ও যখন পর্ন-আসক্ত

ও যখন পর্নআসক্ত 

বাচ্চা-কাচ্চা, কিশোর-তরুণদের পর্ন-আসক্তির ওপর ফোকাস করতে গিয়ে বিবাহিতদের মারাত্মক পর্ন-আসক্তি ফোকাসের বাইরেই থেকে যায়। বিবাহিতদের পর্ন-আসক্তি কী ভয়ঙ্কর তা এ বইয়ের প্রথম দিকে “১০৮ টি নীলপদ্ম” শিরোনামের লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। একবার পর্ন-আসক্ত হয়ে গেলে সঙ্গীর মাঝে আর প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া না, তাকে শুধু ভোগ্য দ্রব্য মনে হয়। অনেক স্বামী-স্ত্রী তাদের সঙ্গীদের বাধ্য করেন বিছানায় পর্নস্টারদের অনুকরণ করতে। ভালোবাসা হারিয়ে যায়, মধ্যরাতে স্বামীর স্পর্শ স্ত্রীর শরীরে আর শিহরণ জাগায় না, মনে হয় একটা পশু তাকে ছিঁড়ে ছিবড়ে ফেলছে। ঝড় থেমে গেলে স্বামী পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যান, স্ত্রী বেচারি জেগে থাকেন একজোড়া সিক্ত চোখ আর বুকভরা ঘৃণা নিয়ে। একসময় ভেঙে যায় সংসার। অথচ একটু সচেতন হলেই বিবাহিতদের পর্ন-আসক্তি এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কীভাবে এ আসক্তির মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে এ লেখায়। 

আপনার স্বামী বা স্ত্রী যদি নিজে থেকেই আপনার কাছে এসে তার আসক্তির কথা স্বীকার করে নেয়, তাহলে আসক্তি কাটিয়ে ওঠার অর্ধেক কাজটাই শেষ হয়ে যায়। বাকি থাকে শুধু দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবশিষ্ট কাজটুকু করে ফেলার। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পর্ন-আসক্ত স্বামী/স্ত্রী আসক্তির কথা সযত্নে গোপন রেখে দেন, সরাসরি জিজ্ঞাস করলে অস্বীকার করে বসেন। ফলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যায়। তে, প্রথমেই আমরা আলোচনা করব পর্ন-আসক্ত হবার চিহ্নগুলো নিয়ে। 

যেভাবে বুঝবেন আপনার সঙ্গী পর্নআসক্ত :

 ১) আপনার স্বামী ধীরে ধীরে অসামাজিক হয়ে পড়বেন। পারিবারিক এবং সামাজিক বিভিন্ন গেট টুগেদার তিনি বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে চলবেন। আপনাকেও তিনি আর আগের মতো সময় দেবেন না। আপনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন না। আপনার মান-অভিমান, সুখ-দুঃখের প্রতি তার তেমন কোনো নজর থাকবে না। 

২) আপনার স্বামীর ইন্টারনেট আসক্তি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যাবে। দিনরাত অনলাইনে পড়ে থাকবেন। কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে তিনি ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে বসবেন। আপনার সাথে বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সাথে স্থির হয়ে দুদণ্ড বসে কথা বলার সময়টুকুও তার হবে না।

 ৩) তার ঘুমের প্যাটার্ন বদলে যাবে। রাতভর অনলাইনে থাকার কারণে সকালে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে উঠবেন। কখনো কখনো এমনো হবে যে, সারা রাত তিনি বিছানায় পিঠ ঠেকাবেন না, “অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত” এসব বলে রাতভর অনলাইনে পড়ে থাকবেন।

 ৪) ব্রাউযারের সার্চ হিস্ট্রি ডিলিট করে দেবেন।

৫) রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় আপনি সাথে থাকলেও, আপনার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি অন্য মেয়েদের শরীর চোখ দিয়ে গিলে খেতে চাইবেন।

 ৬) আইটেম সং, মিউঠিক ভিডিওর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ জন্মাবে। আপনার সামনেই চরম অশ্লীল আইটেম সং দেখতেও দ্বিধাবোধ করবেন না।

 ৭) আপনার স্বামী সম্পূর্ণ এক নতুন দৃষ্টিতে আপনাকে দেখতে শুরু করবেন। আপনার পোশাক-আশাক কেমন হওয়া উচিত, আপনার ফিগার কেমন হলে ভালো হয়, সে সম্পর্কে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেকচার ঝাড়তে থাকবেন। আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করবেন, যে মানুষটার কাছে আপনি ছিলেন দুর্দান্ত রূপসী, অমরাবতীর রাজকন্যা, যে মানুষটা আপনার সবকিছুই পছন্দ করত, আপনাকে নিশিদিন পাগলের মতো ভালোবাসত, সে মানুষটি আজ আপনার চেহারার খুঁত ধরছেন, উঠতে-বসতে অপিনার কাজের ভুল ধরছেন, আপনার সাথে রূঢ় আচরণ করছেন! 

৮) আপনার স্বামী অন্তরঙ্গতার সময় জানোয়ারের মতো হয়ে যাবেন। অ্যানাল সেক্সের মতো হারাম বা ওরাল সেক্সের মতো জঘন্য কাজে আপনাকে বাধ্য করবেন বা করতে চাইবেন। আপনি রাজি না হলে আপনাকে বকাঝকা করবেন বা মারধর করবেন। অনেক সময় এ কাজগুলো করতে আপনাকে বাধ্য করবেন এবং আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে করবেন। অন্তরঙ্গতার সময় আপনার তৃপ্তি-অতৃপ্তির দিকে কোনো খেয়াল রাখবেন না, নিজের তৃপ্তিই তার কাছে শেষ কথা হয়ে দাঁড়াবে। একজন পর্ন-আসক্ত ব্যক্তির স্ত্রী তার স্বামীর সাথে অন্তরঙ্গতার বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে : 

..ওর কাছে আমি রক্ত-মাংসের একজন মানুষ ছিলাম না, ছিলাম একটা ভোগ্য পণ্য। বিছানায় ও আমার সাথে ঠিকমতো প্রেম করত না, যেন বিছানায় শুধু ওর শরীরটাই উপস্থিত, মন থাকত অন্য কোথাও–হয়তো-বা ওর মন পড়ে থাকত সেই পর্ন অভিনেত্রীদের কাছে–যাদের কথা চিন্তা করে সে উত্তেজিত হতে আর তারপর আমার শরীরের ওপরে ঝাল মেটাত…”।

৯) বিছানার অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখতে চাইবেন।

১০) পর্ন-আসক্তির একপর্যায়ে আপনার স্বামী আপনার সঙ্গে অন্তরঙ্গতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। আপনার সঙ্গে একই বিছানা ভাগাভাগি করার চেয়ে তিনি অন্য বিছানায় বা অন্য ঘরে ঘুমুতে আগ্রহী হবেন। অন্তরঙ্গতীর বিশেষ পর্যায়ে তার উত্তেজিত হতে সমস্যা হবে।

১১) আপনার স্বামী তার প্রাইভেসি নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে। তার সঙ্গে কথা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনার স্বামী কী যেন লুকোচ্ছে আপনার কাছ থেকে। নিছক কৌতূহলবশত, “রাত জেগে অনলাইনে কী করো”, “কী লুকোচ্ছো আমার কাছ থেকে”, এ ধরনের প্রশ্নও আপনার স্বামীকে মারাত্মক ক্ষেপিয়ে দেবে। তিনি আপনাকে কটু কথা বলবেন, ঝগড়াঝাঁটি করবেন। 

অগণিত পর্ন-আসক্তদের ওপর গবেষণা করে বিশেষজ্ঞরা এ লক্ষণগুলো চিহ্নিত করেছেন। ওপরের কিছু কিছু লক্ষণ অবশ্য পরকীয়া করেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যেও থাকতে পারে। তবে ৫,৬,৮,৯,১০ নম্বর লক্ষণগুলো থাকলে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারবেন যে, আপনার স্বামী পর্ন-আসক্ত।

 নিজের স্বামী পর্ন-আসক্ত এটা বোঝার পরের ধাপটার ক্ষেত্রেই অধিকাংশ স্ত্রী ভুল করে বসেন। কেউ কেউ একেবারেই পাত্তা দেন না, ভাবেন এটা আবার এমন কী, পুরুষমানুষ এক-আধটু এগুলো দেখতেই পারে, দেখলে তো কোনো সমস্যা নেই। কেউ কেউ আবার প্রচণ্ড রেগে যান, চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, দুনিয়াশুদ্ধ লোকদের জানিয়ে দেন (বিশেষ করে স্বামীকে হাতেনাতে পর্ন দেখা অবস্থায় ধরে ফেললে)। আবার অনেক স্ত্রীই নীরবে চোখের পানি ফেলেন, কাউকেই কিছু বলেন না।

এই লেখায় আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব, আপনার স্বামী পর্ন-অসিক্ত এটা বোঝার পর আপনার করণীয় কী।

 ১) আপনার পর্ন-আসক্ত স্বামীর সঙ্গে তীর পর্ন-আসক্তি নিয়ে কথা বলা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই ধাপে পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। একটু এদিক সেদিক হলে অবস্থা খুবই জটিল হয়ে যাবে। 

খেয়াল করে দেখুন, কখন আপনার স্বামীর মন ভালো আছে, তারপর এমন কোথাও গিয়ে দুজনে বসুন যেখানে আপনারা একান্তে কথা বলতে পারবেন, হতে পারে সেটা বেডরুম কিংবা কোনো পার্কের বেঞ্চ। অথবা কোনো নিরিবিলি সবুজ ফুটপাত, যেখানে দুজনে হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারবেন বেশ কিছুটা দূর। তার চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলুন, আপনি জেনে ফেলেছেন তার পর্ন-আসক্তির কথা, তার পর্ন-আসক্তির কারণে আপনি নিজেকে কতটা তুচ্ছ মনে করেন, আপনার হৃদয়ে প্লীবন নামে অষ্টপ্রহর, তার প্রতিটা স্পর্শে আপনার গা ঘিন ঘিন করে ওঠে; বিস্তারিত বলুন। 

তাকে মনে করিয়ে দিন বিয়ের সেই প্রথম রাতগুলোর কথা যখন পৃথিবীতেই নেমে এসেছিল জান্নাতের সুখ, ঘোমটা খুলে প্রথম চোখে চোখ রাখা, প্রাণভরে দেখা, প্রথম স্পর্শ, প্রথম জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় মুগ্ধ হওয়া। তারপর কত ঝড়ঝাঁপটা এসেছে। দমকা বাতাস লন্ডভন্ড করে দিতে চেয়েছে আপনাদের সাজানো সংসার, আপনারা দুজন দাঁতে দাঁত চেপে, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে গিয়েছেন, জয়ী হয়েছেন। সেই আপনারাই কেন পর্ন-আসক্তির কাছে পরাজিত হবেন? মেয়েদের চোখের পানি পুরুষদের জন্য সহ্য করা খুব কষ্টের। আপনার স্বামীর সাথে কথা বলতে বলতে চোখে পানি আনুন, আপনাদের সন্তান থাকলে তার ভবিষ্যতের কথা আপনার স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দিন। আপনাদের এই কথোপকথনের সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে তিন রকমের।

i) আপনার কাছে ধরা পড়ার আগে থেকেই আপনার স্বামী পর্ন-আসক্তি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। আপনার মুখে কথাগুলো শোনার পরে তিনি প্রচণ্ড ইমোশোনাল হয়ে পড়বেন, লজ্জায় লাল হয়ে যাবেন। কঠোর প্রতিজ্ঞা করবেন আসক্তি কাটানোর।

ii) ধরা পড়ার আগে তিনি পর্ন-আসক্তি কাটানোর ব্যাপারে সিরিয়াস কোনো চিন্তাভাবনা করেননি। কিন্তু আপনার সাথে এ কথোপকথনের পরে পর্ন-আসক্তি ছাড়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করবেন। আপনাকে আশ্বাস দেবেন যে, তিনি আর পর্ন দেখবেন না।

iii) আপনার কথা শুনে রেগে যাবেন। আপনাকে বকাঝকা করবেন। গোঁয়ার গোবিন্দের মতো আচরণ শুরু করবেন। পর্ন দেখার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবেন। আপনার স্বামীর প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। তিন নম্বর প্রতিক্রিয়ার কথা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমরা এখন চিন্তা করব প্রথম দুটি প্রতিক্রিয়া নিয়ে। 

নিজে যেমন পর্ন-আসক্তির ক্ষতিকর দিক নিয়ে পড়াশোনা করবেন ঠিক তেমনই আপনার স্বামীকেও পর্ন-আসক্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। গুগল ঘেঁটে ঘেঁটে আর্টিকেল পড়বেন, ইউটিউবে ভিডিও দেখবেন, বই পড়বেন। পর্ন-আসক্তির ভয়াবহতা সত্যিকার অর্থেই উপলব্ধি করতে পারলে আপনার স্বামীর ভেতর থেকেই একটা তাগাদা আসবে আসক্তি কাটানোর। সেই সাথে আপনারা দুজনেই পর্ন-আসক্তির সাথে লড়াই করার কৌশল সম্পর্কেও ধারণী পাবেন ইন্টারনেট বা বইপত্র ঘেঁটে।

২) এর পরের ধাপ নিজেদের জন্য একজন কাউন্সেলর ঠিক করে নেয়া। কাউন্সেলর হতে পারেন মসজিদের ইমাম সাহেব, দুজনেরই কাছের কোনো বিশ্বস্ত বয়স্ক মুরুব্বি, কোনো মনোবিদ বা কোনো যৌন-বিশেষজ্ঞ। আপনার স্বামীর পর্ন-আসক্তি কোন পর্যায়ের, মানে তিনি কি অল্প কিছুদিন হলো পর্ন দেখা শুরু করেছেন এবং এখন আসক্তির প্রথম পর্যায়ে আছেন, সফটকোর পর্ন দেখেন নাকি হার্ডকোর পর্ন ছাড়া চলেই না, অল্প কিছুদিন নাকি দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মক রকমের পর্ন-আসক্ত, এ। সবকিছু চিন্তা করেই কাউন্সেলর ঠিক করতে হবে। মনে রাখবেন, কাউন্সেলরের সাহায্য নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ একটি মাত্র কাজে অবহেলার কারণে পর্ন-আসক্তি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হওয়ার নজির আছে ভূরি ভূরি।

৩) পরের ধাপটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের খুঁজে বের করতে হবে কেন আপনার স্বামী পর্ন ভিডিও দেখছেন, কী আপনার স্বামীর জন্য পর্ন দেখার ট্রিগার হিসেবে কাজ করছে। হতে পারে,

 i) তিনি বিয়ের অনেক আগে থেকেই পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।

ii) বিয়ের পরে ইন্টারনেট ব্রাউয করতে করতে কৌতূহলবশত পর্ন ভিডিও দেখেছেন দু-একবার, তারপর ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়েছেন।

 iii) কোনো বন্ধুর মাধ্যমে।

 iv) ইরোটিক মুভি, আইটেম সং দেখার নেশা থেকে আরও কড়া পর্ন ভিডিওতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন।

v) চারপাশের যৌনতা-তাড়িত পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।

vi) যৌন অতৃপ্তি থেকে।

 vii) মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য। এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। স্বামীর পর্ন-আসক্তির জন্য নিজেকে কখনোই দোষারোপ করবেন না। তারপরেও একটু চিন্তা করে দেখুন তো, এমন কিছু কি আপনাদের মধ্যে ঘটেছে যেটা আপনার স্বামীর সঙ্গে আপনার দুরত্ব বাড়িয়েছে, আপনাদের সম্পর্কে তৈরি করেছে। শূন্যতা? আর এই শূন্যতা তিনি পূরণ করছেন পর্ন ভিডিও দিয়ে? যৌনতা-তাড়িত এ সমাজে সবকিছুই একজন মানুষকে অবাধ, বিকৃত যৌনতার হাতছানি দেয়। মনে করুন আপনার স্বামী সারাদিন অফিসে কাজ করে বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফিরলেন, কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের পথচারিণী, বিলবোর্ড, দোকানের সাইনবোর্ড সবকিছুই তার ভেতরে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। তার এই শূন্যতা পূরণ করতে পারতেন আপনি নিজে। আপনার সাথে দুটো কথা, আপনার মিষ্টি মুখ, মিষ্টি মুখের এক চিলতে হাসি, হালকা খুনসুটি আপনার স্বামীর বুকের বিশাল শূন্যতা ভরিয়ে দিত জান্নাতী সুখে। কিন্তু দেখা গেল আপনার স্বামী বাসায় ফিরে আপনাকে কাছেই পেল না, আপনি হয়তো তখন বাসাতেই নেই, ঘরের বাইরে আপনার কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত। অথবা আপনি বাসাতে আছেন, কিন্তু আপনার স্বামীর সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বললেন না, ঘরের কাজের চাপে আপনি। এলোমেলো, অগোছালো চেহারা এবং বিরক্তি নিয়ে আসলেন আপনার স্বামীর সামনে। অথবা ঘরে ঢোকার পরেই খ্যাঁক খ্যাঁক শুরু করে দিলেন, “এটা আনতে বলেছিলাম কেন আনোনি? আর কয়বার বলতে হবে? মিনসে, আজ তোমারই একদিন না হলে আমারই একদিন!” আপনার স্বামীর বুকের ভেতরের শূন্যতার বিস্তৃতি আরও কিছুটা বাড়ে। অনলাইনে সারফিং শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে পর্ন-আসক্তি। নাটক-সিনেমার কল্যাণে এখন “কেয়ারিং ওয়াইফের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। স্বামীর সব ব্যাপারে খবরদারি করা, “এটা কেন করলে, ওটা কেন করলে না, ওর সঙ্গে কেন মিশলে…” এই ধরনের প্রশ্নবাণে বেচারা স্বামীকে সব সময় তটস্থ করে রাখা স্ত্রীকে এখন বলা হচ্ছে “কেয়ারিং ওয়াইফ”। কোনো পুরুষ, সত্যিকারের পুরুষ স্ত্রীকে নিজের “বস” এর ভূমিকায় দেখতে চায় না। এ কাজগুলো কত অজস্র স্বামীদের মন বিষিয়ে তোলে, ধীরে ধীরে স্ত্রীর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়, পরকীয়া, পর্ন-আসক্তির সূচনা হয় তা আমরা বুঝতে পারছি না! আপনার স্বামীকে চোখের হেফাযতের গুরুত্বের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে থাকুন। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় সিনেমা, নাটক দেখা ধীরে ধীরে কমাতে শুরু করুন এবং একপর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে এগুলো থেকে আপনার স্বামীকে দূরে থাকতে বলুন। 

অবসর খুব ভালোমতো কাজে লাগাতে হবে। ছুটির দিনগুলোতে মুভি, নাটক দেখা, ফেইসবুকিং, ইউটিউবে সারফিং করা বাদ দিয়ে নিজেদের মতো করে একান্ত সময় কাটান। অনুভব করুন আরও কতটা ভালোবাসা বাকি রয়ে গেছে আপনাদের দুজনের ভেতরে, সেই ভালোবাসাগুলো বেসে ফেলুন, বাইরে ঘুরতে যান, ফুটপাত ধরে হাঁটুন যতক্ষণ ক্লান্ত না হন, রিকশীয় বৃষ্টিবিলাস করুন (পর্দা মেইনটেইন করে)। জীবনের টানাপোড়নে অপিনাদের মধ্যে যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল কমে যাবে তার অনেকটাই। আপনার স্বামীর জন্য সুন্দর করে সাজুন। রাস্তাঘাট, কর্মক্ষেত্রে নারীদেহের প্রদর্শনী দেখে দেখে তিনি বিষাক্ত মন নিয়ে ঘরে ফেরেন। আপনি অগোছালো হয়ে থাকলে সেই বিষাক্ত মন আরও বিষাক্ত হয়ে যায়, আপনার প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে। পরকীয়ার সূত্রপাত যেমন হয় তেমনই পর্ন দেখার প্রবণতাও বাড়তে থাকে। কুড়ি পেরোলেই বাঙালি মেয়েরা কেমন যেন বুড়িয়ে যায়। নিজের শরীর ফিট রাখুন। বিয়ের প্রথম সময়ে দুজনের চোখে মুগ্ধতার যে ঘোর লেগে থাকে বিয়ের পর কিছুটা সময় পার হলে তা কেটে যায় বাস্তবতার আঁচড়ে। আমরা কেউই স্বীকার করি না, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনার শরীর বেঢপ আকৃতির হয়ে গেলে আপনার স্বামীর আপনার প্রতি দৈহিক আকর্ষণ কমে যাবে। ভালোবাসা, মায়া মমতা হয়তো আগের মতোই থাকে, কিন্তু দৈহিক আকর্ষণ নিশ্চিতভাবেই কমে যায়। এই ফাঁকা জায়গাটুকু দখল করে নেয় পরকীয়া কিংবা পর্ন-আসক্তি। আপনার স্বামীর দৈহিক চাহিদা মিটছে কি না, তিনি একান্তভাবে আপনাকে তার প্রয়োজনমতো কাছে পাচ্ছেন কি না সেদিকে খেয়াল রাখুন। অন্তরঙ্গতার সময় আপনার স্বামীকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করুন। মাথায় রাখতে হবে, অন্তরঙ্গতার সময় স্বামীকে সাহায্য করার মানে এই না যে, তিনি অন্তরঙ্গতার সময় অ্যানাল সেক্স, ওরাল সেক্স করতে বললেও বা পর্নের নায়িকাদের মতো বিকৃত কাজ করতে বললেও আপনি সেটাই করবেন। শরীর ফিট রাখার মানে এই নয় যে, আপনাকে পর্নস্টারদের মতো হতে হবে। সমস্যাটা আপনার স্বামীর, আপনার না। আপনি আপনার নিজের জীবনকে নষ্ট করবেন। কেন? হারাম-হালালের সীমার মধ্য থেকে যতটুকু করা সম্ভব আপনি ততটুকুই করবেন। এর বেশি কিছু না। একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার। আপনার স্বামীর পর্ন দেখার জন্য আপনি দায়ী না। আপনি যা-ই করুন, যদি কোনো অপরাধও করে ফেলেন, তবুও সেটা আপনার স্বামীর পর্ন-আসক্তিকে জাস্টিফাই করে না। কিন্তু একজন মুসলিম নারী ও স্ত্রী হিসেবে, স্বামীর সংশোধনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা আপনার দায়িত্ব। পশ্চিমা ফেমিনিস্ট দর্শন দ্বারা যাদের চিন্তা কলুষিত তাদের কাছে হয়তো আমাদের অনেক কথাই ভালো লাগবে না, কিন্তু এ সমাধানগুলো তাদের জন্য না। এ সমাধানগুলো এবং এ বই ইসলামের অবস্থান থেকে, মুসলিম হিসাবে। মুসলিমদের জন্য বলা।

৪) আপনার স্বামীকে টার্গেট সেট করে দিন, “আগামী এক সপ্তাহ তুমি পর্ন দেখবে না…” এক সপ্তাহ পার হলে আবার নতুন টার্গেট দিন। এবার দু-সপ্তাহ। এভাবে চলতে থাকবে। প্রত্যেকবার টার্গেট পূরণ করতে পারলে তাকে পুরস্কৃত করুন, সেটা হতে পারে তার জন্য আপনার সুন্দর করে সাজা, কোনো উপহার দেয় অথবা তার পছন্দের কোনো খাবার রান্না করা; কথায় আছে The only way to the heart is through the stomach!

৫) আপনার স্বামী টার্গেট পূরণ করতে না পারলে তার সঙ্গে রাগারাগি করবেন না। তাঁকে সাহস দিন, প্রেরণা জোগান। পুরুষের জন্য নারী যে কত বড় প্রেরণার উৎস। তী নারীরা মনে হয় না কোনো দিন বুঝবে!

৬) আপনার স্বামী তার পর্ন-আসক্তি কাটানোর ব্যাপারে আন্তরিক, এটা যদি আপনি বুঝতে পারেন তাহলে আপনার স্বামীকে সময় দিন। তিনি বার বার ব্যর্থ হলেও তার সঙ্গে ধৈর্য ধরে লেগে থাকুন। কিন্তু আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনার স্বামী পর্ন-আসক্তি কাটানোর ব্যাপারে একেবারেই আন্তরিক না, তিনি আপনার আবেগ নিয়ে খেলছেন তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আপনিও তার আবেগ নিয়ে খেলুন। কান্নার বন্যা বইয়ে দিন, সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দিন, রান্না করা বন্ধ করুন; ভাতে মারুন, পানিতে মারুন, শরীরে মারুন।

৭) আপনার স্বামীকে পর্ন দেখী অবস্থায় দেখলে ঠিক তখনই কিছু বলার দরকার নেই। এ সময় তার থেকে দূরে থাকাই ভালো। তিনি এ সময় স্বাভাবিক অবস্থাতে থাকেন না, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই পরে যেকোনো একসময় এটা নিয়ে আলাপ করবেন।

৮) পিসি বা ফোনে পর্নসাইট ব্লক করার সফটওয়্যার বা অ্যাপস ইন্সটল করা অত্যন্ত জরুরি। এই ওয়েবসাইট বা অ্যাপসগুলো আপনার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করেই ইন্সটল করতে হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য নয়। আপনার স্বামীর সঙ্গে কোনোরকম পূর্ব আলোচনা ছাড়াই এগুলো ইন্সটল করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনা পাবেন “বিষে বিষক্ষয়” প্রবন্ধে। ইন্সটল করতে সমস্যা হলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সঙ্কোচবোধ করবেন না।

৯) বাসায় পারতপক্ষে কাজের মেয়ে রাখবেন না, যেসব নারীদের সাথে আপনার স্বামীর বিয়ে হালাল, যাদের সঙ্গে আপনার স্বামীকে পর্দা মেইনটেইন করতে হবে, তাদের ব্যাপারে আপনার স্বামীকে বার বার নাসীহাহ দিতে হবে। আপনার স্বামীকে পর্দার গুরুত্ব মনে করিয়ে দিতে হবে নিয়মিত।

১০) প্রচুর পরিমাণে দু’আ করতে হবে দুজনে মিলে। দান-সাদকাহ করতে হবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।

 ১১) আপনার সন্তানদের তাদের বাবার কাছ থেকে যতটা পারা যায় দূরে রাখতে হবে। অনেক অনেক মানুষের পর্নোগ্রাফির সাথে পরিচয় ঘটে তাদের বাবাদের পর্ন আসক্তির সূত্রে। 

১২) আপনার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও যদি আপনার স্বামী পর্ন-আসক্তি কাটানোর ব্যাপারে আন্তরিক না হন, বার বার আপনার সঙ্গে প্রতারণা করেন, বার বার সুযোগ দেয়ার পরও তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে আপনাকে আপনাদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একা একা কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, আপনার কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলুন, মুরুব্বিদের সঙ্গে আলোচনা করুন। কোনো কিছু লুকোনোর দরকার নেই। তারপর সবাই মিলে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন, তার আগে অবশ্যই কোনো আলিমের সাথে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে হবে, আর অবশ্যই ইস্তেখারার২৬৬ সালাত আদায় করে নিতে হবে। এবার আবার প্রথম ধাপে ফিরে যাই। পর্ন-আসক্তি নিয়ে কথা শুরু করলে আপনার স্বামী যদি রাগারাগি করেন, তাহলে ওকে কিছুটা সময় দিন। তারপর আবার বলুন। পর্ন-আসক্তির ভয়াবহতা বুঝিয়ে বলুন। আবেগ নিয়ে খেলুন, সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি দিন, তিনি একসময় বুঝবেন ইন শা আল্লাহ্। তারপর ধাপে ধাপে ২ থেকে শুরু করে পরে টিপসগুলো অনুসরণ করুন। কোনোমতেই আপনার স্বামীকে বোঝাতে না পারলে, কোন কিছুতেই কাজ না হলে মুরব্বিদের সাথে কথা বলে, আলিমদের কাছ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে পরামর্শ নিন।