ও করকমলেষু – তিলোত্তমা মজুমদার
শনিবার সন্ধ্যা। সবুজকলির ঘর। বন্ধুরা ছড়িয়ে—ছিটিয়ে বসেছে কেউ বিছানায়, কেউ মেঝেতে। সবুজকলি শুয়ে শুয়ে পড়ে, শুয়ে শুয়ে লেখে। তাই ওর ঘরে কোনো চেয়ার—টেবিল নেই। পরীক্ষার সময়ও লিখতে লিখতে ও আধশোয়া হয়ে যেত।
ফেব্রুয়ারির শেষ এখন। দিনের কলকাতা তবু গরম হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় স্নিগ্ধ হাওয়ায় পরদা উড়ে যায়। আর ক—দিন পর দোলপূর্ণিমা। শুক্রবার পড়েছে। নীলাভ মন দিয়ে ক্যালেন্ডার দেখছিল। একটু আগেই সবুজকলি আর প্রভাতসূর্য ঘোষণা করেছে ওরা শিগগির বিয়ে করবে। মধুস্মিতা আর সন্দীপনের বাল্যপ্রেম। একেবারে ছোটোবেলার বন্ধু সবাই। সমবয়সি। একই পাড়ায় বেড়ে ওঠা। কেউ কারোকে ছেড়ে থাকতে পারে না। সবুজকলি ও প্রভাতসূর্যের গভীর বন্ধুত্বের মধ্যে সাম্প্রতিক প্রেমের সঞ্চারে ওরা খুশি। নীলাভ ক্যালেন্ডার দেখছে, কারণ দোলের ছুটিতে ও বন্ধুদের নিয়ে বেরোতে চায় কোথাও।
নীলাভ : খুব ভালো দিন, দ্যাখ। শুক্রবার দোল। শনি—রবি ছুটি। সোমটা জুড়ে নিলে টানা চারদিন।
প্রভাতসূর্য : কোথায় যাবি? চারদিনে কোনো ট্রেক করা যাবে না। আসা যাওয়ার সময় ধরতে হবে তো!
নীলাভ : ট্রেক আর ট্রেক! শুধু বেড়াতে যাবার জন্যই যেতে ইচ্ছে করে না? ধর এমন কোথাও, সারাদিন বারান্দায় বসে বসে দিন কেটে যাবে?
ঝাউ : প্লিজ, কোনো কঠিন ট্রেক করিস না। তোরা তো শুধু এ পাহাড় ও পাহাড় করিস। জানিস তো আমার ভার্টিগো আছে।
নীলাভ : আর আমার আপত্তি আছে। অখাদ্য। কী করতে যে যাস তোরা!
মধুস্মিতা : তুই যেন যাস না!
নীলাভ : আমি তোদের জন্য যাই। তোরা যা বিচ্ছু, একটা গার্জিয়ান টাইপ কেউ না গেলে… হ্যাঁ, জঙ্গল থাকলে আমার ভালো লাগে। গভীর সবুজ বন। গাছের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা টাটকা বুনো গন্ধ। পাতা—ঝরা সরু পথের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার ছিপছিপ শব্দ। পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে। নদী বইছে।
সবুজকলি : থামতে কত নিবি লাভো? এই নে চার আনা। (একটা সিকি ছুড়ে দিল।)
নীলাভ : এসব ভালো লাগবে কেন? ন্যাড়া ওঁচা পাহাড়, দাম্বা দাম্বা পাথরের স্তূপ দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে, নয়তো সাদা ফ্যাটফেটে বরফের চূড়া! ওই দেখে তো আহ্লাদে গলে যাস।
প্রভাতসূর্য : কাজের কথায় আয় লাভো। কলি, ‘ভ্রমণবিলাস’ কারেন্ট ইস্যুটা আনবি?
নীলাভ : ওসব ভ্রমণবিলাস—টিলাস ছাড়। চল বাগোরা যাই। বিষ্যুদবার ট্রেনে চাপব। শুক্রবার পৌঁছোব। ঝক্কাস চাঁদ উঠবে। তোরা প্রি—ম্যারিটাল হানিমুন করবি। আর যা করার এবেলাই করে নিবি। বিয়ের পর তো হানি শুকিয়ে যাবে, ফ্যাটফ্যাট করবে বুড়ি চাঁদ!
সবুজকলি : ওফ! এত বাজে বকে না লাভোটা!
প্রভাতসূর্য : কিন্তু বাগোরাটা কোথায়?
নীলাভ : কার্শিয়াং থেকে দশ—বারো কিলোমিটার ওপরে।
সন্দীপন : কার্শিয়াং? বস, দু—বার সান্দাকফু গেছি। আগোরা টাগোরা শুনিনি তো।
নীলাভ : আগোরা নয়, বাগোরা। এ নয় বি।
সন্দীপন : ওই হল।
নীলাভ : না। হল না। কার্শিয়াঙের কাছাকাছি আরও একশোটা জায়গা আছে, যেগুলোর নাম তুই জানিস না।
প্রভাতসূর্য : বাগোরায় ট্যুরিস্ট লজ আছে? জায়গাটা কেমন?
নীলাভ : শুনেছি খুব সুন্দর। ওটা কিন্তু ট্যুরিস্ট স্পট নয়। পণ্ডাদা বলছিলেন একদিন, আমরা যেতে চাইলে বনবাংলোটা বুক করে দেবেন।
সবুজকলি : ও! তোর সেই পণ্ডাদা, না? কী যেন? বনদপ্তরে কী যেন?
নীলাভ : বনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব। যাবি তো বল। হাঁউটারও খুব অসুবিধে হবে না। কার্শিয়াং তো খুব উঁচু নয়।
ঝাউ : না না। যেতে পারব। কালিম্পং, দার্জিলিং গেছি তো। আর নীলাভ, আমাকে হাঁউ বললে এবারে ঠিক ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলব।
নীলাভ : না না! খাঁউ মাঁউ… কাঁদিস না! মনসিজ কষ্ট পাবে।
মনসিজ : কিছু মনে কোরো না, এই ট্রিপে আমি বাদ।
মধুস্মিতা : সে কী! ঝাউ তা হলে কী করবে?
নীলাভ : ম্যায় হুঁ না! (বুড়ো আঙুল নিজের বুকে ঠেকায়)। দারুণ প্রক্সি দিতে পারি।
সবাই হা হা হাসে। মনসিজও হাসে। ও ঝাউয়ের প্রেমিক। একটু বড়ো বয়সে। কিন্তু দলে মিশে গেছে। ওরা থাকে টালিগঞ্জে। বাকিরা লেকটাউনে। ঝাউকে ওরা পেয়েছে কলেজে।
ওদের খাওয়া হয়ে যাওয়া প্লেট সমেত ট্রে—টা গুছিয়ে ভেতরে দিয়ে এল সবুজকলি। নীলাভর পাশে বসল।
নীলাভ : এই, সরে বোস। তোর গায়ে সূর্যর গন্ধ।
(আরেক প্রস্ত হাসি।)
সবুজকলি : কিন্তু তোর কী হবে লাভো? প্রক্সি দিয়ে তো সারাজীবন কাটবে না! তোর যদি একটা ন্যাকাটাইপ বউ হয়, তাহলে তো অঙ্কপ্রশ্ন আনকমন হয়ে যাবে রে!
নীলাভ : আরে না না। যে—কোনো বউ পেলেই চলবে। আমি যা বউপাগলা!
প্রবল হইচই শুরু হল। প্রত্যেকেই কিছু বলতে চাইছে কিন্তু সবার কথা মিশে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র মনসিজর গলাই আলাদা করা গেল—মাথা নেই তার মাথাব্যথা!
নীলাভ : তোরা কী বুঝবি? যে—কোনো সুন্দরী দেখলেই আমি পাগলা হয়ে যাই। নতুন একজনকে না পাওয়া অবদি তাকেই বউ ভাবতে থাকি।
মধুস্মিতা : বাজে বকিস না। কলেজে গিটার বাজিয়ে স্বরচিত গান করতিস যখন, কত সুন্দরী তোকে ঘিরে থাকত। একটাকেও তুলতে পারলি?
সন্দীপন : শুধু সুন্দরী না! হাই ভোল্টেজ! নেহাৎ মধু আগেই আমায় পটিয়ে ফেলল তাই!
সবুজকলি : মধুটা অসম্ভব ভালো তাই। নইলে কে তোকে পাত্তা দিত রে কুমড়োপটাশ?
মনসিজ : নীলাভ কলেজে বাজিয়ে গাইত? গান গাইত?
প্রভাতসূর্য : ও অনেককিছু করেছে। আমরা যখন ইলেভেনে, ওর নাটক করার ইচ্ছে হল। পাড়াতেই থপুদার গ্রুপ ছিল। ও নিজেই বলুক না!
সবুজকলি : প্লিজ সূর্য! তপুদা বল!
প্রভাতসূর্য : (লাজুক হেসে) আসলে তপুদা। মোটা ভুঁড়িওলা—এই সন্দীপনের মতো, থপথপ করে হাঁটে, তাই থপুদা।
সন্দীপন : আমি থপথপ করে হাঁটি?
মধুস্মিতা : থপুদার বয়সে হাঁটবি। এখনই তো পাহাড়ে ঠেলে তুলতে হয়।
ঝাউ : সেটা কী রে? সেটা কী?
মধুস্মিতা : জোংরি গেছি আমরা। একেবারে খাড়াই পথ। সন্দুটা উঠতেই পারছে না এক জায়গায়।
সবুজকলি : শেষ পর্যন্ত আমি, মধু আর সূর্য ওকে পেছন থেকে ঠেলে তুললাম। উঃ! এর থেকে পাহাড় ঠেলা সোজা!
সন্দীপন : যাঃ! রোগা হয়ে গেলাম।
মধুস্মিতা : কবে?
সন্দীপন : বিয়েটা হোক। তুই যা খাটাবি! সব ঝরে যাবে।
মধুস্মিতা : এই এই—(দুমদাম মারে সন্দীপনকে। ও আরামের ভঙ্গি করে।)
মনসিজ : নীলাভর নাটকটা কী হল? ইন ফ্যাক্ট সূর্য, তোমাদের দু—জনকেই যা দেখতে, সিনেমায় নামতে পারতে। প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম তোমরা ভাই। কত তোমরা?
প্রভাতসূর্য : পুরো ছয়।
নীলাভ : জুতো পরলে ছয় এক। বডি দেখেছিস? সূর্যর ক্রিকেট খেলে। আমার না খেলেই।
সবুজকলি : পাগলা থাম। এবার তো উড়ে যাবি।
ঝাউ : নাটকের গল্পটা বল না!
নীলাভ : আরে নাটকের ইচ্ছে—টিচ্ছে নয়। সূর্য ক্রিকেট প্যাঁদাতে যায়। মধুটা গান শিখতে যায় দু—জনের কাছে। সন্দু আঁকতে যায়। কলিটা আগে ক্যারাটে শিখতে যেত, পরে কত্থক শিখতে লাগল। তো আমি ঘোড়াড্ডিম করি কী! নাটকে চলে গেলাম। ভালোই চলছিল। আমি নায়ক। রফিক আমার বন্ধু কিন্তু ঘটনাচক্রে আমাকে গলা টিপে খুন করবে। তো থপুদা বলে, ‘রফিক তোর গলা টিপলে তুই আ আ আ করে আর্তনাদ করবি।’ বললাম, ‘গলা টিপলে গলা সাধার মতো আ আ আ বেরোবে কী করে তপুদা?’ বলে, ‘ডিরেক্টরের মুখে মুখে কথা বলিস না। অভিনয়টা অধ্যবসায়। যা বলছি কর।’ শালা! ইচ্ছে করছিল ওর গলাটা টিপে দিয়ে দেখাই কীরকম আওয়াজ হয়। ওই শেষ। আর যাইনি।
প্রভাতসূর্য : তবে গানগুলো কিন্তু ভালো বেঁধেছিলি। ছেড়ে দিলি কেন কে জানে!
মধুস্মিতা : কোনো সেন্টু থেকে ছেড়েছে।
নীলাভ : যা ফোট!
মধুস্মিতা : শোন, গান যাকে ধরে, ছাড়ে না। তোর নিশ্চয়ই কোথাও ব্যথা আছে। সেন্টু মেরে গানে গাপ্পি দিয়েছিস।
সবুজকলি : বাদ দে তো। সবই ওর খেয়াল। এখন নয়নমণিকে নিয়ে কী আদিখ্যেতা করে ভাবতে পারবি না।
মনসিজ : নয়নমণি?
ঝাউ : লাভোর হুলো।
মনসিজ : নীলাভ? মানে হুলো মানে ও বেড়াল পুষছে?
সবুজকলি : শুধু পুষছে না। আমাদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। বেড়ালটা যতদিন ছোটো ছিল কোনো ঝামেলা ছিল না। যেই বড়ো হয়েছে ওমনি মন উচাটন হয়েছে। লাভো আবার ওর গলায় একটা লাল ফিতে পরিয়ে রেখেছে। ফিতেসমেত ও মাঝে মাঝে হাওয়া হয়ে যায়। তখন ওর দুঃখ যদি দেখতে।
মনসিজ : আহা! বাড়িতে দেখার কেউ নেই?
সবুজকলি : আরে বেড়াল কি কুকুর যে দেখে রাখবে? তা ছাড়া কাকু কাকিমা দু—জনেই চাকরি করেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ন—টা। কে বেড়াল কোলে বসে থাকবে? বাবু নিজেও তো কাজে যান।
প্রভাতসূর্য : আরও কী, ও বেড়াল হারালে খুঁজতে বেরোয়। কিছুতেই একা যাবে না কিন্তু। কলিকে ডাকবে। আমাকে ডাকবে।
সবুজকলি : একদিন কী হয়েছে শোন না, নয়নমণির দেখা নেই বেশ ক—দিন হল। কতদিন যেন লাভো?
নীলাভ : তিনদিন।
সবুজকলি : আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি। আমি, সূর্য, লাভো। ঝোপঝাড়, লেকের ধার, এর—ওর বাড়ির বাগান—কোথাও বাদ নেই। হঠাৎ পাড়ার মুখে দাঁড়িয়ে সূর্য হেঁড়ে গলায় চ্যাঁচাতে শুরু করল—নয়নমণি! নয়নমণি! কিছুতেই থামাতে পারি না। লোকে কী ভাবছে বল, সব জানালার পরদা সরিয়ে তাকাচ্ছে। হঠাৎ নীচু হয়ে হাতটা বাটির মতো করে বলে—নয়নমণি নয়নমণি, এই তোর দুধ এনেছি, আঃ আঃ, চুঃ চুঃ।
প্রভাতসূর্য : (হেসে) লাভো ছুটে এসেছে। বলে—নয়নমণি কি কুকুর যে তুই চুঃ চুঃ করছিস?
ঝাউ : তারপর নয়নমণি এল!
প্রভাতসূর্য : সন্ধ্যাবেলা এল, পা না হাত ভেঙে।
নীলাভ : সূর্যর কথা আর বলিস না। রাস্তায় যে বেড়াল দেখে, বলে—ওই তো তোর নয়নমণি! আরে, আমার নয়নমণির গলায় লাল রিবন। আর একটা কান ছোটো।
প্রভাতসূর্য : ফিতে খুলে যেতে পারে না? আর দূর থেকে রাস্তায় বেড়ালের কান মাপা যায় নাকি?
সবুজকলি : কত বললাম, ওরে হুলোদের চরিত্র কখনো ভালো হয় না। তুই একটা মেনি পোষ। না হলে তোর জন্মদিনে একটা ল্যাপডগ দিচ্ছি! শুনলে তো!
মনসিজ : গান আর নয়নমণি—দুই—ই তো থাকতে পারে।
নীলাভ : না ভাই, পারে না। গানের দেবী অন্য কিচ্ছু সইতে পারেন না। হিংসুটে মেয়েছেলে!
সবুজকলি : আবার? আবার ? (নীলাভকে মারে।) বলেছি না ওই শব্দটা উচ্চারণ করবি না?
নীলাভ : (নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে) আরে! তোরা ওটায় রেগে যাস কেন? আমরা তো বেটাছেলে বললে রাগ করি না?
প্রভাতসূর্য : তা হলে কী ঠিক হল? বাগোরা?
মধুস্মিতা : তাই চল। কীভাবে কী ঠিক কর এবার। রাত হয়ে যাচ্ছে।
নীলাভ : তা হলে বিষ্যুদবার বেরিয়ে যাই আমরা? শুক্র—শনি—রবি থাকব। সোমবার ট্রেনে উঠলে মঙ্গলবার কলকাতা পৌঁছে যার যার অফিস যাওয়া যাবে।
ঝাউ : এই না। রবিবারে ফিরব। একদিন একটু রেস্ট নিতে হবে রে!
সবুজকলি : উফ! নেকুপুষুটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। সন্দু, তুই তা হলে টিকিটের দায়িত্ব নে।
সন্দীপন : নিলাম। ওই ফ্লো চার্টই রইল তা হলে? সূর্য টিমলিডার। মধু ট্রেজারার। তুই আমি খাবার ম্যানেজমেন্টে। লাভো আগোরার দায়িত্ব নিচ্ছে।
নীলাভ : আগোরা না বাগোরা। এ নয়, বি। বিগ বি।
ঝাউ : আর আমি?
সবুজকলি : তুই আমাদের মাথা গুনবি বারবার। সবাই আছি কিনা। নিজেকেও গুনিস।
নীলাভ : একটা প্রস্তাব আছে।
সন্দীপন : বলে ফেল বাপ।
নীলাভ : কেউ সেলফোন সঙ্গে নেব না।
ঝাউ : এই না।
নীলাভ : কেন না? মনসিজর সঙ্গে পুটুর পুটুর কথা হবে না বলে? তবে শুনে রাখ, বাগোরায় সেল ফোনের সংকেত পাওয়া যায় না।
ঝাউ : রাস্তায় লাগতে পারে।
নীলাভ : কী নেশা! শোন হাঁউ, সেলফোন বিজ্ঞানের একটা তিতকুটে আবিষ্কার। বলিবে কি, সেলফোন কারে বলে, আহা! মুখোমুখি বসিবারে দেয় নাকো যাহা?
