ওষুধ

ওষুধ

উকিলবাবু এখনও আসেননি। মক্কেলরা বসে বসে মশা মারছে।

দুর্গাপদ খুবই ধৈর্যশীল লোক। সে জানে, বড়ো অফিসার, বড়ো ডাক্তার, বড়ো উকিল ধরলে ধৈর্য রাখতে হবে। যে যত বড়ো সে তত ঘোরাবে।

দুর্গাপদ রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকের পানের দোকানে গিয়ে লেমনেড চাইল তেষ্টা পেয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ। উকিলবাবুর বাড়ির চাকরের কাছে জল চাইলে দিত নিশ্চয়ই, কিন্তু চাইতে কেমন ভয় ভয় আর লজ্জা লজ্জা করছিল তার।

দোকানদার বুড়ো মানুষ। তার দোকানটাও তেমনি কিছু বড়ো দোকান নয়। ছোটো—মোটো, গরিবগুর্বোর দোকান। বিড়ি চাও আছে, পিলাপাতি কালাপাতি চমনবাহার মোহিনী জর্দা দেওয়া পান পাবে, ক্যাপস্টান, গোল্ড ফ্লেক চাও তাও মজুদ, কম দামি কোল্ড ড্রিঙ্কস রাখতে হয় বলে তাও রাখা, কিন্তু বেশি বায়নাক্কা হলে অন্য দোকান দেখতে হবে। বুড়ো তার লাল বাক্স খুলে বরফে রাখা বোতল অনেক বেছেগুছে একটা বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে— এরকম ঠান্ডা হলে চলবে?

অন্যমনস্ক দুর্গাপদ বলে, হুঁ।

লেজেনচুসের গন্ধওয়ালা ঠান্ডা, মিষ্টি ঝাঁঝালো জলটা খেতে গিয়ে বুকের জামা ভিজে গেল দুর্গাপদর। কাগজের নল দিয়ে টেনে সে এসব খেতে পারে না। চুরুক চুরুক খাওয়া তার পছন্দ নয়। ঘঁৎঘঁৎ করে না গিললে তৃপ্তিটা পায় না।

জলটা খেতে খেতে চেয়ে আছে উলটোদিকের বাড়িটার দিকে। না উকিলবাবু এখনও আসেননি।

কতকগুলি ব্যাপার আছে যা কেবল এই উকিল, ডাক্তার বা অফিসাররাই জানে, আর কেউ জানে না। মুশকিলটা সেখানেই। তার ওপর দুর্গাপদ কস্মিনকালে মামলা—মোকদ্দমা বা কোর্টকাছারি করেনি। উকিলবাবু আগের দিনই সাফ বলে দিয়েছে— কেউ বিয়ে ভাঙতে চাইলে আটকানো কি যায়? কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখতে পারি বড়োজোর। আর চাও তো, বেশ ভালো মাসোহারার ব্যবস্থাও করে দিতে পারি। সে এমন ব্যবস্থা যাতে বাছাধনকে দ্বিতীয় বার বিয়েতে বসতে খুব ভেবে—চিন্তে বসতে হবে।

কিন্তু দুর্গাপদ তার জামাইকে খুব একটা অপছন্দ করে না। লোকটা নরম—সরম, ভদ্র, বিনয়ী, খরচে ধরনের। বরং তার মেয়ে লক্ষ্মীই ট্যাটন। বিয়ের আগে পাড়া জ্বালিয়েছে। বিয়ের পর বছর দুই যেতে—না—যেতে বাপের বাড়িতে এসে খাদিমা হয়ে বসেছে। জামাই নিয়ে আসেনি। জামাইয়ের বদলে দিন কুড়ি আগে জামাইয়ের পক্ষের এক উকিলের চিঠি এসেছে। জামাই ডিভোর্সের মামলা আনছে।

তার মেয়ে লক্ষ্মীর তাতে কোনো ভাব বৈলক্ষণ নেই। রেজিস্ট্রি করা খামটা খুলে চিঠিটা তেরছা নজরে পড়ে বারান্দায় ফেলে রেখে পা ছড়িয়ে উকুন বাছতে বসল সরু চিরুনি দিয়ে। বাতাসে উড়ে উড়ে ঘুড়ির মতো লাট খেয়ে খেয়ে চিঠিটা করুণ মুখে এসে উঠোনে দুর্গাপদর পায়ের পাতায় লেগে রইল। দুর্গাপদ উঠোনে বসে একটা ভাঙা মিটসেফের ডালায় কবজা লাগাচ্ছিল। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটা বুঝতে একটু দেরি হল বটে, কিন্তু অবশেষে বুঝল এবং মাথাটা তখনই একটা পাক মারল জোর।

জামাইবাবাজি যে লোক খুব খারাপ নয় তা জানে বলে দুর্গাপদ কটমট করে তাকাল মেয়ের দিকে। কিন্তু এসব তাকানো—টাকানোয় ইদানীং আর কাজ হয় না। কোনোদিন হতও না।

বলি ব্যাপারটা কি, শুনছিস? হুংকার দিল দুর্গাপদ।

লক্ষ্মী সূক্ষ্ম চিরুনিতে উঠে আসা চুলের গোছা আলোয় তুলে উকুন খুঁজতে খুঁজতে নির্বিকার গলায় বলে, দেখলে তো, আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?

দুর্গাপদ বুঝল তিরস্কারে কাজ হবে না। গলা নরম করে বলল— স্বামী—স্ত্রী ঝগড়া হয় সে তো দিন—রাত্তিরের মতো সত্য। তা বলে উকিলের চিঠি কেন?

তেমন কী হল তোদের?

লক্ষ্মীর মা ঘরেই ছিল। বরাবরের কুঁদুলী মেয়েছেলে। সেখান থেকেই গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, কে উকিলের চিঠি দিল আবার?

নবীন। হাল ছেড়ে দুর্গাপদ বলে।

জামাই!

তবে আর কে নবীন আছে?

লক্ষ্মীর মা কিছু মোটাসোটা। ফর্সা গোলগাল প্রতিমার মতো চেহারা। বড়ো বড়ো চোখে রক্ত হিম—করা দৃষ্টিতে চাইতে পারে। দুর্গাপদর প্রাণ এই চোখের সামনে ভারি ধড়ফড় করে ওঠে।

ইংরেজি জানে না, তবু উঠোনে নেমে এসে চিঠিখানা হাতে নিয়ে একটু ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইল সেটার দিকে। তারপর দুর্গাপদকে জিজ্ঞেস করল ডিভোর্স করবে নাকি?

তাই তো লিখেছে।

করলেই হল। আইন নেই?

ডির্ভোসের কথা তো আইনেই আছে।

তোমার মাথা। ডিভোর্স হল বেআইনি ব্যাপার। কেউ ডিভোর্স করছে জানতে পারলে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। জেল হয়।

লক্ষ্মীর মা তার বাপের বাড়ি থেকে যা যা শিখে এসেছে তার উপর আজ পর্যন্ত কেউ তাকে কিছু শেখাতে পারেনি। অনেক ঠেকে দুর্গাপদ আর সে চেষ্টা করে না। তবু বলল, জেল দাওগে না। কে আটকাচ্ছে পুলিশে যেতে।

লক্ষ্মীর মা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল, আমি যাব পুলিশের কাছে? তবে তুমি পুরুষ মানুষ আছো কী করতে?

এ নিয়ে যখন লক্ষ্মীর মা—র সঙ্গে তর্ক—বিতর্ক চলছিল তখন লক্ষ্মী ম্যাটিনী শোয়ে যাবে বলে রান্নাঘরে গিয়ে পান্তা খেতে বসল।

লক্ষ্মীর মায়ের বাঁজা নাম ঘুচিয়ে ওই লক্ষ্মীই জন্মেছিল, আর ছেলেপুলে হয়নি। একমাত্র সন্তান বলে আশকারা পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দুর্গাপদর কাছে যতটা তার চেয়ে ঢের বেশি তার মায়ের কাছ থেকে। সারাদিন মায়ে মেয়ের গলাগলি ভাব, গুজগুজ, ফুসফুস। দুটো মেয়েছেলে একজোট, অন্যধারে দুর্গাপদ একা পুরুষ। কীই—বা করবে? চোখের সামনেই মেয়েটা বখে গেল।

লক্ষ্মী সিনেমায় বেরিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্মীর মা দুর্গাপদকে বলল— জামাই খারাপ নয়, কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা হাড়জ্বালানি। সবকটাকে কোমরে দড়ি বেঁধে সদরে চালান দিয়ে আসবে। যাও। এ কী কথা! দেশে আইন নেই। কোর্ট—কাছারি নেই? পুলিশ—জেলখানা নেই? ডিভোর্স করলেই হল?

এসব ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই তা দুর্গাপদ জানে। কিন্তু কোথায় যেতে হয় তা তারও মাথায় আসে না। সে তেমন লেখাপড়া জানে না, খুব ভদ্রসমাজের লোকও সে নয়। তবে ইলেকট্রিক মিস্তিরি হিসেবে গয়েশপুর থেকে কাঁচরাপাড়া অবধি তার ফলাও প্র্যাকটিস। বলতে কি উকিল, ডাক্তার, অফিসারদের মতোই তার গ্রাহককেও ঘুরে ঘুরে আসতে হয়। বলতে নেই তার টাকা অঢেল। সেই সাইকেলখানা নিয়ে ভরদুপুরে বেরিয়ে পড়ল।

বুদ্ধি দেওয়ার লোকের অভাব দুনিয়ায় নেই। একজন দুঁদে এক উকিলের ঠিকানা মায় একটা হাতচিঠিও দিয়ে দিল। তাতে লাভ হল কিনা দুর্গাপদ জানে না। প্রথমদিন জামাইয়ের উকিলের দেওয়া চিঠিটা পড়ে দুঁদে উকিল মোট মিনিট দশেক তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পঁচিশটা টাকা নিল। কিন্তু তবু কোনো ভরসা দিতে পারল না।

দুর্গাপদ আজও এসেছে। বুকের মধ্যে সারাক্ষণ ঢিবঢিব, মুখ শুকনো গলা জুড়ে অষ্টপ্রহর এক তেষ্টা। মেয়েটা ঘাড়ে এসে পড়লে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। আর হারামজাদি শুধু যে ঘাড়ে এসে পড়বে তা তো নয়, ঘাড়ে বসে চুল ওপড়াবে। পাড়ায় ঢিঢি ফেলে দেবে দু—দিনেই। স্বভাব জানে তো দুর্গাপদ। গতকাল সে লক্ষ্মীকে খুব সোহাগ দেখিয়ে বলেছিল, মা গো, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বনিবনা করে থাকো গে যাও। আমি সঙ্গে যাব বুঝিয়ে—সুঝিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে আসব। থাকতে যদি পারো তো মাসে তিনশো টাকা করে হাতখরচ পাঠাব তোমায়।

শুনে লক্ষ্মীর কী হাসি! পা ছড়িয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, এলে চুলে বসে ছিল। হাসির চোটে সেই চুলে মুখ—বুক ঢাকা পড়ল। বলল, মাসোহারার লোভ দেখাচ্ছ? তুমি মরলে সর্বস্ব তো এমনিতেই আমি পাব।

মূর্তি দেখে দুর্গাপদ ভারি মুষড়ে পড়েছিল। লক্ষ্মীর মা বলল, পুরুষ মানুষ বোকা হয় সে তো জানা কথা। কিন্তু তোমার মতো এমন হাঁদারাম আর মেনিমুখো তো জন্মেও দেখিনি। লক্ষ্মী শ্বশুরবাড়ি যাবে কেন, ওর সম্মান নেই?

এ বাড়িতে বাকি জীবন বসে বসে খাবে। মেয়ে কি ফ্যালনা?

উকিলবাবুর গাড়ি এসে থামল। তাড়াহুড়োয় দুর্গাপদ লেমনেডের দাম দিতে ভুলে গিয়ে রাস্তা পেরোতে যাচ্ছিল। পিছন থেকে ‘ও দাদা দাম দিয়ে গেলেন না’ শুনে লজ্জা পেয়ে ফিরে এসে দাম মেটাতে গেলে বুড়ো দোকানদার মোলায়েম গলায় বলল, উকিলবাবুর এখন দেরি হবে। হাত—পা ধোবেন, জল—টল খাবেন, পাক্কা এক ঘণ্টা, রোজ দেখছি। আপনার নাম লেখানো আছে তো?

