ও কুমারী

ও কুমারী

রসময়বাবুর আজ বড় আনন্দ; প্রাণে রসের ঢেউ খেলিয়া যাইতেছে। বাঙলা দেশে ফতোয়া জারী হইয়াছে, টেলিফোন করিবার সময় ফোন তুলিয়া আর ‘হ্যালো মিস’ বলা চলিবে না, বলিতে হইবে—ও কুমারী।

বাঙলা ভাষার মতো ভাষা আছে? এই তো রসময় ত্রিশ বৎসর ধরিয়া টেলিফোনে ‘হ্যালো মিস’ বলিয়া আসিতেছেন, কিন্তু কখনও প্রাণে একবিন্দু রস সঞ্চার হয় নাই। যেমন কাটখোট্টা জাত, তেমনি তার ভাষা! রস আসিবে কোথা হইতে? কিন্তু ও কুমারী? বলিতে গেলেই হৃৎপিণ্ড দুলিয়া ওঠে, গলার স্বর গদ্‌গদ্ হইয়া যায়।

রসময়বাবু সাবধানী মানুষ, সহজে কাহাকেও টেলিফোন করেন না; কারণ টেলিফোন করিলেই খরচ আছে। কিন্তু আজ তাঁহার মন দুর্বার হইয়া উঠিয়াছে। তিনি টেলিফোনের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন ও মাঝে মাঝে সেই দিকে হাত বাড়াইতেছেন।

হঠাৎ মনে পড়িল, অনেক দিন যদু খুড়োর খবর লওয়া হয় নাই। খুড়োর নম্বরটা কত? ফোন তুলিয়া রসময় কুহু স্বরে বলিলেন—‘ও কুমারী!’

কুমারীরা বোধ হয় নিজেদের মধ্যে কুমারীসুলভ জল্পনা কল্পনায় ব্যস্ত আছেন, কারণ রসময় তাঁহাদের হাসি গল্পের ভগ্নাংশ শুনিতে পাইলেন।

‘ও কুমারী!’

কেহ সাড়া দিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া রসময় টেলিফোন রাখিয়া দিলেন। বাঙালীর ঘরের কুমারীরা মন খুলিয়া গল্প করিবার কতটুকুই বা সময় পায়। আহা গল্প করুক। যদু খুড়োর খবর লওয়াটা এমন কিছু জরুরী কাজ নয়।

আধ ঘণ্টা পরে রসময়ের স্মরণ হইল ছয় মাস পূর্বে তিনি গৃহিণীর গয়না গড়াইতে দিয়াছিলেন, এখনও স্যাকরার দেখা নাই। ইতিমধ্যে গৃহিণী কয়েকবার তাগাদা দিয়াছেন, কিন্তু রসময় সময় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। স্যাকরার নম্বরটা কত—?

ডিরেক্টরি দেখিয়া রসময় ফোন ধরিলেন—‘ও কুমারী!’

কুমারীর সাড়া দিলেন না। রসময় তখন কণ্ঠস্বর একটু চড়াইয়া ডাকিলেন—‘বলি ও কুমারী।’ তবু সাড়া নাই! ‘বলি শুনছ—শু কুমারী!’

রসময় চমকিয়া উঠিলেন; ওপার হইতে যেন ‘ঝ্যাঁটা’ শব্দটা অস্পষ্টভাবে ভাসিয়া আসিল। তারপরই একটি কুমারীর অতি স্পষ্ট গলা শোনা গেল—‘আপনি কি রকম ভদ্রলোক—?’

ঘাবড়াইয়া গিয়া রসময় বলিলেন—‘অ্যাঁ, আমি—’

আবার কুমারী কণ্ঠে তীব্র প্রশ্ন আসিল—‘আপনার বয়স কত?’

অভিভূত রসময় বলিয়া ফেলিলেন—‘ঊনপঞ্চাশ।’

‘ঘাটের মড়া।’

রসময় আবার টেলিফোন রাখিয়া দিলেন।

দুত্তোর! বাঙালীর মেয়েকে প্রশ্রয় দিতে নাই। এর চেয়ে ওরা বরং ছিল ভাল। অন্তত ‘ঝ্যাঁটা’, ‘ঘাটের মড়া’ শুনিতে হইত না। কুমারীদের মুখে বাঙলা ভাষা যেন করাতের মতো হইয়া উঠিয়াছি। ইংরেজি গালাগালি সহ্য হইয়া গিয়াছিল—

দুত্তোর!

রসময় কাজকর্মে মন দিলেন।

আধ ঘন্টা পরে তাঁহার আবার মনে হইল, যদু খুড়োর খবর না লওয়া ভাল দেখায় না। খুড়োর বয়স অনেক হইয়াছে, কোন্ দিন আছেন কোন্ দিন নাই—

টেলিফোন তুলিয়া রসময় কুহক-মধুর স্বরে ডাকিলেন—‘ও কুমারী?’

২১ শ্রাবণ ১৩৫৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *