিংশুকের মনে হল আগুন প্রশান্ত মহাসাগরের ভিতর থেকে বাইরে আসতে চাইছে।
মৃত্তিকা বলল, আমাদের বাড়ির পোষা মুরগিগুলো জংলি কুকুর ঝোপঝাড় থেকে ধেয়ে এলে লুকিয়ে পড়ত এধার ওধার। কিন্তু বাবা যখন হাতে করে গমের দানা নিয়ে এগিয়ে যেত, ওরা ছুটে আসত, উৎসাহে, আনন্দে। বুঝতেও পারত না খাওয়াতে খাওয়াতেই মটাত করে ঘাড়টা ভেঙে দেবে বাবা।
কী হয়েছে তোমার? কিংশুক নরম গলায় বলল।
ওইরকমভাবে গমের দানা হাতে নিয়ে ভালবাসা এল, জানো তো! যদি জংলি কুকুর হয়ে আসত, আমি লুকিয়ে পড়তাম ঠিক, কিন্তু… মৃত্তিকা কাঁদতে শুরু করল আবার।
কিংশুক ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে টেনে তুলল মৃত্তিকাকে।
চলো তোমার পিসির বাড়িতে যাব আজ।
মৃত্তিকা অবাক হয়ে বলল, কৃষ্ণর আজ আসার কথা। আমি কী রেফারেন্স দেব তোমার?
তোমার স্যার, তোমার সিনিয়র, যা খুশি। চলো, চলো।
মৃত্তিকা একটু দমে গিয়ে বলল, তুমি কি আজই কৃষ্ণগোপালকে সব বলে দেবে?
হ্যাঁ বলব, আমি ব্যাধ কালকেতু আর ইনিই আমার স্ত্রী ফুল্লরা।
ইয়ারকি মেরো না। বলো না কী বলবে? মৃত্তিকা পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে চুমু খেল কিংশুকের গালে।
বড় বড় ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ভরতি পার্কে সান্ধ্য-গার্ডরা বেরিয়ে পড়েছিল জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকাদের বিদেয় করতে। কিংশুক ওদের হুইসলের শব্দ শুনতে পেয়ে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল মৃত্তিকাকে। বলল, আমার বিশ্বাস বেশি কিছু বলতে হবে না। উনি আমাদের একসঙ্গে দেখলেই বুঝবেন।