ওয়ানম্যান বাউন্ডারি ফোর্স – সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভয় পাচ্ছিলেন যদি গান্ধীজি এ সময় হঠাৎ দিল্লি এসে পড়েন। ততদিনে ভারতবর্ষের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন সুকৌশলে মহাত্মা গান্ধীকে দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতার রাজনীতির মূলস্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। মাউন্টব্যাটেন কিছুতেই চাইছিলেন না যে গান্ধীজি দিল্লি এসে এমন কিছু বলে কিংবা করে ফেলুন যাতে ভারতকে বিভক্ত করার জন্য তাঁর পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু গান্ধীজি দিল্লি এসে গেলেন এবং তিনি পরের দিনই ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাসভবনে গেলেন। মাউন্টব্যাটেন গান্ধীজির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক টুকরো কাগজ তাঁর চোখের সামনে ধরলেন। মহাত্মাজি দেখলেন, কাগজে মাউন্টব্যাটেনের লেখা ”এই দিনটি আমার মৌন পালনের দিন!” গান্ধীজি বুঝতে পারলেন, মাউন্টব্যাটেন তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা করতে চান না। তিনি সরাসরি ভাইসরয়ের চোখের উপর তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। বললেন, ”বুঝতে পারছি আপনি চান না যে আমি কিছু বলি!” দিনটি ছিল ১ মে, ১৯৪৭। মাউন্টব্যাটেনর সঙ্গে মহাত্মাজির প্রথম সাক্ষাতের দিনটি এভাবেই কাটল।
গান্ধীজির কাছে ওই দিনগুলি ছিল হারানোর ও হেরে যাওয়ার। তিনি নোয়াখালি থেকে বিহার রওনা হলেন। ফেনি থেকে ডাউন চিটাগাং এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠলেন। ৩ মার্চ (১৯৪৭) রাত নটায় ট্রেন থেকে সোদপুর খাদি আশ্রমে। আশ্রমে এসেই তিনি তাঁর লোকদের বললেন একটি নির্দিষ্ট ফাইল তাঁকে দিতে। কিন্তু ফাইলটি পাওয়া গেল না। পরের দিন কলকাতার সব কয়টি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নোটিশ ছাপা হল : লাল মলাটের গান্ধীজির একটি ব্যক্তিগত জরুরি ফাইল হারিয়ে গেছে। কেউ খোঁজ পেলে যেন তা সোদপুর আশ্রমে জানিয়ে দেন। ফেনি থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত রেল লাইনের সর্বত্র, চাঁদপুর, গোয়ালন্দ পর্যন্ত যে স্টিমারে তিনি চড়েছিলেন এবং গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদা পর্যন্ত জায়গা সরকারি ও বেসরকারি লোকেরা ফাইলটির জন্য সন্ধান চালালেন। কিন্তু পাওয়া গেল না। ফাইলটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। সোদপুর থেকে গান্ধীজি বিহার গেলেন। সেখানে দাঙ্গাবিধ্বস্ত গ্রামে তাঁকে পেয়ে আর্ত মানুষেরা তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। আরম্ভ হল প্রচণ্ড ভিড় ও ধাক্কাধাক্কি। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় সারা জায়গা ছিল কাদায় ভরা। এই ধাক্কাধাক্কিতে গান্ধীজির কোমর থেকে তাঁর ট্যাঁকঘড়িটি পড়ে হারিয়ে গেল। এই হারানোগুলি যেন অশনি সংকেত।
পাটনা থেকে মহাত্মাজি দিল্লি পৌঁছলেন। পৌঁছেই বুঝতে পারলেন, তাঁর সংগ্রামী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ভারতবর্ষ, অবিভক্ত ভারতবর্ষও তাঁর কাছে আর নেই। হারিয়ে গেছে। ১৯৪৭—এর ৯ মে তিনি তা বুঝতে পারলেন। ততদিনে চুড়ান্ত পরিণতির দিনগুলি চোখের সামনে এসে পড়েছে। স্বাধীনতার মঞ্চে ২৫ কোটি হিন্দু, ৯ কোটি মুসলমান, ১ কোটি খ্রিস্টান এবং ৫০ লাখের বেশি শিখকে বিভক্ত করার সব পরিকল্পনা সম্পূর্ণ। মানচিত্রে দেশকে ভাগ করার জন্য র্যাডক্লিফ ৯ জুলাই দিল্লি এলেন। মাউন্টব্যাটেন তাঁকে নির্দেশ দিলেন, পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ভারত বিভাগের কাজটি শেষ করতে। র্যাডফ্লিকের রায়ের দিন যত এগিয়ে আসছে, পাঞ্জাব ধিকধিক জ্বলতে আরম্ভ করছে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের উদ্বেগ ছিল সবচেয়ে বেশি বাংলার জন্য। কারণ মাত্র বছর আগেই সেখানে কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে।
পাঞ্জাবে গভর্নর স্যার ইভান জেনকিন্স (Evan Jenkins) মাউন্টব্যাটনকে চাপ দিলেন পাঞ্জাবের জন্য একটি শক্তিশালী বাউন্ডারি ফোর্স গঠন করতে। ভাইসরয় রাজি হলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিটিশ, মুসলমান ও অ—মুসলমানদের মধ্যে থেকে ৫৫ হাজার সৈন্য বাছাই করে গঠন করা হল জয়েন্ট পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স। সর্বাধিনায়ক হলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বর্মার রণাঙ্গনের খ্যাতিমান সৈনিক মেজর জেনারেল রিজ। সহকারী হিসাবে তিনি পেলেন হিন্দু কে এস থিমায়া ও মুসলমান আয়ুব খানকে। তাঁরা দু’জনেই তখন ব্রিগেডিয়ার। মাউন্টব্যাটেন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে লেঃ জেনারেল টুকারকে ( জি. ও. সি বেঙ্গল) লিখলেন যে তিনিও পাঞ্জাবের মতো জয়েন্ট বেঙ্গল বাউন্ডারি ফোর্স চান কি না। জেলারেল টুকার সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি এক ভয়ানক ধর্মীয় দাঙ্গা বাংলায় আরম্ভ হয়, তা হলে ৫৫ হাজার সৈন্য, কামান ও সাঁজোয়া গাড়ি কোনও কাজেই আসবে না। তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছবার আগে তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্য মহাত্মা গান্ধী এই সময় বাংলায় উপস্থিত থাকবেন।
দেশ বিভাগের দিন যতই এগিয়ে আসছে, নোয়াখালি আবার অশান্ত হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। গান্ধীজি কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি নোয়াখালির উদ্বেগজনক খবর পেলেন। তিনি কাশ্মীর থেকে লাহোর ফিরে এলেন। লাহোর থেকে সরাসরি কলকাতার ট্রেন ধরলেন। ৮ আগস্ট সকালে কলকাতায় পৌঁছলেন। হাওড়ায় ট্রেন থেকে নেমে সোজা সোদপুরে চলে গেলেন। বাংলা সরকারের প্রশাসনের বেশিরভাগ মুসলমান অফিসার তখন তাঁদের নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পথে রওনা দিয়েছেন। মুসলমানদের মধ্যে যারা মাত্র এক বছর আগে কলকাতার রাস্তায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার লড়াই করেছিলেন, অথচ পাকিস্তানে যেতে পারছেন না, তাঁর খুবই ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। গান্ধীজি সোদপুর আশ্রমে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে বহু মুসলমান নেতা তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। তাঁকে তারা অনুরোধ করতে লাগলেন তিনি যেন তাঁদের কলকাতায় অরক্ষিত রেখে নোয়াখালি চলে না যান। অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী শাহিদ সুরাবার্দি তখন করাচিতে। গান্ধীজির কলকাতা পৌঁছনোর খবর পেয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন। তিনিও গান্ধীজিকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তখন নোয়াখালি না যান। গান্ধীজি বললেন, ”শাহিদ, আমি তোমার কথায় রাজি আছি। কিন্তু যদি নোয়াখালিতে খারাপ কিছু ঘটে, তাহলে তোমাকে আমার অনশনের মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে হবে। আর তোমাকেও আমার সঙ্গে থাকতে হবে। মনে রেখো শাহিদ, তোমাকে ও আমাকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ ও মিলিটারি থাকবে না।” সুরার্বদি গান্ধীজির প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। এরপরই সুরাবর্দি নোয়াখালিতে শান্তি বজায় রাখতে তাঁর অনুগত এম এল এ গোলাম সারওয়ারকে টেলিগ্রাম পাঠালেন। কারণ, তিনি জানতেন, নোয়াখালিতে কিছু হলে গান্ধীজিকে হয়তো বাঁচানো যাবে না।
পনেরোই আগস্ট দিল্লি ও করাচিতে ৩১ বার তোপধ্বনি দিয়ে স্বাধীনতার দিবসটিকে ঘোষণা করা হল। কিন্তু গান্ধীজির কাছে এটা আনন্দের ও উৎসবের দিন ছিল না। তিনি সারাটি দিন বেলেঘাটার বস্তিতে চরকা কেটে ও উপোস করে কাটালেন। তিনি তাঁর বাণীতে বললেন, ”আমার হৃদয় শুকিয়ে গিয়েছে। অন্যেরা আনন্দ—উৎসব করুক। আমাকে একা চোখের জল ফেলতে দাও।’
ওই দিনটিতে কলকাতা ও সারা বাংলা থেকে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা মুছে গেল। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান উঠল ”হিন্দু—মুসলমান ভাই ভাই।”ফোর্ট উইলিয়ামে বসে জেনারেল টুকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তাঁর মন ভারাক্রান্ত হল জয়েন্ট পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জেনারেল রিজ ও তাঁর ৫৫ হাজার সৈন্যদের কথা ভেবে। তবে চরম বিভীষিকার খবর তিনি তখনও পাননি। ২০ আগস্ট তারিখে জানা গেল আকাশপথ ছাড়া পাঞ্জাবের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব সম্পর্ক ছিন্ন। ১৭ আগস্ট গান্ধীজি লাহোর থেকে ভয়ঙ্কর খবর পেলেন। ‘লাহোরের পথে পথে শত শত মৃতদেহ ছড়িয়ে রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা রাওয়ালপিণ্ডির ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। সারা লাহোর জ্বলছে। আটকে পড়া শিখ ও হিন্দুদের পুলিশ ও মিলিটারি গুলি করে মারছে। আপনি এখনই লাহোরে চলে আসুন।’ গান্ধীজি আর থাকতে পারছিলেন না। তাঁর মানসিক স্থৈর্য ভেঙে পড়ার মুখে। জয়েন্ট পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্সের ৫৫হাজার সৈন্য, মেশিনগান, টমিগান, ব্রেনগান ও সাজোয়া গাড়ি প্রতিহত করতে পারল না পাঞ্জাবের নারকীয় ঘটনাবলী। আগস্ট মাসের মাত্র শেষ দু’সপ্তাহেই ওই বিপুল সৈন্যের উপস্থিতিতে পাঞ্জাবে খুন হল ৬ লাখ মানুষ ১৪ লাখ লোক দেশান্তরী হতে বাধ্য হল। ১ লাখ কিশোরী ও তরুণী ধর্ষিতা হল, অপহৃতা হল বা বিক্রি হল। ২০ আগস্ট সন্ধ্যায় বেলেঘাটায় গান্ধীজির প্রার্থনা সভায় চার লাখ লোক সমবেত হল। গান্ধীজির ভাষণের পর সুরাবর্দি বক্তৃতা করতে উঠলেন। তিনি পাঞ্জাব্রে পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলার পরিস্থিতির তুলনা করলেন এবং বললেন, ‘এটা কেবল মহাত্মাজির জন্যই সম্ভব হয়েছে। আমি এখন মহাত্মাজির মহত্ত্ব বুঝতে পারছি।’ শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘অনেক আগেই তোমার ওটা বোঝা উচিতল ছিল।’ সুরাবর্দি জবাব দিলেন, স্বাধীনতাই আমার মধ্যে এই উপলব্ধি এনে দিয়েছে।
এ সময় বেলেঘাটার ঠিকানায় লর্ড মাউন্টব্যাটেন গান্ধীজিকে চিঠি লিখলেন, ‘পাঞ্জাবে আমাদের ৫৫ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও সেখানে ভয়ানক দাঙ্গা চলছে। কিন্তু বাংলায় রয়েছেন আমাদের একজনের একটি বাহিনী এবং সেখানে কোনও দাঙ্গা নেই। একজন কর্মরত অফিসার এবং একজন প্রশাসক হিসাবে আমি কি ওয়ান ম্যান বাউন্ডারি ফোর্সকে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি ও অভিবাদন জানাতে পারি!’