প্রভাতসূর্য : আমার মনে হয় এটা মানতে না পারার কিছু নেই।
ঝাউ : আরে সেলফোন এখন চশমার মতো। কানে না দিলে ঝাপসা শোনায়।
ঝাউয়ের প্রতিবাদ দাঁড়াল না। বাকি বন্ধুরা জানে বন—পাহাড়ের মৌনতা কী সম্মোহক! ওখানকার হাওয়ার শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, জন্তুজানোয়ারের হাঁকাহাঁকি আর পাতা নড়ার শব্দ এক গভীর ধ্যান স্থাপন করে। তাকে উপলব্ধি করতে পারার আনন্দ অমৃতের সমান। উড়োজাহাজের শব্দ তাকে কলুষিত করে। শিউরে ওঠে বনাঞ্চল। দূরভাষকোষে বেজে—ওঠা ধাতব আহ্বায়ক সুর তাকে পীড়ন করে। গাছের শরীর থেকে আদি অশ্রু পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। ফুটবার উপক্রমেও ফুল ঝরে যায় ভয় পেয়ে। জঙ্গল—তাকে চোখের পাপড়ি দিয়ে ছুঁতে হয়।
২
শিয়ালদহ ইস্টিশানে দুটি নতুন প্ল্যাটফর্ম হয়েছে, নয় এ ও নয় বি। সন্ধে সাতটা পঁচিশ। পঁয়ত্রিশে ছেড়ে যাবে আপ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। প্ল্যাটফর্মে লোকজনের ব্যস্ততা, মালবাহকদের চিৎকার, হকারের হাঁকাহাঁকি, ভিখিরির আবেদন মিশিয়ে বিচিত্র হল্লা। যতজন ট্রেনে চাপতে আসে, চাপাতেও আসে ততজন। তাই ট্রেন প্রস্তুত হলেই ভিড় হয়ে যায় কামরাগুলো। মনে হয় এত লোক একটাই কামরাতে! প্রথমদিকে প্রত্যেক যাত্রীই একে অচেনা অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে। রুক্ষভাবে বলে—ওই সাতাশ নম্বরটা কিন্তু আমার! কিংবা—আপনার সুটকেসটা একটু ঘুরিয়ে রাখুন না, আমাদেরটাও তো রাখতে হবে। বুবু, নিজের জায়গায় চুপটি করে বসো। জায়গা দখল হয়ে যাবে। তারপর ট্রেন ছাড়ার সময় হলে অতিরিক্ত লোকেরা নেমে জানালার কাছে ভিড় করে। কেউ আর কারও জায়গা দখল করে না। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেলে কিছুক্ষণ নানা স্বর—হ্যাঁ হ্যাঁ! এই ছাড়ল। হ্যাঁ পৌঁছে খবর দেব—সেলফোনে বার্তা পাঠায়। এরপর জড় বিষাদ নেমে আসে কামরা জুড়ে। বাচ্চারা কাঁদে, বায়না করে। বড়ো দল থাকলে কে কোথায় শোবে পরিকল্পনা করে। যারা একক, কিংবা দু—জন, কিছুক্ষণ আগেকার সন্দিহান দৃষ্টি ঝেড়ে ফেলে এ ওর পত্রিকা চেয়ে নেয়। একসময় পত্রিকা হাতের মুঠোয় রেখে, কিছুক্ষণ আগেকার ওই রুক্ষতাও গিলে ফেলে শুরু হয় আলাপচারিতা। কতদূর যাবেন?
দেখতে দেখতে সাড়ে সাতটা বাজল। আর পাঁচ মিনিট। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের ত্রিস্তর শয্যাযুক্ত বাতানুকূল কামরার সামনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাতসূর্য। নীলাভ ছাড়া বাকি চারজন ভিতরে বসে আছে একই উদ্বেগে। নীলাভ এখনও আসেনি। এই মুহূর্তে ওরা সবাই সেলফোনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে। কেউ মুখে কিছু বলছে না। পত্রিকায় বা ক্যামেরায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে। এখন কামরার বাইরে প্রভাতসূর্য।
প্রভাতসূর্যর ভাবনা : কোথায় আটকাল লাভোটা? সেরকম জ্যাম তো দেখলাম না। ও তো সল্টলেক থেকে আসবে। না না! ও তো বলেছিল অফিস থেকে বাড়ি ফিরবে একবার। তার মানে লেকটাউন থেকেই আসবে। আমি তো সরাসরি অফিস থেকে এলাম। মধুটাও। কলি আর সন্দুটা যদি লাভোকে নিয়েই আসত। সামনের লোকটার কাছে সেলটা চাইব? যদি ভাবে কোনো বদ মতলব আছে? যদি না বলে দেয়? লোকটা দেখতে বেশ ভদ্র। চাই? আমাকে সন্ত্রাসবাদী ভাববে না তো? চার—পাঁচদিন দাড়ি কাটা হয়নি। লোকটা কথা বলেই যাচ্ছে। এত কী কথা মানুষের? আচ্ছা, যদি এমন হয়, দুটি সেল সংযোজিত হলেই আকাশে তরঙ্গরেখা আঁকা হয়ে যাবে! সবুজ ঢেউ চলতেই থাকবে, যতক্ষণ কথা চলে! কী হবে তা হলে? নীল আকাশ সবুজ হয়ে যাবে। ওই তো নামিয়েছে। তেত্রিশ হয়ে গেল। নাঃ! বলেই ফেলি!
প্রভাতসূর্য : (জনৈক যাত্রীকে) মাপ করবেন। আমাদের এক বন্ধু এখনও পৌঁছোয়নি। আমাদের কারও কাছে ফোন নেই। আপনারটায় কথা বলতে পারি? শুধু জানব ও কোথায় আছে।
যাত্রী : কেন? ফোন নেই কেন? আজকাল ফোন ছাড়া কেউ পথে বেরোয়?
প্রভাতসূর্য : না, মানে, আছে। আমরা আনিনি। আপনার অসুবিধে থাকলে..
যাত্রী : না না! অসুবিধে কী! বলুন নম্বরটা!
প্রভাতসূর্য নম্বর বলছে। ভদ্রলোক ডায়াল করছেন। কানে চাপলেন। সুইচড অফ। আবার আবার। প্রভাতসূর্য ধন্যবাদ জানিয়ে আলোর সংকেত দেখল। এখনও লাল আছে।
ঝাউয়ের ভাবনা : বললাম ফোন ছাড়া চলে না আজকাল। বিশ্ববখাটেগুলো শুনলে তো! মনসিজ কী করছে এখন? লাভোটার আর কী! দিয়ে দিল প্রস্তাব। প্রেম তো করল না জীবনে। আশ্চর্য কিন্তু। বেশি আকর্ষণীয় বলেই ওর বউ, মানে প্রেমিকা জুটল না। সূর্যটা পর্যন্ত যাজ্ঞসেনীর সঙ্গে প্রেম করেছে কিছুদিন। আচ্ছা, সূর্যকে কী করে ল্যাং মারল যগ্যি? সূর্যর মধ্যে একটা নিরুত্তেজ ভাব আছে। কতখানি গরম বোঝা যায় না। ধুস! কীসব ভাবছি! সূর্য সেক্সি কিনা শেষ পর্যন্ত তাই ভাবতে হবে নাকি? ধুস! সমবয়সি বন্ধুদের শরীর নিয়ে ভাবতে বিচ্ছিরি লাগে। একটু বড়ো বয়সের বরই আমার পছন্দ।
সন্দীপনের ভাবনা : কেন যে লাভোটাকে তুলে আনলাম না। ওই তো বলেছিল, তোরা চলে যাস। খাবার ম্যানেজার হওয়ার ঝামেলা কম নাকি? দু—দিন থাকব কিন্তু নিতে হল সবই। বাগোরায় কিছু পাওয়া যায় না। আমি আর কলি তো বেরিয়ে বাজার করে স্টেশনে এলাম। সঙ্গে সূর্যর ব্যাগ, মধুর ব্যাগ। লাভোর ব্যাগই গোছানো হয়নি। হলে আমরা আনতে পারতাম। আর এনেই বা কী লাভ হত? কোথায় আটকাল? সাতটা চৌত্রিশ। সূর্যর এবার ট্রেনে উঠে পড়া উচিত। এখান থেকে কারও ফোন ম্যানেজ করে দেখলে হয়। কিন্তু হিসেবমতো লাভোর এখন স্টেশনের মধ্যে চলে আসার কথা। ফোন কি সঙ্গে রাখবে? মোটেই না। ও এসব ব্যাপারে দারুণ সিরিয়াস। পাগলের মতো বন ভালোবাসে। সিমলিপালে দাবানল থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল পশুরা। লাভোটা কেঁদে ফেলেছিল। ভেতরটা খুব নরম। পরশু রাতে হঠাৎ চলে এল। বলে, থাকব তোর সঙ্গে। থাক। মাঝরাতে আমাকে ঠেলে তুলেছে। কী হল? ঘুম আসছে না। আর কোনো কথা হয়নি। ও একটু অস্থির আছে। কারণটা বলবে ঠিকই। এখন আয় বাবা। আর টেনশন দিসনি।
