ঔরস – ৩

এগারো

         দণ্ডকারণ্যে যাবো আপনার বাড়ি, যদি নিয়ে যান কখনও । আর হ্যাঁ, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাবো, আপনি আমার অ্যাবসেন্সটা ম্যানেজ করে দেবেন । আপনি তো পি এইচ ডি করছেন , অসুবিধা হবার কথা নয় । অপু বলল সনাতন সরকারকে ।

         –চলিস আমার সঙ্গে, একা তুই রাস্তা গোলমাল করে ফেলবি । নারায়ণপুর জেলাসদর হলেও, এখনও ডেভেলাপ করেনি ।

         –আমার বাবার পদবি ঘোষ হলেও, আমার মা বিহারি গংগোতা পরিবারের মেয়ে, ভাগলপুর শহরে নয়, আমাদের বাড়ি গঙ্গার চরে, দিয়ারায় । দিয়ারা শুনেছেন তো ? মলম লাগাবার মতো করে কথাগুলো বলল অপু, ক্যান্টিনে বসে মসালা দোসা খেতে-খেতে, সনাতনকে ।

         –গংগোতা ? কাস্ট ? তোর পাঞ্জাবি গার্লফ্রেণ্ড সে-কথা জানে, যে মেয়েটা সব সময় তোর সঙ্গে চিপকে থাকে ?

         –হ্যাঁ, বিহারের লোয়েস্ট নিম্নবর্ণ । হ্যাঃ, নিকিতা মাখিজা পাঞ্জাবি নয়  , ও সিন্ধি । ওকে আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছি, বিশ্বাস করে না, ভাবে কাটিয়ে দেবার জন্য গুল মারছি । বলেছি  প্রায়ভেট ডিটেকটিভ দিয়ে ইনভেসটিগেট করাতে, সে-প্রস্তাবকেও মনে করে ওকে ছেড়ে দেবার আরেক চাল । দিল্লির নাইটলাইফ এনজয় করা-মেয়ে, প্রায়ই ডিসকোয় গিয়ে টাল্লি হয়ে যায়, আর বাড়ি পৌঁছে দিতে হয় আমাকে । ওর বাবা-মা কেন যে অমন ছুট দিয়ে রেখেছেন, জানি না । ওকে আমাদের দিয়ারায় নিয়ে গেলে ওর হার্টফেল করবে।

         –নিম্নবর্ণের আবার হাই-লো আছে নাকি রে, বওড়া ? এনিওয়ে, তোর বাবার প্রেম তো স্যালুট করার মতন অসমসাহসী ঘটনা রে । তোর বাপ পারলেন, তোর গার্লফ্রেণ্ডও পারবে, সিন্ধিরা বেশ সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে, ওরাও উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল, কিন্তু সরকার ওদের ধরে-ধরে আদিবাসীদের মাঝখানে পোঁতেনি, যেমন আমাদের পুঁতেছে । তবে টাকাকড়িকে ওরা মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসে ; চেক করে দেখেনিস তোর কাঁচা টাকা ওড়ানো দেখে তোকে ফাঁসিয়েছে কি না । সেক্স-টেক্স করলে কনডোম পরে করিস, মনে রাখিস এটা ইনডিয়ার রাজধানি, এখানে মানুষের মুখের লালায় যত  সায়েনাইড, তার চেয়ে বেশি সায়েনাইড তাদের চুতে আর লাঁড়ে।

         –প্রেম নয়, আমার মায়ের বাবা আমার বাবাকে কিডন্যাপ করে আমার মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন । মায়ের বয়স তখন চোদ্দ বছর আর বাবার একুশ । মা লেখাপড়া শেখেননি, স্কুলের কোনো বিল্ডিংও দেখেননি আজ পর্যন্ত ; বাবা কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক । সেই থেকে বাবা শশুরবাড়িতে আমার নানা, মানে দাদুর সঙ্গে থাকেন, দিয়ারায় চাষবাসের উন্নতির কাজ দেখেন । বাবা আমার মাকে নিজের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাননি, একাই গিয়েছিলেন বিয়ের পরে।  গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে মাকে ওই বাড়িতে অ্যাকসেপ্ট করা হবে না । তারপরে আমাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকেও অ্যাকসেপ্ট করা হয়নি ।

         –স্ট্রেঞ্জ । আমি ভাবছিলাম আমার জীবনের ঘটনাটাই ইউনিক । তুই তো নিজেই একটা ইউনিক সোশিওলজিকাল প্রডাক্ট । তো তুই বাংলা শিখলি কী করে ?

         –বাবার কাছে । আমি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি ।

         –বাবা বাঙালি হলে না শেখার কারণ নেই, যদিও আমরা মাতৃভাষার, মানে মায়ের ভাষার কথা বলি, আদপে কিন্তু বাবার ভাষাটাই শিখি সবাই । তুই তো গ্রেট ।

         –আপনার জামাইবাবুর বাড়ির ঠিকানাটা দেবেন আমায় । নিকিতাকে প্রথমেই দিয়ারায় আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলে ওর মাথা খারাপ হয়ে যাবে । আমার তো বাঙালি আত্মীয়স্বজন নেই, আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবো ওকে । যদি আপনার ফ্যামিলিকে দেখে অ্যাডজাস্ট করতে পারে, তাহলে নিয়ে যাব দিয়ারার গংগোতা পাড়ায় ।

         –লিখে নে না । আমি বরং জামাইবাবুকে একটা চিঠি লিখে তোকে দিয়ে রাখছি, যখনই তোর গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে যাবি চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে যাস । তোর নাম জানিয়ে ফোন করে দেব । আমরা মালকানগিরি থেকে চলে গেছি ছত্তিশগড়ে, আমার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান এড়াবার জন্য।  দিদি-জামাইবাবু নারায়ণপুরে বাড়ি করেছেন, এখন তো নারায়ণপুর জেলা শহর, আগে যাতায়াতে বেশ অসুবিধা হতো । সরি ফর দ্য অ্যাবিউজেস । সামলাতে পারি না, বুঝলি । এত ছোটো ছিলাম যে মা-বাবার মুখও মনে নেই । ওনাদের মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। পুলিশের লোকেরা লোপাট করার জন্য শব তুলে-তুলে  জলে ফেলে দিয়েছিল ।

         –ভাগ্নের হিউমিলিয়েশান ? অসুবিধা না থাকলে বলতে পারেন ।

         –১৯৭১-এ ঢাকায় আমার দিদিকে চারজন রাজাকার রেপ করেছিল, জামাইবাবু অ্যাবর্ট করাতে দেননি। ইন ফ্যাক্ট, জামাইবাবু দিদিকে মালকানগিরিতে বিয়ে করেছিলেন, দিদি যখন প্রেগন্যান্ট, বিষ খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন দিদি।  তখন মালাকানগিরিতে ডাক্তার-ফাক্তার ছিল না, জঙ্গল এলাকা, নব্বুই বছরের একজন বুড়ি ওকে জড়িবুটি খাইয়ে বিষ বের করে দিলে, জামাইবাবু দিদিকে ইমোশানাল সাপোর্ট দ্যান, বাচ্চা হবার কয়েকমাস আগে বিয়ে করেন ।

         –আমি তাই ভাবতুম যে আপনি দলিতদের এক্সট্রিম লেফটিস্ট ইউনিয়ানে কেন ঢুকেছেন । আপনার পারসোনাল ব্যাকগ্রাউণ্ড তো জানা ছিল না ।

         –এক্সট্রিম লেফটিস্ট ? স্ট্রেঞ্জ ওয়র্ড । দিল্লির সংসদবাজ লেফটিস্টদের দেখছিস তো ? অনেকে জে এন ইউতে এসে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে মাঝে-সাঝে, হোয়াট ফর ?

         –দণ্ডকারণ্য তো এখন শুনি আলট্রা লেফটিস্টদের ঘাঁটি ।

         –এই লেফটিস্ট ওয়র্ডটা কাইন্ডলি বারবার উচ্চারণ করিসনি । পোঁদ জ্বালা করে । আই হেট দেম ।

         –অলটারনেটিভ ওয়র্ড কী ?

         –প্রতিশব্দ নেই । মাওওয়াদকে প্রতিশব্দ বলা যায় না । মাওওয়াদ ইজ এ সেল্ফকনফিউজড ডগমা ।

        –কেন ? আমি যদিও মাওওয়াদ সম্পর্কে বিশেষ জানি না, কাগজে পড়ি, ব্যাস ওইটুকু । সিলেবাসে্ও নেই।

         –ওদের লক্ষ্য হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জবরদস্ত গণআন্দোলন, ইংরেজি মাইটিকে বাংলায় জবরদস্ত বলা ছাড়া অন্য ওয়র্ড আছে কিনা জানি না ।

         –আমার বাংলা নলেজ আপনার চেয়ে খারাপ, হাফ বেকড । ইন ফ্যাক্ট সাম্রাজ্যবাদ ব্যাপারটাই যে কী তা ঠিকমতন বুঝি না । সবকটা রাজনীতিককেই তো মনে হয় সাম্রাজ্যবাদী, যে যার নিজের এমপায়ার খাড়া করে চলেছে ।

         –কী করে তুই স্নাতক হলি রে ? টুকলি ? না তোর হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষায় বসেছিল ? মওকাপরস্ত তেঁদুয়া কহিঁকা ।  হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকে বিধ্বস্ত করতে চায় মাওওয়াদিরা, গড়ে তুলতে চায় পাওয়ারফুল আর্বান মুভমেন্ট, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সাহায্যে, কেননা কেতাবি মার্কসবাদ মেনে সশস্ত্র কৃষকদের সংঘর্ষ এদেশের কৃষিকাঠামোয় দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় । ভারতীয় বহুত্বওয়াদি বাস্তবতার ক্ষেত্রে ওগুলো কোনোটাই লাগু হয় না ; তাছাড়া পৃথিবীতে কী ঘটছে সেদিকেও তো তাকাতে হবে । পৃথিবী তো রামচন্দ্রের বনবাসের দণ্ডকারণ্যে আটকে নেই, রামচন্দ্রের নির্বাসনের পথটাই নাকি রেড করিডর ।

         –রিয়্যালি ? এই ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা জিনিসটাও বুঝলুম না ।

         –যা যতটা বুঝেছিস, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাক । জে এন ইউতে কয়েকজন নেপালি ছাত্র আছে, ওই তুই যাদের বলছিস একস্ট্রিম বা আলট্রা লেফটিস্ট । তাদের একজন, চিনিস বোধহয়, জনক বহুছা, ওর মতে রেড করিডর হল যে পথে গৌতম বুদ্ধ নেপাল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাণী বিলিয়েছিলেন ভারতবর্ষের গ্রাম-গঞ্জ-বনপথে।

         –বলুন না, থামলেন কেন ? ইনটারেসটিং ।

         –দণ্ডকারণ্যে ওরা বৌদ্ধবিহার বানায় না, যা বানায় তার নাম দলম । দলমরা বানায় জনতম সরকার। দলম, জনতম এটসেটরা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিস যে ডিসকোর্সটা তেলুগু ডমিনেটেড । ডিসকোর্স বুঝিস তো, না তাতেও গাড্ডুস ? এর আগে মানুষের ইতিহাসে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতরা সন্ত্রাসের সাহায্য নেয়নি । ওদের মতে শোষিতদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এখন সন্ত্রাস ।

        অপু নিজেকে নিঃশব্দে বলতে শুনল, সনাতন বোধহয় মায়াবতীর দলের ভাবুক, আর এগোনো উচিত হবে না । বলল, আপনার পিসতুতো দিদির কথা বলছিলেন, যিনি আপনার অভিভাবক, তাঁর গল্প বলুন না , আপনার ভাগ্নের হিউমিলিয়েশানের, যদি অসুবিধা না থাকে।

         –বললাম বোধহয় একটু আগে, দিদি  বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করায়নি, জামাইবাবু করাতে দেননি । ভাগ্নেটা জানতে পেরে দু-দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল । ভাগ্নের বয়স অবভিয়াসলি আমার চেয়ে বেশি, সেভেন্টিটুতে জন্মেছিল, আর আমি জন্মেছি ওর পাঁচ বছর পর, ভাগ্নেদা বলে ডাকি । ওকে ওর বাবার নাম জিগ্যেস করলে ও আনকনট্রোলেবলি উন্মত্ত হয়ে যায়, বলে, আমার বাবা একজন নয় চারজন, বাবাদের নাম জানি না । দিদি-জামাইবাবুর চোখাচোখি বড় একটা হতে চায় না কার্তিক, বাড়ির বাইরে সময় কাটায় । আমার ভাগ্নের নাম কার্তিক সরকার । ওকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, নারায়ণপুর থেকে রায়পুর, কিংবা অন্যা নন-মোটোরেবল জায়গায় যাত্রীদের নিয়ে যায় ; সব জায়গায় তো বাস যায় না, মোটোরেবল রোডও বিশেষ নেই নারায়ণপুর জেলার ফরেস্ট এরিয়ায় । আগে তো রেসট্রিকশান ছিল ফরেস্ট এরিয়ায় যাবার, মুরিয়া, মাড়িয়া আর গোঁড় উপজাতির লোকেরা থাকে ওখানে, ষাট বছরে কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, সার্ভে হয়নি, সেনসাস হয়নি ।

         –সরকারি অফিসাররা যেতে চায় না, না ? সব রাজ্যে একই ব্যাপার ।

         –যেটুকু কাজ তা রামকৃষ্ণ মিশন করে, এমন কি রেশনের দোকান আর স্কুলও মিশনই চালায় । বিজলি নেই, পানীয় জল নেই, মাসে এক-আধ লিটার কেরোসিন, ব্যাস ।

         –ফরেস্ট এরিয়ায় গেছেন ?

         –না তেমন করে যাইনি, রেসট্রিকশান ছিল এতদিন । নদীর জল নিয়ে, জঙ্গলের গাছ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে । তারপর গোপনীয় সৈনিক, স্পেশাল পুলিশ অফিসার, অগজিলিয়ারি ফোর্স আর সালওয়া জুড়ুমের নামে উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করানো হল । ভারতের সংবিধান ওই অঞ্চলে অস্তিত্বহীন । সালওয়া জুড়ুম আর আধামিলিট্রির সাহায্যে জঙ্গলে শান্তি ফেরানোর চেষ্টা হল জাস্ট নাইটমেয়ার । কতকাল যে চলবে লড়াইটা, কেউই জানে না । ইনডিয়ার আকরিক খনিজের মানচিত্র আর ট্রাইবাল ডেনসিটির মানচিত্র একই, বুঝলি ? যারা আকরিক খনিজ চায় তারা আদিবাসিদের উৎখাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে ; তাদের চাই-ই চাই । প্রতিরোধ করার জন্য যা-যা করা দরকার তা আদিবাসীরা করে চলেছে , এসপার নয়তো ওসপার । ইয়াতো করনা হ্যায়, নহিঁতো মরনা হ্যায় ।

         অপু চুপ করে রইল, যে বিষয়ে কিছুই জানে না সে ব্যাপারে বেফাঁস কিছু যাতে না বলে ফ্যালে । প্রসঙ্গের খোঁচা ভোঁতা করার জন্য বলল, কী-কী গাছ হয় জঙ্গলে ?

         –সব তো আর জানি না, তবে প্রচুর পলাশ, মহুয়া, আমড়া গাছ দেখেছি । আর আছে চিকরাসি, জিলন, শিমুল, উলি, বডুলা, কড়ুয়া পাঙার, পিছলা, জারুল, জংলি বাদাম, ছাতিম এইসব ।

          শুনে, বুঝতে পারল অপু, ওর বাংলা জ্ঞান দিয়ে গাছের নাম চিনতে পারছে না । দিয়ারায় বসবাস করে গাছের নাম জানতে চাওয়া বোকামি হয়ে গেছে । কেবল মাথা দুলিয়ে সায় দিল, বোঝার ভান করে ।

         –মালিক মকবুজা শুনেছিস ?

         –না, কার লেখা ?

          –তুই তো পুরো চুতিয়াছাপ মূর্খ থেকে গেছিস রে, পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল গাণ্ডু । মালিক মকবুজা হল একটা স্ক্যাণ্ডালের নাম ।

         –না শুনিনি । বিহারে রোজ এতো স্ক্যাণ্ডাল হয় যে অন্য রাজ্যের স্ক্যাণ্ডাল পড়ার দরকার হয় না ।

         –ট্রাইবালদের ওনারশিপের নাম মালিক মকবুজা । দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে প্রচুর সেগুনকাঠের গাছ ছিল আর সেসবের মালিক ছিল স্হানীয় আদিবাসীরা । টিমবার মাফিয়ারা প্রশাসন আর রাজনীতিকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আদিবাসীদের ঠকিয়ে সেগুনের গাছগুলো কেটে পাচার করে দিত, ইসকি… । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লোকায়ুক্ত একটা কমিটি গড়ে রিপোর্ট চেয়েছিল । রিপোর্টে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে নিচেতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত প্রশাসন সেগুনগাছ কাটায় আর ট্রাইবালদের ঠকানোয় ইনভলভড । সেসময়ের বস্তারের কমিশনার নারায়ণ সিং আর সালওয়া জুড়ুমের জন্মদাতা মহেন্দর করমার বিরুদ্ধে ছিল প্রধান অভিযোগ । কিন্তু অ্যাজ ইউজুয়াল সে রিপোর্ট ধামা চাপা পড়ে গেল, কারোর কিছু হল না, মাঝখান থেকে আদিবাসীগুলো জমিও হারালো আর জমির ওপরের সেগুনকাঠের গাছগুলোও, ইসকি…। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যে আদিবাসীদের শহরে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে বা চকচকে বোতলের মদ খাইয়ে চুক্তিতে টিপছাপ করিয়ে নেয়া হয়েছিল । যখন হইচই হয়েছিল তখন সেগুনগাছের গুঁড়িগুলোর চালান বন্ধ ছিল, তারপর সংবাদ মাধ্যম ভুলে গেল, পাবলিকও ভুলে গেল । সংবাদ মাধ্যম যে কাদের, তুই তো জানিস, ইসকি…।

         –কিছুদিন আগে মারা গেছে, সেই লোকটাই মহেন্দর করমা, না ?

         –হ্যাঁ, মাওওয়াদিদের অনেকদিনের পেয়ারা সনম ছিল । সালওয়া জুড়ুমের ভয়ে প্রচুর আদিবাসী ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে অন্ধ্র আর মহারাষ্ট্রে ; ওদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো, ফসল কেটে নেয়া হতো । সরকারি অফিসাররা বলে যে মাওওয়াদিদের ভয়ে ওরা ছত্তিশগড় থেকে পালিয়েছে ।  দাঁতেওয়াড়ায় হাই টেনশান লাইন উড়িয়ে দশদিন অন্ধকার করে দিয়েছিল মাওওয়াদিরা । সত্যি-মিথ্যে একাকার হয়ে গেছে আমাদের দণ্ডকারণ্যে । নিম্নবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভিশাপ থেকে রাঘব বোয়ালের বংশই মুক্তি পেলো না, এরা তো সব চিতি-কাঁকড়া, ইসকি…।

         –এ তো দেখছি কিছুটা আমাদের দিয়ারার মতন ব্যাপার । উঁচু জাত আর উঁচু চাকরির মতলবখোরি !

         –আদিবাসীদের জমিজমার কোনো রেকর্ডও সরকারি দপতরে পাওয়া যায় না, ইসকি…। একবার ছানবিন করে জানা গিয়েছিল যে দুজন মুখিয়ার পাঁচশ একর করে জমির মালিকানার পাট্টা আছে, আর কারোর নামে কোনো প্রমাণ নেই। জমি নেই তো কিষাণ ক্রেডিট কার্ড হবে না । অনেকে ভোটার কার্ড কাকে বলে জানে না, বি পি এল কাকে বলে জানে না ।

         –ওফ, বড় বেশি কমপ্লিকেটেড আপনার এনভিরন । যাকগে, রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যেতে কোন কোন শহর পড়ে বলুন ? আপনার দিদিকে দেখতে ইচ্ছে করছে । সেলাম জানাতে ইচ্ছে করছে ।

         –কথাটা সেলাম নয়, প্রণাম ।

         –হ্যাঁ, হ্যাঁ, কারেক্ট, সরি ।

         –ভিলাই, দুর্গ, দাল্লি রাজহরা, ভানুপ্রতাপপুর, তারপর নারায়ণপুর । তবে রায়পুর থেকে মোটোরেবল রোডও আছে । কোন রাস্তায় যাবি তার ওপর নির্ভর করে দূরত্ব, ২২৫ থেকে ২৭৫ কিলোমিটার খানেক হবে । শর্টকাট রাস্তা হল রাওঘাট হয়ে । এখন অবশ্য বয়লাডিলার খনির জন্যে এলাকাটায় চহলপহল দেখা দিয়েছে । আগে মাওওয়াদিরা কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল, এখনও ওড়ায় মাঝে-মধ্যে, রাস্তার মাঝখানে লাশ পড়ে থাকে, পুলিশ ভয়ে সরায় না, সরাতে গেলেই বোমা ফাটার সম্ভাবনা ; মরেওছে অনেক সিপাহি জওয়ান । আসাম থেকে, হরিয়ানা থেকে, তামিলনাডু থেকে,  চাকরি করতে এসে বেচারাদের কি বিপত্তি ।

         অপুর জ্ঞান সীমিত, টের পেল অপু, দিয়ারাও তো প্রায় আদিনিবাসীদের অঞ্চল । 

.

বারো

         পৃথিবীর উঠাপটক-জোড়তোড় সম্পর্কে বেশি খোঁজখবর রাখেন অপুর বাবা, অখবার পড়েন, আংরেজি টিভি দ্যাখেন, স্কুলে আর কালেজে যা শেখানো হতো সেসব বাবা জানেন, পড়া বুঝিয়ে দিতেন । মারোয়াড়ি কলেজে পড়ার সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন বাবা । সকলে শহরে কোচিং পড়তে অঢেল টাকা খরচ করে, ওকে, অপুকে, করতে হয়নি । দাদু কিছুই জানেন না, খেতের রোপনি, কাটাই, মাল বিক্রি, লেন-দেন, পহলওয়ান সাপলাই আর রংদারি ট্যাক্স ছাড়া। অপুকে কোনো কথা বোঝাতে হলে মায়ের মাধ্যমে বোঝান বাবা। মা যদি তা না বোঝেন তখনই বাবা নিজে বিষয়টা নিয়ে অপুর সঙ্গে কথা বলেন ।

         –আরে উ অব বচ্চা-বুতরু হ্যায় কাআআআআআ ? করনে দিজিয়ে জো মন মেঁ আবে । কৌনো মৌগি কে সাথ নহিঁ না ফঁসা হ্যায়, না আপকে তরহ দিন-দহারে দারু কা নিসা করতা হ্যায় । কহিয়েএএএএএ ।

         –সসুরজি উসকো এতনা রুপয়া দে-দেকে খরাব কর রহে হ্যাঁয় ।

         –আরে রুপয়া হ্যায় কিস লিয়ে ? আপ কোই সোনে কা মুরত হ্যাঁয় কি আপকা বেটা হীরা-জওহারাত কা মুরত হোগা ? মগর ডরপোক নহিঁ হ্যায় আপকে তরহ । পহলওয়ান লেকে নহিঁ ঘুমতা হ্যায় মেরা বেটা । কা কহ রহেঁ হ্যাঁয় হম, সুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ ? আপনার আর আমার বাবার চাপে পড়ে আমার ছেলের ঘাড়ে দুটো মাথা গজিয়েছে, বিষ্ণু ভগওয়ানের আর ভস্মলোচনের , ও নিজেই বুঝতে পারে না যে কোন মাথাটার নির্দেশ কখন শুনবে। মাথা দুটোর লড়াই একদিন ওকে ডোবাবে । দুটো মাথার একটাও আমার কথা শোনে না । যখনই ফোন করি ফোন কেটে দিয়ে বলে ব্যস্ত আছি, এখন বিরক্ত কোরো না । ছেলেটা দিল্লি গিয়ে একদম সরফিরা হয়ে গেছে ।

         –মেরে তরহ গোরাচিট্টা হ্যায় উ । বাল ভি মেরে তরহ ঘুংরালি । অন্য কাউকে বিয়ে করতিস তো কয়লার খাদান থেকে বেরোনো কুলির চেহারা নিয়ে জন্মাতো ।

         –কয়লা খাদানের মজা লুটবেন বলেই তো থেকে গেলেন । এমন কচি কয়লাখনি তো আর পেতেন  না, যাতে ঢুকতে দু’ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হয়েছিলেন । লেকিন লম্বাই-চওড়াই ওকর নানাকে তরহ হ্যায় নাআআআআআ?

         –মজা ? কেঁচোর মাটিখাওয়া  আবার মজা নাকি !

         –তবে না তো কী ? প্রথম রাত আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে, মুঠো শক্ত করে, চুপচাপ সহ্য করেছিলুম, আপনি কতক্ষণ চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন । আমি জানতুম যে আপনি সফল মানেই দিয়ারায় ঘরজামাই হয়ে থাকা আপনার পাক্কা । মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, গঙ্গায় শুশুক ভেসে উঠেছে মানে আপনাকে আমার চাই-ই চাই, চিরে রক্তারক্তি হলেও, একফোঁটা চোখের জল ফেলব না। আপনার সফলতা আমার সফলতার সঙ্গে মিশে গেল, ছোটোবেলা থেকে স্নান করে-করে গঙ্গার যতগুলো ঢেউ আমার গায়ে জমা হয়েছিল, সেগুলো সেদিন ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল ।

      –হ্যাঁ, তোর ঢেউ তবু ফুরোয়নি । গঙ্গায় স্নান করিস আর নতুন-নতুন ঢেউ গায়ে করে তুলে আনিস ।

      –আপনি তো দেওয়ি-দেওতায় বিসওয়াস করেন না, গঙ্গায় স্নান করে দেখুন না একদিন, সব পাপ ধুয়ে যাবে।

      –কোনো পাপই করিনি আমি যে পাপ ধোবার জন্য তোর গঙ্গায় স্নান করতে হবে । পাপ অন্যেরা করে, আমি তার পূণ্য ভোগ করি ।

       জামাইবাবা সুশান্ত ঘোষের  মেয়েও হয়েছিল, অপুর জন্মের এগার বছর পর । ওনাকে বোঝানো হয়েছিল, দিয়ারায় মেয়ে-বাচ্চা অশুভ বলে তাকে একদিনের বেশি বাঁচতে দেয়নি তারিণী মণ্ডলের বউ, মানে জামাইবাবার শাশুড়ি । দিয়ারার খেত এত উর্বরা কেন , যুক্তি দিয়েছেন শাশুড়িমাইয়া ; তার কারণ দিয়ারায়-দিয়ারায় পোঁতা আছে সীতামাইয়ার কন্যা-সন্তানরা, তারা মাটির তলায় নাল ফেলে-ফেলে জমিকে উর্বরা করে দ্যায় । জানতে পেরে, যদিও সুশান্ত ঘোষের গেঁয়ো বউয়ের ততটা মনখারাপ হয়নি, জামাইবাবার হয়েছিল । তারপর উনি নিজেকে স্তোক দিয়েছিলেন, যে, শহুরে মগজ নিয়ে দিয়ারার নৈতিকতা যাচাই করা অনুচিত ; যেমন ভুঁইসমাজ তেমন তার আচার-বিচার, তেমন তার সত্য, তার নৈতিক নিয়মাবলী ;  কে বাঁচবে কে মরবে তার নির্ণয় নেবার অধিকার তো যে নিচ্ছে তার ।

         ওনার শশুর, তারিণী মণ্ডল,   কাউকে উড়িয়ে দেবার হুকুম দিলে, যাকে ওড়ানো হচ্ছে তাতে তার কোনো নির্ণয় নেবার নৈতিক অধিকার থাকে না, কেননা সে এমন কাজই করেছে যে তাকে চলে যেতে হবে । তিনি কিডন্যাপ হলেন, তাতে তো তাঁর নিজের কিছু করার ছিল না । নির্ণয় নিয়েছিলেন হবু-শশুর ।

         মেয়ের মুখটুকু দেখা হল না বলে আপশোষ থেকে গেছে অপুর বাবার । যখনই মনে পড়ে, শরীর খারাপ হয়ে যায় । তরমুজের গুলাবি মদ নিয়ে বসেন ।

      আসল কারণটা অবশ্য সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা  বউই ফাঁস করে দিয়েছিল, সারা গায়ে ডেওডেরেন্ট উড়িয়ে, যখন একদিন রাতে মরা মেয়ের শোকে তরমুজের চোলাই করা মদ খেয়ে একা-একা কাঁদছিলেন । বউ বলেছিল, কেঁদে আর কী হবে ? ছেলে জারজ হলেও তার বিয়ের সমস্যা হয় না । কিন্তু জারজ মেয়েকে কে বিয়ে করত ? আপনি তো এমন মানুষ যে মনের মতন পাত্র কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে দিতে পারতেন না ; আজকালকার ছেলে, কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে  দিলেও সে পালিয়ে যেত কিনা বলা যায় না । তারপর আবার কাজিয়া-খুনোখুনি, বিশ-পচিশ লাশ ইধর তো বিশ-পচিশ লাশ উধর ।

       ভাগলপুরের দিয়ারা অঞ্চলে সুশান্ত ঘোষ নিজে একাই এসেছিলেন, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে, তারিণী মণ্ডলের খুংখার ক্রিমিনাল দলের সাহায্য নিয়ে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় বেদখল হয়ে-যাওয়া জমিজমার পুনর্দখল নেবার মতলব নিয়ে । সুশান্ত ঘোষ অফিসের বিহারি সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ভাগলপুরের নাথনগর, আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুন্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুরের গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুনি, তারিণী মণ্ডল, মলহারিয়া মণ্ডল, লালে মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডলের পহলওয়ানরা — আধুনিক সমাজের বাইরে মারকাট অঞ্চল ।

         ইংরেজদের সময় থেকে কোনো তারতম্য হয়নি এই দিয়ারার মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি তার তত জমিন আর জলপ্রবাহ, গঙ্গার ধারের জমিন, গঙ্গার মাঝে জেগে ওঠা জমিন, আর গঙ্গার জলপ্রবাহ । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমিসংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেঙে গেছে । কাগজে-কলমে যে-ই মালিক হোক না কেন, খুংখার খুনি গিরোহদের সমর্থনে দখলে রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান জমি আর তর্জনী-বুড়ো আঙুলে ছেটানোর সমান জল । সুশান্ত ঘোষ ব্রিফকেস ভরে লাখ দেড়েক টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের সাহায্যে নিজেদের পিপারিয়ার জমিদারির জমিজমা ফেরত পাবার ষড় কষতে ।

       জমিজমার দখল নিতে গিয়ে নিজেই জবরদখল হয়ে গিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । সেই কাঁচা যৌবনে, তখনই, তাঁর চেহারার খোলতাই ছিল অবাঙালি, প্রায় মারোয়াড়ি । পাঁচ ফুটের ফর্সা গালফোলা ঘাড়ে-গর্দান কোঁকড়াচুল চনমনে । অথচ বাঙালি বলে, মুঙ্গেরের পিপারিয়া গ্রামে, যেখানে ওঁদের জমিজমা, সেখানে যাওয়া, ফসল তোলা, এতোয়ারি হাটের খাজনা আদায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ওনার বাবার ঠাকুর্দা, মানে ঠাকুর্দার বাবা, হাইকোর্টে, তখন কলকাতায় মামলা লড়তে হতো, ভূমিহার রাজনাথ সিংকে ফৌজদারি মামলায় জিতিয়ে দেয়ায়, মুঙ্গেরের রোমহর্ষক দিয়ারায়, দুশো একর জমি আর সাত একর আনাজ বাগান, আর এতোয়ারি হাট ওনার ঠাকুর্দার নামে করে দিয়েছিল ।

         সুশান্ত ঘোষ আগে যাননি কখনও পিপারিয়া । ছোটোবেলায় চাল মুসুর অড়র ভুট্টা সর্ষে পটল কচু আম রাঙা-আলু গাওয়া-ঘি আর হাটের টাকা আসত । তারপর ওখানে কৈলু যাদব, কজ্জল ধানুকদের দলের অপহরণকারী অপরাধীরা এমন জ্বালাতন আরম্ভ করলে যে সুশান্তদের বাড়ির কেউই ওমুখো হবার সাহস যোগাতে পারেননি । কাদের হাতে যে সেই বিশাল সবুজ খেতখামার তা কেবল কানাঘুষোয় শুনতে পাওয়া যেত। বাংগালি-তাংগালি বলে সুশান্ত ঘোষের জ্যাঠা-কাকা-বাবা সেখানে পাত্তা পেতেন  না ।

         সত্তরে পৌঁছে বাঁচোখ কানা তারিণী মণ্ডল পাকাপাকিভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন জামাইবাবার হাতে ।

         তারিণী মণ্ডলের সিংহাসনে বসার দিনকতক পর, একদিন রাতে মুঙ্গেরের পিপারিয়ায় তাঁর দলের বাছাই পালোয়ানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ, বাপ-ঠাকুর্দার জমিজমা দখলের জন্য নয়, সেই জমিজমা যারা দখল করে ওনাদের বেদখল করে দিয়েছে, তাদের সাফায়া করে প্রতিশোধ নেবার জন্য । সাফায়া করার পর তাদেরই তিনটে লাশ আর বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বোমাবারুদ ফেলে এসেছিল মাধেপুরার আরেকটা দলের অঞ্চলে, যাতে তাদের পারস্পরিক খুনোখুনিটা চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের চেহারা নিতে পারে । নিয়েও ছিল । সেই থেকে মুঙ্গেরের আর মাধেপুরার অপরাধীরা লড়ে মরে জামাইবাবাকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছিল । মারকাট এড়াবার জন্যে শলা করতে বসে ওরা জানতে পারে যে ওদের মধ্যে লড়াইটা বাধিয়েছিল তারিণী মণ্ডলের জামাই ।