দুর্গাপদ মাথা নেড়ে বলল, জনা আষ্টেকের পর।

তাহলে আরও দেড়ঘণ্টা ধরে নিন।

বড়ো উকিল ধরে বড্ড মুশকিল হল দেখছি।

আসানও হবে। উনি হারা—মামলায় জিতিয়ে দেন। কত খুনিকে খালাস করেছেন।

দুর্গাপদ বলল, কিন্তু আমারটা কিছু হল না?

আপনার মুশকিলটা কী?

সে আছে অনেক ঝামেলার ব্যাপার। জামাই ডিভোর্স চাইছে।

অ। বলে বুড়ো মুখে কুলুপ আঁটল।

দুর্গাপদ লেমনেডের দাম দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে উকিলবাবুর বাইরের ঘরে আরও জনা ত্রিশেক লোকের মধ্যে ঠাসাঠাসি হয়ে বসে থাকে। আড়াই ঘণ্টা বসতে হবে। ঘরটা বিড়ি আর সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। শোনা গেল, উকিলবাবু এখনও চেম্বারে আসেননি। জল খাচ্ছেন বোধহয়। গুটি গুটি আরও মক্কেল আসছে।

ঝাড়া তিন ঘণ্টা। হাঁটু ব্যথা হল, মাজা ধরে গেল, হাই উঠতে লাগল ঘন ঘন তারপর ডাক এল। ব্যস্ত উকিলবাবু মক্কেলদের এক—দুইবার দেখে মনে রাখতে পারেন না, তাই ফের পুরোনো পরিচয় এবং বখেরার কথা বুঝিয়ে বলতে হল। সব বুঝে উকিলবাবু হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ভাঙন রুখতে চাইছেন তো? কিন্তু কী দিয়ে রুখবেন? আজ হোক কাল হোক এ ভাঙবেই। আমরা ভাবের কথা বুঝি না, কেবল আইন বুঝি। কে কাকে ভালোবাসে বা বাসে না, কার বিয়ে ভাঙা ভালো নয় বা কার ভালো এসব হল নীতির কথা, ভাবের কথা। আইন তার তোয়াক্কা করে না। বলেন তো লড়তে পারি খামোকা।

ফের পঁচিশ টাকা গুনে দিয়ে দুর্গাপদ উঠে পড়ল।

দুই

খেয়ে উঠে নবীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘটির জলে আঁচাচ্ছিল। এমন সময় দেখল, উঠোনে জ্যোৎস্না পড়েছে। এই হেমন্তকালের জ্যোৎস্নার রকমসকমই আলাদা। একটু দুধের সরের মতো কুয়াশায় মাখামাখি চাঁদখানা ভারি আহ্লাদি চেহারা নিয়ে হাসছে। বাতাসে চোরা শীত। উঠোনে বসে থাকা ঘেয়ো কুকুরটা এঁটো খেতে খেতে ভ্যাক ভ্যাক করে ডেকে উঠল।

নবীন কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে শুনল মা তাকে ডেকে বলছে, ও নবীন, গায়ে একটা গেঞ্জি দে। এ সময়কার ঠান্ডা ভালো না।

আঁচাতে গিয়ে চারদিককার দৃশ্য দেখে জগৎসংসার বেবাক ভুলে চেয়ে রইল নবীনচন্দ্র। ঘটিতে আঙুলের টোকা মেরে মৃদুস্বরে একটু গানও গেয়ে ফেলল সে— না মারো না মারো পিচকারি…

ঘেরা উঠোনের যে ধারটায় দেওয়ালের গায়ে দরজাটা রয়েছে তার পাশেই মায়ের আদরের দু—দুটো মানকচুর ঝোপ আশকারা পেয়ে মানুষপ্রমাণ প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে। এক—একখানা পাতা ডবল সাইজের কুলোকেও হারা মানায়। কুকুরটা ভ্যাক ভ্যাক করে সেদিকেই বারবার ছুটে গিয়ে ফের ল্যাজ নামিয়ে চলে আসছে। নবীনের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন বোঝাবারও চেষ্টা করল ভ্যাক ভ্যাক করে।

নবীন গান থামিয়ে বলে, কে?

কচুপাতার আড়ালে কপাটের গায়ে লেগে থাকা ছায়ামূর্তি বলে উঠল, আমি হে নবীন। কথা ছিল। আঁচাচ্ছিলে বলে ডাকিনি, বিষম খেতে পারো তো।

অক্ষয় উকিলের হয়ে এসেছে। আজকাল বড়ো আলতু—ফালতু কথা বলে। মানে হয় না।

নবীন উঠোন পেরিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে বাতি জ্বেলে বলে, আসুন।

বিবর্ণ একটা শাল জড়ানো বুড়োটে লোকটা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চেয়ারে বসে ঠ্যাঙ তুলে ফেলল। বলল, ডিভোর্সের মামলা বড়ো সোজা নয় হে।

নবীন ভ্রূ কুঁচকে বলল, ও পক্ষ কোনো জবাব দিয়েছে?

জবাব এত টপ করে দেবে? এত সোজা নাকি। যা সব আর্গুমেন্ট দিয়েছি তার জবাব ভেবে বের করে মুসাবিদা করতে দুঁদে উকিলের কালঘাম ছুটে যাবে।

তবে এও ঠিক কথা ডিভোর্স জিনিসটা অত সহজ নয়।

নবীন গম্ভীর মুখে বলে, শক্তটাই বা কী? রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি ডিভোর্স হচ্ছে দেখছি।

আরে না। সরকার ডিভোর্স জিনিসটা পছন্দ করে না। আইনের অনেক ফ্যাঁকড়া আছে। যা হোক সে নিয়ে আমি ভাবব, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। খরচাপাতি কিছু দেবে না কি আজ?

খরচা আবার কী? নবীন অবাক হয়ে বলে, এখনও মোকদ্দমা শুরুই হয়নি।

আছে, আছে। মোকদ্দমা শুরু হয়নি বলে কী আর উকিলের বসে থাকলে চলে? আইনের পাহাড়—প্রমাণ বই ঘাঁটতে হচ্ছে না? এই যে মাঝে মাঝে এসে খবর দিচ্ছি এর জন্যও তো কিছু পাওনা হয় বাপু। মহেশ উকিলের সঙ্গে বাজারদর নিয়ে কথা বলতে গেলে পর্যন্ত ফিজ চায়।

নবীন বেজার হল। তবে বলল, ঠিক আছে, কাল সকালে কারখানায় যাওয়ার সময় দুটো টাকা দিয়ে আসব’খন। মোকদ্দমাটা বুঝছেন কেমন?

অক্ষয় শালটা খুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে বলে, সোজা নয়।

তোমার বউ বাগড়া দিতে পারে। তারও অনেক পয়েন্ট আছে। সবচেয়ে মুশকিল হল মাসোহারা নিয়ে।

নবীন খেঁকিয়ে উঠে বলে, মাসোহারাই যদি দেবো তবে আর উকিলকে খাওয়াচ্ছি কেন?

সান্ত্বনা দিয়ে উকিল বলে, সেই নিয়েই তো ভাবছি। ওরা কী কী পয়েন্ট দেবে, আর আমাদেরই বা কী কী পয়েন্ট সেসব গুছিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তোমার বউ যদি বলে যে শ্বশুরবাড়িতে তার উপর খুব অত্যাচার হত?

অত্যাচার আবার কী? মা—খুড়ি একটু ফিচফিচ করত, তা অমন সব মা—খুড়িই করে। ভারি বেয়াড়া মেয়েছেলে, কাউকে গ্রাহ্য করত না। উলটে মুখ করত, বিনা পারমিশনে সিনেমায় যেত, যেসব বাড়ির সঙ্গে আমাদের ঝগড়া সেইসব বাড়িতে গিয়ে আমাদের নিন্দে করে আসত।

মারধর করা হয়নি তো?

কস্মিনকালেও না। বরং ও—ই উলটে আমার হাত খিমচে দিয়েছিল। একবার কামড়েও দেয়। আমি দু—একটা সটকান মেরেছি হয়তো। তাকে মারধর বলে না।

চরিত্রদোষ ছিল কি? থাকলে একটু সুবিধে হয়। ডিভোর্সের বদলে অ্যানালমেন্ট পেয়ে যাবে, মাসোহারা দিতে হবে না।

ছিল কি আর না? তবে সেসব খোঁজখবর আর কে নিয়েছে!

অক্ষয় উকিল উঠতে উঠতে বলে, কোন পয়েন্ট টিকবে কোনটা না টিকবে বলা শক্ত। ভাবতে হবে। তুমি বরং কাল চারটে টাকাই দিয়ে যেয়ো।

জ্বলন্ত চোখে নবীন চেয়েছিল। অক্ষয় উকিলের আসল রোজগার হল জামিন দেওয়া। সস্তা হয় বলে নবীন ধরেছে, কিন্তু এখন ভারি সন্দেহ হচ্ছে তার যে লোকটা এজলাসে দাঁড়িয়ে সব গুলিয়ে না ফেলে।

জ্যোৎস্নাটা আর তেমন ভালো বলে মনে হল না নবীনের। গলায় গানও এল না। নিজের বিবাহিত জীবনের ভুল—ভ্রান্তিগুলি মনে হয়ে খুব আফশোস হচ্ছে। ঢ্যামনা মেয়েছেলেটাকে সে চিরকালটা প্রশ্রয় দিয়েছে। উচিত ছিল ধরে আগাপাশতলা ধোলাই দেওয়া। তাহলে হাতের সুখের একটা স্মৃতি থাকত। এখন দাঁত কিড়মিড় করে মরা ছাড়া গতি নেই। আদালত তো বড়োজোর বিয়ে ভেঙে দেবে, তার বেশি কিছু করবে না। আইনে মারধরের নিয়ম নেই, কিন্তু থাকা উচিত ছিল।

কাউকে কিছু না বলে লক্ষ্মী সটকে পড়েছিল। প্রথমে সবাই ধরে নিয়েছিল, অন্য কারও সঙ্গে ভেগেছে। পরে খবর এল, তা নয়। বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। তাতে খানিকটা স্বস্তি বোধ করেছিল নবীন। মুখটা বাঁচল। কিন্তু সেই তার লোহা—পেটানো হাত—পা নিশপিশ করে।

সকালে কারখানা যাওয়ার পথে অক্ষয় উকিলের চেম্বারে উঁকি দেয় নবীন। চেম্বারের অবস্থা শোচনীয়। উপরে টিনের চালওলা পাকা ঘরের চুন—বালি গত বর্ষার স্যাঁতসেঁতে ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ঝুরঝুর করে সব ঝরে পড়ে যাচ্ছে। উকিলের নিজস্ব চেয়ারের গদি ফেড়ে গিয়ে ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে। তিন আলমারি বইতে উই লেগেছে, আলমারির গায়ে উইপোকার আঁকাবাঁকা মেটে সুড়ঙ্গ। বই অবশ্য নকল, মক্কেলদের শ্রদ্ধা জাগানোর জন্য সাজিয়ে রাখা বেশিরভাগ বই—ই ডামি। ওপরে মলাট, ভিতরটা ফোঁপরা। মক্কেলহীন ঘরে বসে অক্ষয় উকিল গতকালের শালটা গায়ে দিয়ে নাতিকে অঙ্ক কষাচ্ছে। চারটে টাকা পেয়ে গম্ভীর মুখে বলল, এ মামলা তুমি জিতেই গেছ ধরে নাও।

নবীন নিশ্চিন্ত হল না।

তিন

শীতের বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে আসে। ওভারটাইম খেটে বেরোতে বেরোতে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।

কারখানা ছাড়িয়ে বাজারের পথে পা দিতেই মোড়ের মাথায় শুকনো মুখে তার শ্বশুর দুর্গাপদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু থমকাল নবীন। কথা বলা উচিত কি না ভাবছে। লোকটা তেমন খারাপ নয়।

নবীনকে বলতে হল না, দুর্গাপদই শুকনো মুখে একটু হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে এগিয়ে এল— সব ভালো তো?

নবীন বে—খেয়ালে প্রণাম করে ফেলে। বলে, মন্দ কী?

দুর্গাপদ শুকনো ঠোঁট জিভে চেটে বলে, এদিকে একটু বিষয়—কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।

নবীনও ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করে, ওদিকে সব ভালো?

দুর্গাপদ হতাশ মুখে বলে, ভালো আর কই? তুমি উকিলের চিঠি দিয়েছ। আমি অতশত ইংরেজি বুঝি না, তবে পড়ে মনে হল, ডিভোর্স—টিভোর্স কিছু একটা কথা আছে।

নবীন বিনীতভাবেই বলল, তাই লেখার কথা। ঠিকমতো লিখেছে কি না কে জানে? আইনের ইংরেজির অনেক ঘোঁরপ্যাঁচ।

দুর্গাপদ বলে— শুধু ইংরেজি কী, উকিলের মুখের কথাও ভালো বোঝা যায় না। দু—বারে কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা দিলাম দুটো মুখের কথা শোনার জন্য। ডিভোর্স ঠেকানোর নাকি উপায় নেই, বলছে উকিল। আমরা তবু ঠেকাতে চাই।

নবীন গম্ভীর হয়ে বলে, আমার উকিল বলছে ডিভোর্স পাওয়া নাকি খুব শক্ত। সরকার নাকি ডিভোর্স পছন্দ করে না।

কারও কথাই বোঝা যাচ্ছে না। ওদিকে লক্ষ্মীর মা বলছে, ডিভোর্স নাকি বে—আইনি। পুলিশ খবর পেলে জেলে দেবে।

নবীন হাসল।

দুর্গাপদ করুণ নয়নে চেয়ে বলল, হাসছ বাবা? লক্ষ্মীর মা যে কীভাবে আমার জীবনটা ঝাঁঝরা করে দিল তা যদি জানতে।

লোহা—পেটানো শরীরটা গরম হয়ে গেল নবীনের মেনিমুখো শ্বশুরের কথা শুনে। ঝাঁকি দিয়ে বলল, স্ট্রং হতে পারেন না? মেয়েছেলেকে দরকার হলে চুলের মুঠি ধরে কিলোতে হয়।

এ কথায় দুর্গাপদও গরম হয়ে বলল, বেশি বলো না বাবাজীবন! তুমি নিজে পেরেছ? পারলে উকিলের শামলার তলায় গিয়ে ঢুকতে না!

এ কথায় নবীন স্তম্ভিত হয়ে গেল।

চার

সিনেমা থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীর খুব উদাস লাগছিল। দুনিয়ায় সে কাউকে গ্রাহ্য করে না, শুধু এই উদাস ভাবটাকে করে। এই যে কিছু ভালো লাগে না উদাস লাগে, এই যে দুনিয়ার সঙ্গে নিজেকে ভারি আলাদা মনে হয়, এই যে সিনেমা দেখেও মন ভালো হতে চায় না— এই তার রোগ। ভেতরে নাড়াচাড়া নেই, নিথর, ভ্যাতভ্যাতে পান্তার মতো জল— ঢ্যাপসা একটা মন নেতিয়ে পড়ে আছে।

সিনেমা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে চেয়ে থাকে লক্ষ্মী। কোথায় যাবে তা যেন মনে পড়তে চায় না।

লক্ষ্মী একটা রিকশা নিল। স্টেশনে এসে উদাসভাবেই নৈহাটির ট্রেনে উঠে বসল। নিজের কোনো কাজের জন্য কখনো কাউকে সে কৈফিয়ত দেয় না।

উঠোনে ঢুকতেই নেড়ি কুকুরটা ভ্যাক ভ্যাক করে তেড়ে এসে লেজ নেড়ে কুঁইকুঁই করে গা শোঁকে। কচুপাতা একটু গলা বাড়িয়ে গায়ে একটা ঝাপটা দেয়।

প্রথমটা কেউ টের পায়নি। কয়েক মুহূর্ত পরেই সারা বাড়িতে একটা চাপা শোরগোল পড়ে গেল।

লক্ষই করল না লক্ষ্মী। উদাস পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে উঠল। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে রাস্তার ধকলটা সামলাতে বড়ো বড়ো শ্বাস টানতে লাগল।

কতক্ষণ কেটেছে কে জানে! লক্ষ্মীর হয়তো একটু ঘুমই পেয়ে থাকবে। হঠাৎ ঘরে একটা বোমা ফাটল দড়াম করে। কানের কাছে একটা বিকট গলা বসে উঠল, উকিলের শামলার তলায় ঢুকেছি? কেন আমার হাত নেই?

বলতে—না—বলতেই চুলের গোছায় বিভীষণ এক হ্যাঁচকা টানে লক্ষ্মী খাড়া হয়ে স্তম্ভিত শরীরে দাঁড়িয়ে রইল। গালে ঠাস করে একটা চড় পড়ল দু—নম্বর বোমার মতো। মেঝেয় পড়তে—না—পড়তেই নড়া ধরে কে যেন ফের দাঁড় করায়।

বিকট গলাটা বলে ওঠে— কার পরোয়া করি? কোন উকিলের ইয়েতে তেল মাখাতে যাবে এই শর্মা? এই তো আইন আমার হাতে? বলি, পেরেছে দুর্গাপদ দাস?

বলতে—না—বলতেই আর একটা তত জোরে নয় থাপ্পড় পড়ল গালে।

লক্ষ্মীর গালে হাত। ছেলেবেলা থেকে এত বড়োটি হল কেউ মারেনি তাকে।

এই প্রথম। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখ! মনের ম্যাদামারা ভাবটা কেমন কেটে যাচ্ছে। টগবগ করছে রক্ত। আর তো মনে হচ্ছে না পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। নেই মানে? ভীষণভাবে সম্পর্ক আছে। ভয়ংকর নিবিড় সম্পর্ক যে।

মেঝেয় বসে লক্ষ্মী কাঁদতে লাগল হাঁটুতে মুখ গুঁজে। কিন্তু সে কাঁদতে হয় বলে কাঁদা। মনে মনে কী যে আনন্দে ভেসে যাচ্ছে সে!

দরজার একটু তফাত থেকে উঁকি মেরে দৃশ্যটা দেখে দুর্গাপদ হাঁ। বজ্জাত মেয়ে বটে! এত নাকাল করিয়ে নিজে এসেছে।

একমাত্র সন্তান মার খাচ্ছে বলে একটু কষ্টও হল দুর্গাপদর। কিন্তু লোভীর মতো জ্বলজ্বলে চোখে সে দেখলও দৃশ্যটা। ঠিক এরকমই দরকার ছিল লক্ষ্মীর মায়ের। দুর্গাপদ পেরে ওঠেনি। কিন্তু বহুদিনকার সেই পাকা ফোঁড়ার যন্ত্রণার মতো ব্যথাটা আজ যেন কেটে গিয়ে টনটনানি কমে গেল অনেক।

পরিশ্রান্ত নবীন ঘরে শিকল তুলে বেরিয়ে এলে পরে দুর্গাপদ গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে হাসি হাসি মুখে বলল, এই না হলে পুরুষ।

রাত্রিবেলা লক্ষ্মী নিজের হাতে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছিল বাপকে। মার খেয়ে মুখ—চোখ কিছু ফুলেছে। কিন্তু সেটা নয়, দুর্গাপদ লক্ষ করল লক্ষ্মীর চোখ দু—খানায় আর সেই পাগুলে চাউনি নেই। বেশ জমজম করছে মুখ—চোখ।

লক্ষ্মী বলল, বাবা, রাতটা থেকে যাও না কেন?

নবীনও সায় দিল, রাতটা হয়েছে, যাওয়ার দরকারটা কী?

দুর্গাপদ মাথা নেড়ে ম্লান মুখে বলে, ও বাবা, তোর মা কুরুক্ষেত্র করবে তা হলে। চিনিস তো!

দুর্গাপদ জানে সকলের দ্বারা সব হয় না। নিয়তি কেন বাধ্যতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *