ঔরস – ২

ছয়

          বাবা-মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মন কেমন করে মাঝেসাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই-করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োরের মাংসের বড়া , আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসন মাখা, হামান দিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই । ওনার ছেলে অপু , যদিও বাংলা বলতে পারে, কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে ; আরে অগর আপকা দিল নহিঁ লগতা থা তো ভাগ কেঁও নহিঁ গয়ে থে ? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক । পর আপ নহিঁ ভাগে । লগতা হ্যায় আপকো  অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুর সে হ্যায় । বিবি কহিঁ ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মণ্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম ?

        তারিণী মণ্ডলের হাঁটু-ডিংডং স্ত্রী, ফোকলা গুটকাদেঁতো হাসি হেসে নিজের মহিষ-কালো বরকে খুসুরফুসুর কন্ঠে  বলেন, দোগলা হ্যায় না আপকা পোতা, ইসিলিয়ে বহুত দিমাগ রখতা হ্যায় । সাধারণ জারজ নয়, বাঙালি-বিহারি, উঁচুজাত-নিচুজাত, পড়াশোনাঅলা- মুখ্খু, শহুরে-গাঁইয়া, গরিব-মালদার, কানুনি-গয়েরকানুনি, কলমচি-খেতিহর, কত রকমের মিশেল ।

         –আরে মাথা তো খাটিয়েছিলুম আমি ছোঁড়াটাকে বন্ধক বানিয়ে, ঘরজামাইও পেলুম, আবার নসলও ভালো হয়ে গেল । এখন কয়েক পুরুষ চকচকে ফর্সা বাচ্চা পাবি ; অপুর মেয়েদের বিয়ে দিতে বেশি অসুবিধা হবে না। জামাইবাবার মেয়ে না হওয়াই ভালো, কী বল ? বলল তারিণী মণ্ডল, ডান চোখে হাসি মেলে । যখন সুশান্ত ঘোষকে কিডন্যাপ করেছিল, তখন অবশ্য দুটো চোখই ছিল,বাঁ চোখটা নষ্ট হয়নি রামধারী ধানুকের হামলায় ।

         –সে কথা ঠিক । আমি তি ভেবেছিলুম ছোঁড়াটা পালিয়ে যাবে ।

         –আমার মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে পালিয়ে গেলেই হল ? ধরে এনে কেটে টুকরো করে দিয়ারার বালিতে পুঁতে দিতুম ।

         –ছোঁড়াটা ভালোবেসে ফেলেছে ওর গালফোলা বউকে । শোবার সময় রোজ রাতে খুশবুর টিন থেকে গ্যাস মারে তোমার মেয়ের গায়ে, দ্যাখো না কেমন গন্ধ ভুরভুর করে বেবির গা থেকে, মনে হয় চবুতরা জুড়ে ফুলের গাছ ? ভৌঁরাভৌঁরি জোড়ি ।

         –তাজ্জব ব্যাপার, না ? বকের সঙ্গে কোকিলের বিয়ে !

         –তাজ্জবের কি আছে । এরকম কচি কুচুরমুচুর মেয়ের সঙ্গে কি ওর বিয়ে হতো ওদের নিজেদের সমাজে ? কোনো দরকচা হেলাফেলা টিড্ডিছাপ বউ পেতো ।

         –কি যা তা বকছিস নিজের মেয়ের সম্পর্কে ।

         –সত্যি কথাটাই বলছি । নিজের বিয়ের কথা মনে করে দ্যাখো । তুমিও কচি কুচুরমুচুরই পেয়েছিলে । ওই কুচুরমুচুর জিনিসটাই হল মেয়েদের দুসরা দিল, যা মরদদের থাকে না । দ্বিতীয় হৃদয়ে রক্ত থাকে না, থাকে রসালো মাদকের ফাঁদ, যে ফাঁদে একবার পড়লে রোজ-রোজ পড়ার নেশায় মরদরা ভোগে, যতদিন সে মরদ থাকে ততদিন তো ভোগেই ।

         –তা ঠিক, ছিলিস ছাপ্পানছুরি-ছইলছবিলি । এটা কোনো টিভি সিরিয়ালের সংলাপ বললি নাকি ? ছোঁড়াটা নাকি প্রথম রাতেই রক্তারক্তি করে ফেলেছিল ?

         –হ্যাঁ । বেচারা । গলার শেকল খুলে-দেয়া শহুরে রামছাগল । কত দিনের বদবুদার তবিয়ত ।

         –ওদের বিয়ে দিতে এত দেরি করে কেন জানি না । কম বয়সের টাটকাতাজা রস সব বেকার বয়ে চলে যায় ।

         –দেরি করে বলেই তো পেলে ছোঁড়াটাকে ।

        তা নয় ; কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত ঘোষ হয়ে গেছেন দিয়ারাচরিত্রের উন্মূল মানুষ । যখন নোট গোণার চাকরি করতেন, তখন বিহারি জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভূমিহার কুরমি যারা, কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্হ বিহারি আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান আনতেন। ব্র্যাণ্ডেড জ্যাকেট জিন্স টিশার্ট উইন্ডচিটার । দপতরের গৃহবধু কর্মীদের চোখে সুশান্ত ঘোষ ছিলেন অবিনশ্বর জাদুখোকোন, লিচুকুসুম, মাগ-ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ । গেঁজিয়ে যেতে পারতেন, চোখে চোখ রেখে, ননস্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছেন পৌরাণিক কিন্নরে, সবায়ের অজান্তে । গায়কের ইশারায় যেভাবে ধ্বনিপরম্পরা টের পায় তবলাবাদকের আঙুলের ছান্দসিক অস্হিরতা, তেমনই, নৈশভোজে বেরোনো শীতঘুম-ভাঙা টিকটিকি যুবকের মতন, মহিলা সহকর্মীদের অবান্তর কথাবার্তা, ভোজপুরি বা হিন্দি বা বাংলায় বা ইংরেজিতে, বলার জন্যই বলা, শ্বাসছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে গিলতেন সুশান্ত ঘোষ ।

         এখন আর ওনার, সুশান্ত ঘোষের সম্পর্কে,  আগাম বলা যায় না কিছু । চাকরি করতেন পচা টাকার নোট জ্বালিয়ে নষ্ট করার । এখন কাঁচা টাকার করকরে আরামে ঠ্যাং তুলে খালি গায়ে, ভুঁড়ির তলায় চেককাটা লুঙ্গি পরে, লুঙ্গির গেঁজেতে সেমিঅটোমেটিক পিস্তল, যা জীবনে কখনও চালাননি, শাশুড়ির পরানো কালো কাপড়ের ছোট্ট তাবিজ গলায় , নিজেকে অন্যমানুষে পালটে ফেলার আনন্দে তরমুজ-সোমরসের হেঁচকি তোলেন। যা একখানা চেহারা করেছেন, ওনার স্তাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ে ওনাকে বলে গেণ্ডা-মরদ অর্থাৎ আলফা গণ্ডার ।

         প্রতি রাতে শোবার আগে বিবসনা বউয়ের আগাপাশতলা বডি ডেওডোরেন্ট স্প্রে করেন সুশান্ত ঘোষ বা গেণ্ডা-মরদ, মানে আলফা গণ্ডার । এমন নয় যে বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ  ; প্রথম রাতেই সুশান্ত ঘোষ একটা স্যান্ডালউড সাবান কিনে বলে দিয়েছিলেন যে রোজ এই সাবান মেখে স্নান করতে হবে, সপ্তাহে একদিন শাম্পু করতে হবে । বউই আসক্ত হয়ে গেছে ডেওডোরেণ্টের, শ্যাম্পুর, লিপগ্লসের, লিপস্টিকের, ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলির, কমপ্যাক্ট পাউডারের, ওলে টোটাল এফেক্টের, নখপালিশের, পিচ-মিল্ক ময়েশ্চারাইজার আর নানা আঙ্গিকের শিশি-বোতল-কৌটোর-ডিবের সুগন্ধের নেশায় ।

         শহুরে দশলাখিয়া বরকে বশ করার জন্য, টিভিসুন্দরীরা যা মাখে, তা মেখে কৃষ্ণাঙ্গী-অপ্সরা হবার প্রয়াস করে বেবি, সুশান্ত ঘোষের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর শ্যামলিমা চির-তুলতুলে বউ, আর সুশান্তর শাশুড়ি বশ করার মন্ত্রপূত তাবিজ পরিয়ে জামাইকে বেঁধে রেখেছেন বেবির আপাত-বেবিত্বে ।

         কোনো রাতে মাতাল অবস্হায় সুশান্ত ঘুমিয়ে পড়লে, মাঝরাতে বউ ওনাকে ঠেলে জাগিয়ে দিয়ে বলে, উঠিয়ে না, নিন্দ নহিঁ আ রহল , জরা গ্যাস মার দিজিয়ে না । হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা একাধিক ডেওডোরেন্টের স্প্রে থেকে যেটা হাতে পান বউয়ের পোশাকহীন গায়ে সুগন্ধী  বর্ষা ছিটিয়ে এক খেপ দ্রূত-প্রেম সেরে ফেলে দুজনে দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন । অনেক সময়ে বেবি নামের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ আগেই হুশিয়ারি দিয়ে রাখে, জল্দিবাজি মত কিজিয়ে, ধিরজ সে কিজিয়ে, বুডঢি নহিঁ না হো গয়ে হ্যাঁয় হম ।

         ডেস্কটপের মনিটারে , বেবি নামের মেঠোগন্ধা শ্যামলিমা বউকে, পর্নো ফিল্ম দেখিয়ে আরো বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের । বেবি বলে, ফিলিম মেঁ জইসন কর রহা হ্যায় ওইসন কিজিয়ে না, উঠাইয়ে, লেটাইয়ে, গিরাইয়ে, গিরিয়ে, পটক দিজিয়ে, সাঁস ফুলাইয়ে, মুহ সে প্যার কিজিয়ে, হমকো ভি মৌকা দিজিয়ে । কেতনা দের তক ভোগ করতা হ্যায়, অওর আপ হ্যাঁয় কি কবুতরকে তরহ ঝপট লিয়ে বস সো গয়ে । শুন রহেঁ হ্যাঁয় নাআআআআআ । তারপর বলে, দেখেছেন তো ওরা কেউ পৈতে পরে না ; আপনি যদি পৈতে পরতেন তাহলে সুতোর লচ্ছা সামলাতেই আমাদের সময় চলে যেত , ভালো করেছেন পৈতে পরা বন্ধ করে ।

         ঘুমনেশার ঘোরে সুশান্ত বলেন, আরে ওরা সব সাহেব-মেম কিংবা হাবশি, কুমিরের মাংস, বনমানুষের মাংস, ঘোড়ার মাংস, হাতির মাংস খায়, গাধার মাংস খায়  ।

       –হাঁ, সে-কথা ঠিক, হাতিদের মতন ; হাতিরা কেমন নিজেদের গোমোরের জিনিসকে লটকিয়ে হাঁটে, মাটিতে ছুঁয়ে যায়। আপনি অপুকে বিলেতে পড়াশুনা করতে পাঠাতে চাইছেন ; সেখানে গিয়ে ও যদি মেম বিয়ে করে তাহলে তো সঙ্গত দিতে-দিতে  হালকান হয়ে যাবে ! বিয়ে দিয়ে পাঠাতে পারতেন ; ওর বউ থাকত দিয়ারায় আমাদের সঙ্গে ।

       –ওখানে বিয়ে করার দরকার হয় না ; না করেই একসঙ্গে থাকা যায় । সঙ্গত মনের মতন না হলে আরেকজনের কাছে চলে যাওয়া যায়, বুঝলি ?

       –তাহলে তো ভালোই, মন ভরে গেলে বাড়ি ফিরে আসবে ; তখন ওর বিয়ে দেবেন ।

        অপুর মা, সুশান্তর মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বউ, পর-পর কয়েকদিন মাঝ রাতে ঘুম ভাঙাবার পর বলে ফ্যালে, চাহিয়ে তো এক বংগালন বিবি শাদি করকে লাইয়ে না পটনা য়া কলকত্তা সে, সাহব-মেম খেলিয়েগা দোনো মিলকর, জইসন নঙ্গা-ফিলিম মেঁ দিখাতা হ্যায়, কেতনা মছলি পকড়া যাতা হ্যায় অপনে হি নদী মেঁ, বড়কা-বড়কা রোহু । ঘরকা বনা মিঠাই খাতে হম লোগ সব । আপ চখতে বংগালন বিবি কি মিঠি চুচি । হমরে বিছওনে মেঁ হি, লগাকে মচ্ছরদানি, পিলাসটিকবালা গুলাবি মচ্ছরদানি । নহিঁ তো কলকত্তা যাইয়ে না, বংগালন রণ্ডিলোগন কা বাজার নহিঁ হ্যায় ওয়াহাঁ কাআআআআআআ ? কমর হিলাকে আইয়ে, অইসন দুখি-দুখি মত রহিয়ে, অওর দারু মে মত ডুবে রহিয়ে রাত ভর ; দারু পিকে আপ একদম সঠিয়া যাতে হ্যাঁয় । দিন মেঁ পিজিয়ে দারু, কৌনো মনা কিয়া হ্যায় কাআআআআ ? রতিয়া কে বখত বদনওয়া ফিরি রখিয়ে জি ।

        বারবার শুনে বিরক্ত সুশান্ত একদিন বলেছিলেন, ঠিক আছে, নিয়ে আসবো একজন লেখাপড়া-শেখা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে । নাছোড়বান্দা বেবি, যাকে বলা যায় তৎক্ষণাত, প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, নিয়ে এসে দেখুন না, আপনার আর আপনার বাঙালি বউয়ের মাথা, সেই দিনই হাসুয়া দিয়ে ধড় থেকে নামিয়ে দেবো ; জানেন তো আমি তারিণী মণ্ডলের মেয়ে ।

         –হ্যাঁ, জানি, তুই প্রথমে তারিণী মন্ডলের মেয়ে, তারপর আমার বউ । ধড়টা তো তোকে দিয়েই দিয়েছি, আর আলাদা করে নিয়ে কী করবি ? আর মুণ্ডুও অনেকসময়ে তোর উরুর ঝক্কি সামলায় ।

         –খারাপ লাগল শুনে ? তাহলে মাফ করে দিন । আমি বেবি ঘোষ, আপনিও জানেন, আমিও জানি, ভোটার লিস্টে দেখে নেবেন, আমি তো লিখাপড়হি জানি না, কিন্তু বেবি ঘোষই লেখা আছে আমার ফোটুর পাশে, ভোট দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি । আমি বেবি মণ্ডল নই । আমার ছেলেও মণ্ডল নয় । আর বলব না, মাফ করেছেন কি না ? আঁয় ?

         –করে দিলুম । এখন যা । দরকার হলে ডেকে নেবো ।

         –দাঁড়ান চান করে আসি, তারপর । ভিজে-ভিজে শরীরে আপনি যখন ফোঁটায় ফোঁটায় গুটিপোকা ফ্যালেন তবিয়ত এতো মগন হয়,  গুটিপোকাগুলো সব ভেতরে গিয়ে নানা রঙের প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় ।

         –এই জন্যই তো থেকে গেলুম ; যখন বলি তখনই তুই তৈরি, ঘুম থেকে উঠে হোক, দুপুর হোক, সন্ধ্যা হোক, মাঝ রাত হোক ।

         –রান্না চাপিয়ে গ্যাস নিভিয়েও তো কতবার এসেছি আপনার গুটিপোকাদের ফোঁটা নিয়ে প্রজাপতি ওড়াবো বলে। ভাগ্যিস আপনাকে পেয়েছি, কোনো গংগোতা বর হলে তো যৌবন নষ্ট হয়ে যেত বছর-বছর বাচ্চা পয়দা করে ।

        দিয়ারা, দ্বীপের মতন চর, জেগে ওঠে,  জলপ্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর, জামাইবাবার মতন, বেগুসরায় মুঙ্গের থেকে গঙ্গা নদীর কিনার বরাবর, ভাগলপুর কাটিহার অব্দি ; এক জায়গায় ডুবে আরেক জায়গায় কুমিরের মতন জেগে ওঠে, খেলা করে অজস্র মানুষের সুখ-শান্তি নিয়ে, তাদের দুর্ধর্ষ ক্রুর মমতাহীন আতঙ্কিত উদ্বিগ্ন করে রাখে আজীবন, ভালা বরছি গাঁড়াসা ভোজালি পাইপগান কাট্টা তামাঞ্চা একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস একে-ছপ্পন দিয়ে ।

         আচমকা যদি কখনও ওনার, সুশান্ত ঘোষের, মগজে ঘুমিয়ে থাকা লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসে জানতে চায় যে, ওহে খোকা, তুমি কি ছিলে আর কি হয়ে গেলে, তখন ছিপি খুলে  গুড়ে চোলাইকরা তরমুজের সোমরসের বোতল নিয়ে বসেন, আর নিজেকে বলেন, ইতু জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে চলেছে, আমার উদ্দেশ্য আমাকে খুঁজতে হয়নি। উদ্দেশ্যই আমাকে খুঁজে নিয়েছে । আমারও কী আত্মপরিচয় আছে ? কী ? আমি তারিণী মণ্ডলের জামাই, বেবির স্বামী, গংগোতা ক্ল্যানের ডনের অভিনেতা ! আমি কে ? আমি, যার নাম সুশান্ত ঘোষ ? আই অ্যাম নাথিং ।

       ল্যাপটপে বা স্মার্টফোনে লোডকরা ওনার প্রিয় গান শোনেন, বারবার, বারবার, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন, ব্যায়ঠে রহে তসব্বুর-এ-জানা কিয়ে হুয়ে, দিল ঢুণ্ডতা হ্যায় ফির ওয়হি ফুরসতকে রাতদিন…। শুনতে পান, বেবি বলছে, এরকম দুখি-দুখি গান শুনছেন কেন, অন্য গানটা শুনুন না, দো দিওয়ানে শহর মেঁ, রাত মেঁ য়া দোপহর মেঁ…। ঠিক আছে, শোন, জিন্দগি ক্যায়সি  হ্যায় পহেলি হায়, কভি ইয়ে রুলায়ে, কভি ইয়ে হাসায়ে…।

        বেবি : কী-ই বা করবেন, আমাদের দুজনের অদৃষ্ট, আর সেই শুশুকটার ইশারা, আপনি রামচন্দ্রজীর মতন দরজায় এসে যেদিন দাঁড়ালেন, তার আগের দিন গঙ্গায় শুশুক দেখে সবাই বলেছিল যে আমার জন্য গঙ্গা মাইয়া একজন রাজপুত্রকে পাঠাচ্ছেন । হ্যায় নাআআআআআ ।

        দুপুরের প্যাচপেচে গরমে একা বসে-বসে স্বস্তি না পেলে ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে ট্রিপল এক্স । তাতেও স্বস্তি না পেলে বেবি বলে হাঁক পাড়েন, আর বেবি ঘরে ঢুকলে, বলেন, দরোজা বন্ধ করে দে, এই নে, দেখে একটু শরীর টাটকা-তাজা করে নে, তারপর তুই শুশুক ধরিস, আমি চুচুক ধরব, তাড়াহুড়ো করব না । বেবি উত্তর দ্যায়, তাড়াহুড়ো করলে আপনার গুটিপোকাগুলো থেকে তরমুজের গন্ধ বেরোতে থাকে, ভাল্লাগে না, গ্যাসের টিন বরবাদ ।

      জমিন, জল, জবরদস্তি– এই তিনটের মালিকানা, একদা লালটুশ এখন ভুঁড়োকার্তিক সুশান্ত ঘোষকে করে তুলেছে বহু ফেরারির আশ্রয়দাতা । নর্থ বিহার লিবারেশান আর্মির নেতা শংকরদয়াল সিং, ফাইজান পার্টির অওধেশ মণ্ডল আর হোয়াইট অ্যান্ট পার্টির বিকরা পাসওয়ানদের পোঁদে বেয়নেট ঠেকিয়ে পুলিশ  যখন তাড়িয়ে বেড়াবার খেলা খেলছিল, তখন সুশান্ত ওদের লুকিয়ে রেখেছিলেন দুষ্প্রবেশ্য নামহীন এক দিয়ারায়, গঙ্গামাটির প্রলেপ-দেয়া, ডিজেল ইনভার্টারে চালানো রুমকুলারে ঠাণ্ডাখড় আরামঘরে । ভাড়া সেভেনস্টার হোটেলের । রুম সার্ভিস চাইলে ওনার শশুর ডান্সবারের নাচিয়েদের আনান নৌকোয় চাপিয়ে, সার্ভিস হয়ে গেলে ডান্সগার্লদের  ফেরত পাঠান ভোর রাতের নৌকোয় চাপিয়ে ।

         সুশান্ত ঘোষের পারিবারিক কিংবদন্ধি অনুযায়ী,  ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা ছিল ঠগি ; গুড়ে চোলাই করা তরমুজের মদ টেনে সুশান্ত ঘোষ ভেবে ফ্যালেন যে হয়ত তাই তিনিও শশুরের দেয়া সুপারঠগির সিংহাসন দখল করলেন ।

         পুলিশ যায় না অপরিচিত কোনো দিয়ারায় ; গুজব যে ভাগলপুর শহর থেকে চান করার মার্বেল-বাথটব এনে দিয়ারার বালিতে বসিয়ে রেখে গেছেন তারিণী মণ্ডলের বাবা । তাইতে নাইট্রিক অ্যাসিড ভরে একজন পুলিশের মুখবির বা ইনফরমারকে চুবিয়ে গলিয়ে ফ্যালা হয়েছিল ।  

.

সাত              

         শেষবার যখন ইতু ওর ক্লিনিক থেকে নিজের সঙ্গে, একদা পালিয়ে-যাওয়া অমিতকে বাড়ি নিয়ে এলো, বিরোধের হল্কা প্রায় নিভে গিয়েছিল, কেননা ইতিমধ্যে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একে আরেকের সঙ্গে কথাহীন বার্তা-বিনিময় করে নিয়েছিলেন, যে, ইতুটাকে ঘাড় থেকে যদি নামানো যায় তাহলে স্হান-কাল-পাত্রের যেমন সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনই, আর্থিক দায়টাও বাড়ির বাইরে চালান করে দেয়া যাবে। এর আগে যখন অমিত এসেছে, সেদিন বিকেলেই চলে গেছে বা থেকে গেছে একদিন, বহিরাগতের মতন, অতিথির মতন নয়, বাড়ির সদস্যের মতন তো নয়ই ।

         শেষবার যখন অমিত এসেছিল,  কোথায় শোবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল, ইতু প্রস্তাব দিল, তিনতলার ছাদে ওর ঘরেই রাতটা কাটাক অমিত, সঙ্গে টয়লেট-বাথরুম আছে, কোনো অসুবিধা হবে না ; দোতলার বারান্দায় যে খাট পাতা আছে তাতে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়বে ইতু, একটা রাতেরই তো ব্যাপার । আগে ঘরটা ছিল সুশান্তর বাবার, তিনি মারা যেতে জাঠতুতো ভাই সমরেন্দ্রর দখলে গিয়েছিল ; ওর বউ যমজ বাচ্চাদের ইতুদের বাড়ির জিম্মায় চাপিয়ে ঝাড়া হাত-পা ডিভোর্স দিয়ে নাচতে-গাইতে চলে গেছে, যার দরুণ নিজের বলার মতন একটা ঘর পেয়েছে ইতু ।

         অমিত যখন এই বাড়ির সদস্য ছিল, তখন ও একতলায় ওর রাঙাবাবা-রাঙামা, মানে ইতুর রাঙাকাকা-রাঙাকাকিমার ঘরে ওনাদের সঙ্গে থাকত । উধাও হবার পর প্রথমবার ফিরে, অমিত ওর রাঙাবাবা-রাঙামায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়নি ; ওনারাও কুন্ঠিত, হয়তো অমিত চলে যাওয়ায় ওনারা যেচে-নেয়া দায়ভার থেকে ছাড়ান পেয়েছেন ।

         শুকগে তিনতলার ঘরে, মরুকগে যাক, মেয়েটা মা-বাপকে খেয়েছে, এবার ছেলেটাকে খাক, বয়স্কদের মুখ দেখে, তাদের ঘিলুর ভেতরের মেঘে সেরকমই রুপোলি পাড় দেখতে পেয়েছিল ইতু ।

         সকলকে শুনিয়ে ইতু বলল, তুই চল, বিছানা পেতে দিচ্ছি, জিনিসপত্র নেই দেখছি, শুধু এই কাঁধব্যাগ ?

         –হ্যাঁ, এতেই আমার পেন আর খাতা আছে, সংবাদ যা পাই টুকে নিই, পরে অফিসে গিয়ে তথ্যগুলো খাতা থেকে লিখে নিই আর যা দেখেছি বা শুনেছি তা স্মৃতি থেকে লিখে নিই । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।

         –একটা ল্যাপটপ রাখলেই পারতিস, রিপোর্টাররা তো আজকাল ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এই সব নিয়ে কাজ করেন । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।

         –আমি এখনও টেকস্যাভি হতে পারিনি । হাতে কলম নিয়ে লিখতে ভালো লাগে আমার । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।

         –তুই স্নানটান করে রেডি হয়ে নে, খাবার সময় হলে ডেকে নেব । ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।

         –আমার না খেলেও চলবে, রিপোর্টারের চাকরিতে সময়ে খাওয়া হয়ে ওঠে না, জানিসই তো, অভ্যাস হয়ে গেছে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।

         –ও লজ্জা পাচ্ছিস । এমব্যারাসড ফিল করার কী আছে, আমি তোর ডিনার ঘরেই পৌঁছে দিচ্ছি । ডিনার মানে রুটি আর আলু-পটলের তরকারি হয়েছে আজকে । ছয়টা রুটি চলবে তো ? ইতুর অভিনয়, সংলাপ ।

         –না না, দুটো রুটি হলেই হবে । অমিতের অভিনয়, সংলাপ ।

         রাঙাকাকা আর সুশান্তজেঠুর  মা, যাকে ওনার ছেলেরা, ভাসুরপো-দেওরপোরা, তাদের বাচ্চারা, অন্নমা বলে ডাকে, অমিতকে বললেন, তুমি আসো বেশ ভালো লাগে বাবা , তুমি সুশান্তর সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, এ-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েই বা কেন গিয়েছিলে , সব বাড়িতেই অমন মেলামেশা হয়, তাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় নাকি , কী আর বলব, আমার কোনো গুরুত্ব আর নেই, সুশান্তর বাবা মারা যাবার পর কিছুই আর ভালো লাগে না । কিন্তু প্রতিবার অমন আপত্তি করো, আর যাই-যাই করো বলে মন খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আমার মন বিষিয়ে থাকে, জানোই তো ।

         ইতু জানে, সুশান্তজেঠুর অভাব, জেঠুর বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলের মাধ্যমে কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করেন অন্নমা । অতনুজেঠুকে ইতু দেখেছে ছোটোবেলায়, সুশান্তজেঠুর মোটরসাইকেলে বসে এ-বাড়িতে আসতে, কিন্তু ভুলে গেছে ওনার মুখ । সুশান্তজেঠু কিডন্যাপ হয়ে চলে গেলেন, তারপর অতনুজেঠু চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে গেলেন কোথাও । তখন সবাই বলত উনি সাধু হয়ে গেছেন, কুম্ভ মেলায় ওনাকে জটাজুট দেখা গেছে  । শেষে উনি যখন অমিতকে এবাড়িতে রাখতে এলেন, ইতু তখন স্কুলে, জানা গিয়েছিল যে উনি নওয়াদা জেলার কোনো গ্রামে মানসী বর্মণের সঙ্গে সংসার পেতেছেন, সেই বাড়িতে আবার মানসী বর্মণের স্বামীও থাকেন । আরও পরে, যে অফিসে উনি কাজ করতেন, সেখানের কর্মীদের সূত্রে, কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল যে ওনারা নকসল্লি-মালে আন্দোলন করতেন, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন ; ওনাদের বিপ্লবী জীবনে শিশু অমিত খাপ খাবে না ভেবেই হয়ত রেখে গিয়েছিলেন ইতুদের বাড়িতে । বাবা-মাকে খুঁজে পাবার আগে পর্যন্ত অমিত ছিল বাবাহীন-মাহীন ।

         তিন তলার ঘরে পৌঁছে ইতু বলল, তোর মেসেঞ্জার আমাকে যে চিরকুট দিয়েছিল তাতে তো লেখা ছিল তুই কালকে সকালে আসবি ? মেসেঞ্জারদের দেখে বাড়ির লোকেদেরও খটকা লাগে ; বলেন ওরা কে রে, তোর পেশেন্ট, অথচ তুই তো বলতিস যে তোর রোগি জোটে না । বানচোদ, তোর জন্য কতো আর মিথ্যার সিনেমা করব ? আমি বিপদে পড়লে ক্ষতি নেই, বাড়িসুদ্দু লোকেরা যেন বিপদে না পড়ে ।

         –আমার বিহারশরিফে একটা কাজ ছিল । প্রতিবারের মতন আমি পাটনায় চলে এলুম । কতদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়নি, মুখোমুখি কথা হয়নি । তোকে টাচ অ্যান্ড ফিল করতে ইচ্ছে করে ।

         ডিনারের বদলে একটু পরে ফোটো অ্যালবাম নিয়ে এলো ইতু । খাটের ওপর বসে, অ্যালবাম খুলে দ্যাখালো, এই দেখ, আমাদের  দোল খেলার দিন তুই, তোর ক্লাসের বন্ধুরা সবাই এসেছিল, এই যে তোর ছবি, কতকাল হয়ে গেল, অবহেলায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ।

         গোটা দশেক ফোটো ছিল ওদের, সেগুলো প্লাসটিকের খাপ থেকে বের করে অমিত যখন বলল, আমি কি এগুলো রেখে নেব, তখন ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ইতু বলল, রেখে আবার কী করবি ? ডেসট্রয় করে ফেলতে চাইছিস তো ?

         –হ্যাঁ, এ-বাড়িতে আমার কোনো চিহ্ণ রাখতে চাই না ।

         –পরে কথা হবে, ফোটোগুলো ছিঁড়তে-ছিঁড়তে বলল ইতু । তারপর হাতের মুঠোয় দলাটা ধরে যোগ করল, জ্বালিয়ে ফেলতে হবে তো ? ডিনার আনছি, ঘুমিয়ে পড়িসনি যেন । ফোটোগুলো থাকলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হতো না । এই বাড়িতে এসে কে-ই বা তোর ফোটো খুঁজবে । যাদের খোঁজবার তারা যদি সন্দেহ করে থাকে তাহলে  তোর স্কুল-কলেজের রেকর্ড থেকেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে ডোসিয়ার বানিয়ে ফেলে থাকবে ।

        –ফোটোগুলো কেনই বা রেখেছিলিস, আননেসেসারিলি ।

         –ফোটোগুলো ছমাস যাবত প্রায়ই দেখতুম আর আশা করতুম যে তোর চিরকুট আসবে বা তুই নিজে আসবি। তার বদলে  এসেছে তোর মেসেঞ্জার, একজন চিঠি দিয়ে যায়, তো আরেকজন নিয়ে যায় । ভাগ্যিস ক্লিনিকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতে হল ।

             রাতভোজন এনে, সামনে বসে অমিতকে খাইয়ে, বাথরুম থেকে অমিত হাত ধুয়ে এলে, ইতু বলল, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে, তোর আর কিছু চাই ?

         –না, এত করছিস আমার জন্য, না চাইতেই । কাল সকাল-সকাল বেরিয়ে যাবো ।

         –বার-বার অমন যাই-যাই কোরিসনি তো, ইউ ইডিয়ট । কতদিন পর তো এলি । বলেছিলিস সঙ্গে নিয়ে যাবি অথচ প্রতিবার এড়িয়ে যাস, ইউ লায়ার । আমার তো কেমন সন্দেহ হওয়া আরম্ভ হয়েছে ।  তোর হয়তো কিছুই চাই না, আমার চাই, আমি এবার তোর সঙ্গে যেতে চাই, পালাতে চাই এখান থেকে ।

         –কিন্তু..

         –থাম দিকিনি । ফোটো জ্বালিয়ে এলুম , আর এখন আবার  গল্প ফাঁদবার তালে আছিস । তোর কাঁধব্যাগও দেখে নিয়েছি,  শুধু একটা লুঙ্গি আর গামছা । জানতুম না যে সিক্রেট কাল্টের মানুষরাও মিথ্যাবাদী হয় । আমি এবার তোর সঙ্গে যাচ্ছিই । ফাইনাল ।

        অমিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আত্মগ্লানির মতন করে বলল, সিক্রেট কাল্ট  বলে অপমান করিস না প্লিজ, চে গ্বেভারার নাম শুনেছিস ?

          –শুনেছি । বিপ্লবীদের রোমান্টিক মৃত্যু নিয়ে বেশ একটা মুখরোচক রহস্য তৈরি করে ফেলিস তোরা । গুয়েমুতে মরে পড়ে-থাকা স্তালিনকে নিয়ে, কই, তোদের মুখে কিছু শুনতে পাই না । পল পটের বিষয়েও শুনি না। কিম জং উন, কিম জং ইন, কিম জং হিং এটসেটরা, তাদের কথাও তো শুনি না । যাকগে যাক, কী হবে আমার ওসব জেনে ? তোর কাজের অংশীদার করার প্রয়োজন মনে করিসনি  আমাকে । আমি যেন তোর ডাকবাক্স । একজন চিঠি দিয়ে যায়, আর আরেকজন এসে নিয়ে যায় । এতই যখন বিশ্বাস করেছিস আমাকে, তো সঙ্গে নিসনি কেন ? এ-বাড়ি ছেড়ে যখন উধাও হয়ে গেলি তখনই তো সঙ্গে নিতে পারতিস ? তোর নিজের বাবা-মাকে খুঁজে পেলি, তবু নিয়ে গেলি না ।

         –চেয়ার রয়েছে তো, বোস না  আয়েস করে, গল্প করা যাক ।

         ইতু বিছানার ওপর নিজেকে, তেমনই মনে হল অমিতের, পাথর-চাঁইয়ের মতন  ফেলে, বলে উঠল, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে, চেয়ারে বসলে হবে না । অমিত অনুমান করতে পারেনি ইতু কী করতে চলেছে। ইউ              কাওয়ার্ড আহাম্মক, অমিতকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল প্রগলভা ইতু ; আঁকড়ে ধরে, ইতু নিজের ঠোঁট অমিতের ঠোঁটে চেপে ধরে রেখেই বলল,  তুই হয় আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবি, নয়তো আমি আজকে রাতেই আত্মহত্যা করে তোর আরেকবার উধাও হয়ে যাওয়া ভণ্ডুল করে দেব ।

         –তুই কী করতে চাইছিস বল তো ? দু’জনে এভাবে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম বলে, আমাকে তোদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল । এবার দেখে ফেললে ওনারা নির্ঘাত গলাধাক্কা দেবার আগে বেদম পিটুনি দেবেন । বলল উদ্বিগ্নবাক অমিত ।

         –ছাঁচি পেঁয়াজি মারিসনি । ভয়কে কাবু করতে শেখ, স্টুপিড । মার খেলে পালটা মার দিতে শেখ । নিজে তো মা-বাবার আদর-ভালোবাসা খাচ্ছিস । আমার কি ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে না ? জড়িয়ে ধর আমায়, হোল্ড মি ইন ইওর আর্মস, শক্ত করে ধর । প্রেম কর আমার সঙ্গে । জানি আমি প্রায় চটা-ওঠা, তামাটে, নাক-নকশা ভালো নয় । হলেই বা তুই কোনো সিক্রেট কাল্টের জানগুরু, আমিও তো মানুষ, না কি, অ্যাঁ । সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য,  কিছু করার কাজে কি আমার কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ? ইতুর নিঃশ্বাসে তাপ । অমিতকে জাপটে বিছানায় শুয়ে ইতু বলল, তোর মনে আছে নিশ্চই তোর মা তোকে ভালোবাসা সম্পর্কে কী বলেছিলেন ? তবে ?

         –অমিত বলল, মায়ের কথায় তো সঠিক উত্তর পাইনি । যতই যাই হোক,  কেন মা-বাবা আমাকে, নিজের বাচ্চাকে, ফেলে চলে গিয়েছিলেন, আর কখনও পেছন ফিরে তাকাননি, তার সঠিক উত্তর আজও পাইনি ।

         –অত-শত জানি না, আই অ্যাম নট গ্রেট লাইক দেম ; নিজের আর্জের কথা জানি । অবদমনের মানসিক অশান্তির কথা জানি ।

         –এই বারই এত চাপ দিচ্ছিস কেন, ছমাস আগে তো এরকম বিহেভ করিসনি ।  আমার জন্যেই তুই সবায়ের দ্বারা অপমানিত হয়েছিলি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর কার ছবি সামনে রেখে মিষ্টিবিষ্টি করতিস?

         –আহাআআ, আহাআআ, মেয়েদের কোড ওয়র্ডটাও জানিস দেখছি । বেগুন ব্যবহার করতুম, বুঝলি । নারকেল তেলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশান হয় না । আর কিছু ? বিব্রত করার চেষ্টা করিসনি । তুই কার ছবি মনে করে মিষ্টিবিষ্টি করতিস ? কোনো ফিল্মস্টারের বোধহয় ?

        –না, একটা বিশেষ অঙ্গ কল্পনা করে নিতুম, যা নেটে দেখেছি । একটু দেখতে দে না ।

        –দ্যাখ, দেখে নে, ইউ বিট্রেয়ার, চোখের জলের আলোয় দেখে নে, ইউ মেনিমুখো কাওয়ার্ড ।

        –মুখ দেবো ? আমার  তো সিংহের কালো কেশর গজিয়েছে, দ্যাখ হাত দিয়ে ।

        –তোর চোখের জলে ভিজিয়ে ওখানে মুখ দিবি, হাঁটু গেড়ে বসে । গেট অন ইওর নিজ । কাঁদ, ফোঁপা, তোর ফোঁপানি শুনতে চাই আমি, কাঁদ, কাঁদ, কাঁদ, ইউ আনগ্রেটফুল ডেজার্টার ।  অমিতের চুল দু’মুঠোয় ধরে বলল ইতু ।

            ঘর্মাক্ত প্রেমের শেষে, প্রস্তুতির জন্য এনে-রাখা ওষুধের বড়ি গলায় ফেলে, বেডসাইড টেবলের গেলাস থেকে জল খেলো ইতু । বলল, ভিতুরা হল লাশের মতন, স্রোতের সঙ্গে ভাসে ; স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরাতে শেখ, তোর অস্তিত্বে প্রাণ আছে কিনা তা প্রমাণ করতে হলে তোকে  স্রোতের বিরুদ্ধে ননস্টপ হাত-পা চালিয়ে যেতে হবে।

         –প্রথমবার প্রেম করতে গেলে যে ছড়ে যায়, জানতুম না, আমার ধারণা ছিল মেয়েদেরই ছেঁড়াছিঁড়ি হয়,  বলল অমিত ; তারপর যোগ করল, এসেছিলুম এক রাত কাটিয়ে চলে যাবো, এই ভেবে ; তুই কি করলি জানিস? তুই আমাকে আইডেনটিটি দিলি, প্রেমিকের আইডেনটিটি, এ-ছাড়া আমার বলার মতো আত্মপরিচয় নেই । বাবা-মা বিসর্জন দিয়ে চলে গেল, তোদের বাড়ির লোকেরা যৌথ সম্পত্তিতে ভাগ বসাবো ভেবে দত্তক নিল না, পরিবারের অংশ বলে মনে করল না, প্রতি বছর আগের ছাত্রদের বই চেয়ে-চেয়ে পড়ে কোনো রকমে পাশ করতুম, স্কুলও ফালতু তকমা দিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসাতো । বাবা-মাকে যতটা বুঝেছি, ওনাদের কাছে আমি আরও হাজারখানেক কর্মীর একজন, গুরুত্বহীন । ওনারা যেসব তত্ত্বকথা আওড়ান, তা যে আমার জীবনে প্রযোজ্য, সেকথা ভুলে যান । বলতে-বলতে ছলছল-চোখ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।       

         –তখন কাঁদতে বলেছিলুম, জাস্ট এ মোমেন্টারি রিভেঞ্জ, দ্যাট ওয়াজ এনাফ, আর ধ্যাড়াসনি, প্লিজ । কেন করলুম জানিস, বলল  ইতু, তুই এবার আমাকে নিয়ে যেতে বাধ্য হবি । তুই তো কাল্ট মেম্বার, কমিটেড, ডেডিকেটেড, আদর্শবাদী, অ্যান্ড হোয়াটএভার, ফেলে পালাতে তোর দায়বদ্ধ বিবেক বাধা দেবে । আই থিংক সো । আমাকে ধোকা দিয়ে পালাতেও পারবি না, আমি দোতলাতেই জেগে থাকব সারারাত, পাহারা দেব । বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে ছাড়াছাড়ি এটসেটরা, আই ডোন্ট কেয়ার, আমি একাই এনাফ । আর, গুছিয়ে বলি, তোর প্রাপ্য তোকে দিয়ে দিলুম, পরে দেয়া হয়ে উঠবে কিনা, দেবার সময়-সুযোগ হবে কিনা, তা তো জানি না ।

         –অমন অদ্ভূত সব খুঁতখুতে শব্দ কোথায় পেলি ?   না, তোকে ফেলে এবার পালাব না, পালাবার হলে আর আসতুমই না, তোদের বাড়ির গোমড়ামুখগুলো দেখতে ; পাহারা দেবার দরকার নেই, তুই জানিস তোর টান ছিন্ন করতে পারিনি । তুই এবার আমার সঙ্গে যাবি । তোর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে গেছে । অকল্পনীয় কষ্টের জীবনে তোকে মানিয়ে নিতে হবে, শারীরিক কষ্টের । হয়ত পানীয় জল নেই, বিজলি বাতি নেই, শোবার ঘরবাড়ি নেই, প্রতিদিন খাবার জোটার সম্ভাবনা কম । পদে-পদে মৃত্যু ওৎ পেতে থাকতে পারে । সময়ে-অসময়ে ডাক্তারি করতে হতে পারে ।

          –বাড়ির কুচুটে নোংরা স্বার্থপর জঙ্গলে বসবাসের পর আমি আফ্রিকার সিংহ আর হায়েনাদের জঙ্গলে গিয়েও থাকতে পারব ।

         –জঙ্গলে নয়, ওরা সাভানার ঘাসভূমিতে থাকে ।

         –হোয়াটএভার, ডোন্ট ট্রাই টু টিচ মি । তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতুম ।       

         –কেউ কোথাও আমাকে চিনে ফেললে, তুই বলবি তুই আমার সঙ্গী নোস, কোনো একটা জায়গায় যাবার নাম করে বলে দিস বাবা বা কাকার বাড়ি যাচ্ছিস ।

         –সে দেখা যাবে, কপি-পেস্ট সংলাপবাজি করিসনি । যখন অমন বিপদ আসবে তখন তার মোকাবিলা করব । তাছাড়া এটা পাটনা শহর। গয়া, নওয়াদা, সাসারাম, জেহানাবাদ, পালামউ নয় । এই শহরের জাতপ্রথার রাজনীতিকদের খেলা যতটা বুঝি, এখানে তোদের  কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না ; অবশ্য খুনোখুনি হলে আলাদা কথা ।

         –না, ওই লাইনে ভাবিসনি ।

         –কোথায় যাব আমরা ? প্রশ্নটা এই জন্য করছি যে আমার যাবার সঙ্গে ইলোপ শব্দটা জুড়ে আছে ।

         –তুই যেখানে যাবি  সেখানে যারা থাকে তারা মুরিয়া মারিয়া মাড় গোঁড় । দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত ওদের যুবতীরা পোশাক দিয়ে বুক ঢাকত না, খালি গায়ে গয়না পরে থাকত । কোনো-কোনো গ্রামে পৌঢ়ারা এখনও খালি গায়ে থাকে, যখন খুব গরম পড়ে । অবশ্য ওদের খুচরো জনবসতিগুলোকে গ্রাম বলা যায় না, এক জায়গায় চাষবাস করে আবার জনবসতি অন্য জায়গায় তুলে নিয়ে যেত, সেখানে গিয়ে এক ঋতু চাষবাস করে আবার অন্য কোথাও বসতি তুলে নিয়ে যেত । ব্রিটিশ গবেষকরা লিখে গেছেন  ওদের মাড় শব্দটা নাকি এসেছে বনের আগুন, মানে, পলাশ ফুলের নাম থেকে । আমার তা মনে হয় না, কেননা গাছটাকে তো ওরা পুজো করে না । তার তুলনায় মহুয়াগাছকে শ্রদ্ধা করে ।

         –জঙ্গলমহলে ? ঝাড়খণ্ডের খবরও তো পড়ি কাগজে ।

         –ওয়েস্ট বেঙ্গলে আর ঝাড়খণ্ডে কী গোঁড় বা মাড়িয়া উপজাতির মানুষ থাকে ? আমি যাদের কথা বলছি তারা পশ্চিমবাংলার মানুষ নয় । সিলেবাসের বাইরে একটু-আধটু সাধারণ জ্ঞানের বই-টই পড়তে পারতিস । তুই যাবি দণ্ডকারণ্যের দুর্ভেদ্য, প্রায় দুর্ভেদ্য, জঙ্গলে । অবুঝমাড় ।

         –হ্যাঁ, অবুঝই ছিলাম এতকাল । অবুঝ জীবনে পড়ে-পড়ে মার খেয়েছি । তুই যাবি মানে ? তুই যাচ্ছিস না ? কিন্তু তুই ওরকম ব্লাডি মোরোনদের মতন বসে-বসে পা দোলাসনি ।

         –এই তো বললি যে সাধারণ দুস্হ গরিব মানুষের সেবা করতে চাস । আমার থাকা-না-থাকার সঙ্গে তোর জীবনের উদ্দেশ্যকে কেন জড়াচ্ছিস ? আমার মা-বাবা তো আমাকে এখনও পুরোপুরি জড়ায়নি তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন ! আমি চিরকাল পরিত্যক্ত সন্তান থেকে যাবো, ফর দেয়ার কজ ।

         –আমিও ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করতে চাই, তোর লেজুড় হবো বলিনি । আমি কারোর লেজুড় হতে চাই না । কিন্তু তুই না থাকলে কী করে জানবো যে কোথায় যেতে হবে, কাদের সেবা করতে হবে ? হোয়াট অ্যাবাউট টাকাকড়ি ?

         –গন্তব্য তো তোর, ঠিকই পৌঁছে যাবি । জানি তুই যথেষ্ট বোল্ড, আউটস্পোকন, সেল্ফ-মেড, এমনকি দুঃসাহসী । নিজেকে প্রয়োগ করে দ্যাখ-ই না । ভারতের এলোমেলো-হেলাফেলা মানুষদের সম্পর্কে  স্পষ্ট ধারণা হোক । টাকাকড়ির জন্য সুশান্তজেঠুর দরবারে ঢুঁ মারব ।

          –ওকে, তবে তা-ই হোক । এবার থেকে আমিই আমার গন্তব্য । কারেক্ট, আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে । জানি, গন্তব্যের লক্ষ্যে চলতে থাকা জরুরি, চলাটাই সফলতা, লক্ষ্যবস্তুটা নয় । আজ থেকে আমার কাছে যুক্তি আর যুক্তিহীনতার পার্থক্য রইল না ।  আর তো ভার্জিন থাকার বিড়ম্বনা রইল না যে আগের মতন ওয়ান-ডে প্রেমিকদের দুর্ভাবনায় সিঁটিয়ে থাকবো ।

         ঘুমোতে যাবার আগে ইতু ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটার কাঁচি এনে বলল, আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বা ভ্যানিটি, যা-ই বল, তা হল আমার চুল, তুই তো জানিস, এই নে , ঘাড়ের কাছ থেকে ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে দে দিকিনি ।

        –ভ্যানিটি ? আকর্ষণের কেন্দ্র ? তা তোর সুরাহিদার গর্দন, ভারি পাছা আর নিটোল বুক ।

        –শাট আপ, চাপলুসি করিসনি । হ্যাঁ, আমার বুক সম্পর্কে আমার গর্ব আছে । কিন্তু ওগুলো তো আর কেটে বাদ দিতে পারি না । চুল কেটে দিতে বলছি, কাট, এই নে ।

         –এরকম দীর্ঘ চুল, পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আ্ছে, তাকে বাদ দিয়ে দিতে চাইছিস ?

         –হ্যাঁ, জাস্ট ডু ইট, কেটে ফ্যাল, এত বড়ো চুল বয়ে বেড়ানো যায় না । আমিও আর আয়নার মুখ দেখতে চাই না । যাদের মাঝে বড়ো হয়েছি, তাদেরই যদি বাদ দিতে পারি, তাহলে চুলটুকু কেন বাদ দিতে পারব না ?

