ওলো সই
অনিরুদ্ধদা কাজটা ঠিক করেনি, কিন্তু কথাটা বোধহয় ঠিকই বলেছে। আমাদের মতো দেশে একজন ডাক্তারের ভিজিট আটশো টাকা হওয়া সত্যিই উচিত নয়, সংস্থিতা বলল।
থাক তোকে আর এসটিডি-তে লেকচার ঝাড়তে হবে না! অন্তরা কপট রাগে বলল।
না রে লেকচার দিচ্ছি না কিন্তু উচিত-অনুচিত নিয়ে তো কথা বলতেই হবে, তাই না? তবে তাও বলব তুই ডাক্তার বক্সির কাছেই যা। ওই পেট কেটে অপারেশনের ঝামেলায় যাস না।
উনি পেট কাটবেন না?
না রে বাবা। ল্যাপ্রোস্কোপিক সার্জন তো, কোনও দাগই থাকবে না তোর অপারেশনের। আমি এর মধ্যে আমার অফিসের কাজেই ভেলোর গিয়েছিলাম একদিন। তোর ব্যাপারটা নিয়ে ওখানকার এক বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। উনিও বললেন সেই সনাতনী প্রথায় পেট কেটে ওভারির সিস্ট বাদ দেওয়া খুব রিস্কি। মানুষ চিরকালের জন্য বন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।
ওরকম হয়ে গেলেই বোধহয় ভাল হত।
একটা টেনে থাপ্পড় কষাব অন্তরা, কী যা-তা বলছিস?
ঠিকই বলছি রে। ওই মিসক্যারেজ না হলে তো আমার এই সমস্যাগুলো দানা বাঁধত না। এবার আবার যে প্রেগন্যান্ট হব, একটা বাচ্চাকে যে নিয়ে আসব পৃথিবীতে, কার ভরসায় আনব? আমার লোকটা তো সেই একই আছে। মিথ্যেবাদী, বাউন্ডুলে।
বাচ্চা হওয়ার পরে পালটে যাবে দেখবি।
তেঁতুল মিষ্টি হয় না সংস্থিতা।
তা হলে ওই টকই ভালবেসে খেতে হবে। মানতে হবে ওটাই ঈশ্বরের ইচ্ছে।
তুই মরতে চেন্নাই যেতে গেলি কেন? ঈশ্বরের ইচ্ছে মনে করে পিয়ালকে বিয়ে করে কলকাতায় থেকে যেতে পারতি, অন্তরা খুব রাগের গলায় বলল।
আমাকে কলকাতায় থাকতে গেলে পিয়ালকে বিয়ে করতে হবে কেন অন্তরা?
হবে না-ই বা কেন? বারবার তুই পিয়ালের প্রসঙ্গ উঠলেই এড়িয়ে যাবি?
এড়িয়ে যাব কেন? এখানে আসার আগেই তো ওকে ফোন করেছিলাম।
পিয়াল ধরল?
ওর ম্যানেজার ধরেছিল।
কে? ওই সতীর্থ?
হ্যাঁ। পরে অবশ্য পিয়ালই ফোন করল আমাকে।
কী বললি?
ম্যামের স্মরণে, আমরা যাঁরা ওকে ভালবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম, একদিন সন্ধ্যায় বসছি। ও যদি সেদিন ম্যামের বাড়িতে এসে দুটো গান গায়, এই আর কী!
পিয়াল কী বলল?
কী আবার বলবে? রাজি হয়ে গেল। এসেছিল তো গাইতে।
ওরে শয়তান, আমাকে তখন একটা খবর দিলি না কেন?
তুই তখন মাসিমা-মেসোমশাইয়ের সঙ্গে রাজগির বেড়াতে গিয়েছিলি, মনে করে দ্যাখ।
তাই তো। কিন্তু কেমন গাইল পিয়াল?
অপ্রত্যাশিত ভাল। আমি ওর গলায় রবীন্দ্রসংগীত আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু সেদিন যা গাইছিল, চোখ বন্ধ করে বসে থাকলে মনে হচ্ছিল…
এত ভাল গাইল?
সত্যি রে! বিশেষ করে ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ আর ‘আমি যখন ছিলেম অন্ধ’ এই দুটো গানে পুরো ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে আমার।
তুই শুনতে শুনতে ওর সেই পুরনো অপরাধটা ক্ষমা করতে পারলি তো?
ও কোনও অপরাধ করেনি অন্তরা। আর ক্ষমা করার আমি কে? ও আমার কথার খুব খারাপ একটা ব্যাখ্যা করেছিল। সেটা আমাকে ভীষণ হার্ট করায় আমি ওর থেকে নিঃশব্দে দূরে সরে গিয়েছিলাম।
ওটাই ভুল করেছিলি। তোর উচিত ছিল ঝগড়া করা, কাউন্টার করা
কী লাভ হত?
তা হলেই বুঝতি পিয়াল খুব ইনোসেন্টলি কথাটা বলেছিল।
ইনোসেন্টলি? আমি ওর সঙ্গে বৈষ্ণোদেবী দর্শনের জন্য যেতে চাইলাম, আর ওর মনে হল আমি পাঁচ দিন শুতে চাইছি ওর সঙ্গে?
‘শুতে চাইছি’ কথাটা কিন্তু ও কখনও কাউকে বলেনি সংস্থিতা। ওর মনে হয়েছিল যে, তুই যখন ওর সঙ্গে বৈষ্ণোদেবী যেতে চাইছিস, তার মানে তোর মনে নিশ্চয়ই একটা স্পেশ্যাল ফিলিং আছে ওর জন্য…
সে তো ছিলই। আমি ওকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করতাম।
মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সঙ্গেই জীবনটা কাটাতে চায়। তাই পিয়াল যদি ভেবে থাকে তুই ওকে বিয়ে করবি, অন্যায় কিছু ভাবেনি।
একেবারেই নয়। কিন্তু সেই বিয়ের ট্রায়াল দিতে বৈষ্ণোদেবীতে ‘লিভ টুগেদার’ করতে যেতে চাইছি, এই ভাবনাটাও কি ন্যায়সংগত?
‘সেক্স’, ‘লিভ-টুগেদার’, ‘চটকাচটকি’ তোর কানে এভাবেই কথাগুলো এসেছে আমি জানি। কিন্তু তার দায় পিয়ালের ওই সব বন্ধুবেশী শত্রুদের।
তা হলেও পিয়ালেরই দায়। পিয়াল ওদের জানিয়েছিল কেন, আমার সঙ্গে ওর কী কথা হয়েছে?
হয়তো সাময়িক উত্তেজনায় বলে ফেলেছিল।
বাদ দে এই প্রসঙ্গ। তুই এখন পিয়ালের উকিল হয়েছিস, আমি যা বলব তারই উলটো মানে করবি, সংস্থিতা হাসল।
অন্তরা এপার থেকে বলল, উকিল যদি হতে পারতাম তো আমি তোর বোন শ্রীতমার হতাম।
হ্যাঁ, পিউয়ের কেসটা কোথায় দাঁড়িয়ে একটু বল, সংস্থিতা কথা ঘোরাতে পেরে বেঁচে গেল।
শোন, আমরা মিস্টার সরখেলের কথা ভেবেছিলাম পিউয়ের কেসটা লড়ার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই দুঁদে উকিলকে আর দরকার নেই। ওরা মিউচুয়াল দিয়ে দেবে।
মিউচুয়াল দিয়ে দেবে? হঠাৎ এত দয়া?
দয়া কি কেউ কাউকে করে? এমন একটা চাল চেলেছি যে, বাছাধনরা বাপ বাপ বলে মিউচুয়াল দিতে রাজি হয়ে গেছে।
আমাকে বল প্লিজ!
না, তোর জানার দরকার নেই। তুই জান যে, তোর ঠাকুরের দয়ায় ব্যাপারটার একটা সলিউশন পাওয়া গেছে।
ঠাকুরের দয়া তো নিশ্চয়ই। আমি স্থির জানতাম পিউ সদ্গুরুর দীক্ষিত, ওর জীবনের একটা না একটা ভাল পরিণতি হবেই।
সদ্গুরুর দীক্ষিত তো তুইও। তোর নিজের জীবনের কী হবে?
আমারও ভালই হবে। আচ্ছা অন্তরা, তোর বাচ্চা হওয়া, পিউয়ের মুক্তি পাওয়া, এগুলো কি আমার ভালর মধ্যে পড়ে না? আমি দূরে চলে এসেছি বলে কি তোদের থেকে এতটাই দূরে? সংস্থিতা কেঁদে ফেলল।
অন্তরা ধরাগলায় বলল, কাঁদিস না সোনা, যুদ্ধ জেতার আগে কাঁদিস না। আর আমাকে ভুল বুঝিস না কখনও।
সংস্থিতা হেসে ফেলল, তোকে আবার ভুল বুঝলাম কখন?
এই যে একটু আগে পিয়ালের কথা বলছিলাম বলে রেগে যাচ্ছিলি! পিয়াল কী করেছে জানিস? আমার কথামতো পিউয়ের শ্বশুরবাড়ি মানে ওই শয়তানদের বাড়িতে ফোন করে থ্রেট দিয়েছে।
কী বলছিস তুই অন্তরা?
ইয়েস ডার্লিং, ঠিকই বলছি। পিয়াল ওদের ফোন করে বলেছে যে পিউয়ের পাঠানো ডিভোর্সের কাগজে যদি ওরা সই না করে, তা হলে ওদের দুষ্কর্ম নিয়ে গান বেঁধে ও মঞ্চে মঞ্চে গাইবে আর গাওয়ার আগে ওদের ছেলের নামধাম সব বলে দেবে।
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না অন্তরা! সংস্থিতা বিহ্বল গলায় বলল।
কিন্তু এটাই সত্যি। তুই ভাব তো একটা সেলিব্রিটি কত বড় ঝুঁকি নিল তোর জন্য! ওই লোকগুলো তো ইনফ্লুয়েনশিয়াল, ওরা তো ওকে পালটা কেস দিতে পারত! সবচেয়ে বড় কথা, ওর কী দরকার ছিল পিউ ওর রিলেটিভ বলে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করার? পিউকে ক’বার দেখেছে ও জীবনে?
সব তোর জন্য হল রে অন্তরা। তুই এভাবে ভাবলি বলেই…
অন্তরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার জন্য কিছু হয়নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, তোর ঠাকুর আমার মাথায় বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর যা হয়েছে সমস্তটাই পিয়াল তোকে ভালবাসে বলে।
আমি ওর কাছে খুব কৃতজ্ঞ রে অন্তরা! আমি বললে ও কীভাবে নেবে জানি না, তুই ওকে জানাস।
মারব এক থাপ্পড়! কৃতজ্ঞতার দেবী রে আমার! ভালবাসার জবাব ভালবাসা দিয়ে দিতে শেখ। ওই তোর জপ-ধ্যান করার পাশাপাশি এমন একটা কিছু কর, যাতে… অন্তরা চুপ করে গেল।
যাতে? সংস্থিতা জিজ্ঞেস করল।
যাতে পিউ সত্যি সত্যি পিয়ালের রিলেটিভ হতে পারে। বুঝলি? অন্তরা বলল।
সংস্থিতা হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, চেষ্টা করব।