মধুস্মিতার ভাবনা : কিছু হল না তো লাভোর? ও খুব দায়িত্বসচেতন। বাইরে ছ্যাবলামো করে। পেছনে লাগে। আসলে খুব গভীর আর চাপা। পরশু রাতে সন্দুর সঙ্গে ছিল। ভোর পাঁচটায় আমাকে ফোন করে তুলল। বলে, মধু, আমার গানগুলো তোর মনে আছে? আছে তো। এই জানতে তুই আমায় জাগালি? আমি এখন কোথায় বল তো? কোথায়? সন্দুর ঘরে হা হা! একটা গান শোনা মধু। চলে আয়। না না, কাকু—কাকিমাকে বিরক্ত করব না। ফোনে শোনা। যেন কত দূর থেকে তুই গাইছিস এমনভাবে শুনব। তোর গান? ধুস! ও তো তোরা সর্বত্র গাস। বনে, পাহাড়ে, তাঁবুতে, ট্রেনে। আমার মাথা খারাপ যে ভোরবেলা নিজের গান শুনতে চাইব? গান লেখা ছেড়ে দিলি কেন রে? কোনো ব্যথা থাকলে বল না আমাদের? ব্যথা? না রে মধু! সব ব্যথা কি বলা যায়? আমরা তো কেউ কিচ্ছু লুকোইনি এতকাল। তবে কি এই আমাদের দূরত্ব শুরু হল লাভো? না রে না! ব্যথা—ফ্যাতা নেই। উফ! জেরা না করে গানটা শোনা। কোন গান শুনবি বল? ওই যে, রবীন্দ্রসংগীত—বীণা বাজাও হে…। বীণা বাজাও হে মম অন্তরে/স্বজনে বিজনে, বন্ধু, সুখে দুঃখে বিপদে—আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে… চুপ করে ছিল। আমিই ডাকলাম। কীরে আছিস? মধু, গান ছাড়িস না কখনো। না ছাড়ব না। কথা দিচ্ছিস তো? তুই ছাড়লি কেন? আমার কথা বাদ দে। ওসব শখের গানবাজনা। সন্দু তো ভালো রোজগার করছে। তুই চাকরি ছেড়ে দে। শুধু গান কর। তাই হয় পাগল? কেন হয় না রে? আত্মনির্ভরশীল হবি? সন্দু যদি তোর মতো প্রতিভা পেত, তুই ওকে সুযোগ দিতি না? দু—জন যদি পরস্পরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে নাই পারল, তা হলে আর কীসের ভালোবাসা বল তো? আজ অফিস যাবি না? যাব তো। তা হলে একটু ঘুমো এবার। আমার কথাটা ভাববি তো মধু? ভাবব রে ভাবব। কিছু একটা ছিল ওর স্বরে। আনন্দের অভাব। বিষাদ। কেন? কোনো কিছুতে কষ্ট পেয়েছে। কী সেটা? দেখি, বাগোয়ায় গিয়ে সবাই মিলে চেপে ধরব। না। তা হলে আর গুটিয়ে যাবে। একাই ওকে নিয়ে বসব একদিন। এখনও তো এল না। ইস, লাভোটা না এলে যাবারই কোনো মানে হয় না। সারাক্ষণ ও—ই তো মাতিয়ে রাখে।
সবুজকলির ভাবনা : ও চিজ ভালোবাসে বলে একগাদা নিলাম। ভাত খাবার পর বাবুর মশলা লাগে বলে ক্রোড়পতি গুলিয়া নিলাম। শুধু ওটা নেব বলেই আমরা ফুলবাগান মোড়ে গোকুলচাঁদে গেছি। আর দেখো, কোনো পাত্তা নেই? কাল রাতে এসে বলে, নয়নমণির ভার নিবি কলি? অসম্ভব। তার চেয়ে তোর ভার নেওয়া সোজা। তোর হঠাৎ নয়নমণিকে ভার লাগছেই বা কেন? দেখাশোনা করতে পারছি না যে। মাকে বললাম, চাকরি ছেড়ে নয়নমণির ভার নাও, চটে গেল। তা তুই তো খুব আহ্লাদের কথা বলিসনি। নয়নমণি এখন অ্যাডাল্ট হয়েছে। ওকে অত চোখে চোখে রাখার কী আছে? কাকু—কাকিমা যদি এখন তোকে চোখের আড়াল করতে না চান তোর ভালো লাগবে? শুনে হ্যা হ্যা করে হাসল। স্রেফ আড্ডা মারতে এসেছিল পাজিটা। যত দুর্বুদ্ধি ওর মাথায়। একদিন বলে, মানুষের কোন অংশটা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত বল তো? সবাই বললাম পা। বলে, না পশ্চাদ্দেশ। ওই দেশটার কথা কেউ ভাবে না রে! ভারতবর্ষের চেয়েও খারাপ অবস্থা। উফ, পারেও। আসুক আজ। কিলোব।
সাতটা পঁয়ত্রিশ। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে জ্বলে উঠল সবুজ সংকেত। যাত্রীরা যারা বাইরে ছিল, ব্যস্ত পায়ে ট্রেনে উঠল। প্রভাতসূর্যও উঠল। কাচের দরজা ঠেলে চলে এল বন্ধুদের কাছে। সবাই মুখ গোমড়া করে আছে। ট্রেন দুলে উঠল। গতি বাড়াল।
ঝাউ : কী হবে?
প্রভাতসূর্য : দেখি, বিধাননগর স্টেশনে উঠতে পারে। সন্দু ও কোচ নাম্বার জানে তো?
সন্দীপন : বলে তো দিয়েছিলাম। আতাক্যালানেটার মনে আছে কিনা।
ঝাউ : বললাম ফোনটা আনি।
প্রভাতসূর্য : আনলে কী হত? এখন ওদের বাড়িতে কেউ থাকে না। একজনের ফোনে চেষ্টা করেছিলাম। লাভো সুইচড অফ।
সবুজকলি : বাংলোর বুকিং স্লিপটাও তো ওর কাছে।
প্রভাতসূর্য : সেটা কথা না। আমরা বাগোরা না গিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারি। কিন্তু ও ফাঁসল কোথায়?
(বিধাননগর স্টেশন। ট্রেন থেমেছে।)
প্রভাতসূর্য ও সন্দীপন : দরজায় এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। মেঝেয় আরশোলা দৌড়োচ্ছে। প্রভাতসূর্য একবার পতঙ্গহত্যার ওষুধ প্রয়োগের তারিখ দেখে নিল। মাত্র দু—দিন আগের। আবর্জনার পাত্রের চারপাশে এরই মধ্যে কিছু প্যাকেট জমেছে। অথচ পাত্রটি ফাঁকা। যে ফেলেছে, ভেতরে ফেলার দায়িত্ব বোধ করেনি। টয়লেটের দুর্গন্ধ আসছে থেকে থেকে। ওরা যেখানেই যায়, রুম ফ্রেশনার, হ্যান্ডরাব, টিসু পেপার, ন্যাপকিন, ওষুধপত্র, টর্চ, দড়ি সঙ্গে রাখে। ট্রেকিং—এর অভ্যাস। ব্ল্যাকটেপ, ছুরি, সয়েল ব্যাগও বাদ থাকে না। নীলাভ এখানেও উঠল না। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। ওরা ভেতরে এল। কারও মুখে কথা নেই। এত চুপচাপ ওরা কখনো ভ্রমণ করে না। ট্রেন দমদম পেরিয়ে গেল। এরই মধ্যে কেউ কেউ ঝিমোচ্ছে। পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে নীলাভ উপস্থিত।
নীলাভ : এসে গেছি! এসে গেছি!
সবুজকলি : কোথায় ছিলি এতক্ষণ! পাজি কোথাকার!
নীলাভ : (ব্যাকপ্যাক খুলতে খুলতে) আর বলিস না। অসময়ে ওপরওলা ডাকলে যা হয়।
সবুজকলি : তোর বস কি স্যাডিস্ট? জানে না তুই আজ ট্রেন ধরবি?
নীলাভ : জানিসই তো জীবন! কে কোথায় ফেঁসে যায় কে বলতে পারে!
সবুজকলি : গুল্লু থামা। কী হয়েছিল তাই বল।
নীলাভ : ওই যে বললাম।
প্রভাতসূর্য : তুই উঠলি কোথায়?
নীলাভ : বিধাননগরে।
প্রভাতসূর্য : আমরা তো দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম। তোকে দেখতে পেলাম না তো।
নীলাভ : পাবি কী করে? আমি তো ট্রেন ছেড়ে দেবার পর পেছনের একটা কামরার হাতল ধরে ঝুলে পড়লাম। তারপর ভেস্টিবিউল দিয়ে এসেছি।
মধুস্মিতা : খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলি লাভো!
নীলাভ : ওফ! যা ফেঁসে গিয়েছিলাম, জাস্ট একটা জিনিসের জন্য আসতে পারা গেল।
ঝাউ : কী জিনিস রে, কী জিনিস?
সন্দীপন : কী আবার? বাংলোর বুকিং স্লিপ। ওটা দেখিয়ে বসের কাছ থেকে ছাড়া পেলি?
বোতলের সিল খুলে গলায় জল ঢালতে ঢালতে হাসল নীলাভ।
৩
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সকাল সাতটা। মেঘলা আকাশ। ব্যাগপত্র বয়ে এক জায়গায় রাখল ওরা। গাড়ি ঠিক করতে হবে। পিসিও থেকে বাড়িতে ফোন করতে হবে। চাল, ডাল, মুরগি, মশলা বাজার করতে হবে। চা—ওয়ালা এল। সবাই চা নিল একটা করে। সবুজকলি বাস্কেট থেকে বিস্কিট বার করে সবাইকে দিল। পার্কিংয়ে এই সকালেও অনেক গাড়ি। বেশ শীত—শীত লাগছে ওদের।
সবুজকলি : সবাই জ্যাকেট পরে নে।
যে যার ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে পরছে।
প্রভাতসূর্য : মধু চল আমরা গাড়ি ঠিক করি। সন্দু লাভো তোরা ফোনটা করে দে বাড়িতে। মালগুলো দেখিস সবাই।
দু—দল দু—দিকে গেল।
ঝাউ : কত ভিখিরি দ্যাখ।
সবুজকলি : খুব বেড়ে গেছে। আগে এখানে এত দেখিনি।
ঝাউ : কষ্ট লাগে। আমরা মজা করছি, আর ওরা…
সবুজকলি : এটাই জীবন হাঁউ। কষ্ট তো হয়—ই। এবার ফিরে আমরা আমাদের এনজিও রেজিস্ট্রেশন করব। লাভো সব স্কিম করেছে। কাজ গোছানোই আছে।
ঝাউ : হ্যাঁ। সেই কলেজের প্ল্যান, না? নাম তো অনেক এসেছিল। কোনটা রেজিস্ট্রেশনে যাবে রে? আমরা কি শুধু বৃত্তি দিচ্ছি?
