ওমকারা

ওমকারা

দূর থেকে শিঙার আওয়াজ ভেসে আসছিল, বিলিতি শিঙাটাকে ব্রিটিশ ইনফ্যানট্রির সৈন্যরা বলে বিউগল।

রাত বেশি হয়নি, তবুও গঙ্গা থেকে ভেসে আসা প্রবল উত্তুরে শীতার্ত হাওয়ার দাপটে সমগ্র রাজপ্রাসাদে গভীর ঘুম নেমে এসেছে। বিলিতি ইনফ্যানট্রির অবশ্য ঘুম নেই। বিউগলের আওয়াজ থেকে বোঝা যায় রাতভর কোনও মহড়ায় তারা ব্যস্ত। আজ মহালয়া। পুঞ্জীকৃত মেঘ আকাশে জমাট বেঁধেছে। দ্বিতল প্রাসাদের বিরাটাকার ঝরোখা দিয়ে শীতল হাওয়া ভেসে আসছিল। দূরে দৃষ্টি মেললে সুপ্রশস্ত গঙ্গাবক্ষে ভাসমান পিতৃপুরুষের তর্পণে নিবেদিত অসংখ্য প্রদীপের ক্ষীণ কম্পিত আলোকরেখা দেখা যাচ্ছিল। ইংরেজ ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভেসে আসা ইংরাজী বাদ্য, সন্নিকটস্থ লোকালয়ের খোল কর্তালের ধ্বনি আর ভাগিরথীর কলকল শব্দ এই তিন মিলে মৃদু সঙ্গীতের মত শ্রোতার কানে প্রবেশ করছিল। দুটি দীর্ঘদেহী ছায়া, দ্রুত কিন্তু সতর্ক পদক্ষেপে প্রাসাদের চবুতরাটি ধরে এগিয়ে চলছিল। চবুতরাটি গিয়ে শেষ হয়েছে যে সোপানশ্রেণীর মুখটায়, সেখানে মশাল হাতে অপেক্ষা করছিল এক উচ্চ পদমর্যাদার দৌবারিক। তার বাম হাতের বর্শার ফলাটিতে মশালের আলো পড়ে চকচক করছিল। ছায়াদুটি চোখের সামনে এসে দাঁড়ালে সে সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকল। এখানে ধাপ বরাবর সোজা নেমে গেলে বাঁদিকে নিত্যবহমানা পুণ্যতোয়া গঙ্গা আর ডানদিকে প্রাচীরের গায়ে একখানি তোরণ। তোরণের অপরপারে যতদূর চোখ যায় দুর্ভেদ্য অরণ্য। রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের দক্ষিণদিকের এই অরণ্যে জনমানুষের প্রবেশ নেই, শতাব্দী প্রাচীন বিশালাকার বৃক্ষেরা তাদের পত্রপল্লব চারিদিকে ছড়িয়ে মাটির উপর প্রকাণ্ড চাঁদোয়া মেলে রেখেছে। দৌবারিকের পিছন পিছন ওই দুটি ছায়াময় শরীর সোপানশ্রেণীর ধাপ বরাবর নেমে যেতে লাগল। আজ তাঁদের গন্তব্য নদীবক্ষ নয়, বরং লোকচক্ষুর অন্তরালে এক বিশেষ কর্তব্যপালন করতেই নির্জন অরণ্যপথ বেছে নেবেন তাঁরা।

তোরণের কপাট ঈষৎ অবারিতই ছিল, সামান্য ঠেলতেই সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে গেল। মশাল হাতে নিয়ে দৌবারিক চৌকাঠ অতিক্রম করল, তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে দীর্ঘদেহী উন্নতনাসা পুরুষটি একবার পিছনে ফিরে তাকালেন, তারপর চাপা গলায় বললেন, “আসুন মহারাজ, দ্রুত পৌঁছালে হয়তো আপনার সম্পদ সুরক্ষিতভাবে আপনার হাতে তুলে দিতে পারব।”

অরণ্যের আদিম অন্ধকারের মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে গেল বারাণসীর রাজা মহারাজ চেত সিংহ এবং বর্দ্ধমান, হুগলী ও নদীয়ার দেওয়ান মহারাজ নন্দকুমারের শরীর।

*****

রাত প্রায় এগারোটা। ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্দশী, পিতৃপক্ষ পড়ে গেছে, গত দু ঘন্টা ধরে তুমুল বৃষ্টি বাতাসে ভ্যাপসা গরমের ভাপটাকে খানিক কমিয়ে এনেছিল। অবশেষে বৃষ্টি থেমে এসেছে। পূর্ণিমা লাগছে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে। মেঘের জাল কেটে আপাতত আকারে বেশ বড় চাঁদ দেখা দিয়েছে। তবে আজ চাঁদের রঙ ভারি অদ্ভুত। নীলচে রুপোলী থালার মত চাঁদের নীলাভ জ্যোৎস্না বাতাসে ভাসমান অগুণতি জলবিন্দুর মধ্য দিয়ে ঠিকরে চারিদিকে অনৈসর্গিক মায়াজালের মত সৃষ্টি করেছে। এ মাসটা মলমাস, তায় পিতৃপক্ষের পূর্ণিমায় এবছর পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের যোগ, প্রায় আড়াইশ বছর পরে আবার। গ্রহণ লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আকাশে এক মহাজাগতিক বিস্ময়ের সাক্ষী থাকবে গোটা বিশ্ব।

আকালীপুরের শ্মশানে মা গুহ্যকালীর মন্দিরের পেছনে পঞ্চমুণ্ডীর আসনের ধারে যে মেঠো কুঠিয়া রয়েছে, সাধারণ লোকে যাকে বলে মড়ার গাদার গদি, তার দাওয়ায় মজলিশ বসেছিল। কুঠিয়ায় সর্বসাকুল্যে দুখানি ঘর, একটিতে থাকেন শ্মশানের সাঁইদার নিতাই ঠাকুর, আরেকটিতে পরিবার নিয়ে মুনে বাগদি। আজ সারারাত শ্মশানে কোনও মড়া পুড়তে আসেনি, চিতায় তুলে রণদা ডোম আজ কোনও মড়ার মুখে নুড়ো জ্বালায়নি। কলকে সাজিয়ে সুখটান দিয়ে সে বসেছিল শ্মশান সাঁইদারের পায়ের কাছে। নিতাই ঠাকুরের মুখখানি থমথমে, যেন গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন। মুনে বাগদিও বসে ছিল কাছেই, তার বছর বাইশের মেয়ে পার্বতী বাচ্চা বিয়োতে এসেছে বাপের কাছে। জামাই বীরেনও সকাল থেকে এসে বসে আছে ঘরে। মুনের চোখ আজ বাইরের অবিরাম বৃষ্টি দেখে শঙ্কিত। আজ সন্ধে থেকে পার্বতীর শরীরটা বিশেষ ভালো নয়, বৌ মেনকা বলছিল, মেয়ের জল ভাঙার সময় হয়ে গেছে। ঈশ্বরের কাছে মনে মনে মুনে একটাই প্রার্থনা করছিল যে অন্তত গ্রহণের মধ্যে যেন বাচ্চার জন্ম না হয়। সন্ধে থেকে নিতাই ঠাকুরের কাছে বারবার একই প্রশ্ন করে মুনে তার মনের সংশয় দূর করার চেষ্টা করেছে। তিনি বারবারই তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে জীবন বা মৃত্যুর কোনও সঠিক লগ্ন বা মুহূর্ত মানুষের নির্ণয় করা গণ্ডীর অনেক বাইরে। এখানে কোনও পাজিপুঁথির হিসাবনিকাশ কাজ করে না। এমনিতে মুনে জানে, যতদিন নিতাই ঠাকুর আছেন, কোনও বিপদ তার একখানা চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। কারুর কারুর সর্বাঙ্গে ঠাকুরদেবতারা মঙ্গলস্পর্শ দিয়ে পাঠায়, তারা যা ছোঁয় সব শুদ্ধ হয়ে যায়, বিপদমুক্ত হয়ে যায়… নিতাই ঠাকুরও তেমনি একজন। তবু যেন তার মনে হল, সে নিজে যে কারণে এত উদ্বিগ্ন, আশঙ্কিত হয়ে আছে সেই উদ্বেগ বা আশঙ্কা ঠাকুরকেও খানিকটা হলেও স্পর্শ করেছে। শুধু মুখের কথায় তিনি তা প্রকাশ করছেন না। আর উদ্বেগ, আশঙ্কা, হবে নাই বা কেন, সন্ধে থেকে যা অনর্থ শুরু হয়েছে!

লোকে বলে, আকালীপুর শ্মশান সাঁইদারের কুঠিয়াটা নাকি এই শ্মশানের মতই প্রাচীন, নয় নয় করে আড়াইশ তিনশ বছর হবে দাঁড়িয়ে আছে শ্মশানের একধারে। বর্তমান সাঁইদার নিতাই ঠাকুরের আগের জন দেহ রেখেছিলেন চল্লিশ বছর আগে, তখন থেকেই নিতাই ঠাকুর রয়ে গেছেন এ শ্মশানে, শ্মশানবাসী শ্মশানচারীদের একান্ত আপন মানুষ হয়ে। তাঁর হাতযশে মানুষের অসুখ, রোগবালাই সেরে যায় নিমেষেই। শ্মশানে যে জাতেরই মড়া আসুক না কেন, হাড়ি, মুচি, বাগদী, দুলে থেকে শুরু করে বড়ঘরের বাবু, ঝি, বৌ সবারই বেজান শরীরটাকে নিতাইয়ের পায়ে ঠেকিয়ে চিতায় চাপায় রণদা। বদলে মেলে দু’চারশ টাকা, বোতল দুয়েক ধেনো, আর নেহাতই কপাল ভাল থাকলে লুচি, তরকারি, মিষ্টি। নিতাইয়ের প্রসাদ করা ধেনো ভাগ করে খায় মুনে আর রণদা। বীরভূমের শুকনো মাটির মত নিতাই ঠাকুরের চামড়া কুঁচকে ফুটিফাটা হয়েছে, রুক্ষ চুলে জটা পড়েছে হাতখানেক লম্বা, এক জোড়া শণের নুড়ির মত পাকা ঘন ভুরুর তলায় চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল নিত্যানন্দ। শ্মশানের রণদা ডোম, এ তল্লাটের চোলাই ব্যবসার নাটের গুরু হরি পরামাণিক, মুনে বাগদি, পুবের বাগদিপাড়ার বাকিদের কাছে অবশ্য তিনি বাবামশাই। এরা সবাই শ্মশানচারী— কেউ রাতে, কেউ দিন রাত নির্বিশেষে। কুঠিয়ার কাছেই শ্মশানের পেছনে ব্রাহ্মণী নদী বয়ে চলেছে, পূর্ণশশীর আলোতে নদীর জলে চাঁদের আলো ফুল-কুঁড়ির মত ফুটে আছে। জায়গায় জায়গায় আঁশশ্যাওড়া, পাকুড়, বট, অশ্বত্থের মত মোটাবেড়ে গাছেদের ঘন ছায়া পড়েছে মাটিতে, তাদের আওতার বাইরে যেটুকু মাটি দেখা যাচ্ছে তা জলে ভিজে দেবে গিয়ে ছোট ছোট জলার মত হয়ে আছে।

বৃষ্টির মাটিভেজা সোঁদা গন্ধ ছাপিয়ে হাসনুহানার গন্ধ ভেসে আসছিল দাওয়ায়, সেই গন্ধ সজোরে নাকে একবার টেনে রণদা বলে উঠল, “বৃষ্টিটো থামান দিছে বাবামশাই। দেখ লাই কেমন একলাগাড়ে পড়ছেল, আমি চিন্তা করলাম চিতের আগুনটোও আজ লিভে যাবে। লদীতে জলের গর্জনখান শুনছেন কেনে? উটো আবার লাববে বটে। শুনো কেনে হরি, পাক আর কতসময় পর হবে গো? মায়ের ভোগটো জুগাড় না হলি বাবার ক্রিয়ার কামকাজ সারা হবেক লাই। বলি, চিতের আগুন লিভেছে, রুলুনের তো নিভেক লাই। জ্বালাও না কেনে তু রুলুনটা!”

রণদা ডোমের তাড়া খেয়ে হরি পরামাণিক শিবাভোগের ব্যবস্থা করতে ওঠে। আকালীপুর শ্মশানের দক্ষিণ দ্বার দিয়ে এগোলেই মা গুহ্যকালীর মন্দির। মন্দিরে তাঁর কালো কষ্টিপাথরের প্রতিমা স্থাপিত, শ্মশানের পঞ্চমুণ্ডীর আসনে তাঁকে সাধনা করে বহু সাধক সিদ্ধাই পেয়েছেন, নিতাই ঠাকুরও ওখানেই কুণ্ড জ্বেলে হোম ক্রিয়া করেন, মা গুহ্যকালীর নামে নিত্য ভোগ চড়ান। কতকাল হবে তা মনে নেই, কামাখ্যা, আমোদপুর, দুবরাজপুর, কংকালীতলা ঘুরে বছর পঁচিশের নিত্যানন্দ এসে পৌঁছেছিলেন আকালীপুরের এই শ্মশানে। শ্মশানের সাঁইদার তখন ত্রিনাথ অবধূত। শিষ্য হয়ে সেই যে রয়ে গেলেন, পরের ষাট বছর কীভাবে কেটে গেল নিজেই মনে করতে পারেন না তিনি। শ্মশানবাসী সন্ন্যাসীর ঘর থাকে না, সংসার থাকে না, কিন্তু এই লোকগুলো এমনই মায়ায় বেঁধে ফেলেছে নিতাইকে যে এখন দেহাবসান না হলে এ জায়গা থেকে তাঁর মুক্তি নাই, তা ভালোই জানেন নিতাই।

হরি পরামাণিকের হাতে সিধেটা ধরাতে ধরাতে নিতাই বলে ওঠেন, “আর ক্রিয়া! একটাও মড়া এল? সেই সকাল থেকে হাপিত্যেস করে বসে আছি। এমন যোগ কি জীবনে বারবার আসে? একে পিতৃপক্ষ, তায় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। চাঁদটারে দেখছিস ইয়া পেল্লাই! তার মানে গ্রহণ লাগবে আর ছাড়বে, এই এতক্ষণেও যখন মড়া জোগাড় হয় নাই তখন বুঝতে হবে মার ইচ্ছা নাই আমি আজ ক্রিয়া করি। আর বৃষ্টিটারেও দেখ! এ সহজের থামবার নয় রে রণদা। তোরা ভোগের আয়োজন করছিস বটে, কিন্তু আজ কপালে মড়াও নাই, সাধনাও নাই। তাও দেখি শেষ অবধি! তোদের বলছিলাম না, সকাল থেকে মনটা আমার কু ডাকছিল, কেন যেন মনে হচ্ছিল ঠিক বাধা আসবে। তখন দেখলি মন্দিরে মায়ের সামনে প্রদীপটা জ্বালালাম, কেমন এক ফুঁয়ে তা নিভে গেল। যেন কেউ এসে বুকের সবটুকু ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিভিয়ে দিল প্রদীপটা। এ তিনি ছাড়া আর কেউ নয়। আজ মন বলছে একটা না অঘটন হয়! সেই জন্যই তো মুনের বিটির জন্যে এত…” মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তাটা যেন ঢক করে গিলে নেন ঠাকুর।

“ওই আবার, আবার বাজছে ঠাকুর! আরও স্পষ্ট কেনে!”

গুহ্যকালীর মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। সেই বন্ধ মন্দিরের দ্বার ভেদ করে ভারী পিতলের ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছিল শ্মশানে।

“আজ যেন একেবারে মাত্রাছাড়া বাজছে রে মুনে! অন্যদিন গভীর রাতে শুনি, আজ সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছে।”

“মড়াটো আসলে সাধনায় বসতে পারবে? বিপদটোর ভয় লাই আজ?”

“বিপদ হলে হবে! দেখা যাবে! এমন একখান যোগ, তা কি ছাড়া যায়? আমিও তো কম দিন সাধনা করলাম না, কিছু হওয়ার হলে অ্যাতদিনে কি ছাড়ান পেতাম ভেবেছিস! ভোগটা তৈরী কর, শেষকাটালে যদি শিকে ছেঁড়ে। আমি গিয়ে ক্রিয়ার জিনিস গোছাই গে।” কপালে হাত ঠেকিয়ে গুরুকে স্মরণ করে উঠতে যাবেন নিতাই, হঠাৎ নীলচে আলোয় আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে, আর সেই বিদ্যুতের আলোয় তাঁর চোখের সামনে ফুটে ওঠে একখানি মানুষের অবয়ব। তাঁর কুঠিয়ার দালান থেকে হাত তিনেক দূরে মোটা পাকুড়গাছটার নীচে আঁধারঘন ছায়াতে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক, লম্ফর আলোটাকে উসকে দিয়ে লোকটার দিকে তাকান নিতাই। বিদ্যুতের নীলচে কড়া আলো মাঝে মাঝেই পূর্ণবিকশিত চাঁদের আলোকে টেক্কা দিচ্ছে, সেই আলোতেই চোখ মেলে আবার ভালো করে দেখেন নিতাই। এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। আগে দেখেননি কখনও এদিকে। রোগা সিড়িঙ্গেপানা চেহারা, লম্বায় হাত পাঁচেক হবে, পরণে এই বৃষ্টিতেও একখানি ধুতি ল্যাঙ্গটের মতো বাঁধা, গায়ে মনে হয় তাও একখানি ফতুয়ার উপর চাদর চাপানো আছে। কাঁধে একখানি ঝোলা। মুনে আর রণদাও দেখেছে লোকটাকে। মুনে বাগদি চাপা স্বরে বলে, “এমন রাতে উ কে এয়েছে বাবামশাই? উকে তো দেখি লাই কেনে? তুরা দিখেছিস?”

*****

মহারাজ নন্দকুমার প্রগাঢ় বলশালী দৃঢ়চেতা মানুষ, উপরন্তু তিনি ঘোর শাক্ত। আতঙ্ক, বিভ্রম বা সংশয়— এ যেন তাঁর ধাতেই নেই। তবুও আজ মহারাজ চেত সিংহের সঙ্গে অর্ধপরিচিত দেশটির গহন গভীর অরণ্যে প্রবেশ করতে তাঁর কিঞ্চিৎ দ্বিধাই হচ্ছিল। চারিদিকে ব্রিটিশ গুপ্তচর ছড়িয়ে রয়েছে, প্রাসাদ অভ্যন্তরেও যে কেউ গুপ্তভাবে ব্রিটিশরাজের পৃষ্ঠপোষক নয় তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই গঙ্গাবক্ষের সরল অভ্যস্ত পথ ছেড়ে এইভাবে ঘুরপথে পৌঁছাতে হচ্ছে গন্তব্যে। শুধুমাত্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে যে পরিমাণ বিপদের সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এক ছুটে এক সপ্তাহকাল নৌবিহার করে কাশিমবাজার থেকে বারাণসী এসে পৌঁছেছেন, তা আদৌ কতটা ফলপ্রসূ হবে জানা নেই মহারাজের। রাতের পর রাত বিচিত্র স্বপ্ন এবং তাতে ততোধিক বিচিত্র দৃশ্যকল্প না দেখলে হয়তো কোনওদিনই এইরকম পদক্ষেপ নিতেন না। বর্তমান অবস্থায় তাঁর পক্ষে একদিনও মুর্শিদাবাদ ছেড়ে থাকা বিপদজনক। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সদ্য-অতীত হলেও তার ছেড়ে যাওয়া দুষ্ট ক্ষতে সমগ্র বাংলায় নাভিশ্বাস উঠছে। উপরন্তু লবণের আর রেশমের ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার নিয়ে ইংরেজরা নবাব মীরজাফরের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছে। চেত সিংহের দূতের হাতে পাঠানো চিঠিখানি পেয়ে প্রথমে তো তিনি ভেবেইছিলেন শয়তান হেস্টিংস কোনও নতুন ছল করে অচেনা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যার ছক কষেছে। দুরাত্মাকে আবার গর্ভনর জেনারেল করে পাঠিয়েছেন বিলেতের মহারাণী! যোগ্যতর ব্রিটিশ আধিকারিক থাকতে কেন যে খর্বাকার বামনকে পছন্দ করেছেন রাজরাজেশ্বরী, তা কে জানে!

“আর সামান্য দূর চলতে হবে মহারাজ। প্রায় পৌঁছে গেছি।” চেত সিংহের ডাকে সম্বিত ফেরে নন্দকুমারের।

ঘন শ্বাপদ সংকুল অরণ্যপথে যে জায়গায় তারা এসে পৌঁছেছেন, তার চারধারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া অন্য কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। স্থানটি বারাণসীর মণিকর্ণিকার শ্মশান সংলগ্ন অরণ্য। কিছুপূর্বেও গঙ্গা সংলগ্ন ঘাটের কাছে যেখানে দাহক্রিয়া হয়, সেখান থেকে সমবেত পুরুষের কোলাহল, শোকগ্রস্তা নারী ও অন্যান্য পরিবারবর্গের বিলাপ শোনা যাচ্ছিল। তারপর জঙ্গল গভীর হয়েছে, নদীতীর থেকে তাঁরা ক্রমাগত অরণ্যের নিবিড় অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন। তবুও পথে বহুবার বহমানা নদীস্রোতের ক্ষীণ শব্দ কানে এসেছে, শৃগাল কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল কিছুক্ষণ আগেও। অদ্ভুতভাবে এখন একটি ঝিল্লির শব্দও কান পাতলে শোনা যায় না। শুধু, দৌবারিকের হাতের মশাল অনেকক্ষণ ধরে একনিষ্ঠভাবে জ্বলে রাজার মান রক্ষা করেছে। চারপাশে শুধু অসীম শূন্যতা, কৃষ্ণতিথি যেন গিলে খেতে আসছে জীবন্ত প্রতিটি সত্ত্বাকে।

“ওই দিকটায় মহারাজ! মেলুয়া বলেছিল ওখানেই দেখেছে তাঁকে…”

বহুক্ষণ জ্বলে মশালের আলোও ম্রিয়মান হয়ে এসেছে। অন্ধের মত অন্ধকার ঠেলে সামনে এগোতে গিয়ে মহারাজ নন্দকুমার পেছন থেকে বাধা পান। চেত সিংহ তাঁর আচকানের এক প্রান্ত সজোরে চেপে ধরেছেন।

“কী করছেন কী মহারাজ? ওইদিকেই যে…”

দৌবারিক মশাল তুলে ধরতেই নন্দকুমার স্তব্ধ হয়ে যান… আর এক পা এগোলেই এক মানুষ নীচু গর্তে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অস্পষ্ট আলোয় সেই গর্তের অভ্যন্তর যেটুকু দেখা যায় তাতে এক ভয়ংকর দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে ওঠে দুই রাজপুরুষের।

*****

ছপাত ছপাত জল ঠেলে লোকটা হাজির হল সবার সামনে। লম্ফের আলোয় এতক্ষণে চেহারাটা একটু পরিষ্কারও হয়। রণদা, হরি, মুনে সবাই কাজ ফেলে লোকটার দিকে তাকায়। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, এ তো লোক নয়, অল্পবয়স্ক একটি ছেলে। কতই বা বয়েস হবে, বছর বিশেক। বৃষ্টির জল ছেলেটার সর্বাঙ্গ থেকে টুপটুপিয়ে পড়ছে, পরণের কাপড়চোপড়ও ভিজে ন্যাতা হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে নিতাই ঠাকুর বলে ওঠেন, “তুমি কে গো বাবু? এই দুর্যোগে শ্মশানে কী করছ?” দালানে উঠে পড়ে ছেলেটি হলদেটে দাঁত বার করে হাসে, বলে, “আজ্ঞে আমার নাম ওঙ্কারনাথ দত্ত। অনেক দূর থেকে আসছি, আপনাদের কাছেই আসছিলাম, একটা বিপদে পড়েছিলাম। জানি, এখানেই সমাধান মিলবে।”

“হেঁই মা রে! কী বিপদ?” রণদা প্রশ্ন করে।

“আজ্ঞে একটু হাত পা মোছার কাপড় হবে? একটু শুকনো হয়ে নিই, তারপর বলছি না হয়। যখন বেরিয়েছিলাম, শুকনো খটখটে ছিল, এমন অঝোরে ঝরবে বুঝতে পারিনি।”

নিতাই ঠাকুর ব্যস্ত হয়ে একটা গামছা এগিয়ে দেন ছেলেটার দিকে। জবজবে চেহারাটার দিকে তাকিয়ে তাঁর মায়া হয়। রণদাকে বলে ওঠেন, “দড়ি থেকে ধুতিটা পেড়ে দিয়ে এক কাপ চা কর না কেনে রণদা? গোঁসাই একদম ভিজে গেছে গে।” চৌকির তলা থেকে পিঁড়িটা বার করে এগিয়ে দেন ওঙ্কারনাথের দিকে, বলেন, “বসো গোঁসাই, হাত পা মোছো, শুকনো হও, ধুতিটা বদলে নাও, তারপর বলো দেখি কেমন বিপদ? কেউ অসুস্থ নাকি বাড়িতে? ইদিকের কোন গাঁ থেকে আসছ?” হাত-পা মুছতে মুছতে ওঙ্কার আবার হাসে, বলে, “না না বাবাঠাকুর, আমার এ সমস্যা অসুখের নয় গো। একজনের জন্য অপেক্ষা করে আছি, সে আসলেই পুরো ব্যাপারটা বলতে পারব।”

নিতাই ঠাকুর প্রশ্ন করেন, “কে? তোমার গাঁয়ের লোক না অন্য গাঁয়ের? কোনও ক্রিয়া করাবে নাকি গোঁসাই?”

“আজ্ঞে ক্রিয়ার জন্যই তো আসা। সে লোক আমার গাঁয়ের নয়, এমনিই আমার বহুদিনের চেনা।”

ওঙ্কারের হাবভাব দেখে বোঝা যায় তার তাড়া নেই, হয়তো এমন কোনও বিপদের কথা মাথায় করে সে এসেছে যার জন্য যাগযজ্ঞ, শান্তি, স্বস্ত্যয়ন বা পুষ্করা করাতে চায় সে। ঘরের কোনায় গিয়ে শুকনো ধুতি পরে এসে সে ঘরের এককোণে গুটিসুটি হয়ে বসে। রণদা তার দিকে চা এগিয়ে দেয়, বাইরে আবার মেঘ চমকায়। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে একটা অস্ফুট কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। সবার কান খাড়া হয়, এ আওয়াজ মুনের মেয়ের পার্বতীর, তবে কি… সবার আশঙ্কা সত্যি করে মুনের বৌ ঘর থেকে ডেকে ওঠে মুনেকে, এক লাফ দিয়ে উঠে মুনে পাশের ঘরে যায়।

বাইরের আকাশের দিকে তাকান নিতাই ঠাকুর। পূর্ণিমা শুরু হতে এখনও ঘন্টা দুয়েক দেরী, তবে চাঁদের রুপালি জ্যোৎস্না একটু যেন মিইয়ে এসেছে। একটু অস্বস্তি হলেও ঝড়বাদলের দিনে এসে পড়া অতিথিকে বেশি জেরা করতে তাঁর ইচ্ছা করছে না। পঞ্চমুণ্ডীর আসনটা রাতের জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আজ যেন পরিবেশ একটু অন্যরকমই লাগছে, অতবড় গাছটা… না একটা গাছ নয় আসলে, কিন্তু তেঁতুল, বট আর অশ্বত্থ এই তিনটে গাছের গুড়ি জুড়ে একটা বিরাট গাছের মতই দেখায়। তাদেরই তলায় পঞ্চমুণ্ডীর আসন। সেই গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে এখনও একটানা জল পড়ছে, বাতাসে কীসের একটা ঝাঁঝালো গন্ধ, শোঁ শোঁ জোলো হাওয়ায় কী যেন এক আকুতি… সময় আজ যেন স্তব্ধ হয়ে আছে, কীসের প্রতীক্ষায় সমস্ত আকাশ বাতাস নিমেষ গুনছে একমন হয়ে। হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে নিতাই ঠাকুরের, দাওয়ার এক কোণে নিশ্চুপে ধুনি জ্বালান তিনি। আচমকা ঘরের ভেতর থেকে হরির আর্তচিৎকার ভেসে আসে এইসময়… ভারি আতঙ্কিত হয়ে সে ডাকাডাকি করছে।

“কী হয়েছে রে হরি?” প্রায় এক লাফ দিয়ে নিতাই ঠাকুর ঘরের ভেতরে ঢোকেন। হরির চিৎকারে ওমকারাও উঠে দাঁড়িয়েছে।

“বাবামশাই! আতপচালের সিধেটা দিয়ে ভোগ রেঁধেছিলাম…” কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে হরি পরামাণিক।

“হ্যাঁ তো কী হয়েছে?”

“ওই দেখুন!” একই রকম কাঁপতে কাঁপতে হরি উনুনের একটা কোণ নির্দেশ করে।

উনুনের কোণটায় কলাপাতার উপর আতপচালের সঙ্গে কালো তিল মিশিয়ে কে যেন মস্ত বড় একখানি গোলক তৈরী করে গেছে।

“এ কী! এ যে পিণ্ড!”

“আ… আ-আমি কিছু জানি না ঠাকুর! রেঁধে বেড়ে কলাপাতায় সাজিয়েছিলাম, পাঁচরকম ফল রাখতে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড হয়ে বসে আছে। কিছু একটা করুন ঠাকুর। মৃত্যুর আগেই পিণ্ড সাজিয়েছে… বড় অলক্ষণ ঠাকুর… বড় অলক্ষণ!”

বাইরের দাওয়ায় পায়ের আওয়াজ শোন যায়। মুনে বাগদি বেজার মুখে জামাই বীরেনকে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় ওঠে, পার্বতীর বেদনা উঠেছে। হরির দিকে তাকিয়ে নিতাই ঠাকুর বলে ওঠেন, “চুপ করে যা হরি। এই কাণ্ড যে হয়ে আছে মুনের সামনে বলবি না একদম। এমনিতেই ভয় খেয়ে আছে।”

মুনেকে কিছু বলতে হয় না। তার মুখ এমনিতেই শুকিয়ে গেছে। এমনিতে মেনকা দাইয়ের কাজে পটু, বাগদিপাড়ার অর্ধেক বাচ্চা তার হাতেই বিয়ানো। তবে এমন দিনে, বাচ্চা হলে ন্যাকড়াচোপড়া শুকাতে, বাচ্চার শরীর গরম করতে কাঠের আঁচ জ্বালাতে ভারি সমস্যা। কাঠের টুকরো বেবাক ভিজে মিইয়ে আছে। ব্যাজার মুখে নিতাই ঠাকুরের পায়ের কাছে বসে বীরেন বলে ওঠে, “আজকের তো ঘোর দুর্যোগ বাবামশাই, আকাশের অবস্থাটো ভালো লয়, কপালে কী আছে কে জানে!” বীরেন রামপুরহাটের ছেলে, অল্পবয়েসেই তার ঘাড়ে সংসারের বোঝা চেপে ঘাড়টাকে একটু নুইয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রাক যৌবনবেলার অকৃত্রিম সারল্য তার চেহারা থেকে একেবারে মুছে যায়নি। উৎসুক হয়ে সে নিতাই ঠাকুরকে প্রশ্ন করে, “পার্বতীর কাছে এ শ্মশানের বর্ণনা শুনেছি বাবামশাই, একবারটো শুনাও না কেনে! রাত কেটে যাবেক।”

চোখের ইশারায় কলাপাতায় রাখা চালতিলের পিণ্ডটাকে বাইরে ফেলে আসতে বলে গল্প শুরু করেন নিতাই ঠাকুর। হরি পরামাণিক পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পিণ্ডটাকে ফেলে আসতে যায়।

*****

অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে স্তূপাকৃত ভগ্নাবশেষের উপর এক ভয়ংকরী করালবদনী কালিকাপ্রতিমা শায়িত অবস্থায় ছিল। তাঁর ঈষৎ উন্মুক্ত মুখগহ্বর থেকে যেটুকু দন্তপংক্তি দেখা যাচ্ছে তা অবর্ণনীয় সাদা, অনুমান করা যায় ওগুলি মহাশঙ্খের তৈরী। কষ্টিপাথরে তৈরী চারফুট লম্বা দেবীমূর্তি, কর্ণকুহর থেকে কাঁধ অবধি দুখানি মৃত শিশুর শবদেহ ঝুলছে, গলায় পঞ্চাশটি নরকরোটির মালা, চতুর্দিকে কষ্টিপাথরের খোদিত নাগফণা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। ডেলা ডেলা মাটির স্তূপের মধ্য থেকে অনবরত হিসহিস শব্দ ভেসে আসছে। শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দুই রাজন্য বিস্ময়ে আতঙ্কে নির্বাক হয়ে যান। ঘোর কৃষ্ণা, দ্বিভূজা, খড়্গহস্তা, লোলজিহ্বা, আয়তনয়না সেই মূর্তিটির চারপাশে অসংখ্য বিচিত্র জাতির সাপেরা এমনভাবে বেষ্টন করে আছে যে দেখে মনে হচ্ছে দেবী সর্পালঙ্কার পরেছেন। তমসাময় রাত্রির নৈঃশব্দ ভেঙ্গে ক্রমাগত হিস হিস শব্দে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল মহারাজ নন্দকুমার আর চেত সিংহের।

“মহারাজ! এঁকেই দেখেছিলেন স্বপ্নে?”

মশালের আলো নন্দকুমারের বিধ্বস্ত মুখমন্ডলের উপর এসে পড়েছিল… শীতের রাত্রেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছিল বিগত বেশ কয়েকটি নিদ্রাহীন রাতের কথা। দিন চারেক আগেও যখন কাশিমবাজার থেকে নৌকাযোগে রওনা দিয়েছিলেন বারাণসীর দিকে, তখন মনের মধ্যে শুধু ক্ষীণ এক প্রতিচ্ছবি ছিল দেবী প্রতিমার। আজ যাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন তাঁর মত এত ভয়ংকারী প্রলয়ঙ্করী দেবীপ্রতিমা এর আগে কখনও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। মাটির নীচে নাগবেষ্টিত প্রতিমা! মহাদেবী কি পাতালে পূজিতা?