         ভোঁসড়িকে ক্যা বাংগালি দিমাগ, হমনিলোগকে চালিস আদমি মর গেলই আপস মেঁ লড়ঝগড়কে । প্রকৃত ব্যাপার জেনে ফেলার পর, পিপারিয়া গিরোহ লোক পাঠিয়েছিল তারিণী মণ্ডল আর তার বাংগালি জামাইকে খুন করার জন্য । সাতসকালে ট্রাক চালিয়ে এসে, সামনেই তারিণী মণ্ডল আর মন্হরা দেবীকে পেয়ে যাওয়ায় শশুর আর তার বউকে সাফায়া করার লোভ সামলাতে পারেনি তারা।

       বালিয়াড়িতে দুই চিতার ওপর সাজানো দাদু-দিদিমার শব দেখে পর্যন্ত অপু নিজেকে বুঝিয়েছিল যে বদলা নিতে হলে আজকেই নিতে হবে । শোক-ফোকে ডুবে থাকলে চলবে না । দাদু তো শিখিয়ে গেছেন যে পৃথিবীতে ভয় নামে কোনো ব্যাপার নেই । মনের ভেতরে পোষা অজানা আতঙ্ক ছাড়া বাইরের কোনো কিছুকে ভয় করতে নেই । বুলেটই হল চিরসত্য ।

         একবার নিজের মাথার ওপর খেত থেকে সদ্য তোলা পটল রেখে, তখন ওর বারো বছর বয়স,  দাদুকে বলেছিল, চালান গুলি, দেখি কে ভয় পায়, আপনি না আমি । উত্তরে তারিণী মণ্ডল বলেছিল, আমার বাঁচোখ নেই, ডান চোখ এখন খারাপ হয়ে গেছে, জোয়ান বয়স হলে চালাতুম গুলি, দেখিয়ে দিতুম তোকে, চশমা পরে তো আর এক-নল্লা চালানো যায় না । অপু বলেছিল, ডরপোক কহিঁকা ।

         –আমি আর ডরপোক ? আমার নাম শুনলে সরকারি অফিসাররাও হেগে ফ্যালে, জানিস তো, আমি হলুম মূর্তিমান ত্রাস । আচ্ছা, আমি রাখছি পটলটা মাথার ওপর, তুই চালা ।

         –আমার তো আর এখন অত টিপ হয়নি । পাঁচদশ বছর যাক তখন দেখবেন, দেয়ালের পিঁপড়েকেও একশ মিটার দূর থেকে গুলি চালিয়ে মেরে দেখাবো  । পিস্তল-বন্দুক চালাতে শেখাচ্ছেন তো আপনিই ; দেবো গুরুদকছিণা, চিন্তা করবেন না।

         –তোর বাপকে আর মাকে বলিসনি যেন যে তুই পিস্তল-বন্দুক চালাতে শিখছিস । শসার শাঁষ দিয়ে হাত পুঁছে নে, নয়তো তোর মা হাত শুঁকলে বারুদের গন্ধ পেয়ে যাবে ।

         –জানি ।

.

তেরো

      রাত নামতেই চারটে মেছো নৌকো আর একটা গাদাবোটে নম্বরপ্লেট-খোলা মোটরসাইকেল চাপিয়ে, বাবা সুশান্ত ঘোষকে না জানিয়ে, গংগোতা গ্যাঙের দলবল নিয়ে চুপচাপ মাধেপুরায় পৌঁছে গিয়েছিল অপু । সঙ্গে দশটা জেরিক্যানে পেট্রল । পটলের পাহাড়, তরমুজের ঢিবি, ভুট্টাগাছের কাটা আঁটির ডাঁই আর শুয়োর-ছাগলের খোঁয়াড়ে পেট্রল ঢেলে বোমা মেরে আগুন যখন দাউ-দাউ, অপু একে-সানতালিস চালিয়েছে ঝোপড়িগুলোকে লক্ষ্য করে ।

        মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে ঠেলে দিয়েছে উল্টো দিকে,  আর নিজেরা চুপচাপ ফিরেছে নৌকোয় চেপে ।

         –আপ্পু, চল অব, ছোড় দে, সব মর গয়া হোগা । সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে, থেমেছিল অপু । অন্ধকারে কোনো কিছু নড়তে দেখলেই গুলি চালিয়েছিল, বেরহম । সবুজ পটলের পাহাড় পেট্রলের আগুনে ঠিশ-ঠাশ লাফিয়েছে দিকবিদিক, পাকা পটলগুলো হলদে ছ্যাদলামাখা কালো দাঁত থেকে আগুনের ফিনকি বের করে অট্টহাসিতে গলা ফাটিয়েছে। কালচে তরমুজরা শ্মশানে চিতায় শোয়া খুলির মতন ফেটে লাল রঙের ঘিলু উড়িয়েছে অন্ধকারের মহোল্লাসে । ভুট্টার খোসার  ভেতরে গচ্ছিত পাকা দানাগুলো হাতবোমায় ভরা ছররার ঢঙে ফরফরিয়েছে ।

       পরের দিনই স্হানীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে তারিণী মণ্ডল ও তার স্ত্রীর হত্যা আর মাধেপুরায় নারীশিশু মিলিয়ে তেত্রিশজনের জ্বলেপুড়ে বা গুলি খেয়ে মরার খবর । তার পরের দিন সর্বভারতীয় মুদ্রিত আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, আতংকওয়াদি নেতা আপ্রাধি ঘোষের নেতৃত্বে অতর্কিত হামলায় শতাধিক নিহত । পুলিশের ডিজিকে ওপরতলা থেকে গোপন হুকুম দেয়া হয়েছে যে আতংকওয়াদিদের নেতাকে যদি ধরা  যায়, তাহলে, যদি সে ধরা দিতে না চায়, তাহলে, দেখামাত্র তাকে, আপ জানতে হ্যাঁয় কেয়া করনা হ্যায় । একটা মুদ্রিত মাধ্যমে নামকরা সাংবাদিক উত্তরসম্পাদকীয়তে লিখেছে, বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে লোকটা প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল, আর ওর প্রকৃত নাম আপ্রাধী ঘোষ নয় ।

         অপু নিজেকে তারিণী মণ্ডলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে, শুনে, খেপে গেলেন সুশান্ত ঘোষ । ভ্যাপসা অন্ধকারে বসে, মেঠোগন্ধা স্ত্রী বেবিকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে, যেভাবে উনি কখনও আজ পর্যন্ত কথা বলেননি, বললেন, আমি নিজে  কোনোদিন বন্দুক-পিস্তল চালাইনি, আমার লুঙ্গিতে এই অটোমেটিক পিসতলটা শুধু গোঁজাই থাকে, চালিয়ে মাঝে-সাঝে টেস্ট করার হলে রামশরণ করে, আমি ট্রিগারও ছুঁয়ে দেখিনি । আমি অপুকে কোনো অস্ত্র-শস্ত্রে হাত দিতে দিইনি, তোর মাথায় ছোটোবেলায় হাত রেখে ও শপথ করেছিল যে জীবনে কোনোদিন ও বোমাবারুদ গুলিগোলা বন্দুক রাইফেলে হাত দেবে না । এটা কী করে হল ? কে শেখাল ওকে ? নিশ্চই ওর দাদু কোনো ফাঁকা দিয়ারায় নিয়ে গিয়ে নিশানার অভ্যাস করিয়েছে ; তুই আমায় জানতে দিসনি, তুইও চেয়েছিস যে তোর ছেলে আমার মতো নয়, তোর বাবার মতন খুনি কিডন্যাপার অপরাধী হোক । এখন কী করবি ? তোর ছেলেকে খুন করার জন্য নিশ্চই বেরিয়ে পড়েছে শত্রুরা ।

        সতত কলহাস্যময় বেবি এখন নিঃশব্দে, দুঃখ-মেশানো ক্রোধে, চোখের জল ফেলছিল ; সম্ভবত বাবা-মার অপঘাতে মৃত্যুর কারণে। চোখ মুছে, দাঁতে দাঁত রেখে, বিরক্তির স্বাচ্ছন্দ্যে, বলল, আমিও জানতাম না যে ও বন্দুক চালানো শিখেছে ; দিয়ারায় বাচ্চারা ছোটোবেলা থেকেই কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা চালাতে শেখে । ও-ও হয়তো সেভাবেই শিখেছে ।

       নৃশংস ঘটনার অতর্কিত বিহ্বলতায় বিচলিত ও  বিমূঢ় সুশান্ত বসেছিলেন দাওয়ায় বাঁশের বেঞ্চে, ফলসা আর খিরনিগাছের তলায় । অপুকে কি ভাবে বাঁচানো যায় চিন্তা করছিলেন ।

        বেবির পরবর্তী কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুশান্ত ঘোষ । 

        ঠোঁটের কোনে উত্তজনার দুঃসাহসী ফেনায় হতচেতন বেবি, ভয়ার্ত শ্রদ্ধায়,  বলল, আপনি তো খুশিই হলেন আমার বাবা ওভাবে খুন হওয়ায়, রাস্তার মাঝখানে জানোয়ারের মতন, মুখ দেখে আর চেনার উপায় ছিল না যে ওই লোকটাই তারিণী মণ্ডল । আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করে আপনার জমিদারি বেদখলের বদলা নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন । অন্য সবাইকে বোকা বানাতে পারেন, আমাকে নয়, আমি আপনার সঙ্গে প্রতিদিন-প্রতিরাত থাকি, জানি আপনকে, কখন কোন গান শুনছেন তা থেকে আপনার মনের অবস্হা বুঝে যাই, কেন বেশি মদ খাচ্ছেন তার আসল কারণ টের পেয়ে যাই । কী দরকার ছিল ? বেশ ভালোই তো ছিলেন, দিয়ারার একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে । আসলে আপনি জানতেন যে পিপারিয়াকে আক্রমণ করলে ওরা তারিণী মণ্ডলকে নির্ঘাত খুন করবে । আর আমার বাবা আপনাকে কিডন্যাপ করে আমার সঙ্গে যে জোর করে, চারিদিকে পাহারাদার বসিয়ে, বিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ নেয়া হবে । নয়কি ? নিশ্চই আপনি মনে-মনে ষড়যন্ত্র করেছেন বিয়ের পর থেকেই, কী করে আপনার কিডন্যাপিঙের আর মুখ্যু কালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বদলা নেবেন।

         বেবির কথাগুলো ওনাকে, সুশান্ত ঘোষকে, অবাক করল । তিনি যাকে মেঠোগন্ধা বোকা মেয়ে ভাবছিলেন, সে তো তা নয় । সে ওনার গোপন ইচ্ছের কথা জানে ! কখনও কি ঘুমের ঘোরে বা অত্যধিক মদ খেয়ে বলে ফেলেছেন মনের কথা ? কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক যুবককে রাজধানীর ব্যাপক জীবন থেকে উপড়ে তুলে এনে ফালতু একটা জায়গায় পুঁতে বনসাই করে দেবার কাজের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রোষের আগ্নেয়গিরির মুখকে খুলে ড্র্যাগনের আগুন-নিঃশ্বাস ছড়িয়ে সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবার পরিকল্পনা ?

       বেবির মর্মপীড়া  প্রতিবন্ধকহীন, বলতে থাকল, খুন-করার ঋণ খুনের মাধ্যমেই প্রতিশোধ হয়, জানি, ছোটোবেলা থেকে ; বদলা যে নেয় তার মাথার দাম বদলা নেবার সময়েই নির্ধারিত হয়ে যায় । আপনি তো আলাদা মানুষ ছিলেন, সাক্ষাৎ দেওতা, কী করলেন আপনি ? বিষ খেতে-খেতে ভাবলেন যে আপনি বিষ খেলে যার কাছ থেকে বিষ কিনেছিলেন সেই  দোকানদার মারা যাবে, আপনার কিছুই হবে না ।

        সুশান্ত , উদাসীন ক্ষোভে, বাকরুদ্ধ, শুনছিলেন, বেবির উদ্গীরণ, কে জানে কোথায় চাপা দেয়া ছিল,  যাকে উনি মেঠোগন্ধা বোকা কথাকিপটে মেয়ে ভেবেছিলেন, তার অন্তরঙ্গ মিশুকে সংযমের আড়ালে ছিল আরেক বেবি।

        বেবি বলল, আপনি আপনার ছেলেকে বসিয়ে বাংলা বলতে পড়তে লিখতে শেখালেন, আমাকে তো শেখালেন না, আমি তো হিন্দিতেও আনপঢ়, আপনি চাইলে আমাকে চোদ্দ বছর বয়স থেকে আপনার বাঙালি বউ করে তুলতে পারতেন ।  আমাকে আপনি আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাননি । মিষ্টি কথা বলে-বলে আমায় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, তা কি আমি বুঝতুম না ? আজ আপনার কাছে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।

        সুশান্ত বেবির কথাগুলোর উত্তর দিলেন না, কেবল বললেন, কোথায় অপু, ওর এখানে থাকা চলবে না, এখানে ও হয়তো আজকেই খুন হয়ে যাবে । ওকে একটা মিডিয়া আতংকওয়াদি, আরেকটা মিডিয়া মাওওয়াদি বানিয়ে দিয়েছে ।

       অপু এলে সুশান্ত ঘোষ বললেন, গেট রেডি টু গেট লস্ট । গো ফ্রম দিস প্লেস । যেখানে কেউ তোকে খুঁজে পাবে না এমন জায়গায় চলে যা ।

        অপু কিছু বলতে চাইছিল । ওর নিরক্ষর মা, ইংরেজির একটিও শব্দ না জানা সত্ত্বেও, সুশান্তর মনোভাব আঁচ করে, অবিচলিত কন্ঠে  বলল, তোর বাবা যা বলছেন, তা-ই কর । তোর এখানে থাকা চলবে না । তোর দাদুর মতন তুইও রাস্তায় গাড়ি চাপা শুয়োরের মতন মরে পড়ে থাক তা দেখার আগে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেবো।

         ডেস্কটপের মনিটারে গুগল ম্যাপ খুলে, বাবা সুশান্ত ঘোষ অপুকে বোঝালেন , তুই পালা, এই দ্যাখ, ইতুদিদি আর  অমিত বর্মণ নামের লোকটা যে জঙ্গলে গেছে তার ম্যাপ, জায়গাটার নাম অবুঝমাড়, কেউ যায় না আদিবাসীদের ওই অঞ্চলে, গুগল সার্চ করে দেখেছি, ইমপ্রেগনেবল ফরেস্ট । প্রথমে দণ্ডকারণ্যের নারায়ণপুরে যাবি, সেখান থেকে হদিশ নিয়ে অবুঝমাড় । 

         সুশান্ত ঘোষ অনুমান করেছিলেন যে পুলিশ এসে ওনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করবে । ছেলেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্হা করে দিয়ে বেবিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেও পালালেন  দিয়ারার চরে, যেখানে পলিমাটির প্রলেপ-দেয়া চ্যাঁচারির বেড়ায় ঘেরা ঢেউতোলা অ্যাসবেসটসের চালাঘরে দাগি অপরাধীরা, পুলিশ-প্রশাসনকে এড়াবার জন্য, এসে লুকোয় । তারা এসে লুকোলে শহর থেকে নাচানিয়াওয়ালি আনিয়ে তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্হা করত তারিণী মণ্ডল ।

         সুশান্ত ঘোষ ভেবে দেখলেন যে, যতদিনে পুলিশ ওনাকে ধরবে ততদিনে অপু পৌঁছে যেতে পারবে নাগালের বাইরে । অবুঝমাড়ে পালিয়ে গেছে শুনলে পুলিশের আর কিছু করার থাকবে না ।

        দিয়ারায় বানানো গঙ্গামাটি-লেপা বাঁশের কাঠামোর ওপর বেছানো অ্যাসবেসটসে পাতা খড়ের ছাদের তলায় ফেরারি অপরাধীদের কুকর্মশালায় আশ্রয় নিলেন সুশান্ত ঘোষ । ডিজেল জেনারেটারে চালানো কুলারের ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে ছিলেন চেয়ারে । ওনার চালাঘর ঘিরে, আর নৌকোয় বসে, কুড়ি-পঁচিশজন বন্দুকধারী পাহারাদার, তারা পুলিশের আর শত্রু গ্যাঙদের আক্রমণ প্রতিহত করবে যতক্ষণ পারবে ।  বেবি আর ওনার মাঝে কথা বলার বিষয় হতে পারত ওনাদের ছেলে অপুর সুরক্ষিত থাকা, নির্ধারিত জায়গায় পোঁছানো । কিন্তু বিবাহ নামের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুজনের যোগাযোগের যে মাধ্যমটি ছিল, যা কিডন্যাপিঙের সূত্রে জোর করে তৈরি সম্পর্কে গড়ে উঠেছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে তারিণী মণ্ডলের মৃত্যুতে। বেবির নিঃশর্ত ভালোবাসা তাঁর সমস্যার সমাধান করতে পারেনি । দেখনপ্রেম হোক বা মাংসঘর্ষণ ভালোবাসা, সেসবের প্রলেপ লাগিয়ে কোনো ঘা শুকোয় না । শশুরের মৃত্যুতে তিনি যেমন গোপন আহ্লাদে মাতোয়ারা, তেমনই ছেলে অপুর অবধারিত গ্রেপ্তার, বিচার ও কারাদণ্ডের, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের,  দুশ্চিন্তার চাপা আতঙ্কে বিপর্যস্ত । পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্যার সমাধান এই ভাবেই করতে হল, বোঝাচ্ছেন নিজেকে, এ ছাড়া উপায় ছিল না । কিন্তু সে সমস্যার সমাধান হতে দিল না তাঁরই ছেলে। ছোঁ-মারা কিডন্যাপিঙের সময় যেমন আলাদা ছিলেন, এতকাল একসঙ্গে ঘর করে সেই আলাদাই রয়ে গেছেন, মাংসাশী জানোয়ারের হাইবারনেশানে, রেকলুজ, কাস্টঅ্যাওয়ে ।

.

চোদ্দ

        মুঙ্গেরের দিয়ারার ঝোপড়িগুলোয় সাতসকালে তাজা রক্তের গন্ধে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বেলেমাছি চ্যানেল, ঘোড়ামাছি চ্যানেল, হোবারমাছি চ্যানেল, সিসিডামাছি চ্যানেল পলিমাটির দরদালানে পৌঁছে গিয়েছিল । ওঃ এত লোক গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে মরেছে, আর কি থাকা যায়, প্রতিটি মাছি চ্যানেল ভনভনিয়ে ওবি ভ্যান চালিয়ে তড়িঘড়ি দুর্ঘটনার জায়গায় ।

         ঘোড়ামাছি : আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এই মুহূর্তে, জনগণমাছিদের ডুমোচোখের সামনে তিরিশ-চল্লিশটি হত্যা হয়েছে অ্যাবং সেই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কারা এই লজ্জাজনক বীরত্ব দেখিয়েছে, তা কেউ বলতে রাজি নন, কেননা স্হানটি অসামাজিক চরিত্রের মাছিদের নিয়ন্ত্রণে । এই যে, ফলেরমাছি, আপনি তো প্রত্যক্ষদর্শী, আপনি কী দেখলেন ?

         ফলেরমাছি : আমি কিছুই দেখিনি, তখন তরমুজের খোসার ভেতরে রাতের ঘুম দিচ্ছিলাম ; আমি গুলির শব্দে বিরক্ত হয়ে পচা তরমুজের ভেতর থেকে উড়তে বাধ্য হয়েছি, তাই আমার গায়ে লাল রং লেগে আছে । আমি এর ঘোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি । আমরা ফলের মাছিরা নির্ণয় নিয়েছে যে আমরা এইপ্রকার আওয়াজ অ্যাবং আগুন, যা শান্তি নষ্ট করে, তার বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবো । তবে গুজবমিশ্রিত অনুমান যে একজন যুবক বদলা নেবার হাতিহাঁক পেড়েছিলেন।

         বেলেমাছি : নীল মাছির দল পৌঁছে গেছেন অকুস্হলে । আপনারা দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, মানব প্রজাতির একাধিক মহিলার বক্ষস্হল নির্মল আকাশের তলায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে অ্যাবং তাঁদের যাবতীয় অভিমান নিঃশব্দ বিলাপ হয়ে দৃশ্যমান । দীপঙ্করদামাছি, ক্যামেরাটা একটু প্যান করে দেখান ঘরের মাছিরা ঘরের কাজকর্ম ফেলে কোন আঙ্গিকে এই সামগ্রিক রসপানে অংশ নিতে র‌্যালির পর র‌্যালিতে আসছেন ।

         নীলমাছি : বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে গত কয়েক দশক যাবত ডানার রঙ পালটে পালটে কায়েমিস্বার্থান্বেষী দলবদলু অ্যাবং রংবদলু গুয়েমাছিরা ভুল সংবাদ পরিবেশন করে চলেছেন । রক্তপাত ঘটলেও তাঁরা বলছেন যে রেতঃপাত হয়েছিল…আচ্ছা আমরা এখান থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা মানবপ্রজাতির বহু নমুনা পৌঁছে গেছেন এবং তাঁরা মাছিসমাজ সম্পর্কে অভদ্র কথাবার্তা বলছেন । ব্যাক টু স্টুডিও ।

         হোবারমাছি : সঙ্গে থাকুন ।

         মোদোমাছি : সঙ্গে তো থাকতে চাই গো, কিন্তু কী করে তোমাদের কাঁচের বাক্সটার ভেতরে ঢুকবো তার উপায় তো বাতলাও না ।

         সরকারিমাছি : মানব সম্প্রদায়ের এক প্রতিকল্প তার ঔরস উপন্যাসে, আপনাদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা লিখেছে । আপনারা তাকে গিয়ে বিরক্ত করুন, সে-ই আপনাদের সবার সামনে ল্যাংটো করে ছেড়েচে।

.

পনেরো

         দিল্লির ওপন টিকিট কাটাই ছিল অপুর ।  ফোমচামড়ার ব্যাগে তারিণী মণ্ডলের তিজোরি থেকে করকরে নোটের বাণ্ডিল আর কয়েকটা জামাপ্যান্ট নিয়ে, পাটনা গিয়ে সোজা দিল্লি, দিল্লি বিমানবন্দর থেকে রায়পুরে একরাত হোটেলে ।  পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আতংকওয়াদি বা মাওওয়াদি আপ্রাধি ঘোষকে । সিকিউরিটি চেকে অশ্বমেধ ঘোষের অসুবিধা হল না । ভাগলপুর স্টেশানের টেলিফোন বুথ থেকে নিকিতাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে ওর ম্যালেরিয়া হয়েছে, ফিরতে মাসখানেক লেগে যাবে । নিকিতা জানতে চাইছিল কী করে ভাগলপুরে অপুর বাড়ি যাবে । অপু বোঝালো, অনেকের ম্যালেরিয়া হয়েছে, শেষে নিকিতা আসলে ওর-ও হতে পারে । নিকিতা বলল, হরওয়খৎ ধোখা দেনে কে চক্কর মেঁ রহতে হো, মুঝে গিনতি মত পঢ়াও, ম্যায় জরুর পহুঁচ জাউঙ্গি, তুমহারে মাতা-পিতা সে মিলনা হ্যায় ।

         অপু মোবাইলের সিম কার্ড বের করে ট্রেনলাইনে ফেলে দিল ।

         রায়পুরে, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে, বাসস্ট্যাণ্ডের সামনে, ফালতু হোটেল, ওর কাছে পরিচয়পত্র চাইল না, চাইলে ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখাবে বলে তৈরি ছিল  , রেজিস্টারে লেখালিখিও করতে বলল না । রেজিস্টার চাইতে বেঁটে-মোটা-টেকো হোটেল মালিক বললে, আরে এখন ছাড়ুন ওসব ; এখন নদীর নিলাম হবে বলে লোক আসছে আর যাচ্ছে, আসছে আর যাচ্ছে  । আপনার ভাগ্য ভালো যে ঘরটা আজ সকালেই খালি হয়েছে।

         –নদীর নিলাম ? অনেক মাছ হয় নাকি ? না নৌকো যাতায়াত করে ?

        –জলের জন্য নিলাম ।

         –জলের জন্য ?

         –শোনেননি আপনি ? রায়গড়ে কুরকেত নদী, দাঁতেওয়াডাতে সাবরি নদী, রায়পুর জেলায় খারুন নদী, কোরবাতে হাদেও নদী, ঝাঙ্গির-চম্পায় মাঁড নদী নিলাম হয়ে গেছে । সাবরি বা কোলাভ নদীর ধারে চিন্তালনাডের জঙ্গলে মাওওয়াদীরা ছিয়াত্তর জওয়ানকে মটিয়ামেট করে দিয়েছিল, কাগজে পড়েননি ? সাবরি নদীই তো উড়িষা আর ছত্তিসগড়কে আলাদা করেছে । উড়িষ্যার  কোরাপুট থেকে চালু হয়েছে ।

         –নদী যে নিলাম হয়, এই প্রথম শুনলুম । কোথায় গিয়ে মিশেছে নদীটা ?

         –সাবরি নদী নারায়ণপুর-দাঁতেওয়াডায় প্রথমে পশ্চিম থেকে পুবে, তারপর উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে ভদ্রাচলমের কাছে গোদাবরীতে গিয়ে মিশেছে ।

         –নৌকো চলে ?

         –হ্যাঁ, কিন্তু বন্যার সময়ে নদীর চেহারা পালটে যায় । কখনও-কখনও আঠাশ ফিট পর্যন্ত জল ওঠে । আসেপাশে সব ডুবে যায় । যাতায়াত, এখন যেটুকু দেখছেন, তাও বন্ধ হয়ে যায় ।

         …অপু আরেকটু হলে অবুঝমাড় শব্দটা উচ্চরণ করে ফেলত । গিলে ফেলল মগজ থেকে জিভে এসে নামা কথাটা।

          –নদীর পাড়ে জংলিরাই থাকে । দণ্ডকারণ্যে কে যে আসলি জংলি আর কে যে মাওওয়াদী জংলি তা আপনি বুঝতে পারবেন না । পুরো দণ্ডকারণ্য জঙ্গলে হয় মাওওয়াদী নয়তো সিপাহিদের জামাত । আর ছিটপুট রিফিউজি, সোয়াধিনতার টাইমে ওরা বাংগালি ছিল।

         –নদী কিনে করবে কি লোকে ?

         –ফ্যাকটিরি বসছে । আপনি কিনতে পারবেন না, অনেক টাকা খাওয়াতে হয় এসব ব্যাপারে । করোড় করোড় । করোড়-করোড় ক্যাশ । নিলাম একটাকায়, পিছুয়াড়িতে করোড়-করোড়, পেটি ভর-ভরকে, খুল্লমখুল্লা।

         –সব জল কি ফ্যাকট্রিই নিয়ে নেবে ? এতগুলো নদীর ?

         –ওই তো কুরকেতি নদীর ধারে গারিয়া জাতের জংলিরা তরমুজ, শশা তারপর রবির মরশুমে রবি চাষ করত, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত, কিন্তু রাবো গ্রামের কাছে ড্যাম তৈরি হল, ব্যাস, জাঁপলি, কিকরিচোলি, দেহজান গ্রামের খেতি বন্ধ হয়ে গেল । এক হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট বসেছে তামনারে, সব জল খেয়ে নিচ্ছে ফ্যাকটিরি । জংলিদের খাবার জল নিয়ে চলছে হল্লাগুল্লা ।

         –জংলি ?

         –গারিয়া, গোঁড়, মাড়িয়া, মুরিয়া  লোকেরা থাকে, গায়ে এক চিলতে জামা-কাপড় নেই, শর্মনাক, শর্মনাক, পুরুষগুলো দিনেরবেলাতেও সালফি মদ খেয়ে টপ্পাগুল  বেহুঁশ ।

         –আচ্ছা নারায়ণপুর যাবার সহজ উপায় বলুন তো ।

         –বাসে করে চলে যান । তবে বাসগুলো সবকটা সিটে প্যাসেঞ্জার না পেলে যেতে চায় না । নৌকরওয়ালা বাসেও যেতে পারেন, ওটা রেগুলার, সরকারি নৌকরি করে যারা, নারায়ণপুর জেলা হেডকোয়ার্টার হবার পর পোস্টিং হয়েছে, বউ-বাচ্চা রায়পুরে, তাদের বাসে যেতে পারেন ।

         –মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় না ?

         –ভাড়া তো পাওয়া যায় না, তবে আপনার মতন একজন বাংগালি আদমি আছে, নারায়ণপুরে বাড়ি,  সে নিয়ে যেতে পারে। ও অনেক ফোটোগ্রাফার আর সাংবাদিককে নিয়ে গেছে, ওই দিকের অলিগলি চেনে ।

         –লোকটাকে খবর দিন না ; আজকেই বেরিয়ে পড়ব তাহলে ।

         –আগে ও মালকানগিরির যে গ্রামে থাকত তার নাম একানওয়ে ।

         –একানওয়ে ? নাইনটিওয়ান ? এরকম নাম কেন ?

         –বাংগালি রিফিউজিরা এসেছিল, সানতালিস, একাওয়ান, পঁয়ষট আর একহত্তর সালে, পরেও এসেছে ছিটপুট । জঙ্গল কেটে বানানো তাদের ঝোপড়পট্টিগুলোর তো নাম ছিল না । এক দুই তিন চার করে হবে বোধহয়, একানওয়ে বানওয়া এমনি করে একশো দুশো, কে জানে, সে অনেকদিন আগের কথা। যুগ কেটে গেছে কিন্তু বাংগালি লোকগুলো রিফিউজির মতনই গরিব থেকে গেছে । মাওওয়াদীরাও ওদের কাছ থেকে…

         –রংদারি ট্যাক্স নেয় ?

         –রংদারি ট্যাক্স । ভালো বলেছেন ।

         –নাম কি ছেলেটার ?

         –কাতিক, কার্তিক ছিল বোধহয়, লেখাপড়া শেখেনি তো, কার্তিককে কাতিক করে ফেলেছে । দেয়োই-দেওতাদেরও সম্মান করে না আনপড় বাংগালিগুলো ।

         –ওর বাবার নাম কি গণেশচন্দ্র সরকার ?

         –জি হাঁ । আংরেজি পড়ান । লেকিন কাতিক অপনে বাপ কো আব্বা পুকারতা হ্যায়, অওর মা কো অম্মি।  অজব বাংগালি ।

         –একটু ফোন করে দেখুন না । গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতেই যাবো ।         

         –এসে যাবে, এসে যাবে, কজনই বা প্যাসেঞ্জার হয়, মোটর সাইকেল সওয়ারি করতে অনেক প্যাসেঞ্জারের সাহস হয় না ।

         –আচ্ছা । তাহলে অপেক্ষা করি ।

         –আপনি কী করেন ?

         –আমি ফিউজিটিভ ?

         –ফিউজিটিভ মতলব ?

         –ভগোড়া ।

         –হেঁঃ হেঁঃ, আচ্ছা-খাসা মজাক কর লেতে হ্যাঁয় আপ ।           

         ঘণ্টাখানেক পরে মোটর সাইকেলে গেরুয়া মাটির ধুলো উড়িয়ে কাটাঢ়েঁড়া জিন্সের প্যান্ট আর হাতকাটা লাল গেঞ্জিতে, পাঁচ ফিটের, বছর চল্লিশের একজন দোহারা লোক হোটেলের সামনে পৌঁছে হর্ন দিতে, হোটেল মালিক বলল, নিন, এসে গেছে কাতিক । লোকটাকে দেখে, বাবা একটা শব্দ শেখাতে কয়েকটা চড় মেরেছিলেন, সেই শব্দটা অপুর মগজে ভেসে উঠল, অকুতোভয় ।

         কয়েকটা ধাপ নেমে অপু বলল, হিন্দিতে, আমি নারায়ণপুরের ইংলিশ টিচার গণেশচন্দ্র সরকারের বাড়ি যেতে চাই । উকোখুস্কো চুল লোকটা জিগ্যেস করল, গণেশচন্দ্র সরকার ? তার সঙ্গে কী কাজ ? আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি তাঁর খোঁজে আসতে । অপু জবাবে বলল, সনাতন সরকার একটা চিঠি দিয়েছেন তাঁকে দেবার জন্য । ছেলেটার চোখ কটা, লক্ষ করল অপু ।

          –সনাতনভাই ? তাঁর সঙ্গে কী করে পরিচয় হল, জানতে চাইল কার্তিক ।

           অপু বলল, ওনার সঙ্গে পড়ি ।

         –আপনি এখন কী করেন ? ভ্রু কোঁচকায় কার্তিক, নিশ্চিন্ত যে ওর মোটর সাইকেলের একজন সওয়ারি পাওয়া গেল । মোটর সাইকলের ধুলো পুঁছতে-পুঁছতে বলল, হাজার টাকা নিই ।

         –ঠিক আছে, নো প্রবলেম, বলে অপু যোগ করল, কিছুই করি না । আমি ফিউজিটিভ ।

         –ফিউজিটিভ ইয়ানে কি ?

         –ভগোড়া । আমি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছি । ওনার সাহায্য নিয়ে অবুঝমাড় জঙ্গলে গিয়ে লুকোবো । জঙ্গলটা নাকি দুর্ভেদ্য, পুলিশও যায় না সেখানে ।

         কোমরে হাত দিয়ে গেরুয়া ধুলোর পাশাপাশি অট্টহাসি ওড়ালো কার্তিক । বলল, আরে ইয়ার, মাওওয়াদি, বনবিভাগ, রেভেন্যু ডিপাট আর আধামিলিট্রি মিলে জবরদস্ত কাহানি ছড়িয়েছে, হাউয়া খাড়া করে দিয়েছে । ভারতীয় জওয়ানরা কার্ল গুস্তাভ রাইফেল, আনডারব্যারেল গ্রেনেড হাতে ভেতরে ঢুকে বুড়বক বেনে গেছে । গিয়ে দ্যাখে হাড্ডিসার ঝোপড়পট্টি, গাছের পাতা আর সরু বাঁশে তৈরি ভুখমরিতে বেচয়েন অনজান আদমিদের গ্রাম, আর তংগ দড়িদঙ্কা আদিবাসী । অবুঝমাড়ে এখন যার ইচ্ছে সে ঢুকে যেতে পারে । শুধু মাওওয়াদিদের আর আধামিলিট্রির তিকড়মবাজিতে  পড়ে চকনাচুর হয়ে যাবার মওকা থাকে, এই যা, বাদবাকি সব মনোহর কাহানিয়াঁ । চলুন, বসুন, ফিউজিটিভ মহাশয়জি ।

         প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা জামা-ট্রাউজারে, ফোমচামড়ার ব্যাগে, চুলে, ভুরুতে ধুলোর চাদরে ঢাকা পড়ার পর অপু পৌঁছোল রায়গড় থেকে নারায়ণপুর ।

         কার্তিকের বাবাকে সনাতন সরকারের চিঠিটা দিয়ে, গংগোতা প্রথা অনুযায়ী গণেশচন্দ্র সরকার আর তাঁর স্ত্রীর হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করে অপু ওনাদের জানালো যে চিঠিতে ওর যে বান্ধবীর উল্লেখ রয়েছে, তাকে সঙ্গে আনতে পারেনি ।

          গণেশচন্দ্র সরকার সনাতনের চিঠি পড়ে অপুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, দ্যাখো, কতদূর থেকে তুমি এলে, সনাতনের বন্ধু বলে, জায়গাটা দেখার ইচ্ছা হয়েছে তোমার ; কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না, কে-ই বা নেবে, কেউ তো নেই। সনাতন নিশ্চয়ই ওর গালাগালের স্টক তোমার মাথায় উপুড় করে দিয়েছে? ভীষণ রগচটা । যত বেশি পড়াশোনা করছে তত ওর হিন্দি গালাগালের স্টক বাড়ছে । তুমি খাও-দাও, যতদিন ইচ্ছা থাকো, আমাদের ভালো লাগবে, তার আগে স্নান করে নাও, লাল চালের ভাত খাও, মাছ-টাছ পাবে না ।

         অপু ওনাকে বলল, আপনি বসুন, প্রথমে শুনুন, আমার জীবনে কী ঘটেছে, আমি কেন এসেছি, কেন আমার বান্ধবীকে সঙ্গে আনিনি, আর এখন আমি কেন অবুঝমাড় জঙ্গলে যেতে চাইছি । শুনে, গণেশচন্দ্র সরকার, কোলে হাত রেখে, কিছুক্ষণ বসে রইলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ওনার স্ত্রী । অপুর মনে হল, রোগা, ময়লা, টাকমাথা গণেশচন্দ্র সরকারের বয়স ওনার স্ত্রীর চেয়ে বেশ কম । ওনার স্ত্রী বললেন, তোমাকে কে বুঝিয়েছে যে অবুঝমাড় দুর্ভেদ্য? আমার ছেলে ওই জঙ্গলে তিন বছর ছিল ; মাওওয়াদিরা ওর গোঁড়-মাড়িয়া বউকে গুলি করে মারার পর ও পালিয়ে এসেছে । বাড়িতে প্রায় থাকেই না কার্তিক । রাতে ফেরে, খায়, ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়ে ; যদি রায়পুরে থেকে যায় তাহলে সে-রাতে ফেরেই না ।

        অপু স্তম্ভিত ।

         কার্তিক সরকার অপুকে পৌঁছে দিয়ে নতুন যাত্রীর খোঁজে মোটর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ।

         কার্তিকের বাবা-মা ওর জীবনের ঘটনা, থেমে-থেমে, কন্ঠস্বরে শ্লেষ্মা মিশিয়ে, অপুকে বলতে আরম্ভ করলেন।  কার্তিক এক মাড়িয়া-গোঁড় মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ; মেয়েটি মাঝে-মাঝে কোকোমেত্তায় ডিম, মুর্গি, শুয়োর বাচ্চা, বিয়ার বাহুতি পোকা, মহুয়ার ফুল, সালফি মদ বিক্রি করতে আসত । কার্তিক ওর ডিম কিনত, মুর্গি কিনত, সালফি খেতো আর যত দাম তার চেয়ে বেশি টাকা দিত । একদিন মেয়েটা কার্তিককে জানালো মাওওয়াদিরা ফতোয়া জারি করেছে যে জঙ্গলের বাইরে আর যাওয়া চলবে না । যারা যাবে তাদের পুলিশের চর বলে সন্দেহ করা হবে ; ফিরে আসলে জন আদালতে তাদের বিচার হবে । মেয়েটার নাম ছিল কুমিয়া খোসা।

         —ছিল মানে ?

         –কইছি, কইছি, কার্তিক কুমিয়াকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে, আমাদের কাছে এনে জানালো যে ও চলে যাচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে ঘর করতে, কুমিয়ার হিকোনার গ্রামে ।  আমরা কার্তিককে কোনো কাজে বাধা দিই না, ওর জন্মের কথা আরেকদিন শুনো । মনে হয়েছিল, যাচ্ছে যাক, কোথাও তো সংসার পাতবে, নারায়ণপুরে একা-একা অস্হির হয়ে, মাথা খারাপ করে, দুঃখে-দুঃখে,  নিজেকে কষ্ট দিয়ে, ঘুরে বেড়াবার চেয়ে ঢের ভালো ।

     হিকোনারে যাবার পর ওদের বিয়ে দেয়া হয়েছিল গোঁড়-মাড়িয়া রীতি অনুযায়ী , দুজনকে রঙিন কাপড়ে আগাপাশতলা মুড়ে ওদের ওপর দুধ ঢেলে বিয়ে হল ; আমরা দুধ, গায়ে জড়াবার শাড়ি, গোটা পাঁঠার মাংস কিনে নিয়ে গিয়াছিলাম । গোঁড়-মাড়িয়া সমাজে বিয়ে না করলেও চলে, অনেক ছেলে-মেয়ে বিয়ে করে না, তাদের কয়েকটা বাচ্চা হয়ে যাবার পরও বিয়ে করতে পারে না, দুধের টাকা, নতুন কাপড়ের টাকা, মাংস খাওয়াবার টাকা, সালফি খাওয়াবার টাকা, কোথা থেকে পাবে, বলো । পঁচিশ তিরিশটা চালাঘর নিয়ে এক-একটা গ্রাম, যদিও সেগুলো পাশাপাশি নয়, ছড়ানো-ছেটানো । তুমি ভেবো না যে অবুঝমাড় অ্যামাজনের মতন ঘন জঙ্গল, মোটেই নয়, সুন্দরবনের মতনও নয়, খোলামেলা ধরণের জঙ্গল, দূর থেকে গাছের ফাঁকে দেখতে পাবে, কে আসছে, ভাল্লুক, শেয়াল, বনবিড়াল  আসছে কি না।

          আমরা ওর সংসার শুরু করার কয়েক মাসের খরচ দিয়ে  ফিরে এসেছিলাম । ওরা তেল-মশলা দিয়ে আমাদের মতো রান্না করে না, বেশির ভাগ মাংস পুড়িয়ে খায় । একদিক থেকে ভাল, খরচের বোঝা কম । ভালই ছিল দুজনে, ওদের চালাঘরে, মুর্গি, খরগোশ আর শুয়োর পুষেছিল । কুমিয়া তীর-ধনুক দিয়ে খরগোশ, বেঁজি, কাঠবেরালি, সাপ, পাখি শিকার করে আনলে দুজনে মিলে খেতো ।  পেণ্ডা খেতি, মানে শিফটিং কালটিভেশান বা জুম চাষের সময়ে পাহাড়ের ঝোপঝাড় পোড়ানোয়, ফসল পোঁতা আর কাটায়, অংশ নিত । শিকারের ফাঁদ পাতায়, জংলি পাখি শিকারে, মহুয়ার ফুল কুড়োনোয়, অংশ নিত ।

          সকলের দেখাদেখি কার্তিকও পাঁচ টাকা দিয়ে মাওওয়াদি জনতম সরকারের নাগরিক হয়ে গেল । জন আদালতের সদস্য করা হল ওকে । কার্তিক ভেবেছিল সদস্য হয়ে গেলে জঙ্গলের কোনো অংশের পাট্টা পাবার সুবিধা হবে । পাট্টার জন্য জনতম সরকারের অধ্যক্ষকে বলতে গিয়ে বিপদে পড়ল । পাট্টা দেয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট । জনতম সরকারের নেতারা ভাবল যে কার্তিক যেহেতু গোঁড়-মাড়িয়া নয়, তাই গোঁড়-মাড়িয়া মেয়ের সঙ্গে বসবাস করে, বাচ্চা পয়দা করে, বন বিভাগ-রাজস্ব বিভাগে যোগাযোগের নামে ফিরে যাবার তাল করছে, ফিরে গিয়ে হয়ত পুলিশের সঙ্গে যোগসাজস করে জনতম সরকারকে বিপদে ফেলে দেবে ।

          তার আগে সেরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, কোনো-কোনো গ্রামবাসী জনতম সরকারের হুকুম পছন্দ হয়নি বলে পালিয়েছে জঙ্গলের বাইরে, নারায়ণপুরে, বা আরও দূরে অন্ধ্র কিংবা মহারাষ্ট্রতে । পুলিশ তাদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ঢুকেছে, খুনোখুনি হয়েছে, গুলিগোলা চলেছে । এই তো সেদিন সতেরো বছরের একটা মেয়ে ধরা পড়ল, সে আইইডি বানাতো ; সে জানিয়েছে যে তার চেয়ে কম বয়সী মেয়েরা আইইডি বানায় ।   

         গোঁড়-মাড়িয়ারা নির্লোভ, সরল প্রকৃতির, বুঝলে, খায়, নেশা করে, জংলি জানোয়ার বা পাখি শিকার করে, পেণ্ডা খেতি করে সবাই মিলে, ফসল তোলে, এই ভাবেই জীবন চলে যায় । সহযোগীতার ক্ষেত্রে ইজরায়েলের কোঅপারেটিভের চেয়ে ভালো । ওরা পড়ে গেছে মাওওয়াদি আর সরকারের জাঁতাকলে । আদিবাসীরা প্রথমে ভেবেছিল যে মাওওয়াদিরা ওদের সরকারি অত্যাচার-অবিচার থেকে বাঁচাবে।  তার বদলে সেই একই শাসনপ্রথা নতুন ভুত হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে ।

          ওখানে সরকারি স্কুল আছে, আঙনওয়াডিও আছে, সোলার পাওয়ার আছে, পাহাড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত হ্যাণ্ড পাম্প আছে । স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করার কাজ পেয়েছিল ওর বউ । রান্না করার দরকার হতো না । শুনে তুমি অবাক হবে যে স্কুলের প্রার্থনা হয় গায়ত্রী মন্ত্র গেয়ে, কারণ স্কুলটা  সরকারি, আমি দেখে এসেছি । স্কুল থেকে বরাদ্দ র‌্যাশন মাওওয়াদিরা নিয়ে চলে যেত, তাদের বন্দুকধারি ক্যাডারদের জন্য, তাতে কারোরই আপত্তি ছিল না । ওরা জানতে পারেনি যে ওদের ওপর জনতম সরকারের জন মিলিশিয়া নজর রেখেছে ; কার্তিক তো রিফিউজির ছেলে । মালকানগিরিতেও লক্ষ করতুম যে মাওওয়াদিরা বাঙালি রিফিউজিদের পছন্দ করে না । জন মিলিশিয়ারা বন্দুকধারী গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের থেকে আলাদা । জন আদালতে কাউকে মেরে ফেলার হুকুম হলে জন মিলিশিয়ার লোক তা পালন করে । জন মিলিশিয়ার ছোকরাদের কাছে ট্রানজিসটার আর ল্যাপটপ দেখেছি । ল্যাপটপে ওরা সিনেমাও দ্যাখে, হলিউডের হিন্দিতে ডাব করা সব ফিল্ম, হিরোগিরির ফিল্ম, যদিও বেশির ভাগ গোঁড়-মাড়িয়া হিন্দি ভালো জানে না । কুমিয়া, কার্তিকের বউও, তেমন হিন্দি জানত না । কার্তিক অবশ্য ছোটোবেলা থেকে ওদের সঙ্গে মিশেছে বলে গোঁড়-মাড়িয়ায় কথা বলতে পারে, আমরা দুজনেও তত ভালো পারি না ।

          বাচ্চা হবার পর কুমিয়াকে নিয়ে তিন-চার মাসে একবার আসত আমাদের কাছে । গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েদের গয়নার খুব শখ । কুমিয়ারও গয়না পরার শখ ছিল । সোনার চেয়ে রুপোর জল-দেয়া ব্রোঞ্জের গয়না ওদের বেশি পছন্দ । আমরা ভাবলাম ব্রোঞ্জের কেন দেবো, ছেলের বউকে দিচ্ছি যখন তখন রুপোর গয়নাই দিই। ওদের ওপর যে জন মিলিশিয়ার জাসুসরা নজর রাখত তা ওরা টের পায়নি । গয়না পরে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল কুমিয়াকে । কার্তিক ভাবল যে বার-বার কষ্ট করে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে আসা আর আবার আট-দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেরত যাওয়ার চেয়ে মোটর সাইকেলটাই গ্রামে নিয়ে গিয়ে রাখবে, ছাগল-চরানো রাস্তাতেও কার্তিক মোটর সাইকেল চালাতে পারে । ওর বউ আগে চলে গেল বাচ্চা নিয়ে যাতে জনতম সরকারের কোপে না পড়ে । কার্তিকের যেতে দু’দিন দেরি হয়ে গিয়েছিল, মোটর সাইকেলের সারভিসিং করাতে গিয়ে ।

          গ্রামে পৌঁছে কার্তিক জানতে পারল যে জন আদালতের বিচারে কুমিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে । গুলি করে মারা হয়েছিল কুমিয়াকে । কার্তিক যাবার আগেই ওরা কুমিয়াকে কবরও দিয়ে  দিয়েছিল । বাচ্চা ছেলেটা কার কাছে আছে জানতে চাইলে কেউ কার্তিকের সঙ্গে কথা বলেনি । ওকে বলা হয়েছিল তক্ষুনি নারায়ণপুরে ফিরে যেতে নয়তো ওরও কুমিয়ার দশা হবে । কুমিয়ার কবরের কাছে গাছের ডালে নিজের শার্ট খুলে বেঁধে খালি গায়ে চলে এসেছিল । 

           সেই যে ও জঙ্গল থেকে মোটর সাইকেলে চেপে পালিয়ে এসেছে, আর ও-মুখো হয়নি । আমাদের মনে হয়  পালিয়ে এসে বেঁচে গেছে । এই কিছুদিন আগে অপারেশান হাক্কা করেছিল সরকার, টোকে নামের পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। হেলিকপ্টারের ডানার বাতাসে অনেকের চালাঘরের ছাদ উড়ে গেছে । আসলে অবুঝমাড় নিয়ে সবাই এতকাল এমন গল্প ফেঁদেছিল যে প্রচার হয়ে গিয়েছিল জায়গাটা দুর্ভেদ্য । সরকার তো ড্রোন উড়িয়ে ফোটো তুলেছিল আর ভেবেছিল যে কালো-কালো দেখতে জায়গাগুলো বুঝি ট্রেঞ্চ আর মাওওয়াদিদের ক্যাম্প । কোবরা-ফোবরা, সিআরপিএফ, পুলিশের লোকজন অপারেশান হাক্কা চালিয়ে  ভেতরে ঢুকে বুঝতে পেরেছে যে সবই ফক্কিকারি, মাওওয়াদি, টিম্বার মাফিয়া আর সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থান্বেষী প্রচার ।

        –কিন্তু আমি তো এরকমই শুনে এখানে এসেছি । এটাই সেফেস্ট জায়গা মনে হয়েছিল ।

        গণেশচন্দ্র সরকার বললেন, আশির দশকের শুরুতে বিদেশি টিভি চ্যানেল অবুঝমাড়ে ঢুকে ওদের ঘোটুল নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে প্রচার করেছিল । এখন গোঁড়-মাড়িয়া মেয়েরা সকলেই পোশাক পরে, শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া, ভেতরের জামা । এখনও  ঘোটুল আছে, সেখানে পোশাক পরে ঢোকে ছেলে-মেয়েরা ; সেক্সের ব্যাপারে ওদের সমাজ ইউরোপ আমেরিকার চেয়েও প্রগ্রেসিভ আর পারমিসিভ । যখন তথ্যচিত্র তোলা হয়েছিল তখন ওদের ঘোটুলে ওরা পোশাক পরে যেত না । ভারত সরকার ভাবল যে এটা ভারতবিরোধী প্রচারের ষড়যন্ত্র, ভারতের ইমেজ বিদেশে নষ্ট  হচ্ছে । ব্যাস, হাঁটু-কাঁপা প্রতিক্রিয়ায় অবুঝমাড়কে প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করে দেয়া হল । এতকাল নো একট্রি জোনই ছিল, এই কিছুদিন হল নিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে । নিষেধের ফায়দা লুটত মাওওয়াদি, টিমবার মাফিয়া, বন বিভাগ, তেন্দু পাতার ব্যাপারি, রেভেনিউ ডিপার্টমেন্ট । নিষেধের দরুণ একদিকে তো নানা গল্প ছড়িয়েছে, অন্যদিকে দেশের অন্য আদিবাসীরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থেকেছে অবুঝমাড়ের আদিবাসীরা ।

         আমার প্রতিবারই এলেকশান ডিউটি পড়ে । গত বিধানসভা নির্বাচনে কোকোমেত্তায় ভোট দেবার জন্য কুরসুনার, জিলাপুর, সোনাপুর, কুদলা, কাছাপাল, ঝারাবাহি, মাঙ্গুর, বোলাবেড়া, মাস্তুর, সাহাকাগোড়া থেকে গোঁড়-মাড়িয়া আর মুরিয়ারা হেঁটে ভোট দিতে এসেছিল, বাচ্চা কোলে মেয়েরা, বুড়ো-বুড়িরাও । ভোটের জন্য ঢেড়া পেটানো হয়েছিল গ্রামে-গ্রামে, যাকে ওরা বলে মুনাড়ি । অনেকে আগের দিন রাতের বেলাই পৌঁছে গিয়েছিল বলে তাঁবু খাটিয়ে শোবার ব্যবস্হা করতে হয়েছিল ।

         এবারের সংসদ নির্বাচনেও গোঁড় মাড়িয়া মুরিয়ারা দলে-দলে ভোট দিতে এসেছিল । তা ভোট শেষে ফেরার সময়ে   পোলিং পার্টির আটজন আর আধামিলিট্রির পাঁচজনকে কেতুলনার গ্রামের কাছে ল্যাণ্ডমাইন পেতে উড়িয়ে দিল আশি-নব্বই জনের মাওওয়াদি জামাত । ঈশ্বরের কৃপায় আমার এলেকশান ডিউটি এখানেই পড়েছিল । তুমি বলো, ওভাবে কি বিপ্লব হবে ? গোঁড়-মাড়িয়াদের জীবনের উন্নতি হবে ? আমি তো কিছুই বুঝি না বাবা ।

         –বিপ্লব ? বিপ্লবের আমি তেমন কিছু বুঝি না । যুক্তাক্ষর শব্দগুলো সব বেকার ।

          হ্যাঁ, একটা কাজ ওরা করছে, তা হল  সেগুনগাছ, শিশুগাছ, শালগাছগুলো টিম্বার মাফিয়াদের করাত থেকে বেঁচেছে ; তখন যদি ওরা থাকত তাহলে মালিক মকবুজার মতন জঘন্য ঘটনা ঘটত না । আরেকটা হল, সব আদিবাসী এলাকার মতন অবুঝমাড়েও তো মাটির তলায় খনিজে ভরা । যতদিন ওরা পাহারা দিতে পারবে ততদিন কর্নাটকের আকরিক লোহার মতন লুকিয়ে-লুকিয়ে জাহাজ ভরে-ভরে মাও-এর দেশ চিনে চোরাচালান করা হবে না । দেখা যাক কারা শেষ পর্যন্ত জেতে ।

         কার্তিকের সঙ্গে কথা বললেই টের পাবে যে জঙ্গলের ভেতরে কে যে আদিবাসী, কে মাওওয়াদি জন মিলিশিয়া, কে জন আদালতের সদস্য, কে মাওওয়াদি তাত্ত্বিক, কে কেন্দুপাতার ফড়ে, আর কে বনদপতর বা রাজস্ব বিভাগের কর্মী তা তুমি পার্থক্য করতে পারবে না । শুধু পিএলজিএ, মানে গণমুক্তি গেরিলা বাহিনীর ক্যাডারদের, চিনতে পারবে, ওরা জওয়ানদের মতন জলপাইরঙের  পোশাক পরে । আমার-তোমার মতন সাধারণ মানুষের সামনে ওরা বেরোয় না বড়ো একটা । আদিবাসীরা দুপক্ষের শাসনের-হুমকির আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছে ।

         তুমি ফিউজিটিভ হয়ে এখানেই থাকো । বিহারে সবই কালক্রমে ধামাচাপা পড়ে যায়, তিন হাজার কোটি টাকার চারাঘোটালাই চাপা পড়ে গেল । এবারের এলেকশানে রাবড়ি দেবী এফিডেভিট দিয়ে জানিয়েছেন যে ওনার সম্পত্তি হল পঁয়ষট্টি কোটি টাকা, ওনার মেয়ে মিশার চার কোটি টাকা । তবেই বোঝো । সম্প্রতি প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পারিখের স্মৃতিকথা সময় পেলে পোড়ো । উনি লিখেছেন যে কয়লা মন্ত্রী শিবু সোরেন আর ওনার উপমন্ত্রী দাসারি নারায়ণ রাও কোল ইনডিয়া লিমিটেডের পদে পোস্টিঙের জন্য শশী কুমার-এর কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা একলপ্তে আর প্রতিমাসে দশ লাখ টাকা করে চেয়েছিল । এই তো দেশ, যার স্বাধীনতার জন্য আজও আমরা লাৎ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি । আমাদের কোনো আইডেনটিটি নেই । সনাতন যে গালাগাল দেয়, তা ইমপোটেন্ট রেজ ।  ও গালমন্দ করে শরীর সুস্হ রাখে । ইমপোটেন্ট রেজে ভুগে-ভুগে আমার কন্সটিপেশানের ব্যারাম হয়ে গেছে ; রাতে ল্যাক্সেটিভ খাই আর সকালে চোখ বুজে বসে থাকি, যারা আমাদের দুরবস্হার জন্য দায়ি তাদের মাথার ওপর ।

        –আমার রেজ ইমপোটেন্ট নয় বলে আমি ফিউজিটিভ, গংগোতা মায়ের গরম রক্ত আর বাঙালি বাবার ঠাণ্ডা রক্তের গুণ । বলল অপু ।          –কার্তিক তোমায় ওর মোটর সাইকেলে বসিয়ে একদিন অবুঝমাড় ঘুরিয়ে আনবে । কুমিয়া  মারা যাবার বাৎসরিকে গাছে নতুন কাপড় বাঁধতে যাবার জন্য গোঁ ধরেছিল, আমরা যেতে দিইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে, চারিদিকে নজর রাখতে পারবে।     

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *