ওরফে বাচ্চু

ওরফে বাচ্চু

আমার ডাকনাম ছিল কাজল। বিভূতিভূষণের অপরাজিত উপন্যাস থেকে বাবা এই নাম তার প্রথম ছেলের জন্যে রাখলেন। আমার জন্মের পরপর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মস্তিষ্কবিকৃতি। কাউকে চিনতে পারেন না। কাজেই আমাকে চলে যেতে হলো নানার বাড়ি। আমি নানিজানের বুকের দুধ খেয়ে বড় হতে থাকলাম। নানিজান আদর করে আমাকে ডাকতেন বাচ্চু। বাচ্চা থেকে বাচ্চু। নানিজানের আদরের নামের কাছে পরাস্ত হলো বাবার সাহিত্যনির্ভর নাম।

এখন কোনো পত্রিকা যদি আমার ডাকনাম ব্যবহার করে আমাকে অপমান করতে চায় তাহলে ঘটনা কেমন দাঁড়াবে? তারা যদি লেখে- হুমায়ূন আহমেদ ওরফে বান্ধু–তাহলে কি আমি অপমানিত বোধ করব?

কবি শামসুর রাহমানের ডাকনাম বাচ্চু। তাকে অপমান করতে যদি লেখা হয়–শামসুর রাহমান ওরফে বা–তাহলে কি দেশবরণ্যে এই কবি অপমানিত হবেন?

সম্প্রতি ট্যাবলয়েডশ্রেণীর একটি পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন এই কাজটি করছে। তারা প্রথম আলোর সম্পাদককে অপমান করার জন্যে লিখছে–মতিউর রহমান ওরফে বাচ্চু। অপমানের এই কৌশলের বালখিল্যতা তারা ধরতে পারছে না দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। একজন সম্মানিত মানুষের সম্মান আমরা রাখব না? রুচিবোধের বিষয়ও তো আছে!

মতি ভাইয়ের (মতিউর রহমান) সঙ্গে আমার বর্তমান সম্পর্ক বরফের চেয়েও শীতল, তারপরেও তাকে অপমানের এই হীন কৌশল দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। আমার ডাকনাম বাচ্চু, এটাও একটা কারণ হতে পারে।

যে সাংবাদিকের মাথায় ‘ওরফে বাচ্চু’র উর্বর আইডিয়া এসেছে তার মতো এক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। গল্পটা বলা যেতে পারে।

তখন শহীদুল্লাহ হলের আমি হাউস টিউটর। লেখক-পরিচিতি বা খ্যাতি কিছুই হয় নি। পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যে লালায়িত থাকি, যদি তাতে লোকজনের কাছে আমার নামটা পৌঁছে। কেউ ইন্টারভিউ নিতে আসে না।

এক ভোরবেলায় ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। ইন্টারভিউ নিতে সাংবাদিক বাসায় উপস্থিত। তিনি বললেন, আপনার উপর বিশাল প্রতিবেদন ছাপা হবে, ছবিসহ। বাসায় ছবি আছে?

আমি খুঁজে-পেতে একটা ছবি বের করে তাকে দিলাম। আগ্রহ নিয়ে ইন্টারভিউর প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলো।

সাংবাদিক বললেন, এখন আমার খরচটা দিন চলে যাই।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কিসের খরচ?

আপনার উপর বিশাল প্রতিবেদন যাচ্ছে তার খরচ।

সবাই দেয়। আমি আপনাকে খরচ দিব না। আমার প্রতিবেদনের প্রয়োজন নাই।

সাংবাদিক রাগাবেন না হুমায়ূন ভাই। উল্টাপাল্টা নিউজ করে দিব, সাত হাত পানির নিচে চলে যাবেন।

পানির নিচে গেলেও সমস্যা নাই। আমি সাঁতার জানি।

এই সাংবাদিক নিউজ’ করলেন। তখন মনে হলো খরচ দেওয়াই ভালো ছিল।

সাংবাদিকরা উপদেবতার মতো। তারা খরচে তুষ্ট থাকেন। মতি ভাই, খরচ দিয়ে দেখতে পারেন।

থাক এই প্রসঙ্গ। বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির অপমানের কৌশলের গল্প করা যাক।

মোগল সম্রাট শাহজাহান খেতে বসেছেন। তার সঙ্গে খেতে বসেছেন পারস্য থেকে আসা রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূত কড়মড় করে মুরগির রান চিবুচ্ছেন। শাহজাহান বিরক্ত হয়ে বললেন, হাড় সব খেয়ে ফেলছেন। কুকুরের জন্যে কিছু রাখবেন না?

রাষ্ট্রদূত আঙুল উঁচিয়ে পোলাওয়ের থালা দেখিয়ে বললেন, ওই তো রেখেছি। কুকুর খাবে।

সম্রাটকে অপমান করার জন্যে এই কথা বলা। পোলাও সম্রাটের অতি প্রিয় খাবার। পারস্যের রাষ্ট্রদূত এটা জানেন।

সম্রাট হুমায়ূনের ভাই বিদ্রোহী কামরান মির্জাকে গ্রেফতার করে সম্রাটের সামনে আনা হয়েছে। যে তরবারি ঝুলত কামরান মির্জার কোমরে, সেই তরবারি তার গলায় ঝুলিয়ে তাকে উপস্থিত করা হয়েছে। একজন রাজপুরুষের জন্যে অপমানের শেষ সীমানা।

কবিরা আবেগতাড়িত মানুষ। এরা অতি সহজেই অপমানিত হন। তার একটি গল্প বলি।

অনেক কাল আগে সুনামগঞ্জে গিয়েছি হাসন উৎসবে। দেশের অনেক কবিও গিয়েছেন। আমাদের জায়গা হয়েছে সার্কিট হাউসে। ভালো আয়োজন। হঠাৎ কবিদের একজনের মাথা গরম হয়ে গেল। কারণ অতিথি তালিকায় তার আগে জুনিয়র একজন কবির নাম চলে এসেছে। তিনি উৎসবে যোগ না দিয়ে ঢাকায় চলে এলেন।

বাংলাদেশের কবিরা নামের আগে-পরের বিষয়ে স্পর্শকাতর। তাদের নানান ভাগও আছে। সত্তর দশকের কবি, ষাট দশকের কবি ইত্যাদি।

ঔপন্যাসিকেরা কবিদের মতো এত স্পর্শকাতর না। তারা বিভিন্ন দশকে বিভক্তও না। আমি কখনো বলতে শুনি নিউনি সত্তর দশকের ঔপন্যাসিক।

কবিদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আমি নিজে শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে, কবিদের কিছু হাতাহাতি দেখেছি। ঔপন্যাসিক বা গল্পকারদের হাতাহাতি এখনো দেখা হয় নি।

এখন ব্যক্তিগত কিছু অপমানের গল্প।

বিটিভিতে তখন ‘বহুব্রীহি’ নামের একটি ধারবাহিক নাটক চলছে। বাংলা সাহিত্যের জনৈক অধ্যাপক আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আমার কাজের মেয়ে আপনার এই নাটক মন দিয়ে দেখে। কাজের মেয়ের মন জয় করাও খারাপ না।

তোমাদের জন্যে ভালোবাসা নামের একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেছিলাম। মনে হয় বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। বইটি পড়ে সাহিত্যের এক অধ্যাপক বললেন, লেখার আগে কি গাঁজায় দম দিয়ে নিয়েছিলেন? গাঁজায় দম না দিয়ে এই জিনিস লেখা যায় না।

আমার চামড়া মোটা এবং খসখসে বলেই মনে হয় কোনো অপমান আমার গায়ে লাগে না। তবে কোনো অপমানই আমার গায়ে লাগে না কথাটা ভুল বললাম। ছেলেমেয়ের অপমান গায়ে লাগে।

আমার মেজো মেয়ে শীলা ইকনমিক্সে প্রথম শ্রেণীতে এম এ ডিগ্রি পাওয়ার পর তাকে মিষ্টি এবং ফুল পাঠালাম। সে তা ফেরত পাঠাল। সঙ্গে একটা চিঠি ভুল করে মিষ্টির প্যাকেট খুলে একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলেছি। সরি।

সব মানুষকে তার দীর্ঘ বা স্বল্প জীবনে নানান তপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অপমান আগুণের মতো, মানুষকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।

.

পাদটিকা

মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ
জিহ্বা টলতি ধীরস্য
পাদষ্টলতি হস্তিনঃ।

ধীর ব্যক্তিরও জিহ্বা কখনো কখনো বিচলিত হয়। হাতিরও কখনো কখনো পদস্খলন হয়।

.

কুইজ

‘যে ঈশ্বর পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্ন দিতে পারেন না তিনি পরকালে আমাদের পরম সুখে রাখিবেন ইহা আমি বিশ্বাস করি না।‘

কে বলেছেন এই কথা?

উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *