ও যখন ডাকে
[Robert Bloch এর লেখা Enoch গল্পটির অনুবাদ]
ব্যাপারটা সচরাচর এইভাবেই আরম্ভ হয়।
প্রথমটা শুরু হয় মাথার ভেতরে কারও একটা হেঁটেচলে বেড়াবার অনুভূতি দিয়ে। মনে হয় কে যেন শীতল ধাতব পায়ে খুলির ওপরে হাঁটছে। ওঠানামাটা শুরু হয় অবশ্য ঘাড়ের কাছ থেকে। তারপর দু-খানা ছোটো ছোটো পা মাথার মধ্যে এদিক থেকে ওদিক চলেফিরে বেড়াতে থাকে। অস্বস্তিটা বাড়তে বাড়তে অসহ্য হলে আমি মাথার চুলগুলো আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে থাকি। ভাবি এই বুঝি ধরতে পারব ওকে।
কিন্তু না। ও খুব চালাক, আর সেরকমই ধূর্ত ওর গতিবিধি। অনায়াসে আমার মুঠির নাগাল এড়িয়ে ও নেমে আসে আমার ঘাড়ের কাছে।
আর কথা বলে। ফিসফিস করে। আমার কানের মধ্যে ভাবছেন আমি মিথ্যে কথা বলছি? আমিও তাই ভাবতাম, যদি না ঘাড়ের কাছে ওর ধারালো নখের আঁচড়গুলো বুঝতে পারতাম। প্রথমে মনে হয় বরফের ছোটো ছোটো ছুরির মতো আঙুল দিয়ে কে যেন আমার কানের পাশের চামড়াগুলো খিমচে দিচ্ছে। এতই শীতল সেই আঙুল, আর এতই ধারালো সেই নখ, যে প্রথমে মনে হয় আমার ঘাড়ে আর মাথায় কোনো সাড় নেই। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে একটা জ্বলুনিভাব ফিরে আসতে থাকে ওখানে। তখন আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হয়। আর বুঝতে পারি যে ও আবার কিছু একটা বলবে আমাকে।
বলবে ধীরে ধীরে, প্রায় না শোনার মতোই। আর আস্তে আস্তে সেই স্বর আমাকে গ্রাস করে ফেলবে। এতই অমোঘ সেই স্বর যে আমি তার হাত এড়াতে পারি না, সে যেন আমার মাথার মধ্যে এক মসৃণ, হিমশীতল জাল বুনে চলে।
আর তখন আমি বুঝতে পারি, ফের সেই সময় এসেছে।
লোকে আমাকে পাগল ভাবে। শুধু পাগল নয়, বদ্ধ উন্মাদ। সেইজন্যই আমি জলাভূমির লাগোয়া ঘরটা ছেড়ে রাস্তায় প্রায় বেরোই না। অবশ্য লোকের কথায় আমি যে খুব কেয়ার করি, তা নয়। কারণ আমি জানি এই লোকগুলো আমার কেউ না। এদের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এই জায়গাটাই আমার নয়। আমি আসলে অন্য দুনিয়ার লোক। ওর দুনিয়া।
এই পৃথিবীর বাইরে যে দুনিয়াটা আছে, ওর কথা শুনলে সেখানে আমাকে নিয়ে যায় ও। আমাকে রাজা করে দেয় কয়েকদিনের জন্য। সেখানে আমার ইচ্ছেই সব। সেখানে ও আমার গলায় ঢেলে দেয় দামি মদ, ভোগ করার জন্য এনে দেয় সুন্দরী বেশ্যাদের। আমি তাদের ঊরুসন্ধিতে রক্তের মতো লাল মদ ঢেলে চেটে চেটে খাই। তখন এই দুনিয়াটা ফালতু মনে হয়। তখন মনে হয় এই নোংরা পৃথিবীতে যা যা করছি সব মিথ্যে। এমনকি খুন করাটাও।
কী, চমকে উঠলেন নাকি?
হ্যাঁ, খুন। আমি খুন করি। ও আমাকে দিয়ে খুন করায়। ঘাড়ের কাছে ফিশফিশ করে ও আমাকে বলে সে ওর রক্ত চাই। আর তার বদলে… সে তো বললামই।
এমনটা নয় যে আমি স্বেচ্ছায় কাজটা করি। প্রথমে আমি প্রবল আপত্তি জানাই। নিজেই নিজের মাথার চুল ধরে ঝাঁকাতে থাকি। তারপর ধরার চেষ্টা করি ওকে, নিজের নখগুলো গেঁথে দিই চামড়ার ভেতরে। ফালাফালা করে দিই নিজের গাল। জুলপি বেয়ে নেমে আসে রক্তের স্রোত।
কিন্তু না, আজ অবধি নাগাল পাইনি ওর। ও আমার পাগলামি দেখে খিলখিল করে হাসে। আমি আমার মাথার ভেতর সেই হাসি শুনতে পাই। তারপর যখন ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকি, চোখায় কোনায় রক্ত জমে আসে, তখন ও কথা বলতে শুরু করে।
তারপর আমি শান্ত হয়ে যাই। একদম শান্ত। আমার মাথার ভেতরে ওর কথাগুলো কোকেনের নেশার মতোই ছড়িয়ে পড়ে। আমার কোনো উপায় থাকে না ওর কথা শোনা ছাড়া।
কথা মানে রক্তের কথা। খুন করার কথা।
তাই বলে সবসময় যে ও আমাকে খুন করতে বলে তা নয়। ধরুন বেশ কয়েকদিন হয়তো ওর পাত্তাই নেই। আমি বাইরে যাই, চলেফিরে বেড়াই। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া বেওয়ারিশ বেড়ালের বাচ্চা গলা টিপে মারি, স্মিথের দোকান থেকে শুকনো রুটি আর মুরগির স্যুপ কিনে খাই। ভাবি এইবার বোধহয় ও আর আসবে না।
আর ঠিক তখনই ও আসে। আর ব্যাপারটা সচরাচর ঠিক এইভাবেই শুরু হয়।
ও ডাকে আমাকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “একটা ভবঘুরে। এলসওয়র্থ রোড দিয়ে হাঁটছে। বেঁটে, মোটা, মাথায় টাক। ওর নাম মাইক। পরনে বাদামি সোয়েটার আর নীল রঙের কোট। সূর্য ডুবে যাওয়ার ঠিক দশ মিনিট বাদে ও এই জলাভূমির দিকে আসবে। ময়লার গাদাটার পাশে যে গাছটা আছে, তার নীচে দাঁড়াবে। ঠিক দশ মিনিট। গলার কাছটায়, ঠিক গলার কাছটায়….”