সবুজকলি : না না। বছরে আপাতত চারজনের হস্টেলে থেকে পড়ার খরচ। গ্রামাঞ্চলের দুস্থ অথচ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য। নাম হল ষাড়ব। মধু দিয়েছিল। দ্যাখ দুটো ঠিক ঝগড়া করতে করতে আসছে। নীলাভ বলেছে,আমাদের বৃদ্ধাবাসের নামটাও হবে ষাড়ব। সেটা নাকি ষাঁড়বও হয়ে যেতে পারে। (দু—জনের উচ্চকিত হাসি।)
সন্দীপন : বলছি কারও সেল চেয়ে ফোন করি, দেবে না।
নীলাভ : কেন দেব? কথা ইজ কথা।
সবুজকলি : বুথে পেলি না?
সন্দীপন : ঝাউয়ের বাড়িতে ফোন করলাম, মনসিজকে করলাম, পরিষ্কার। যেই আমার বাড়িতে করেছি ওমনি খ্যার খ্যার খ্যার। বোধহয় লেকটাউনের সব লাইন খারাপ। তোদের বাড়িতেও এক অবস্থা। কারও সেলের নম্বর মনে নেই।
সবুজকলি : অন্য বুথে যা। আমাদের পাড়ার অন্য একজনকে বললেই তো হবে।
নীলাভ : আমি দেখছি। আমি বলে দিচ্ছি। কলি, তোর মা—র সেল নম্বরটা বল তো। আমি বাড়িতেও বলে দিচ্ছি।
নীলাভ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরেও এল।
নীলাভ : সব্বাইকে বলে দিলাম।
সবুজকলি : সব ঠিকঠাক?
নীলাভ : (অন্যমনস্ক) না রে! কাল নয়নমণি চারতলা থেকে পড়ে গিয়ে…
ঝাউ : মারা গেছে!
নীলাভ : (হেসে) না। আহত হয়েছে। মাথায় চোট পেয়েছে। যাক গে! ওদের গাড়ি ঠিক করতে এতক্ষণ লাগছে কেন? তোরা দাঁড়া। আমি দেখি। সন্দু, অবলাগণ তোর দায়িত্বে রইল।
সবুজকলি নীলাভকে মারতে যায়। নীলাভ হাসতে হাসতে সরে পড়ে। সবুজকলি তাকিয়ে থাকল ওর যাবার দিকে।
সবুজকলি : আশ্চর্য খেয়ালি ছেলে। নয়নমণির জন্য অস্থির। অথচ এখন মনে হল কিছুতেই কিছু যায় আসে না। মাথায় চোট পেয়েছে শুনেও বিকার নেই। গাড়ি ঠিক করতে চলে গেল।
৪
পার্কিং লট। প্রভাতসূর্য ও মধুস্মিতা একের পর এক গাড়ি ধরছে। একটু বড়ো গাড়ি চাই ওদের। ছ—জন মানুষ। এত ব্যাগেজ।
গাড়ি ১ : বাগোরা? নামই শুনি নাই।
প্রভাতসূর্য : আমরা চিনিয়ে নিয়ে যাব।
গাড়ি ২ : না না। ওইদিকে যাব না। রাস্তা খারাপ।
মধুস্মতা : রাস্তা তো সব জায়গাতেই খারাপ।
গাড়ি ৩ : যাওয়ার ইচ্ছা নাই। কেন, অত বলতে পারব না।
নীলাভ : কীরে, গাড়ি পেলি না?
মধুস্মিতা : কী জায়গা রে! দাঁড়িয়ে আছে, তবু যাবে না! কারণ ইচ্ছে করছে না!
নীলাভ : চল, ওই গাড়িটা ধরি। ওই দূরের সুমোটা। কেউ তো যাবেই।
তিনজনে এগোল। ওদেরই মতো একটি ছেলে। এককথায় রাজি হয়ে গেল। ওর নাম পটাই। গাড়ির পেছনে লেখা পটাইয়ের গাড়ি। মধুস্মিতা কথা বলে নিল টাকাপয়সার ব্যাপারে। গাড়ির অবস্থা দেখে নিল। পটাই গাড়ির যত্ন করে।
প্রভাতসূর্য : লাভো, আজ একটা ভুটান বাম্পার কেন।
নীলাভ : গাড়িটা লেগে গেল বলে? ক্ষমতা বন্ধু ক্ষমতা।
প্রভাতসূর্য : তোর এরকম দূরদর্শী ক্ষমতা আগে দেখিনি কিন্তু। যা দূর থেকেই গাড়িটা টার্গেট নিলি!
নীলাভ : (জোরে হেসে) সূর্য, তোর কথায় কলির টান লেগেছে।
প্রভাতসূর্য : চ্যাংড়ামো করিস না।
গাড়ি চলছে। সামনে নীলাভ ও মধুস্মিতা। মাঝে প্রভাতসূর্য, সবুজকলি, ঝাউ। পেছনে মালসমেত সন্দীপন।
নীলাভ : পটাই, তোমার বাড়ি কোথায়?
পটাই : মকাইবাড়ির নাম শুনেছেন? ওই মকাইবাড়ি।
নীলাভ : গাড়িটা তোমার?
পটাই : হ্যাঁ। দেখলেন না পেছনে লেখা?
নীলাভ : কেমন রোজগার হয় গাড়ি থেকে? ভালো?
পটাই : ওই, ভগবানের কৃপায় চলে তো যাচ্ছে। বাবা—মা, বউ, দুই বাচ্চা, দুটো বোনের বিয়ে দিলাম। আগে একটা মারুতি ভ্যান ছিল। আমার প্রথম গাড়ি। বেচে এটা কিনলাম।
নীলাভ : তোমার দুই বাচ্চা? কত বড়ো?
পটাই : একটা পাঁচ, একটা তিন!
নীলাভ : তোমার বয়স কত পটাই?
পটাই : (লাজুক হেসে) এই পঁচিশ। আঠেরো বছরে বিয়ে করেছিলাম। বউকে নিয়ে পালিয়ে, সেবক কালীবাড়ির নাম শুনেছেন তো? ওখানে বিয়ে করেছিলাম। সিঁদুর পরিয়ে বললাম, তুমি আমার আমি তোমার। আপনারা বাজার করবেন তো? আজকে শুকনা হাট আছে। সকাল থেকে বসে যায়। ওখানে করে নিতে পারেন। বাগোরাতে কিছু পাওয়া যাবে না।
আকাশে ঘনিয়ে এসেছে কালচে—নীল মেঘ। ওরা দ্রুত বাজার সারল। বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোতেই ঝড় উঠল দারুণ। মেঘ নেমে এসেছে এমন, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। কালো মেঘের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ধুলোর ঘূর্ণি আর হাজার হাজার ঝরা পাতা। গাছের ডালপালা এলোমেলো অস্থির দুলছে। আছড়ে পড়ছে বাঁশ। ওরা জানালার কাচ তুলে দিয়েছে। চুপ করে ঝড়ের রূপ দেখছে। কথা বলতে ভুলে গেছে, খিদের কথা ভুলে গেছে। খোলা আকাশের তলায়, খোলা প্রান্তরে বড়ো বড়ো গাছগাছালির ঝাঁকে এমন অনিরুদ্ধ ঝড় ওরা কলকাতায় দেখতে পায় না। ঝড় তাণ্ডব। কিন্তু তাণ্ডবও মনোমোহন।
গাড়ি শুকনা বনে ঢুকল আর ঝাঁপিয়ে এল বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টিময় ঘন অন্ধকার। ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্য বৃক্ষসব কোল দিতে চাইল ওদের। ওদের আড়াল করে নিজেরা ভিজতে থাকল। উইন্ডস্ক্রিনে মুহূর্তে জমে যাচ্ছে অসংখ্য ফুল পাতা। প্রভাতসূর্য সচেতন হল। এত দুর্যোগে একটুদাঁড়িয়ে যাওয়া ভালো। আকাশ কাঁপিয়ে চমকাল বিদ্যুৎ।
প্রভাতসূর্য : চল, এখানে গাড়ি থামিয়ে খেয়ে নিই। ততক্ষণে ঝড়বৃষ্টি কিছুটা ধরে যাবে।
গাড়ি থামল একটি অচেনা গাছতলায়। তার থেকে শত শত ফুল পড়ছে বাতাসে দ্রুত পাক খেতে খেতে। যেন অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট প্যারাসুট। ওরা কেউ জানে না এ কী ফুল! কী গাছ! পটাইও জানে না। প্লেট বেরুল। কলা, ডিমসেদ্ধ, পাউরুটি, জ্যাম, সন্দেশ বেরুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রেকাবি ভরে উঠল জলখাবারে। সবুজকলি সবার হাতে হাতে খাবার এগিয়ে দিল। এতক্ষণে সবাই খিদে বোধ করছে। ঝড়ের মোহময়তার ঘোর আর নেই। বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়ার দাপট কমে যাচ্ছে। নীলাভ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঝাউকে দেখল।
নীলাভ : হাঁউ, এই যে বৃষ্টি নামল, আমরা বাগোরায় গিয়ে কী দেখব বল তো?
ঝাউ : আমি কী করে জানব? আমি কি গিয়েছি আগে?
নীলাভ : সে তো আমরাও যাইনি? তবু জানি। ওখানে গিয়ে আমরা দেখব পাইন বন। দুশো তিনশো ফিট বা তারও বেশি উঁচু। দেখব কতরকম ফুল, ফল। একরকমের ফুল—সে তো তুই দেখলেই আঁতকে উঠবি। ঠিক সাপের ফণার মতো। আবার লম্বা জিভও বেরিয়ে আছে। স্থানীয় লোকেরা ওকে বলে বাকো। শহুরেরা বলে স্নেক অর্কিড। আর কী দেখব বল তো? আর দেখব পাহাড়ের পর পাহাড় সাজানো ছবি, পাহাড়ি মানুষ, আর জোঁক!
ঝাউ : জোঁক! ও মা গো! গায়ে উঠবে না তো?
নীলাভ : ছাতা এনেছিস? আনিসনি। গায়ে কী? গাছ থেকে টুপ করে মাথায় পড়বে। পা বেয়ে ট্রাউজারে ঢুকে যাবে। অস্থান কুস্থান কিচ্ছু কি বাদ রাখবে? এই মধু—কলিদের জিজ্ঞেস কর না, সেবার বাক্সা ফোর্ট যেতে কী হয়েছিল, কিংবা সিকিমের উত্তরেতে?
ঝাউ : ওমা! আমি কোথাও যাব না। ঘরে বসে থাকব। জোঁকের মুখে নুন—এই তোরা ক—প্যাকেট নুন নিয়েছিস?
পটাই : গায়ে একটু কেরোসিন তেল মেখে নেবেন না তামাকপাতা, জোঁক ধরবে না।
ঝাউ : অ্যা ম্যাঃ!
প্রভাতসূর্য : ওকে ভয় দেখাস না লাভো। হাঁউ, আমরা এতজন আছি, জোঁক একা তোকে ধরবে কেন? ভাগ হয়ে যাবে, ভাবিস না।
সবুজকলি : ও এখন মা—র কাছে ফিরে যেতে চাইলে আমি কিন্তু নিয়ে যেতে পারব না। (সবাই হাসে। সবুজকলি একটা বড়ো সেলোফেন প্যাকেট এগিয়ে দেয়।) এর মধ্যে যার যার প্লেট ফেলো। বাগোরায় নিশ্চয়ই ডাস্টবিন পাব।
পটাই : কার্শিয়াঙে পাব। ফেলে দেব।
বৃষ্টি পড়ছে। ঝড় নেই। গাড়ি চলতে শুরু করল।
সন্দীপন : এই মধু। চুপ করে আছিস কেন? পেট পুরে খাওয়ালুম, এবার গা। হিট আর্টিস্ট দু—জনেই তো সামনে।
মধুস্মিতা ধরল। বন—পাহাড় নিয়ে নীলাভর লেখা গান। এই গানটায় মধুস্মিতা সুর দিয়েছিল। বন্ধুরা গলা মেলাল। একের পর এক নানাধরনের গানের মধ্যে দিয়ে ওরা অতিক্রম করেছিল বৃষ্টিভেজা পথ। সবুজকলি দেখল অন্যমনস্ক হয়ে আছে নীলাভ।
সবুজকলির ভাবনা : লাভোটার হল কী? এবারের মতো উদাস আগে কখনো দেখিনি। হইচইয়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু প্রাণের অভাব। আগে কিছু হলে হুড়মুড় করে সব বলে দিত। কলেজ—ইউনিভার্সিটি পর্যন্তই সব ঠিক আছে। কাজের জগতে ঢুকে পড়লে বন্ধুদের সবার আলাদা আলাদা জগৎ। আলাদা বিপন্নতা। আলাদা বিরক্তি। ঈর্ষা। প্রতিযোগিতা। আমার অফিসে যেমন শাঁওলির সঙ্গে হচ্ছে। বসের মন পাবার জন্য শরীর… উঃ জঘন্য! সহ্য করতে পারি না। এরকম কয়েকটা মেয়ের জন্যই পুরুষগুলো সব মেয়েকে খাদ্য ভাবে। কাজের সঙ্গে শরীরটা ভাবে ডিউটি—ফ্রি চিজ! সবাই কি একরকম? না, তা না। তবে শাঁওলির ব্যাপারটা বন্ধুদের এখনও বলিনি। কত না বলা কথা জমে যাচ্ছে। আগের মতো রোজ তো আড্ডা হয় না। খুব মিস করি। কী টান ছিল! ছুটির দিনেও গ্রুপ স্টাডির নাম করে হি হি! এখন কি টান কমে গেছে? ধুস! বৃদ্ধ বয়সে একই বৃদ্ধাবাসে থাকব না সবাই?
৫
এখন আর বৃষ্টি নেই। কার্শিয়াঙের পর থেকে পথ ক্রমশ সংকীর্ণ আর এবড়োখেবড়ো। তেমনি খাড়াই। পথের ধারে আশ্চর্য ফুলের মালা। কী অপার্থিব বর্ণময়তা তাদের। বন ক্রমশ ঘন হচ্ছে। তারই মধ্যে পথের ধারে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাড়ি। কাচের জানালা। বারান্দায় কালো সেলোফেন প্যাকে ফুলের গাছ। দু—পাশে দীর্ঘ দীর্ঘ পাইনের সারি আর তাদের মাথায় আটকে থাকা মেঘ। দূরের পাহাড়ে মেঘের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে ছোট্ট গ্রাম। সবুজ খেত।
প্রভাতসূর্য : চল, এখানে সবাই মিলে একটা বাড়ি কিনি।
সবুজকলি : এ নিয়ে ক—টা কিনলি? তা ছাড়া ভেবে দ্যাখ, নুন কিনতে কার্শিয়াং যেতে হবে। ডাক্তার ডাকতে শিলিগুড়ি নামতে হবে। সংসারী হতে চলেছিস, এসব ভাব সূর্য।
নীলাভ : অসুবিধে আছে ঠিকই কলি, কিন্তু এই সবুজ, এই নির্মল বাতাস—এর মধ্যে শরীরে রোগ ধরে না রে। আর সৌন্দর্যটা ভাব, কোনো কথা হবে না। বৃদ্ধাবাসটা আমরা কোনো পাহাড়েই করব বুঝলি।
সবুজকলি : কেন? তোর তো পাহাড় ভালো লাগে না। প্রতিবার যাওয়া চাই, ঘ্যানঘ্যানও করা চাই।
নীলাভ : এ ব্যাপারে আমি ক্যাপ্টেন হ্যাডক। কী হবে পাহাড়ে চড়ে? সেই তো নেমেই আসতে হবে। আরে পাহাড় হবে এইরকম। সবুজে সবুজ। তোদের ওই ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়? ধুস!
সন্দীপন : কী ঝাঁকুনি রে বাবা!
সবুজকলি : এতে যদি একটু ঝরিস।
সন্দীপন : ঝরব ঝরব, বললাম না, বিয়ের পর, মধু যা খাটাবে! একদিন ইয়ে না হলে ওর নাকি ইয়ে হবে না।
সকলে প্রাণ খুলে হাসে। এভাবেই পৌঁছে যায় বাংলোয়। সুন্দর সুসজ্জিত কাঠের বাংলো। দুটি শোবার ঘর। দুটি স্নানঘর। একটি বিরাট লবি। একপাশে খাবার টেবিল। একপাশে ফায়ার প্লেস ঘিরে বসার আয়োজন। এখানকার কেয়ার টেকার ও কুক ওয়াংদি। পাহাড়ি মানুষ। বয়স বোঝা যাচ্ছে না। বাংলোর সামনে বড়ো লনে প্রচুর রডোডেনড্রন গাছ। তাতে ফুলের গুচ্ছ। এ ছাড়াও আছে বিবিধ মরশুমি ফুল। তারপাশে ঘন বনে ঘেরা। বাংলোর পেছন দিয়ে পাকদণ্ডী চলে গেছে ওপরের দিকে। বেলা দুটো বেজে গেছে। পটাই নেমে গেল। রবিবার এসে ওদের নিয়ে যাবে। নীলাভ ছাড়া কেউ স্নান করল না। দারুণ ঠান্ডা এখানে। রাতে সৌর বৈদ্যুতিক আলো পাবে। দশটা পর্যন্ত।
পেট পুরে খিচুড়ি, ডিমভাজা আর স্যালাড সাঁটিয়ে ওরা হাঁটতে বেরোল। দেখল বাংলোটা এক উপত্যকায়। এখান থেকে টানা খাড়াই চড়ে তারপর পাকদণ্ডী পথ। সদ্য খেয়ে এসে চড়াই উঠতে হাঁপিয়ে গেল ওরা। পাকদণ্ডী দিয়ে একটি ছোট্ট বস্তিতে এল যখন, সন্ধ্যা নামছে। দুটি—তিনটি দোকান আছে কিন্তু জিনিস প্রায় নেই। এখান থেকে রাস্তা দু—ভাগ হয়ে গেছে। একটি গিয়েছে মিলিটারি ক্যাম্পের দিকে। অন্যটি রাজহাট্টা গ্রাম। তার পরেও আরও কত গ্রাম। কত পাহাড়। যে রাস্তায় হাঁটছে ওরা তার নাম ওল্ড মিলিটারি রোড। ওরা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। ক্রমশ আঁধার নামছে। আকাশে ঘন মেঘ। চাঁদ আর দেখা যাবে না। বিদ্যুৎ চমক দিচ্ছে। ক্যাম্পের কাছাকাছি কয়েকটি পথবাতি। বস্তির মধ্যেও কয়েকটা। বাতাস বইছে। ওদের হাঁটতে ভালো লাগছে। বিদ্যুৎ চমকাল। প্রভাতসূর্য আকাশের দিকে দেখল। ওর সঙ্গে ব্যাকপ্যাক। তার মধ্যে জরুরি জিনিসপত্র। অন্যদের হাত খালি।
প্রভাতসূর্য : চল ফেরা যাক। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।
ফেরার পথ ধরল ওরা। অবতরণ দ্রুত করা যায়। হাওয়ার দাপট বাড়ছে। ওরা গতি বাড়াচ্ছে। অনভ্যাসে পিছিয়ে পড়ছে ঝাউ। নীলাভ ওর হাত ধরেছে। প্রভাতসূর্য টর্চ নিয়েছে হাতে। বস্তি পেরিয়ে গেল নির্বিঘ্নে। পাকদণ্ডী বেয়ে নামছে। বিদ্যুৎ ঝলসে দিল সারা আকাশ। হাওয়া বাড়ল হঠাৎ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল বড়ো বড়ো ফোঁটায়। ঠান্ডা, বৃহদাকার বৃষ্টি ওদের শরীরে আঘাত করতে লাগল। নিকষ কালো আঁধারে ওরা কেউ কারোকে দেখছে না। শুনছে না। প্রবল বৃষ্টির ধারা ওদের দিকভ্রান্ত করে দিল পুরোপুরি। একটু ভুল পা ফেললেই মরণান্ত ফাঁদ। প্রভাতসূর্যর আলো লক্ষ করে এগোচ্ছে তবু। ও হোঁচট খেল। হাত থেকে ছিটকে পড়ল টর্চ। এখন কোথাও কোনো আলো নেই ক্ষণিকের বিজলি ঝিলিক ছাড়া।
প্রভাতসূর্য : (চেঁচিয়ে) যে যেখানে আছিস, দাঁড়া। নড়িস না। আমি টর্চ খুঁজে দেখছি।
নীলাভ : (চেঁচিয়ে) খবরদার না। কোথায় খুঁজবি? শোন, আমরা ওপরে আর উঠতে পারব না। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলে কাল নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। আমাদের নামতে হবে। সূর্য তোর ব্যাকপ্যাকে দড়ি আছে?
প্রভাতসূর্য : আছে, বার করছি।
নীলাভ : আওয়াজ কর জোরে। আমরা শব্দ শুনে তোর কাছে যাচ্ছি। আওয়াজ কর, থামবি না।
প্রভাতসূর্য : (দড়ি বার করতে করতে) হোও হো ও হো ও…
ওরা একে একে প্রভাতসূর্যের কাছে এল। সন্দীপন আর সবুজকলি সবার কোমরে দড়ি বাঁধছে। শৃঙ্খলের মতো।
নীলাভ : শোন, আমি সবার আগে যাচ্ছি। সূর্য তুই সবার পেছনে যা। তোর আগে সন্দুকে নে। সবাই হাতের শেকলে থাকবি। টানে টানে নেমে যাব।
সবুজকলি : তুই এই অন্ধকারে দেখতে পাবি কী করে?
নীলাভ : তোরাও পাবি। বিদ্যুতের আলোয়।
প্রভাতসূর্য : দড়ি শেষ। আমাকে আর বাঁধা যাবে না।
নীলাভ : সন্দুর হাত ধর। শক্ত করে ধর। চল। আমি গাইছি। চোখ—কান খোলা রাখ। (গান ধরে) ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণীতল।
পায়ে পায়ে চলে ওরা। পাকদণ্ডী পেরিয়ে খাড়াইতে চলে আসে। বৃষ্টি কমার নাম নেই। শীতে কাঁপুনি লেগে যাচ্ছে। জ্যাকেটগুলো ভিজে যাচ্ছে। বাড়তি সকলের থাকার কথা। ওরা অভিজ্ঞতায় জানে বাড়তি নিতে হয়। এই বৃষ্টিতেও পদস্খলনের ভয়ে ওদের গলা শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি পথকে অবজ্ঞা করতে নেই। হালকাভাবে নিতে চাই। এখানে পায়ে পায়ে বিপদ। ওরা কর্কশ বিদ্যুতালোকে নীলাভনির্ভর হয়ে নিরুপায় চলে। আর কতদূর? নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পথ যেন ফুরোয় না।
প্রভাতসূর্যর ভাবনা : আজ লাভোটা দারুণ ফর্মে আছে। এমন হাঁটছে যেন কতবার এসেছে। ও না থাকলে বিপদে পড়তাম। টর্চটা হঠাৎ পড়ে গেল। একটু হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। ভাগ্যিস লাভো স্নায়ু হারায়নি। ও আমাকে নিখুঁত বুঝতে পারে। আজ পর্যন্ত আমার ব্যাপারে ওর ভুল হয়নি। যেই বুঝেছে আমি ধসে গেছি, লিড নিয়েছে। আমারই ভুল। এরপর দ্বিতীয় কারোকে ইকুইপড রাখতে হবে।
একটা হ্যাঁচকা। সন্দীপন হোঁচট খেল। প্রভাতসূর্যর হাত ছেড়ে গেল। হাত ধরার জন্য দ্রুত এগোচ্ছে। নীলাভর চিৎকার হল্ট! হল্ট এভরিবডি! কেউ নড়বি না! নীলাভ শৃঙ্খল সমেত পিছিয়ে এল। প্রভাতসূর্যর হাত ধরল। বিদ্যুৎ ঝলসাল। শিউরে উঠল ওরা। আর দু—পা। প্রভাতসূর্য খাদে পড়ে যেত না থামলে!
৬
সকালে ঝকঝকে রোদ। ওরা লনে খাবার টেবিল সাজিয়ে চা নিয়ে বসেছে। টেবিলে দূরবিন। পাখি চেনার বই। চায়ের পট, কাপ, বিস্কিট। ওয়াংদি এগ নুডলস করছে।
সন্দীপন : কাল কিন্তু খুব বিপদ গেছে যা হোক। ওফ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম।
ঝাউ : আমিও। দেখি অ্যা—ত বড়ো বড়ো জোঁক। (হাত দিয়ে ফুটখানেক দেখায়।)
সবুজকলি : হ্যাঁরে লাভো, (হেসে) তোর কি পেছনে চোখ গজিয়েছে? আগে তো ল্যাজটাই আছে জানতাম।
ঝাউ : কেন? কেন?
সবুজকলি : সূর্য ছিল সবার পেছনে আর লাভো সবার সামনে। ও কী করে বুঝল সূর্য পড়ে যাচ্ছে?
প্রভাতসূর্য : সতর্ক থাকলে বোঝা যায় কেউ ছুটে গেছে চেন থেকে। সেভাবেই…
নীলাভ : (জোরে হেসে) কলি, মাই ফ্রেন্ড, গড অ্যানড গোস্ট—বোথ আর ওমনিপ্রেজেন্ট!
সবুজকলি : যাক এতদিনে চিনেছিস নিজেকে…
নীলাভ : যে আমি ঈশ্বর, না রে! (পা বাড়িয়ে দেয়) নে পেন্নাম কর! কী বর চাস?
সবুজকলি ওকে মারতে ওঠে। ওয়াংদি খাবার সাজিয়ে আসে তখন। ওরা খাবারে মন দেয়।
সারাদিন প্রচুর খেল, ঘুরল, পাখি প্রজাপতি দেখল, ছবি তুলল ওরা। বুনো স্ট্রবেরি খেল। বাকো ফুল দেখল। কিন্তু চাঁদ ওদের সঙ্গ দিতে পারল না। বিকেল থেকে অর্কিডের পাতায় পাতায় ঘন হল মেঘ। আকাশ ঢেকে গেল। টিপ টিপ বৃষ্টিপাত ওদের ঘরবন্দি করে দিল পুরোপুরি। ওরা এমনই মশগুল—চাঁদের পরোয়া না করে নুন লেবু লঙ্কা সমেত ভদকা সাজিয়ে বসল। শৈত্য রয়েছে। ফায়ারপ্লেস জ্বেলে দিয়েছে ওয়াংদি। সন্দীপন ও সবুজকলি কাজু, ভুজিয়া, স্যালাডের ডিশ সাজিয়েছে। ওয়াংদি গরম চিকেন পকোড়া দিয়ে গেল সঙ্গে। ফায়ারপ্লেসকে আধা গোল করে ঘিরে বসল ওরা। হাতে গ্লাস নিয়ে উল্লাস উদযাপন করল।
নীলাভ : আজ প্রত্যেকে আলাদা করে কিছু দেবে। যার যা ইচ্ছে। সেই আমার গান দিয়ে কোরাস শুরু আর ‘পুরানো সেই দিনের কথা’—য় শেষ—এরকম চলবে না।
ঝাউ : ওরে বাবা! আমি তো কিছুই পারি না।
সবুজকলি : কেন রে হাঁউ! তুই ওড়িশি শিখতিস তো।
ঝাউ : ওরে বাবা! সব ভুলে গেছি।
সবুজকলি : যা মনে আছে, তা—ই করবি। এখানে আমরা প্রাইজ দেব না।
জমে উঠল সভা। মধুস্মিতা অসামান্য গাইল আশা ভোঁসলের গলায় শোনা ‘জীবনগান গাহি কী যে’ সলিল চৌধুরীর কথা, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুর। ঝাউ ওড়িশি, নীলাভর টেবিল—তবলার সঙ্গে হাতে ভদকার গ্লাস নিয়ে সন্দীপন। ধুনুচি নৃত্য, প্রভাতসূর্য আবেগে চোখ বন্ধ করে ‘জীবনসে ভরি তেরি আঁখে…’ কিশোরকুমার, মধুস্মিতার বোল—এর সঙ্গে সবুজকলি কত্থক—প্রত্যেকে মন দিয়েছে, হয়তো ভদকার চুমুক ওদের নিবিড় করেছে আরও, কিংবা কাজের চাপে আর নিয়মিত অভ্যাস হতে পারছে না, তারই ক্ষুধা ওদের যোগী করেছে। নীলাভর পালা এবার। ছবি তোলা চলছিলই। অতএব সব ক্যামেরা প্রস্তুত হল। হাতের গ্লাস রেখে নীলাভ উঠল। চোখ বন্ধ করে দাঁড়াল।
নীলাভ : একটি ছোট্ট নাটক। সংলাপের সঙ্গে যে কয়েকছত্র কবিতা ব্যবহৃত হবে, তার রচয়িতা কবি অগ্নি বসু।
সবুজকলির পায়ের কাছে জানু ভেঙে বসল। ওর ডানহাতে ধরা আছে ভদকার গ্লাস। নীলাভ টেনে নিল বাঁ হাত।
নীলাভ : নয়নমণি! (স্বরে গভীর ঘন আবেগ! কম্পন! বাকিদের মুখে হাসি।) শেষবার। এই শেষবার। আর আসব না। কোনোদিন আসব না। যা বলতে পারিনি এতকাল, শুধু তারই জন্য, তারই জন্য নয়নমণি—আজ আমার সুদূর পেরিয়ে আসা! নয়নমণি, আমি তোমাকেই তোমাকেই তোমাকেই একমাত্র… (হস্তচুম্বন। এবং হাত ছেড়ে দিয়ে, দু—পাশে নিজের প্রসারিত দু—হাত—ওর চোখ বন্ধ) ‘….ভোরের আকাশে,উন্মুখ নীল মেঘে আমারও ডানার শব্দ রয়েছে লেগে,—সারাটা জীবন শুধু জেগে, শুধু জেগে এবার তা হলে একটু ঘুমিয়ে থাকি?’ (স্বর নামিয়ে শেষ ছত্রটি দু—বার পুনরাবৃত্তি করে। ঝুঁকে নমস্কার করে সহজ হাসি মেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অনেকগুলো ক্যামেরার ঝলকের মধ্যে ও সম্পন্ন করে নাটক।) বন্ধুদের হইচই, হাততালি, বিস্ময়, মুগ্ধতা! এত ভালো অভিনয়! গলায় কান্না এসে গেছে। সত্যি, লাভোটার নাটক ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি! কী যে ছেলেটা।
৭
ফেরাটা বড়ো অবসাদের। তবু ফিরতেই হয়। উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে আসে। অতি প্রত্যূষে ওদের ট্রেন পৌঁছোল বর্ধমানে। এখনও রাত্রি কাটেনি পুরোপুরি। আকাশে আলোর রেখা। সকাল সকাল পৌঁছে যাবে কলকাতা। ওপরের দুটি শয্যায় নীলাভ আর প্রভাতসূর্য। বাড়তি পা বেরিয়ে থাকলেও অসুবিধে হয় না ওটায়। প্রভাতসূর্য নেমে এল। নীলাভও।
নীলাভ : চা খাবি?
প্রভাতসূর্য : বল। এই পেপার! পেপার! আজকের ‘দৈনিক খবর’ একটা দাও তো!
পেপারওলা : আজকেরটা এখনও পৌঁছোয়নি দাদা। আর আধঘণ্টা পরে পাবেন। কালকের আছে।
প্রভাতসূর্য : তাই দাও।
নীলাভ চা আনল। পান করল দু—জনে। ট্রেন চলতে শুরু করল। ওরা ঠেলে তুলল সবাইকে। মাঝের শয্যা না তুললে বসতে পারছে না। হাই তুলতে তুলতে ব্রাশ—পেস্ট নিচ্ছে ওরা। নীলাভ একবার কাগজ খুলল। এ পাতা ও পাতা একটু দেখল। দিয়ে দিল প্রভাতসূর্যর হাতে। প্রভাতসূর্য কাগজ খুলল। ট্রেন ছুটছে জোর। নীলাভ করিডোরে গেল। প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে দ্বিতীয় পাতা। শোকসংবাদ, জমি—বাড়ি—সম্পত্তি, নিরুদ্দেশ পেরিয়ে নীচের দিকে আটকে গেল চোখ—শোকসংবাদ—অনেক বড়ো করে। মৃতের স্পষ্ট বৃহৎ ছবি। তলায়—তোমার আকস্মিক প্রয়াণে আমরা শোকস্তব্ধ। মাঝে—নীলাভ দত্ত। জন্ম…। মৃত্যু…। আজ তাঁর পারলৌকিক কাজে বন্ধু ও আত্মীয়বর্গের উপস্থিতি অনুরোধ করি!
কিন্তু, কিন্তু ছবিটা তো নীলাভরই! প্রভাতসূর্য কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে পড়ে।
প্রভাতসূর্য : এ কী? এই লাভো! ইজ ইট এ প্র্যাকটিক্যাল জোক অর হোয়াট?
সবুজকলি : লাভো বাইরে মুখ ধুতে গেল। তুই এখানে চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?
প্রভাতসূর্য : পড় এটা। (কোলে কাগজ ছুড়ে দেয়। ছুটে বাইরে যায়। লাভো নেই। ছুটে অন্যদিকে যায়। নেই। সন্দীপনকে ডাকে।) সন্দু তুই ওদিকের কামরাটা দ্যাখ তো। আমি এদিকে দেখছি। দ্যাখ তো লাভো কোথায়?
নেই নেই, কোত্থাও লাভো নেই। সারা ট্রেন খুঁজল ওরা। বহুজনকে জিজ্ঞেস করল। কেউ ঝাঁপ দেয়নি। কেউ পড়ে যায়নি। সবচেয়ে উঁচু শয্যায় চাদর তেমনি কুঁচকোনো কিন্তু লাভোর ব্যাকপ্যাক নেই কোথাও! এ কী? এ কেন? নীলাভর এ কী নাটক? সহযাত্রীর সেলফোন চেয়ে বাড়িতে ফোন করছে প্রভাতসূর্য। সবাই ওকে ঘিরে। এর বেশি হতবুদ্ধি, এর চেয়ে বেশি অবাক ওরা কখনো হয়নি! নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে কিছু একটা!
প্রভাতসূর্য : হ্যালো বাবা! বাবা! আমরা আর ঘণ্টা দেড়েকে পৌঁছে যাব। (গলা কাঁপছে।)
বাবা : এসো। গাড়ি থাকবে।
প্রভাতসূর্য : বাবা, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কাগজে দেখছি নীলাভ দত্ত। অথচ ও তো… ও তো…
বাবা : ও দেখেছ? তোমাদের খবর দিতে পারিনি। এন জে পি থেকে তুমি ফোন করলে, ভালো করে কিছু না শুনেই ছেড়ে দিলে।
প্রভাতসূর্য : এন জে পি থেকে? আমি ফোন করিনি বাবা! লাভো করেছিল। লাভোই তো সবার বাড়িতে…
বাবা : কী বাজে বকছ! শোনো, বিষ্যুদবার সন্ধ্যায় বেরোবার মুখে নয়নমণিকে ধরতে গিয়ে চারতলার রেলিং টপকে নীলাভ পড়ে যায়। পিঠে ভারী ব্যাকপ্যাক ছিল, টাল সামলাতে পারেনি। তোমরা বাড়ি এসো সাবধানে। কথা হবে।
প্রভাতসূর্য : বাবা, বিশ্বাস করো, ও তো… ও তো…
বাবা : হ্যাঁ! ওর ভালো স্বাস্থ্য ছিল। কিন্তু মাথায় আঘাত! কিছু করা যায়নি। ভেঙে পোড়ো না। ওর বাবা—মায়ের কথা ভাবো। এখন তোমাদের পৌঁছোনো প্রয়োজন।
ফোন নামিয়ে নেয় প্রভাতসূর্য। ওরা বিশ্বাস করতে পারে না কিছুই। বোকা হতচেতন হয়ে যায়। কীভাবে বিশ্বাস করবে? কীভাবে বিশ্বাস করাবে অন্যদের? ওদের মনে ধাঁধা লেগে যায়। আবার ধাঁধা খোলেও। নীলাভর বহু কথার দ্বিতীয় মানেটি পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু এ যে অসম্ভব! অবিশ্বাস্য!
সবুজকলি : (চেঁচিয়ে) ক্যামেরা! ক্যামেরা!
ঝাউ ক্যামেরা বার করে। ওই তুলেছে সবচেয়ে বেশি ছবি। একটার পর একটা খোঁজে। কই নীলাভ! নীলাভ কই! নেই! কোনো ছবিতে নেই। অথচ কত ছবি তুলেছিল ওরা। কই! সেসব কই! এই তো! আছে! একমাত্র একটি ছবিতে আছে। নাটকের দৃশ্য। ফায়ার প্লেসের আগুনের চালচিত্রে একটি ছায়াচ্ছন্ন ছবি। হাতে গ্লাস নিয়ে সবুজকলি। ওকে চেনা যাচ্ছে। ওর বাঁ হাতে চুম্বন করছে জানু পেতে বসা নীলাভ। নীলাভ! নাকি প্রভাতসূর্য! দু—জনের শরীর এক একরকম, এই ছায়াময়তায় আলাদা করে চেনা কঠিন।