ওস্তাদ

ওস্তাদ

আর কয়েকদিন পরেই মহালয়া৷ চতুর্দিকে পুজো পুজো গন্ধ৷ শরৎকালের নিয়ম মেনেই আকাশ গভীর নীল! বেশ কিছু মাখন রঙের ছেঁড়া মেঘের নরম টুকরো শ্লথগতিতে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ তাদের কোনওরকম ব্যস্ততা নেই৷ শুধু আপনমনে ধীরগতিতে কোন নিরুদ্দেশের ঠিকানায় চলেছে কে জানে! হয়তো বা কোনও প্রেয়সীর বার্তা বয়ে নিয়ে চলেছে তার দূরপ্রবাসী প্রিয়তম’র জন্য৷ মা আসছেন৷ তাই প্রবাসের মানুষদের এখন ঘরে ফেরার আমন্ত্রণ জানাতে চলেছে ওরা!

মেঘগুলো আজ যতই রোম্যান্টিক মুডে থাকুক না কেন, সূর্যদেব কিন্তু যথারীতি রুদ্রমূর্তিতে আছেন! এমনিতেই পুরাণে কথিত আছে যে এই দেবতার তেজের চোটে স্বয়ং তাঁর অর্ধাঙ্গিনী, দেবী সংজ্ঞা তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন! দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর নগণ্য প্রাণীদের সে উপায় নেই! সুতরাং চাঁদির ওপরে সূর্যের অনাবিল আশীর্বাদ গ্রহণ করতে করতে মানুষগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত! তবু যাঁদের মাথায় চমৎকার বাবরি চুল আছে, তাঁরা কিঞ্চিৎ ছাড় পেয়েছেন৷ কিন্তু যাঁদের ব্রহ্মতালু জুড়ে চকচকে ‘দর্পণসদৃশ ইন্দ্রলুপ্ত’, তাঁদের অবস্থা শোচনীয়!

‘দাদা, ক’টা বাজে?’

যাঁকে বলা হল, সেই ‘দাদা’ বিরক্ত হলেন৷ ভদ্রলোক বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল৷ কিন্তু বাসের পাত্তাই নেই! কপালদোষে তাঁরও গোটা মাথা জোড়া কপাল! যেভাবে অবাধে সোলার এনার্জি গ্রহণ করে চলেছেন, তাতে আশঙ্কা হয়, রাতে চাঁদের বদলে তাঁর টাকটিই না আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! মস্তিষ্কের ভেতর ঘিলু টগবগিয়ে ফুটছে! যেটুকু ধূসর বস্তু আছে, তাও বাষ্পীভূত হওয়ার উপক্রম! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু-পায়ে দুব্বো গজিয়ে গেল! আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সম্ভবত হেরিটেজে পরিণত হবেন! এমন পরিস্থিতিতে কেউ যদি আহ্লাদি গলায় সময় জানতে চায় তখন আর ধৈর্য থাকে!

দাদা একঝলক প্রশ্নকর্তাকে দেখে নিলেন৷ লোকটাকে দেখতে অবিকল একটা ভোঁদড়ের মতো! সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে আবার জানতে চাইল, ‘বারোটা বেজে গিয়েছে?’

বারোটা তো তাঁর নিজেরই বেজে গিয়েছে! এবং বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষেরই বাজছে৷ তা সত্ত্বেও ‘দাদা’ যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললেন, ‘সাড়ে বারোটা৷’

‘বা-বা!’ ভোঁদড়মার্কা লোকটা বলল, ‘এর মধ্যেই এত বেলা হয়ে গেল! আমি তো বুঝতেই পারিনি!’

তিনি লোকটার দিকে রাগত চোখে আবার তাকালেন৷ লোকটার মুখে এখন কান এঁটো করা হাসি৷ ফের সেই আহ্লাদি মিহি গলায় জানতে চাইল, ‘কদ্দূর যাবেন?’

