ওলিম্পিয়া
এগারোটা বেজে গেছে। এত দেরি হবে ভাবতে পারিনি। এখন কোনওরকমে ঘরে গিয়ে ঢুকতে পারলে হয়। তার ওপর আবার যদি কুঁজোটা দেখি খালি, তাহলেই চমৎকার। শুয়ে পড়লেই রাত কাবার হয়ে যাবে। কিন্তু আর কিছু না হোক, দু-গেলাস জল তো চাই। অমিয়র বাড়িতেই দু-মুঠো খেয়ে নিলে হত। অমিয় বোধহয় আমার অবস্থাটা কিছু আন্দাজ করতে পারে। একমাত্র অমিয়। আর সবাই দেখে–বালিগঞ্জ প্লেস। দোতলা বাড়ি। বিলিতি স্টাইলের। লাল মারুতি।
যা ভেবেছি। ঘরে আলো জ্বলছে। সেই মুখোমুখি দেখা হবে। এমনই বাড়ির প্ল্যান যে সামনের ওই ঘরটাকে এড়িয়ে যাবার কোনও পথ নেই। রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে উঠলেও নয়। সত্তর বছর বয়সে একটা লোক এরকম পরিশ্রম করতে পারে বোধহয় শুধু টাকার লোভেই। মরুক গে–যা বলার বলুক, একটাও উত্তর দেব না। অনেক সহ্য করেছি। আর তো একটা মাস বড়জোর। তা ছাড়া কী বলবে, সে তো মুখস্থ। খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে। রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। এখন কৃতজ্ঞতার সুদ দিতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয় বলে দিই, আর এক মাস–তারপর আপনার চোখ দুটো কোটর ঠেলে বেরিয়ে পড়বে, মুখ দিয়ে কথা সরবে না।
ধুত-দরজাটা অবধি বেইমানি করছে। অবশ্য দরজা নিঃশব্দে খুললেই কি আর রেহাই পেতাম। ঘাড়টা সিধে করে হেঁটে যাব। চটিটা ফটর ফটর করে অসীমের মতো হাঁটতে পারলে খারাপ হত না। কিন্তু তাহলে মাঝরাতে লঙ্কাকাণ্ড বাধবে। কটা দিন যাক–
আশ্চর্য! ডাকল না তো! ব্যাপার কী? ঘরে নেই নাকি! হতেই পারে না। আলো জ্বালিয়ে চলে যাবে–বাথরুমে গেলেও তা করবে না। তা ছাড়া টাইপরাইটারের শব্দও কানে আসছে না। দেখতে হচ্ছে উঁকি মেরে।
দরজাটা খোলাই রয়ে…এ কী!
টাইপরাইটারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। দু-হাত টেবিলে ছড়ানো… তবে কি…
নাঃ, শ্বাস পড়ছে না। বুড়ো তাহলে হার্ট অ্যাটাকেই মরল। অনেকগুলো চিঠি টাইপ করেছে। একটা লেটারহেডের কাগজ তো রাইটার থেকে ঝুলছেও। যাক, সারাজীবনের অপকর্মের ফল পেল তাহলে। তা-ই বা বলি কী করে? হার্ট অ্যাটাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে… এ তো সুখের মৃত্যু। ভুগতেও হল না। মৃত্যুযন্ত্রণাও কিছুই টের পেল না। এখন অসীমকেই ডাকি তাহলে…।
না। সাদা কাগজটা টাইপরাইটারে গুঁজেই মরেছে যখন–কিছু টাইপ করে রেখেও তো মরতে পারত। সারাজীবন তুমি আমাকে নিয়ে তোমার ইচ্ছেমতো পুতুলখেলা করেছ। এবার মরার পর আমার একটা ইচ্ছেমতো তোমাকে শেষ কাজটি করতে হবে।
দেখি–না, আঙুলগুলো তেমন শক্ত হয়নি। এখনও শরীরটা গরম আছে। তার মানে বেশিক্ষণ হয়নি। রুমালটা বার করি। না, নিজেরটা দিয়ে নয়। বুড়োর রুমালটাই-হ্যাঁ পেয়েছি। এবার তুমি মরা আঙুলে টুকটুক করে টাইপ করে ফেল দেখি–হ্যাঁ, এই তো বেশ হচ্ছে। বেশি কথার দরকার কী… তাড়াতাড়ি কাজ সারা চাই। হার্ট অ্যাটাকের রুগি তার শেষ ইচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে মরার আগে। কাজেই ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ–বাক্য অসম্পূর্ণ ক্যাপিটাল ব্যবহার না করে–শুধু একটাই তো বক্তব্য–যাবতীয় সম্পত্তি সে তার নেফিউ রঞ্জিত মিত্রকে দান করে দিতে চায়। বাস!
আরেকবার দেখে নিই। টাইপরাইটারের কি-বোর্ডে আঙুলের ছাপ থাকতে পারে না। বুডোর রুমালে আমার আঙুলের ছাপ থাকলেও ঘষে দিয়েছি। ঘরের মধ্যে জুতোর ছাপ না, চলাফেরা কিছুই করিনি। ওহ, টাইপরাইটারের রোলারটা হাত দিয়ে ঘুরিয়েছিলাম– রুমাল দিয়ে মুছে দেওয়া দরকার।
এবার হাঁক ছাড়তে পারি। অসীমকে ডাকব, না রঘুকে? আগে বরং ডাক্তারবাবুকে ফোন করি। মারা গেছে বলে বুঝতে পেরেছি কবুল করব কেন?
–ব্যাপার কী রঞ্জিত?
অসীমের গলা কানে আসতেই চমকে গেল। রিসিভারটা প্রায় হাত ফসকে যাচ্ছিল। সামলে নেবার আগেই অসীম ঘরে ঢুকেছে। মুহূর্তের জন্যে হলেও রঞ্জিতের এস্ত ভাব তার চোখ এড়ায়নি। তারপরে বাবার দিকে নজর পড়তেই শিউরে উঠল অসীম, এ কী! বাবা!
-প্লিজ টাচ করবেন না। রঞ্জিতের গলাটা ঠান্ডা।
–কী বলতে চাস তুই?
হ্যালো! ডাক্তারবাবু, আমি নীহার রায়ের বাড়ি থেকে বলছি। রঞ্জিত। শিগগির আসুন একবার। মিস্টার রায় টেবিলে, টাইপরাইটারের সামনে টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। ভঙ্গিটা খুব খারাপ। নাকের সামনে হাত রেখে দেখেছি, নিঃশ্বাস পড়ছে না। কী বললেন? জানি না, আমি এইমাত্র ফিরেছি। চোখে পড়ামাত্র ফোন করছি।… না না, কোনও কিছুতে হাত দিইনি।
অসীম জ্বলন্ত দৃষ্টিতে রঞ্জিতের দিকে তাকালেও তার আদেশ অমান্য না-করাটা বোকামি হবে আন্দাজ করেছে।
রঞ্জিত টেলিফোন রেখে ফিরে তাকাল। অসীম টাইপরাইটারের ওপর ঝুঁকে কাগজটা দেখছে।
রঘু! রঘু!
হঠাৎ তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল রঞ্জিত। অসীম যদি টাইপরাইটারের কাগজটা টেনে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে! কথাটা আগে মাথায় আসেনি। গায়ের জোরে তাকে বাধা দিতে পারার মতো পুষ্টিকর খাদ্য কোনওদিনই মামার বাড়িতে জোটেনি।
রঞ্জিতের ভয়ার্ত চিৎকারে একটু থমকে গিয়েছিল অসীম। দ্বিধাগ্রস্ত দু-চার সেকেন্ড। হয়তো টাইপরাইটার থেকে কাগজটা টেনে নেয়ার চিন্তা তার মাথাতেও আসত না, কিন্তু রঞ্জিতের দৃষ্টিই তাকে সচেতন করে দিল। টাইপরাইটার থেকে খামচা মেরে টেনে নিল কাগজটা।
রঘু দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। রঞ্জিত আবার চিৎকার করে উঠল, রঘু! ধর ধর—
বড়বাবুর ঘাড় কাত করে পড়ে-থাকা; অসীমের হাতের মধ্যে দলা-করা কাগজ–কিছু বুঝুক বা না, রঘু লাফিয়ে এসে চেপে ধরল অসীমকে। রঘুর হাত ছাড়িয়ে নেবার মতো ক্ষমতা নেই অসীমের। রঘু প্রায় চেপে ধরে তার মুঠো থেকে কাগজের টুকরোটা বার করে নিল।
রঞ্জিত দেখল, অহেতুক ভয় পেয়েছিল সে। তাড়াহুড়োয় অসীম কাগজের তলার দিকের অংশটা টেনেছিল। টাইপ করা অংশটা টাইপরাইটারেই থেকে গেছে।
বাইরে একটা গাড়ির হর্ন। ডাক্তারবাবু এসে গেছেন।
–আসুন, আসুন অস্বাস্থ্যকরবাবু!
বেশ মর্যাদাপূর্ণ একটি টাকবিশিষ্ট মধ্যবয়স্ক অপরিচিতকে একমাত্র ঝন্টুমামাই পারেন এভাবে সম্বোধন করতে।
ডক্টর সিনহা আগেই নিলয়ের মুখে বিজ্ঞানকর্মী ঝন্টুমামার পরিচয় পেয়েছিলেন। তিনি অবাক হলেন না। বরং অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন।
ব্যাটারির খোল দিয়ে তৈরি টুলে বসে ডাক্তারবাবু কাজের কথা পাড়লেন। কিছুটা নিলয়ের কাছে শোনাই আছে, তবু ঝন্টুমামা জানতে চাইলেন, ডাক্তারবাবু হঠাৎ ঝন্টুমামার শরণাপন্ন হচ্ছেন কেন?
-না, মানে মিস্টার রায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। সিম্পল কেস। আগেও দু-বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, মাসিভ অ্যাটাক। কাজেই যা ঘটেছে, অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও তা-ই বলে। আমি এসেছি অন্য কারণে। মিস্টার রায়ের ভাগনে রঞ্জিতের জন্য। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। ওর প্রতি আমার একটু দুর্বলতাই আছে বলতে পারেন। মিস্টার রায় রঞ্জিতের সঙ্গে যেরকম দুর্ব্যবহার করেছেন, সেটা জানলে যে কেউই… যাক, এখন কথা হল, রঞ্জিতকে পুলিশ খুব হ্যারাস করছে। শারীরিক নির্যাতনও বাদ যায়নি। এবং সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটছে মিস্টার রায়ের গুণধর পুত্র অসীমের নির্দেশে। ভারী অন্যায়। অসীম পয়সার জোরে…।
সবুর, সবুর। আমি যেন শুনেছিলাম, মিস্টার রায় মৃত্যুর ঠিক আগে টাইপ করে তাঁর শেষ উইলে যাবতীয় সম্পত্তি রঞ্জিতকেই দিয়ে গেছেন?
হ্যাঁ, শুনেছেন ঠিকই, কিন্তু ওটাকে উইল বোধহয় বলা যায় না। নিজে সই করেননি, কোনও সাক্ষী নেই–মোট কথা, ওটা আদালতেই নিস্পত্তি হবে।
-তাহলে অসীম এখনও সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়নি?
-না। কিন্তু তার নিজেরও টাকার অভাব নেই। আমি শুধু আপনার কাছে এসেছি রঞ্জিত যাতে অযথা শাস্তি না পায়। সত্যি বলতে সেই রাত্রির ঘটনার তো আমিও সাক্ষী, আজ যদি রঞ্জিতের টাকা থাকত, সে-ও অসীমকে একইভাবে প্যাঁচে ফেলতে পারত।
-কীরকম?
মিস্টার রায়ের মৃতদেহ প্রথম চোখে পড়ে রঞ্জিতের। সে প্রথমেই আমাকে খবর দেয়। তারপর অসীম এসে ঢোকে। টাইপরাইটারে গোঁজা কাগজটার দিকে নজর পড়তেই সে একটানে সেটা তুলে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল। এমন সময় বাড়ির চাকর রঘু এসে পড়ে। আমি যখন পৌঁছাই তখনও সেই ধস্তাধস্তি-বচসা চলছে। কাজেই বুঝতেই পারছেন, অসীম একেবারে নির্ভেজাল সাধু নয়। মুশকিল হচ্ছে, অসীমের দাবি, ওই উইলটা জালিয়াতি। রঞ্জিতই ওটা টাইপ করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
-রঞ্জিত সেদিন কখন বাড়ি ফিরেছিল, সেটা জানা গেছে?
–হ্যাঁ। ওর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে সেদিন রাত করে ফিরেছিল। এই রাত এগারোটা, সওয়া এগারোটা নাগাদ। আর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা গেছে, মিস্টার রায় দশটার আগে মারা যাননি। কাজেই ঠিক… তবে আরেকটা কথা, অসীম দাবি করেছে, তার বাবার পক্ষে সমস্ত সম্পত্তি রঞ্জিতকে দান করার মতো অ্যাবসার্ড ব্যাপার আর হয় না। জীবনে তিনি কোনওদিন তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেননি। কথাটা রঞ্জিতও স্বীকার করে, কিন্তু সেই সঙ্গে সে এটাও জানিয়েছে যে, গত মাস দু-তিন ধরে পিতা-পুত্রের রিলেশনও খুব স্ট্রেইন্ড ছিল। রঘুও সে কথা বলেছে। ব্যাপারটা অসীমের বিয়েঘটিত। মিস্টার রায়ের পছন্দ-করা পাত্রীটিকে নাকচ করেছিল অসীম।
–আচ্ছা, ওই টাইপ করা কাগজটার কোনও কপি কি…
-এই দেখুন–একটা ফোটোকপি। আর এটা হচ্ছে ভদ্রলোকের মৃত্যুর কিছুক্ষণ বাদে ঘরের মধ্যে তোলা ছবি।
ডক্টর সিনহার হাত থেকে টাইপ করা কাগজটা টেনে নিলেন ঝন্টুমামা।
heart attack i hereby bequeath all my property to my nephew ranjit mitra
একটা ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস বার করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন ঝন্টুমামা।
ডক্টর সিনহা বললেন, আমি জানতে পেরেছি, টাইপ করার সময়ে অক্ষরগুলোর ওপর সমানভাবে চাপ পড়েনি। ক্যাপিটাল বা যতিচিহ্নও ব্যবহার করেননি। মিস্টার রায় কিন্তু ভালো টাইপ জানতেন। ইন ফ্যাক্ট, প্রথম জীবনে এক জার্মান এজেন্সি হাউসে তিনি টাইপিস্টের চাকরি করতেন। তারপর নিজেই ব্যাবসা শুরু করেন…
-কী বললেন, জার্মান কোম্পানি? টাইপিস্ট?
-হ্যাঁ। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের পর বা সেই সময়ে টাইপ করতে গিয়ে এরকম তো হতেই পারে। হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয় তাঁর দু-হাত ব্যবহার করার ক্ষমতা ছিল না। এক হাতেই কোনওরকমে–আর সেই জন্যেই ক্যাপিটাল হরফও ব্যবহার করেননি
-না না। আমি সে কথা বলছি না। আচ্ছা, এক মিনিট বসুন তো।
ঝন্টুমামা উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা বই টেনে নিয়ে তার পাতা ওলটাচ্ছেন। মিনিট দু-তিনের মধ্যেই ফিরে এসে বললেন, মিস্টার রায়ের কীসের ব্যাবসা ছিল?
–এক্সপোর্টের। ডয়টশে হান্ডেল কোং (Deutsche Handel Co.)। একচেটিয়া কারবার।
–উনি নিজে হাতে টাইপ করতেন কেন?
–কাউকে বিশ্বাস করতেন না তাই। জার্মান ফার্মদের সঙ্গে চিঠিচাপাটির ব্যাপারটা নিজেই চালাতেন।
-হুঁ। আচ্ছা, আমার যা জানার জেনে নিয়েছি। এবার আপনাকে দুটো কাজ করতে হবে। এক, রঞ্জিতকে একবার আমার কাছে পাঠাবেন। দুই, মিস্টার রায়ের টাইপরাইটারের একটা ছবি। যাতে পুরো কি-বোর্ডটা পড়া যায়–এভাবে তুলতে হবে। সম্ভব?
–হ্যাঁ, তাতে আর অসুবিধে কী!
.
বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। কিন্তু দূর থেকে শীর্ণ চেহারা আর খসখসে চুলগুলো দেখলে আরও দশ বছর বেড়ে যেতে পারে। গালের হাড় দুটো উঁচু, পাতলা ঠোঁট-ময়লা রং। বৈশিষ্ট্য শুধু চোখ দুটো। বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু ভীরু। দাঁড়াবার ভঙ্গিটার মধ্যেও যেন সচেতন কুণ্ঠা।
ঝন্টুমামা দু-বার বসতে বলবার পর কোনওরকমে ব্যাটারির প্রান্তে শুধু সামান্য ভর রেখে এগিয়ে বসল।
ঝন্টুমামার দৃষ্টির সামনে যেন ক্রমেই কুঁকড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো কোথায় রাখবে, ভেবে পাচ্ছে না।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রঞ্জিত। ঝন্টুমামার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, যা-ই বলুন আর যাই করুন, আমি কিছুই ভয় পাই না। পুলিশের কাছে এত আদর খেয়েছি, তারপর আর… আপনি যদি ভেবে থাকেন, শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন, খুব ভুল করছেন।
–এক মিনিট, রঞ্জিত। তোমাকে বেশিক্ষণ আটকাব না। আমায় শুধু একটা কথার জবাব দাও। কেন মিথ্যে নিজেকে অত্যাচার করছ? তুমি তো সত্যিই নীহার রায়ের সম্পত্তি চাও না!
-সম্পত্তি! কে চায় ওই নোংরা সম্পত্তি!
–তাহলে কেন শুধু শুধু সুযোগ দিচ্ছ পুলিশকে…
–পুলিশ কী অত্যাচার করবে? তাহলে শুনুন। সাত বছর বয়সে মা-বাবাকে হারাই। মামিমা নিয়ে আসেন আমাকে। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যে তিনিও চলে গেলেন। দ্বিতীয়বার মা-কে হারালুম। তারপরেই শুরু হল–অসীম আমারই বয়সি। ক্লাস এইটে ও ফেল করল আর আমাকে ছাড়তে হল স্কুল। তারপর থেকেই নীহার রায়ের ক্রীতদাস আমি। ভাবতে পারেন, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও একটা লোক প্রয়োজনভিত্তিক মাইনে পায় দৈনিক আঠারো ঘণ্টা পরিশ্রম করে! বুঝতে পারছেন না? প্রয়োজনভিত্তিক মানে–রেশন মাসে একটা সাবান, আধখানা টুথপেস্ট, ট্রামের মান্থলি ইত্যাদি। আর তিন টাকা হাতখরচ।
–সবই বুঝছি রঞ্জিত, কিন্তু ওই উইল নিয়ে…
-মন-ভোলানো কথা বলে লাভ নেই। পারেন তো প্রমাণ করুন, ওটা আমি জাল করেছি। আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পারবেন না।
–কিন্তু ধর, যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় তাহলে কিন্তু স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরলেও তুমি আর চাকরিটা পাবে না।
-কী বললেন?
মুহূর্তের মধ্যে রঞ্জিতের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
–তোমার ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। আরও শুনে রাখ, তুমি ফার্স্ট ডিভিশনে পাশও করেছ। ক-দিনের মধ্যে জানতেই পারবে। তার মানে তোমার বন্ধু অমিয়র বাবার অফিসে চাকরিটা পাকা। যে পরিস্থিতির মধ্যে সবাইকে লুকিয়ে পড়াশোনা করেছ–সত্যি আমি খুব আনন্দিত। অনেক কষ্ট পেয়েছ, এবার সুস্থভাবে বাঁচার সময় এসেছে। কেন আর…
-না না। আপনি যা-ই বলুন, প্রমাণ যদি করতে না পারেন…
–যদি করতে পারি, মেনে নেবে তো? কথা দাও, আর তাহলে এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না? অসীম তার বাবার সম্পত্তি ভোগ করুক, তোমার কী? শুধু ঈর্ষা আর রাগ…
কথা দিচ্ছি, উইল যদি জাল প্রমাণ করতে পারেন তো যা বলবেন, মাথা পেতে নেব।
–বেশ। তাহলে এবার এই ফোটোটা দেখ।
–এ তো মামার টাইপরাইটার?
–হ্যাঁ। এটা কোন কোম্পানির তৈরি, পড়তে পারছ? ওলিম্পিয়া। মডেলের নাম– Splendid 33। নামটা একটু অচেনা–তা-ই না? আসলে এটা জার্মান টাইপরাইটার। তুমি কি জান, জার্মান টাইপ রাইটারের সঙ্গে ইংরেজি টাইপরাইটারের কিছু তফাত আছে?
-জানি। মানে দেখেছি। জার্মান টাইপরাইটারের মাথায় ফুটকিঅলা এ আর কী যেন একটা
ও। একে বলে উমলাউট। এ ছাড়াও তফাত আছে। কি-বোর্ডটার দিকে তাকাও। এই দেখ–এই যে y-এর চাবিটা রয়েছে, এটা কিন্তু সাধারণ টাইপরাইটারের জায়গায় নেই। সাধারণ টাইপরাইটারে যে জায়গায় z থাকে, এখানে সেই জায়গায় y, মানে y আর z এখানে জায়গা বদল করেছে। জার্মান ভাষায় ইংরেজির চেয়ে ঢের বেশি ব্যবহার হয় y, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।
heart attack i hereby bequeath all my property to my nephew ranjit mitra
রঞ্জিতের ভুরু কুঁচকে যায়। বিড়বিড় করে বলে, আমি কখনও জার্মান টাইপরাইটার ব্যবহার করিনি।
জার্মান টাইপরাইটার ব্যবহার না করলেও এই ভুল হয়তো হত না, যদি তুমি টাইপিং না শিখতে। তাহলে চোখে দেখে দেখে চাবি টিপে টাইপ করতে। এবার এই উইলটা দেখ। যেখানে যেখানে y আছে, সেখানেই টাইপে ভুল। প্রথমে ইংরেজি টাইপরাইটার ব্যবহারের অভ্যাসবশত z টিপে ফেলে তার ওপর আবার y মেরেছ। শুধু শেষের দিকে my শব্দটার সময় ভুল করতে গিয়েও শুধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারই মধ্যে এক ঘর এগিয়েছে কাগজসুদ্ধ রোলার–তাই m আর y এর মধ্যে একটু ফাঁক দেখা দিয়েছে। তাই বলছি, জালিয়াতিটা তুমি করেছ কি না প্রমাণ না হলেও এটা তো মানবে যে, সারাজীবন যে লোকটা জার্মান টাইপ রাইটার চালিয়ে অভ্যস্ত, সে কখনও এমনভাবে ভুল করতে পারে না–হাঁর্ট অ্যাটাকের পরেও নয়। তুমি কী বল?
মাথা নিচু করে বসে থাকে রঞ্জিত।
আদিদাস পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁ-করে গিলছিল কথাবার্তা। ঝন্টুমামা বললেন, কী বুঝলি?
–বাব্বা, এ যে দারুণ এক ডিটেকটিভ গল্প!
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮৫ পূজাবার্ষিকী]