ও কার হাসি – কলমে পিয়ালী রায়
আজকেও সহেলী প্রতিদিনের মতন অফিস থেকে ফিরছে।বাসে বসার জায়গা পেয়ে বসে পড়ল ও। মোবাইল নেটটা ওন করল।সত্যি আজকাল যা খাটুনি যাচ্ছে অফিসে! লকডাউন বলে অনেক কাজ জমে গেছিল কয়েক মাস।এই মহামারীর মধ্যেও ওর অনেক ব্যাচমেট নিয়মিত অফিস করেছে।ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তানিয়া রোজ অফিস গেছে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলে।
কলেজে পড়তে ওদের একটি ছোটখাটো মেয়েদের গ্রুপ ছিল এবং ওদের সেই বন্ধুত্ব আজো অটুট।সহেলী,তানিয়া, নৈঋতা,মধুরিমা,তনুশ্রী ওরা পাঁচজন, সারাক্ষণ কলেজ মাতিয়ে রাখত।আজ সবাই যে যার নিজের কাজে ব্যাস্ত হলেও মাঝে মাঝেই দেখা করে সময় করে,যোগাযোগ রাখে ফোনে,ম্যাসেজ করে।আজ যখন “ফ্রেন্ডশিপ ডে” তাই তনুশ্রী ফেসবুকে ওদের একসাথে ছবি দিয়ে “মিস ইউ গার্লস” লিখেছে।পোষ্টটা দেখেই মন ভালো হয়ে গেল সহেলীর, বসের ঝাড়টাও ভুলে গেল।ও কমেন্ট করল “মিস ইউ টু”।
হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল সহেলীর।নৈঋতার ফোন, ফোনটা ধরতেই ওপাস থেকে নৈঋতা, মধুরিমা আর তনুশ্রীর গলা শোনা গেল, “হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে!” সহেলী হাসল, “হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে!কেমন আছিস সব? “
তনুশ্রী বলে ওঠে, “আর বলিস না,কাজ করে করে পাগলা হয়ে গেলাম! “
সহেলী হঠাৎ শোনে এক খিলখিলয়ে হাসির শব্দ।
“সত্যি ভাই, লকডাউনটা হয়ে কত কাজ ঘাড়ে এসে পড়ল!একটুকু নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছি না!”মধুরিমা বলে।
“কোরনার বাজারে আর কি করবি বল! এভাবেই চলতে হবে”, নৈঋতা বলে।
” কেউ কি সত্যি ভেবেছিলাম,যে এমন অবস্থা হবে বল!”, সহেলী বলে,”যাক গে, বাদ দে! বল কেমন কাটচ্ছিস আজকে? “
“ভাই,আর কি করব! সবে অফিস থেকে ফিরলাম আমি!” তনুশ্রী বলে।
“আরে, যদি আজ দেখা করা যেত ভাল হত!কিন্তু উপায় নেই,” নৈঋতা বলে ওঠে।
“হুম, ঠিক বলেছিস,কিন্তু তানিয়াটা কোথায় গেল?” মধুরিমা বলে।
“আরে ওকে ফোন করে যাচ্ছি,কিন্তু ফোন তুলছে না!ও যা ব্যাস্ততা দেখায়,যেন গোটা ব্যাঙ্কটাই ওর ঘাড়ে! ” নৈঋতা বলে।
আবার খিলখিল করে মেয়েলি গলায় কেউ হেসে ওঠে এবার হাসিটা যেন থামতেই চাইছে না।
সহেলী বলে, “ও মনে হয় কাজে ব্যাস্ত আছে, ছাড় পড়ে ফোন করে নেব সবাই একদিন।আজকাল ওর এমন দর বেড়েছে!দাঁড়া না, সব উসুল করব একদিন দেখা করে ওর থেকে সবাই, ব্যাটা ম্যানেজার হওয়ার পর খাওয়ালো না ওবদি!”
আবার খিলখিলয়ে হাসির আওয়াজ মেয়েলি গলায়, এবার যেন হাসির মাত্রাটা একটু বেশি।
সহেলী খেয়াল করে ওদের কন কলে কারোর যেন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস শোনা যাচ্ছে। এমনকি ওদের কথায় হাসছেও খুব মেয়েলি গলায়!
এবার সহেলী একটু বিরক্ত হয়,”এই তোরা কে এত হাসছিস বলত!আর এত হাসলে দেখ,সব দাঁত ভেঙে দিয়ে আসব আমি! কথায় কথায় এত হাসিস না তোরা, পাগলের মত!”
এবার হাসির আওয়াজ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।নৈঋতা,মধুরিমা ও তনুশ্রী এবার অবাক হয়, নৈঋতাই বলে, “কই, আমরা কেউ তো হাসছি না! তুই সারাদিন কল সেন্টারে কাজ করিস তো! ভুল শুনছিস।
এবার হাসির আওয়াজ তিনগুণ বেড়ে যায়। সহেলী রেগে যায় এবার,” একদম ফালতু বকবি না, তোরা হাসছিস না,তো কি আমার কান বাজছে নাকি!এতটাও ভুল শুনি না আমি! “
এবার ওরা সবাই বলে ওরা মিথ্যা বলছে না,যাই হোক তখনকার মত ব্যাপারটা ওখানেই ইতি হয়। সহেলী বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে।মা চিকেন কারি খুব বেড়ে রেঁধেছিল।রাতে শুতে যাবার সময় ঘটনার কথা মনে পড়ে মনটা কেমন খচ খচ করে সহেলীর।বন্ধুরা কেউ মজা করেছে ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে।
হঠাৎ মাঝরাতে একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে যায় সহেলীর।দেখে বিছানার পাশে যেন একটা ছায়ামূর্তি,ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।কে ও! “কে? ” বলে ভালো করে তাকাতেই দেখে তানিয়া,একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে।ভয় পায় সহেলী অন্ধকার ঘরে তানিয়া এল কি করে! কিছু বোঝার আগেই ছায়ামূর্তিটা মিলিয়ে যায়।
ভয়ে চিৎকার করে সহেলী অজ্ঞান হয়ে যায়।
সকালে জ্ঞান হয় ওর মায়ের ডাকে, মা মুখে জলের ছিটে দিচ্ছেন সহেলীর।সহেলী ধড়ফড় করে উঠে বসে।
“কি হয়েছিল তোর!” সহেলীর মা বলেন। কিছু বলার আগেই তনুশ্রীর ফোন, হাউহাউ করে কাঁদছে ও।
“জানিস,কাল সন্ধে ছটায় তানিয়া মারা গেছে!কোরনা পজেটিভ ছিল ও।তিনদিন আইসোলোশনে ছিল।কাল নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, বারবার নাকি আমাদের নাম করছিল বেচারী।”