‘দাদা’র উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না৷ তবু নিমপাতা গেলার মতো মুখ করে একটি বিরাট শপিংমলের নাম করলেন৷

লোকটার পিটপিটে চোখ নেচে উঠল৷ ব্যাটা নির্ঘাৎ পুজোর শপিং করতে যাচ্ছে! অত বড় শপিংমলে যাচ্ছে মানে মালদার পার্টি৷ আড়চোখে একবার তাঁর প্যান্টের পকেটে রাখা ওয়ালেটটা দেখে নিল সে৷ যথেষ্ট পেটমোটা! এক ঝলকেই বুঝে নিল, শুধু ক্রেডিট কার্ড নয়, এ পাব্লিক যথেষ্ট ক্যাশ নিয়েই বেরিয়েছে৷ এখন শুধু সুযোগ বুঝে হাত মারতে পারলেই কেল্লা ফতে৷ আর যেভাবে ওয়ালেটটা অসতর্ক ভাবে আধখানা বেরিয়ে আছে, তাতে কোনও অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়৷

যখন সে মনে মনে এসব অঙ্ক কষছিল, ততক্ষণে বাস এসে দাঁড়িয়েছে স্টপেজে৷ তার হাবভাব অবিকল আস্ত হরিণ গিলে আসা অজগরের মতো৷ নড়াচড়ার কোনও ইচ্ছেই নেই! সেফটিপিনের গোছার মতো যত্রতত্র মানুষ ঝুলছে! বেচারি কন্ডাক্টরেরও দাঁড়াবার জায়গা নেই৷ ধ্যানস্থ বকের মতো একপায়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ‘আসুন…আসুন…! তাড়াতাড়ি উঠে আসুন৷ যাবে, যাবে…!’

বাসের মধ্যে প্রচণ্ড ভিড়! লোকগুলো একে অন্যের সঙ্গে লেপ্টে আছে! আহা, এরই নাম তো মহামিলন! এর হাত ওর কাঁধে! ওর ঠ্যাং আরেকজনের ঠ্যাঙের তলায়! কারোর ফরাসি সুগন্ধের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অন্য কারোর ঘামের দুর্গন্ধ! কারোর শখের শার্টের ওপরে পেছনের লোকটির মুখের পানের রস বাটিকপ্রিন্ট তৈরি করেছে! সবমিলিয়ে পুরো ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’ কেস!

এরকম ভিড় দেখলেই ‘দিল গার্ডেন গার্ডেন’ হয়ে যায় ওস্তাদের! হ্যাঁ, ওই ভোঁদড়মুখো লোকটার নামই ওস্তাদ! বলাই বাহুল্য, যে এটা ওর পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়৷ কিন্তু ওর হাতের কাজ এমন মাখনের মতো যে ওর লাইনের সবাই ওকে ওস্তাদ বলেই ডাকে! সবাই জানে যে সে এ তল্লাটের ‘কনৌসার অব পিকপকেট’! চ্যাম্পিয়ন সমাজসেবী বলে কথা!

কোনওমতে ভিড় ঠেলেঠুলে, একে গুঁতো মেরে, ওর পা মাড়িয়ে দিয়ে, টপাটপ গোটা দুয়েক হাত মেরে ওস্তাদ এসে দাঁড়াল ঠিক সেই ‘বাসস্ট্যান্ডতুতো দাদা’টির পিছনে৷ শুরুতেই ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির সুযোগে দুটো উইকেট তুলে নিয়েছে৷ তাই এইমুহূর্তে সে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে! এই তো, কয়েক ইঞ্চি সামনেই তার বহু ঈপ্সিত ওয়ালেট! একটু হাত বাড়ালেই…!

‘আ-রে দা-দা…!’

এক প্যাসেঞ্জারের চিৎকারে সচকিত হয়ে তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিল ওস্তাদ! বাস চলতে শুরু করেছে ঠিকই৷ কিন্তু এত মন্থরগতিতে যে কচ্ছপও বোধহয় ওভারটেক করে যাবে৷ বাসের সামনের দিকের এক অধৈর্য প্যাসেঞ্জার বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বাসটাকে এবার টানুন! কতক্ষণ এরকম ক্যাটওয়াক চালাবেন!’

‘মনে হচ্ছে এবার নেমে ঠেলতে হবে৷’ পাশ থেকে মন্তব্য ভেসে এল৷

ওস্তাদ কথাগুলো শুনে সামনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়৷ আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল ওকে!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে ওঠে সে৷ আরে, সেই লোকটা না! একদম সামনের মুখোমুখি সিটটায় বসে আছে! তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আগের দিনেরই মতো! মুখে সেই সাঙ্ঘাতিক রহস্যময় হাসি! যেন ওস্তাদের সব রহস্য জানে ও! অপলকে দেখছে তাকে৷ বলা ভালো, মাপছে তার গতিবিধি! ভাবটা এমন, যেন বলতে চাইছে, ‘আমি সব জানি৷’

সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নেয় ওস্তাদ! আবার! আবার সেই লোকটা৷ একেবারে মূর্তিমান শনি! দু-দিন আগেই এই রুটের বাসে দেখেছিল৷ একেবারে শুরু থেকেই ওর দিকে এমনভাবে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল যে হাতটা একটু নাড়াতেও পারছিল না সে৷ দু-একবার অগ্রসর হয়েও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ওস্তাদ! কারণ লোকটার চোখ তো নয়, যেন একজোড়া হ্যালোজেন লাইট! সেই দপদপে অপলক দৃষ্টির সামনে স্বয়ং কৃষ্ণও বোধহয় হাতসাফাই করে ননী খেতে পারতেন না! ওস্তাদ তো মানুষ!

সে টের পেল বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছে৷ এই লোকটার জন্যই আগের দিন বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি! হাতে যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও দামি দামি ভ্যানিটি ব্যাগ, পেটমোটা পার্স, ওয়ালেটগুলোকে অক্ষতই ছেড়ে দিতে হয়েছিল৷ আজও কি তবে কপালে ব্যর্থতাই নাচছে! চোখের সামনে দামি চামড়ার পেটমোটা ওয়ালেটটা তখনও ভালোবেসে হাতছানি দিয়ে ডেকে চলেছে৷ ওটাকে আলগোছে তুলে নেওয়া ওস্তাদের কাছে প্লেট থেকে রসোগোল্লা তুলে নেওয়ার মতোই সহজ কাজ৷ অথচ এই অলপ্পেয়ে লোকটার জন্য কি সেটাও পারবে না? মরিয়া হয়ে হাতটা অতি সন্তর্পণে বাড়িয়ে দিল সে…!

‘আরে, পেয়েছেন কী মশাই!’

ওস্তাদ প্রায় ব্যাগটাকে ছুঁয়েই ফেলেছিল৷ কিন্তু ফাঁক বুঝে তুলে নেওয়ার আগেই ব্যাগের মালিক সেই ‘দাদা’ নড়েচড়ে উঠলেন৷ তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকটির দিকে প্রায় তেড়ে গিয়ে বললেন, ‘তখন থেকে আপনি আমার টাকে খোঁচা মেরে চলেছেন! এটা আমার টাক! বারোয়ারি ঢাক নয় যে, যার যখন খুশি এসে পিটিয়ে যাবে!’

ভিড়ের মধ্য থেকেই কোনও এক সুরসিক ফোড়ন কাটলেন, ‘নিজের জিনিস নিজের দায়িত্বে রাখুন! তা না পারেন তো অতকিছু নিয়ে ভিড় বাসে ওঠার দরকার কী?’

‘আমি আমার টাক আগলেই রেখেছি৷’ ‘দাদা’ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন, ‘কিন্তু ওঁকে বলুন নিজের হাত সামলে রাখতে…উফফফ!’

তিনি হাঁউমাউ করে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ একখানা পেল্লায় লম্ফ মেরে উঠলেন৷ না, নিজের ইচ্ছেয় নয়৷ বাসটা সম্ভবত স্পিড বাম্পে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠেছে৷ মুহূর্তের মধ্যে বাসযাত্রীরা মহাকাশযাত্রীদের অভিজ্ঞতা লাভ করলেন৷ অর্থাৎ শূন্যে ভাসমান হলেন৷ ‘দাদা’র মাথাটা প্রায় আরেকটু হলেই বাসের ছাতে ঠুকে যাচ্ছিল৷ সেই দৃশ্য দেখে আবার উড়ে এল ফোড়ন, ‘আহা! ফেটে গেল বুঝি?’

‘দাদা’ ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন৷ চোখ গোল গোল করে বললেন, ‘কী ফাটল?’

‘ইয়ে…৷ মানে…!’ ফ্যাঁচফ্যাঁচে হাসির সঙ্গে ভেসে এল শব্দগুলো, ‘কালীরামের ঢোল!’

ভদ্রলোক প্রায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠেছেন৷ গোল গোল ভাঁটার মতো চোখ করে সম্ভবত ঝগড়া করার প্রস্তুতিই নিচ্ছেন৷ অন্যদিকে বিশেষ মন নেই৷ এই সুযোগ! প্যান্টের পকেটে ওয়ালেটটা…!

কিন্তু নাঃ! ওস্তাদের কপালই খারাপ! এবারও হল না৷ এমন নয় যে সে চেষ্টা করেনি৷ কিন্তু হাত বাড়াতে গিয়েই দেখল, লোকটা ফের তার দিকেই তাকিয়ে আছে! মুখে সেই রহস্যময় মিটিমিটি হাসি! নিষ্পলকে দেখছে তাকে৷ এমন করে দেখছে যেন ওস্তাদকে সে খুব ভালোভাবেই চেনে৷ আর তার মনের অন্ধকার গলিঘুঁজিগুলো ওই দুটো চোখের সামনে একদম দিনের আলোর মতো স্পষ্ট!

ওস্তাদের মনে সন্দেহ ঘনায়৷ কে এই লোকটা? সাধারণ প্যাসেঞ্জার? কিন্তু হাবে-ভাবে ওকে মোটেই সাধারণ মনে হচ্ছে না! ওর পরপর দু-দিন আবির্ভাবটা কি নিতান্তই কাকতালীয়? তাই যদি হয়, তবে এরকমভাবে তাকিয়ে আছে কেন? মুখে স্মিত হাসিটাই বা কেন লেগে আছে? ও কি ওস্তাদের পরিচিত? আগে কখনও দেখেছে?

ভাবতে ভাবতেই ঘেমে ওঠে সে৷ এমনও তো হতে পারে এই লোকটা ওর ভূতপূর্ব শিকার৷ কোনওদিন হয়তো ওরই পকেটসাফা করেছিল ওস্তাদ৷ সেইজন্যই…!

সে-ও এবার চোখ সরু করে দেখতে থাকে লোকটাকে৷ দেখলে তো নিরীহ বলেই মনে হয়! নিতান্তই সাধারণ পাঞ্জাবি-পাজামা পরে আছে৷ কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা৷ শান্ত সৌম্য চেহারায় বেশ অহিংস ভাব! কোনও দিক থেকেই ওকে বিপজ্জনক মনে হয় না৷ অথচ চাউনিটা অদ্ভুত! আশ্চর্য বরফশীতল! মনে হয় অর্ধনিমজ্জিত হিমশৈল! চোখদুটো নেহাতই আইসবার্গের উপরের অংশ৷ বাকিটা লুকিয়ে রয়েছে আরও গভীরে৷ সে অংশটা হয়তো আরও রহস্যময়৷ আরও বিপজ্জনক!

ওস্তাদ ওকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মাপছিল৷ কিন্তু ঠিকমতো ওকে মেপে নেওয়ার আগেই আরও একটা বিপজ্জনক ঝাঁকুনি! এবার ‘দাদা’টি ওস্তাদের ঘাড়ের ওপরে এসে পড়েছেন! একদম লুজ বল! এই সুযোগে ছক্কা মারতেই হবে! ওয়ালেটটা এবার ওর কোমর স্পর্শ করেছে৷ এটা তুলে নেওয়ার জন্য কোনও যন্ত্রেরই দরকার নেই৷ ওস্তাদের হাতই যথেষ্ট৷ শুধু একবার টুক করে তুলে নিলেই হয়!

তার সাঁড়াশির মতো আঙুলদুটো মুহূর্তের জন্য চেপে ধরল ব্যাগটাকে৷ ওই মুহূর্তের ভগ্নাংশের স্পর্শেই সে বুঝতে পারল, তার আন্দাজই সঠিক৷ ওয়ালেটটার ভেতরে ভালোই মালপত্র আছে! তুলে নিতে পারলে কয়েকদিনের ইনকাম একসঙ্গে হয়ে যাবে! এবার মালটাকে তুলেই ছাড়বে ওস্তাদ! কিন্তু অভ্যস্ত হাতে ব্যাগটাকে টান মেরে বের করতে করতেই ফের পাথর হয়ে গেল সে! লোকটা আবার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এদিকেই! যথারীতি মিটমিট করে হাসছে! মুখ তুলে তাকাতেই একদম চোখে চোখ পড়ে গেল৷

ওস্তাদের মনে হল তার আঙুলগুলো বরফ হয়ে গিয়েছে৷ অথবা একদম অসাড়! তার মনের অবস্থা বলার মতো নয়! একটু আগেই মনে হয়েছিল, লুজ বল পেয়েছে৷ এখন বুঝতে পারছে, লুজ বলের ছদ্মবেশে বডিলাইন চলছে! চতুর্দিকে শিকারির মতো ছড়িয়ে আছে চতুর ফিল্ডাররা! পুরো জন্টি রোডসের ফিল্ডিং! স্কোর করা তো দূর, নড়তে-চড়তেই পারছে না!

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই পর্বই চলল৷ সেই আগের দিনেরই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি৷ যতবারই সে ওয়ালেটটাকে কব্জা করার জন্য হাত বাড়ায় ঠিক ততবারই অব্যর্থ টাইমিঙে লোকটার মুন্ডু ঘুরে যায় তার দিকে! ওরকম গোল গোল চোখের সামনে কেউ পকেট মারতে পারে! বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দেয় ওস্তাদ৷

‘দাদা কি আগে পাইলট ছিলেন নাকি?’

বাস ড্রাইভারের দিকে কোনও এক প্যাসেঞ্জারের প্রশ্নবাণ ধেয়ে গিয়েছে৷ ড্রাইভার এবার খোঁচা খেয়ে এদিকেই তাকায়৷ প্রশ্নকর্তা মৃদু হেসে বলে, ‘আসলে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে হাওয়ায় বেশি উড়ছি কিনা!’

ড্রাইভার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিপাত করে মুখ ফিরিয়ে নেয়৷ পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, ‘না না, পাইলট নয়, উনি অ্যাস্ট্রোনট ছিলেন৷ রকেট চালাতেন৷ দেখছেন না, কেমন মাধ্যাকর্ষণের বাপ-ঠাকুর্দা মায় চোদ্দো পুরুষের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ছেন!’

এসব মন্তব্য শুনলে যে কেউ ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়বে! বাস ড্রাইভার কতটা ফ্রাস্ট্রেটেড হল কে জানে৷ কিন্তু তার চেয়েও একটি দুঃখী আত্মা নিজের ব্যর্থতার হতাশায় ডুবে ছিল৷ ওস্তাদের হঠাৎই মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে পড়া খবরটা৷ পুজোর আগে পকেটমারি, কেপমারি, ছিনতাইয়ের প্রকোপ দূর করার জন্য কলকাতা পুলিশ সব জায়গায় সাদা পোশাকের ছদ্মবেশী পুলিশ ছড়িয়ে দিয়েছে! দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে নেমে পড়েছে ইনফর্মাররাও৷ দাগি অপরাধী, তথা হিস্ট্রি শিটারদের চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে৷ এ খবরটা আগেই তার চোখে পড়েছিল৷ তখন বিশেষ পাত্তা দেয়নি৷ বরং ভেবেছিল, এসব নিতান্তই কলকাতা পুলিশের মিথ্যে আশ্বাস! অথচ এখন মনে হচ্ছে, খবরটা ঠিকই ছিল৷

ওস্তাদ নিশ্চিত হয়৷ হ্যাঁ, লোকটা নির্ঘাৎ সাদা পোশাকের পুলিশ৷ অথবা ওদের ইনফর্মার৷ সেজন্যই তাকে এভাবে চোখে চোখে রাখছে৷ কোনওরকম বেগড়বাঁই করলেই সোজা ক্যাঁক করে ধরে পাঠিয়ে দেবে শ্রীঘরে৷ তারপর চলবে ‘কচুয়া ধোলাই’! সে মনে মনে বুঝতে পারছিল আজ তার দিনটা মাটিই হতে চলেছে৷ আস্তে আস্তে নিরাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল ওস্তাদ…৷

‘কা-লী-বা-ড়ি! কা-লী-বা-ড়ি’! চিৎকার করে সামনের স্টপেজের নাম ঘোষণা করল কন্ডাক্টর৷ আর তখনই ঘটল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা!

লোকটা ওস্তাদকে অবাক করে দিয়ে আচমকা সটান উঠে দাঁড়াল! তারপর ঝোলার ভেতর থেকে বের করে আনল একটা ফোল্ডিং ব্লাইন্ড ওয়াকিং স্টিক! লাঠি ঠুকঠুকিয়ে আন্দাজে এগিয়ে এল তার দিকেই৷ সম্ভবত পিছনের দরজা দিয়ে নেমে যাবে পরের স্টপেজে৷ তার হাঁটাচলাতেই স্পষ্ট যে মানুষটি দৃষ্টিহীন!

ওস্তাদের মনে হল, বহুবছর দ্বীপান্তরে থাকার পরে সে বুঝি এতদিনে দেশের মাটিতে পা রাখল! লোকটা অন্ধ! তার মানে ও কিছুই দেখছিল না৷ স্রেফ শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল৷ ওস্তাদের কীর্তি দেখার কোনও সুযোগই ছিল না ওর৷ অথচ সে কিনা এতক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে মরছিল…!

লোকটা এগিয়ে আসতে আসতেই বাসের ঝাঁকুনিতে একটু বেসামাল হয়ে উলটে পড়ল ওস্তাদের ঘাড়ের ওপরে! পরক্ষণেই সামলে নিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘সরি!’

‘কোনও ব্যাপার না দাদা!’ ভীষণ আনন্দে ও শান্তিতে ওস্তাদ তখন করুণার সাগর, ‘আসুন, আপনাকে নামিয়ে দিই৷’

‘থ্যাঙ্কস ভাই…মেনি মেনি থ্যাঙ্কস! ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন৷’

অন্ধ লোকটাকে হাত ধরে স্টপেজে নামিয়ে দিল সে৷ তারপর ফুরফুরে মনে এসে দাঁড়াল নিজের জায়গায়৷ এখন আর কোনও বাধা নেই৷ ওই পেটমোটা ওয়ালেটটা এখন তার!…শুধু তারই…! আর কেউ তাকে আটকাতে পারবে না৷

‘আমার ও-য়া-লে-ট…!’

এতক্ষণ বাসস্ট্যান্ডের ‘টাকদাদা’টি চুপচাপই দাঁড়িয়েছিলেন৷ নীরবে দাঁড়িয়ে বাসের ঝাঁকুনি সহ্য করছিলেন৷ কিন্তু বাস কন্ডাক্টর তাঁর কাছে ভাড়া চাইতেই বিপত্তিটা ঘটল! পকেটে হাত ঢুকিয়েই চরম হাঁকাড় পাড়লেন, ‘আমার ওয়ালেট নেই!’

ওস্তাদ এবার যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খায়! ওয়ালেট নেই মানে! এই তো, একটু আগেই ছিল৷ সে স্বচক্ষে দেখেছে৷ ওটার ওপর থেকে একবারের জন্যও চোখ সরায়নি৷ শুধু যখন সেই লোকটা ওর ঘাড়ে এসে পড়ল…!

মুহূর্তটা মনে পড়তেই তার বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়৷ কী এক কুটিল সন্দেহে ওর হাতদুটো বিদ্যুৎবেগে নিজের দু-পকেটে ঢুকে গেল! নেই! সেখানে কিছু নেই! ওর নিজের পার্সটা তো বটেই, এমনকি শুরুতেই যে দুটো ব্যাগ তুলেছিল, সেগুলো সব হাওয়া! ওর খালি পকেটদুটো যেন সজোরে ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠল!

ওস্তাদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! তার মানে লোকটা অন্ধও ছিল না…!

সে ওস্তাদ ছিল! তার চেয়েও বড় ওস্তাদ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *