ওয়ারিশান
ঘরের বাহিরে পা রাখতেই প্রফুল্লবাবু দেখতে পেলেন, চারদিকে বেশ একটা হাসিখুশি ভাব। টমেটোর মতো টুকটুকে রাঙা রোদ উঠেছে, আমলকি গাছে বসে একটা দোয়েল পাখি ফচকে ছেলেদের মতো শিস দিচ্ছে, ঘাসের ওপরে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের ফোঁটার মতো শিশির জমে আছে, হিমেল একটা হাওয়া সজনে আর নিমগাছের সঙ্গে নানা কথা কইতে কইতে বয়ে যাচ্ছে। আরও যেসব দৃশ্য প্রফুল্লবাবুর চোখে পড়ল তাতে তাঁর খুশি হওয়ার কথা নয়। যেমন নগেন ঘোষাল দাঁত খিঁচিয়ে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে দাঁতন করছেন, পরাণ মিত্তির তাঁর বাড়ির বারান্দায় মাদুরে বসে উচ্চচকণ্ঠে ছেলে পটলকে ইংরিজি গ্রামার পড়াচ্ছেন, নিমাই সরখেলের বুড়ি পিসি কতক বককে বকা—ঝকা করতে করতে সামনের উঠোনে গোবরছড়া দিচ্ছেন। এসব নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য। তবু আজ এসব দৃশ্য তাঁর ভারি ভালো লাগল। বাস্তবিক প্রফুল্লবাবু আজ খুবই প্রফুল্ল বোধ করছেন।
প্রফুল্লবাবুর প্রফুল্ল হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। তাঁর অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। বাজারে বেশ কিছু ধার—দেনা আছে। চাষবাস থেকে তেমন আয় হয় না। টাকার অভাবে বাড়িটা মেরামত করতে পারছেন না, বর্ষাকালে ঘরে জল পড়ে। পয়সার জোর না থাকলে মানুষের কাছে মানসম্মানও বজায় রাখা যায় না। লোকে ভারি তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য করে। তিনি গরিব হলেও তাঁর খুড়োমশাই বেজায় বড়োলোক। লোহার কারবার করে লাখো লাখো টাকা করেছেন। তবে পঞ্চানন বিশ্বাস প্রফুল্লবাবুর মুখদর্শনও করতেন না। তার কারণ প্রফুল্লবাবুর যৌবনকালে খুব যাত্রা—থিয়েটার করার নেশা ছিল, আর যেটা তাঁর বাবা বা কাকা কেউই পছন্দ করতেন না। প্রফুল্লবাবু লুকিয়ে গিয়ে যাত্রাদলে নাম লেখান এবং মেয়েদের ভূমিকায় চুটিয়ে অভিনয় করতে থাকেন। যাত্রা করছেন বলে যতটা নয় তার চেয়ে বেশি ওই পুরুষ হয়ে মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন বলে বাবা আর কাকা দু—জনেই তাঁর ওপর বেজায় খাপ্পা হয়ে ওঠেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র অবধি করে ছেড়েছিলেন, আর পঞ্চানন বিশ্বাস তাঁর সঙ্গে সব সম্পর্ক রহিত করে দেন। প্রফুল্লবাবু অবশ্য যাত্রাদলে বেশিদিন টিকতে পারেননি। কারণ ক্রমে ক্রমে মহিলার ভূমিকায় মেয়েরাই অভিনয় শুরু করতে থাকায় প্রফুল্লবাবুর কদর কমে যায়। তিনি যাত্রা ছেড়ে সংসারে মন দেন। কিন্তু তেমন সুবিধে করে উঠতে পারেননি। সম্প্রতি খবর এসেছে তাঁর নিঃসন্তান খুড়োমশাই তাঁর নামে আশি লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। খবরটা পেয়ে আশি লক্ষ টাকা মানে ঠিক কত টাকা তা তলিয়ে ভাবতে গিয়ে প্রফুল্লবাবু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। বিশ—পঞ্চাশ বা দুশো—পাঁচশো টাকা অবধি ভাবতে প্রফুল্লবাবুর বিশেষ অসুবিধে নেই। ক্ষেত্রবিশেষে দু—চার—পাঁচ হাজার অবধিও ভেবে ফেলতে পারেন। কিন্তু তা বলে আশি লাখ! ওরে বাবা! আশি লাখ তো পাহাড়—পর্বত! প্রথম মাথা ঘুরে পড়লেন, তারপর খেতে বসে কয়েকবার বেজায় বিষম খেলেন, আর প্রায়ই আনমনে চলাফেরা করতে গিয়ে ঘরের চৌকাঠে, রাস্তায় পড়ে থাকা ইটে, ইঁদুরের গর্তে হোঁচট খেয়ে পা মচকালেন, তেলকে জল, জলকে তেল বলে ভুল করলেন।
তবে যাই হোক, তিন দিন ধরে তাঁর মনটা ভারি প্রফুল্ল রয়েছে। যখন—তখন ফিক ফিক করে হেসে ফেলছেন, আপনমনে বিড়বিড় করে মাথা নাড়া দিচ্ছেন, আনন্দটা একটু বেশি ঠেলে উঠলে ছাদে গিয়ে কয়েক পাক চরকি নাচও নেচে নিচ্ছেন।
আজ রোববার পঞ্চানন বিশ্বাসের ম্যানেজার অঘোরবাবু আশি লাখ টাকার চেক নিয়ে আসছেন। শর্ত একটাই, গাঁয়ের পাঁচজন বিশিষ্ট লোক যদি প্রফুল্ল বিশ্বাসকে শনাক্ত করেন তবেই চেকটা হস্তান্তর করে অঘোরবাবু রসিদ নিয়ে চলে যাবেন। অঘোরবাবুর চিঠিতে এই শনাক্তকরণ ব্যাপারটার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ অঘোরবাবু প্রফুল্লবাবুকে চেনেন না, আর খুড়োমশাইও প্রফুল্লবাবুর মুখদর্শন করবেন না। তবে সেটা কোনো সমস্যাই নয়। এই গাঁয়ে তাঁর দীর্ঘকাল বাস। সবাই এক ডাকে তাঁকে চেনে। অঘোরবাবুর চিঠি পাওয়ার পরই প্রফুল্লবাবু গাঁয়ের পাঁচজন বাছা বাছা মাতব্বরকে গিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। নগেন ভটচায, বীরেশ মিত্তির, বৈকুণ্ঠ গোঁসাই, সদানন্দ সমাদ্দার আর পাঁচুগোপাল দত্ত। এঁরা সবাই মান্যগণ্য লোক। নগেন ভটচায দারোগা ছিলেন, বীরেশ মিত্তির ছিলেন ওভারসিয়ার, বৈকুণ্ঠ গোঁসাইয়ের তেলকল আছে, সদানন্দ সমাদ্দার পঞ্চায়েতের পাণ্ডা, পাঁচুগোপাল দত্ত একজন নামকরা নাট্যকার, মেলা পালা লিখেছেন।
কিন্তু প্রফুল্লবাবুর এখন চিন্তা হল আশি লক্ষ টাকা নিয়ে। আশি লাখ অনেক টাকা বটে, কিন্তু একটু খুঁতও আছে। টাকাটা লাখই বটে, কোটি নয়। লোকে তাঁকে লাখোপতি বলবে ঠিকই, কিন্তু কোটিপতি বলবে না। কিন্তু কোটিপতিটা শুনতে আরও একটু ভালো। তাই প্রফুল্লবাবু প্ল্যান এঁটে রেখেছেন, টাকাটা হাতে পেয়ে খরচাপাতি একদম করবেন না। বরং আরও শক্ত হাতে খরচ কমিয়ে আশি লাখকে এক কোটিতে নিয়ে তুলবেন। বাজার থেকে মাছ—মাংস আনা ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছেন, তেরো টাকার চাল আনতেন, এখন আট টাকার মোটা চাল ছাড়া আনেন না, দুধের বরাদ্দ কমিয়ে অর্ধেক করে ফেলেছেন, কাজের লোক ছাড়িয়ে দিয়েছেন এবং আরও খরচ কী করে কমানো যায় তা নিয়ে দিনরাত্তির মাথা ঘামাচ্ছেন। এ নিয়ে বাড়িতে ঝগড়াঝাঁটি এবং অশান্তি বড়ো কম হচ্ছে না। তাঁর গিন্নি তো তাঁকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন বলে নিত্য টানাহ্যাঁচড়া করছেন। বলছেন, কোথায় এক কাঁড়ি টাকা পেয়ে একটু ভালো—মন্দ বাজার করবে, গয়নাগাঁটি গড়িয়ে দেবে, বাড়িটা বেশ সারিয়ে—টারিয়ে ঝাঁ—চকচকে করবে, তা নয় এ যে আরও পেচেশপনা শুরু হল!
যে যাই বলুক প্রফুল্লবাবু তাতে কান দিচ্ছেন না। টাকা জিনিসটাই ভারি অস্থায়ী, আজ আছে তো কাল নেই। সেই যে ইস্কুলের নীচু ক্লাসে অঙ্ক কষেছিলেন, একটা আশি গ্যালনের চৌবাচ্চচায় মিনিটে সাড়ে সাত গ্যালন জল ঢোকে আর আট গ্যালন জল বেরিয়ে যায়, চৌবাচ্চচাটি খালি হতে কত মিনিট লাগবে? অঙ্কটার কথা ভেবে আজ একটু শিউরে উঠলেন প্রফুল্লবাবু। সুতরাং বেরিয়ে যাওয়ার ফুটোটা আরও ছোটো করতে হবে এবং ঢোকার ফুটোটা বড়ো করা দরকার।
আজকাল ব্যয়সংকোচের নানা ফন্দিফিকির তাঁর মাথায় ঘুরছে। আগে তাঁর বাড়িতে নিয়মিত কয়েকজন ভিখিরি আসত। এক মুঠো চাল বা সিকিটা—আধুলিটা দেওয়াও হত তাদের। আশি লাখ টাকার খবর পাওয়ার পর প্রফুল্লবাবু তাদের হুড়ো দিয়ে তাড়িয়ে ছেড়েছেন। তারা আর এ বাড়িমুখো হয় না।
অর্থাগম বাড়ানোর জন্য প্রফুল্লবাবু বন্ধকী কারবার খুলবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন। লোকের হঠাৎ বিপদে পড়ে টাকার দরকার হলে সোনাদানা বন্ধক রেখে চড়া সুদে ধার নেবে। এ কারবারে লোকসানের ভয় নেই, ষোলো আনা লাভ। টাকা সময়মতো শোধ করতে না পারলে তাদের সোনাদানাও প্রফুল্লবাবুর হাতে এসে যাবে। এই প্রস্তাবে অবশ্য তাঁর গিন্নির সায় নেই। উনি ভারি বিচলিত হয়ে বলেছেন, না না, ও ভারি সব্বোনেশে ব্যবসা। লোকের বিপদ—আপদের সুযোগ নিয়ে টাকা রোজগার করা ভারি খারাপ, তাতে অমঙ্গল হবে। কিন্তু প্রফুল্লবাবু কানে তোলেননি। কোটি টাকা পার না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সোয়াস্তি নেই।
নগেন ভটচাযের বেশ দশাসই লম্বাই—চওড়াই চেহারা, কাঁচাপাকা পেল্লায় গোঁফ আর বাবরি চুল। বীরেশ মিত্তির রোগা—ভোগা মানুষ, তাঁরও গোঁফ আছে বটে, কিন্তু ঝোলা গোঁফ। তেলকলের মালিক বৈকুণ্ঠ গোসাঁইয়ের চেহারাখানাও বেশ তেল—চুকচুকে, নাদুসনুদুস, দাড়ি—গোঁফের বালাই নেই, মাথাজোড়া টাক। সদানন্দ সমাদ্দারের কেঠো রসকষহীন নিরানন্দ চেহারা, সর্বদাই ভারি ব্যস্তসমস্ত ভাব। পাঁচুগোপাল দত্ত ভারি ঠান্ডা সুস্থির মানুষ, মুখে সর্বদা পান আর মিঠে হাসি। বেলা দশটার মধ্যেই একে একে এসে পড়লেন সব।
নগেন ভটচায বাজখাঁই গলায় বললেন, কই হে প্রফুল্ল, আপ্যায়নের কী ব্যবস্থা হয়েছে শুনি! আমার আবার সকালে দুটি হাফ বয়েল ডিম না হলেই চলে না।
প্রফুল্লবাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। অ্যাপায়নের ব্যবস্থা যে তিনি করেননি তা নয়, তবে একটু চেপে—চুপে। দুটি করে সন্দেশ আর একটি করে শিঙাড়া। আমতা আমতা করে বললেন, তা সে ব্যবস্থাও হবে।
বীরেশ মিত্তির মাথাটা ঘন ঘন নাড়া দিয়ে বললেন, হ্যাঁ! হাফ বয়েল ডিম আবার একটা বস্তু হল! ডিম ভাঙলেই ফচ করে খানিকটা সিকনির মতো বেরিয়ে আসে। ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! বলি সকালবেলায় লুচি দিয়ে মোহনভোগ খেয়েছ কখনো?
সদানন্দ সমাদ্দার অত্যন্ত অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ওহে এই বয়সে ওসব গুরুভোজন কোনো কাজের কথা নয়। ডিমে কোলেস্টরেল বৃদ্ধি, লুচি আর মোহনভোগে হাই ক্যালোরি, বরং দুধ কলা দিয়ে পোটাক ছাতু মেরে দাও, সারাদিনের মতো পেট ঠান্ডা।
পাঁচুগোপালবাবুর মুখে পান, খাবার—দাবারের কথায় বিশেষ উৎসাহ বোধ করলেন না। খুব ঠান্ডা মিষ্টি গলাতেই বললেন, তা কীরকম খরচাপাতি করবে হে প্রফুল্ল?
প্রফুল্লবাবু আমতা আমতা করে বললেন, কীসের খরচাপাতির কথা বলছেন বলুন তো পাঁচুদা।
বীরেশবাবু বললেন, আহা, গাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপটার কথাই তো বলা হচ্ছে হে। পড়ো—পড়ো অবস্থা, সংস্কার না করলেই নয়, টাকার জোগাড় ছিল না বলেই হয়নি। তোমার টাকা পাওয়ার খবর পেয়েই আমরা এস্টিমেট নিয়েছি, তা ধরো কমসম করেও সাড়ে তিন লাখে দাঁড়াচ্ছে!
নগেন ভটচায মশাই ভারি উদার গলায় বললেন, আহা, সেই সঙ্গে রাসেশ্বরীর মন্দিরের এস্টিমেটটাও জুড়ে দাও না হে। চূড়াটা কবে ভেঙে পড়ে গেছে, পশ্চিমের দেয়ালে ফাটল, পুকুরঘাটের সিঁড়ি ভেঙে ধসে গেছে। তা ওই লাখ চারেক হলেই হয়ে যাবে মনে হয়। এক—আধ লাখ এদিক—ওদিক হতে পারে।
সদানন্দ মিষ্টি করে হেসে বললেন, আরে, প্রফুল্লর টাকা তো গাঁয়েরই টাকা, কী বলো? গরিব গাঁ আর কার ভরসা করবে! ফটক বাজার থেকে কালীতলা অবধি রাস্তাটার হাল দেখেছো? বর্ষাকালে অগম্য। দশ থেকে বারো লাখ ফেলে দিলেই রাস্তা একেবারে রেড রোড হয়ে যায়। নিরঞ্জন ঠিকাদার তো মুখিয়ে বসে আছে হে।
নগেনবাবু বললেন, আহা, ও আর চিন্তার কী আছে! আশি লাখ টাকার মালিকের কাছে ও তো নস্যি!
বীরেশ মিত্তির পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে কী দেখছিলেন, মুখ তুলে বললেন, ও আরও একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল হে। প্রগতি সংঘের ক্লাবঘর আর নবীন যুবদলের খেলার মাঠ। বেচারারা বহুকাল হা—পিত্যেশ করে আছে। ক্লাবঘরের জন্য লাখ তিনেক আর খেলার মাঠ বাবদ মাত্র দেড় লাখ।
পাঁচুগোপাল পানের পিক ফেলে এসে বললেন, আসল কথাটাই তো এখনও তুললে না তোমরা! বিদ্যাপতি ইনস্টিটিউশনের এক্সটেনশন বিল্ডিং আর বয়েজ হস্টেল। ও দুটো না হলেই নয়। গাঁয়ের মান থাকছে না। দুটো মিলিয়ে বাইশ—তেইশ লাখে দাঁড়াবে গিয়ে।
বীরেশবাবু কী যেন যোগ করতে চাইছিলেন, ঠিক এমন সময়ে সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। প্রফুল্লবাবু গিয়ে দরজা খুলে বললেন, কাকে চাই?
আজ্ঞে আমি অঘোর সরকার, পঞ্চানন বিশ্বাসের ম্যানেজার। এটা কি প্রফুল্ল বিশ্বাসের বাড়ি?
প্রফুল্লবাবু অম্লান বদনে বললেন, না। প্রফুল্লবাবু মারা গেছেন।