         চুল কাটতে গিয়ে অমিতের নজরে পড়ল মাথার শিয়রে স্যাঁতসেতে দেয়ালে সেলোটেপ দিয়ে একটা ইংরেজি পোস্টার লাগানো, ফ্যাকাশে, পুরোনো, ছেঁড়া । রঙিন হরফে লাইনের তলায় লাইন উদ্ধৃতি । চুল কাটার শেষে লাইনগুলো জোরে পড়ে ফেলছিল, ইতু বলল, মনে-মনে পড়, ওটা ডাকবাংলো রোডের ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছিলুম । বেশ ভালো, না ? অমিত অনুবাদ করে পড়ল :

         “কখনও নিজেকে গুরুত্বহীন মনে করবেন না

         কখনও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করবেন না

         কখনও সদর্থক দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না

         কখনও শরীরে আরামের শিকড় গজাতে দেবেন না

         কখনও নিজেকে অক্ষম মনে করবেন না

         কখনও অসন্তোষে আপ্লুত হয়ে নিজের সঙ্গে মনে-মনে কথা কইবেন না

         কখনও আত্মাভিমান বর্জন করবেন না

         আনন্দের মুহূর্ত ছোট্ট হলেইবা তাকে সযত্নে উপভোগ করুন”

         চুলের কাটা গোছাটা ইতুর হাতে দিয়ে অমিত ইতুর মুখের দিকে অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ে তাকাতে, ইতু বলল, হ্যাঁ, জানি, আমার মুখময় ওই কথাগুলো লেখা আছে, বহুকাল, পাঁচ বছরের বেশি,  লেখা আছে, মগজে গেঁথে গেছে ইন ফ্যাক্ট । এতক্ষণে বোধহয় তুই আমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলি । ভাগ্যিস চুলটা কাটতে বলেছিলুম, নয়তো ওদিকে তোর চোখ যেত না ।

         রাত দুটোয় তিনতলার ঘর থেকে নেমে দোতলার বারান্দায় ইতুর বিছানায় অমিত মশারি তুলে ঢুকতে গেলে, ইতু বলল, তুই যে আসবি জানতুম, তোর ভয়কে যে কাবু করতে পারলি, দ্যাখ, আমার কাছে নেমে আসাই তার প্রমাণ, আরো বড়ো প্রমাণ যে তুই জামাকাপড় খুলেই নেমে এসেছিস । তোর কাওয়ার্ডাইস থেকে তোকে বের করে আনার জন্য আমাকে কী করতে হল, ভেবে দেখেছিস ? তুই আসবি জানতুম বলে আমিও শাড়ি-টাড়ি খুলে  শুয়েছিলুম । দাঁড়া, এই খাটে আওয়াজ হয়, নিচের তলায় শোনা যায় । তিনতলার ছাদে চল, খোলা আকাশের তলায় শাড়ি পেতে সুহাগ-রাত করব । দ্বিতীয়বার আকুতিময় শ্বাসের ঘনঘটা আর স্পন্দনের লেনদেন শেষ হলে ইতু ওর দোতলার বিছানায় ফিরে যেতে যেতে বলল, স্কাউন্ড্রেল, কি তোড়ু লাভমেকিং করলি, বুকে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিস, হারামি কোথাকার ; তূরীয়-মুহূর্তে সিংহরা সিংহীর মাথায় দাঁত বসায়, বুকে নয় ।

         ভোরবেলা বাড়ির লোকেরা জাগবার আগেই সদরের ছিটকিনি আলতো খুলে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে । কাঁধের ঝোলায় স্টেথোস্কোপ, মশার কামড়ের প্রতিষেধক মলম, কয়েকটা জরুরি ওষুধ, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, গামছা , পেনসিল টর্চ, এক সেট ডেনিম ট্রাউজার আর কটন-টপ পুরে নিয়েছিল ইতু ; পায়ে জগিং করার কেডস । রাতের নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়ি-শায়া আর চুলের গোছা দোতলার বিছানার ওপর ফেলে রেখে গেল, যাতে  বাড়ির সদস্যরা আঁচ করতে পারেন যে ওরা দুজনে ষড় করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে ।

        জানার পর আর ওনারা ইতুর খোঁজ করবেন না, জানে ইতু ।

        ইতুর পালানোর চাটনি-রসালো সংবাদ বাড়ির সদস্যরা শুনলেন কাজের বউয়ের মুখে । সকালে দরোজা খোলা পেয়ে সে অনুমান করেছিল যে বড়কর্তা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে থাকবেন । তিনতলার ছাদে ইতুর ঘর থেকেই ঝ্যাঁটানো আর পোঁছা আরম্ভ করে । দেখলো ইতুদি বিছানা তোলেনি, দোতলাতেও আসার সময়ে দেখে এসেছে খাটের ওপর বিছানা গোটানো নেই, তার বদলে পড়ে আছে ইতুদির শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ । আর অনেকখানি চুল, দেখলেই বোঝা যায় ইতুদিদির চুল, বাড়িতে আর কারোর চুলই অমন কোঁকড়া আর লম্বা নয় । শাড়ি তুলে তাতে অতিপরিচিত আঠা দেখে, নাকের কাছে এনে মোহক গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে উঠল বিহারি কাজের ব্‌উ রুকমিনি ।

        কাজের বউয়ের হাঁক, ইতুদিদি বিছৌনা তোলোনি কেন আজকে, ঘরে বসে খেয়েছ, বাসনও ফেলে রেখেছ, কলতলায় নিয়ে গিয়ে রাখেনি, ইতুদিদি, ইতুদিদি..

        বাড়ির মেজবুড়োর কন্ঠস্বর শোনা গেল, ইতু ওপরেই আছে দ্যাখ, দোতলায় এখনও মশারি ফেলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।  ডেকে তোল । ইতুর ঘরে একজন অতিথি আছে, টয়লেটে গিয়ে থাকবে, অমিত, আমাদের বাড়িতে থাকত আগে, তুই বোধহয় দেখিসনি, সৌদামিনী কাজ করত তখন ।

        রুকমিনি টয়লেটে-বাথরুমে ঢুঁ মেরে দেখল ফাঁকা, কেউই নেই । চেঁচিয়ে বলল, কেউ নেই, অতিথিও নেই, দোতলার বিছানায় ইতুদিদিও নেই । শাড়ি-শায়া-বেলাউজ পড়ে আছে, সঙ্গে ওনার কাটা চুল ।

        রুকমিনির হাঁকডাকে, যে হাঁকডাকে শাড়ি-শায়ায় আঠামাখা গন্ধের প্রচ্ছন্ন আহ্লাদ ছিল, শুনে, বাড়ির অধিকাংশ সদস্য, বৃদ্ধরা ছাড়া, দৌড়ে প্রথমে দোতলার বিছানায় দোমড়ানো শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ-চুলের গোছা আর তারপর তিনতলায় পৌঁছোলে, রুকমিনি পান-খাওয়া দাঁতে হাসি মাখিয়ে যখন বলল যে বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল, তখন সকলে ঠাহর করতে পারল যে ইতু অতিথির সঙ্গে উধাও হয়েছে ।

         –বিয়ে দিলে না তোমরা সময় মতন, পালাবে না তো কি করবে ? বললেন সেজকর্তার গোলগাল ভারিভরকম স্ত্রী, সাতসকালে ওজনদার শরীর নিয়ে বাতের ব্যথা সত্ত্বেও তিনতলায় হাঁটু ভেঙে উঠতে হয়েছে বলে যিনি ক্লান্ত, হাঁপাচ্ছিলেন ।

        –অমিতের সঙ্গে ওদের সম্বন্ধটা করে ফেললেই হতো, তোমরাই অযথা ছেলেটার মা-বাবার সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে মেয়েটার জীবন গোলমাল করে দিলে । সুযোগ পেয়ে বলে নিলেন রাঙাকাকি । ওরা ভাইবোন নাকি ? তোমরা ভাইবোন-ভাইবোন আওড়াতে লাগলে । এখন হল তো সেই-ই ।

         –যাক ভালোই হল একদিক থেকে, দায়িত্বটা বড় খচখচ করত এদান্তি । বললেন মেজকর্তা ।

         মেজকর্তার দুই যমজ নাতি, পাঁচে পড়েছে সবে, যাদের মা, মানে মেজকর্তার বড় ছেলের স্ত্রী, ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, নাতিরা একযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ঘরটা আমরা নেবো, আমাদের নিজেদের ঘর নেই, পড়াশোনার ডিসটার্বেন্স হয়, একতলার বারান্দায়  বড্ড চেঁচামেচি করে সবাই ।

         –পড়াশুনোর নামে নিজেদের ঘর মানে তো দেয়ালে সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে  জেনিফার লোপেজ. লেডি গাগা আর কাটরিনা কাইফের ব্লোআপ, সৌরভের হাফ-টেকো পোস্টারটা বদলে ফেলিস, এখন ওর মাথায় আবার চুল গজিয়েছে । বললে দুই খোকাটে নাতির বাবা, পরোক্ষে তাদের দাবির সমর্থনে । দুই নাতির দিকে তাকিয়ে মুখে  পানপরাগি-হাসি খেলালো রুকমিনি ।

           ইতুর পলায়নে তৃপ্ত অভিভাবকরা সিঁড়ির ধাপে চোখ রেখে, এক-পা দু-পা করে নেমে চলে গেলেন যে যার ঘরে । নাতি দুজন তিনতলার ছাদের ঘরে ঢুকে ইতুর আর ইতুর আগে ওদের বাবার চাকরানি-প্রেমী যৌনতার স্মৃতিকে নিশ্চিহ্ণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।

         –চুলটা আমি নিচ্ছি , খোঁপার ভেতরে ঢুকিয়ে বানখোঁপা বাঁধলে বেশ ভালো দেখাবে ।  নেবো তো ? জিগ্যেস করল রুকমিনি, নেমে যেতে থাকা সিঁড়ির উদ্দেশ্যে ।

         –নিয়ে নে, বিছানার ওপর যা শাড়ি-টাড়ি আছে সেগুলোও যাবার সময় নিয়ে যাস ।

         –আর যেগুলো ইতুদিদির আলমারিতে আছে ?

         –নিয়ে যাস সময় করে, কিন্তু গিটারটা নিসনি যেন, ওটা নবনীতার, ফাইনাল ঝগড়া করবে বলে রেখে গেছে । জবাব দিল নামতে-থাকা সিঁড়ি ।

          রুকমিনিকে রাখা হয়েছে তার আগের কাজের বউ সৌদামিনির সঙ্গে দুই নাতির বাবা সমরেন্দ্রর আঠালো সম্পর্ক ধরা পড়ে যাবার পর । সৌদামিনির সঙ্গে দুপুরে বিছানায়, ওদেরই বিছানায়, দুই নাতি তখন শিশু, সমরেন্দ্র রঙ্গিলা-রতির ম্যাটিনি শো করছিল । শিশুদের দেখাশোনার জন্যই রাখা হয়েছিল সৌদামিনীকে, যার বর আরেকটা বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে হরিয়ানার খেত-খলিহানে কাজ করতে । সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা অনুমান করেছিল যে কিছু একটা গোলমাল চলছে, কেননা যখনই সৌদামিনীকে বকুনি দেয় নবনীতা, তখনই সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে সমরেন্দ্র ঝগড়া করত নবনীতার সঙ্গে । একবার তো নবনীতার গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিল সমরেন্দ্র, শিশু দুটোর কান্না সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে শুনে অফিসের পোশাকেই সোজা তিন তলার ছাদের ঘরে পৌঁছে দ্যাখে বাচ্চা দুটো গুয়েমুতে মাখামাখি । যে ডায়াপার নবনীতা পরিয়ে গিয়েছিল, দুটো বাচ্চাই সেগুলো পরে আছে, আলগা ডায়াপারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গুয়ের স্রোত ।

        নবনীতা সৌদামিনিকে বকুনি দিতে, বুকে কাপড় চেপে ও  সমরেন্দ্রর দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে, সমরেন্দ্র সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল, কত কাজ করবে ও, সারা বাড়ির ফাই ফরমাস, তারপর দু-দুটো বাচ্চা সামলানো ।

         –ও, কাজের বউ তার মালিকের মুখ নিজের বুকে গুঁজে খাটছিল, তাই না ? দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল নবনীতা।

          –ও তুমি বুঝবে না, যাদের হৃদয় বড়ো হয় তাদের বুকের মাপও বড়ো হয় । সমরেন্দ্রর উত্তর ।

         –হৃদয় বড়ো না ছোটো তা বিয়ের আগে তো আন্দাজ করে থাকবে ?

         –তখন তো দেখে মনে হয়েছিল হৃদয় যথেষ্ট বড়ো । তা যে নকল কী করে জানব ?

         –নকল হৃদয়ের সুধারস পান করার সময় তো উচ্ছ্বসিত হতে ।

           হাঁ করে তাকিয়ে থাকা সৌদামিনীকে বুঝিয়েছিল সমরেন্দ্র, হৃদয় মতলব দিল, যিস অওরতকা দিল জিতনা বড়া, উস অওরতকা ছাতি ভি উতনাহি বড়া হোতা হ্যায় ।

           সমরেন্দ্র যখন ডিউটি আওয়ার্স পালটে রাতের শিফট নিল, সন্দেহে জারিত নবনীতা সেদিনই নির্ণয় নিয়েছিল যে ব্যাপারটাকে এবার ট্যাকল করতেই হবে । একদিন অফিস যাবার নাম করে অফিসে না গিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে সময় কাটিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পা টিপে-টিপে ওপরে উঠে দরোজা আলতো ফাঁক করে দ্যাখে সৌদামিনি আর সমরেন্দ্র দুজনে উলঙ্গ হয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায় । তিনতলার ছাদে কেউ আসে না ভেবে ওরা দুজনে বেপরোয়া হয়ে গিয়ে থাকবে, তাই দরোজা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেনি ।

         বড়জেঠি আর রাঙাকাকিকে চুপচাপ ডেকে এনে,  দরোজা ঠেলে, সৌদামিনী পর্বের শেষ দৃশ্যের অভিনয় নবনীতা দেখিয়ে দিয়েছিল ওনাদের । তাৎক্ষণিক ঝগড়া, বড়ো-হৃদয়ের প্রাপ্তি সম্পর্কিত বুকের আদল, ইত্যাদি প্রগাঢ় মন্তব্য । তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে নবনীতা সোজা বাপের বাড়ি, কয়েকদিন পর ডিভোর্সের নোটিস, ব্যাস।  সমরেন্দ্র চালান হল দুই শিশুর সঙ্গে একতলায়, কেননা শিশুদের দেখাশোনা যাঁরা করবেন তাঁদের একতলা-তিনতলা করার ক্ষমতা ছিল না ।

         ইতু পেয়ে গেল ঘরটা । রুকমিনি পেয়ে গেল চাকরি ।

         সমরেন্দ্র আর বিয়ে করেনি । এখনও নাইট ডিউটি করে । দুপুরে বেরিয়ে যায় খেয়েদেয়ে, যেখানে যায় সেখান থেকেই নাইট ডিউটি করতে চলে যায় । বাড়ির সবাই জানে কোথায় যায় । রুকমিনি পেছন-পেছন গিয়ে দেখে এসেছে, সৌদামিনীর বস্তির ঘরে ঢুকছে সমরেন্দ্র । সৌদামিনীর তিন মাসের বাচ্চাটা যে সমরেন্দ্রর তাতে কোনো সন্দেহ নেই, অত চেকনাই-মার্কা বাচ্চা কী করেই বা হবে ! সৌদামিনী সাঁওলা ওর পালিয়ে-যাওয়া বর কালো । বাচ্চা চেকনাই-মার্কা বলে সৌদামিনীর কত গর্ব, রুকমিনিকে বলেছিল, এরকম খোকা-বাচ্চা তোর কোনো কালেই হবে না ; পারিস তো করে দ্যাখা । অটোতে বসিয়ে সৌদামিনীকে কুর্জি হোলো ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সমরেন্দ্র, বাচ্চা হবার সময়ে, ফর্মে বাপের জায়গায় নিজের নামই লিখেছে, রুকমিনিকে জানিয়েছে সৌদামিনী, নিজের স্কুটারের পেছনে বসিয়ে পোলিও ড্রপস খাওয়াতে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় ওর বাংগালি আদমি, সাচ্চা দিলওয়ালা ।

         সমরবাবু বাচ্চাটার খাওয়াপরার খরচ দ্যায় আর বলেছে বড়ো হলে ওকে ভালো আংরেজি স্কুলে পড়াবে ।

         –কী করে শুরু হল তোদের প্যার-মোহোব্বত ? জানতে চেয়েছিল রুকমিনি ।

         –বাচ্চা দুটো একদিন ভিষণ কাঁদছিল, একেবারেই চুপ করছিল না, কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না, তো সমরবাবু বলল, তোর দুই বুকে বাচ্চা দুটোর মুখ গুঁজে দে না, তোর বুক তো নবনীতা মেমসাবের চেয়ে বড়-বড় । আমি বললুম আমার বুকে তো দুধ নেই, ওরা কি হাওয়া খেয়ে চুপ করবে ? জবাবে সমরবাবু বললে, বাচ্চারা যেভাবে চুষিকাঠি চুষে ঘুমিয়ে পড়ে, তুই ওদের মুখে তোর বুক গুঁজে দ্যাখ চুপ করে যাবে, ঘুমিয়েও পড়বে । সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল বাচ্চা দুটো । সমরবাবু আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল । আমি বললুম, আমি রোজ-রোজ একাজ করতে পারব না । সমরবাবু জিগ্যেস করল, কেন, তোর অসুবিধা কিসের । আমি বললুম, বাচ্চারা আমার বুক চুষলে গা থিরথিরিয়ে যায়, মনে হয় কাউকে জড়িয়ে ধরি । তা সমরবাবু তক্ষুনি আমায় জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে আর বললে, যখনই তোর শরীর থিরথিরোবে, আমাকে বলবি, আমি শান্ত করে দেব । তারপর তো সমরবাবু দিনের বেলার অফিসের ডিউটিকে রাতের ডিউটি করে নিলে, আমরা দুজনে মিলে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে, নবনীতা দিদির বিছানায় শুয়ে পড়তুম । কত রকম ভাবে প্যার-মোহোব্বত করতে পারে সমরবাবু ; কাঁইচিমার মোহোব্বত করতে শিখিয়েছে । চুল ওঠাবার কিরিম, বগলের পাউডার, বুকের কিরিম, গায়ে গন্ধমাখার গ্যাসের টিন, শ্যাম্পু, লিসটিপ, প্যার-মোহোব্বত করতে গেলে এসব জিনিস কত দরকার তা সমরবাবুর চেয়ে ভালো কেউ জানে না । নবনীতা দিদি জানবার পর আমাকে যখন বকুনি দিচ্ছিল, সমরবাবু নবনীতাকে গালে কষে দিয়েছে এক থাপ্পড়, এইসান, ধাঁয় । ওনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, আমি সমরবাবুকে পেয়ে গেলুম, এখন আমি ডবল মাইনে পাই, কাজও করতে হয় না ।

       ডিভোর্স দেয়া সমরেন্দ্রর বউ নবনীতা এখন নিজের মারুতি গাড়ি চেপে অফিস যায়, নিজে চালায় । বলেছে, যাদের বাড়ির পদবি নিয়ে বাচ্চা দুটো জন্মেছে, তারাই মানুষ করুক । সৌদামিনীকে স্কুটারে পেছনে বসিয়ে, রাজপথে নবনীতার গাড়ি দেখতে পেলে, তার পাশাপাশি চালায় সমরেন্দ্র । নবনীতার দিকে বাচ্চাটাকে তুলে দেখিয়েছে সৌদামিনী, বত্রিশপাটি হাসি ফুটিয়ে । সেই ঘটনার পর, আইনত নিষিদ্ধ হলেও, গাড়ির কাচে কালচে সানফিল্ম লাগিয়েছে নবনীতা ।

.

আট

         ইতুকে দেখে অবাক হননি সুশান্ত ঘোষ, কেননা ইতু বাসে বসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে গর্দানিবাগের বাড়িতে  অমিত বর্মণ এসেছে আর ও আজকেই অমিতের সঙ্গে পালাচ্ছে, সুশান্তজেঠুর বাড়িতে যাবে, বাসস্ট্যাণ্ডে সুশান্তজেঠু যেন ওদের নিতে আসেন ।  তার আগে সুশান্তর বড়জেঠি, মানে ইতুর বটঠাকুমা, ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দ্যাখ ইতু আর তোর ছেলেবেলাকার বন্ধু অতনুর ছেলে অমিত তোর বাড়ি পৌঁছোল বলে, এখানে হইচই ফেলে চলে গেছে, যা করেছে একশবার ভালো করেছে, ওদের মুখেই শুনিস ।

         বাসস্ট্যাণ্ডে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সুশান্ত ঘোষ। দিয়ারায় পৌঁছে, পটলের পাহাড়, তরমুজ-শসা-ফুটির ডাঁই দেখে ইতু বলল, এ তো বেশ ভালো জায়গা গো, ভিলেজ-ভিলেজ টাইপ, যেমন টিভিতে দেখি । দিনকতক থেকে গেলে হয়না এখানে ?

         –না না, প্রায় আঁৎকে বলে উঠল অমিত, যত তাড়াতাড়ি কেটে পড়া যায় ততই সবায়ের মঙ্গল ।

         –ঠিক আছে, যাসখন, কালকে সকালে তোদের জন্যে নৌকো করে দেব । আজকে রেস্ট নিয়ে নে । আমরা কি খাই কোথায় শুই এসব দেখে যা । আমাদের জীবন কম রঙিন নয় । আমার বউ, শশুর, শাশুড়ির সঙ্গে আগে পরিচয় করিয়ে দিই তোদের ।

         –হ্যাঁ, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার শশুরমশায়কে দেখিনি, শুনেছি যে উনি গর্দানিবাগের বাড়িতে এসে তোমাকে ফেরত দেবার জন্য দশ লাখ টাকা চেয়েছিলেন ।

         –উনি যখন জেঠা-বাবা-কাকার কাছে র‌্যানসাম চাইতে গিয়েছিলেন, তার আগেই বেবির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উনি জানতেন যে বাবা-জেঠারা ফোতো-বড়োলোক, আর দশ লাখ টাকা দেবার মতো ক্ষমতা বাবা আর জেঠাদের নেই ।

         অমিত বলল, তোমার লাইফটা আনবিলিভেবল । অ্যাডভেঞ্চারস ।

         –এখানে এসে টের পাচ্ছি গো, কী ধরনের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছ নিজের জীবনে । ইতু বলেছিল ।

        সুশান্ত, এই যে আমার বউ বেবি, বলতে, একজন ঢ্যাঙা কালচে কৃশতনু যুবতী, দেখলেই বোঝা যায় সাজগোজ করে পারফিউম মেখে এলো, অমিত আর ইতুর পায়ে দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল । সুশান্তর বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল ইতু, কেঁপে-কেঁপে কাঁদতে লাগল । ইতু বলল, হিন্দিতে, তুমি আমাদের পায়ে হাত দিচ্ছ কেন ? বয়সে তুমি আমাদের বড়ো, তুমি তো আমার জেঠিমা হও ।

        বেবি : এই প্রথম শশুরবাড়ির লোক আমাদের বাড়ি এলো । শশুর শাশুড়িকে তো দেখিনি ; তাদের প্রণাম তোমাদের পায়ে রাখলুম ।

        সুশান্তর শশুর তারিণী মণ্ডল আর শাশুড়ি মন্হরা দেবী ইতুদের আসার খবর পেয়ে হাজির হলে, ছফিটের ঋজু পালোয়ানি কালো তারিণী মণ্ডলকে দেখে ইতু বলে ফেলল, তোমার শশুর তো একেবারে কোমোডো ড্র্যাগন গো, সেরকমই জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন । বলে ফেলে, বলল, সরি , ওনাকে দেখে বেফাঁস বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।

         –বেফাঁস বেরোয়নি, উত্তর দিল সুশান্ত, তারপর যোগ করল, ইতু তোর অবচেতনে ওনার সম্পর্কে যে ভীতি জমে আছে তা থেকেই বেরিয়ে এলো কোমোডো ড্র্যাগনটা । ঘাবড়াসনি, উনি কোনো ড্র্যাগনের কথাই জানেন না, নিজেকে ছাড়া ।

         তারিণী মণ্ডলের শাশুড়ি বলল, এতদিন পরে আত্মীয়দের সঙ্গে জামাইবাবার খাঁটি বাংলায় কথা বলার সুযোগ হল । বলে নাও, বলে নাও, তারপর আমাদের পালা । অমিত-ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার নাতিও বাংলা, আংরেজি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি বলতে পারে ।

          তারিণী মণ্ডল গমগমে কন্ঠস্বরে গর্ব ঝরিয়ে বলল, আমার নাতি বাংলা বলতে, লিখতে আর পড়তে পারে। ইংলিশে কথা বলতে পারে, একদম আংরেজ পলটন জইসন ।

           বেবির প্রশ্নাতুর ভ্রু দেখে অমিতের মনে হল, এনারা বোধহয় প্রণাম বা নমস্কার আশা করছেন ওদের তরফ থেকে ; বেবি এসেই ঝপ করে দুজনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে । ইতু নির্ঘাত প্রণাম করতে চাইছে না, হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম করতেও ওর বাধো-বাধো ঠেকবে, একে বিহারি তায় আবার শিডুলড কাস্ট, হয়ত জীবনে কোনো বিহারির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি  । হাতজোড় করে নমস্কার করাটাও বিসদৃশ । অমিত আচমকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুঠো পাকিয়ে নির্বাক রেড স্যালুট দিল সুশান্তর শশুর-শাশুড়িকে । দেখাদেখি ইতুও তাই করল ।

           তারিণী মণ্ডল বলল, চাবস চাবস, এই তো চাই, নেতাজির মতন স্যালুট দেবে, বলে, সুভাষচন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হলেই যা করে থাকে, উরুতে চাপড় মেরে বিব্রত করল নিজের জামাই আর তার অতিথিদের । মন্হরা দেবী বেবিকে হুকুম দিল, এই বেবি, আজকে ওদের জন্য একটা কচি শুয়োর কাটতে বল, গরম-গরম শুয়োরের মাংস আর পুদিনার চাটনি দিয়ে ভুট্টার রুটি খেয়ে যাক ।

           শুয়োরের মাংস খেতে হবে শুনে অমিতের কব্জি আঁকড়ে ফেলেছিল ইতু । অমিত ফিসফিস করে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে হয়ত মহুয়ার রুটি আর ভাল্লুকের মাংস খেতে হতে পারে । পরে, নৌকোয় করে যাবার সময়ে, ছইয়ের ভেতরে বসে, নদীর ছলাৎছলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অমিত গল্প করেছিল মুরিয়া, মাড়িয়া, গোঁড় উপজাতিদের জীবন নিয়ে । অবুঝমাড়ের পাহাড়ি মানুষদের বিভিন্ন গোষ্ঠীদেবতা আছে । নাগবংশ, যারা কেউটে সাপের পুজো করে বলে কোনো সাপ খায় না, মরা সাপ দেখতে পেলে সেদিন শোক পালন করে গোষ্ঠীর সবাই । তেমনই আছে কাছিমবংশ, বকরাবংশ, বাঘবংশ,  আর বোধমিকবংশ, মানে মাছের বংশ ।

         –হ্যাঁ, তাহলে আজকে থেকে অভ্যাস করে নিই । বমি পায় পাক, বমি করতে-করতে তো পোয়াতিরাও অভ্যস্ত হয়ে যায় ; প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে  বারবার বাচ্চার জন্ম দেয় । ইতু বলল ফিসফিসিয়ে । শুয়োরের মাংস তবু খেলো না ইতু, বলল, এখন পারছি না, ক্রমশ অভ্যাস করব । সুশান্তর ঘরে খেতে বসে বেবির দেয়া সিম আর ফুলকপির আচার দিয়ে মকাইয়ের রুটি খেলো । বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের বডি পারফিউম দেখে ইতু বলল, তুমিও তো তোমার এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারোনি দেখছি ।

         বেবি : ওই সব গ্যাসগুলো নাআআআ ? ফিকফিকে দাঁতে বলল বেবি, ডেওডেরেন্টের দিকে তাকিয়ে ইতুকে কথা বলতে দেখে, ওই গ্যাস আমার গায়ে না মারলে আমার ঘুম আসে না ।

         ইতু : কার ঘুম আসে না ? তোমার না আমার জেঠুর ?

         বেবি : আমাদের দুজনেরই । তুমি নিয়ে যাও না কয়েকটা গ্যাস, বেশ ভালো লাগবে । দুজনে ঘুমোতে পারবে ।

         –আর ওই কসমেটিকসগুলো ? বউকে তো হাল ফ্যাশানের সাজগোজের জিনিস কিনে দাও দেখছি, বলল ইতু ।

         –আমি কিনে দিই না, বেবি টিভিতে দ্যাখে আর কিনতে লোক পাঠায় । বলল সুশান্ত, শুয়োর মাংসের বড়ার ঢেঁকুর তুলে ।

         –সুশান্তজেঠু তোমার কাছে যদি থাকে তো তুমি ইতুকে মশা থেকে বাঁচার ক্রিম দিতে পারো, গিয়েই হয়তো অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না । অমিতের প্রস্তাব ।

         –আমি নিয়ে নিয়েছি সঙ্গে, কোথায় থাকবো শোবো কিছুই তো জানি না, প্রথম-প্রথম লাগবে । ওষুধ-বিষুধও নিয়েছি ।

         –অ্যালোপ্যাথিক ? প্রশ্ন করল অমিত ।

         –হ্যাঁ, হারবাল মেডিসিন তোদের চারপাশ থেকে যোগাড় করে নেব ।

         –তোর দলের ডাক্তারের অভাব পুরণ করে দিল ইতু। বলল সুশান্ত ।

         –তোমার ছেলের নাম কি গো, গর্দানিবাগে তোমরা যখন এসেছিলে, আমি ছিলুম না ? জানতে চাইল অমিত ।

         –অপু, সুশান্ত বলার আগেই জবাব দিল ইতু ।

         –ওর নাম আপ্রাধি ঘোষ, বলল বেবি, অপু আর নাম এই শব্দ দুটো থেকে প্রশ্নটা অনুমান করে ।

         সুশান্ত বলল, সামান্য হেসে, বেবি টের পাবে না এমন করে, ওর দাদুর মতে মহাকবি বাল্মিকী ছিলেন ওনার মতনই অপরাধী, তিনি যদি পূজিত হন, তাহলে কারোর নাম অপরাধী হলে সে পূজিত হবে না কেন । এরা সবাই জানে যে আমার ছেলের নাম আপ্রাধি : আমি স্কুলে ওকে অশ্বমেধ নামে ভর্তি করেছি, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, বি এ পাশের ডিগ্রিতে আমার দেয়া নামটাই আছে । ছেলেকে বলা আছে যে এ-কথা এনাদের কাছে ফাঁস করার প্রয়োজন নেই, ওনারা যে নামে ডাকতে চান ডাকুন, পরিচয় করাতে চান, করুন ।

         –তুমি কিন্তু একেবারে বদলে গেছ, তাই না, উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি ছেড়ে ? অমিতকে বলল সুশান্ত । ইতুর কাছে শুনলুম  এন জি ওতে ঢুকে দেশোদ্ধারের কাজ নিয়েছ।

         –দেশোদ্ধার ? এই দেশের ব্যবস্হাকে আমূল উপড়ে না ফেললে, কারোর উদ্ধার হবে না । বাবার আওড়ানো বুলিকে, প্রয়োগ করল অমিত, তারপর বলল,  তুমিও তো অন্যমানুষ হয়ে গেছ , দেখে মনে হচ্ছে, নিজের মতন করে শোষণের বিরুদ্ধে লড়ছ ।

         –না আমি সেই লোকটাই আছি, কেবল অভ্যাসগুলো পালটেছে । টাকাকড়ি করার লোভ ছিল, তা করেছি, আয়েস করার লোভ ছিল তা করছি । মানুষের ওপর আধিপত্যের নেশাই আলাদা, ও তুমি বুঝবে না, কারোর বিরুদ্ধেই লড়ছি না ; আর শোষণের বিরুদ্ধে ? কই ? বরং শোষকের সিংহাসনে বসে পড়েছি হে । শোষিতরা শোষকের আনন্দের মজা বুঝতে পারে না । ধার্মিক গুরুদের দেখেছ তো ? অনেকটা সেরকম । নিজেকে নিঃশব্দে বললেন, আমি আমার বিরুদ্ধে লড়ছি ।

         –ঈশ্বরে বিশ্বাস এটসেটরা হিন্দুগিরি করছ নাকি, চারিপাশে তাকিয়ে টের পাচ্ছি । রসুন, পেঁয়াজ, আদাবাটা, বেসন মাখানো, হামান দিস্তেতে থেঁতো করা শুয়োরের মাংসের বড়ে খেতে-খেতে বলল অমিত ।

         –ইসওয়র নাআআআআ ? ছট পুজা করতে হ্যাঁয় ইনকে খাতির, বলে, সুশান্তর দিকে ইঙ্গিত করল বেবি ; আপ ভি কিজিয়েগা ইতু দিদি, আপকে আদমি কা লমবিইইইই জিন্দগি কে লিয়ে ।

         –ঈশ্বর ? ইউ মিন গড ? ইয়েস, গড ইজ ওমনিকমপিটেন্ট ওমনিপ্রেজেন্ট । আই অ্যাম গোইং টু গেট হিম ইরেজড ওয়ান ডে, ওনার অবসান পৃথিবীতে অবধারিত । বক্তব্য রাখতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন সুশান্ত ।

          –বদলাওনি দেখছি, বলল ইতু, আগে গর্দানিবাগের বাড়িতে যেমন বলতে, তেমন ধরনের কথাই বলছ, ভগবানের ওপর বেশ চটে আছ, তাই না ?  এখন আর কি, এখন তো তুমিই-ই ভক্তের ভগবান, দেখতেই পাচ্ছি এসে অব্দি ।

         –হ্যাঁ, শুধু ঈশ্বর বদলে-বদলে যেতে থাকে । তারপর জিগ্যেস করলেন, আমার আর অতনুর বন্ধুবান্ধব, যেমন অরিন্দম মুখার্জি , মৌলিনাথ, মাহমুদ জোহের, এরিক পেজ, মলয় রায়চৌধুরী, ওদের খবর জানিস নাকি ইতু ? দেখা-সাক্ষাৎ হয় ? সবাই বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে বোধহয় ; আমিই কেবল যুবক থেকে গেলুম, বেবি আর বেবির বাবা-মায়ের খাঁচার খাবার-পানীয় সেঁটে ।

         –তোমাদের অফিসের  শ্যামলী কর্মকারকে মনে আছে ? যার পিঠে শিরদাঁড়ার দুপাশে জড়ুল, যেন প্রজাপতির ডানা, দেখাবার জন্য পিঠখোলা ব্লাউজ পরেন ? ওনার মেয়ে তো আমার বন্ধু । সব খবরই পাই । অরিন্দম ওনার সাঁওতাল গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে কার অ্যাকসিডেন্টে পুড়ে মরে গেছেন, কলকাতায় । মৌলিনাথ কিডনি ফেল করে মরে গেছেন, কলকাতায় । মাহমুদ জোহের দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন, করে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পা ভেঙে হুইলচেয়ারে জীবন কাটাচ্ছিলেন ; একদিন এক যুবক এসে মাহমুদ জোহেরের চোখের সামনেই ছোরা মেরে-মেরে ওনার দ্বিত্বীয় বউটাকে মেরে ফেললে, পাটনায় ; যুবক ছিল দ্বিতীয় বউয়ের প্রেমিক ।

       –সে কি !

        –হ্যাঁ গো । এরিক পেজ পাগল হয়ে গেছেন, বাড়িতে ওনাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে, মোকামায় ; শুনেছি যে যখন বেশি চেঁচামেচি-গোলমাল করেন তখন ওনার হাতে একটা ব্রিটিশ আমলের রুপোর টাকা গুঁজে দিলে চুপ করে যান, আর টাকাটাকে শুধিয়ে-শুধিয়ে, হ্যালো মাউন্টব্যাটেন সাহেব, আপনি চলে গেলেন কেন, এখন আমাদের কী হবে, ইনডিয়াকে ফ্রিডাম দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু বেইমানি করে চলে গেলেন, কেউ-কেউ ফ্রি হল, সবাই কেন হল না, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, ডেডউইনা মাইয়া, এই ধরনের কথা বলে নিজের মনে বকবক করেন ।

        –পাগল হয়ে গেল ? অতনুদের গ্যাঙের তো ও লিডার ছিল রে ! অমিতের দিকে ফিরে বললেন, সরি অমিত, তোমার বাবার অন্যধরণের বন্ধুবান্ধবও ছিল, নারী-নারকটিক গ্যাঙ বলত সবাই ।

        –মলয় রায়চৌধুরী, নোট পোড়াবার চাকরি ছেড়ে, পাটনার বাড়ি ছেড়ে, গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরি নিয়ে কলকাতা চলে গেছেন; পাটনায় এসে হোটেলে উঠেছিলেন, এসেছিলেন আমাদের বাড়ি, বউকে নিয়ে । পাটনার বাড়িটা আর বসবাসের মতন নেই জানিয়েছিলেন, ওনার পাটনার বাড়ির  লাইব্রেরি থেকে হাজার খানেক বই রঞ্জিত ভট্টাচার্য নামে ওনাদের এক আত্মীয় চুরি করে নিয়ে চলে গেছে । কলকাতায় আবার নাকি অনেক বই জড়ো করেছিলেন, মুম্বাই যাবার সময় সেসব বই যাকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকটাকে রাজনৈতিক মাস্তানরা এমন পিটুনি দিয়েছিল যে মরো-মরো লোকটা  প্রায় ছয় মাস ভেলোরে ট্রিটমেন্টের পর সুস্হ হয়েছে, কিন্তু হিন্দু বাঙালিদের ওপর চটে গিয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে, চার্চ-টার্চ যায়।

         — ওঃ, তুই তো অনেক খবর রাখিস রে । সমরেন্দ্রর কী খবর ?

         –সমরজেঠুর গোলমালের কথা তুমি কী করে জানলে ? জিগ্যেস করল ইতু ।

         –বড়জেঠিমাকে মোবাইল কিনে দিয়ে এই সুযোগটা পেয়েছি, উনি বহুক্ষণ আমার সঙ্গে গ্যাঁজাতে ভালোবাসেন । ওনার কাছ থেকে বাড়ির সব খবর পেয়ে যাই । বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই । আমি ওনার বেশ কিছু গল্প মোবাইলে রেকর্ড করে ল্যাপটপে ধরে রেখেছি । শুনি মাঝে-মাঝে ।

         –সমরজেঠুর লেটেস্ট সমস্যার কথা বলেছে জেঠি ?

         –কী সমস্যা ?

         –সৌদামিনীর বাচ্চাটাতো বেশ ফুটফুটে ক্যালেণ্ডার-খোকা হয়েছে । নবনীতাজেঠির দুই যমজ ছেলের চেয়ে ভালো দেখতে । তো সেই বাচ্চাটাকে মহাবীর নেমিচাঁদ নামে একজন  বিলডার-কনট্রাক্টার লিফ্ট করিয়ে নিয়েছিল । বিলডারটার দুটো মেয়ে আছে, নয় বছর আর চোদ্দো বছরের ; তবু ব্যাটা ছেলে-ছেলে করে অবসেসড ছিল । সৌদামিনী একদিন অটো করে বাচ্চাটাকে খগোলে ওর বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল মা-বাবাকে দেখাবার জন্য, তখন মোটর সাইকেলে দুজন লোক বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে দে চম্পট । সৌদামিনী, জানো বোধহয়,  কেমন চালাকচতুর মেয়ে, মোটর সাইকেলের নম্বরটা মনে রেখেছিল । সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে কোতোয়ালিতে কমপ্লেন করার বারো ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটাকে ফেরত পায় ওরা । সবসুদ্দু সাতজন লোক ধরা পড়েছে । নেমিচাঁদ নাকি ওর বউকে সঙ্গে নিয়ে দানাপুরের এক মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরোবার সময় সিঁড়িতে বাচ্চাটাকে পেয়ে ওর বউকে বুঝিয়ে ছিল যে বাচ্চাটা ঈশ্বরের দান । যে গুণ্ডাগুলোকে দিয়ে লিফ্ট করার কাজে লাগিয়েছিল, তারা, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মন্দিরের সিঁড়িতে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে বাকি পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই পুলিশ ওদের পাকড়াও করেছে । নেমিচাঁদ সৌদামিনিকে প্রোপোজাল দিয়েছে যে মামলাটা তুলে নিলে দুলাখ টাকা দেবে । সৌদামিনী সমরজেঠুকে সঙ্গে নিয়ে নেমিচাঁদের বাড়ি গিয়েছিল, এক লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে বিল্ডারটার কাছ থেকে, কিন্তু মামলা এখনও ফেরত নেয়নি সৌদামিনী, সমরজেঠু চাপ দিচ্ছে অ্যামাউন্ট বাড়াবার জন্য । পাটনার হিন্দি কাগজে তো সৌদামিনী আর সমরজেঠুর কোলে ওর বাচ্চা নিয়ে ফোটো বেরিয়েছিল, দেখোনি ?

          অমিত অবাক তাকিয়েছিল ইতুর দিকে । গল্প শেষ হলে বলল, যেখানে যাচ্ছ সেখানে কোনো গল্প পাবে না, কেবল শোষণ, অস্বাস্হ্য, মৃত্যু আর গুলিবারুদের রক্ত হিম করা গল্প পাবে । দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিদিনকার সত্যকার ঘটনা স্বচক্ষে দেখবে  ; তোমার এই গোপ্পুড়ে মস্তিষ্ক এখানে দিয়ারার গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে যাও । বাবার বক্তৃতার কয়েকটা কথা, যে কথাগুলোকে, শুনে-শুনে, অমিত মনে করে কিতাবি-বাকোয়াস, ব্যবহার করার সুযোগ ছাড়ল না ।

         উচ্ছ্বাসকে সামলে ইতু বলল, সরি, সুশান্তজেঠুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ছোটোবেলায় ফিরে গিয়েছিলুম, যখন ডাইনিং টেবিলে বসে বড়োরা সবাই মিলে শহরের নানা কেচ্ছা আলোচনা করত, আর আমরা ছোটোরা শুনতুম, তুইও তো হাঁ করে শুনতিস, ভুলে গেলি কেন  ।

         –দু-দুটো মেয়ে রয়েছে লোকটার, আবার ছেলের কী দরকার ? মেরে ফেলা মেয়ের কথা মনে পড়ল সুশান্তর, ওকে তো সেই মেয়ের মুখও দেখতে দেয়া হয়নি ।

         –সৌদামিনীর বডি দেখলে মাথা বিগড়োবেই । বটঠাকুমা বলেছিল যে একে রেখো না, এর ভাবগতিক ভালো নয়, কাজের বউয়ের অমন খাঁজ-দেখানো লোকাট ব্লাউজ কেন ? কিন্তু সকলে মিলে সৌদামিনীর পক্ষ নিয়ে বলেছিল যে তিন তলা বাড়ি ঝ্যাঁটানো, পোঁছা আর এতগুলো লোকের বাসন মাজার জন্য উপযুক্ত স্বাস্হ্য থাকা জরুরি ।

         সুশান্ত : আমার কাছে অমরেন্দ্রর গল্পটাও রেকর্ড করা আছে । বড়জেঠি বলেছিল একদিন, শুনবি ?

         ইতু : শোনাও, বড় জেঠি ভেতরের খবর আরো বেশি জানেন । অমরকাকু চলে গেছে ব্যাঙ্গালোর । কী করবে বল ? বউ পালিয়ে গেলে পুরুষদের যে কী অবস্হা, যেন জাঁতিকলে পড়া জ্যান্ত ইঁদুর । অমিতের দিকে ফিরে ইতু বলল, তুই তো জানিস, অমরেন্দ্রকাকু আমাদের নতুনদাদুর ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট ছিল, খড়গপুরে পড়েছে, নতুনদাদু ওকে পড়াবার জন্য মেমারির তিন কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা তুলেছিলেন ।

         অমিতের উদাসীন মুখের পানে তাকিয়ে ইতু টের পেল যে প্রসঙ্গটা তোলা উচিত হয়নি । অমিতের মা মানসী বর্মণ, পালিয়ে না গেলেও, স্বামীর উপস্হিতিতেই আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে অমিতের জন্ম দিয়েছেন । হয়ত অমিতের বাবা-মা সেই কারণেই অমিতকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন রাঙাকাকু-কাকিমার ওপর ; ওনারা অমিতকে আইনত দত্তক নিয়ে নিলে অমিত নিশ্চই গর্দানিবাগের বাড়ি থেকে অমনভাবে উধাও হয়ে যেত না ।

         সুশান্ত : শোন । স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিই ।

         ইতু : তোমার তরমুজ মদ দাও তো একটু, খেয়ে দেখি, হুইস্কি, রাম, ব্র্যাণ্ডি, জিন, ভোদকা খেয়েছি, চিড়াইয়াটাঁড়ের দেশিদারুও খেয়েছি, এই ধরণের রঙিন কান্ট্রি লিকার খাইনি । বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে বার-রেস্তরাঁয় গেলে, বাবা বিয়ার এলাউ করত, বড় জোর, দু’পেগ প্রিমিয়াম হুইস্কি ।

          সুশান্ত । এই নে, চুমুক দিতে-দিতে শোন ।

         …এদিকে কী হয়েছে জানিস তো…অ্যাঁ…অমরের বউটা একজনের সঙ্গে পালিয়েছে…অমর রে…অমরেন্দ্র…প্রেম করে বিয়ে করেছিল…আই আই টিতে পড়ার সময়ে…বামুন বাড়ির মেয়ে…তুই তো দেখিসনি….বাবা…কী দেমাগ…মাটিতে পা পড়ে না…পালিয়েছে এক ব্যাটা তামিলিয়ানের সঙ্গে…কোথায় জানিস…আমেরিকা…অমর কেন জানতে পারেনি…তুই-ই বল…পাসপোর্ট ওর বউয়ের আগে থাকতেই ছিল…কবে ভিসা হল…কবে টিকিট হল…কাকপক্ষীও টের পায়নি…আচ্ছা তুই আমাকে বল…অমর কেন জানতে পারেনি না যে ওর বউ কার সঙ্গে মিশছে…কোথায় যাচ্ছে…রাত করে কেন ফিরছে…অমরের মতন পুরুষদের উচিত শাস্তি…ওরা বউকে মনে করে যেন ফলের গাছ…যখন ইচ্ছে এই ডাল থেকে আম খাচ্ছি..ওই ডাল থেকে লিচু খাচ্ছি…সেই ডাল থেকে আপেল খাচ্ছি…তা খাচ্ছিস তো খা না…কে বারণ করেছে…কিন্তু বউ তো আর গাছ নয়…যে এক জায়গায় শেকড় বসিয়ে সারা জীবন তোমার পোঁতা মাটিতে থেকে যাবে…আর তুমি আজ হিল্লিতে কাল দিল্লিতে যত্তো নচ্ছার বন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা  করে বেড়াবে…বউয়েরও তা সাদ আহ্লাদ আছে…শরীর আছে…রসের চাহিদা আছে…তাকেও তো সময় দিতে হবে…বউকে অবহেলার ন্যায্য পুরস্কার পেয়েছে ব্যাটা…তুই তোর বউকে সময় দিস তো…তোর বউ অবশ্য পালাবে না…বউ তো গাছের মতন নয় যে নট নড়ন-চড়ন এক জায়গায় থেকে যাবে…এখন বোঝো…গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ঘুমোও…আর গাছের গুণকেত্তন করো খঞ্জনি বাজিয়ে…পরে আবার গল্প করব, অ্যাঁ…পার্কে বসে তোকে ফোন করছি রে…বাড়িতে কে আড়ি পেতে শুনবে…তার চেয়ে পার্কে আসি সকালে…ডায়াবেটিস কমাতে হলে নাকি দুবেলা হাঁটতে হবে…এই এক বেলাই হাঁটি…বিকেলে টিভিতে একটা প্রোগ্রাম হয়…মেজকত্তা কচুর লতি এনেছিল ভুল করে…লতির ঘণ্ট তোর প্রিয় ছিল বলে কাজের বউকে বললুম ফেলে দিয়ে আসতে… ও কী আর ফেলে দেবে…নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজেদের মতন করে রাঁধবে….রাঁধলে তোর মা কান্না সামলাতে পারবে না….বিকেলে টিভির জন্য সময় পাইনা…ভালো থাকিস…তোর বউ ছেলেকে আশীর্বাদ দিস…সকালে পুজো-আচ্চা আছে…জানিস তো…

         ইশারায় বেবিকে ডেকে ইতুদের গিফ্ট দিতে বলল সুশান্ত, ইতু বলল, আরে তুমি বিয়ে করলে, নতুনবউকে গিফ্ট তো আমরাই দেবো, তোমার বউ কেন দেবে ? তুমি বরং আমাদের কিছু মোটা টাকা দিও । তোমার বউকে দেবার মতন আমার সঙ্গে অবশ্য কিছুই নেই  । তোমার বউয়ের গালে বরং একটা চুমু দিই ।

         বেবি হাজার টাকার দুটো প্যাকেট এনেছিল । সুশান্ত বলল, ওরা যেখানে গিয়ে সংসার পাতবে সেখানে বোধহয় লোকে একশ টাকার নোটও দেখতে পায় না । শুনে, বেবি প্রকৃতই হতবাক, বলল, বাংগালের লোকেরা কি বিহারিদের চেয়েও কাংগাল ?

         সুশান্ত বলল, একশ আর দশ-পাঁচ টাকার প্যাকেট নিয়ে আয়, হাজার টাকা প্যাকেট খুলে নিয়ে আয় । এনে ইতুর ঝোলাতে রেখে দে ।

         –জি । আচ্ছা ।

         ইতু : এরকম করকরে টাটকা হাজার টাকার নোটের প্যাকেট ? এ তো আমিও দেখিনি গো !

         সুশান্ত : পলিটিশিয়ান আর ঠিকেদারদের দেয়া ডোনেশান । শশুরমশাই মাসোহারা পান ।

         ইতু : এরকম রাজত্ব পেয়েছ, সঙ্গে দীঘলচাউনি রাজকন্যা পেয়েছ । ও, তাই তো ভাবি, কীসের টানে আটকে রইলে । তোমার বউতো একেবারে হরিণী, অমন বড়-বড় চোখ, এই বয়সে ফিগারও মেইনটেইন করেছে, গায়ের রঙের কী করার আছে !  ওনার ব্যবহার অনেক মিষ্টি । ট্রফি বলে একটা কথা আছে, জানো তো, তোমার বউ হল সেই ট্রফি ।

         বেবি : হরণ ? না ওনাকে বাবা হরণ করে আনেননি, উনি নিজেই এখানে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন । তখন ওনাকে দেখতে অনেক ভালো ছিল, এখন মদ আর শুয়োরের মাংস খেয়ে-খেয়ে  ভমচৌলা কুম্ভকরণ হয়ে গেছেন । ওনাকে দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । আমি কেন দিয়ারার অন্য কাউকে বিয়ে করতুম, বলুন, যখন এত ভালো পাত্র আমাদের দরোজায় শ্রীরামচন্দ্রের মতন এসেছে !

         সুশান্ত : আমাকে হরণ করার কথা বলছে না । বলছে যে তুই হরিণের মতন সুন্দরী ।

         বেবি হাঁটু মুড়ে ইতুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, এতদিনে শশুরবাড়ির আশীর্বাদ পেলুম । ইতু ওর মাথা ধরে কপালে একটা চুমো দিল, বলল, তুমি তো বাক্যবাগীশ হরিণী গো, আমি ভাবতুম আমিই বুঝি গায়েপড়া বেহায়া ; সুশান্তজেঠু, আমার হয়ে তোমার বউকে একটা মুখরোচক চুমু দিও । নিজের দুই হাত থেকে চারগাছা চুড়ি আর কান থেকে টপ খুলে বেবিকে দিয়ে ইতু বলল, যেখানে যাচ্ছি সেখানে এগুলোর প্রয়োজন হবে না, তুমি রেখে নাও । বেবি সুশান্তর দিকে চাইতে, সুশান্ত বলল, লে লে, কুছ তো তুঝে তেরে সসুরাল সে মিলা ।

         –এই ছিঃ, গুরুজন না, ইতুর চুমু প্রসঙ্গে বলল অমিত ।

         –কোনো-কোনো গুরুজন ঝাঁসু হন, ইয়ার্কিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন । সুশান্তজেঠু তাদের এক ও অদ্বিতীয় । করে নিচ্ছি ইয়ার্কি । আর তো বোধহয় দেখা হবে না । তাছাড়া এই মদটা বেশ কড়া । তোমার ছেলে অপুকে দেখছি না, তোমার শশুরবাড়ির ট্র্যাডিশান ফলো করে ওর বিয়ে দাওনি এখনও ?

         বেবি বলল, আপ্পু নাআআআআ ? ওকে বিলেতে পাঠাতে চান উনি, আরও পড়াশুনা করার জন্য ; বিলেতে গেলে কি আর ফিরবে ? থেকে যাবে সেখানেই, টিভিতে দেখি, কত সুন্দর ওদেশের মেমরা, বুড়িরাও জোয়ান ।

          অপুর সঙ্গে ওদের দেখা হল না । অপু তো দিল্লিতে ।

          সুশান্ত ওদের নৌকোয় চাপিয়ে দিলে, গর্দানিবাগের বাড়িতে দেয়া  মোবাইলটা গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ইতু । সুশান্ত ওকে একটা চোরাই মোবাইল আর চারটে বেনামি সিমকার্ড দিয়েছেন ।

          অমিতরা চলে যাবার পর সুশান্তকে মনমরা দেখে মেঠোগন্ধা নিরক্ষর বেবি জানতে চাইল, পুরোনো দিনের জন্য আপনার মন খারাপ লাগছে ?

          অমিত আর ইতু চলে যাবার পর সুশান্ত ঘোষের মনে হচ্ছিল যে উনি প্রকৃতপক্ষে একা, নিঃসঙ্গে । ওনার বউ রয়েছে, চারিপাশে হুকুমবরদার রয়েছে, শশুর-শাশুড়ি রয়েছে, তবু উনি একা বোধ করেন নিজেকে । কেন এমন হয় ? কিছুরই তো অভাব নেই । ঠাণ্ডা একটা চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অজানা অসন্তোষ লুকিয়ে রয়েছে , সেন্স অব বিলংগিং নেই ওনার, সদা সন্ত্রস্ত থাকেন, ভয়ে নয়, সন্ত্রস্ত থাকার অবস্হানকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে । মনে করেন যে ওনার বাইরের সঙ্গে ভেতরের মিল নেই । হোক না অস্বাস্হ্যকর, তবু একা থাকতে ওনার ভালোলাগে । উনি তো সেই চাকরি করার সময় থেকে মিশে আসছেন সবায়ের সঙ্গে, ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে, কিন্তু দিয়ারায় স্হায়ী হবার পর থেকে আসেপাশের সবাই ওনাকে হতাশ করে চলেছে । উনি যেমন জগতসংসারের পরোয়া করেন না, তেমনই পৃথিবী ওনার পরোয়া করে না, জানেন উনি । এই যে অমিত বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে চাইছে, রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলে ইউটোপিয়া আনার স্বপ্ন দেখছে, তাতে জগতসংসারের বয়েই গেছে । কাটার সময় শুয়োরগুলো যেমন আতঙ্কিত চিৎকার দেয়, তেমনই নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে ওনার অস্তিত্ব জুড়ে । তিনি যেন তাঁর নিজের মগজের ফাঁকা পোড়োবাড়ির একমাত্র ভাড়াটে । কিসের সঙ্গে যে সংঘর্ষ করে চলেছেন তা উনি নিজেই জানেন না । কে জানে কোন আড়ালে ওৎ পেতে আছে বিষণ্ণ আতঙ্ক, ঘষা কাচের ভঙ্গুর আদলে ভেসে বেড়াচ্ছে শরীরময়, পেটের ভেতরের কুনকি-হাঁস, যাকে তরমুজের মদ প্রতিদিন গিলিয়েও বশে আনা যাচ্ছে না । বেবির সমর্পিত ভালোবাসার অতিউন্নত খোঁয়াড়  সত্ত্বেও নিজেকে কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়, পার্থিব সব কিছু পাবার পরও, চাহিদা মেটার পরও, নিজেকে অতৃপ্ত মনে হয়, আর এগুলো তো স্হায়ী হয়ে গেছে। এ থেকে যে মুক্তি নেই, তা আরও বিষময় যন্ত্রণাদায়ক এক সমস্যা ।

.

নয়   

          দিয়ারার আসেপাশের জলে মাছ ধরতে হলে, নৌকো বাইতে হলে, সুশান্তকে, মানে জামাইবাবার নামে তাঁর শশুরকে, রংদারি ট্যাক্স দিতে হয় । এই মহার্ঘ বালিয়াড়িতে সরকার বলতে বোঝায় তারিণী মণ্ডলের জামাই, যাকে গ্রামের লোক আর প্রশাসনের লোকেরা যে-যার আতঙ্কের মাধ্যমে চেনে-জানে । অঞ্চলের অন্য গুণ্ডারা, যেমন দীনা যাদব, দমদমি যাদব, রাসবিহারি মণ্ডল, দারা মিয়াঁ, সৎইয়া মণ্ডল প্রতিমাসে জামাইখোরাকি দিয়ে যায় ওনার শশুর বা শাশুড়িকে । ওনার দলের সবায়ের কাছে কাট্টা,তমঞ্চা, একনল্লা, দুনল্লা আছে, কয়েকজনের কাছে একে-সানতালিস আর একে-ছপ্পন ।

       যে দিয়ারাগুলোর পলি প্রায় পাকা জমির চেহারা নিয়েছে, সেখানে সরকারি স্কুল আছে বটে কিন্তু বর্ষায় তারা ডুববে না ভাসবে তা কেউ আগাম বলতে পারে না বলে সারা বছর ক্লাস হয় না । ছেলে অপুকে তাই ভাগলপুর শহরে রেখে সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জামাইবাবা । তারিণী মণ্ডলও চেয়েছিলেন নাতি আজকালকার খ্যাতনামা অপরাধীদের মতন স্যুটটাই পরে দেশে-বিদেশে নাম করুক । স্কুলে যে চারটে গ্রুপ ছিল লাল, হলুদ, সবুজ আর নীল, তাতে লাল গ্রুপে ছিল অপু, বাদশাহি লাল । ওর, অপুর, নামটা তারিণী মণ্ডলের দেয়া, আদর করে, আপ্রাধি ঘোষ, তারিণীর মতে জগতসংসারে অপরাধীর চেয়ে বড়ো আর কেউ হতে পারে না, তা মহারাজ বাল্মিকীর জীবন থেকে জানা যায় । এককালের ডাকাত সর্দার, পরে রামায়ণের লেখক, তাঁর  নাম যদি উইয়ের ঢিবি হতে পারে তাহলে তারিণী মণ্ডলের একমাত্র নাতির নাম কেন রামায়ণ রচয়িতার অনুকরণে হবে না । তাই আপ্রাধি ; সুশান্ত নিজের মতো করে তাকে বাঙালিয়ানা দিয়ে অপু করলেও, কেউই ওকে অপু বলে ডাকে না, এমনকি সুশান্তর বিড়িসেবিকা মেঠোগন্ধা নিরক্ষর ডাগরচোখ শ্যামলিমা বউও নয় । বেবি ডাকে আপ্পু বলে ।

         ওর ডাকনাম হয়ে গেছে আপ্পু । আড়ালে, আপ্পু দোগলা । স্কুলেতে সহপাঠীরা ‘আবে আপ্পু’ ডাকটাকে ‘এবি আপ্পু’তে, মানে ‘এ বাস্টার্ড আপ্পুতে’,  পালটে তাতাতে চেষ্টা করলে, অপুর সরাসরি উত্তর, হ্যাঁ, তো কি হয়েছে ?

         অশ্বমেধ হোষ নামে ডাকে না কেউ, টিচাররাও বলেন আপ্পু ।               

         বুক চিতিয়ে অপু জানায়, আমি বাঙালি, বুঝলি বাঙালি ।

         –বাংগালি ? সে তো আরও কমজোর, দল বেঁধে চেঁচায় । দুজন এক সঙ্গে না হলে লড়তে ভয় পায় । আর কায়স্হ মানে তো মুনশিগিরি, যমরাজের কেরানি চিত্রগুপ্ত জাতে কায়স্হ । দেখিস না কায়স্হগুলো চিত্রগুপ্ত পুজো করে ।

         –বাড়ি গিয়ে পুরাণ-শাস্ত্র পড়গে যা । চিত্রগুপ্ত হল বিহারি কেরানি, আর যমরাজ হল বাঙালি ।

        –আচ্ছা ?

         –হ্যাঁ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নাম শুনিসনি তোরা । ইংরেজদের এমন বাঁশ দিয়েছিল যে সে বাঁশ কাংরেসিরা ধামাচাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে । একদিন ওই বাঁশের চারা বেরোবে চারপাশ থেকে, তখন দেখিস কী হয়।

      সুভাষচন্দ্র বসুর নামটা তারিণী মণ্ডল মুখস্হ করে রেখেছেন । নাতিকে যখনই উৎসাহিত করার দরকার হয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের গল্প আরম্ভ করেন, সবই গাঁজাখুরি, কেননা উনি কেবল নামটুকুই জানেন আর ফোটো দেখেছেন । বলেন, আরে ওনার ফোটুর দিকে দ্যাখ, লম্বা-চওড়া গাবরু জওয়ান, প্যান্ট-শার্ট পরে স্যালুট নিচ্ছে । আর আজকালকার নেতাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ভয়ে সবায়ের ল্যাজ পোঁদে এমন ঢুকে থাকে যে দশটা বন্দুকধারি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ; আমি তো শুধু দুটো পহলওয়ানকে রেখেছি, আমার ওপর রামধারি ধানুক একবার হামলা চালিয়েছিল বলে, রামধারীর জন্যই আমার বাঁচোখটা নষ্ট হয়ে গেল ।

         –জানি দাদু, রামধারিকে তুমি লোক পাঠিয়ে কলকাতায় মারিয়েছিলে ; দুই রাজ্যের ঝগড়ায় সে ব্যাটার লাশ পনেরোদিন কলকাতার মর্গে পড়ে পচে পোকা ধরে গিয়েছিল ।

         –আরে, এই দিয়ারার জমিজমা সবই গংগোতা আর মাল্লাহদের ছিল ।

         –জানি, বাবা সেকথা বলেছিল তোমায় । এচ এচ রিজালে নামে একজন সায়েব ১৮৯১ সালে লোকগণনা করে লিখে গেছে সেসব । কিন্তু উঁচু জাতের আফসাররা টাকা খেয়ে ভূমিহার, রাজপুত, যাদব, কোয়েরি, কুর্মিদের হাতে দিয়ারার জমি তুলে দিত । গংগোতারা ফেরত নেবার চেষ্টা করতে গেলে তাদের চোখে ছুঁচ ফুটিয়ে অ্যাসিড ঢেলে দেয়া হয়েছিল, ক্রিমিনাল দেগে দেয়া হয়েছিল ।

         –ক্রিমিনাল খারাপ হতে যাবে কেন ? রামায়ণ লিখেছিলেন মহারাজ বাল্মিকী, উনি কি ক্রিমিনাল ছিলেন?  উনি ছিলেন মহাআপ্রাধি । তুই বড়ো হয়ে মহাআপ্রাধি হয়ে দেখা দিকিনি ।

       গঙ্গার তো মতিগতির ঠিকঠিকানা নেই ; এই বর্ষায় এক দিয়ারা ডোবায় তো আরেক বর্ষায় আরেক  । যে খেতি করে তার জমি ডুবলে যে নতুন জমি ভেসে উঠল সেটা তার পাওনা, কিন্তু ইংরেজরা যাবার পর উঁচু জাতের লোকেরা নতুন ভেসে-ওঠা দিয়ারা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত । কী আর করা যাবে, বল । তাই আমরা হাথিয়ার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি । বন্দুক যার, জল-জমিন তার । কৈলাশ মণ্ডল নামে একজন গংগোতা নকসল্লি কামকাজ করে  চেষ্টা করেছিল সব ঘোটালা বন্ধ করতে, সেই ১৯৬৭ সালে ; কিন্তু সেও তো কোথায় গায়েব হয়ে গেল ।

         –গায়েব হয়নি, আমাদের ইউনিভারসিটির একজন টিচার বলেছে যে তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছিল । তখন নকসল্লি ধরে-ধরে গায়েব করার সরকারি কারিয়াকরম চলছিল ।          

         –আরে সব বেকার । লুকিয়ে-লুকিয়ে যদি কিছু করতেই হয় তো সুভাষচন্দ্র বোসের মতন করো । আংরেজরা অব্দি পালিয়ে গেল ভয়ে । কথা কটা বলে উরুতে কুস্তিগিরের চাপড় দাদুর ।

         –দাদু, আমাদের মতন ছিল না সুভাষচন্দ্র বোস । ওর জন্যে জান দেবার অনেক সঙ্গীসাথী ছিল । আমরা তো নিজেরাই লড়ে মরি ।

      বাবা সুশান্ত ঘোষ মনে করেন ওনার  কোনো প্রত্যক্ষ অবদান নেই অপুর চরিত্র গঠনে । পরোক্ষ অবদান আছে । অপু নিজেও তাই মনে করে । বাবা বাংলা বলতে আর ভাগলপুর শহর থেকে বই এনে বাংলা পড়তে শিখিয়েছেন, সাধারণ জ্ঞানের বই কিনে দিতেন ছোটোবেলা থেকে । বাংলা শেখানোর সময়েই চটে যেতেন বাবা, কান মুলে দিতেন, চড় মারতেন । বাংলা শেখার দরুণ আলটপকা কথা বলে বিব্রত হতে হয়েছে অনেক সময়ে । জে এন ইউয়ের বন্ধুরা তো আর জানে না যে ওর মা দিয়ারার গংগোতা বিহারিন । পদবি দেখে অনুমান করে নেয় যে এ. ঘোষ মানে শহুরে বাঙালি ।

         সনাতন সরকার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল অপুর। গায়ের রং বেশ ময়লা, কোঁকড়া উস্কো-খুস্কো চুল, রোগা, সাড়ে পাঁচ ফিটের, কালো ফ্রেমের চশমা-চোখ সনাতন দিল্লিতেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বজায় রেখেছে, পায়ে কোলহাপুরি, বাংলা কথায় ওড়িয়া টান । বিড়ি ফোঁকে । প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই সনাতনের সঙ্গে আড্ডা মারে অপু ।

         –হাই সনাতন, আপনিও কি সোকলড প্রবাসী ? প্রথমবার পরিচয় করার জন্য শুরু করেছিল অপু ।

         –পশ্চিমবাংলার বর্ণহিন্দু হাফগাণ্ডুরা আমাদের অমনভাবে গালাগাল দেয়, ইসকি মাকা সালে…… ; তুইও কেন সেকথা পাড়ছিস । তুই তো ভাগলপুরি খোটুয়া বলে জানি । কথায় বিড়ির ধোঁয়া মিশিয়ে বলল সনাতন সরকার ।

         –না, পুজোপাণ্ডালে, দিল্লি হাটে  বা কোনো ফাংশানে দিল্লির বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ হলে, যখন ওনারা জানতে পারেন যে আমি ভাগলপুরের তখন অমন প্রশ্ন তোলেন । আপনি তো উড়িষ্যা থেকে ?

         –না, টু বি স্পেসিফিক, আমি দণ্ডকারণ্য থেকে । শুনেছিস কি দণ্ডকারণ্য ?

         –বাবার কাছে গল্প শুনেছিলুম, রামায়ণ না মহাভারতের গল্প ঠিক জানি না, নর্মদা আর গোদাবরী নদীর তীরে দণ্ডক রাজার রাজ্য ছিল । কোনো ঋষির অভিশাপে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল ।

         –আবে সালে হাফউইট, আমি সেই আদ্যিকালের গাঁজাখুরি এরিয়ান গল্পের কথা বলছি না ।

         –দেন হোয়াট ?

         –দণ্ডকারন্য জায়গাটা হল ভারতের কয়েকটা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত নয়টা জেলা , মাটির তলায় প্রচুর মিনারালস আছে ; গড়চিরোলি, ভাণ্ডারা, বালাঘাট, রাজনন্দগাঁও, কাউকের, বস্তার, নারায়ণপুর, দাঁতেওয়াড়া আর মালকানগিরি । আমি মালকানগিরি প্রডাক্ট, সুভাষপল্লিতে থাকতাম, এখনও আছে সুভাষপল্লী, জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরাই বসত গড়েছিলাম, আর এখন চুতিয়াগুলো আমাদেরই ঘরছাড়া করে দিতে চাইছে, ইসকি মাকা…  । কিন্তু এখন চলে গেছি ছত্তিসগড়ের নারাণপুরে ।

         –মালকানগিরি ? অমন অড, গড ফরসেকন জায়গায় ?

         –দেশভাগের পর কী হয়েছিল জানিস না, চামগাদড় কঁহিকা ?

         –হ্যাঁ, জানি-জানি, বাস্তুহারাদের দণ্ডকারণ্যে সেটল করানো হয়েছিল ।

         –কোন ভোঁসড়িকে-জনা তোকে বুঝিয়েছে, ইসকি মাকা… ? কিছুই জানিস না তুই । আমাদের, নমঃশূদ্র  বাঙালিদের, আনসেটল করা হয়েছিল, ডেসট্রয় করা হয়েছিল, ইসকি মাকা…. । বাঙালির প্রত্নতাত্ত্বিক রুইনস যদি দেখতে চাস তো ঘুরে আয় একবার, ইসকি মাকা…। স্বাধীনতার লাৎ খেয়ে আমরা  সেই সব মানুষ হয়ে গড়ে উঠেছি যাদের অতীত লোপাট, বর্তমান গায়েব আর ভবিষ্যৎ নেই । আইডেনটিটিলেস । আমাদের ইতিহাস প্রতিদিন রিপিট হয়, কেননা আমরা ইতিহাসহীন, বিমূর্ত । বিমূর্ত বুঝিস ? অ্যাবসট্র্যাক্ট !

          …চুপ করে যায় অপু । টের পায় যে সারেনি এমন আঘাতের রক্তপূঁজের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে ।

          –আমরা ১৯৪৭-এ, ১৯৬৪-৬৫-তে, ১৯৭১-এ, ১৯৭৫-এ মার খেয়েছি, যখনই ওপার বাঙালির কসাইদের প্রবৃত্তি সালভাদর দালির পেইনটিঙের মতন হয়  , তখনই ওরা আমাদের পোঁদে জ্বলন্ত জিরাফ ঢোকায়। অপর জানিস তো, দি আদার, পড়ছিস বোধহয়, তোদের কোর্সে আছে তো, দি আদার, ইসকি মাকা… । সম্প্রতি নাস্তিক আর আস্তিকদের খুনিখুনি হল ঢাকায়-চট্টগ্রামে, তাতেও ঘরছাড়া করা হল আমাদের, আমাদের ইয়ানেকি নিম্নবর্ণের লোকেদের । ওদেশের রাজনীতির বনেদ হয়ে গেছে  খেদাও, খেদাও, খেদাও, মেইনলি রিমেইনিং নিম্নবর্ণদের খেদাও।

         …চুপ করেই থাকে অপু ।

         –মরিচঝাঁপি শুনেছিস, মরিচঝাঁপি ?

         –হ্যাঁ, জানি ঘটনাটা, বাবা বলেছিলেন, দণ্ডকারণ্য থেকে কয়েক হাজার পরিবার গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপে বসতি গড়তে ।

         –ওই দ্বীপেই, ১৯৭৯ এর ৩১ জানুয়ারি আমার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইসকি… । মরিচঝাঁপি দ্বীপটাকে চারিদিক থেকে তিরিশটা পুলিশ-লঞ্চ ঘিরে রেখেছিল যাতে খাবার আর পানীয় জল না পোঁছোয় ; তারপর যুদ্ধক্ষেত্রের ঢঙে ব্রাশফায়ার করেছিল, ইসকি… । দণ্ডকারণ্যের অনেকের বাড়িতে ৩১ জানুয়ারির দিনটা তাদের কোনো-না-কোনো আত্মীয়ের মৃত্যু দিন হিসাবে পালিত হয় । আমাদের বাড়িতে পালিত হয় আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন হিসাবে । যারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল তাদের কেউ-কেউ কলকাতার বারাসাতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনি গড়ে থেকে গেল, কেউ-কেউ থেকে গেল ক্যানিঙের হিঙ্গলগঞ্জে কলোনি গড়ে, কেউ রেললাইনের ধারে, কেউ খালপাড়ে । আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দণ্ডকারণ্যে  নিয়ে এসেছিলেন আমার পিসেমশায়, নিজের পিসেমশায় নন, তবু আপন । নয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম, ইসকি… । তোরা হয়তো ভাবিস তোদের চেয়ে আমার বয়স এত বেশি, ইউনিয়ানবাজি করার জন্য গাণ্ডুগর্দি চালিয়ে ইউনিভার্সিটিতে টাইম পাস করছি, হয়তো মনে করিস পি এইচ ডি করতে এত বছর লাগছে কেন, ইসকি… ।

         …আবার চুপ করে যায় অপু ।

         –আমাকে আবার দণ্ডকারণ্যে এনে লালন-পালন বলতে যা বোঝায় তা করেছেন, স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন, এখনও  পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন, আমার পিসতুতো বোন যাকে ১৯৭১ সালে রেপ করেছিল পাকিস্তানি রাজাকারগুলো, ইসকি…। সেও আমার নিজের পিসতুতো বোন নয়, কিন্তু আপন । ও দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি যায়নি । ওর বর, আমার অভিভাবক জামাইবাবু গণেশচন্দ্র সরকার যেতে চাননি ; উনি তখনই বলেছিলেন ওই টেঁটিয়া গিরগিটিমার্কা বর্ণহিন্দু বাঙালিগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, ইসকি…। আন্দামানে যাবার জেটিতে গিয়ে ওদের ছাতুবাবুরা কালাপানি-দ্বীপান্তরের আতঙ্ক ছড়িয়ে ভাষণবাজি করে হাজার-হাজার মানুষের আন্দামানে যাওয়া ভণ্ডুল করে দিয়েছিল । নেহেরু আমাদের ঠুঁসে দিল আদিবাসীদের জংলি এলাকাগুলোয়, আর বর্ণহিন্দু বাঙালিরা পেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, তুই তো এসব সাপসিঁড়ির পলিটিক্স জানিস না। বাড়ি থেকে কাঁচা টাকা আনিস, আর নাইটক্লাব-ডিসকোবাজি করে বেড়াস ।

         …অপু চুপ করে রইল । বুঝতে পারছিল যে সনাতন সরকার সম্ভবত মন খুলে ঝাল ঝাড়ার অবসর তৈরি করে ফেলতে পেরেছে ওর প্রশ্নগুলোর চোট খেয়ে । অপু আরও ভয়ঙ্কর হিন্দি গালাগাল জানে, ব্যবহার করে না কখনও, ছোটোবেলা থেকে বাবার চড়-খাওয়া নির্দেশ ।

           –ওই নেতাগুলোর বেশ কয়েকজন বেঙ্গলের ডিভিজান করে পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিল । যেই পাকিস্তান হল অমনি বর্ণহিন্দু  লোকগুলো আগেভাগে পালিয়ে এলো ; এসে, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় জিগির তুলে ট্রাম-বাস পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর আমরা ? আমরা তো নমঃশূদ্র, নিম্নবর্ণ, আনটাচেবল, ইসকি…। বর্ণহিন্দু পরিবারগুলো পশ্চিমবাংলায় বাড়িঘর তৈরি করে থেকে গেল, পার্টিগুলোকে দখল করে নিল । নিম্নবর্ণের জন্যে দণ্ডকারণ্য, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, ইসকি…। বর্ণহিন্দু ভাড়ুয়াগুলোই আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়নি । এখন আন্দামানে গিয়ে দ্যাখ, সাউথ ইনডিয়ান আর পাঞ্জাবিরা গুছিয়ে নিয়েছে । বাংলা তো পড়তে পারিস । তোর ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে মনোরঞ্জন ব্যাপারির লেখা চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল বইটা আছে, পড়িস । জঁ জেনে সম্পর্কে জাঁ পল সার্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করে সেইন্ট জেনে নামে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন । কোনো বাঙালি কি মনোরঞ্জন ব্যাপারিকে নিয়ে বই লিখেছে ? শালা বর্ণহিন্দু চুতিয়া ইনটেলেকচুয়ালদের দল, ইসকি…।

         ক্যান্টিনের অন্য টেবল থেকে একজন সহপাঠির মন্তব্য শোনা গেল, আবে সানি, হিন্দি মেঁ গালি কিঁউ ? তু বংলা গালি নহিঁ জানতা হ্যায় ক্যা ? সুনা, সুনা, দো-চার, ইয়াদ করকে রখুঁ ।

         সনাতন জবাব দিল, যাদের দিচ্ছি তাদের জন্য এই গালাগালগুলোই উপযুক্ত মনে হল । বাংলা গালাগাল কয়েকটা জানি, কিন্তু সেগুলোয় তেমন তেজ নেই । মালকানগিরিতে বাংলা বলার চল শেষ হয়ে গেছে, ইসকি…।  উড়িষ্যা সরকার বাংলা শেখানো তুলে দিয়ে ওড়িয়া শেখাচ্ছে । মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলি জঙ্গলের উদ্বাস্তু গ্রামে বাঙালিরা আছে, তাদের বাচ্চাদের স্কুলে মারাঠি শিখতে বাধ্য করা হয়েছে, সাতচল্লিশটা স্কুলে, বুঝলি, আমরাই এসট্যাবলিশ করেছিলাম ওগুলো। চন্দ্রপুর আর গড়চিরোলিতে বাংলা বলার মতন বাঙালি আর পাবি না, দশ-পনেরো বছর পর, ইসকি…। কোথাও কোথাও ইলেকট্রিসিট পৌঁছেচে বটে, কিন্তু চাষের জল, সেচের ব্যবস্হা নেই, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র নেই । গালাগাল দেবো না তো কী দেবো, ভ্যালেন্টাইনের খামে পুরে আমাশার মিক্সড ফ্রুট জ্যাম ?

            অপু বলল, আরে আপনি ওদের ছাড়ুন, শালারা সারাদিন লন্দিফন্দি করে আর চকরলস কাটে ; ছোলে-ভাটুরে খাতে, অওর লিডারকে দুম চাটতে ।

         –এখন দণ্ডকারণ্যে পোলাভরম ড্যাম তৈরি হবে নয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, চুতিয়া শালা ইসকি…। উপজাতি আর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত দুশো ছিয়াত্তরটা গ্রামের দু লাখ মানুষ ভেসে যাবে, উৎখাত করা হবে তাদের, দাঁতেওয়াডায় সাবরি নদীর ধারে চাষের সব জমি ভেসে যাবে, ইসকি…। কারোর দুশ্চিন্তা নেই, তার কারণ যারা ভেসে যাবে তারা হয় শিডুল্ড ট্রাইব বা বাঙালি শিডুল্ড কাস্ট । এই যে সেনসাস হল, তাতে আমরা যে শিডুলড কাস্ট তা চাপা দিয়ে দেখানো হল আমরা বাঙালি, ইসকি…। কেন ? যাতে আমরা শিডুলড কাস্টের সুবিধাগুলো না পাই । ভোঁসড়িকে, পোলাভরমের জল যাবে ভিশাখাপটনমের কারখানাগুলোয়, স্টিল প্ল্যান্টে, হাইড্রোপাওয়ারে,শহরে । ক্যান ইউ ইম্যাজিন ? লক্ষ-লক্ষ মানুষ পানীয় জল পাবে না, ইসকি…। আর কলকাতায় গিয়ে দ্যাখ ; বর্ণহিন্দু লৌণ্ডাগুলো আমরা বাঙালি আমরা বাঙালি করে ধুতি খুলে লুঙ্গি ড্যান্স নেচে চলেছে। দেশভাগের দরুণ আমরা শুধু তাদের সাংস্কৃতিক গর্বের বাল ওপড়াবার জন্য নিশ্চিহ্ণ হয়ে চলেছি, ইসকি…। দণ্ডকারণ্যের দলিতরাও তাদের দলে আমাদের নিতে চায় না  । আমরা ইতিহাসের গার্বেজ ডাম্প, ইসকি…।

           সনাতন সরকার নিজের রোষকে সামাল দিয়েছে আঁচ করে অপু বলল, বাংলাদেশ কিন্তু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিচ্ছে, এতকাল পরে হলেও নিচ্ছে । সেখানের জনসাধারণের মধ্যে থেকেই সরকারকে নাড়া দেয়া হচ্ছে, মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা হচ্ছে ।

         –কী রকম শুনি ?

         –শাহবাগে এককাট্টা হয়ে মেয়েরা পর্যন্ত প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, বোরখা পরে নয়, ওপনলি । আমাদের এখানে চুরাশির শিখ নিধন, নেলি গণহত্যা, গোধরার পর আহমেদাবাদের দাঙ্গা, কয়েকমাস আগে মুজফফরনগরে আর শ্যামলিতে যে দাঙ্গা হল, কই এখানে তো শাহবাগের মতন রাস্তার মোড়ে নামতে দেখা গেল না ছেলে-মেয়েদের ।

         –ওদের দেশে বিয়াল্লিশ বছর লেগেছে কাদের মোল্লাকে কাঠগড়ায় তুলতে, যে লোকটা শুধু মীরপুরেই সাড়ে তিনশ মানুষকে খুন করিয়েছিল । আসল শয়তান বাচ্চু রাজাকরটা  আগেই পাকিস্তানে পালিয়েছিল, ইসকি…। তুই আমার তর্কটাকে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছিস । আমাদের এখানে যতই দাঙ্গা হোক না কেন, আমরা কাউকে পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে তাড়া করে নিয়ে যাই না । আমাদের কোনো রাজাকরের ইকুইভ্যালেন্ট নেই । রাজাকর কাদের বলে জানিস ?

         –ধার্মিক স্বেচ্ছাসেবকদের । যতদূর জানি হায়দ্রাবাদের নিজামের টাকায় তৈরি মিলিশিয়া ।

         –আবে ঘড়িয়ালকে চামড়া, তর্ক চলছে পূর্ব পাকিস্তান আর নিম্নবর্ণের বাঙালি নিয়ে , তুই তার মধ্যে নিয়ে এলি হায়দ্রাবাদ।  রাজাকার হল খুনি মিলিশিয়া, যাদের অর্ডিনান্সের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিল টিক্কা খান, ইসকি… । পূর্ব পাকিস্তানে, আই মিন বাংলাদেশে,  তুই ঘরে-ঘরে রাজাকার পাবি। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, হিমালয়ের তরাই, আন্দামান এমনকি দণ্ডকারণ্যেও বাঙালিদের মধ্যে তুই অমন জাতকসাই পাবি না । আমাদের এখানে সরকার কোনো দিনই ধর্মান্ধ মিলিশিয়া তৈরি করবে না, আমরা দেবো না তৈরি করতে, গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে , ব্লাডি সিভিল ওয়র । হুমায়ুন আজাদের নাম শুনেছিস ?

        –হ্যাঁ, আমার বাবা হুমায়ুন আহমেদের অনেক বড়ো ফ্যান । যে গংগোতা বাংলাদেশ-ইনডিয়া সীমার ব্যবসা দেখভাল করে আর থার্মোকোল আইসবক্সে বাবার জন্যে ইলিশ আনে, শুঁটকি-মাছ আনে, সে বাবাকে বইপত্র এনে দ্যায় । ইলিশ-টিলিশ বাবা নিজেই রাঁধেন ।

       সনাতন সরকার, স্তম্ভিত, অপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবে, তেলচাট্টা ঘাসলেট, আমি একজন ভাবুকের কথা বলছি, পাল্প ফিকশান রাইটারের কথা বলছি না। হুমায়ুন আজাদকে পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে একটা বই লেখার জন্য রাজাকাররা খচাখচ-খচাখচ ছুরি-ছোরা-চপার মারার কিছুদিন পর উনি মারা যান। যাকগে, তোর মতন অ্যায়রা-গ্যায়রা নাৎথু-খায়রাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই ; কী জানতে চাইছিলিস যেন ?

         –এমন লেকচার দিলেন যে যা বলতে চাইছিলুম, তা-ই ভুলে গেলুম । গালাগালের তোড়ে ভেসে গেলুম ।

.

দশ

মংরুরাম নুনেতি ( কানাগাঁও-এর প্রাক্তন সরপঞ্চ ):  আরে, আরে, খাদেতে দুজন লোক পড়ে আছে । সাপের কামড়ে নাকি অন্য কোনো জন্তু জানোয়ার মেরে ফেলে রেখে গেছে, পরে এসে খাবে ?

গাসসুরাম ( গ্রামবাসী ) : গ্রামের তাতিম গোঁড় বলছিল যে এই জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যাবেলা গুলিগোলা চলেছিল । গুলি লেগে মরেছে বোধহয় ।

মংরুরাম : রক্ত লেগে নেই কেন তাহলে ? গুলি লাগলে রক্ত থাকত জামাকাপড়ে ।

গাসসুরাম : চলুন চলুন, শেষে আধামিলিট্রি জওয়ানরা দেখতে পেলে আমাদেই জেলে পুরবে । মাওওয়াদিরা দেখতে পেলে ধরেবেঁধে নিয়ে গিয়ে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে শেয়ালের মাংস ঢুকিয়ে দেবে ।

মংরুরাম : যে-ই ধরুক, নিখালিস  উড়িয়ে দেবে ।

গাসসুরাম : বাপ রে । তাকাবেন না ও দিকে ।

মংরুরাম : তাড়াতাড়ি চল, তুই তো ভাঙা পা নিয়ে হাঁটতেই পারিস না ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *