ষোলো
বনবিভাগের বিট মার্শাল : দুজন পোচারের বডি পড়ে আছে স্যার ।
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : দেখে তো পোচার মনে হচ্ছে না । টিম্বার মাফিয়ার এজেন্ট শালারা, নিশ্চই ।
বনবিভাগের বিট মার্শাল : টিম্বার মাফিয়ার এজেন্টদের আমি চিনি স্যার । এরা বাইরের লোক । কী করে ওখানে গিয়ে পড়ল ? বেঁচে আছে না মরে গেছে !
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : কেন মিছিমিছি নিজের বিপদ ডেকে আনছ । যা রেগুলার রিপোর্টিং তাই রেকর্ড করে দিও ।
বনবিভাগের বিট মার্শাল : ব্যাস স্যার, কুরুসনার ছেড়ে অনেকটা চলে এসেছি, আর ভেতরে যাওয়া সুবিধার নয়।
বনবিভাগের রেঞ্জ অ্যাসিস্ট্যান্ট : চলো ।
.
সতেরো
রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি; সুশান্তজেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি । তুই মিশনের গেটের কাছে পৌঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি । নারায়ণপুরে নেটওয়র্ক তত ভালো কাজ করে না । ছেলেটা রেসপণ্ড করে ওর নাম বলবে বীরবল মাড়িয়া । হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলনডার মোটর সাইকেলে আসবে । ও তোকে নমস্তে ইতু দিদি বললে কোনো বাক্যব্যায় না করে পিলিয়নে বসে পড়িস । ও তোকে যেখানে পোঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ । চিন্তা করিসনি না, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।
বাসডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল । কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল যাত্রীদের চোখ এড়িয়ে । বলেছিল, আর দেখা হবে না, জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি । উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময় থেকে কাট-অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল । সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাদের ভুলে যা । গেট রিড অফ অলল মেমরিজ ।
ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর ঝোলা । রায়পুরে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে ।
যে-বাসটায় চেপেছিল সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস । কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে । স্কুলের অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রির কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিল । মাসের শেষে টাকা নেবে । প্যাসেঞ্জারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা-সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, মল, মাল্টিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও । ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না ।
বাস থেকে নেমে হাতেটানা রিকশয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু ।
নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল ; উফ, ফেরোমোন । মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলাল । কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যাণ্ডল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই । ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে । ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ।
যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হল । ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায় ।
–না দিদি, দান্তেশ্বরী হল বস্তারের দেবী । নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হল কাকসার । বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে । উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনো পালটা প্রশ্ন করল না ইতু । নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ, এ কোন মেঘনাদ, রামায়ণের মেঘনাদ, যে মেঘনাদকে নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাকাব্য লিখেছিলেন ?
যুবকটি বলল, আমার নাম বীরবল মাড়িয়া নয়, আমার ট্রাইবের নাম ওটা । অবুঝমাড়ে দুজাতের গোঁড় থাকে, মাড়িয়া গোঁড় আর মুরিয়া গোঁড় । শহরের লোকেরা মনে করে অবুঝমাড় মানে যে জায়গাকে এখনও জানা হয়ে ওঠেনি । ঠিকই, অবুঝমাড়কে কেউ জানে না । কিন্তু তা অবুঝমাড়ের মানে নয় । মাড় একরকমের শেকড় ।
–ও, বলল ইতু, ভাবল রোদ বাঁচাতে মাথায় গামছা চাপা দেবে কিনা । নাঃ, এখন থেকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড় যা-ই হোক, কোনো কিছুর দ্বারা পরাস্ত হলে চলবে না । সহ্য করবে । সহ্য করবেই । সহ্য করতে হবে । ছেলেটিকে বলল, তুমি সামনে দিকে তাকিয়ে চালাও, যা রাস্তার অবস্হা ।
এভাবে কখনও বাইরে-দূরে বেরোয়নি ও, ইতু । সঙ্গে টুথব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে, সাবান অবশ্যই নিত, বাবা-মার সঙ্গে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার সময় । বটঠাকুমা বড়দাদু ইউরোপে বেড়াতে যাবার সময়, সেখানে টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে হবে শুনে, সঙ্গে একটা প্লাসটিকের মগ নিয়েছিলেন । ও কী করবে, কোথায়ই বা করবে ?
–জানেন, এখানে কেউ আসে না , বেশ দূরে-দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার হাজার একর জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই বীরবল মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না, জানেই না সরকারি আফসররা । কেন বলুন তো ? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি, সেনসাস হয়নি । রিপোর্টাররাও বস্তার যেতে চায়, নারায়ণপুরে আসতে চায় না, তাই আমার রোজগার তেমন হয় না । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হল অবুঝমাড় । আপনাকে এ-সব বলছি কেন বলুন তো ? যিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি বলেছেন যে আপনাকে জায়গাটার ছবি বুঝিয়ে দিতে ।
–ও, আচ্ছা । মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল ইতু । তারপর নিজের মোবাইলটা বীরবল মাড়িয়ার হিপ পকেটে ঢুকিয়ে বলল, যিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে দিতে ।
–হ্যাঁ, আচ্ছা, ঠিক আছে । অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর মাওওয়াদিরা । গ্রামের লোকেদের সঙ্গে মাওওয়াদিরা মেশার চেষ্টা করে । সিপাহি জওয়ানরা এড়িয়ে চলে । আপনাদের শহরের ভিখমাংগা বস্তির চেয়েও বদতর এখানকার জীবন । বিজলি নেই, খাবার জল নেই, স্কুল নেই, ডাক্তার-বইদ নেই, কারোর কিছু হলে চিকিৎসার কোনো উপায় নেই, তা সে আধামিলিট্রি জওয়ান হোক বা মাওওয়াদি জওয়ান, গ্রামের লোকেদের কথা তো ছেড়েই দিন, ওরা জানেই না কাকে ডাক্তার বলে, হাসপাতাল বলে । আফ্রিকাতেও এরকম গয়াগুজরা এলাকা পাবেন না । তবে, শ্বাস নিয়ে, বলল বীরবল মাড়িয়া, শহর মানেই তো চাপা দুর্গন্ধের ম্যানহোল ; যতো বড়ো শহর, তত বেশি ম্যানহোল । এখানের আকাশে যেমন রাতের তারা, আপনাদের শহরে তেমন মাটিতে পাতা ম্যানহোল ।
ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম ? বাড়িতে কী ভালো ছিলুম না ? কত বাঙালি বাড়িতেই তো অবিবাহিতা মেয়েরা থাকে যারা সকলের অবহেলায় অবরে-সবরে মুখঝামটা খেয়ে তাদের মাঝে বসবাস করে ক্রমশ ন্যাড়ামাথা বুড়ি হয়ে যায়, স্বজনদের বাচ্চা হলে তাদের সঙ্গে খেলে, সময় কাটায়, বাড়িতে কোনো উৎসব হলে সে-ই খাটাখাটুনি করে, আর অতিথি অভ্যাগতদের সাবাশি পায়, অসুস্হ হয়ে সিঁড়ির তলায় চটে বা সতরঞ্চিতে শুয়ে মরে ভুত হয়ে যায় । নাঃ, একেবারে ভালো ছিলুম না, তার কারণ কোনো কাজই নিজের জন্য করছিলুম না, শুধু বেগার খাটছিলুম । এবার নিজের জন্য কিছু করব । যা হবার হোকগে, সিআরপিএফ-এর গুলি খেয়ে, না খেতে পেয়ে, মাওওয়াদিদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে, গ্রামবাসীদের সন্তুষ্ট করতে না পেরে, মরে যেতে হলে মরে যাবো, নিজের জন্য তো মরব । ছেলেটিকে বলল, তুমি চুপ করে গেলে কেন, বেশ ভালোই তো লাগছে শুনতে ।
–কুরসুনার গ্রাম এসে গেল তো, তাই । যে অনজান দুনিয়ায় আপনি ঢুকতে চলেছেন, এই গ্রাম হল তার প্রবেশপথ । ভারত সরকার বলুন, ছত্তিশগড় সরকার বলুন, এখান পর্যন্তই তারা ছিল, অপারেশান হাক্কার পরে কিছুটা বদলালেও, মানুষের মনের ভেতরটা বদলাতে অনেক সময় লাগে । ওই যে স্কুল বিল্ডিং দেখছেন, ওখানে আগে আধামিলিট্রি জওয়ানরা থাকত, তাই স্কুলটা চলে গেছে, ওই যে, ওখানে যে চালাঘর দেখতে পাচ্ছেন, ওখানে । আসলে স্কুলটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাড়িয়াদের আৎমা, পূর্ণিমার দিন যদি আসেন, তাহলে নিজের চোখে দেখতে পাবেন যে স্কুলটা একটু-একটু করে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে । নতুন স্কুল বিল্ডিংটা পুরো তৈরি হয়নি, অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে । মাওওয়াদিরা নাকি ঠিকেদারকে এমন হুমকি দিয়েছিল যে সে প্রাণ বাঁচিয়ে ভাগলবা । তা নয়, আসলে মাড়িয়াদের আৎমা ঠিকেদারকে বলেছিল যে চলে যাও, নয়ত গুলি খেয়ে মরবে । তবে মাওওয়াদিরা ঠিকেদারের ট্র্যাক্টরটাও কেড়ে নিয়েছিল । ট্র্যাক্টর নিয়ে মাওওয়াদিরা কী করবে জানি না ; এরপর তো ট্র্যাক্টর চালাবার মতন রাস্তা পাহাড় শুরু হবার আগে পর্যন্ত, তারপর ছাগল-গরু চরাবার সরু হাঁটা-পথ ।
কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, ছেলেটি বলা বজায় রাখল । অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে মাওওয়াদিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক-কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়, ওদের কামচলাউ ডাক্তার আছে, আনপঢ়, সে কি আর ডাইনদের সঙ্গে পারে, বলুন । কুরুসনার আধামিলিট্রি ভুতাহা ক্যাম্প দেখলেন, ওখানে একবার হামলা চালিয়েছিল মাওওয়াদিরা ; যারা চালিয়েছিল তারা আন্ধ্রার, এখানকার জঙ্গলে তাদের দুজনের শরীর এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা আন্ধ্রার আদিলাবাদে গিয়ে সারেনডার করেছিল, তাও লোকটার বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ, নাম ছিল রায়সিদম জাওয়েন্দ্রা রাও উর্ফ লালচন্দ, মেয়েটার বয়স আরো কম, তিরিশ বছর, নাম ছিল কোনগাতি করুণা উর্ফ লতা । মাওওয়াদিরা নিজের বড়ো-বড়ো নাম বদলে নিয়ে ছোটো করে ফ্যালে, অন্য নাম নিয়ে নেয়, নিজের মা-বাপের আদর করে দেয়া নামকে কেন ওদের বন্দুকবাজির সঙ্গে জড়াবে, বলুন ? অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা হালউই ভাষায় কথা বলে ; ওরা ছত্তিশগড়িয়া, হিন্দি, তেলেগু কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না, বললে বুঝতেও পারে না ।
–তুমি তো ভালই হিন্দি বলছ ।
–আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পড়েছিলুম ।
–ছেড়ে দিলে কেন ?
–আধামিলিট্রিরা আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল আমার মা নাকি মাওওয়াদিদের চর । মাওওয়াদিরাও ভেবেছিল আমার মা নিশ্চই সরকারের চর, নয়তো কেন্দ্রীয় রিজর্ভ পুলিশ বলের ক্যাম্পে কেন গেছে । একবার দু-পার্টির গুলিগোলা চলার সময় মায়ের গায়ে গুলি লাগে । সরকার বলেছিল মাওওয়াদিদের গুলিতে মরেছে । মাওওয়াদিরা বলেছিল, আধামিলিট্রির গুলিতে মরেছে। মা মরে যেতে আমি এক লাখ টাকা মুয়াবজা পেয়েছিলুম, সেই টাকা থেকেই তো এই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মোটর সাইকেলটা কিনেছি । আপনাদের মতন প্যাসেঞ্জারদের নানা জায়গায় নিয়ে যাই, নিয়ে আসি, তা থেকেই সংসার চলে যায় । আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না , আপনার ভাড়ার টাকা আমি কালকেই পেয়ে গেছি ।
–তোমার বাড়িতে কে আছে ?
–বাবা আছে, দিনভর মদ খেয়ে পড়ে থাকে, সালফি মদ, এতো নেশা হয় যে লোকে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় ; ওরকম মদখোরকে কে-ই বা বিয়ে করবে, বলুন, লোকটা যদি সারাদিন আকাশে উড়তে থাকে তাহলে কোনো মেয়েই আসবে না, বৃষ্টি না পড়লে কী করেই বা আকাশ থেকে নামাবে, বলুন । বৃষ্টি শুরু হলে পেণ্ডা খেতি করবে, না নিজের আদমিকে আকাশ থেকে নামাতে ছুটবে । বাবা আমাকেই বলছিল বিয়ে করে নিতে । দুটো ছোটো-ছোটো বোন আছে, তাদের দেখাশোনা করব, বিয়ে দেব, তবে তো আমি বিয়ে করব, কি না ?
–বিয়ে করলে আমায় ডেকো ।
–হ্যাঁ, ডাকব, সে তো এখন অনেক দেরি, দেখুন আপনি কতদিন অবুঝমাড়ে টিকতে পারেন । টিকতে হলে সালফি খেতে হবে ; নোংরা জলের চেয়ে সালফি খাওয়া ভালো, সকাল হবার আগেই খেয়ে নেবেন, সকালের সালফি খেলে আকাশ তাকে নেয় না । সকালের পর সালফি মেঘ হয়ে যায় ।
–সালফি ?
–হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকম মদ । তালগাছ বা খেজুরগাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো , যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বেরোয়, তেমন করে বের করে গ্রামের লোকেরা । তালের রস পচলে তাড়ি হয়, তেমনই সালফির রস চব্বিশ ঘণ্টার পর সাদা রঙের মেঘ হয়ে যায় । তবে মাওওয়াদিরা হুকুম জারি করে মাড় বাজারে গুটকা, গুড়াকু, বিড়ি, সিগারেট, সালফি বিক্রি বন্ধের কাগজ সেঁটেছে। ওরা যদি কাউকে খেতে দ্যাখে তাহলে তাকে একশো টাকা জরিমানা করে । জরিমানার টাকাটা মাওওয়াদিদের ওষুধ কেনার কাজে লাগায় । বাতের আর গা-হাতপা ব্যথার রোগ খুব হয় অবুঝমাড়ে । আমরা তাই বিয়ার বাহুতি পোকা থেকে তেল বের করে বাড়িতে রাখি । যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তারা ওগুলো শুকিয়ে খায় । নারায়ণপুর বাজারে কিনতে পাবেন ।
–কী পোকা ? কী করকম দেখতে ?
–বিয়ার বাহেতি, লাল টকটকে । সরকারি আফসাররা বলে রেড ভেলভেট মাইট ।
–ওঃ, ট্রমবিডাইডা পোকা । হ্যাঁ, ওর তেলকে হিন্দিতে তিজ বলে, বাতে বা প্যারালিসিসে ব্যবহার করে আয়ুর্বেদিক ডাক্তাররা ।
গাঁয়ের লোকেরা পোকাগুলো শুকিয়ে ইনডিয়ান ভায়াগ্রা হিসেবে খায়, তা জানে ইতু, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিনের কোর্সে । পুরুষ পাখিরাও বসন্তঋতুতে খায় পোকাগুলো, প্রজননের জন্য ।
–এর পর আমাদের হাঁটতে হবে ।
–এত ভারি মোটর সাইকেল ঠেলে হাঁটবে কী করে ?
–না, কাছে আধামিলিট্রি চেকপোস্ট আছে ; তারা আপনাকে আমার সঙ্গে দেখে ফেললে যেতে দেবে না । আপনি চুপচাপ এগিয়ে চলে যান, আমি মোটর সাইকেল একটু পরে স্টার্ট দিয়ে আসব ।
পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেরুমাটির পথ আরম্ভ হল, গরুর গাড়ি বা ট্র্যাক্টর চলার মতন চওড়া কাঁচা রাস্তা। শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী পেরোবার পর বীরবল মাড়িয়া মোটর সাইকেল চালিয়ে এলে ইতু বসে পড়ল পিলিয়নে । বীরবলের পেট আরও ঘেমেছে, কিন্তু উপায় নেই । দু’পাশে শালগাছের সারি, যাক, ছায়া পাওয়া গেল এতক্ষণে, জংলি জঙ্গলের জংলা ঝাউ । কই, ল্যাণ্ডমাইন, বোমাফাঁদ, মাওওয়াদি, আদিবাসী, কিছুরই তো দেখা নেই । গাছগাছালির রংছড়ানো সৌন্দর্য্যে বেশ খাপছাড়া, লেবুসবুজ পাতাগুলো বনের আশ মেটাতে পারছে না । কোনো গ্রামে পৌঁছোল ওরা, পাটনা শহরে গঙ্গায় যাবার ঘাটের দুধারের ভিকিরিদের ঝোপড়ির মতন কুঁড়েঘর, একটা থেকে আরেকটা বেশ দূরে-দূরে।
–ওগুলো কী ? ঢিবিগুলো । রঙিন কাপড়ে উড়ছে ? একটায় শার্টও ঝোলানো রয়েছে । ইতু জিগ্যেস করল বীরবল মাড়িয়াকে, কয়েকটা ঢিবির দিকে আঙুল দেখিয়ে ।
আঙুল দেখাবেন না, আঙুল দেখাবেন না, আৎমার অপমান হবে । ওগুলো মাড়িয়াদের কবর । কোনো আত্মীয় আৎমার শান্তির জন্য কাপড়ের টুকরো বেঁধে গেছে, কাপড়গুলো অমাবসের রাকছসদের থেকে আৎমাদের রক্ষা করে । বলল বীরবল মাড়িয়া ।
লোহার তোরণের মত দেখতে একটা জায়গায় থামল বীরবল । তোরণের ওপরের টিনে সবুজ রঙের ওপর সাদা রঙে হিন্দিতে লেখা রয়েছে, ভারতীয় সেনা ওয়াপস যাও, বস্তরওয়াসী বাহরি নহিঁ হ্যাঁয় । জঙ মত লড়ো । টিনের সাইনবোর্ডের পেছনে লেখা, বস্তরকে য়ুবায়োঁ, সরকার কে নাজায়জ জঙ কে খিলাফ জনয়ুধ মেঁ শামিল হো জাও ।
মোটর সাইকেল থামিয়ে বাক্সে রাখা একটা কাঁধে ঝোলাবার ব্যাগ বের করে ইতুর দিকে এগিয়ে দিল বীরবল, ইতু বলল, আমার কাছে তো রয়েছে কাঁধে ঝোলাবার থলে ।
বীরবল মাড়িয়া বলল, আপনার ঝোলাটা এই কাঁধব্যাগে ঢুকিয়ে নিন, এটায় ডাক্তারের ক্রস চিহ্ণ আঁকা আছে । আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ডাক্তারের লাল ক্রস চিহ্ণ আঁকা ঝোলাটা দিই আপনাকে । নিজের ঝোলাটা বীরবলের দেয়া ঝোলায় পুরে নিল ইতু । থ্যাংকস জানিয়ে জিগ্যেস করল, ওই চালাঘরটার ছায়ায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসা যায় কি ?
–ওটা র্যাশানের দোকান ছিল । যে লোকটা চালাত সে ছিল বস্তারের গোঁড় , মাওওয়াদিদের আৎমার ভয়ে দোকান তুলে দিয়ে, নারায়ণপুরে চলে গেছে, মরে গেলে মাওওয়াদিরা তাদের আৎমাকে এই জঙ্গলে ছেড়ে যায় । আগে র্যাশানের কাজ রামকৃষ্ণ মিশন করত । সরকার ওদের হাত থেকে নিয়ে দোকানদারদের হাতে দেবার পর চালাতে না পেরে আবার রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়েছে ; মিশনের পাঁচটা সেন্টার আছে অবুঝমাড়ে । আসলে দোকানদাররা গড়বড়ি করে টাকা বানাতো র্যাশান থেকে, ভাবতো যে গোঁড়-মাড়িয়ারা তো জংলি, ওদের নিয়মমত র্যাশান না দিলে টের পাবে না, গোঁড়-মাড়িয়ারা তো আর জানে না যে কত র্যাশান ওরা পায় । কিন্তু মাওওয়াদিরা দোকানদারদের গড়বড়ি ধরে ফেলেছিল । হুমকি খেয়ে কেউই আর দোকান চালাবার সাহস করেনি । র্যাশান মানে পঁয়ত্রিশ কিলো চাল আর কেরোসিন তেল ।
ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে বীরবল বলল চলুন, আরেকটু এগিয়ে দিই ।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নিচুছাদ চালাঘরের গ্রামের মতন একটা জায়গায় পোঁছোলো ইতু আর বীরবল মাড়িয়া । উলঙ্গ বাচ্চারা খেলা করছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়ত কখনও, স্নান করেনি । শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুকঢাকা পোশাক পরে । কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা ; বৃন্দাবনের বিধবাদের অনেকে এরকমই শিড়িঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন গিয়েছিল, তখন দেখেছিল ইতু । লোকগুলোর কোনো আগ্রহ হল না ওদের উপস্হিতিতে, সম্পূর্ণ উদাসীন , যেন সত্যিই আকাশে ভেসে রয়েছে । ওদের মধ্যে একজন যুবকও ছিল, তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বীরবল গোঁড় মাড়িয়া ভাষায় কথা বলল । ইতুর দিকে ফিরে বলল, এর পরের গ্রামে যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে । ওরাও এ গ্রামের নয়, কুরুসনারে গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে । এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে মাওওয়াদিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে ।
বড় ধাপ থেকে ছোটো হতে থাকা সিঁড়ির মতন ওঠা লাল আর সাদা কয়েকটা স্তুপের দিকে ইশারা করে বীরবল মাড়িয়া বলল, ওগুলো শহিদ-বেদি ; যারা আধামিলিট্রির গুলিতে মারা গেছে তাদের ইয়াদগারে বানানো, বেশিরভাগ বেদি আসলে সমাধি, দেখছেন না বেদির ওপরে টিনের কাস্তে-হাতুড়ি । ইতু নিজেকে বলল, এখানে তার মানে ইঁট, বালি, সিমেন্ট এনে ঘর তোলা যায় ; জায়গাটাকে দুর্ভেদ্য করে না রাখলে হয়ত গ্রামের লোকেরা পাকা আস্তানা তৈরি করতে পারত, যেমন অন্য প্রদেশের আদিবাসীদের বাড়িগুলো ।
মায়ের বাবা-মা, মানে দাদু-দিদা, বেঁচে থাকতে, ছোটোবেলায়, একবার বাবার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল ইতু ; সেখানে পাড়ার রাস্তায় ওইরকমই, কিন্তু ছোটো মাপের, কয়েকটা ক্ষয়ে-যাওয়া ইঁটদেঁতো বেদি দেখতে পেয়ে জানতে চাইলে, দাদু বলেছিলেন, ওগুলো শহিদ বেদি, যারা বসিয়েছে তারা নিজেদের, আর যে মারা গেছে তাকে, বোকা বানাবার স্মৃতিকে জিইয়ে রেখেছে । আজকে দাদুর বলা কথাটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল ও, ইতু ।
মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর ক্ষতি ছিল কোনো, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু । এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, এখনও এরা কলাকৌশলের ইঁদুরকলে আটকে পড়েনি, এখনও এরা ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক ; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু । সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে তত বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহুরে মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে । মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইল না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে । বোধহয় এটা মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য । সভ্যতা যত সভ্যতর হয়ে চলেছে ততই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ । এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কিসে তাদের আনন্দ । সভ্যতা হয়তো মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে । মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে বা আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক । কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই । দেখি কী হয় । অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, তাহলেই যথেষ্ট ।
ইতুর দোভাষীর কাজ চালিয়ে বীরবল বলল, যুবকটির নাম হরিয়া, ও বলছে যে ওর কোনো কিছুরই দরকার নেই, সবই আছে, রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসলে, পঁয়ত্রিশ কিলো চাল নিয়ে আসে । এক টাকা কিলো চাল কিনতে অসুবিধা হয়না, শুয়োরবাচ্চা , মুরগি, মুরগির ডিম, মহুয়ার ফুল বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা হয়ে যায় মাসে । রামকৃষ্ণ মিশনের লোকেরা আসার আগে খবর পাঠিয়ে দেয় ।
গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হল । অঝোর বৃষ্টিতে খসে-পড়া পাথরকে সিঁড়ির মতন সাজিয়ে নেয়া হয়েছে । দুপাশে নানা রকমের চেনা-অচেনা গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর । তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, বিকেল হয়ে গেছে । আপনি আগে যে গ্রাম পাবেন সেখানে অপেক্ষা করুন কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে এগিয়ে যান, আরেকটা বড় গ্রাম আসবে , আমার সেরকমটাই মনে আছে, কয়েক বছর আগে গিয়েছিলুম তো । অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালাগুলো সাপ হয়ে যায়, নানা রকমের সাপ, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার ; আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে । টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয় ।
–সে কি, তুমি যাবে না ? ইতু বুঝতে পারল যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনী খাচ্ছিল । এবার ওকে আত্মনির্ভর হয়ে নির্ণয় নিয়ে এগোতে হবে । কারোর ঘাড়ে চাপার জন্য তো ও বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি । কিছুক্ষণেই সূর্য অস্ত যাবে । একা-একা কী করব এখানে । চিনি না, জানি না কাউকে।
–না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না । মাড়িয়া গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে । জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না । যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন ।
ইতু হাত তুলে ফির মিলুংগি জানিয়ে এগোলো বনের পথ ধরে । বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিন্স খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিল । অবিরাম হাঁটার দরুণ প্যাণ্টির ঘষা লাগছিল কুঁচকিতে । ওহ, কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি-বসানো ঘন-সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দু’হাত মেলে জন্মেছিল । টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল । সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে এসে সবচে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ।
বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখল, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুন জ্বালা করছিল । একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি-জ্বালায় লাগিয়ে নিল ।
বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে । দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউ…, আমি ইতান…, পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন… । দুদিকে দুহাত মেলে দিয়ে, আবার চেঁচালো, আমি ইতু…, আমি আদিমানবী…, আমি ইতু…আমি ইতু…আমি ইতুউউউউ…।
শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখল, একটা কাঠবিড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপর বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি । কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেলে, জুতো আর পোশাক পরে নিল, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে । হালকা হয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না আর । এটা জঙ্গল, না বনানীর ধ্বংসাবশেষ, কেমন যেন ছড়ানো-ছেতরানো !
সোফানরম শুকনো-পচা পাতার ওপর হাঁটতে-হাঁটতে ইতুর মনে হল এই জায়গাটা তো ওর চেনা । ওই তো ডুমুর গাছে থোকা-থোকা পাকা ডুমুর হয়ে রয়েছে, পায়ের কাছে বনপথের পাশে-পাশে ঘৃতকুমারীর জঙ্গল, ঘৃতকুমারী, যা এখন কতো দাম দিয়ে কেনে পাবলিক, বহেড়া গাছ, অশোকফুল গোছা-গোছা, ভরাঙ্গিপাতা, ডেভিলস কটন বা উলটকম্বলের গাছ, ইগল উড বা অগরু গাছ, আরে, এলিফ্যাণ্ট ক্রিপার বা সমুদ্রাশোক, সুগন্ধমূল বা গ্রেটার গলাঙ্গল, উইনটার চেরি যাকে সিলেবাসে অশ্বগন্ধা বলা হতো, কত পরিচিত গাছ-গাছড়া, পাটনায় পেতুম শুকনো, কবে কোথা থেকে অশোক রাজপথের ইউনানি দোকানে আসত কে জানে । এখানে দিব্বি রয়েছে অবহেলার ঐশ্বর্যে ঝিলমিলিয়ে, শিশি-বোতল-বয়ামের বাইরে মাথা তুলে, হাতপা ছড়িয়ে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায় , জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজানো ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে উঠে আসছিল। ওপর থেকে ঝরঝর করে কয়েকটা শুকনো ফুল ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেল যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে ? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত । বলেছিল হাঁটতে থেকো যতটা পারো । পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে । তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল । সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে ।
ঘুম ভাঙতে, দেখল, অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয় । জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হল সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম, মাংসল । দ্রুত হাত সরিয়ে নিল । কী করবে ? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে ! কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে । হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁহাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, সাপের গায়ে ঠেকল, ঠাণ্ডা । সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল । বুঝতে পারল যে যা ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক ।
হঠাৎ ওর মুখের ওপর সরু নিয়ন আলো পড়তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল । কোনো ময়ালের চোখ ?
আওয়াজ আর কন্ঠস্বর শুনে সন্দিগ্ধ ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল ইতু । ভাল্লুক ? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, আঁচ করল ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী । প্রত্যেকের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, জওয়ানদের কাঁধে ঝুলতে দেখেছে অমন অস্ত্র । আধামিলিট্রি জওয়ান নয়তো ? একজন যুবতী রয়েছে যখন তার মানে এরা সি আর পি এফ জওয়ান নয় বলেই মনে হচ্ছে । যুবতী তো খোঁপাও বেঁধেছে, চুলে তেল দেয় নিশ্চয়ই, চকচক করছে। এখানে জঙ্গলে মাথায় দেবার তেলও পাওয়া যায় নাকি ! চুলটা কেটে ফেললুম, না কাটলেও বোধহয় চলত ।
একজন যুবক এগিয়ে এলো, যাকে দেখে চিনতে পারল ইতু, আরে, এই ছেলেটা তো ওর ক্লিনিকে একবার খাম দিতে আর ওর বাড়িতে একবার খাম নিতে এসেছিল । যাক এরা তাহলে অমিতের পরিচিত । অমিতও এরকম কাঁধে বন্দুক ঝোলায় নাকি ? আমাকেও বন্দুক ঝোলাতে হবে নাকি ? তা তো চাইনি ।
–ডক্টর ঘোষ, ওয়েলকাম, বলল ছেলেটি ।
ইতুর মুখ দিয়ে বেরোল, থ্যাংকস , ম্যায় বহুত ডরি হুই থি, কোই দিখাই নহিঁ দে রহা থা, কাফি অন্ধেরা ভি হো চলা হ্যায় ।
–জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর হম লোগোঁনে নিন্দ সে নহিঁ জাগায়া আপকো । আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয় । আপ হম লোগোঁ কে সাথ আইয়ে, বলল ওদের সঙ্গের যুবতী । সে-ই বোধহয় এদের নেতা । পিঠের ব্যাগ থেকে দুশো এম এল জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, লাইফ ইজ টাফ ফর অল ইন দিস প্লেস, অ্যান্ড ভেরি ডেঞ্জারাস টু, ইউ হ্যাভ টু গ্র্যাজুয়ালি অ্যাডজাস্ট ।
জল খেয়ে তৃপ্ত বোধ করল ইতু । ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে । দেখুকগে, কীই বা এসে যায়। এতক্ষণ পর মানুষ দেখতে পেয়ে অসুরক্ষিত থাকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত লাগল নিজেকে ।
মেয়েটি বলল, আপনি হাঁটার সময়ে মাঝখানে থাকবেন, আমি আপনার দেহরক্ষী, আমার নাম সোনারি । ওদের সঙ্গে হাঁটা আরম্ভ করল, ওর সামনে তিন জন, পেছনে দুজন । গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে তারা দেখতে পেয়ে দেহরক্ষীদের চেয়ে তাদের টিমটিমে আলোদের বেশি আপন মনে হল ইতুর । সেই সকাল থেকে বেরিয়েছে, রোদের জন্য দ্বিতীয়বার আর পেচ্ছাপ পায়নি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, আর কতক্ষণ হাটঁতে হবে কে জানে, কয়েকটা বিস্কিট আগেই খেয়ে নিলে ভালো হতো । এরা কেউ কথাবার্তাও বলছে না । নিজে থেকে কোন প্রসঙ্গেই বা কথা বলবে, নানা ভাবনা মগজে ঘুরছিল ইতুর। দেহের আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে মাদি-জোনাকিদের আকৃষ্ট করার জন্য । বনের পাতারা গন্ধ বিলোচ্ছে । নয়নাভিরাম নির্বাক অন্ধকার । বনপথের সহযাত্রীদের পাহারায় হয়ত আরও দেড় ঘন্টা হেঁটেছিল ইতু ।
তখনই, অন্ধকারকে হুশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল ।
আচমকা গুলিচলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুর ওপর ঝাঁপিয়ে একজন সঙ্গী যুবক ওকে জঙ্গলের শুকনো পাতার ওপরে উপুড় করে শুইয়ে দিল, ইতুকে বাঁচাবার জন্য দুদিক থেকে ওর দেহকে নিজেদের শরীর দিয়ে ঢেকে নিল বাকি দুজন যুবক । মেয়েটি শুকনো পাতার ওপর উপুড় হয়ে কোনো অচেনা শত্রুর দিকে তাক করে বন্দুক উঁচিয়ে শুয়ে পড়ল ইতুর মাথার কাছে।
অবিশ্বাস্য । এরা আমার কেউ নয়, তবু আমাকে বাঁচাবার জন্য নিজেদের শরীরকে আমার দেহের বর্মে পালটে ফেলল ! মানুষ না রোবোট এরা !
ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, গুলির আগুন-ফিনকিও দেখতে পাচ্ছে না । ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, বোধহয় নতুন জীবন আরম্ভ হল, কিংবা জীবন হয়তো কিছুক্ষণেই শেষ হয়ে যাবে । আর আশ্চর্য, এক্ষুনি হয়তো মরে যাবো, এই ভেবেও ভেতরে-ভেতরে আনন্দ খেলছে।
শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল সেই দিনকার ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগল ইতুর, হুবহু ।
.
আঠারো
মালগুজার কর্মচারী : ওই দ্যাখো । সালফি খাবার জন্যে জঙ্গলে ঢুকেছিল, ভ্যায়েনচো, সামলাতে পারেনি, মাতাল হয়ে পড়ে রয়েছে ।
কেন্দুপাতার ফড়ে : সালফি খেয়ে মাতাল হলে তো যেখানে খেয়েছে, তার কাছাকাছি পড়ে থাকত । এখানে আসপাশে কোনো গ্রাম নেই, সালপিখোরদের গেঁয়ো জামাতও নেই ।
মালগুজার কর্মচারী : ভ্যায়েনচো, কেন্দুপাতার চোরাকারবারি নয়তো ?
কেন্দুপাতার ফড়ে : কেন্দুপাতার ব্যাবসার সবাইকে চিনি, চোরাকারবারিদেরও । ওখানে, রাস্তার ধারে খাদে পড়ে থাকবে কেন ?
মালগুজার কর্মচারী : মরুকগে বেওড়াগুলো, ভ্যায়েনচো । আমাদের কী করার আছে ।
কেন্দুপাতার ফড়ে : হ্যাঁ, উঠিয়ে নিয়ে যাবার হলে বনদপতরের লোক বা সিআরপিএফ নিয়ে যাবে । নয়তো খাবে জন্তু-জানোয়াররা । চলুন, চলুন । কদম চলাকে চলিয়ে ।
.
উনিশ
অমিত বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথম বার যখন ইতুর সঙ্গে দেখা করতে ওর ক্লিনিকে এসেছিল, সে ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে ইতুর । অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, মাটিতে শুকনো জঞ্জালের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গুলির অধারাবাহিক শব্দ শেষ হবার পরও, বহুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে, সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল ইতুর, হুবহু ; পাতাগুলো বোধহয় বয়ে এনেছে অমিতের যৌবনগ্রন্হির নিঃসরনের বুনো গন্ধ ।
অমিতের সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না । হয়তো কেন, নিশ্চিত হবে না ।
বছর আড়াই আগে,আনিসাবাদে, নিজের ক্লিনিকে রোগি আসার অপেক্ষায় হতাশ বসেছিল ইতু, ইতু ঘোষ ; দেখল, ফুটপাতে, ওর ক্লিনিকের সামনেই চেককাটা শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে, ওপরে মুখ তুলে । দাড়ি-গোঁফ আর বাবরি চুলে মুখ প্রায় ঢাকা, ইতু বয়স আন্দাজ করল বাইশ-তেইশ হবে, রোগকে যেচে ডেকে আনার সবচেয়ে উদ্দীপক বয়স । উঠে দাঁড়িয়ে, সাদা গাউন পরেই ছিল, টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে, এগিয়ে গিয়ে ডাকল লোকটাকে, হিন্দিতে, আসুন না, আসুন, আপনাকে দেখেই তো বুঝতে পারছি আপনি বেশ ক্লান্ত, হয়ত কোনো রোগের কারণে ।
সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল, ডাক্টর ইতু ঘোষ কা ক্লিনিক, য়ঁহা সভি রোগোঁকা ইলাজ কিয়া জাতা হ্যায়, তারপর ইতুর দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল, তুই ইতু ঘোষ, গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ির মেয়ে, তাই না ?
যুবকের মুখের দিকে না তাকিয়ে, পেছন ফিরে তাকে বলল, হ্যাঁ, আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে ইতু, অনেকে ইতি বা ইতান বলেও ডাকে । আপনি ভেতরে আসুন না, শুনবো আপনার শারীরিক সমস্যার কথা, কোনো চিন্তা করবেন না, হেভি অ্যালোপ্যাথিক ডোজের ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসা আমি করি না, আসুন, ভেতরে আসুন ।
লোকটা ভেতরে ঢুকে, ইতুর টেবিলের উল্টো দিকে, রোগির চেয়ারে বসলে, নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে, স্টেথোটা টেবিলে রেখে, টেবিলে ছড়ানো জিনিসগুলো, খোলা-সংবাদপত্র, সাজাতে-সাজাতে ইতু বলল, কি হয়েছে শুনবো, তার আগে আপনার ব্লাড প্রেশার আর পাল্স চেক করে নিই । রোগি তার সমস্যা বর্ণনা করার আগেই, ইতু বলল, দিন আপনার বাঁ হাতখানা এখানে রাখুন তো, বলে ব্লাড প্রেশার মাপার জন্য ফ্ল্যাপটা হাতে জড়িয়ে বলল, আপনি ওনাদের চেনেন ?
–আমি তোকেও চিনি, বলল লোকটা, তুইও আমাকে চিনিস, মুখের পানে আগে তাকিয়ে দ্যাখ, ইডিয়ট । আমার গলার আওয়াজও এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি নাকি ?
যুবকের কথা শুনে তার মুখের দিকে চেয়ে সঞ্চিত বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ইতু, আরে অমিত, চিনতেই পারিনি, দাড়ি গোঁফ রেখে এমন ভোল পাল্টে ফেলেছিস রাসকেল, গলার আওয়াজও বড়দের মতন হয়ে গেছে, সন্ন্যাসী হয়ে গেছিস নাকি ? ফুঁপিয়ে ফেলেছিল, সামলে নিয়ে বলল, সেই যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলি, আমাকে বলে যাবার প্রয়োজন বোধ করলি না।
–হ্যাঁ, সাধুই হয়ে গেছি প্রায় ?
–বাড়িতে গিয়ে আমার ক্লিনিকের ঠিকানা পেলি ? টিশ্যু পেপারে চোখ পুঁছে বলল ইতু ।
— গিয়েছিলুম একটু আগে, ভেতরে ঢুকিনি , তাই আমাকে দেখে রোগীর মতন মনে হয়ে থাকবে, হাঁটছি তো অনেকক্ষণ যাবত । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে চলে এলুম । তোদের প্রতিবেশী গোবর্ধন মিশ্রর কাছে খোঁজ করে তোর ক্লিনিকের ঠিকানা পেলুম । মন কেমন করছিল রে সবায়ের জন্য, কিন্তু ওই বাড়িতে আমি তো আনওয়ান্টেড কলঙ্ক । কিছুক্ষণ থেমে, মাথা নামিয়ে অমিত বলল, ওই বাড়িতে আমি একজন বেজন্মা ।
–স্টপ ইট, ভাট প্যাঁদাসনি । কেউই তোকে বেজন্মা বলেননি ।
–তা না হলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে বাধা ছিল কোথায় ? আমার বাবার চেয়ে আমার মা দশ বছরের বড়, আর আমার মা আমার বাবার স্ত্রী নন, অন্য আরেকজনের স্ত্রী, এই তো ? এই কারণেই তো ওনাদের আপত্তি ?
ইতু চিৎকার করে উঠল, না, না, না, না । ক্লিনিকে বসে অমনভাবে চেঁচিয়ে ফেলে, হুঁশ হল, যে, ফুটপাথ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ওর দিকে অবাক ঔৎসুক্যে তাকাচ্ছে, সম্ভবত ভাবছে যে এ কেমন ডাক্তারনি, রোগিকে বকুনি দিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে । উঠে গিয়ে শাটার নামিয়ে, অমিতের মুখের কাছে মুখ এনে ইতু বলল, ওনাদের বক্তব্য ছিল আমরা দুজনে ছোটোবেলা থেকে ভাইবোনের মতো বড়ো হয়েছি, আমরা বিয়ে করলে ভাইবোনের বিয়ে বলে মনে করবে পাড়াপড়শিরা, বলেছিলেন সকলে । আফটার অল রাঙাকাকু-রাঙাকাকিমা তোর দায়িত্ব নিয়েছিল, ছেলের মতন মানুষ করছিল, তাই । শুনে রাখ, তুই যদি আমার মায়ের পেটের ভাইও হতিস, ইনসেসচুয়াস হলেও, তোর সঙ্গেই রিলেশানশিপ করতুম, কিংবা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তোর সঙ্গে লিভ ইন করতুম ।
–তুইও জানিস, আমিও জানি ইতু, তোদের বাড়িতে কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হতো আমার । তারপর যখন ওনারা জানতে পারলেন যে তুই আমাকে ভালোবাসিস তখন ওনারা ঘেন্না আর রাগ সামলাতে পারেননি ।
অমিতের জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তাই তুই আমাকে ফেলে পালিয়ে গেলি; ইনফর্মটুকু করতে পারলি না ? বেশ ককিয়ে কেঁদে ফেলল ইতু, ফিরে গিয়ে বসল নিজের চেয়ারে, টিশ্যু দিয়ে চোখ পুঁছল , মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কাওয়ার্ড রেনিগেড ।
অমিত : আমি আমার বাবা আর মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলুম রে, বিশ্বাস কর, ওনাদের কাছ থেকে জবাবদিহি পাওয়া জরুরি ছিল । কেন ওনারা জাস্ট একজন বন্ধুর বাড়ি আমাকে ডাম্প করে চলে গেলেন, তাও সেই বন্ধু নিজেই কিডন্যাপ হয়ে গিয়েছিল বলে যে বাড়ি তার বউ-বাচ্চাকে স্বীকৃতি দেয়নি ।
চেয়ার ছেড়ে অমিতের কাছে পৌঁছে, এবার ওর দীর্ঘ চুল দু’হাতে ধরে ইতু বলল, তাই বলে তুই আমাকে ডিচ করবি ? আমি কি দোষ করেছিলুম ? আমিই বা কোন রাজকন্যার মতন আছি ওই বাড়িতে ?
অমিত : ডাক্তার হয়েছিস তো ! কনভেন্ট এজুকেশান ঝাড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারিসনি দেখছি ।
ইতু : এটা ডাক্তারি ? ভালো করে পড়েছিস বাইরে সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে, ইউ ফুল ? বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার দরুণ এক বছর এম বি বি এস পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল । আমি যেটা করেছি সেটা অলটারনেটিভ মেডিসিন । রোগি আসে না, যাও দুচারটে আসে তারা দ্বিতীয়বার আসে না, কেননা আমি রাংতায় মোড়া অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ দিই না ।
অমিত : মিশ্রাজির কাছে শুনেছি, তোর মা-বাবার অ্যাকসিডেন্টের কথা । হ্যাঁ, সাইনবোর্ড দেখেছি, তুই অলটারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার । বাবা-মায়ের খোঁজে গিয়েছিলুম, অথচ সে বিষয়ে জানতে চাইছিস না ? কেবল নিজের চিন্তা করছিস ?
ইতু, মুঠো থেকে অমিতের চুল আলগা করে বলল, তুই ছাড়া আমার আপন বলতে কে আছে বলতো ওই ফাকিং একান্নবর্তী পরিবারে ? আই অ্যাম সরি, এতদিনে তোকে পেয়ে ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে গিয়েছিলুম । তোর বাবা-মা কোথায় আছেন ? খুঁজে পেয়েছিস ওনাদের ? কী করে পেলি ?
অমিত : আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছিস না । বোস, গিয়ে নিজের চেয়ারে বোস । তোকে আমার দরকার।
অমিত : বাবা আর মা দুজনকেই খুঁজে পেয়েছি । মায়ের হাজবেন্ডকেও খুঁজে পেয়েছি ।
অমিত : আমার মা এই বয়সেও সুন্দরী, পাকাচুল-সুন্দরী । শি ইজ সো সিরিন অ্যাণ্ড ডিগনিফায়েড, কী বলব তোকে, কিন্তু ডিসট্যান্ট, হ্যাঁ, এক্সট্রিমলি ডিসট্যান্ট । জানিস, আমি কলকাতায় নার্সিং হোমে জন্মেছিলুম । নার্সিং হোমের আর কলকাতা কর্পোরেশানের বার্থ সার্টিফিকেট আছে রাঙাবাবার কাছে, অথচ, কখনও সে কথা বলেনি আমাকে । বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম অমিত বর্মণই লেখানো হয়েছিল ।
ইতু : এই ডাফার, পা দোলাসনি, পা ব্যথা করছে তো চেয়ারে পা তুলে বোস ।
অমিত : ওকে, ওকে, পা তুলেই বসছি । যেদিন সকালে তোদের বাড়ি ছাড়লুম, সোজা বাবার অফিসের কর্মীদের কাছে গিয়েছিলুম, বাবার কনটেমপোরারি একজন বললেন, যে উনি কোনো নকসল্লি ফ্যাকশানের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিলেন । অফিসের এক ক্লাস ফোর স্টাফের কাছে রসিক পাসওয়ান নামে এক পিওনের নাম-ঠিকানা পেয়ে তার কোচাগাঁও গ্রামের দলিত টোলার বাড়িতে গিয়েছিলুম ; সে ওই ফ্যাকশানে ছিল । গিয়ে শুনলুম যে রসিক পাসওয়ান পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল । আশঙ্কা করেছিলুম যে তাহলে বাবাও হয়ত মারা গিয়ে থাকবেন আর মাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়ে থাকবে ।
অমিত : ওয়ারিস আলি গঞ্জে স্টেশানে বসে ভাবছিলুম যে এর পর কী করব, কোথায় সুত্র পাবো, যাবোই বা কোথায় ? গর্দানিবাগের বাড়িতে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাবার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন যে ওনার আর আমার মায়ের খোঁজখবর যেন কখনও করা না হয় । বাড়িতে কেউ কখনও আলোচনা করেনি ; করল প্রথম যখন ওনারা তোর-আমার সম্পর্কের কথা জানতে পারল । আমার বাবার নাম অতনু চক্রবর্তী আর মায়ের নাম মানসী বর্মণ, ওনারাই সেদিন উত্তেজনার মুখে বলেছিলেন, মনে আছে তোর ? আমি তোর রাঙাকাকুকে কতবার জিগ্যেস করতুম যে আমার পদবী বর্মণ কেন, উনি এড়িয়ে যেতেন, বলতেন কী করবি জেনে ।
অমিত : স্টেশানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরের ট্রেনের জন্য । ভাবছিলুম শালা যে ট্রেনই আসুক, যেখানেই যাক, চেপে যাব । হঠাৎ কাঁধে কেউ একজন হাত রাখতে, পেছন ফিরে দেখি, বুড়োটে কদমছাঁট বিহারি , মাথায় লাল গামছা বাঁধা, বলল যে তুমি রসিক পাসোয়ানকে খুঁজছ কেন ? আমি বললুম, উনি আমার বাবাকে আর মাকে চেনেন, তাই, আমি ওনার কাছে জানবার জন্য এসেছিলুম যে আমার বাবা-মাকে কোথায় পাবো, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না । উনি বললেন, তোমার মুখ অনেকটা তোমার বাবার মতনই । আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি কে, আমার বাবা-মাকে চেনেন ?
অমিত : উনি বললেন ওনার নাম রসিক পাসওয়ান । ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেই একই দলিত টোলায়, সেই বাড়িতেই, যেখানে আমাকে বলা হয়েছিল যে রসিক পাসওয়ান মারা গেছে । রসিক পাসওয়ান নামে সত্যি একজন মারা গিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে নকসল্লিদের লড়াইতে, কিন্তু সে অন্য রসিক পাসওয়ান ।
ইতু : যাই হোক, বাবা মাকে কোথায় পেলি, কী করেই বা পেলি ? ওনাদের বাড়িতেই ছিলি এতকাল ? আমাকে নিয়ে চল, আমি তোর সঙ্গে ওনাদের বাড়িতেই থাকব ।
ইতু : আমার আর এখানে একদম ভাল্লাগছে না । এখানে থাকতে হলে আমি মরেই যাবো ।
অমিত : আবার তুই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এলি । বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা হল, সে কথা তো জানতেই চাইছিস না । রসিক পাসওয়ান বলল যে আমার বাড়িতে দুচারদিন থাকো, আমি খোঁজখবর নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো ওনাদের কাছে । দশ দিন থেকে গেলুম ।
ইতু : একজন অচেনা বিহারির বাড়ি দশ দিন থেকে গেলি ? তোকে কিছু করেনি তো ?
অমিত : আমাকে আবার কী করবে ? আমার কাছে পয়সাকড়িও ছিল না তেমন যে লুটপাট করে কেড়ে নেবে । বটঠাকুমা মাঝে-সাঝে যে হাতখরচ দিতেন সেটুকু জমানো টাকাই ছিল । রসিক পাসওয়ানের সঙ্গে দেখা না হলে ভিক্কে করতে হত ।
ইতু : তা নয় । যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন খিচ্চা-কওলা-চিকনা-লালটু, ইনোসেন্ট-ইনোসেন্ট টাইপ, ছিলি । ওইসব এরিয়ায় ছেলেদের সঙ্গে জোর করে সেক্স করে শুনেছি । এই ক’বছরে অবশ্য রোদে পুড়ে কিছুটা চেবানো-চোয়াড়ে আর ছিবড়ে-মাসকুলার হয়ে গেছিস, যে জন্য দেখামাত্র চিনতে পারিনি ।
অমিত : আমি সিরিয়াস আলোচনা করছি আর তুই তার মাঝে গল্পগাছা নিয়ে আসছিস । লোকটা আর ওর বউ অনেক ভালো । তোদের বাড়িতেও আমার অমন আদর-যত্ন হয়নি । দশদিন পরে, সকালে আমরা বাসে করে গেলুম গয়া । গয়া থেকে ট্রেনে করে লাতেহার, ওটা ঝাড়খণ্ডে পড়ে । দিনের বেলাটা তেতিয়া বিরহোর নামে একজন আদিবাসীর মাটির বাড়িতে কাটিয়ে বিকালে হাঁটা দিলুম তিনজনে । সারারাত উবড়-খাবড় রাস্তা ঠেঙিয়েছি, ভেবে দ্যাখ ।
অমিত : পৌঁছোলুম কাতিয়া নামে একটা জঙ্গলে, রিয়্যাল ঘন-জঙ্গল, গাছের পর গাছ আর ঝোপঝাড়। তাতিয়া ফিরে গেল ; আমাদের আরেকজন কম বয়সী আদিবাসীর জিম্মায় দিয়ে, তার নাম ঝুনাই । সেখান থেকে অনেকটা ওপর দিকে উঠে, অনেকটা, অনেকটা, জঙ্গলের আরও ভেতরে গিয়ে ঝুনাই ফিরে গেল । আরেকজন, তার নামও তেতিয়া, আমাদের নিয়ে গেল আরও ভেতরে খোলামতন একটা জায়গায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতন অমন একটা খোলা জায়গা রয়েছে, ন্যাচারাল জায়গা । কয়েকটা পলিথিনের তাঁবু দেখতে পেলুম, দু’জন লোক কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে পাহারা দিচ্ছিল । কীরকম তাঁবু জানিস, তোর ক্লিনিকের একটু আগে ফুটপাথে চায়ের দোকান আর ভাতের দোকানে যেমন পলিথিনের তেরপল আছে, তেমন । একটা তাঁবুতে ঢুকে তেতিয়া আস্তে ডাক দিতে, একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, তিনি বললেন, আবার ম্যালেরিয়া হল নাকি রে, সেরে তো গিয়েছিলি । তেতিয়ার পেছনে আমাদের দেখতে পেয়ে রসিককে বললেন, আচ্ছা, রসিক একজন নতুন ছাত্র এনেছে বলে মনে হচ্ছে । মাস্টারসাহেবকে খুঁজছ তো ? উনি ওইদিকের ছাউনিটায় মিটিং করছেন । শুনেছ তো কয়েকদিন আগে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বল-এর লোকেরা জওয়ানদের শব তোলার কাজে কয়েকজন গ্রামবাসীকে লাগিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বোমা ফেটে মারা গেছে আর কয়েকজনের অঙ্গহানি হয়েছে ।
ইতু : জঙ্গলে স্কুল-মাস্টার কী করেন রে ?
অমিত : ধৈয্য ধর না, সবই তো বলছি । ওই মহিলা আমার মা আর মাস্টারসাহেব আমার বাবা ।
ইতু : মাই গড ! আমি যাবো ওখানে, তুই আমাকে আজই নিয়ে চল । আমি ওনাদের বলব যে আমি তোকে চাই বলে তুই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিস, তোর কোনো দোষ নেই ।
অমিত : মা আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না যে আমি ওনার ছেলে ; শালা মাতৃত্ব নিয়ে লেকচারবাজি সবই ফালতু । আমার তক্ষুনি এত খারাপ লেগেছিল যে হয়ত কেঁদেই ফেলতুম । উনি হিন্দিতে বললেন, তোমাকে বেশ ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে । অনেকটা হেঁটে এসেছ তো, ক্লান্ত হয়ে গেছ, ওই শেডটায় যাও, মাস্টারসাহেব আছেন, যাও দেখা করে নাও, ক্লান্তি জুড়িয়ে নাও । রসিক পাসওয়ান ওনাকে বললই না যে আমি ওনার ছেলে । পাশের তেরপলে ঢুকেছি, রসিক পাসওয়ান ওনাকে লাল সেলাম মাস্টারসাহেব বলতেই, উনিও একইভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন, আর আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গভীরভাবে আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখে তক্ষুনি জড়িয়ে ধরলেন , বাংলাতেই বললেন, এখানে কেন এলে, যেখানে ছিলে ভালোই তো ছিলে । তুমি আমার ছেলে, ওনারা নিশ্চয় তোমাকে বলে থাকবেন, যে কারণে তুমি কমরেড রসিককে সন্ধান করে এখানে ছুটে এসেছ, দাঁড়াও তোমার মাকে ডাকছি, উনি প্রায়ই তোমার প্রসঙ্গ তোলেন আর বলেন যে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিলুম আমরা । আমি বললুম যে আমার নাম অমিত । ওনাকে ঘিরে যে আদিবাসীরা ছিল, জিগ্যেস করল, আপকা বেটা ? বাবা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে দেখে একজন বাবার যেমন রিঅ্যাকশান এক্সপেক্ট করেছিলুম, তেমন প্রতিক্রিয়া হল না দেখে, মনটা খারাপ হয়ে গেল, ডিফিটেড ফিল করলুম রে ।
অমিত : উনি বলতে লাগলেন, আমি কিন্তু মনে করি কিছুই ভুল করিনি । দেখছ তো অঞ্চলটা ? এখানে একজন শিশুকে লালন করা অসম্ভব । উনি তারপর মানসী মানসী বলে কয়েকবার ডাক দিতে আমার মা এলে, বাবা বললেন, একে চিনতে পারছ ? তোমার ছেলে । মা আমার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, আমিও মায়ের দিকে । উনি কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ব্যাস, জীবনে প্রথমবার নিজের গ্রোনআপ ছেলেকে দেখে, জড়িয়ে, কাঁদাবার কথা । উল্টে, আমারই কান্না পেয়ে গেল । মায়েরা জড়িয়ে ধরলে মগজের মধ্যে যে তুফান আরম্ভ হয় তা জানতে পারিনি কখনও । মা বললেন, তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, জবাবদিহি চাইতে, না? আমার কাছে দেবার মতো ব্যাখ্যা নেই । আমি জবাবে বলেছিলুম, আপনি আমাকে এভাবে অনেকক্ষণ জড়িয়ে থাকুন, তাহলে আমার কান্না পাবে না । ওনার হৃৎস্পন্দন যে দ্রুত হয়ে চলেছে, তা টের পেয়ে মনে হচ্ছিল যে যাক, জবাবদিহি পাওয়া গেল । দূরত্ব কিন্তু থেকেই গেছে রে ।
অমিত : বাবা বললেন, মানসী, ডাক্তারসাহেবের কাছে নিয়ে যাও ওকে, দেখাও তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, অমিত, তুমি এখানেই থাকবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, আর ফিরে যাবার দরকার নেই ।
অমিত : মা আমাকে অন্য একটা পলিথিনের তেরপলে নিয়ে গেলেন । সেখানে রোগা, পাকাচুল, চশমাপরা, ফর্সা একজন বসে টেবিলে কিছু লিখছিলেন, তাঁর সামনে দুজন আদিবাসী বসেছিল । মা তাঁকে বললেন, একে চিনতে পারছ ? এ আমার ছেলে । উনি এমনভাবে আমার ছেলে কথাটা বললেন যে বুঝতে পারলুম তার ভেতরে গোপন গর্ব লুকিয়ে আছে, আর কিছুটা ওই পাকাচুল লোকটার প্রতি অবজ্ঞা । লোকটা উঠে আমার মুখের কাছে মুখ এনে চশমা কপালে তুলে বলল, তুই কমরেড অতনুর ছেলে ? কী নাম রেখেছে তোর, অমিতই আছে তো ? ডাক্তারসাহেবের কথা শুনে আমার বেশ ভালো লাগল রে । বাবা-মা তুমি-তুমি করে কথা বলছিলেন, ইন ফ্যাক্ট আজও ওনারা আমার সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলেন, আর আমি ওনাদের আপনি-আপনি করে কথা বলি, কিছুতেই তুমি বেরোয় না মুখ থেকে । বুঝতে পারি যে ওনারা একটা অদৃশ্য পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করে রেখেছেন আমাকে ।
ইতু : আমি হলে দেখা হতেই বলতুম, মা, বাবা, তোমরা আমাকে অন্যের কোলে ফেলে দিয়ে আর কখনও ফিরে তাকাওনি কেন । তারপর কী হল ? ঘ্যাঙাচ্ছিস কেন, শিট, তাড়াতাড়ি বল ? তুই ওনাদের সঙ্গেই ছিলি এতকাল ? কী করতিস ? আমায় কবে নিয়ে যাবি ?
অমিত : হ্যাঁ, থেকে গেলুম । ডাক্তারসাহেব কী করেন জানিস ? যে সব আদিবাসী ছেলেরা স্কুলে ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে, তাদের ডাক্তারির প্রথমপাঠ পড়ান, অ্যান্টিবায়টিক দেয়া, কখন অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দিতে হবে, ইনজেকশান দেয়া, ওষুধের নাম, জখম হলে কী ভাবে পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে, এইসব । গরিবদের জন্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের জন্য কিলোমিটার-কিলোমিটার তো ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই হাতে-নাতে প্রাথমিক ডাক্তারি শিখে তারা গ্রামে-গ্রামে ডাক্তারি করে, বেয়ারফুট ডাক্তার ।
ইতু : আর তোর বাবা-মা, ওনারা ওই জঙ্গলে কী করেন ?
অমিত : বাবা ক্লাস নেন, আদিবাসী ছেলে-মেয়ে-জোয়ান সবায়ের । হিন্দি, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখান । এছাড়া উনি রাজনীতি সম্পর্কে সহজ বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন গরিবরা ষাট বছর পরও গরিব থেকে গেল ; তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে কী করতে হবে, এইসব তত্ত্বকথা । ওনারা কিন্তু একই জায়গায় থাকেন না ; প্রায় রোজই পলিথিনের তাঁবু আর জিনিসপত্তর গুটিয়ে অন্য কোথাও তাঁবু খাটান । বন্দুকধারীরা পাহারা দ্যায়, কুচকাওয়াজ করে, বন্দুক চালাতে শেখে । অনেক লোক আছে, প্রথম দিন কোনো আইডিয়া হয়নি । একটু-একটু করে জানতে পারলুম ।
ইতু : আর মা ?
অমিত : মা যে ঠিক কী করেন জানি না । আমি তো বাবার তাঁবুতে শুই । মাঝে-মাঝে অলিভ রঙের পোশাকে বন্দুকধারী লোকজন আসে, তারা মায়ের সঙ্গে খুসুরফুসুর কথা বলে, তারপর চলে যায় । সাধারন পোশাকের বন্দুকধারীও দেখেছি আসতে । তখন ওনার ছাউনিতে ঢোকা নিষেধ । বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলুম যে লোকগুলো কারা, কেন আসে, উনি বলেছিলেন, সময় হলে জানতে পারবে, যদি বোধবুদ্ধি গড়ে ওঠে তাহলে তোমাকে ওই কাজগুলোই করতে হতে পারে যা তোমার মা এখন করছেন । আপাতত তুমি দেখতে থাকো আমি কী ভাবে পড়াই, কোন বই পড়ি ; তুমি সেই বইগুলো পড়ো । মাঝে-মাঝে আমিও অঙ্কের ক্লাস নিই, বাবা উপস্হিত থাকেন, আমাকে গাইড করেন । ব্যাস ওইটুকুই, উনি বাবার মতন বিহেভ করেন না । তত্ত্বফত্ত্ব যতটা বুঝেছি, সব ফালতু ।
ইতু : হাঃ, তুই ক্লাস নিস, পড়াশুনায় লো সেকেন্ড ক্লাস ! যাকগে, পড়াচ্ছিস, পড়া । তুই তো বললি এই বয়সেও তোর মা অপরূপ সুন্দরী ?
অমিত : হ্যাঁ, সত্যিই সুন্দরী ; চুল পাকলেই বা । আমি ওনাকে একদিন সাহস করে জিগ্যেস করেছিলুম যে, আপনি তো ডাক্তারসাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলেই পারতেন, তাহলে আমাকে জন্মের গঞ্জনা শুনতে হতো না । উনি কী বললেন জানিস ?
ইতু : কী ?
অমিত : বললেন, আমি অতনুর এত কাছে চলে গিয়েছিলুম, এত ভালোবেসে ফেলেছিলুম যে বিয়ের প্রয়োজন ছিল না; অতনুও বাড়ি-চাকরি সবকিছু ছেড়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে চলে এসেছিল আমার আস্তানায়, তখন আমি আর ডাক্তারসাহেব নওয়াদায় থাকতুম । বললেন, তুমি আমাদের প্রেম থেকে জন্মেছ, গতানুগতিক দৈহিক সম্পর্ক থেকে নয় । তোমার ছোটোবেলায় যদি আমাদের সঙ্গে তোমাকে রেখে মানুষ করতুম তাহলে আমরাও গতানুগতিক সম্পর্কের রুটিনে জড়িয়ে পড়তুম । দেশের জন্য, মানুষের জন্য, যে স্বপ্ন দেখি, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠত ।
ইতু : হোয়াট ডাজ শি মিন ? উনি একটা পোয়েটিক অ্যালিবাই খাড়া করে তোকে বুঝিয়ে দিলেন, আর তুই বুঝে গেলি ? রাবিশ । আমি তো তোর ফ্লেশকে আমার ফ্লেশ দিয়ে কারনিভোরের মতন ভালোবাসি । তুই যখন চলে গেলি তখন এমন হয়ে গিয়েছিল যে তোকে রাস্তায় পেলে সত্যি খুন করে ফেলতুম । একদম ভেঙে পড়েছিলুম ।
অমিত : এখন সামলে নিয়েছিস তো ? আমার বাবাকে তোর কথা বলেছিলুম । উনি বলেছেন, তুই যেহেতু আমার বিশ্বাসের পাত্রী, আমাদের হয়ে কাজ করতে পারবি ।
ইতু : কাজ ? না, না, আমি তোর সঙ্গে যেতে চাই, কাজ-ফাজ করার হয় ওখানে গিয়ে করব, তোর মাকে হেল্প করব, ডাক্তারি করব, আমি তো বেয়ারফুট ডাক্তারের চেয়ে বেশি কমপিট্যান্ট । আমি যে-কোনো অবস্হার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, তুই তা জানিস । আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস মিনিংলেস লাইফ।
অমিত : মানুষের-সেবা, সমাজের-সেবা, গরিবদের সেবা, ওয়েলবিইং অফ ম্যানকাইন্ড, এইসব বক্তৃতা ঝাড়তিস, আর এখন শুধু আমার সঙ্গে যাবার বায়না করছিস । তুই যাবি, তবে এখনই নয় । এখন তুই বাবা-মার জন্য কিছু-কিছু কাজ করবি । সহজ, কিন্তু বিপজ্জনক কাজ । তোর ক্লিনিকে মাঝে-সাঝে একজন লোক সবুজ বা নীল টিশার্ট পরে খাম দিয়ে যাবে, তুই সেটা নিজের কাছে রাখবি, পরে ধূসর বা ছাইরঙের টিশার্ট পরা একজন লোক এসে ওটা কালেক্ট করে নেবে । এটা অত্যম্ত গোপন কাজ ; এ-বিষয়ে তুই কখনও কারোর সঙ্গে আলোচনা করবি না । ভেবে নে, চিন্তা করে বল । আবার বলছি, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক । যদি ওৎ-পাতা পুলিশ তোকে ওই খামসুদ্দু ধরে তো কী যে হবে তা জানিস তো, মেয়েদের ধরে লকাপে যা-যা হয় ।
ইতু : তোর জন্য সবকিছু করতে পারি । ধরেবেঁধে রেপও যদি ওরা করতে চায়, তো করবে । কিন্তু, দাঁড়া, স্তোক দিয়ে তুই কেটে পড়ছিস না তো ?
অমিত : না । বি সিরিয়াস । এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । ইয়ার্কি হাসিঠাট্টার নয় ।
ইতু : তাহলে বাড়ি চল । চান-টান করে খেয়ে-দেয়ে তারপর যাস । আমি স্কুটার কিনেছি, চল না একবার পুরো গান্ধি ময়দানের চক্কর মেরে গোলঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে আসি ; তুই জড়িয়ে বসে থাকবি, আর আমি হ্যাপি ফিলিং নেবো । চল, চল ।
অমিত : কী যে বলিস, এমনিতেই আমি ক্লান্ত । ওই বাড়িতে আমি আর ঢুকতে চাই না রে।
ইতু : সুশান্তজেঠু অত অপমান সহ্য করে, হেনস্হা সহ্য করে, অবহেলা সহ্য করে আসেন । তোকে তো শুধু বলা হয়েছিল যে আমি তোর বোন, তুই যাদের ছেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করেনি । তোর তো একটা স্পেস আছে বাড়িটায় । এত তাড়াতাড়ি হেরে যাবি কেন ? বি পজেসিভ অ্যাণ্ড অ্যাগ্রেসিভ লাইক মি । বটঠাকুমা আর অন্নমা তো তোকে ভালোবাসেন । ওনারা দুজনে কাঁদছিলেন, যেদিন তুই বাড়ি ছেড়ে চুপচাপ কেটে পড়লি । চল, চল ।
অমিত : ঠিক আছে, চল তাহলে, দেখি ওনাদের প্রতিক্রয়া, আমি তো জন্মেছি লাৎখোর হয়ে, অপমান-ফপমান সব মাথার ভেতর থেকে হাপিশ করে দিয়েছি ।
ইতুর স্কুটারে বসে অমিত ওদের বাড়িতে পৌঁছলে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমন হল না । বটঠাকুমা আর অন্নমা বুকে জড়িয়ে আদর করলেন অমিতকে । বললেন, যে যাই বলুক, যতদিন আমরা দুই বুড়ি বেঁচে আছি ততদিন তুই এই বাড়ির ছেলে । যা চান-টান করে আয়, ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তো ?
ইতু টয়লেটে টাওয়েল সাবান রেখে এসেছিল । সুশান্তজেঠুর মা টয়লেটে সুশান্তজেঠুর সযত্নে রাখা অতিপুরোনো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রেখে এলেন । স্নান করে আসার পর ডাইনিং টেবিলে অমিতকে ঘিরে বাড়িতে উপস্হিত সবাই ওর উধাও হয়ে যাবার গল্প শুনতে চাইছিলেন, হয়তো ওনাদের অভিনয় । রাঙামা লুচি ভেজে নিয়ে এলেন, সঙ্গে আগের দিন ইতুর রাঁধা আলু দিয়ে ডিমের ডালনা, আর আচার । অমিত ভাবল, একবার জিগ্যেস করে, ওর পোশাক-আশাক জামাকাপড়গুলো কী হল, যে সুশান্তজেঠুর কম বয়সের পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরতে হচ্ছে । আর কী-ই বা হবে, যাকগে, আমি তো আউটসাইডার, নিজেকে বলল ।
–সত্যিই আমি ভবঘুরে সাংবাদিক হয়ে গেছি , ঘুরে বেড়াই, আজ এখানে, কাল সেখানে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গা আর নেই । আমি কিন্তু আজকেই চলে যাব । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
–আজ আর যেতে হবে না, কত দিন পরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বাড়ি ফিরল, বললেন বটঠাকুমা । এটা কি তোর বাড়ি নয় নাকি, বল, আমরা কি তোর পর ? আমাদের কোনো অসুবিধা নেই । সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর ওনার ঘরটা তো পড়েই আছে, আমি আর ওই ঘরে শুতে পারি না, ইতু শোয়, বললেন সুশান্তজেঠুর মা।
–হ্যাঁ, আমি এই বাড়ির মিউজিকাল চেয়ার । একজনের বিয়ে হয়, তার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, আবার আরেকজনের বিয়ে বা বাচ্চা হয়, বা কারোর পরীক্ষা, ব্যাস, নির্দেশ আসে, ইতু এবার বারান্দায় শো, দালানে শো, রান্নাঘরে শো, ডাইনিং টেবিলের পাশে শো, সিঁড়ির তলায় শো । রাঁধুনি না এলে, এটা রাঁধ, সেটা রাঁধ। জমিয়ে রাখা ক্ষোভ চারিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করল না ইতু ।
–ওঃ, এই অবস্হায় আমি কেন আবার জমির লড়াইতে শরিক হই । অমিতের কথায় পরিবেশ ফিরল স্বাভাবিকতায় । বলল, বহুকাল বাড়িতে তৈরি লুচি আর ডিমের ডালনা খাইনি । দুপুরে আর লাঞ্চ করার দরকার হবে না । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।
–বাড়ির রান্না খাসনি বলছিস, দুপুরে মাছের ঝোল আর ভাতও তো খেতে হবে তাহলে । বলল ইতু, তারপর অমিতকে বলল, চল মাছের বাজারে যাওয়া যাক, তোর পছন্দের মাছ কেনা যাবে । লুঙ্গি পরেই চল, লজ্জা পাসনি, নেতারা পর্যন্ত লুঙ্গি পরে গান্ধি ময়দানে ভাষণ দিচ্ছে, মিছিলে হাঁটছে , অমিতের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বলল ইতু । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইতু বলল, বানচোদ, তুই এসেই যাই-যাই করছিস কেন বলতো ?
সিঁড়ির পাশের স্লোপ দিয়ে স্কুটার নামাতে-নামাতে বাড়ির উল্টো দিকের গেটের দিকে মুখ তুলে ইতু বলল, মিশ্রাজির ছেলেটা অন্ধকার থাকতে সকাল পাঁচটা থেকে মারুতি গাড়ি রিভার্স করতে শেখে আর ঘুম ভাঙিয়ে দ্যায়, রিভার্স হর্নে ভোর থেকে একঘেয়ে সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা বাজায় ।
একদিকে পা ঝুলিয়ে বসার কারণে ইতুর পেটে অমিতের জাপট কিছুটা নিকটতর হল । ইতু বলল, এই, নাভিতে সুড়সুড়ি দিসনি, ব্যালান্স গোলমাল হয়ে যাবে । অলরেডি তুই আমার জীবনের ব্যালান্স গোলমাল করে দিয়েছিস ।
— মাছের বাজার এসে গেছে, নাম আর বল কোন মাছ খেতে চাস । তখন প্রস্তাব দিয়েছিলুম যে শহরটা এক পাক ঘুরে নিই, রাজি হলি না, ফর হোয়াটএভার রিজনস ।
–বলব আবার কি, ইলিশ পাওয়া গেলে ইলিশ কেন, খেয়ে নিই, কে জানে আবার কখনও খাওয়া হবে কিনা, ইলিশ কেমন দেখতে তা-ই তো ভুলে গেছি।
ইলিশ কিনে, কাটিয়ে, স্কুটারে পা ঝুলিয়ে বসে, অমিত বলল ইতুকে, রাতটা থেকেই যাবো, বুঝলি । তোকে কিছু-কিছু দায়িত্ব দিয়ে যাবো ।
–তোর নিজের দায়িত্বটাই দে না, এত ভিতু কেন তুই ? অমিতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল ইতু। গান গাইতে শিখিনি, নয়তো মন খুলে একখানা পেলব-পেলব ঢিললা-হিললা টাইপ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতুম । কোন গান জানিস ?
–না, কী করে জানবো ? স্কুলের বন্ধুরা তো সব ছিল হিন্দি গান আর হিন্দি সিনেমার কীট । রাঙামা হিন্দি টিভি সিরিয়ালের পোকা । নবনীতাবৌদি গিটারে হিন্দি ফিলমের সুর বাজাতো ।
–হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…
–শুনতে পাবে পাবলিক । মাছের বাজার মানেই বাঙালির জমায়েত ; অনেকে তোকে-আমাকে ভালোই চেনে ; হয়ত আমাদের রিলেশানশিপের খবরও ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে ।
–বুলশিট, তুই এখনও আমাকে নেগলেক্ট করার ডিজাইন বজায় রেখেছিস কেন বল তো ? তোর দায়িত্ব চাইছি বলে ভয় পেয়ে গেলি নাকি, কাওয়ার্ড ?
–ক্লাস টেন থেকেই তো কত ছেলে তোকে লাইন মারত, নিজেই ঢিল দিসনি, নয়তো দায়িত্ব পেয়ে যেতিস এতদিনে। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর লাইনে ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে থাকতিস ।
–স্টপ ইওর জিবারিশ । যত্তোসব ফালতু ছোকরার দল । তোর তো ক্লাস টেনেই গোঁফের রেখা আবছা বেরিয়ে এসেছিল, তবু তুই লাইন মারার সাহসটুকু দেখাতে পারিসনি । আমি না এগোলে তুই বোধহয় চেপেই রাখতিস নিজেকে ।
–তখন বেশ ক্যাবলা ছিলুম রে, তোকে দেখলেই তোর বুকের দিকে চোখ চলে যেত, আড়ষ্ট ফিল করতুম, কথা বলতে পারতুম না, ভাবতুম কোন বিষয়ে কথা বলব । তাছাড়া, মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে আমি তোদের বাড়ির চাকরের স্তরের । মালিকের মেয়েকে প্রণয়-প্রস্তাব কোন চাকরেই বা দ্যায় ? ওসব নাটক-নভেলে হয় ।
–শাট আপ, ইউ সাকার…, গালাগাল এসে যাচ্ছে মুখে ।
–কেমন বোকা-বোকা কথা বলছি না আমরা ?
–হ্যাঁ, বর-বউ হতে পারত কিন্তু হল না, এরকম একজোড়া বোকা-বোকির গল্প ।
রাতে, খাওয়া-দাওয়ার পর, ইতুকে বলল অমিত, ও একটা মিটিঙে , বিহারশরিফে, এসেছিল, বাবার সঙ্গে।
–হোলি শিট, তোর বাবাও এসেছিলেন ?
–হ্যাঁ । উনি তো মেশেন না কারোর সঙ্গে ।
–দায়িত্বটা কী তা বললি না তো ? বিছানায় বসে জিগ্যেস করল ইতি ।
–এতো ঘেঁষে বসিস না, আবার গোলমাল হবে শেষকালে ? ভাববেন, ছাড় দেয়া হয়েছে, ব্যাস, মাখামাখি করছে রাতদুপুরে ।
–কারোর অমন মাথাব্যথা নেই; ওসব নিয়ে চিন্তা করিসনি । বরং তোর ঘাড়ে চেপে যদি কেটে পড়ি তো ওনারা বেঁচে যান । হয়তো ওনারা আমাকে এই স্পেসটা সেকারণেই ছেড়ে দিলেন । এখন দেখার যে তুই কীভাবে রেসপণ্ড করিস ।
–এই তো সবে এতদিন পর দেখা হল, তুই বেশ ফ্রিলি গল্প করতে পারছিস , মনের কথা খুলে বলতে পারছিস । আগেই বলেছি, আমি যে কাজটা দেবো সেটা বেশ সিম্পল কিন্তু বিপজ্জনক । ভেবে উত্তর দিস । কাল সকালে আমার যাওয়া পর্যন্ত তোর হাতে সময় থাকবে ।
–কী কাজ, শুনি, ঘোড়ার ডিম বিপজ্জনক । কাউকে বোমা মারতে বা গুলি মারতে বলবি নাকি ? কিংবা সোনার বিস্কুট এখান-ওখান । তা আমি পারব না, আগেই বলে রাখলুম ।
–বলেছি তো, মনে করে রাখ । তোর ক্লিনিকে বা বাড়িতে সবুজ বা নীল শার্ট বা টিশার্ট পরা একজন একটা চিঠি দিয়ে যাবে, হয়ত স্মার্ট নয়, বিহারি বা বাঙালি না-ও হতে পারে সে, ইংরেজিতে একটা-দুটো কথা বলে চিঠিটা দিয়ে চলে যাবে । তুই তা নিজের কাছে রেখে দিবি । পরে, দু-এক সপ্তাহের ভেতর বা মাসখানেক পরেও হতে পারে, ওই খামটা আরেকজন নিতে আসবে, তার গায়ে ছাইরঙা বা ধূসর শার্ট বা টিশার্ট থাকবে ।
–ওঃ, ডাকবাক্সের কাজ, পারব না কেন ? স্মাগলিং-টাগলিং নয়তো ? যেরকম দাড়ি-গোঁফ বাবরিচুল চেহারা করেছিস, দেখে তো স্মাগলার বলেই মনে করবে লোকে । লুঙ্গি পরে তোকে মানিয়েও গেছে ।
–না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের কাজ ।
–তুই আসবি না ? তুইও তো আসবি, দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে, হলুদ টিশার্ট আর জিন্স পরে, স্মার্টলি । ফর মি ?
–সিরিয়াস ইশ্যু ।
–ওকে, টেকন । কিন্তু আমি কেবল তোর ওই প্রক্সিদের নিয়ে ডিল কোরবো নাকি ? তুই যদি না আসিস তাহলে কেন বেগার খাটতে যাবো উটকো লোকেদের জন্য ?
–তা-ই কর কিছুদিন । কিন্তু আবার বলছি, অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ । ওই খামসুদ্দু তুই ধরা পড়লে যে ধরণের ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বি তা মোটেই সুখকর নয় ।
ইতু নিঃশব্দে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলল, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে । তারপর অমিতের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলুম, কিন্তু এক শর্তে, ন’মাসে-ছ’মাসে তোকেও আসতে হবে । ইউ মাস্ট, আদারওয়াইজ দি ডিল ইজ ক্যানসেল্ড ।
অমিত আবার এসেছিল, প্রায় এক বছর পরে, ক্লিনিকে, বিনা দাড়ি-গোঁফে, হলুদ টিশার্ট আর জিনস পরে, চোখে রোদ চশমা । তার মাঝে নীল-টিশার্ট ধূসর-টিশার্ট যুবকেরা ক্লিনিকে খাম দিয়ে গেছে আর নিয়ে গেছে, বেশ কয়েকবার । ইতুর কি খাম খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি কী আছে ভেতরে ? হয়েছে । কিন্তু সেলোটেপে মোড়া চিঠি খোলেনি । নিজেকে বুঝিয়েছে যে অমিতকে জানতে হলে ওর মুখোমুখি বসেই জানতে হবে, গোপন কাজকর্ম, তা যাই হোক, স্মাগলিং বা লুকিয়ে বেড়ানো বিপ্লব, না সিক্রেটিভ কোনো ধার্মিক কাল্ট, কথা বলে জেনে নিতে হবে ।
অমিতের চেহারা বেশ রোদঝামা হয়ে গেছে, স্মার্ট পোশাক সত্বেও, আঁচ করল, ইতির মগজের ডাক্তার । অমিত ক্লিনিকে ঢুকে চেয়ারে বসে স্মিত হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলে, ইতি বলল, প্রায় শিশুর আদুরেপনা মিশিয়ে, তোর একটা খাম পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি তো ?
–খাম, কই দেখা, বিস্ময়ে বলল অমিত ।
–এই যে, দ্যাখ, পড়ে আছে সেই কবে থেকে ।
— কই দে তো, দেখি ।
টেবিলের ওপর চারভাঁজ করা প্রেসকিপশানের কাগজে, দেখল অমিত, লেখা রয়েছে, ‘যদি বিপদ শেয়ার করি, তাহলে বেডশিট শেয়ার করব না কেন’ ? ইতি বলল, তারিখ দেখেছিস, ছয় মাস আগের । কত এক্সপেক্ট করেছি তোকে । ইন ফ্যাক্ট আমার এই ক্লিনিক চলে না, রোগি আসে মাসে হয়ত দুজন, কখনও আসেই না, তবু খুলে রেখেছি, স্রেফ তুই একদিন হঠাৎ আসবি বলে । আজ থেকে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেল । চল , বাড়ি চল, বাড়িতেও সবাই বলে যে কেন মাছি মারছিস বসে-বসে, ভাড়া গুনছিস, বাবার দেয়া জমানো টাকা নষ্ট করছিস। তারপর, প্রায় কান্নামাখা কন্ঠস্বরে বলল, কী করে ওনাদের বলতুম যে আমি তোর অপেক্ষায় বোকার মতন হাঁ করে বসে থাকি ।
অমিত থ । অনুমান করতে পারেনি যে রহস্যময় খামগুলোর মাধ্যমে নৈকট্যকে বিপজ্জনক করে ফেলেছে। কাগজের লেখাটার দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল । বলল, যে ভালোবাসার কথা বলছিস, তা আমি যে জীবন কাটাই, তাতে কতটা প্রযোজ্য, তা যারা এই জীবন যাপন করে কেবল তারাই বুঝতে পারবে । আমি তো ভবঘুরে, বলেইছিলুম তোকে । তোকে তো বলেছি কী ধরণের লাইফ লিড করছি । বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেও তাঁদের সঙ্গে নেই, তাঁরা আমার কেউ নন । এখন মনে হয় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তাঁদের খোঁজে বেরোনোটাই ছিল ব্লাণ্ডার ।
ইতি ক্লিনিকের চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলল, চল, চল, যেতে যেতে কথা বলা যাবে । ক্লিনিক আমি বন্ধ করে দিচ্ছি আজ থেকে, তোর এই মোবাইল ডাকবাক্সে বার্তা ফেলতে হলে মেসেঞ্জারদের আমার বাড়ি আসতে হবে । ইতুর কব্জি শক্ত করে ধরে অমিত বলল, তোর নির্দেশমতো যে পোশাক পরে এলুম সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করলি না ।
–তুই তাহলে শুনতে পাসনি ; চোখ দিয়ে করা মন্তব্য শোনার মতন ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছিস । বোতাম খুলে তোর বুকের চুলও দেখাচ্ছিস, তোর বুকে যে চুল গজিয়েছে কী করে জানব । তা জানার জন্যও তো করাঘাতের অধিকার দরকার, নয়কি, বিপদ শেয়ার করার অধিকার থেকে সামান্য পৃথক অধিকার ?
–তোদের বাড়িতে চড়ুইপাখির বাসা আছে, মনে আছে, দালানের কড়িকাঠের ফাঁকে ? কখনও লক্ষ করেছিস কি যে মাদি চড়ুইপাখিকে ইমপ্রেস করার জন্য পুরুষ চড়ুইপাখিরা তাদের কালো বুক দেখাবার প্রতিযোগীতা করে ?
ক্লিনিকের শাটার নামিয়ে, তালা দিয়ে, ফুটপাতে নেমে, অমিতের দিকে তাকিয়ে ইতু বলেছিল, ঠিক কী বলতে চাইছিস বুঝতে পারলুম না । তুই কি বলতে চাইছিস যে তোর হৃদয় উনিশ শতকের গৌরবগাথায় বর্ণিত মসীলিপ্ত ভিলেনের মতন হয়ে গেছে ? নাকি বলতে চাইছিস যে তুই মাদি চড়ুইপাখিটাকে জয় করতে এসেছিস ? ভুলে যাচ্ছিস কেন যে মাদি চড়ুইপাখিটাই তোকে জয় করার জন্য যুদ্ধ করেছিল । ওহ, ইনটলারেবল, জাস্ট ইনটলারেবল ।
–না সত্যিই অনুমান করতে পারিনি । না, অনুভব করতে পারিনি বললে যুৎসই হয় ।
–বাঃ, আমার কথামতন পোশাক পরে এক বছর পর উদয় হলি, আর অনুভব করতে পারিসনি, ইউ সেল্ফসার্ভিং জোকার ? নিজেকে ভুল বুঝিয়েই কি তুই তোর রহস্যময় জীবনকে মিনিংফুল করে তুলতে চাইছিস?
তারপর যোগ করল, স্কুটারটা বেচে দিয়েছি । ভাড়া গোনার জন্য টাকার দরকার ছিল । বলল ইতু, ফুটপাতে পড়ে-থাকা শালপাতার দিকে তাকিয়ে ।
একটা রিকশাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল অমিত । ইতু বলল, রিকশা ডাকছিস কেন, হাঁট না পাশাপাশি । চল গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাইনি । গিয়ে বসি কিছুক্ষণ । কিছু কথা স্পষ্ট করে নে্য়া দরকার, বাড়িতে গেলে দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করতে হবে । প্রিভেসি নেই ।
–বিশ্ববিদ্যালয় ? গঙ্গার ধারের কথা ভাবছিস ? কিন্তু গঙ্গা তো দূরে সরে গেছে, সরকার ভাবছে গঙ্গার ধার দিয়ে মেরিন ড্রাইভের মতন পথ বানাবে । তুই তোর শহরে থেকেও জানিস না, দ্যাখ, আমি বাইরে-বাইরে থাকি, থাকি বলা ভুল হল, অ্যাকচুয়ালি থাকিই না কোথাও, তবু জানি শহরের কথা ।
–ও, তুই তাহলে শহরে আসিস, আর দেখা না করে কেটে পড়িস ? আর ইউ চিটিং অন মি ?
–না, শহরে আজকেই এলুম, সেদিনকার পর, এবারেও বাবার সঙ্গে নালান্দাতেই এসেছিলুম, এর-তার মুখে শহরের পরিবর্তনের কথা শুনতে পাই । তোর সঙ্গে দেখা করব বলেই এলুম পাটনায় । এত কাছে এসে ফিরে যেতে পারলুম না । মনের ভেতরের ব্ল্যাংক স্পেসটায় তুই ক্রমশ জায়গা করে নিয়েছিস, বাবা-মায়ের সঙ্গে তো এখনও আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারিনি ; ওনারাও তুমি থেকে তুইতে আসতে চাননি । শুধু তুই-ই একমাত্র যে আমার কাছে একই সঙ্গে তুমি আর তুই । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমিত বলল, চল ওই অমলতাস গাছটার তলায় বসি, রাস্তার দিকে পেছন ফিরে বসা যাবে ।
–কেন ? আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে ?
–তুই আমার সঙ্গে বসে আছিস তা কেউ দেখে ফেলতে পারে, তোর সঙ্গে আমি নয় ।
অমলতাসের হলুদ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো চারিদিকে । সিটের ওপর পাখিতে হেগে রেখেছে । তার ওপরই বসল দুজনে । অমিত জিগ্যেস করল, কী বলবি বল ?
অতনুর হাত নিজের কোলে নিয়ে ইতু বলল, আমি সেল্ফ ডেসট্রয় করার জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছি । জীবন সম্পর্কে তিতিবিরক্ত । জানি না কী করব । এনজিও জয়েন করার কথা ভাবি । কোনো পারপাস নেই জীবনে । এর চেয়ে কমার্স পড়লে টাকাকড়ির গুণ ভাগ যোগ বিয়োগ নিয়ে থাকতে পারতুম । বাবা-মা মারা যাবার পর আমি রাডারলেস হয়ে গেছি, কোনো নোঙর নেই । ওনাদের ইনশিওরেন্সের টাকাটা এখনও পেলুম না।
অমিতের হাত নিজের ঠোঁটের ওপর চেপে ধরেছিল ইতু, ছাড়িয়ে অমিত বলল, চল, তোর ক্লিনিক আরেকবার খুলতে হবে । পাটনা শহরের পথে, অমলতাস গাছের তলায়, এভাবে কাছ-ঘেঁষটে বসে থাকার চেয়ে তোর ক্লিনিকের নিভৃতি ভালো ।
–হ্যাঁ, আমাদের বাড়ির দোতলার বারান্দার চেয়ে তো অবশ্যই ভালো। আসলে আমার কথাগুলো কী ভাবে তোকে বলব, কোথায় গিয়ে বলব, তোকে দেখামাত্র যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তাতে শাটার নামিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলুম । চল, ক্লিনিকেই যাই ।
রিকশা থেকে নেমে, ক্লিনিকের তালা খুলে শাটার ওঠাতে সাহায্য করল অতনু, বলল, বেশ ভারি তো, রোজই এভাবে খুলিস আর বন্ধ করিস, বলে, শাটারটা নামিয়ে দিল অমিত । নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে ইতু বলল, এবার বল, যা জানতে চাইছি তা বল, কেউ নেই এখানে, কেউ তোর পেছু নেয়নি, রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল ।
–আমি রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি করি । তোকে তাতে ব্যবহার করি ।
–তাতে কী হয়েছে ! রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি তো আজকাল সবাই করছে, কে করছে না শুনি ? রাষ্ট্রবিরোধী-ফিরোধি বলে কিছু হয় না । দুশ্চিন্তার কী আছে ? সরকার যারা চালায় তাদের কুকর্ম দেখে, আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের স্ক্যাম প্রতিদিন কাগজে পড়ে, সব পাবলিকই মনে-মনে রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে পড়েছে । ধর্ষক, খুনি, ডাকাত সকলেই তো দিল্লির তখত-এ-তাউসে পৌঁছোচ্ছে । এই তো সেদিন মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধি দিল্লিতে ওনার বক্তৃতায় বলেছেন যে রিলায়েন্স কোম্পানি এত বেশি ক্ষমতা রাখে যে ভারতে তারা একটা সমান্তরাল রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে ? তুই ভাবছিস বোধহয় আমি কোনো খবরই রাখি না । সারাদিন ক্লিনিকে বসে কী করি ? পাশের কাপড়ের দোকানটা থেকে হিন্দি আর ইংরেজি কাগজ তিনটে এনে সারাদিন পড়ি ।
–বাবা-মা যে রাজনীতি করেন, তা-ই করি ।
–জানি, অতটা বোঝার মতো জ্ঞান আছে আমার । প্রশ্ন হল, আমি কি এখানে একা পড়ে থাকব, তোর ডাকবাক্স হয়ে ?
–আমি তো কোনো নির্ণয় নিতে পারি না, আই অ্যাম জাস্ট এ ওয়ার্কার, ওনারা যে নির্ণয় নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তুই ভালোই কাজ করছিস । তাছাড়া, কোনো বিষয়ে কথা বলার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার । নেতারা কয়েকজন মিলে নির্ণয় নেন, তাঁরা যে কারা তাও আমি জানি না । তবে, শুনেছি, তাঁদের দুজন তোকে যাচাই করে গেছেন । তুই আমার জন্য নয়, তাঁদের জন্য ডাকবাক্সের কাজ করছিলিস। রোগি সেজে তোর অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্লিনিকও তাঁরা দেখে গেছেন ; তোর মতন ডাক্তারই ওনাদের প্রয়োজন, কেননা তুই আসেপাশে যা পাওয়া যায় তাই প্রয়োগ করে উপশম ঘটাবার চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিস, এম বি বি এসও এক বছর পড়েছিলি ।
–তাহলে কবে তুই আমাকে তোদের সঙ্গে নিবি, আই ওয়ান্ট এ ক্লিয়ার আনসার, নো মোর ডিলিড্যালিং ? ক্লিনিকটা আমাকে বন্ধ করতেই হবে, কেননা বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য পাই না, ভাড়া দিই বাবা যে টাকা আমার ভাগ্যে বরাদ্দ করে গেছেন তা থেকে, ফিক্সড ডিপোজিট ফুরিয়ে গেছে, তাই স্কুটারটা বিক্রি করতে হল । ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অফ দিস রাট, আমার বডি একটু-একটু করে শবের আদল পাচ্ছে ।
রিভলভিং চেয়ারের কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে ইতুর চোখে চোখ রেখে, অমিত বলল, আমি কি তোকে চুমু খাবো ?
ইতু কেঁদে ফেলেছিল, বলল, চড়ুইপাখি তো কালো বুক দেখিয়ে জিতে গেছে । অমিতের অনুমতির অপেক্ষা না করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল ইতু, কয়েক সেকেন্ড পর তুলে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে বসে, ফুঁপিয়ে কাঁদা আরম্ভ করল । বলল, কেঁদে নিই, অনেক দিনের কান্না জমে আছে । কান্না থামার পর সামলে নিয়ে বলল, চল বাড়ি যাই, অন্নমা, মানে সুশান্তজেঠুর মা, তোকে দেখে খুশি হবেন । সুশান্তজেঠু ওনার ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন, তারপর থেকে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন ।
–তাহলে না যাওয়াই ভালো । সুশান্তজেঠুর অভাব আমাকে দিয়ে মিটবে না। বরং ঘায়ে খোঁচা লেগে আঘাত বেড়ে যাবে । তোদের বাড়ির সবাই শুরুতেই মানিয়ে নিলে অবস্হা এতটা নিরাশাজনক হতো না । সুশান্তজেঠু আর ওনার বউ-ছেলেকে অ্যাকসেপ্ট না করার তো কারণ ছিল না । তোর বাড়ির লোকেরা তো আর ক্রিমিনাল গ্যাঙটাকে নেমন্তন্ন করে আনছিল না ।
–না, সুশান্তজেঠু নাকি ওদের ক্রিমিনাল দলের ডন হয়ে গিয়েছেন, ওনার শশুর নিজের নেতৃত্ব সুশান্তজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে।
–হ্যাঃ, ওসব তো তোরা এর-তার মুখে শুনেছিস । তোদের বাড়ি থেকে কেউ কি গিয়েছিল একবার ? গিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল ? ওরা তো তোদের বাড়ির কাউকে খুন বা কিডন্যাপ করত না । যা করার তা তো করেই ফেলেছিল ওরা, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে ওদের গ্যাঙ লিডারের মেয়ের বিয়ে দিয়ে । সম্বন্ধটা শুধরে নিলে সকলেরই মঙ্গল হতো ।
–কত রেসপনসিবলি কথা বলছিস রে, ইউ হ্যাভ রিয়্যালি গ্রোন আপ উইথ ইওর চেস্ট হেয়ার । চল না সুশান্তজেঠুর আস্তানায় ট্রিপ মারি ।
–যাবো । সময় হলে যাবো । এবার আমি যাই ।
–এক্ষুনি ?
–হ্যাঁ, আবার তো আসব ।
–ক্লিনিক কিন্তু বন্ধ করে দিচ্ছি । তোর মেসেঞ্জাররা কি আমাদের বাড়ি চিনে নিতে পারবে ? আমাকে চিনতে পারবে ? কয়েকবার তো নতুন মেসেঞ্জার দেখেছি ।
–তারা সব কিছুই পারে ।
–তাহলে পুরোটা কেঁদে নিতে দে, বলে, সান্নিধ্যের সঙ্কোচ কাটিয়ে, অমিতকে জড়িয়ে ধরেছিল ইতু । কান্না শেষ হলে চোখ পুঁছে বলেছিল, চড়ুইপাখিরা বসন্তঋতুতে একশকুড়িবার প্রেম করে, তা জানিস ?
–না, জানা ছিল না ; তবে, সিংহের কেশর কখন বাদামি থেকে কালো হয়ে ওঠে তা জানি ।
–হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস । পরের বার যখন আসবি তখন কাঁধের ওপর অদৃশ্য কালো কেশর নিয়ে আসিস, মনে থাকে যেন । জাস্ট টু রিমাইণ্ড ইউ, সিংহিগন্ধের ঋতুতে সিংহরা দিনভর পনেরো মিনিট অন্তর প্রেম করে ।
.
শেষ
মোবাইলে বড়জেঠিকে রিং দিয়ে সুশান্ত ঘোষ শুনতে পেলেন ওনার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর, সুশান্ত…সুশান্ত…কাল থেকে তোকে রিং দিচ্ছি…কতবার চেষ্টা করছি…সুইচ অফ আসছিল….তুই কোথায়…অপু কোথায়…কাগজে খবর পড়ে অব্দি ঘুমোতে পারিনি…খেতে বসে রুচি হল না…শুনছিস তো…সাড়া দিচ্ছিস না কেন…সুশান্ত… অপুকে পাঠিয়ে দে…আমি ওকে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখব…সুশান্ত শুনতে পাচ্ছিস…কথা বলছিস না কেন…আমার কথা শোন…তুই চলে আয়…বউকেও নিয়ে আয়…আবার সব আগের মতন ঠিক হয়ে যাবে…তিনজনেই চলে আয়…পুলিশ তোদের এখানে খুঁজবে না…পুলিশ জানে তুই ত্যাজ্যপুত্র…শুনতে পাচ্ছিস ? উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমে ফোঁপানি এবং ফোঁপানি ক্রমে কান্নায় রূপান্তরিত হলে, সুশান্ত ঘোষ বললেন, এই নাও, শোনো ।
লুঙ্গিতে গোঁজা সেমিঅটোমেটিক পিস্তলটা বের করে একটা গুলি ওপর দিকে চালিয়ে পরখ করলেন কাজ করছে কিনা । গুড, করছে ।
শোকার্ত আতঙ্কিত বেবি, দড়ির খাটে, রাতের পর রাত ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি-মাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পাশ ফিরে শুয়ে, চাপা ফোঁপানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল শরীর জুড়ে, খাটের শিয়র থেকে দীর্ঘ এলোচুল নামিয়ে, কী হল, কী হল, বলতে-বলতে খাট থেকে নেমে, ওনার, সুশান্ত ঘোষের দিকে ছুটে এলে, বেবিকে লক্ষ করে পর-পর দুটো গুলি চালালেন, বুকে আর মাথায় ।
তারিণী মণ্ডলের মতনই, বেবির খুলি ফেটে দুধে-আলতা মগজ ছিৎরে পড়ল । মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বেবি, প্রতিদিন শাম্পু-করা সুগন্ধিত চুল উড়িয়ে ।
দেহরক্ষীরা, যারা সুশান্ত ঘোষের পাহারায় চ্যাঁচারির বেড়ার বাইরে আর নৌকোয় বন্দুক হাতে বসেছিল, তারাও কী হল, কী হল, কারা ফায়ার করছে, বলতে-বলতে চালাঘরের দিকে দৌড়োল ।
সেমিঅটোম্যাটিক পিস্তলের নল নিজের ডান কানের ওপর করোটিতে চেপে , তাকিয়ে দেখলেন বালির ওপড় পড়ে-থাকা তাঁর এত বছরের সঙ্গিনী, তারিণী মণ্ডলের মেয়ে বেবির মৃতদেহের দিকে, তারপর ট্রিগার টিপলেন সুশান্ত ঘোষ ।
বালিতে ছিটকে পড়ে-যাওয়া মোবাইলে বড়জেঠির কান্না-মেশানো কন্ঠস্বর আতঙ্কিত আর্তনাদে বলে চলেছে, গুলির আওয়াজ কেন…কী হচ্ছে ওখানে…সাড়া দিচ্ছিস না কেন…সুশান্ত..শুনতে পাচ্ছিস…গুলিগোলা চলছে কেন…কথা বলছিস না কেন…ঠিক আছিস তো…তোর ছেলে কোথায়…সুশান্ত…সুশান্ত…বলছি তো অপুকে পাঠিয়ে দে…তোর বউকে নিয়ে চলে আয়…সুশান্ত…সুশান্ত…
মোবাইলটা উচ্চকন্ঠে কাঁদা আরম্ভ করল উড়ন্ত বালির সদালাপী হাওয়ায়, ঝিরি-ঝিরি রঙ্গপ্রিয় বালির অবাক হাসিখুশি দিয়ে হয়তো ক্রমে ঢাকা পড়ে যাবে আজ রাতের অমনোযোগী অন্ধকারে । বর্ষায় দিয়ারার সঙ্গেই হয়তো চলে যাবে জলের তলায় শেষ কান্নার বর্ষীয়ান স্মৃতি নিয়ে, তারপর একদিন চিকচিকে বসন্তে মাথাচাড়া দেয়া নতুন চরের পলিমাটির ওপর বোবা জেগে উঠবে কোথাও, খুরপি দিয়ে কেয়ারি-করা পলতালতা বা তরমুজলতার হলুদ ফুলের আড়ালে ।