আর আমি আমার বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী, ছ-ইঞ্চির মাংস কাটার ছুরিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মাথার মধ্যে টিকটিক করতে থাকে, দশ মিনিট, ন মিনিট, আট মিনিট…
আর ও আমার মাথার মধ্যে ফিসফিসিয়ে বলে যেতে থাকে, “গাছের আড়ালে যাও। এইবার, এইবার, ওকে নীচু হতে দাও। ঝাঁপাও, ঝাঁপিয়ে পড়ো….”
আমি জানি ওর কখনও ভুল হয় না। এই ডাক অমোঘ, অব্যর্থ। আমি জানি ও আমাকে কখনও বিপদে ফেলবে না। ফেলতে পারে না। ও আজ অবধি আমাকে কোনোদিন বিপদে ফেলেনি।
শুধু এবারেরটা ছাড়া।
সেদিন আমার ঘরে বসে রাতের খাওয়ার সারছি, এমন সময় ও এল।
“একটা মেয়ে এদিকেই আসছে। তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে। কালো রঙের পোশাক। ভালো দেখতে। গাড়ি নিয়ে শহরে যাচ্ছিল। এই রাস্তাটা নিয়েছিল শর্টকাট হবে বলে। গাড়ির টায়ার ফেঁসে গেছে। তোমার সাহায্য চাইবে। ও আসছে।”
আমার শরীর টানটান হয়ে গেল। মাথার মধ্যে তখনও বলে চলেছে ও, “তোমার সাহায্য চাইবে মেয়েটা। তুমি যাবে। ছুরিটা সাবধানে নিও। খুনটা কিন্তু ছুরি দিয়ে করবে না। গাড়িতে একটা রেঞ্চ আছে। ওটা দিয়েই…
“না,” আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলাম এবার, “আমি পারব না, পারব না।”
সেই সরু খিলখিলে হাসিটা ভেসে এল, “তুমি করবে না? তাহলে তো আমাকেই করতে হবে। তুমি কী চাও আমি করি? নাকি তোমাকেই….”
“না, না”, আমি আর্তচিৎকার করে উঠি, “করব, আমি করব। যা বলবে তাই করব।”
“কী করব বল?” চুক চুক করে ও, “আমার যে দরকার হয়। আমার যে খিদে পায়। না খেলে দুর্বল হয়ে পড়ব না? আর আমি দুর্বল হয়ে পড়লে তোমার জন্যে কে এনে দেবে মদ? কে তোমার বিছানায় এনে দেবে সুন্দরী মেয়েদের? তুমি কি চাও না ওসব?”
“করছি, আঃ!” সজোরে নিজের মাথা চেপে ধরি আমি, “চুপ করো, চুপ করো। বলছি তো আমি করছি, করছি।”
ঠিক তক্ষুনি দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করে কেউ। বুঝলাম, সে এসেছে।
একে মেয়েটাকে মারকাটারি সুন্দর দেখতে, তার ওপর একমাথা সোনালি চুল। আমার আবার সোনালি চুল খুব পছন্দ, তাই রেঞ্চটা মেয়েটার মাথায় মারিনি, যদি রক্তে অমন সুন্দর চুল নষ্ট হয়ে যায়?
আঘাতটা করলাম ঘাড়ে। একবারই যথেষ্ট ছিল। মেয়েটা আওয়াজ করার সময়ই পায়নি।
বডি কোথায় লুকোতে হবে সেটা অবশ্য বেশি ভাবতে হয় না আমাকে। প্রথম বারে খুন করার সময়েই ও দেখিয়ে দিয়েছিল চোরাবালিটা, এবারেও তাই। এমনকি পায়ের ছাপ মুছে ফেলার বুদ্ধিটাও ওরই।
মুশকিল হচ্ছিল গাড়িটা নিয়ে। শেষে ওর কথামতোই একটা পাইন গাছের লজ্ঝড়ে গুঁড়ি দিয়ে গাড়িটাকে চোরাবালিটায় ফেললাম। এটা বরঞ্চ মেয়েটার থেকে তাড়াতাড়ি ডুবল। গাড়িটার শেষ চিহ্নটুকু মুছে যেতেই রেঞ্চটারও একই গতি করলাম।
সব শেষ করে যখন বেশ নির্ভার হয়ে ঘুমোতে যাচ্ছি, তখন বুঝলাম যে ও নেই, মাথা থেকে নেমে গেছে। জলাটার দিকেই গেছে নিশ্চিত। ভাবতে ভাবতেই গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। যাক, দিনকয়েকের জন্য ওর হাত থেকে মুক্তি।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। যখন জেগে উঠছি, বুঝতে পারলাম যে ও আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে। একবার খিদে মেটাবার পর সচরাচর দিন কয়েক ও আমার ধারেকাছে ঘেঁষে না। তাই বুঝলাম কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে কোথাও।
তারপরেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম। কে যেন আমার দরজা ধাক্কাচ্ছে জোরে জোরে।
বুঝতে পারছিলাম না এখন আমার কী করা উচিত। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর ওই আমার কানে কানে বলে দেয় কী করতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে ও এখন চুপ। অনেক বার ডেকেও ওর কোনো সাড়া পেলাম না।
এদিকে দরজাটার ওপর গুম গুম আওয়াজটা বেড়েই যাচ্ছিল। আর থাকতে না পেরে আমি গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম।
বাইরে দাঁড়িয়ে এই শহরের শেরিফ, বুড়ো শেলবি!
“ওঠ রে সেথ, তোর খেলা এবার শেষ। চুপচাপ আমার সঙ্গে আয়।” বিনা ভূমিকায় কথাটা বলে আমার ঘরের কোণায় কোণায় ইতিউতি তাকাতে শুরু করল লোকটা। মনে হল যেন তন্নতন্ন করে কী একটা খোঁজার চেষ্টা করছে ও।
আমার পা দুটো কে যেন মাটিতে গেঁথে দিয়েছিল, মাথাটা ভোঁ ভাঁ করতে শুরু করে। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিল একটা চিনচিনে আতঙ্কের স্রোত। প্রথমে ভয় হল, শেরিফ ওকে দেখতে পাচ্ছে না তো? পরমুহূর্তেই অবশ্য আমার ভুল ভাঙে। আমিই ওকে দেখতে পাইনি আজ অবধি, শেরিফ কী করে পারবে? তবে বুঝতে পারছিলাম যে ও আছে। আমার ব্রহ্মতালুর ঠিক নীচে। রক্তমাংস আর শিরার ওমে মজাসে ঘুমিয়ে আছে ব্যাটা। মাথার চুলে একটা আলতো টানও অনুভব করছিলাম যেন।
“এমিলি রবিন্স”, ঠান্ডা গলায় বলল শেরিফ শেলবি, “প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী হাইওয়ে ছেড়ে এই জলার ধার দিয়ে আসছিল, শর্টকাট হবে বলে।” বলে থামল বুড়ো লোকটা, তারপর কুতকুতে চোখ দুটো আমার চোখে রেখে বলল, “টায়ারের দাগ বলছে মহিলা এদিকে এই জলার দিকেই এসেছিলেন। তারপর?”
ইস্, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে দেখছি! টায়ারের দাগটা মোছার কথা মাথাতেই আসেনি। এটা বোধহয় ও-ও ভাবেনি যে বুড়ো শেলবি টায়ারের দাগ ধরে এতদূর চলে আসবে। কুকুরের মতো নাক লোকটার!
“যা বলবি ভেবেচিন্তে বলবি। কারণ মনে রাখিস, আইন মোতাবেক কিন্তু তোর কথা তোর বিরুদ্ধেই আদালতে ব্যবহার করা হতে পারে।” আমার হাতে হাতকড়া পরাতে পরাতে বলল বুড়ো শেলবি। “চল এখন। তোর কপালে বিস্তর দুঃখ আছে দেখছি।”
পুলিশের গাড়িটা জলার বাইরে রাস্তার ওপর রাখা ছিল। গাড়িটা যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, দেখি রাস্তার পাশে লোকজন ভিড় করে আছে। তাদের চোখে যেটা দেখলাম সেটাকে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বখাটে ছেলেরা খিস্তি করতে শুরু করল, কয়েকজন আবার সবাইকে উসকাচ্ছিল, যাতে আমাকে টেনে বার করে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়।
তবে শেলবি শক্ত লোক। সে ঠিক আমাকে এদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনে শহরের থানার ভেতরে একটা সেলে পুরে দিল। থানায় তিনটে সেল থাকলে কী হবে, বাকি দুটো খালি। ফলে এখন আর কেউ রইল না আমার সঙ্গে।
শুধু একজন ছাড়া। ও।
আমি ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, এই যে এত কাণ্ড ঘটে গেল, এর মধ্যে কিন্তু একটিবারের জন্যও ও জাগেনি। ওর যেন কোনো আগ্রহই নেই এই ব্যাপারে। আমার মাথার ভেতরে, রক্তমাংস আর স্নায়ুর মধ্যে একটা ডেলার মতো শুয়ে ছিল ও। নির্জীব, নিস্পন্দ।
তখন সবে সকালটা শুরু হয়েছে। শেরিফ শেলবি আরও কয়েকজনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জলার দিকে। বোঝাই যাচ্ছিল যে ওরা জলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে। যদি চোরাবালি থেকে মেয়েটার বডি পায় ওরা, তাহলে আমার যে কী হবে ভেবে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।
যে হাবিলদারটা আমাকে সকালের খাবার দিতে এল তাকে আমি চিনি। ওর নাম চার্লি পটার। বুড়ো শেলবি ওকেই এই জেলখানার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। ছোকরাকে আমার কোনোদিনই খুব একটা খারাপ লাগেনি। তবে বড়ো বেশি প্রশ্ন করছিল বলে বিরক্ত লাগছিল খুব। বলা বাহুল্য ওর বকবকানির উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই বোধ করিনি। কারণ আমি জানি যে আমি যা বলব তার একবর্ণও ও বিশ্বাস করবে না। উলটে আমাকে পাগল ঠাওরাবে। যেমন থানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমাকে ক্রমাগত খিস্তি করে যাওয়া লোকগুলো আমাকে পাগল ভাবে। যেমন আমার মাকেও ওরা পাগল ভাবত, জলার ডাইনি বলে ডাকত!
চার্লিকে দেখে অবশ্য মনে হল না আমার চুপচাপ থাকাটা ও লক্ষ করেছে বলে। ও বলেই যেতে থাকল, শেরিফ শেলবির মত হচ্ছে এমিলি রবিন্সের কেসটার সঙ্গে আরও বেশ কিছু লোকের উধাও হওয়ার একটা যোগসূত্র আছেই। ওর মতে, একটা বেশ বড়োসড়ো কেসে আমি ফাঁসতে চলেছি। কারণ ইতিমধ্যেই নাকি জেলার সরকারি উকিলকে এত্তেলা দেওয়া হয়েছে আমাকে জেরা করার জন্য। এমনকি একজন ডাক্তারকেও নাকি ডাকা হয়েছে আমাকে পরীক্ষা করে দেখবে বলে।
বলতেই বলতেই ডাক্তার সাহেব দর্শন দিলেন। দেখে মনে হল থানার বাইরে আমার মুণ্ডু চেয়ে স্লোগান দেওয়া বজ্জাতগুলোর ভিড় সরিয়ে এতদূর আসতে ভদ্রলোককে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। উনি এসেই অবশ্য একটা ভালো কাজ করলেন, বকবকে চার্লিকে বললেন থানার সামনে গিয়ে ভিড় সামলাতে।
ডাক্তারবাবুকে অবশ্য আমি ভালো করেই চিনি। ডক্টর সিলভার স্মিথ তাদের মধ্যে একজন যারা আমার মা প্রথমবার ধরা পড়ার পর আমাকে অনাথাশ্রমে পাঠাতে চেয়েছিলেন। মানুষটি আকারে ছোটোখাটো, থুতনিতে সাদা কালো ছাগুলে দাড়ি। আমাকে দেখেই প্রথম প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক, “তোমার মা এখনও বেঁচে আছে? এখনও ওইসব করে বেড়াচ্ছে?”
শুনে কেমন যেন মনে হল লোকটা বেশ ভালো, ভরসাযোগ্য। এ আমাকে চেনে, আমার মাকে চেনে। এমনকি আমার মা কী কী করত সেসবও জানে। একে সব কথা খুলে বলাই যায়, তাই না?
ফলে আমার পক্ষে আর লোকটাকে সবকিছু খুলে বলার ক্ষেত্রে কোনো বাধাই রইল না। সব কিছু বেশ গুছিয়েই বললাম ছাগলদেড়েটাকে। আমার কথা, আমার মায়ের কথা, মায়ের ওই তুকতাক, জড়িবুটি এসবগুলোর কথা। মায়ের বিছানায় নীচে রাখা ছেঁড়াখোঁড়া বইগুলোর কথা, তাকের ওপর রাখা শিশি-বোতলগুলোর কথা।
এমনকি অমাবস্যার রাতে মা যে আমাদের কুঁড়েঘরটা ছেড়ে জলার পাশের জঙ্গলটায় চলে যেত, আর সেখান থেকে অদ্ভুত সব সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসত, সেসব কথাও খুলে বললাম ডাক্তারটাকে।
অবশ্য এতকিছু বলার দরকার ছিল না। আমার মাকে লোকে ডাকত জলার ডাইনিবুড়ি বলে। ফলে মায়ের ব্যাপারে অনেকেই অনেক কিছু জানত। এমনকি স্যান্টো ডিনোরেলির কুমারী মেয়ে যে মায়ের দেওয়া ওষুধ খেয়ে পেট খসাতে গিয়ে মরে যায়, আর সেই রাগে স্যান্টো আমার মাকে আমার সামনেই কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে, সে কথাটাও জানত ডাক্তার। তারপর থেকে আমি যে ওই কুঁড়েঘরে একা একাই থাকি, সেটাও।
ফলে একবার ভাবলাম লোকটাকে ওর ব্যাপারে ও সবকিছু খুলে বলব কি না। মানে বলাটা ঠিক হবে কি না। তারপর আগুপিছু ভেবে সবকিছু খুলে বলাই সাব্যস্ত করলাম। সবকিছু বলতে এই যে আমি খুন-টুন করি, মানে সেসবই যে আসলে ওই করে, অর্থাৎ কি না ও আমাকে দিয়ে করায়, এসবই। এমনকি মা যেদিন আমার জন্য ওকে কিনতে গেছিল সেদিনকার কথাও। সেদিনের পুরো ব্যাপারটা অবশ্য ভালো বলতে পারলাম না। কারণ জঙ্গলে যাওয়ার সময় মা সঙ্গে নেয়নি আমাকে। শুধু একটা জিনিসই নিয়ে গেছিল মা।
আমার রক্ত। একটা ছোটো শিশিতে।
মা সেদিন একা ফেরেনি। আর-একজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছিল।
ওকে নিয়ে।
আসার পর মা আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল যে, এবার থেকে ওই আমার দেখভাল করবে, যা চাই তাই এনে দেবে, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে।
মা বোধহয় সেই রাতে বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা। কারণ পরের দিন সকালেই স্যান্টো আমাদের কুঁড়েঘরে হানা দেয়। তারপর একটা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে… ও… তারপরের ব্যাপারটা তো জানেনই আপনারা।
আমি ডাক্তার স্মিথকে ওর ব্যাপারটা খোলাখুলিই বললাম। এতদিন ধরে ও আমাকে কীভাবে আগলে আগলে রেখেছে, আমাকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে এসেছে, এমনকি প্রতিটা খুন করার সময় কী করে আমাকে ও সবদিক দেখেশুনে কাজ করতে শিখিয়েছে। মা যেমন ভেবেছিল, ঠিক তেমনই। কথাটা বলতে বলতে আমার বেশ হালকাই লাগছিল। হাজার হোক ডাক্তার সিলভার স্মিথ মান্যগণ্য লোক, ব্যাপারটা বুঝবেন নিশ্চয়ই।
কিন্তু কথাগুলো বলা শেষ করে লোকটার চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। লোকটার ধূর্ত চোখ দুটো আমার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেই দৃষ্টিতে অবিশ্বাস ছাড়া কিছুই ছিল না। বুঝতে পারলাম যে এতক্ষণ ধরে যা যা ভেবেছি লোকটার ব্যাপারে, সব ভুল।
আমি থেমে যেতেই লোকটা যতসব অদ্ভুত প্রশ্ন করতে শুরু করল। যেমন ও কোথায় থাকে। যদি ওকে দেখতেই না পাই তবে ওর কথা শুনতে পাই কী করে। মাঝেমাঝেই আমি এইরকম অদৃশ্য বাণী-টানী শুনতে পাই কি না। এমনকি এমিলি রবিন্সকে খুন করার সময়… না না ওসব কথা আমি বলব না, একদম না। আমি কি পাগল নাকি?
তবে লোকটাকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম, লোকটা দেখলাম তার থেকেও অনেক বেশি ধূর্ত। ওকে না চেনার ভান করে করেই আমার পেট থেকে বেশ কিছু কথা টেনে বের করে নিল। যেমন আরও কতজনকে খুন করেছি, এমনকি তাদের মুণ্ডুগুলো কোথায় রেখেছি, সেসব অবধি! কী বদমাশ মাইরি। আমিও অবশ্য কম সেয়ানা নই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই স্রেফ শামুকের মতো গুটিয়ে গেলাম। উঁহু, হতচ্ছাড়াটাকে আর একটা কিছু যদি বলেছি।
অনেক চেষ্টাচরিত্র করার পর লোকটা হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে যেতেই ফিকফিক করে হেসে ফেললাম। বেশ জব্দ হয়েছে ব্যাটাচ্ছেলে। ওর সব জানা চাই, না? আমার ব্যাপারে, আমার মায়ের ব্যাপারে, ওর ব্যাপারে। চল ফোট বে, কোথাকার কে রে!
এর পরে আমার বিশেষ কিছুই করার নেই দেখে একটা টেনে লম্বা ঘুম দিলাম।
ঘুম যখন ভাঙল তখন বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠেই দেখি আমার সামনে আর-একটা লোক দাঁড়িয়ে। এটা আবার ডাক্তারটার মতো বাঁটকুল নয়, বেশ লম্বাচওড়া মোটাসোটা লোক। মুখে একটা গ্যালগ্যালে হাসি লেগে আছে।
“হেঁ হেঁ, অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম নাকি?” মিষ্টি করে বলল লোকটা।
আমি চট করে একবার মাথার ওপর হাত বুলিয়ে নিলাম। ও আবার এই ফাঁকে কোথাও চলে-টলে যায়নি তো?
নাহ, ওখানেই আছে ও, যেখানে ছিল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
“আরে অত চমকাবার মতো কিচ্ছুটি হয়নি। হেঁ হেঁ, আমাকে তোমার বন্ধুই ভাবতে পার ভায়া।”
“ডাক্তারটা পাঠাল নাকি তোমাকে?” সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলাম আমি।
“আরে ধুর,” মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল লোকটা, “আমার নাম ক্যাসিডি, এডউইন ক্যাসিডি। আমি হলাম গিয়ে এই জেলার সরকারি উকিল, বুঝলে কি না। বলি বসতে-টসতে বলবে না?”
“এটা আমার বাড়ি না যে অতিথিকে বসতে বলব,” নীরস কণ্ঠে বললাম আমি।
“হেঁ হেঁ, সে তো বটেই, সে তো বটেই। তবে তোমার বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই এসেছি ভায়া।” বলতে বলতেই চাবি দিয়ে সেলের দরজা খুলে ভেতরে চলে এল লোকটা। বসল আমার পাশেই, বেশ জুত করে।
“ভয় লাগছে না তোমার?” প্রশ্ন করলাম আমি, “মানে আমি খুন-টুন করেছি কি না, তাই বলছি।”
“আরে ধুর পাগল, ভয় কীসের?” বলতে বলতে বেশ স্নেহের সঙ্গেই আমার কাঁধে নিজের ভারী হাতটা রাখল লোকটা। খেয়াল করলাম যে লোকটার হাতে বেশ বড়োসড়ো একটা হিরের আংটি। রোদ্দুরের আলো সেই হিরের ওপর ঝিকিয়ে উঠে মেঝেতে চিত্রবিচিত্র নকশা তুলছিল।
“তারপর সেথ, তোমার ও কেমন আছে?”
আমি লাফিয়ে উঠলাম। মানে? এ কী করে জানল ওর কথা?
“আহা, আহা,” লোকটা প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠল, “অমন চমকে ওঠার মতো কিছু হয়নি ভায়া। বোকা ডাক্তারটার সঙ্গে রাস্তার মোড়ে দেখা হয়েছিল কি না, সেই জানাল আমাকে ওর কথা। তবে ব্যাটা বেকুবের হদ্দ। আমি তো শোনামাত্র বুঝে গেছি কেসটা কী। আর ব্যাটার মাথায় নির্ঘাত গোবর পোরা, ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি।” এই বলে লোকটা ভুঁড়ি দুলিয়ে খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগল।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আমি শুকনো গলায় বললাম, “ডাক্তার নিশ্চয়ই এও বলেছে যে আমি পাগল।”
“ডাক্তারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই ভায়া, প্রথম প্রথম আমি নিজেও বিশ্বাস করিনি। তবে আমি এখন জলার ধার থেকেই আসছি কি না। স্বচক্ষে দেখে এলাম চোরাবালি থেকে এমিলি রবিন্সের বডি টেনে তোলা হচ্ছে। এমনকি শেরিফ তো ওই জলা আর চোরাবালি তোলপাড় করে ফেলছে আরও হারিয়ে যাওয়া লোকের খোঁজে। আমি নিজেই তো আরও তিনটে বডি দেখে এলাম, একটা বেঁটে মতো লোকের, একটা বাচ্চা ছেলের আর শেষেরটা বোধহয় একটা ইন্ডিয়ানের। চোরাবালির মধ্যে থাকলে বডি পচে যায় না, জানোই তো, হেঁ হেঁ।”
আমি স্থির ভাবে লোকটার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। না। এও ডাক্তারটার মতো আমাকে পাগল ভাবছে না তো?
আরও কাছে ঘনিয়ে এল লোকটা, “ওদের সঙ্গে বাজি ধরেছি, বুঝলে ভায়া, যে চোরাবালিটা ভালোভাবে খুঁজে দেখলে আরও বেশ কিছু বডি পাওয়া যাবে। কি, ঠিক বলিনি?”
মাথা নাড়লাম। পাওয়া যে যাবে তাতে আর সন্দেহ কি? “একদম। আর যেই না সেটা বুঝেছি, অমনি টক করে মাথায় খেলে গেছে যে তার মানে তোমার ওই ওর কথাটা নিয্যস সত্যি। ওইই তোমাকে দিয়ে এইসব করিয়েছে, ঠিক কি না?”
“হুঁ”, ছোট্ট করে জবাব দিলাম আমি।
“বেশ বেশ,” উত্তেজনায় হাতে হাত ঘষল লোকটা। “আজ অবধি ঠিক তোমাকে দিয়ে ঠিক ক-টা খুন করিয়েছে তোমার ওই ও?”
“ন-টা,” নির্জীব স্বরে বললাম আমি।
“আর সবকটাকেই ওই চোরাবালির মধ্যেই পাওয়া যাবে, তাই তো?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ক্যাসিডি।
“হ্যাঁ।”
“সবার নাম বলতে পারবে?”
“ধুর, তাই হয় নাকি? ও কি আমাকে নাম বলে দিয়ে খুন করতে বলত নাকি? এই ধরো বলে দিল কেমন দেখতে, বা কোথায় আছে, বা কী করছে….”
লোকটার চোখেমুখে উত্তেজনা ফেটে পড়ল, “তুমি বড়ো কাজের লোক ভায়া, বড়োই কাজের লোক। তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে, বুঝলে। তার আগে একটা কথা বলো, সরকারি উকিল বলতে কী বোঝায় জান তো?”
“ওই যে কালো কোট পরে আদালতে দাঁড়িয়ে সওয়ালজবাব করে।” নিস্পৃহ স্বরে জবাব দিলাম আমি 1
“শাব্বাশ। এবার বলো তো বাপু, তুমি কি চাও যে তোমাকে ভরা কোর্টরুমে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সওয়ালজবাব করা হোক?”
“একদম না মিস্টার ক্যাসিডি, একদম না। শালারা কুত্তার মতো খেপে আছে। আমাকে দেখলেই আদালত থেকে বার করে পিটিয়ে মারবে। আমি কিছুতেই কাঠগড়ায় উঠব না,” আমি আঁতকে উঠলাম।
“হুম তাহলে ভায়া, তোমায় যে একটু সাহায্য করতে হচ্ছে তোমার এই দাদাটিকে। তুমি তোমার ওই ওর কথা আমাকে খুলে-টুলে বলো, আমি না হয় তোমাকে যাতে কাঠগড়ায় না দাঁড়াতে হয় সেটা দেখছি। কী বল?”
মাথা ঠান্ডা করে ব্যাপারটা একবার ভাবলাম। আমার তো প্রস্তাবটা ভালোই লাগল, ফলে গলা ঝেড়ে বলে ফেললাম, “বেশ, আমি রাজি।”
তারপর সব খুলে বললাম ওকে। সব কিছু। মানে একদম প্রথম দিন থেকে যা যা ঘটেছে তার সব কিছু।
আমার কথা বলার শেষদিকে লোকটা আর হাসছিল না। বরং গম্ভীর মুখে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার প্রত্যেকটা কথা শুনছিল।
আমার বলা শেষ হলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল লোকটা, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “সবই তো শুনলাম আর সবই বুঝলাম। শুধু একটা কথা খোলসা হল না ভায়া।”
আমি সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে রইলাম লোকটার দিকে।
“ডেডবডির মাথাগুলো কোথায়?”
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, “জানি না, বলতে পারব না।”
“জান না, নাকি বলতে পারবে না? কোটা?”
“জানি না। ওগুলো তো আমি ওকে দিতাম। তারপর ও মাথাগুলো নিয়ে কী করত সে আমি কী করে বলব?” বেশ বিরক্তই হলাম আমি।
ক্যাসিডিকে দেখে মনে হল বক্তব্যটা বোধহয় ঠিকঠাক হৃদয়ঙ্গম হয়নি তার।
“আরে বুঝলে না?” সহজ ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করি
লোকটাকে, “খুন করার পর লোকগুলোর মাথা কেটে আমি বডিগুলো চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিতাম। তারপর মাথাগুলো ওখানেই রেখে আমি চলে আসতাম আমার ঘরে। তারপর আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত ও, সে বড়ো শান্তির ঘুম। শুধু এটুকু জানি যে তারপর ও সেই মাথাগুলোর কাছে যেত। গিয়ে কী করত সে নিয়ে আমার কোনোদিনই কোনো মাথাব্যথা ছিল না, আজও নেই। যেত এইটুকু মাত্র বলতে পারি।”
“কিন্তু… কিন্তু…” লোকটা প্রায় তুতলে গেল, “তুমি
এসব করতে কেন ওর জন্যে?
“আরে মর! যন্ত্রণা!” খুব বিরক্ত হলাম আমি, “বললাম যে, আমি এসব না করলে ও আমার সঙ্গেই কাজটা করত, মানে করবার ধমকি দিত! এর পরেও ওর কথা শুনব না, আমার ঘাড়ে কি একটার বেশি মাথা?”
লোকটা আমার দিকে হাঁ হয়ে চেয়েছিল দেখে একটু মায়াই হল ওর প্রতি। “তুমি আবার এসব বলার জন্য আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না তো?”
“না। একদম না।” লোকটা ওর বিশাল শরীরটা নিয়ে আমার ওপর ঝুঁকে এল প্রায়, “ওর কথা কেউ বলবে না, আমিও না, তুমিও না। তোমার বিচারের সময় ওর কথা যাতে না ওঠে তার সব ব্যবস্থা করব আমি।”
“কিন্তু কেন?” এবার আমার একটু সন্দেহ হতে লাগল, “ওর কথা উঠবে না কেন শুনি?”
“কারণ তুমি ওকে ভয় পাও, তাই না সেথ?” আমার মুখের ওপর বড়ো বড়ো লালচে চোখ দুটো মেলে বলল ক্যাসিডি, “তুমিও চাও না যে ওর কথা সবাই জানুক, তাই না?”
আমি এত ঘাবড়ে গেছিলাম যে প্রথম প্রথম কিছু বলতেই পারলাম না।
“শোনো সেথ। এই জেলহাজত থেকে বাঁচবার একটাই রাস্তা, “বলে একবার থামল লোকটা, তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “তোমার ওই ওকে আমাকে দিয়ে দাও।”
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম লোকটার দিকে। ব্যাটাচ্ছেলে বলে কী? ওকে দিয়ে দেব মানে? লোকটার মাথার ঠিক আছে তো?
ক্যাসিডি বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে আমার মনের কথা বুঝতে পারল। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই তড়িঘড়ি বলে উঠল সে, “কথাটা ভালো করে বোঝো ভায়া। যদি ও তোমার কাছে না থাকে, তবে তো ওর ব্যাপারে তোমার কিছু না বললেই চলে, তাই না? আর সবাইকে যে ওর ব্যাপারে বলে বেড়ানো হচ্ছে সেটা তো ও নাও পছন্দ করতে পারে। আর ও যদি কোনোকিছু অপছন্দ করে তবে তার ফল কী হয়, সে তো তুমি জানোই।”
ঘাড় নাড়লাম। সে কথা আমার থেকে বেশি ভালো আর কে জানে?
“কিন্তু… কিন্তু ও যদি তোমার কাছে যেতে না চায়?” ক্যাসিডি এসে ওর মোটা হাতটা আমার কাঁধে রাখল। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, “সেটা তুমি দেখবে। এত বড়ো একটা বিপদ থেকে তোমাকে বাঁচাচ্ছি, এইটুকু আমার জন্য করবে না তুমি? আমি ওকে যথেষ্টই যত্নআত্তি করব, সেটাই বা কম কী?”
কথাটা আমার খুব একটা খারাপ যে লাগল তা নয়। যে দ’য়ে মজেছি তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার এর থেকে ভালো উপায় আর কী আছে? বিশেষ করে ও যখন একেবারেই চুপচাপ, এখান থেকে আমাকে উদ্ধার করার কোনো ইচ্ছাই ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
আমার দিকে সাগ্রহে তাকিয়েছিল লোকটা। আমাকে প্রশ্ন করল, “ও এখন কোথায়?
নিজের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিলাম, “এই যে এখানে, আমার তালুতে।”
ক্যাসিডি আমার দিকে তাকাল একবার, তারপর ফিক করে হেসেই ফেলল, “তাই নাকি?”
হাসিটা দেখে আমার বেশ সন্দেহ হল খানিকটা, লোকটাকে বিশ্বাস করা যাবে তো? তাই প্রশ্ন করলাম, “ওকে নেওয়ার মানে জান তো? মানে ওকে কাছে নেওয়ার কী কী ঝক্কি আছে সে নিয়ে ধারণা আছে কিছু?”
“আছে বইকি”, খিকখিক হাসি চাপতে চাপতে বলল লোকটা।
“ও যা চায়, তা না পেলে কিন্তু ও সেটা জোর করে আদায় করে, জান তো?” সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলাম আমি।
“হুঁ, সেও জানি হে ভায়া।” বেশ চকচকে মুখে বলল লোকটা, “এবার কথা না বাড়িয়ে ওকে আমার কাছে দাও দিকি।”
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর ফিসফিস করে বললাম, “আছ?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
“শোনো, উনি তোমাকে নিতে এসেছেন। উনি তোমাকে খুব ভালো রাখবেন, বুঝলে? যাবে নাকি?”
ও কিছুই বলল না। আমি তাকিয়ে দেখলাম ক্যাসিডি আমার সামনে মোটা ব্যাঙের মতো থেবড়ে বসে চোখের কোণ দিয়ে বিচ্ছিরি ভাবে হাসছে।
আমি আবার নিজের ভেতরে মনোযোগ দিলাম, আলতো আদরে বললাম, “যাও, উনি তোমাকে চাইছেন।”
ও চলে গেল।
ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল আমার। কিন্তু যখন বুঝলাম যে মাথাটা খালি খালি লাগছে, নিশ্চিত হলাম যে ও গেছে। আমার ঘাড় থেকে পুরোপুরি ভাবে বিদেয় হয়েছে ব্যাটা।
কথা নেই বার্তা নেই, ক্যাসিডি হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল। আমি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম, “গেছে? ও তোমার কাছে গেছে? বুঝতে পারছ কিছু?”
ক্যাসিডি কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে তাকাল আমার দিকে। তারপর বলল, “হ্যাঁ, ও এসেছে। ইয়েস, ইয়েস… মাথার ভেতরটা… হ্যাঁ…”
ওকে অন্য কারও ঘাড়ে বিদেয় করেছি ভেবে যে বেশ উৎফুল্ল লাগছিল সে কথা অস্বীকার করব না। গদগদ স্বরে বললাম, “ওর কিন্তু ভালো যত্নটত্ন নিও, বুঝলে। নইলে কিন্তু ও…”
কথাটা ক্যাসিডির কানে গেল কি না বুঝতে পারলাম না। কারণ তখন ও লম্বা লম্বা পায়ে থানার দরজা পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। দৌড়াচ্ছিল বললেই চলে। আমি অবশ্য সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনি। ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর মাথাটা হালকা হালকা লাগছিল কি না! তাই এবার আমি একটা জমাটি ঘুম দিলাম সেলের মেঝেতে শুয়ে।
ঘুমটা ভাঙল রাতের দিকে, সেলের দরজায় জোরদার ধাক্কা শুনে। জেগে উঠে দেখি আমার সুহৃদ, শ্রীমান চার্লি পটার আমার জন্যে রাতের খাবার এনেছে। আমি উঠে বসতেই প্ৰায় লাফিয়ে উঠল চার্লি।
“শুয়োরের বাচ্চা নরকের কুত্তা,” খিস্তি করতে লাগল চার্লি, “ন-খানা বডি তুলেছে ওরা চোরাবালি থেকে, ন-খানা! শয়তান, এতগুলো লোক খুন করেছিস তুই?” চার্লির স্বরে ঘৃণার বদলে উপচে পড়ছিল বিষ।
আমি তো অবাক! বলার চেষ্টা করলাম, “এ কি চার্লি, খিস্তি করছ কেন? তোমাকে তো আমার বন্ধু বলেই জানতাম।”
থুতু ছেটাতে ছেটাতে দূরে সরে গেল চার্লি, “আমাকে তোর বন্ধু বলে ডাকার হিম্মত হল কী করে? তোকে রাস্তার কুত্তার মতো পিটিয়ে মারা উচিত। শেরিফ যে কেন লোকগুলোকে থানার বাইরে আটকে রেখেছে কে জানে। তোর মতো নরকের কীটদের ওদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। ওটাই তোর উচিত শাস্তি।” বলতে বলতে থানার তালা লাগাচ্ছিল চার্লি। বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার ওপার থেকে ছিটকে আসছিল ওর উগরে দেওয়া কথাগুলো।
থানার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলে অনুভব করলাম যে আমি একা। সারা জীবনে এই প্রথম। এমনকি ও-ও নেই আমার সঙ্গে।
মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলাম। কেউ কোত্থাও নেই। কিচ্ছু নেই।
জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের বিষণ্ণ আলো এসে পড়ছিল সেলের মেঝেতে। বাইরে রাত আরও গভীর হয়ে এসেছে। আমি স্থির তাকিয়ে ছিলাম মেঝের ওপর আলোর কাটাকুটি খেলা দেখার জন্য। ও চাঁদের আলো খুব পছন্দ করত, পূর্ণিমার রাতে যেন পাগল হয়ে যেত। তখন আমার মাথার ভেতরে ওর সেই উন্মত্ত ফিসফাস বিষের মতো খেলা করে বেড়াত।
ও কেমন আছে এখন? ক্যাসিডির সঙ্গে?
জানি না কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম। আমার সারা শরীরে, শিরায় উপশিরায় কেমন যেন একটা অলস, ভোঁতা বিষাদ ছড়িয়ে পড়ছিল।
আমার সাড় ফিরে এল একটা শব্দে। কে একজন যেন থানার দরজাটা খুলছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, ওরা আসছে না তো? চার্লি লোকজন নিয়ে আসছে না তো আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে বলে?
না, চার্লি না। আবছায়ার মধ্যেই বুঝলাম দ্রুত পায়ে কে এসে আমার সেলের দরজাটা খুলল।
ক্যাসিডি।
“ও… ও… ওকে নামাও, নামাও আমার মাথা থেকে, ত্রস্ত স্বরে বলল ক্যাসিডি, “এক্ষুনি ফিরিয়ে নাও ওকে, এক্ষুনি।” আশ্চর্য হলাম আমি, এই তো এইমাত্র ওকে নিয়ে গেল লোকটা। এর মধ্যেই কী হল?
“কী হয়েছে? ওরকম করছ কেন?”
“নিয়ে যাও, নিয়ে যাও ওকে।” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ক্যাসিডি, “আমি ওকে চাই না, একমুহূর্তের জন্যও না।”
“কেন? আমি তো বলেই ছিলাম ও কেমন, কী করে, কী চায়…”
“ও রক্ত চাইছে, রক্ত,” বিস্ফারিত স্বরে বলল ক্যাসিডি, “আ… আ…আমি শুনতে পাচ্ছি ওর কথা। আমার ঘাড় বেয়ে উঠছে ও… উফফফ্…. কী যেন একটা বলছে আমার কানে কানে..,”
“আমি তো বলেছিলাম তোমাকে”, ঠান্ডা স্বরে বললাম আমি, “বলেছিলাম যে ও কী চায়। ও যা চায় এবার তো ওকে সেটা দিতে হবে তোমায়।”
“না না, পারব না,” আর্তনাদ করে উঠল ক্যাসিডি, “আমি কিছুতেই মানুষ খুন করতে পারব না। ওকে নিয়ে যাও। দোহাই, পায়ে পড়ি তোমার, ওকে নিয়ে যাও…”
“ঠিক আছে, যখন বলছ, আমি না হয় ফিরিয়েই নিচ্ছি।”
ডাকলাম ওকে। একবার। দুবার। তিনবার। কিন্তু ওর কোনো সাড়া পেলাম না।
ক্যাসিডির দিকে তাকালাম। দরদর করে ঘামছে লোকটা, মুখটা আতঙ্কে আর ভয়ে বেঁকে গেছে। মনে হল কে যেন গলা টিপে ধরেছে ওর।
শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বলল ক্যাসিডি, “না, কিছুতেই না। আমি কিছুতেই ওর কথা শুনব না।”
আমার মুখটা ক্যাসিডির কানের কাছে নিয়ে এলাম, ফিসফিস করে বললাম, “এ ছাড়া যে উপায় নেই মিস্টার ক্যাসিডি। ও যা চায়, সেটা ও আদায় করেই ছাড়ে। মায়ের সঙ্গে সেই চুক্তিই করেছিল ও। তোমার যে আর ফেরবার পথ নেই।”
“না না না…” একটা চাপা আর্তচিৎকার ভেসে এল ক্যাসিডির গলা থেকে।
তারপর লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
আমার আর কীই বা করার ছিল। গুটিশুটি মেরে সেলের এক কোণায় গিয়ে বসলাম। চাঁদের ম্লান আলো গরাদের ফাঁক বেয়ে নেমে এসে মৃত্যুর মতো বিছিয়ে যাচ্ছিল ক্যাসিডির মুখের ওপর। আস্তে আস্তে গুটিয়ে যাচ্ছিল অত বড়ো শরীরটা।
আর ঠিক তখনই একটা বোবা আতঙ্কের কান্না, একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ উঠে এল ক্যাসিডির গলা থেকে।
আমি জানি কী ঘটতে চলেছে এবারে। বোকা ক্যাসিডি জানত না যে ও যা চায়, সেটা আদায় করেই ছাড়ে।
হাত দিয়ে কান দুটো চাপা দিয়ে হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে দিলাম। কী লাভ ওসব দেখে?
কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই। চাঁদের আলো সরে গেলে আবার মাথা তুলে তাকালাম সামনের দিকে।
সেলের ঠিক মাঝখানে ক্যাসিডি শুয়েছিল। নিশ্চল। নিস্পন্দ। নিথর। নিঃশব্দ।
না, নিঃশব্দ নয়। যেখানে ক্যাসিডি শুয়েছিল, সেখান থেকে একটা ঘরঘর আওয়াজ উঠে আসছিল। মৃদু, আরামের ঘরঘরানির আওয়াজ। ভোজ খাওয়ার পরে যেরকম তৃপ্তির শব্দ ভেসে আসে শিকারি বেড়ালের থেকে, ঠিক সেরকম।
তারপরেই ক্যাসিডির মাথার ভেতর থেকে একটা আঁচড়ানোর শব্দ ভেসে এল।
আমি জানি ওটা কীসের আঁচড়ানি।
ওটা কার নখের আওয়াজ।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মুখে একটা মৃদু হাসি এসেই পড়ল।
সেলের দরজা খোলা। থানার দরজা খোলা। আমার আর এখানে থাকার মানে আছে কোনো?
সেলের দরজা খুলে বাইরে পা রাখলাম। তারপর ঘুরে দাঁড়ালাম ক্যাসিডির দিকে। মৃদু স্বরে বললাম, “আসবে না?”
ঠিক পরমুহূর্তেই একটা শীতল নখের আঁচড় আমার ঘাড় বেয়ে উঠে এল। চেনা ছোঁয়া।
থানার দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এলাম। চারিদিকে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে মৃত্যুর মতো। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু রয়েছে মাথার ওপর নিকষ কালো আকাশ। আর আছি আমি, আমার মাথার মধ্যে, রক্তমাংসের ডেলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই হিংস্র, ধাতব অনুভূতিটাকে নিয়ে।
ও।