“ও কী মহারাজ!” দৌবারিকের গলায় অপার বিস্ময়। মশালের আলো গহ্বরের অন্ধকার ছোঁয়া মাত্র সাপগুলি কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়েছে। দেবীপ্রতিমার অতিশুভ্র দংষ্ট্রাবিশিষ্ট মুখমণ্ডল আর আজানুলম্বিত নরকোটির মালা যেন ব্যঙ্গ হাস্যে তাকিয়ে রয়েছে উপরদিকে।

বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে চেত সিংহ বলে ওঠেন, “দৌবারিক, প্রতিমাকে তুলে আনো! রাত্রির অন্ধকারেই এ স্থানত্যাগ করতে হবে মহারাজ। আপনার মাঝিমাল্লাদের পূর্বেই বলা রয়েছে, এক বিশেষ সংকেত পেলেই তারা নৌকা ছাড়তে বিলম্ব করবে না।

আপনি আজই কাশিমবাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু করুন মহারাজ। নদীপথে অন্তত একশ ক্রোশ পথ অতিক্রম করলে তবেই আমি নিশ্চিন্ত হব।”

ঈষৎ ইতস্ততঃ করে দৌবারিক মাটিতে মশাল পুঁতে গহ্বর থেকে মাতৃমূর্তি তুলে আনার প্রস্তুতি নেয়। হাতের বর্শাটি ছাড়া আত্মরক্ষার জন্য আর কোনও অস্ত্রই আনা হয়নি।

চেত সিংহের কথাগুলো সাবধানবাণীর মত শোনায় নন্দকুমারের কানে। এখনও চোখ বন্ধ করলে সমগ্র ঘটনাটিই যেন তাঁর চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এ কাহিনীর অর্দ্ধেকাংশ যদি তাঁর নিজস্ব অর্জিত অভিজ্ঞতা হয়, বাকি অর্দ্ধাংশ মহারাজ চেত সিংহ স্বয়ং সাক্ষাতে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁকে। আজ এই ছায়াচ্ছন্ন তমসাময় রাত্রে আরেকবার চেত সিংহের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটির কথা মনে পড়ে যায় মহারাজ নন্দকুমারের। দীর্ঘনাসা শ্মশ্রুগুম্ফ আচ্ছাদিত মুখটি গভীর চিন্তাচ্ছন্ন হয়ে নন্দকুমারকে বর্ণনা করেছিল অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার কথা।

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল প্রায় এক পক্ষকাল আগে। মণিকর্ণিকার শ্মশানের ডোমবসতির ডোমেদের হঠাৎই গভীর রাতে প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। পায়ের তলার মাটি বেশ কিছু সময়ের জন্য কেঁপে উঠে আবার সব কিছু শান্ত হয়ে গিয়েছিল। নেহাতই প্রকৃতির কোনও তাণ্ডবলীলা ভেবে ডোমেরা চুপচাপ ছিল, ব্যতিক্রম ছিল একটি আট বছরের ডোম বালক, মেলুয়া। পরের দিন শব্দের দিক নির্ণয় করে খোঁজ করতে গিয়ে হঠাৎই জঙ্গলের অভ্যন্তরে এক স্থানে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখে সে চমকে উঠেছিল। শ্মশানের এতটা গভীরে ডোমেরা সাধারণত আসে না। তবে স্মৃতির উপর সম্বল করে সে যেটুকু বলতে পেরেছিল তা হল ওই স্থানে একটি বিরাট অশ্বত্থ গাছের নীচে একখানি কুটীর সে দেখেছিল একবার। শ্মশানে বিভিন্ন স্থানে কত যোগী, কত সন্ন্যাসী, কত অঘোরীরা অস্থায়ী কুটীর বেঁধে থাকেন, সাধনা করেন আবার চলেও যান। সাধনভজনের সময় তাঁদের বিরক্ত করলে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে আসেন, তাই মেলুয়া আলাদা করে আর কুটিরবাসীর পরিচয় জানতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু সেইদিন সেই কুটীরের স্থানে সম্পূর্ণ নিরাভরণ শূন্যতা দেখে সে আঁতকে উঠেছিল… কুটীরটি তো নেইই উপরন্তু সেই স্থানের মাটি যেন কোনও এক ক্রুদ্ধ দানব প্রচণ্ড কোপান্বিত হয়ে খোঁড়াখুড়ি করে চতুর্দিক তোলপাড় করে রেখে গেছে। দেখে অনুমান হয়, অমন সুবৃহৎ অশ্বত্থ গাছটি সমেত কুটীরটি যেন মাটির তলায় অন্তর্হিত হয়েছে। আতঙ্কিত মেলুয়া ডোমবস্তিতে খবর দেয়, অল্পসময়ের মধ্যে খবর পৌঁছায় বারাণসীর মহারাজ চেতসিংহের কাছে। পরিশেষে প্রাসাদের কিছুসংখ্যক সিপাহী পাহাড়প্রমাণ ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে মূর্তিটিকে দেখতে পেয়েছিল। অবশ্য সর্পবেষ্টিত ভয়ালদর্শন মূর্তিটিকে তুলে আনার মত সাহস কেউ দেখায়নি।

চেত সিংহের প্রেরিত পত্র মহারাজ নন্দকুমারের হাতে পৌঁছেছিল অল্পকালের মধ্যেই। কিছুটা বাধ্য হয়েই তাঁকে পত্র পাঠিয়েছিলেন মহরাজ চেত সিংহ। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস প্রতিমাটি হস্তগত করতে চান, ইতিমধ্যেই লোকমুখে প্রতিমার গঠনবৈশিষ্ট্য শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এ দেশের অশিক্ষিত নিরক্ষর কালো চামড়ার মানুষের পূজিতা কালী করালবদনী! নজরকাড়া সংগ্রহ! লন্ডনের জাদুঘরে মূর্তিটিকে স্থান দিতে চান হেস্টিংস। গুপ্তচর মারফত সে খবর পেয়েছিলেন চেত সিংহ। দেশীয় মাতৃমূর্তি থাকবে বিজাতীয় বিধর্মীদের সংগ্রহে! রাগে রোষে সর্বাঙ্গ জ্বললেও ক্রোধ প্রকাশ করার এ উপযুক্ত সময় নয়, এ কথা সম্যক বুঝেছিলেন চেত সিংহ। সবে জমিনদার থেকে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মহারাজ উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে, কোম্পানির আধিপত্য বারাণসীতে এবং সমগ্র আওয়াধে ক্রমবর্ধমান। এই অবস্থায় সরাসরি সংগ্রামে না গিয়ে গুপ্তপথে দেবীমূর্তিকে কোনও সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছে দেওয়া অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কে নেবে সেই গুরুদায়িত্ব? কোন স্থানে দেবী বিধর্মী ইংরেজের লোলুপ দৃষ্টির অন্তরালে থাকতে পারবেন?

“আপনি কী করে জানলেন আমিই সেই উপযুক্ত ব্যক্তি? আশেপাশে সুবিশাল আওয়াধের রাজ্যে অগণিত ক্ষুদ্রবৃহৎ নৃপতি, ভূস্বামী, জায়গিরদার ছড়িয়ে রয়েছেন, তাদের কাউকে কেন নির্বাচিত করলেন না মহারাজ!”

নন্দকুমারের প্রশ্নের উত্তরে রহস্যময় হেসেছিলেন চেত সিংহ।

“সমস্ত বিষয় আপনাকে পত্রে লিখে উঠতে পারিনি মহারাজ। পত্রের বার্তাটি সংক্ষিপ্ত রেখেছিলাম। হেস্টিংসের হাত থেকে মূর্তি বাঁচানোর জন্য যখন ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, তখনই একদিন রাতে স্বপ্নে আপনাকে দেখলাম। ঘটনাচক্রে আপনাকে আমি আগেই চিনতাম, গত বছরে এক আর্মেনীয় রেশম ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে দু’এক বার অর্ণবপোত ভাসিয়েছিলাম কাশিমবাজারের দিকে। আপনি অবশ্য আমার পরিচয় জানতেন না। তবে, আমার প্রস্তাবে পত্রপাঠ অসম্মতি জানিয়েছিলেন দূতের হাতে, হঠাৎ মত বদলালেন কেন?”

“প্রথমে ভেবেছিলাম এ হয়তো কোনও চাল! আমি শাক্ত জেনে আমাকে ফাঁদে ফেলবার জন্য কালীমূর্তির আখ্যান শুনিয়ে দুর্বল করার কোনও প্রচেষ্টা! কিন্তু তারপর… সমস্ত সংশয় নিরসন করে যা দেখলাম… আমার সব দ্বিধা কেটে গেল!”

“কী দেখলেন?”

“আপনার মতই আমিও স্বপ্ন দেখলাম… কানে ভেসে আসতে লাগল অসংখ্য ঘন্টাধ্বনি, অজস্র দীপালোকে ভাগীরথীর জল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার মন্দির, বিরাট উঁচু উঁচু ঘাটের সিড়ি… এ একটাই শহর নির্দেশ করছিল কাশীনরেশ। ঘুমের মধ্যে অস্পষ্টভাবে এক কৃষ্ণকায়া মূর্তিকে ভাগীরথীর জলে নিমজ্জিত হয়ে যেতে দেখলাম আর তার নিমজ্জনের সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে প্রকাণ্ড ঢেউ এসে আমাকেও ডুবিয়ে দিল। সেইদিন… কেমন অনুভূতি হয়েছিল জানেন মহারাজ! যেন জোর করে কেউ আমায় জলের তলায় বন্দী করে রেখেছে, আর আমি… আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু নিতে পারছি না।

ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ মনস্থির করলাম, যেভাবেই হোক খুব শীঘ্রই আমায় বারাণসী পৌঁছাতে হবে।”

“তবে আর কী!” দেবী নিজেই নির্বাচিত করেছেন গন্তব্যস্থল। বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে চৈত সিংহের অধরে।

“মহারাজ!” দৌবারিকের আহবানে বর্তমানে ফেরেন নন্দকুমার।

গহ্বরে ওঠানামার পরিশ্রমে লোকটির সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছিল। কালো কষ্টিপাথরের হাত চারেক লম্বা মূর্তিটি সে একাই তুলে এনেছে গহ্বর থেকে, কিন্তু প্রাণান্তকর পরিশ্রমের ক্লান্তি ভেদ করেও তার দুচোখের আতঙ্ক চোখ এড়াল না দুই রাজার।

“গহ্বরে কে যেন ছিল মহারাজ! মনে হলে এক মুহূর্তের জন্য দেখলাম… একটি নীলচে মুখ… আর দুটো চোখ মহারাজ! উফ কী ভীষণ ক্রোধ চোখদুটিতে মহারাজ!” দৌবারিককে দেখে বোঝা যায় মুখটি মনে করে তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল শুকিয়ে গেছে।

পুনর্বার মশালের আলো গহ্বরের মুখটিতে নিক্ষেপ করে দেখা গেল সেখানে একতাল শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই।

দূরে বারাণসীর চুরাশিটি ঘাটে তখন অখণ্ড নীরবতা। রাণামহল ঘাট, চৌষট্টি ঘাট, কেদারঘাটের অন্ধকার গলি পথ ছাড়িয়ে অনেক দূরে একখানি ছায়ামূর্তি দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল। এ শহর তাকে গিলে খেতে আসছিল। দূরে পালিয়ে যদি বাঁচা যায়! দৌড়াতে দৌড়াতে তার শীর্ণ শরীরটি মাঝেমাঝে ক্লান্তিতে ঝুঁকে নুইয়ে পড়ছিল। বারবার গায়ের চাদরখানি খুলে ঝেড়ে সে কী যেন বিষয়ে নিঃসংশয় হতে চাইছিল। তার চোখের আতঙ্কগ্রস্ত দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তার থামার কোনও উপায় নেই। তার নিদ্রা যাওয়ার উপায় নেই। কখনও অত্যধিক ক্লান্তিতে চোখের দু পাতা জুড়ে এলেও ভীষণ আতঙ্কে তার চোখ যায় খুলে। লোকালয় থেকে দূরে যেতে সে ভয় পায়। ভয় পায় নির্জনতাকেও। তার একা থাকার সুযোগে যদি আবার… প্রাণের মায়া বড় সাংঘাতিক। দিবারাত্রি জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থেকেও বাঁচার আশাতেই বড় কাতর মানুষ। সেই মুহূর্তে যদি কেউ তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করত— থামো, কোথায় চলেছ পথিক, কী হয়েছে তোমার? সে প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারত না ঠিকই কিন্তু তার বিবর্ণ মুখশ্রী, কপালের উপর অযত্নলালিত চুলের গোছা, ছিন্ন বসন আর সর্বোপরি তার চোখের আর্ত শংকিত দৃষ্টি দেখে খানিক হলেও তার দুর্ভাগ্যের বিবরণ সম্পর্কে আন্দাজ করা যেত।

বহুপথ ঘুরে বিধ্বস্ত শরীরে যখন সে বারাণসী শহর থেকে দূরে তার পরিচিত গ্রামটির উপকন্ঠে পৌঁছাল তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। পথের ধারে বেদীর উপর বসে সে কিছুক্ষণ দম নিল। হৃদপিন্ড এত দ্রুত বেগে স্পন্দিত হচ্ছিল যেন এই মুহূর্তেই বুকের পাঁজর ভেদ করে বেরিয়ে আসবে। মুখখানি মোছার জন্য ধুতির কোঁচাটি তুলে ধরতে গিয়েই তার বেদীর পাদদেশে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ধুনির দিকে চোখ পড়ল। শীত নিবারণের জন্য কে যেন জ্বালিয়ে রেখে গেছে। ধুনির কাঠের পোড়া গন্ধ, টুকরো টুকরো আগুনের ফুলকি! তার শরীরে অজানা প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। ফুলকিতে ভরা ধ্বংসের আগুন। যে আগুনে মানুষের শরীর ধ্বংস হয়। আর মন! তাতে যে আগুন লাগে তা অনেকটা ওই ধিকিধিকি আগুনের মতই। প্রতিটি কণার পুড়ে যাওয়ার হিসাব বুঝি অপর কণাগুলিও রাখে। হা ঈশ্বর! তোমার ঘরে কি সব হিসাবই এমন নিক্তি মাপা! এত অগণিত জীবন, এত অগণ্য মৃত্যু! তবু কেন যে সেদিন বাকি সবকিছুর সাথে তার জীবনটাও নিঃশেষ হয়ে গেল না!

আজ এই গভীর রাতে একখানি হাহাকার যদি সে করে ওঠে, তার প্রত্যুত্তর করার কেউ নেই। শুধু সেই আর্তরব বারবার ঘুরপাক খেতে খেতে আবার ফেরত চলে আসবে। সমস্ত প্রশ্ন,সমস্ত উত্তরকে সে নিজে হাতে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে মণিকর্ণিকার শ্মশানে। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন কখনও তীব্র রাগ হয়, কখনও ভয়ানক হতাশা, কখনও প্রবল আত্মগ্লানি… কখনও বা মনে হয় ছুরিকাঘাতেই শেষ হয়ে যাক অভিশপ্ত জীবন। আবার পরমুহূর্তেই বিকট পাপবোধ গ্রাস করে তাকে, চোয়াল দৃঢ় হয়, চোখের মণি স্থির হয়, বহুদিনের অর্ধাহারে অনাহারে জীর্ণ শরীরের ধ্বংসাবশেষ কুড়িয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। পথের ধারের ধাপটিতে দাঁড়িয়ে সে দুহাত বিস্তার করে, ঊর্দ্ধে জাগরিত নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে। প্রেতমূর্তির মত শরীরটিকে ঘিরে বইতে শুরু করে ঝোড়ো হাওয়া, কোথা থেকে যেন রাশিকৃত শুষ্ক পাতার দল এসে সেই ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। কারা যেন পা বেয়ে বেয়ে তার শরীর আঁকড়ে উঠতে শুরু করে! তার কানে কানে কে যেন এসে বলতে থাকে… নেই, নেই, নিস্তার নেই…

*****

“সে বড় অস্থির সময় বুঝলে জামাই। আকালীপুর, ভদ্রপুর, নলহাটি এসব জায়গা তখন মুর্শিদাবাদের ভেতরে, আলাদা করে বীরভূম জেলা গড়ে ওঠেনি তখনও। আমাদের আকালীপুরের এ শ্মশান এখন যেমন দেখছ তেমনটি তখন কল্পনাও করতে পারবে না। ব্রাহ্মণী নদী তখন উত্তরে বাইত, ঘন তুঁত গাছের জঙ্গলে দিনের বেলাতেই এমন গাঢ় ছায়া হয়ে থাকত যে সাধারণ লোকে বাঘ ভাল্লুকের ভয়ে এখানে আসতে ভয় পেত। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগের কথা। শুনেছি, সেসময় বাংলা দেওয়ান ছিলেন মহারাজ নন্দকুমার। তখন এক বিলিতি সাহেব ছিল দেশে, হেস্টিংস বলে ডাকত সবাই তাকে। তার ভারি লোভ ছিল মায়ের মূর্তিটির উপর। কষ্টিপাথরের মূর্তি, লোকে বলে মাকে নাকি পাতাল থেকে পাওয়া গিয়েছিল। সেই হেস্টিংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মহারাজ স্বয়ং বেনারস থেকে আকালীপুরে নিয়ে এসেছিলেন মায়ের মূর্তিটিকে।”

“কত বছর আগের কথা হবে ঠাকুর?” বীরেন প্রশ্ন করে।

“তা হবে আড়াইশ তিনশ বছর।” অন্যমনস্কভাবে বলে ওঠেন নিতাই ঠাকুর।

প্রতিমাটা নিয়ে মহারাজ যেভাবে এখানে এসে পৌঁছালেন তাও এক ঘটনা বটে। মহারাজের পৈতৃক গ্রাম ভদ্রপুর, সে গ্রাম আকালীপুর থেকে মাত্র দু তিন ক্রোশ। মহারাজের প্রবল ইচ্ছা উনি তাঁর ভদ্রাসনে একখানি মন্দির স্থাপন করে দেবীমূর্তিকে স্থাপন করবেন। কিন্তু মায়ের মনে অন্যরকম ইচ্ছা ছিল মনে হয়।

“কী হয়েছিল আজ্ঞে?” ওঙ্কারনাথ প্রশ্ন করে।

“খুব শক্ত-পোক্ত, সাত পাটাতনী গোলন্দাজি নৌকা, বুঝলে গোঁসাই, পিছনে রইঘরে দেবীমূর্তির পাহারায় স্বয়ং নন্দকুমার রয়েছেন। ভদ্রপুরের কাছাকাছি আসতেই বিপত্তি দেখা দিল, লগি ফেলে নোঙর আর করা যায় না, যতই পাড়ে লাগানোর চেষ্টা করে মাঝিরা, নৌকা যেন ছিটকে ছিটকে যায়। মাঘ মাস তখন, আকাশ দিব্যি পরিষ্কার। হঠাৎ কোথা থেকে প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হল, ঠান্ডা শান্ত জলের স্রোতে ঘূর্ণি পাক খেতে লাগল, ঝিঁকা মেরে মেরে নৌকাকে সরানো যায় না। শান্ত নদীর জল চার-পাঁচফুট উঁচু হয়ে হয়ে নৌকার মধ্যে ঢুকতে লাগল। মাঝিদের হাত থেকে হাল গেল সরে, হাজার চেষ্টাতেও সে হাল ধরে রাখতে পারে না। নৌকা যেন আপনা আপনি বয়ে দুক্রোশ দূরের এই আকালীপুরের শ্মশানের ঘাটে এসে ঠেকল। তারপর থেকেই এ শ্মশানে বাস করছেন গুহ্যকালী”।

“গুহ্যস্থান আমাদের শ্মশানটো, তাই কালী আমাদের গুহ্যকালী… জাগান দিলি জাগান, শয়ান দিলি শয়ান।” গাঁজার নেশায় রণদার চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল।

“আর শুধু শ্মশানটো কেনে বাবামশাই, ভূতপ্রেতের কথা একটু বলবেক লাই! নতুন অতিথি আসিছে বটেক, উয়াদের একটু পরিচিতি হবেক লাই?” বীরেন খ্যাঁকখ্যাক করে হেসে ওঠে।

তার প্রকৃতি সবার চেয়ে আলাদা, মড়া পুড়াতে পুড়াতে সে বোধহয় জীবিতের থেকে মৃতের সঙ্গে বেশি একাত্ম বোধ করে। চিতার আগুনে একরকম নেশা থাকে, অর্হনিশি যাদের চোখের সামনে জ্বলে তাদের উপর দুধরণের প্রভাব হয়। হয় রণদার মত জীবন সম্পর্কে মোহমুক্ত এক নৃশংস ভাব ফুটে ওঠে— জীবনটাকে তখন তুচ্ছ, মৃত্যুকেই মহৎ মনে হয়। ইহজীবনের চিহ্ন বয়ে চলা শরীরের খাঁচা গলে গলে পড়ে, হাড়ে হাড়ে আগুন ধরে মট মট করে শব্দ হয়, কাঠের আগুনের আঁচে জ্বলতে থাকা চামড়া আর মাংসের পোড়া গন্ধে তারা আসক্ত হয়। অথবা নিতাই ঠাকুরের মত এমন এক জগতে মন উঠে যায় যেখানে বস্তুতই হৃদয় জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা সদা ভ্রাম্যমাণ আত্মার উপস্থিতি সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়ে ওঠে।

রণদা ডোম আবার বলে ওঠে, “শুধাও না কেনে বাবামশাইরে? পঞ্চমুণ্ডীর আসনটোয় কে বসে সাধনায়? বুলো কেনে বাবামশাই! ভূঊঊঊত গো ভূঊঊঊত।” রণদার অট্টহাস্যে ছোট মেঠো কুঠিয়ার দেওয়াল কেঁপে কেঁপে ওঠে।

“আজ্ঞে শ্মশানে ভূত থাকবে সে আর নতুন কথা কী! ও তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।”

“বেশ বেশ? উ খুব জানে বাবামশাই। দেশটো কুথায় বল দেখি কেনে? সেই তখন থিকে খালি হলহল বইলছ। তুয়ার সাঙ্গাত কখন আস্যবে বুলো তো? ক্রিয়াটিয়া করাও, টাকা পয়সা দাও, দু চারটা ধেনো দাও দিকি।”

রণদার রুক্ষ কথায় ওঙ্কারনাথ রাগ করে না। তাকে দেখে বোঝা যায় তার আপাত সাধারণ শরীরটির তলায় একটি শান্ত শীতল মন আছে। সহজে বিচলিত হওয়ার মত মানুষ সে নয়।

রণদার খোঁচাকে উপেক্ষা করে সে নিতাই ঠাকুরকে প্রশ্ন করে, “ভূত প্রেতের অস্তিত্ব তো শ্মশানে টেরই পেয়েছেন বাবাঠাকুর। কিন্তু মৃত্যুর পরেও অতীত জীবনের সংস্কারটুকু যে আত্মাকে তাড়া করে বেরোয় সে সম্পর্কে আপনার কী মত?”

“আমার মতের তো কিছু নাই গো গোঁসাই। উপনিষদ পড়েছ? তাতে বলা আত্মা দেশ কালের ঊর্দ্ধে নয়, যে সংস্কার নিয়ে সে জীবনত্যাগ করে সেই সংস্কারই তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এমনকি নবজন্মেও সে তার পূর্বতন জীবনের সংস্কার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।”

“আর ধরুন যদি সেই আত্মা শুদ্ধাচারী হন, হঠাৎ কোনও কারণে তার শুদ্ধাচার বিঘ্নিত হয়ে মৃত্যু হয়, তবে সে ক্ষেত্রে তার কী গতি হবে?”

“সে নানারকম দোষ লাগে, পাতিত্য দোষ লাগতে পারে।”

“তখন সে আত্মার কী হবে?”

“প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে ঘুরবে আর কী? কর্ম ভালো থাকলে যদি কেউ তাকে মুক্তি দেয়!”

“এ তো গেল তত্ত্ব কথা, বাস্তবে এমন কোনও ঘটনা ঘটতে দেখেছেন?”

নিতাই ঠাকুরের উত্তর দেওয়ার আগেই একটা পায়ের শব্দে সবাই দরজার দিকে তাকায়। দূর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে কেউ এলে মাটিতে একটা কাঁপুনি হয়, সেইরকমই একটা কম্পন ঘরের সবাইকে জানান দিচ্ছিল যে ধাবমান ব্যক্তিটি এদিকেই আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার চৌকাঠে হরি পরামাণিকের ভীতসন্ত্রস্ত চেহারাটাকে দেখা যায়। দ্রুত দৌড়ে আসার কারণে সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গল্পের মৌতাতে সকলে ভুলেই গিয়েছিল যে হরি পরামাণিক অনেকক্ষণ ঘরের বাইরে গেছে, অথচ ফিরে আসেনি।

“অ হরি, ধেনো টেনে কোন গাছের তলে বসি ছিলি শালা!” রণদা খিঁচিয়ে ওঠে।

রণদার খিঁচুনিতেও হরির বিহ্বল দৃষ্টি পাল্টায় না। নিতাই ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, “আমি তাঁকে দেখলাম বাবামশাই!”

হরির ঘোষণায় ঘরে সাময়িক নৈঃশব্দ নেমে আসে।

“ভাবলাম কলাপাতার মোড়কটাকে নদীতে ভাসাই গে। বাইরেটা যেন নীল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে, অবাক হয়ে চারিদিক দেখছি, এমন পূর্ণিমা তো এর আগে দেখিনি। ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মনে হল হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। চোখে কী সব ঢুকে এমন কড়কড় করতে লাগল যে চোখ মুছতে গিয়ে দেখি হাত থেকে কখন কলাপাতাটা পড়ে গেছে। কোথায় গেল, কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ দেখি, ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে তিনি উঠছেন, পরিষ্কার দেখলাম, মাথায় তেঁতুলের মত জটা, হাতে একখানি কপাল, একবার আমার দিকে তাকালেন, চোখটা ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল… পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে পঞ্চমুণ্ডীর দিকে গেলেন। সত্যি বলছি ঠাকুর… মায়ের কিরা…”

“তারপর?”

“নদীর ধার থেকে পঞ্চমুণ্ডীর আসনটা তো দেখা যায়, দু তিন বার বিদ্যুৎ চমকে উঠল আর সে আলোয় একঝলকের জন্য যেন দেখলাম, উত্তর-পূর্বমুখো হয়ে একখানি ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে, লাল জবা, মুখকাটা ডাব, সাতটা কপাল সাজানো রয়েছে সেখানে। কে যেন পেতলের একখানি ঘটে একটি কাটা পাঁঠার মুণ্ড সাজিয়ে রেখেছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, প্রচুর সাপ কিলবিলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জায়গাটায়। তিনি আস্তে আস্তে পদ্মাসনে বসলেন, আর তারপর…”

“তারপর?”

“তারপর চোখজোড়া মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা আমার দিকে তাকালেন। আমি হাত বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, স্পষ্ট দেখলাম ওনার চোখদুটোর জায়গায় কালো গহ্বর, মণিদুটো আগুনের মত জ্বলছে, কী ভীষণ রাগ গো ঠাকুর! মনে হল, আমায় জ্যান্তই জ্বালিয়ে মারবেন ওখানে, অনেক কষ্টে মনের জোরে পালিয়ে এলাম ওখান থেকে।”

হরি পরামাণিকের কথা শুনে ঘরের ভিতর সবাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। পাশের ঘর থেকে পার্বতীর গোঙানি সময়ের সাথে সাথে চাপা আর্তনাদে পরিণত হয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রণদা অট্টহাস্য করে উঠল— “মনটো আঁচুপাচু করে শালা। আজ উয়ার সাথে দেখাটো হবেক কেনে বাবামাশাই! বড় মজা হবেক গো শালারা!”

*****

ওঁ ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ গুহ্যকালিকে

ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ স্বাহা॥

ওঁ ফ্রেং ফ্রেং ক্রোং ক্রোং

পশূন্ গৃহাণ হুঁ ফট্ স্বাহা॥

মন্ত্রোচ্চারণের শব্দটা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতর হচ্ছিল। আকালীপুর শ্মশানের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একাই এগোচ্ছিলেন মহারাজ নন্দকুমার। চতুর্দিকে নরকরোটি, আর হাড় ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে। ব্রাহ্মণী নদীর ঘাটটা সামান্য দূরেই। নদীর জল এসে ঘাটের সোপানশ্রেণীতে ধাক্কা খেয়ে ছলাত ছলাত শব্দ তুলছিল। প্রবল শীত এখন, পত্রমোচী বৃক্ষেরা পাতা ঝরিয়ে শ্মশানের জমিতে গালিচা পেতে রেখেছে। তার উপর দিয়ে মহারাজের নাগরাইয়ের মশমশ শব্দ আশেপাশের প্রাণীদের কিছুমাত্র হলেও সচকিত করেছিল। এই সময়টা একান্তভাবেই তাদের। শৃগাল কুকুরেরা মৃতশরীরের অর্ধদগ্ধ অংশ নিয়ে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাচ্ছিল। মহারাজের পদক্ষেপের শব্দে সন্ত্রস্ত হয়ে তাদেরই একজন আস্যাওড়া গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে একপলক স্থির হয়ে মহারাজের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই অন্তর্হিত হল। শটিত, গলিত শবদেহের পূতিগন্ধে মহারাজ নাকে হাত চাপা দিয়ে বমনেচ্ছা রোধ করলেন।

আর অল্পদূর এগোলেই মন্দিরটি… মন্দির না অসমাপ্ত দেবালয়! ভীমনাদে এই মধ্যরাত্রিতে সেইস্থান থেকে এক বিদেহী ক্রমাগত দেবীর প্রণাম মন্ত্রে দেবীকে অর্ঘ্য নিবেদন করে চলেছিল। বাইরে শৃগাল কুকুরের বীভৎস চিৎকার, শকুন শিশুর কান্নার সুর, বায়ু তাড়িত বৃক্ষপল্লবের শোঁ শোঁ শব্দ …মহারাজ নন্দকুমারের মনে এইসবকিছুর থেকেও দেবী গুহ্যকালীর উদ্দেশে নিবেদিত ওই মন্ত্র আরও কয়েকগুণ ভীতির সঞ্চার করছিল। সামনে ঘন হয়ে থাকা তুঁত গাছের জঙ্গল দৃষ্টির সামনে অবরোধ সৃষ্টি করে রেখেছিল। চকিতে কোথা থেকে ঘূর্ণিবাতাস এসে সেই গাছগুলির শাখাপ্রশাখা নুইয়ে দিতেই চোখের সামনে অবারিত আকাশে একফালি চাঁদ দৃশ্যমান হল, আর চাঁদের আলোয় অন্ধকার শ্মশানবক্ষে ফুটে উঠল একটি অর্ধভগ্ন অসমাপ্ত মন্দিরের অবয়ব।

অষ্টকোণাকৃতি মন্দিরের গর্ভগৃহ চন্দ্রালোকে আলোকিত হয়ে উঠেছিল। মন্দিরের তিনখানি দ্বার, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণদ্বার। সেদিনকার মত আজও নন্দকুমার দক্ষিণদ্বারের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। শ্মশানের আগাছা পরিষ্কার করে মন্দির নির্মাণের জন্য একখানি মেঠোপথ তৈরী করা হয়েছিল। মন্দিরের পরিসীমা ঘিরে প্রদক্ষিণ করার জন্য প্রশস্ত একটি পথও বানানো হয়েছিল। আজ পরিত্যক্ত মন্দিরটির সামনে দাঁড়িয়ে মহারাজের পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কত দিনই বা হবে, চার বছর মাত্র। সামান্য জেদের বশেই মন্দির স্থাপন করেছিলেন তিনি। দেবীপ্রতিমাকে দেখা মাত্র গুরু বাপুদেব শাস্ত্রী মন্দির নিমার্ণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। মহারাজ শাক্ত হলেও গৃহী, আর যে মূর্তিটিকে উদ্ধার করে তিনি বারাণসী থেকে আকালীপুর নিয়ে এসেছিলেন তিনি তন্ত্রাচারে পূজিতা, মুক্ত আকাশের নীচে তন্ত্রশাস্ত্র স্বীকৃত পথেই তাঁর পূজা হওয়া বাঞ্চনীয়। গৃহী ভক্তের আরাধনা তাঁকে সন্তুষ্ট করবে না এমনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বাপুদেব। তবু, মনের গভীর অতলে রাজপুরুষোচিত আত্মগৌরব যে মহারাজের ছিল, তা বলাই বাহুল্য। যে দেবীকে এত বিপদ স্বীকার করে পথের এত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে তিনি এত দূর নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি কিনা অনাদরে অবহেলায় কোনও এক বেদীমূলে স্থাপিতা হবেন, তাঁকে তুলে দিতে হবে কোনও এক বীরাচারী কাপালিকের হাতে, ভক্ষণ করবেন শবমাংস!

রটন্তী অমাবস্যায় মহারাজ নন্দকুমার মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করবেন এমনই ঠিক হয়েছিল। আজও সেই দিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে মহারাজের। সেই মত নলহাটি, আকালীপুর, কীর্ণাহার, ভদ্রপুর, নিকটস্থ প্রায় সকল গ্রাম থেকে অগণিত সাধারণ মানুষ ভিড় করেছিলেন। বাপুদেব শাস্ত্রী আসেননি, সস্ত্রীক মহারাজ হাতে একখানি পিতলের থালায় সজ্জিত পূজার উপাচার নিয়ে মন্দিরে প্রবেশদ্বারের দিকে ধীরপদে অগ্রসর হচ্ছিলেন। চতুর্দিকে তখন তুমুল জয়ধ্বনি, কখনও দেবী গুহ্যকালির নামে, কখনও বা মহারাজ নন্দকুমারের নামে। গর্ভগৃহে প্রবেশ করামাত্রই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল মহারাজের। মন্দিরের গর্ভগৃহ যেন বাইরের মাঘী অমাবস্যার শীতল রাত্রির থেকেও অধিকতর শীতার্ত, একটিও দীপ জ্বলছে না। নিকষ কালো অন্ধকারে দেবীমূর্তিও হারিয়ে গেছেন চোখের সম্মুখ থেকে। বিরক্ত হয়ে সর্বক্ষণের সহচর গোমস্তা চৈতান নাথকে প্রশ্ন করেছিলেন, “দীপ প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করোনি? মাতৃমূর্তি অন্ধকারে কেন চৈতান?”

চৈতান সসংকোচে উত্তর দিয়েছিলেন, “দীপ জ্বালানো যায়নি মহারাজ, যতবার জ্বালানোর চেষ্টা হয়েছে ততবার ঠান্ডা শীতল বাতাস এসে নিভিয়ে গেছে দীপ। যদি অভয় দেন, একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“আপনি গুরুদেবের কথা মেনে নিন মহারাজ, বারবার দীপ জ্বালাতে চেয়েও নিভে যাওয়া… ভীষণ অলক্ষণ মহারাজ। যে বটবৃক্ষের নীচে দেবীর অস্থায়ী বেদীমূল ছিল, সে স্থান থেকেও আজ প্রাতে মূর্তি অপসারণ করতে বিষম বেগ পেতে হয়েছে। মাতৃমূর্তি একশমণি প্রস্তরখন্ডের মত ভারী হয়ে গিয়েছিলেন, প্রচুর লোকবল প্রয়োগ করে তারপর তাকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে। যাদের ওই কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা সকলেই বলেছে অমানুষিক এক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে তবে প্রতিমাকে ওইস্থান থেকে অপসারণ করা গেছে।”

“আহ্, পঞ্চদীপটি এদিকে নিয়ে এসো।” বিরক্ত হয়েই বলে উঠেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার। গ্রামদেশের মানুষের উপর ভবিষ্যদ্বাণী, দৈবী আদেশের প্রভাব খুব সহজেই পড়ে জানেন তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে দীপের নিভে যাওয়ার ঘটনাটিকে নিছকই চিত্তদৌর্বল্য ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না তাঁর।

অগ্নিশলাকা দীপটিকে স্পর্শ করামাত্রই যে ঘটনা ঘটেছিল তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। কোথা থেকে যেন পিতলের একখানি থালা সজোরে উড়ে এসে মাথায় আঘাত করল, আঘাতের অভিঘাতে মাথায় হাত দিয়ে সামান্য পিছিয়ে এসেছিলেন মহারাজ… নাহলে আজ হয়তো… বিকট শব্দে বিরাট মন্দিরের চূড়াখানি ভেঙে পড়া, অজস্র মানুষের আর্তনাদ, আর তা ছাপিয়ে কানে অনবরত মন্ত্রপাঠের শব্দ… সমস্ত কিছুর আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়েছিলেন মহারাজ। জ্ঞান যখন ফিরল, চতুর্দিকে আহত রক্তাক্ত মনুষ্যশরীরের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অক্ষত দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রতিমা, তাঁর চারপাশে কে যেন তান্ত্রিক মণ্ডল এঁকে তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠা করে গেছে দেবীমূর্তিকে। সম্মুখে তার সাতটি নরকপালে তাজা রক্ত রাখা, পিতলের থালায় নিবেদিত অগরু চন্দন মিষ্টান্নের স্হলে জায়গা করে নিয়েছে অর্ধদগ্ধ শবমাংস।

সেই থেকে শুরু করে যতবার মন্দিরের চূড়াটিকে নির্মাণ করতে গিয়েছেন, ততবার বাধা এসেছে। গতবার, শুধু চূড়া নয়, নবনির্মিত মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের দেওয়ালেও ভাঙন ধরেছিল। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, কোনও কারিগরও এখন মন্দির নির্মাণে সম্মত হয় না। আকালীপুরের জঙ্গলে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে মন্দিরটি। অবশ্য মাতৃমূর্তির পূজাতে ব্যাঘাত ঘটেনি কোনও, গভীর রাত নামলেই শ্মশানের মধ্য থেকে অনবরত ঘন্টাধ্বনির শব্দ অনেকের কানেই এসে পৌঁছেছে। আর আজ চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে নিজে হাতে গড়া দেবালয়ের ধবংসাবশেষ থেকে উঠে আসা মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ… না, জীবনে প্রতি পদে দুর্জয় সাহস আর অনমনীয় জেদ দেখিয়েছেন, কিন্তু এই একটি স্থানে… এই একটি স্থানে ওই বিদেহীর কাছে হার স্বীকার করলেন তিনি।

সময় হাতে আর বিশেষ নেই, নায়েব সুবাদারের পদ থেকে মহম্মদ রেজা খাঁকে অপসারিত করেছেন হেস্টিংস। তিন কোটি টাকার রাজস্ব তছরুপের অভিযোগ তাঁর ঘাড়ে। রেজা খাঁর দেওয়ান হয়েও তিনি স্বয়ং রাজস্ব তছরুপের এই ঘটনায় ইংরেজদের সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে দিয়েছিলেন। মনের কোণে সুস্পষ্ট উচ্চাকাঙ্খা ছিল, রেজা খাঁর অব্যবহিত পরে তাঁকেই নায়েব সুবাদারের পদে নির্বাচিত করবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নায়েব সুবাদারের পদটাই বিলুপ্ত করে হেস্টিংস যে স্বয়ং রাজস্ব আদায়ের পথে হাঁটবেন, তা তিনি কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেননি। উৎকোচলোভী বামনটার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ জানিয়েছিলেন কাউন্সিলে। লাভ হয়নি, পাশার দান পাল্টিয়েছে। কানাঘুষোয় শুনেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই জাল দলিল দস্তাবেজ দাখিল করে সুপ্রিম কোর্ট থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে চলেছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারকের পদে যাকে নিযুক্ত করেছে ব্রিটিশ পালার্মেন্ট, সেই ইলাইজা ইম্পে হেস্টিংসের বাল্যবন্ধু। হেস্টিংসের ষড়যন্ত্রের জালে তিনি প্রতিনিয়ত আটক পড়ছেন। হঠাৎ খুব অসহায় লাগে নন্দকুমারের। এই আকালীপুর, ভদ্রপুরের গ্রাম ছেড়ে সেই কোন ছোট বয়সে কাশিমবাজার পৌঁছেছিলেন। সিরাজ থেকে মীরজাফর, মীরজাফর থেকে মীরকাশেম, আবার মীরজাফরের হাতে বাংলার মসনদ ফিরে গিয়েছে, কিন্তু প্রশাসকের আড়ালে শাসকের দণ্ডটি দীর্ঘকাল ধরে রয়ে গিয়েছে ধূর্ত ইংরেজদের হাতে। তিনি নিজে হয়তো পারতেন… কিন্তু স্বদেশীয় বন্ধুবর্গের বিশ্বাসঘাতকতা, উৎকোচপ্রিয়তা, ব্যক্তিগত স্বার্থান্বেষণ এই সবের ঊর্দ্ধে উঠে একা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া… বুঝি ভাগ্যনায়কেরও ক্লান্তি বোধ হয়।

বহুদিন পূর্বে, তা হয়তো বছর দশেক হবে, মন্বন্তরের সময় কাশিমবাজারে ভাগীরথীর নিকটস্থ একটি ঘাটে অনাহারে মৃতপ্রায় এক পুরুষকে বৃক্ষপল্লব চিবিয়ে খেতে দেখেছিলেন। সম্মুখে তার দুখানি দেহ শায়িত… শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত এক রমণী আর তার ক্রোড়সংলগ্ন এক শিশু… শিশুটির বুকের ক্ষীণ ওঠানামা তার ততোধিক ক্ষীণকায় শরীরে জীবনের স্পন্দন জানান দিয়ে যাচ্ছিল। রমণী জীবিত না মৃত বোঝা দায়। এইটুকু অনুমান করা যায় সঙ্গের পুরুষটি তাঁর স্বামী। ইংরেজ সিপাহীরা এসে ভাগিরথীর তীরে পড়ে থাকা অজস্র পচাগলা শবদেহের মতই নির্মমভাবে ভাগিরথীর জলে নিক্ষেপ করেছিল তাদের। গলা থেকে একখানি আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে গিয়েও সঙ্গী পুরুষটির দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়েছিলেন মহারাজ। নিরুদ্বেগে সে তখনও গাছের পাতা চিবিয়ে চলেছিল… সম্মুখে ছড়ানো সবুজ বটপাতার স্তূপের মধ্য থেকে একটি একটি করে পাতা যত্ন করে তুলে মুখের ভিতর পুরে অনবরত মুখ নাড়িয়ে চলেছিল সে। তুচ্ছ পরিণামহীন জীবনের কী সাংঘাতিক পরিণামপূর্ণ সমাপ্তি! হয়তো বা এভাবেই পরিণামহীনতা আর পরিণামপূর্ণতাকে মিলিয়ে দেন ঈশ্বর। হয়তো বা আর কিছু দিন পরেই… তাঁর নিজের জীবনেও…

দূর থেকেই একবার দেবী গুহ্যকালীর উদ্দেশে প্রণাম করে পশ্চাদাপসারণ করে হাঁটতে শুরু করেন মহারাজ নন্দকুমার। অন্তিম পরিণাম অনেকটাই তাঁর কাছে এখন স্পষ্ট। শুধু যাওয়ার আগে একবার পুত্র গুরুদাসকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়ে যেতে চান তিনি।

*****

খোলা দরজা দিয়ে বারবার দমকা হাওয়া এসে লম্ফর দুর্বল শিখাটাকে প্রায় নিভিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। দরজার টিনের পাল্লাগুলোও হাওয়াতে দেওয়ালের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছিল। এক আঁজলা জোলো বাতাস ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে জানান দিয়ে গেল আবার ঝড় আসছে, সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিও। কেরোসিনের ডিবেটা হাতড়াতে হাতড়াতে নিতাই ঠাকুর ভ্রু কুঁচকে বাইরের দিকে তাকালেন। দুর্যোগের রাতের যেন শেষ নেই। মুনে আর বীরেন উঠে পাশের ঘরে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। হরি পরামাণিক সেই থেকে যে চুপ হয়েছে আর তার মুখে কোনও কথা নেই। প্রায়ান্ধকার ঘরে রণদার গাঁজার ছিলকের ধুমকি ধুমকি আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নজরে আসছিল না। নীরবতা ভেঙে ওঙ্কারনাথ কথাটা বলেই ফেলে, “বাস্তব অভিজ্ঞতা তো আছেই আপনার ঠাকুর।”

খানিক চুপ করে থাকেন নিতাই ঠাকুর। তাঁর নৈঃশব্দ ওঙ্কারের কথার উত্তর দিয়ে যায়। ওঙ্কারের দিকে তাকিয়ে নিতাই বলে ওঠেন, “শুধু আমি কেন? শ্মশানাচারী সকলেই তাঁর অস্তিত্বের কথা জানে। এ শ্মশানের কিংবদন্তী তিনি। শ্মশান আছে, শব আছে, আমরা আছি আর জেগে রয়েছেন তিনি। আদি অনন্তকাল ধরে। কী বেশ প্রশ্ন করেছিলে? শুদ্ধাচারী মানুষের প্রেতযোনি প্রাপ্তি?”

“হ্যাঁ, আপনি তখন বললেন শুদ্ধাচার বিঘ্নিত হলে পাতিত্য দোষ লাগে।”

“হ্যাঁ, এইবার প্রশ্ন হচ্ছে বিঘ্নিত হল কীভাবে? কোনও ব্যাভিচার, বা মিথ্যাচারণ বা অন্য কোনও কারণ? দেখ গোঁসাই, প্রত্যেক দেবদেবীর নিজস্ব পূজাপদ্ধতি আছে, বীজমন্ত্র আছে। এই যে আমাদের তন্ত্রাচার দেখছ, এরও তো কত শাখা আছে। বামাচার, সিদ্ধান্তাচার, কৌলাচার। আমাদের যে মা গুহ্যকালী, ইনি শ্মশান কালী, সাধারণ গৃহীর জন্য তাঁর পূজা নয়। তিনি ভয়ংকরী, শবমাংসপ্রিয়া, শ্মশানচারী, তাঁর এক হাতে সৃষ্টি, অন্য হাতে লয়। তো এনার পূজা যিনি করবেন তাঁকে বিশেষ সতর্ক তো থাকতেই হবে। সামান্য ভুলচুক হলেই ক্ষমা নেই, তখন পাতিত্য দোষ বলো আর যাই বলো, তার ভয়ানক ফলাফল তো সাধককেই ভুগতে হবে।”

ওঙ্কারনাথ চুপ করে থাকে। নিতাই ঠাকুর বলতে থাকেন, “দেখো, আমাদের শ্মশানে যাঁর উপস্থিতি আমরা সকলেই টের পেয়েছি, আজ সন্ধেবেলা হরির মুখে তুমিও কিছুটা শুনেছ, তাঁর বিষয়টা নিয়ে আমি আগেও প্রচুর ভেবেছি। পঁচাশিটা বছর বয়স হয়ে গেল আমার, এই শ্মশানে কম দিন তো হল না। কেউ কেউ বলে, একেবারে শুরুর দিন থেকে তাঁকে এ শ্মশানে দেখা গেছে।”

“শুরুর দিন অর্থে?”

“গোঁসাই, এ সবই আমার শোনা কথা! জনশ্রুতি বলতে পারো, তবে আমি একটা পুরোনো প্রবাদে বিশ্বাস করি। যা রটে তার কিছুটা সত্যি তো বটে। আমার মনে হয়, ইনি কোনও না কোনও ভাবে দেবী মূর্তির সঙ্গে জড়িত, কিন্তু কীভাবে মায়ের সঙ্গে তিনি জড়িত তা আমার জানা নেই! তবে একথা ঠিক যে, যে আচারে মায়ের পূজা তিনি করেন, তাতে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারি। শুনেছি, মহারাজ নন্দকুমার গোটা চারেকবার দেবীর মন্দির তৈরী করতে গিয়ে তাঁর হাতে বাধা পেয়েছিলেন। মন্দিরের উত্তর দিকটা দেখো, ওখানে দেওয়ালে এখনও একটা লম্বা চিড় ধরে আছে, ওটা ঠিক করা যায়নি। মন্দিরের তো কতবছর চূড়াই ছিল না, ঠাকুর এমনিতে খোলা আকাশের তলায় থাকতেন। আমার মনে হয় দেবী শ্মশানবাসিনী বলে সে তন্ত্রধারকের ইচ্ছা ছিল, অশ্বত্থ গাছের তলায় যে অস্থায়ী বেদীমূলে ঠাকুরকে রাখা হয়েছিল, সেখানেই তাঁকে রাখা হোক। শুনেছি, শেষকালে হার মেনে তন্ত্রমতে ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে যান মহারাজ। তার কদিন পরেই শুনেছি তাঁর ফাঁসি হয়। তবে তন্ত্রমতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মন্দিরে সাধারণ পূজায় আর কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি।” এত অবধি বলে নিতাই ঠাকুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন।

“তারপর?”

“মন্দিরের সাধারণ পূজায় ব্যাঘাত না হলেও তিনি যে এ স্থানেই আছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কত বছর আগের কথা, এখন বললে লোকে বলবে বুড়ো গল্পগাছা করছে। তবে, আমি নিজের চোখে এতগুলো বছর ধরে তাঁকে দেখে আসছি, তাই গল্পগাছা বলে উড়িয়ে দেওয়া ক্ষমতা আমার নেই। একেবারে চোখে দেখা, কানে শোনা অভিজ্ঞতা। আজকের কথাই ভাব, এই যে তুমি এলে, আমার আজ শবসাধনায় বসার কথা ছিল। তো সন্ধে থেকে একখানি মড়া তো জুটলই না, তার উপর তুমি তো দেখলে শিবাভোগটাকে কে যেন পিণ্ড করে থুয়েছে। পাশের ঘরে পোয়াতি, আজই একটা খবর হয় হয়। তার মধ্যে এই সব অলুক্ষুণে ব্যাপার। কী আছে তাঁর মনে কে জানে? আচ্ছা আমার কথা থাক, গ্রহণ লাগতে আর ঘন্টা দেড়েক বাকি, তোমার কাজের কথাটা বলো তো দেখি গোঁসাই?”

“একটা প্রেতকর্ম করতে হবে ঠাকুর। ধরুন, আপনার এই শ্মশানবাসী তন্ত্রসাধকের মতই কারুর।”

“বলো কী! কার? পুরোটা খুলে না বললে এই সব ক্রিয়া করা যায় না।”

“বলব। তার আগে আমার বিশেষ কটা কথা জানার দরকার।”

“বলো।”

“আপনারা শ্মশানে এতদিন আছেন, এতবার সেই আত্মার উপস্থিতি অনুভব করেছেন, কোনওসময় তাঁর মুক্তির চেষ্টা করেননি? মানে প্রেতশ্রাদ্ধ জাতীয় কিছু ক্রিয়ার মাধ্যমে?”

“হুম, গুরুর কাছে শুনেছি একবার হয়েছিল বটে। সে বারের কথা তাহলে খুলে বলি।”

“বলুন, আমার জানার ভীষণ প্রয়োজন। আমার হাতে আর বিশেষ সময় নেই।”

“সে কী! এত রাতে কোথায় যাবে?” নিতাই ঠাকুর অবাক হন।

ওঙ্কারনাথ মৃদু হাসে, বলে, “কার কখন কোথা থেকে ডাক আসে কেউ বলতে পারে ঠাকুর? আপনি শোনান না আপনার গুরুর সেই কাহিনী।”

“হুম, বলি তাহলে। আমার গুরুদেব ত্রিনাথ অবধূত সাংঘাতিক সিদ্ধাইয়ের অধিকারী ছিলেন। ওই যে পঞ্চমুণ্ডীর আসন দেখছ, ওখানেই সাধনা করে সিদ্ধাই পেয়েছিলেন। তাঁর কাছেই শোনা এ গল্প, গল্প নয় সত্যিও বলতে পারো। কিন্তু তার আগে তুমি বলো তো, তন্ত্রের যন্ত্র কাকে বলে জানো?”

ওঙ্কারনাথ হাসে, বলে, “কিছুটা জানি বৈকি ঠাকুর। যেমন ধরুন একটা বীজ, তার মধ্যেই চারাগাছ নিহিত থাকে, তেমনি যন্ত্রের মধ্যেই মন্ত্রের সব শক্তি নিহিত থাকে।”

“হ্যাঁ, ঠিক। সেরকম যন্ত্র আঁকতে পারলে যন্ত্রে আর ঈশ্বরে পার্থক্য থাকে না। এরকমই একটা শক্তিশালী যন্ত্র আঁকতে শিখেছিলেন আমার গুরু। তার একটা প্রতিলিপি খুঁজলে মনে হয় পাওয়া যাবে আমার কাছে। ছবিটা মনে আছে আমার, দেখিয়েছিলেন আমাকে। একটা সাদা কাগজের উপর কুড়িটা ছক কাটা। এক একটা ঘরে এক একটা বর্ণ আঁকা। জানো তো, ঠিকঠাক বীজমন্ত্র পড়ে আঁকতে পারলে এক একটা বর্ণের কী তুমুল শক্তি! সেই কুড়িটি ঘরের চতুর্দিকে আবার বেশ কয়েকখানি মন্ত্র লেখা। যন্ত্রটাকে মাটিতে অশ্বগন্ধার গুঁড়ো দিয়ে লিখে একখানি কলাপাতায় চালতিলের পিণ্ড সাজিয়ে প্রেতাত্মাকে আহ্বান করতে হয়। যজ্ঞ করে তণ্ডুল দিয়ে প্রেতের শরীর নির্মাণ করে কাকের বাসার কাঠি দিয়ে জ্বালিয়ে হোমাগ্নিতে দেওয়ার নিয়ম। তিন দিন ধরে লাগাতার নিয়ম ধরে ধরে হোমযজ্ঞ করলে উদ্দিষ্ট প্রেতের মুক্তি অবধারিত।”

“আপনার গুরুদেব সেই ক্রিয়া করলেন তারপর?”

“এই ক্রিয়াগুলো করার আগে গাত্রবন্ধন করতে হয় জানো তো? নাহলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। প্রথম দুদিন সমস্যা হল না, কিন্তু তৃতীয় দিনের দিন গুরুদেব যেই না তণ্ডুলের মূর্তিটাকে হোমের আগুনে আহুতি দিতে যাবেন বড় ভয়ানক ঘটনা ঘটল। পঞ্চমুণ্ডীর আসনের পিছনে ওই গাছটা দেখছ তো, ওই গাছের বয়সের কোনও গাছপাথর নেই। হোমটা করছিলেন ওই গাছের তলায় বসে। পরিষ্কার শান্ত আকাশ, কোথাও দুর্যোগের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই কোথা থেকে একটা বিশাল ডাল ভেঙে হোমকুণ্ডের উপর পড়ে সব আয়োজন একেবারে নষ্ট করে দিল। এদিকে দুদিনের যজ্ঞ হয়ে গেছে, শুধু মূর্তিটাকে হোমের আগুনে আহুতি দিতে পারলেই কাজ শেষ। মহা আতান্তরে পড়লেন গুরুদেব। শেষে লোকজন ডেকে ডালপালা সরিয়ে নতুন করে আবার সব সাজিয়ে বসতে যাবেন, এবার আবার একটা মোটা ডাল ভেঙে পড়ল একেবারে গুরুদেবের মাথায়। কোনওমতে প্রাণে বেঁচেছিলেন সেবার। পরে ওনার কাছে একটা অদ্ভুত কথা শুনেছিলাম।”

“কী কথা?”

“তৃতীয় দিনে এই কাজটায় বসার আগে উনি যখন ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করেছিলেন, সেই সময় মায়ের চোখে আগুন দেখেছিলেন। তখনই সতর্ক হয়ে হোমযজ্ঞ বন্ধ করে দিতে হত, তাহলে অন্তত এই ফাঁড়াটা আসত না।”

“কিন্ত মা কেন অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন সেকথা কি আপনার গুরুদেব বুঝতে পেরেছিলেন?”

“এ কথা বোঝা খুব মুশকিল গোঁসাই। সেই বিদেহী কে, কোন পাপাচারের ফলে তাঁর এমন প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়েছে, এ না জানলে কীভাবে বলব বলো দেখি! তাছাড়া মানুষের জীবনমৃত্যুর চক্র বড় রহস্যময় গো গোঁসাই। কার কতদিন কোন লোকে ঠিকানা লেখা রয়েছে, এ আমাদের মত সাধারণ মানুষেরা কী বলতে পারে! আবার অনেক সময় শাপটাপের ব্যাপার থাকলে নির্দিষ্ট তিথি নক্ষত্র ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। মোট কথা, ওই কাণ্ডের পরে আর কেউ চেষ্টা করেনি কোনওদিন। সব নিয়ম কানুন জানা সত্ত্বেও আমিও চেষ্টা করিনি। মনে মনে ভেবেছি, এখনও সময় হয়নি। সময় হলে, মা নিজেই বুঝিয়ে দেবেন।”

“হুম, নির্দিষ্ট তিথি নক্ষত্র। আজকের তিথিটাও তো ভারি অদ্ভুত, তাই না ঠাকুর?”

“হ্যাঁ, তা তো বটেই। পিতৃপক্ষে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে আমরা শ্রাদ্ধ করি, আর আজকের দিনে মলমাসে গ্রহণের যোগ। এমন যোগ কি বারবার আসে? শাস্ত্রে বলে, পূর্বজন্মের সঞ্চিত পাপ থেকে নাকি এ যোগে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। আমাদের মত যারা সাধনা করে, তাঁদের কাছেও এ যোগ খুব পবিত্র যোগ। অনেকসময় সারা জন্মে একবারও জোটে না, তাই তো মনস্থির করেছিলাম… নিতাই ঠাকুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন। যাক গে… এবার বলো কার প্রেতকর্ম করতে হবে? যিনি মারা গিয়েছেন তার পরিচয় আর মৃত্যুতিথিটা লাগবে। পিতৃপক্ষ চলছে, সঠিক তিথিতে পিণ্ডদান করলে মুক্তি অবধারিত।”

ওঙ্কারনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। ঘরের কোণ থেকে হঠাৎ একটা বিকট তক্-কা আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। লম্ফটাকে আওয়াজের দিকে তুলে ধরতেই দেখা যায় ওঙ্কারের পা ঘেঁষে একটা নীলচে ধূসর রঙের তক্ষক এঁকেবেঁকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ফালির মত মণিটায় লম্ফের আলো পড়ে লালচে চুনির মত চকচক করছে। তক্ষক এ শ্মশানে আগেও দেখেছেন নিতাই ঠাকুর। দেবী প্রতিমার বামহাতে কঙ্কণের মত জড়িয়ে আছে তক্ষক আর ডানহাতে শেষনাগ। লম্ফটাকে নামিয়ে রাখতে গিয়েও চমকে যান নিতাই ঠাকুর। খুব সামান্য সময়ের ব্যবধান কিন্তু স্পষ্ট দেখলেন নীলচে মাথার তক্ষকটা ওঙ্কারের পা বেয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসছে। ওঙ্কারের পায়ের গোছটায় একখানি চওড়া জরুলের দাগ, সেইখানে এসে এক দণ্ড থেমে আবার সরসর করে নেমে গেল প্রাণীটা। প্রশ্ন হচ্ছে এই অন্ধকার ঘরে একটা স্যাঁতসেঁতে সরীসৃপ একজনের গা বেয়ে উঠবে আর তার বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হবে না! সে একবারও ভয়ে চিৎকার করে উঠবে না! এও বা কী করে সম্ভব? ভ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকেন নিতাই ঠাকুর।

“পরিচয় দিতে হবে বললেন না?” খুব চিন্তিত স্বরে ওঙ্কারনাথ বলে ওঠে।

“হ্যাঁ, মানে তিনি কী করতেন? কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল এইসব আরকী!”

“তাহলে একটু পুরোনো কথা শোনাতে হয় আপনাকে। গ্রহণটা কখন লাগছে বলুন দেখি।”

নিতাই ঠাকুর হাতঘড়িতে সময়টা দেখেন একবার, তারপর বলেন, “আর ঘন্টাখানেক।”

অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে ওঙ্কারনাথ হেসে ওঠে, বলে… “বাহ, তাহলে আরেকটু সময় আছে এখনও হাতে! কিছু কথা… মানে আমার জীবনের কিছু ঘটনা…তার আগে যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

পরে আর সময় পাব না। বিশ্বাসভঙ্গ করলে তার কি ক্ষমা হয় ঠাকুর? কত জন্ম পরে সেই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তরটা আজও পেলাম না।” ওঙ্কারনাথের গলাটা বিভ্রান্ত শোনায়। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই বলে ওঠে, “আর আমারই নির্বুদ্ধিতা, আপনিই বা জানবেন কীভাবে? পুরো কাহিনীটা শোনেন তাহলে…”

*****

“আমার নাম ওঙ্কারনাথ দত্ত। বাবার নাম ভবতোষ দত্ত। থাকতাম কাশী জেলার অন্তঃপাতী এক গ্রামে, সে গ্রামের নাম কালীপুর। সবথেকে কাছের বড় শহর বারাণসী তাও মাইল দশেক দূরে। পরিবার বলতে বাবা, মা, দুই ভাই আর এক ছোট বোন। বাবা বারাণসীতেই এক গোমস্তার দপ্তরি ছিলেন, সামান্য পড়াশুনা জানতেন, সেই সুবাদেই চাকরি! কষ্টেসৃষ্টে কোনওভাবে চলে যেত, মোটা ভাতকাপড়ের অসুবিধা সেরম ছিল না আরকী! আমাদের পরিবার পরম বৈষ্ণব ছিল, বাড়িতে গোপীনাথের মূর্তি ছিল, সবাই কন্ঠি ধারণ করতাম। বাড়িতে নামসংকীর্তন, সাধনভজন লেগেই থাকত, বাঙালি হলেও আমিষ এক্কেবারে ঢুকত না। বাবার ইচ্ছা ছিল, গ্রামে গোপীনাথের মন্দির স্থাপন করে আমাকে তাঁর সেবায় নিয়োগ করবেন। সেইমত তৈরীও হচ্ছিলাম, হঠাৎ গ্রামে ভয়ংকর এক বিপদ নেমে এল। একটা বিশেষ ধরণের জ্বর, আগে কোনওদিন কেউ দেখেনি এরকম, গ্রামের সবাই একে একে সেই জ্বরে পড়তে লাগল। ভয়ানক জ্বর, একবেলা কমে তো দ্বিতীয়বেলা একলাফে দুগুণ। হাতপা ফুলে যাওয়া, চামড়া কালো পড়ে যাওয়া, পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা… সে যেন এক মহামারীর সৃষ্টি হল। আমার বাড়িতে আমায় বাদ দিয়ে সবার জ্বর হল, মায়ের, দুইভাইয়ের, শেষে সবথেকে ছোট বোনটারও। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে গোপীনাথের নিত্যপূজা করার মত কেউ রইল না। ওষুধপথ্যি করার মত বা বদ্যিকবিরাজ দেখানোর মত অবস্থা বিশেষ কারোর ছিল না, এক আমাদের পরিবারের বাদ দিয়ে। বাড়িতে সবার জ্বর শুনে বাবা ছুটি নিয়ে শহর থেকে গ্রামে এলেন, মনে মনে হয়তো ইচ্ছা ছিল আমাদের সবাইকে নিয়ে শহরে যাবেন,তারপর, গ্রাম থেকে জ্বরজারির উপদ্রব কমলে আবার দিয়ে যাবেন। কিন্তু অদৃষ্টের মার ঠাকুর! কে কোনদিন বাঁচতে পেরেছে! বাবাও জ্বরে পড়লেন, মাত্র দুদিন… দুদিনের মধ্যে সব শেষ। বাবা, মা, দুই ভাই, সবাইকে হারালাম। বেঁচে রইলাম আমি আর আমার ছোট বোন। সে সবার ছোট ছিল, আর তার জ্বরের প্রকোপটাও যেন কম ছিল। ওকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শুরু করলাম। তখন কতই বা আমার বয়স… সতেরো আঠেরো হবে। কী করব, কোথায় যাব, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। সেই সময় গ্রামের দশা যদি দেখতেন, খাঁ খাঁ করছে ঘরবাড়ি, ঘরের বাইরে উঠোনে পড়ে পড়ে, রোদে পুড়ে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে লোক। মরলে পরে মুখে এক ফোঁটা জল দেওয়ার কেউ নেই, সৎকার করার কেউ নেই, চারিদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। গ্রামের শ্মশানে মড়া পুড়াবে কে? ডোম তো নিজেই মরে ভূত। চারিদিকে মড়া পচা গলা মৃতদেহের ভিড়। ঘর থেকে বেরোলে গন্ধে টেকা যায় না। এই সবের মধেও না জানি কীভাবে আমি বেঁচে রইলাম, হয়তো দৈবের এত সহজে আমাকে নিস্তার দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। একরাতে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রাম থেকে পালাব। পরের দিন সকালে সেইমত বোনকে নিয়ে বেরোতে যাব, দেখি ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বমি, পেটের মারাত্মক যন্ত্রণা। এক একবার বমি করে, আর পেটের ভিতর থেকে গুলিয়ে কাদা কাদা কীসব বেরিয়ে আসে। শেষে ওই অবস্থাতেই ওকে কাঁধে ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। গ্রামের বাইরে প্রথমবার পা রাখলাম। পেছনে ফিরে একবার তাকালাম, আমার বাড়ি, মৃত বাবা, মা, ভাইরা… সবাই পিছনে পড়ে রইল। কত পথ হাঁটলাম মনে নেই, দুপুরবেলা হয়েছিল বোধহয়। গ্রাম ছেড়ে বহুদূরে এগিয়ে এসেছিলাম। মাথার উপর গনগনে সূর্য, তার তো জ্বলার একমুহূর্তও বিরাম নাই। ক্লান্ত হয়ে বোনকে কাঁধ থেকে নামাতে গিয়ে খেয়াল পড়ল, সে তো এতক্ষণের মধ্যে একবারের জন্যও জল চায়নি। যখন বেরিয়েছিলাম, বারে বারে জল চেয়ে ডাকছিল আমায়। তার চুলের মধ্যে হাত দিয়ে মাথাটা নাড়িয়ে দেখি, এক দিকে কাত হয়ে হেলে পড়ল মাথাটা। মনে মনে শিউরে উঠলাম, ইষ্ট ডাকলাম, আমার জীবনের একমাত্র সহায়কেও কি কেড়ে নিলেন শেষে!

কাঁধ থেকে তাকে নামিয়ে দেখি তার ছোট্ট কপালের চারপাশে বেশ কগাছি চুল লেপ্টে রয়েছে। তখনও ঘামে তারা ভিজে, শুধু প্রাণবায়ু হয়তো কিছুক্ষণ আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। অপদার্থ সহোদর আমি, নয়তো মৃত্যুযন্ত্রণায় তার চোখদুটি থেকে জলের ধারা নেমে শুকিয়ে গালে ছাপ ফেলেছিল, অথচ তার কান্নার সে শব্দ আমি শুনতে পাইনি। একটি গাছের তলায় তার ক্ষুদ্র শরীরটিকে আমার সামনে নামিয়ে রেখে চুপ করে বসে রইলাম। বুকের ভিতর কী যেন জমাট বাঁধছিল। কাঁদতে ইচ্ছা করছিল না, শুধু অপরিসীম ক্ষোভ, ক্রোধ আর দুঃখে ক্রমশ পাথর হচ্ছিলাম আমি। সামনেই ভাগিরথী বইছিল, আমার কনিষ্ঠতমা সহোদরাকে জলে ভাসিয়ে দিলাম। তার লালকমলা ফুলছাপ জামাটি, তার ছোট্ট মাথাটি, যে মাথা না জানি কতবার স্নেহচুম্বনে সিক্ত করেছি, ধীরে ধীরে চোখের সামনে তলিয়ে গেল। সেইদিন দুপুরে আমারও জ্বর এল। জ্বরের তাপে পুড়ে যেতে যেতেও মনে স্বস্তি এল, অবশেষে এই নিরর্থক জীবন ছেড়ে যেতে চলেছে আমায়। রাত গভীর হল, চতুর্দিকে শেয়ালের ডাক ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না। জ্বরের ঘোরে আমার ভলকে ভলকে বমি হচ্ছিল। বমির সাথে সাথে পেটের মধ্যে থেকে কী জানি সব কাদা কাদা দলার মত বেরিয়ে আসতে লাগল। ক্লান্তিতে, জ্বরের তাড়সে চেতনা হারাতে হারাতে টের পেলাম কে যেন মুখটা হাঁ করিয়ে তরল কোনও পদার্থ মুখের মধ্যে ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভিতরটা জুড়িয়ে গেল। অনেকদিন জলে না ভেজা মাটিতে জল পড়লে যেমন ভাঁপ বেরোয়, শরীরের ভিতর থেকে তেমন ভাঁপ ছাড়ছিল। আমার শরীরটাকে এরপর সেই অপরিচিত দীর্ঘদেহী কাঁধে তুলে নিল, তাঁর কাঁধে দুলতে দুলতে আবার অনির্দিষ্টের পথে চলতে শুরু করলাম আমি।”

“বারাণসী! কাশী! মানে তুমি এদেশের লোক নও? এত দূর থেকে এখানে?”

হরি পরামাণিক প্রশ্ন করে।

“আহ্, কথাটা শুনতে দে হরি।” নিতাই ঠাকুর বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন।

ওঙ্কারনাথ একটু থেমে আবার শুরু করে।

“যখন জ্ঞান ফিরল, কোনওমতে চোখ মেলে দেখলাম একটা বিরাট মুখ, তার সারা মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। সেই বিরাট মুখটার দুখানা চোখের দৃষ্টিতে আমি গলে যেতে লাগলাম। কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম কিছু মনে নাই, চোখ খুলে দেখলাম একটা ঘরে শুয়ে আছি, জানালা হাট করে খোলা। সে জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যায় নিশ্ছিদ্র দুর্ভেদ্য জঙ্গল। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র কিছু নাই, শুধু এক কোণে ধুনি জ্বালানোর ব্যবস্থা রয়েছে। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, দেখি সেই লোক হাতে একখানা নরকপাল নিয়ে ঘরে ঢুকছে। ভীষণ দর্শন, রক্তাম্বর পড়া, আমার দিকে চোখ পড়াতে দৃষ্টি একটু নরম হল। অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন, “শালা মড়া বেঁচে উঠেছে তো রে! নাম কী তোর শূয়োরের বাচ্চা?” উত্তর দিলাম না দেখে অট্টহাস্য করে আবার বেরিয়ে গেলেন।

সেই শুরু, কিছুদিন থাকার পর বুঝলাম এসে উঠেছি এক শ্মশানে। আশেপাশে ক্রোশ ক্রোশ দূরেও কোনও লোকালয় নেই, জনমনুষ্যি বলতে কতগুলো হাঁড়ি আর ডোম। গঙ্গার ঘাটের কাছে যেখানটা মড়া পুড়ানো হত, সেখানেই একটা মাটির ঘরে থাকতাম। শরীর অসম্ভব ক্লান্ত, অবসন্ন লাগত। সেই কালান্তক জ্বরে আমার শরীরের জীবনীশক্তিটুকু নিঃশেষ করে ফেলেছিল। দিনে মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে পেতাম, ঘরে এসে দুচারটে ফলমূল আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে যেতেন। রাতে কোনওসময়ই তাঁকে দেখতে পেতাম না। ঘরের এক কোণে একটা কলসী ছিল, তাতে উনি জল ভরে দিয়ে যেতেন। কদিন এইভাবেই চলল। কিন্তু মানুষের মত আত্মসুখী জাত আর একটাও নেই ঠাকুর! দুদিন যেতে না যেতেই ভাতের নেশায় মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠল। তাঁকে রোজ দেখতাম কলাপাতায় করে ভাত খেতেন, অথচ একবারের জন্যও আমায় বলতেন না। একদিন তিনি ঘরে ফিরতে তাঁকে বলে উঠলাম, “দুমুঠো ভাত পাওয়া যাবে?”

তাঁর বিকট চেহারা, নোংরা জামাকাপড়, রুক্ষ চুলের জটা, আর তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টি, সব মিলিয়ে তিনি আমার কাছে যেন জীবন্ত বিভীষিকা ছিলেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “ভাত আছে, তুই খেতে পারবি তো? ঠিক করে বল, আনার পর ফেলে দিলে চলবে না। মহাপ্রসাদ, ফেলে দিলে তোকে আমি জ্বালিয়ে দেব।”

দুমুঠো ভাতের জন্য আমি তখন পাগল হয়ে গেছি। ওনার কথার তাৎপর্য না বুঝেই হ্যাঁ বলে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে কোথা থেকে একদলা ভাত এনে সামনে রাখলেন, তাতে কী একটা হলুদ মত রস মাখামাখি করা। মুখে দুগ্রাস তুলতেই পেটের নাড়ি গুলিয়ে বমি এল। বিকট গন্ধ, তেমনি বিশ্রী স্বাদ। এ জিনিস আগে কোনওদিন খাইনি। মুখচোখ বিবমিষায় অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল, মুখ থেকে থুঃ করে খাবারটা ফেলতে গিয়ে দেখি একজোড়া জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে।

দাড়ি গোঁফের আড়াল থেকে সেই একজোড়া চোখের রুষ্ট দৃষ্টি কোনওদিন ভুলতে পারব না। কিছুক্ষণ পরে আপনমনেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন। বললেন, “মড়ার মাথা ফাটিয়ে যে ঘিলু বেরোয়, সেই ঘিলু মাখানো ভাত খায় মা। তোকে আগেই বলেছিলাম! মহাপ্রসাদ এটা। এঁটো করে ফেলতে পারবি নে। একি যার তার কর্ম!”

খাবারটা গিলে নিলাম। এতদিনের ঝড়ঝাপটায় পুরোনো জীবনের স্মৃতির উপর যে ধুলো জমে ছিল, সেদিনের সেই বিষাক্ত খাবার আবার সেই ধুলো উড়িয়ে দিল। কোনও কোনও বিষে মানুষের শরীর মরে না, কিন্তু মন মরে যায় জানেন তো ঠাকুর!

আমার আবার সব মনে পড়ে গেল, গোপীনাথের মূর্তি, তাঁর হাতের বাঁশি, মৃদু হাসি, আমার বাড়ির উঠোন, প্রতি সন্ধ্যায় খোলকরতাল সহযোগে নামভজন, আমার সাত্ত্বিক নিরামিশাষী বাবা মা ভাই বোন সকলকে। আর আমি ওখানে বসে বসে মৃত নরশরীরের পুঁজ, রস, রক্ত, ঘিলু পান করছিলাম। তীব্র ঘেন্না হল, এমন ঘেন্না যাতে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত জ্বলে যায়, জ্বালায় জ্বালায় ছটফট করতে থাকলাম… অথচ মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ঘেন্না মরে গিয়ে আস্তে আস্তে ভয়ানক রাগ হল। পৃথিবীর সব কিছুর উপর, সমস্ত সম্পর্কের উপর রাগ, বিতৃষ্ণায় আমার সব সুখস্মৃতি, সব নরম অনুভূতি জ্বলে খাক হয়ে গেল। জানেন তো ষড় রিপুর মধ্যে নিকৃষ্টতম রিপু ক্রোধ। ধীরে ধীরে আমার বাকি জীবনটাও সেই ক্রোধের আগুনে…”

এত অবধি বলে ওঙ্কার খানিক থামল। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত ওঙ্কারনাথের গল্প শুনছিল। নিতাই ঠাকুর বলে উঠলেন, “মড়ার ঘিলু মাখানো ভাত দিয়ে মহাপ্রসাদ! অঘোরপন্থী ছিলেন নাকি!”

ওঙ্কারনাথ বলে উঠল, “হ্যাঁ, তাঁকে সবাই ভৈরোবাবা বলে ডাকত। বিচিত্র ছিল তাঁর জীবনযাপন, শুদ্ধ অশুদ্ধ, শুচি অশুচি কোনও ভেদ ছিল না। নরমাংস, মল, মূত্র, রক্ত কোনওকিছুতেই কোনও বিকার ছিল না। শুধু ছিল তীব্র তেজ, চোখের দৃষ্টিতে জীবন শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা। আমি শ্মশানে তাঁর সাথে থাকতে লাগলাম। তাঁর সাধনার জন্য নানাবিধ বস্তু যোগাড় করতাম। মাঝে মাঝে দিনের পর দিন ঘরে ফিরতেন না, কোথায় যেতেন তাও বুঝতে পারতাম না। একপ্রকার উদ্দেশ্যহীনভাবে আমার দিন কাটছিল।

আমাকে সেই দিন মহাপ্রসাদ খেতে দেওয়ার পর থেকে ভৈরোবাবার কাছে আমি আর কোনওদিন ভাত খেতে চাইনি। ততদিনে গায়ে হাত পায়ে বল হয়েছে। সারা শ্মশান ঘুরে শববাহকদের কাছ থেকে সাধারণ খাদ্য যোগাড় করে খেতাম। আর পানের জন্য ভাগিরথীর অফুরন্ত জল তো ছিলই। বারবার মনে হতো, পালিয়ে যাই শ্মশান থেকে। কিন্তু আশ্চর্য! যতবার পালাবার কথা ভাবতাম, ঠিক ততবারই উনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাতেন। যেন মনের অন্তঃস্থলে কী আছে পড়ে ফেলতেন। ভীষণ ভয় পেতাম। ভাবতাম, পালিয়ে গেলে এই হিংস্র কাপালিক আমায় মন্ত্র তন্ত্রের জোরে মেরেই ফেলবে। তাছাড়া পালিয়ে গিয়ে যে বাঁচব সেরকম কোনও আস্তানাও তো জানা ছিল না। সমগ্র বারাণসীতে একটি লোককেও চিনতাম না, পুঁথিগত বিদ্যার ভাণ্ডার ছিল খুব সীমিত, তাই কোথাও লেখাপড়ার কাজ নেব সেরকম সম্ভব ছিল না। আর ভদ্রঘরের সন্তান হয়ে কুলিকামিনি করতে রুচিতে বাধত। একপ্রকার বন্দীদশা তখন আমার। একদিকে আশ্রয় আর পেটের টান; অন্যদিকে মড়ার মাথা, পোড়া শরীরের টুকরো, চারিদিকে ছড়ানো মানুষের হাড়ে থিকথিক করা শ্মশান। মনের কোণে বিতৃষ্ণা, রাগ চেপে শুধুমাত্র আশ্রয়টুকুর লোভে থেকে গেলাম সেখানে। কিন্তু একদিন হঠাৎ অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।”

“কীরকম ঘটনা?” নিতাই ঠাকুর প্রশ্ন করলেন।

“এক সন্ধেবেলা কুঠিয়ার দাওয়ায় ভৈরোবাবার সাথে বসে আছি। ভাদ্রমাস, শুক্লপক্ষের পঞ্চমী। হঠাৎ ভয়ানক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলাম। দেখি অনেকগুলো বিষাক্ত সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে ভৈরোবাবার পায়ের কাছে কিলবিল করছে, হাতে ধরা নরকপাল থেকে কী যেন খেয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে একখানি সাপ ছোবল তুলে ধরতেই একবার সাপটার দিকে তাকালেন, সঙ্গে সঙ্গে সাপটা ওখানেই ফণা নামিয়ে কাটা কলাগাছের মত মাটি পড়ে গেল। আতঙ্কে উঠে দাঁড়িয়েছি, দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছেন।

বললেন, “কেন রে? ভয় পাস?” বলেই হাতটা ধরে সাপের কুণ্ডলীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কিন্তু সাপগুলো সরসর করে আমার হাতের উপর দিয়ে নেমে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, উনি বললেন, “শিখবি? সাপের বিষকে কী করে নির্বিষ করতে হয়? মড়া নাচাতে শিখবি? চল আজ থেকে তোর নাম দিলাম ওমকারা।” বলেই ঘরের থেকে একরাশ মড়া পোড়া ছাই তুলে এনে আমার সারা গায়ে মাখিয়ে দিলেন। আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল, কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারলাম না ।

হা হা করে এমন হেসে উঠলেন যে পুরো শ্মশান যেন কাঁপতে লাগল। বললেন, “তোর নামেই তো ভৈরব আছে রে… শুধু শক্তি লাগবে তোর। যাবি নাকি! দেখবি আমার শক্তিকে? এ শক্তি যে সে শক্তি নয় রে, প্রলয়ের শক্তি রাখে আবাগীর বিটি। শালা যেখানে যেখানে যায়, আমায় টেনে টেনে সাথে নিয়ে যায়।”

মনে পড়ে গেল সেই মহাপ্রসাদের কথা! কুৎসিত সাধকের পূজিতা কোনও কুৎসিত দেবী হবেন তিনি! নরমাংস খান, মানুষের ঘিলু মেশানো ভাত খান! কী না বিকট রূপ হবে তার! মন আবার ঘিনঘিনিয়ে উঠল। চুপ করে আছি দেখে ভৈরোবাবা দাঁড়িয়ে উঠলেন। উত্তেজনায় আমার কাঁধ খিঁমচে আবার বললেন, “সামনে ঠিক দশদিন পর চতুর্দশী। মহা যোগ। ওই দিন সাধনায় বসব, সেইদিন সাধনা শেষ হলে তোকে দেখাব আমার শক্তিকে। কয়েকটা জিনিস লাগবে, জোগাড় করে দিতে পারবি? খুব অশ্রদ্ধা নিয়েই উত্তর দিয়েছিলাম, “পারব।” তখনও জানতাম না কী বিপদ ডেকে আনছি!

দশদিন ধরে ভৈরোবাবা আমায় তন্ত্রাচারের নিয়ম নীতি শেখালেন। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে ঠিক কী হবে পরিষ্কার করে বললেন না। অবশেষে উপযুক্ত সময় এসে উপস্থিত হল। সেদিনও ঠিক এমনই এক রাত ছিল। ভাদ্রমাসের শুক্লা চতুর্দশী। মলমাস। পূর্ণিমা লাগবে, আর তার কিছুক্ষণ পরেই গ্রহণ। পিতৃপক্ষের সূচনাতেই গ্রহণ।

রাত্রি তখন তিন প্রহর। শ্মশানে তখন শিয়াল কুকুরের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। ভৈরোবাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গভীর জঙ্গলে ঢুকলাম। অনেকটা দূর হাঁটার পর একটা বিরাট অশ্বত্থ গাছের তলায় একটি ছোট্ট কুঠিয়া দেখতে পেলাম। ভৈরোবাবা মাঝে মাঝে কোথায় নিরুদ্দেশ থাকতেন তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছিলাম। এই কুঠিয়াই যে তাঁর গোপন আস্তানা, আর সেইস্থানেই যে তাঁর উপাস্য সেই দেবী আছেন তা অনুমান করছিলাম। ভৈরোবাবা সেই কুঠিয়ার পেছনে আমাকে নিয়ে গেলেন। দেখি একটা চারহাত চৌকোনও মত জায়গার আগাছা জঙ্গল পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। বুঝলাম, ওইটিই তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্র।

গ্রহণ লাগল এবং যথাসময়ে যথাবিহিত পূজা শুরু হল। শিবাভোগ বানিয়ে সাথে এনেছিলেন। মাংস, নৈবেদ্য, পাঁচরকমের ফল। সেইসব কলাপাতায় মুড়ে বিচিত্র এক মন্ত্র পড়ে কালী-কালী বলে ডেকে ঝোপের ধারে দিয়ে এলেন। আগেই বলেছিলেন শিবাভোগ খেতে নাকি শেয়াল সেজে তাঁর আরাধ্যা দেবী স্বয়ং আসবেন। আমার চোখে তখন তাঁর সব ক্রিয়াকলাপই বিকৃত লাগছিল। পাশবিক সাধকের পাশবিক উল্লাস।

ভৈরোবাবা একে একে গুরু, গণেশ, বটুক, যোগিনী, মাতৃকা এঁদের পূজা করলেন। ক্ষেত্রপূজা শুরু করে শ্মশানাধিপতি ভৈরব, কালভৈরব ও মহাকালের কাছে বলিদান করে , সুদর্শনমন্ত্রতে দেহরক্ষা ও দেহবন্ধন করে দুর্গাবীজ উচ্চারণ করে দশদিকে শ্বেতসরষে ছিটিয়ে সাধনা শুরু করলেন। ততক্ষণ লক্ষ করিনি তাঁর ঠিক পাশেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে একটা মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভৈরোবাবা উঠে গিয়ে লাশটাকে সোজা করে শোওয়ালেন। দেখলাম সম্পূর্ণ নগ্ন এক চাঁড়াল রমণীর লাশ। ভয়ে, ঘেন্নায়, লজ্জায় শিউরে উঠলাম। বুঝলাম, একেই বলে শবসাধনা। ভৈরোবাবা হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকলেন। অন্ধকারে উল্লাসে যেন তাঁর চোখদুটো জ্বলছিল। এক পা এক পা করে তাঁর দিকে এগোতে তিনি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “এনেছিস? যা যা বলেছিলাম?”

ভৈরোবাবা তন্ত্রপূজার জন্য কিছু বিশেষ জিনিসের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন আমায়। কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করে তাঁর হাতে তুলে দিলাম জিনিসগুলো। পিছন ফিরে চলে আসতে যাচ্ছি, উনি আমাকে ডাকলেন। বললেন, “ওঙ্কারা, দাঁড়া বাবা।”

বহু, বহুদিন পরে কারুর মুখে বাবা ডাক শুনলাম। মনে হল মস্তিষ্কের সব কটা তন্ত্রী একসাথে কেঁপে উঠল। ফিরে তাকালাম ওনার দিকে। কাছে এগিয়ে এসে নিজের গলা থেকে একখানি কবচ খুলে আমার গলায় পরাতে পরাতে বললেন, “এটা পরে রাখ, তুই এ পথে নতুন। এই সাধনা খুব সতর্কভাবে করতে হয়। অনেক নিয়ম কানুন, ভেদাভেদ। না মানলেই মারাত্মক বিপদ সাধকের। সাধনায় বসলে কত রকম বিকট শব্দ হয়, ডাকিনী যোগিনীরা আসে, ভয় দেখায়, আসন থেকে ফেলে দিতে চায়, প্রাণসঙ্কট থাকে। তোর ভয় লাগবে। আমার দেহবন্ধন করা আছে, তাছাড়া মা আমার সাথে, আমার কিছুই হবে না। তুই বরঞ্চ এটা পরে ওই কুঠিয়াটায় গিয়ে বস। ওটা মায়ের মন্দির। যদি তাও ভয় পাস, মায়ের মূর্তিটাকে জড়িয়ে বসে থাকিস।” মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে ভৈরোবাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তাঁর ঘোলাটে চোখের মণিতে প্রথমবার স্নেহের নরম আলো দেখতে পেলাম। বললেন, “তোর অনেক শোক তাপ জানি আমি! আশীর্বাদ করলাম তোর শোকতাপ সব কেটে গিয়ে নতুন জীবন পাবি তুই।”

শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। যাকে এতদিন শুধুই ভয়ে, রাগে আর ঘেন্নায় দূরে ঠেলেছিলাম, তিনি কবে থেকে আমায় এমন আপন ভাবতে শুরু করেছেন! নিজের গলার কবচ খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন! মনে পড়ে গেল মৃত্যুমুখ থেকে তুলে এনে আমায় নতুন জীবন দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বেশভূষা, আচারবিচার, পূজাপদ্ধতির অস্বাভাবিকতায় আমার মনে যে বিতৃষ্ণা জন্মেছিল তাতে সেই শাশ্বত সত্যিটা যেন কোথায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। যে জীবনটার বলে মনে এত ঘেন্না, এত অশ্রদ্ধা পুষে রেখেছিলাম, সেই জীবনটাই যে তাঁর দেওয়া সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম! নিজের গলার কন্ঠিটায় হাত পড়ল। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য, গুণী-অগুণী, চন্ডাল-মুচি, সব রকম মানুষকে শুধু একটাই ধর্ম বেঁধে রেখেছে মনে পড়ে গেল। ভালোবাসার ধর্ম, সেবার ধর্ম। সে ধর্মের প্রকাশ আলাদা আলাদা হতে পারে কিন্তু উদ্দেশ্য তো একটাই। কিন্তু যখন এ কথা মনে পড়ল, বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছিল।

আর ফেরার কোনও রাস্তা ছিল না। মনে মনে বুঝতে পারছিলাম একটা প্রকাণ্ড ভুল করে ফেলেছি। অজানার আশঙ্কায় আর পাপবোধে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল।

কতক্ষণ জানি না কুঠিয়ার দাওয়ায় বসে ছিলাম। কুঠিয়ার পিছন থেকে ভৈরোবাবার গলায় উচ্চস্বরে মন্ত্রপাঠ শুনতে পারছিলাম।

বশমে ভবদেবেশ সমামুকং পদং ততঃ

সিদ্ধিংদেহি মহাভাগ ভূতাশ্রয়পাদমবঃ॥

ওঁ ভীম ভীরু ভয়াভাব ভবলোচন ভাবুক।

ত্রাহিমাং দেবদেবেশ শবানামধিপাধিপ॥

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মন্ত্রপাঠ থেমে গেল। একটা প্রবল ঝটাপটির আওয়াজ পেলাম যেন। মন আগে থেকেই উদ্বিগ্ন হয়েছিল… কুঠিয়ার পিছনে দৌড়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার নিঃশ্বাস রোধ হয়ে গেল। দেখলাম চাঁড়াল রমণীর মৃতদেহের উপর ভৈরোবাবার শরীরটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, আর একটা শেয়ালের মত প্রাণী তাঁর বুক খুঁড়ে রক্ত পান করছে। আমার পায়ের শব্দে সে প্রাণী বিচলিত হল না, একইভাবে বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে রক্ত খেয়ে যেতে লাগল। চাঁদ তখন সম্পূর্ণ ছায়ায়। সেই অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখলাম, প্রাণীটার শরীর চিকচিক করে জ্বলছে। মনে হল যেন স্বয়ং নরকের দূত উঠে এসে ভৈরোবাবার রক্ত পান করে যাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গেলাম, গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। অনেকক্ষণ ধরে রক্ত খেয়ে যখন সে মুখ তুলল, সারা মুখ তার রক্তে মাখামাখি। চোখের সামনে তারপর বিভীষিকাময় প্রাণীটা হাওয়ার মধ্যে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। ভৈরোবাবার সম্পূর্ণ রক্তশূন্য শরীর পড়ে রইল নিরাভরণ রমণী শরীরের উপর। চারিদিকে পূজার উপাচার ছড়ানো, পাঁচ দিকে পাঁচখানি দীপ জ্বলছে আর দীপের ম্লান আলোয় দুখানি শবদেহের সামনে হতচকিত দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কাঁপছিলাম আমি।

প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কুঠিয়ায় এলাম।

চাঁদ তখনও গ্রহণে। এক ফোঁটা আলো কোথাও নেই। অন্ধকার ঘরের ভিতরে হাতড়ে হাতড়ে দেবীমূর্তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সমস্ত সত্ত্বা তখন আমার অনুতাপের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। প্রতিমার আদলখানি দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। হঠাৎ প্রকৃতিই সে ব্যবস্থা করে দিল। চাঁদের গ্রহণ আস্তে আস্তে কেটে গেল, আর কুঠিয়ার কঞ্চির জানালার ফাঁক গলে একফালি জ্যোৎস্না লাফ দিয়ে প্রতিমার মুখে এসে পড়ল। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, প্রতিমার সারা শরীর বেয়ে অসংখ্য সাপেরা ওঠানামা করছে। বিরাট কানের ছিদ্র থেকে দুখানি শিশুদেহ ঝুলছে, গলায় আজানুলম্বিত পঞ্চাশটি নরকরোটির মালা থেকে অমানুষিক এক ধরণের খটখট আওয়াজ আসছিল। কাছে গিয়ে পা ধরে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে যাব, দেখি প্রতিমার মুখে অনেকখানি কাঁচা রক্ত লেগে… আর তাঁর চোখদুটি থেকে যেন আগুন ঝরছে। বুঝতে বাকি রইল না, শিবাবেশে কে ভৈরোবাবার রক্ত খেয়ে গেছে।

কুঠিয়া ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। আর আমার বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে পিছনে একটা ভয়ানক জোরে আওয়াজ হল। কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ, মারাত্মক ধ্বংসের সূচনা। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল, দেখলাম মাটিতে বিরাট বড় বড় চিড় ধরছে। দৌড়াতে দৌড়াতে দূরে চলে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম পিছনের কুঠিয়া, অশ্বত্থ গাছ, দেবীমূর্তি, আর ভৈরোবাবার শরীরের অবশেষ সব মাটির তলায় সেঁধিয়ে গেল। সেইদিন শ্মশান ছেড়ে সেই যে দৌড়াতে শুরু করলাম, এতদিন ধরে শুধু দৌড়েই যাচ্ছি। নিস্তার নেই আমার।”

*****

লম্ফটায় তেল কমে এসেছিল। সলতে পোড়ার ফটফট শব্দ ছাড়া আর একটাও শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। হরি পরামাণিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু সব ঠিকঠাক থাকলে তো মড়াসাধনায় ব্যাভিচার ঘটবে না গোঁসাই! কী কারণে দেবী অমন রেগে গেলেন কিছু বুঝতে পারলাম না যে!”

ওঙ্কারনাথের গলাটা হাহাকার করে উঠল। একবুক গ্লানি নিয়ে সে বলে উঠল, “খ-পুষ্প জানেন কাকে বলে?”

নিতাই ঠাকুর ভ্রু কু্চকে ছিলেন। কোনও একটা হিসাব যেন মেলাতে পারছিলেন না। এতক্ষণ পরে স্থির কন্ঠে বলে উঠলেন, “তন্ত্র আচারের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। নারীর স্রাব থেকে নিঃসৃত রক্ত বা রজঃ। এই রজঃ স্ত্রী বীজ হিসেবে কল্পিত, তন্ত্রের ভাষায় রক্তচন্দন বা খ-পুষ্প, যা দেবীর নিকট অতি পবিত্র। সবচেয়ে পবিত্র কার্যকর রজ হচ্ছে অক্ষতযোনি কিশোরীর প্রথম রজঃ। চণ্ডালীর রজের নাম বজ্রপুষ্প, কুমারীর স্বয়ম্ভূকুসুম, সধবার কুণ্ডোদ্ভব এবং বিধবার গোলোদ্ভব।”

“ভৈরোবাবা সেদিনের সাধনার জন্য আমায় অক্ষতযোনি বালিকার প্রথম রজঃ সঞ্চয় করে আনতে বলেছিলেন। যাওয়ার কথা ছিল শ্মশান ছাড়িয়ে লোকালয়ের হরিজন বস্তিতে। ঐ বিশেষ দিনে শবসাধনার জন্য ঐ বিশেষ উপকরণটির ব্যবস্থা কোথা থেকে হবে তা ভৈরোবাবা আগে থেকেই জানতেন। হয়তো বা কোনও স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন! আমাকে বললেন, “যা ওমকারা, চেয়ে নিয়ে আয়। এক হরিজনের নাম বললেন, তার কাছে গিয়ে চাইতে হবে সে উপকরণ। নারী শরীরের রক্ত… রজঃ! রাগে ঘেন্না আমার শরীরের সব কটা রন্ধ্র পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে লোকটা… এতদিনের জমানো বিতৃষ্ণা, জমাট বাঁধা রাগ ফেটে পড়ল। ঠিক করলাম, তাঁর সাধনা পণ্ড করব। যে সাধনপদ্ধতি দেখলে আমার বমি পাওয় ছাড়া আর কোনও অনুভূতিই হত না, তার জন্য আবার নির্দিষ্ট উপকরণ! ঠিক করলাম আকাঙ্খিত উপকরণের বদলে এমন কিছু দিতে হবে যাতে তাঁর পৈশাচিক সাধনা ভঙ্গ হয়, কিছুতেই সিদ্ধি না পান। হঠাৎ শ্মশানের ধারেই চোখে পড়ল, একটি কুকুর রক্তে বিষ্ঠায় মাখামাখি হয়ে পথের একপাশে পড়ে আছে। সর্বাঙ্গে ঘা, তার গুহ্যদ্বার থেকে বেরিয়ে আসা রক্তে সেখানকার মাটি ভিজে গেছে। তখন সূর্য পাটে গেছে, হঠাৎ মনে পড়ল হাতে তো আর সময় নেই। রাতেই তো সাধনায় বসবেন উনি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কোনওমতে সেই রক্ত হাতের পাত্রে তুলে নিলাম। তারপর রাতে ভৈরোবাবা চাইলে তাঁর হাতে ওটাই তুলে দিয়েছিলাম।”

“মারাত্মক অপরাধ করেছিলে। সাংঘাতিক ব্যাভিচার! শব স্বয়ং ভৈরব বা ভৈরবী। পঞ্চভূতের শুদ্ধতম রূপ, কৌলাচারী সাধক একাধিক বার সাধনায় সেই পঞ্চভূতের খাঁচায় ভৈরব বা ভৈরবীকে জাগান। এ পথ সাধারণ মানুষের নয়। তুমি কাজটা করতে অস্বীকার করতে পারতে! সাংঘাতিক অপরাধ করেছিলে, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! কিন্তু এইবার একটা কথা বল দেখি গোঁসাই। মলমাসে পিতৃপক্ষে গ্রহণের যোগ, এমন মহা যোগ তো শুনেছি প্রায় আড়াইশ বছর পর পর আসে। আর যে দেবীর বর্ণনা দিলে তিনি স্বয়ং আমাদের মা গুহ্যকালী…”

নিতাই ঠাকুরের কথা শেষ হতে পায় না। ওঙ্কারের অট্টহাস্য শোনা যায়। ধীরে ধীরে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। হঠাৎ করে জোলো হাওয়া, আর মাটির সোঁদা গন্ধ হাওয়া ভেদ করে একটা আঁশটে পচা গন্ধে ঘর ভরে ওঠে। গন্ধটা ঘরের সবারই চেনা। সে গন্ধ মৃত পচা আধগলা শরীরের। লম্ফর শিখাটা কেঁপে ওঠে একবার। এতক্ষণে হাওয়ার দাপটে ওঙ্কারের শরীরের উপর লেপ্টে থাকা উড়নিটা সরে যায়। লম্ফর প্রায় নিভে যাওয়া শিখাটাতেও স্পষ্ট দেখা যায় ওঙ্কারের শরীর বেয়ে অসংখ্য সাপেরা ওঠানামা করছে। তাদের কালো আঁশহীন শরীরে হাল্কা আলো পড়ে চিকচিক করছে। ওঙ্কারের চোখের সম্পূর্ণ অংশ সাদা। ফ্যাসফ্যাসে স্বরে সে বলে ওঠে, “আজ আড়াইশ বছর আমি এদের শরীরে বহন করে বেড়াচ্ছি ঠাকুর। এদের বিষে বিষে জর্জরিত আমি। যে সাপেদের ভৈরোবাবা নিয়ে খেলা করতেন, যাদের বিষময় শরীরকে নির্বিষ করে দিতেন উনি, তারাই ওনার মৃত্যুর সাজা দিতে সাথে সাথে ঘোরে আমার। আমার দিন নেই, রাত নেই, আদি নেই, অনন্ত নেই… শুধু আছে বিষ দংশনের ভয়। এতদিন পরে আমার ডাক এসেছে… যেতে হবে তবু যাওয়ার আগে একবার তাঁর ব্যবস্থাটা করে যেতে এসেছিলাম। এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন তিনি। পাপাচার আমার… শাস্তি পেলেন উনি! তাঁর মুক্তি হলে যদি আমি একটু শান্তি পাই। আপনি কথা দিন ঠাকুর, মুক্তি দেবেন তাঁকে। ওই বোধ হয় তিনি এলেন বাইরে!”

বাইরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে কিছু একটা দেখিয়ে ওঙ্কারের শরীর ঝুরো ঝুরো মাটির মত খসে পড়ে যেতে লাগল। দ্রুত ক্ষয় হতে হতে বাতাসে মিশতে থাকা মুখটা বলে উঠল, “এটা রাখুন ঠাকুর। আপনার উপর আমার অনেক আশা… আজ সেই একই তিথি, একই যোগ… আপনি কথা দিন…”

ওঙ্কারের শরীর পঞ্চভূতে মিশে গেল। দরজার সামনে একটা ‘ঠক’ আওয়াজে সবাই তাকিয়ে দেখল, চাঁদের আলোয় চকচক করছে একখানি কালো সুতোয় বাঁধা কবচ।

*****

রণদার হাত থেকে গাঁজার ছিলিমটা ঠক করে পড়ে গেল। একবার খুক খুক করে কেশে সে বলে উঠল, “যা শালা! বাবামশাই! উয়া কে ছিল!” হরি পরামাণিককে দেখা যাচ্ছিল না, সে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন প্রকৃতির মানুষ। স্নায়ুর অধিক উত্তেজনায় হয়তো সে জ্ঞান হারিয়েছিল।

আঙুল মুখে ঠেকিয়ে শ্-শ্-শ্ আওয়াজ করে নিতাই ঠাকুর উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। নীচু হয়ে তুলে নিলেন পায়ের কাছে পড়ে থাকা কবচ। গুহ্যকালীর মন্দিরে তখন ঢং ঢং শব্দে ঘন্টা বাজছে। ঘন্টার আওয়াজ হাওয়ার স্রোতে বয়ে, ব্রাহ্মণী নদীর জলকণাদের আমূল কাঁপিয়ে শ্মশানে এসে পৌঁছাচ্ছিল। ঘুরপাক খেতে খেতে সে আওয়াজ শ্মশানের ধুলোমাটির উপর আছড়ে পড়ল। ধুলোর ঝড় উঠল একটা। চাঁদের নীলাভ জ্যোৎস্না তখন মরে গিয়ে ধূসর হতে শুরু করেছে। আকাশে চোখ মেললে চমক লাগে। বিশালাকার চাঁদ খুব কাছ থেকে পৃথিবীর উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। রুপোলি আলোর স্বপ্নময় পূর্ণেন্দু নয়, সে চাঁদের রঙ লালাভ। তার গোলচে পরিধি জুড়ে ঘন লাল রঙ জমাট বেঁধে ছিল, যেন জ্বরাক্রান্ত মানুষের অসুস্থ রক্তচক্ষু। পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ছিল। লালাভ চাঁদ খুব শিগগিরিই ঢেকে যাবে অন্ধকারে। কালো চাদরে মুড়ে যাবে পূর্ণিমা।

আকাশে ক্ষয়মান চাঁদকে দেখে চোখ বুজলেন নিতাই ঠাকুর। তারপর হাতে ধরা কবচটা তুলে গলায় পরে ইষ্ট স্মরণ করলেন। তাঁর মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছিল। করালবদনীর আয়ত চোখের মণিতে কী দেখবেন তিনি? ক্রোধ না ক্ষমা! আড়াইশ বছর ধরে যে সাধকের সাধনায় ভাটা পড়েনি তাঁর প্রতি এখনও কি তাঁর চোখ দিয়ে আগুন ঝরবে? আবারও বাধা পাবে প্রেতকর্ম?

শরীরের সব রোম অদ্ভুত আশঙ্কায় খাড়া হয়ে যায় তাঁর। নয়নপথ ধরে একখানি আলোর রেখা ভেসে আসে। দেবী রুষ্ট নন। মন্দিরে আবার ঘন্টা বাজে। চাঁদকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে পৃথিবীর ছায়া। নিকষ কালো অন্ধকারে হাজার দীপের মত জ্বলে ওঠে অসংখ্য জোনাকি।

রণদা পিছন থেকে ডাকে, “বাবাঠাকুর! ইটো হাওয়ায় উড়ি আসিছে।”

পিছন ফিরে নিতাই দেখেন রণদার হাতে ধরা কলাপাতায় মোড়া একখানি পিণ্ড। হাওয়াতে ভেসে আসলেও তার গোল আকারটি নিটোল রয়েছে এখনও। সেটি হাতে নিয়ে রণদাকে একটা হাঁক পাড়েন নিতাই ঠাকুর, “তণ্ডুলের ছাই ছিল না ঘরে! একটা মূর্তি গড় দেখি। পাঁচটা ঘটে জল ভরে পঞ্চমুন্ডীর আসনে নিয়ে আয়। আরও কটা পিণ্ড গড়তে হবে। হরিকে জাগা, আর হোমের ব্যবস্থা কর।”

পঞ্চমুণ্ডীর আসনে হোমের আগুন জ্বলে ওঠে। আঙুলে কুশ আর করপুটে ঘি নিয়ে হোমের আগুনে আহুতি দিতে দিতে নিতাই ঠাকুর স্পষ্ট কন্ঠে উচ্চারণ করে ওঠেন প্রেত আহ্বানের সঙ্কল্প।

॥বিষ্ণুরোম তৎসৎ অদ্য ভাদ্রমাসি শুক্লেপক্ষে চতুর্দশ্যান্তিথৌ প্রেতস্য ভৈরো দেবশর্মণঃ

দোষনাশার্থায় ঔর্ধ্বদেহ সম্প্রদানায় যোগ্যতাসিদ্ধ্যর্থঞ্চ নারায়ণ বলি করিষ্যামি॥

পিছনের বিশাল বড় গাছটার পাতায় পাতায় কাঁপন জাগে। শোঁ শোঁ হাওয়া ঘুরপাক খায় নিতাই ঠাকুরের চারিদিকে। পাখিরা ঘুম ভেঙে ডানা ঝাপটিয়ে ছেড়ে যায় গাছের ডাল। তাদের ডানা ঝাপটানোর আর আচমকা ঘুম ভাঙার আওয়াজ শান্ত হলে হোমের আগুনের অপর পাশে ফুটে ওঠে এক অবয়ব। রক্তাম্বর পরিহিত বিরাটদেহী পুরুষের ছায়া কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়। তাঁর চোখে ক্রোধ নেই,অসন্তোষ নেই, শুধু আছে অনন্ত অপেক্ষা। নিতাই ঠাকুরের কন্ঠ থামে না, একনাগাড়ে উচ্চারিত হয়,

॥ওঁ অদ্যা ভৈরো দেবশর্মণঃ প্রেতস্য নারায়ণবলিবিহিত সম্বৎসর শ্রাদ্ধে বিষ্ণোএষতে পিণ্ডায় নমঃ॥

ডান হাতে তিল আর চাল নিয়ে পিণ্ড অর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সব কটা রোম খাড়া হয়ে যায় নিতাই ঠাকুরের। একখানি রোমশ হাত কোথা থেকে এসে পিণ্ড গ্রহণ করে। তণ্ডুলের ছাই দিয়ে গড়া মূর্তিটা আগুনে ফেলেন নিতাই ঠাকুর। হোমের আগুনের শিখা অনেক ঊর্দ্ধে ওঠে। সেই সঙ্গে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জটাজুটধারী শরীরটায় আগুন লাগে দাউদাউ করে। পুড়তে থাকে শরীরটা। পোড়ে আর সবকটা অঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মিশতে থাকে বাতাসে।

ঠিক সেই সময় মুনে বাগদির ঘর থেকে একটি তীব্র কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। পার্বতীর তীক্ষ্ণ কান্না স্তিমিত হয়ে গেলে এক নবজাতকের গলার আওয়াজ শোনা যায়। গ্রহণের অন্ধকার কেটে ফের ধীরে ধীরে আলোয় ভরে ওঠে শ্মশান। মুনে বাগদী দৌড়াতে দৌড়াতে আসে নিতাই ঠাকুরের কাছে। কোলে তার সদ্যোজাত শিশু। তার চোখে জল চিক চিক করে।

সদ্যোজাতের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন নিতাই ঠাকুর। হঠাৎই শিশুটির শরীরের একটা অংশে চোখ পড়ে চমকে যান তিনি। বাঁ পায়ের গোছের কাছে জ্বলজ্বল করছে একখানি জন্মদাগ, ঠিক যেমনটি দেখেছিলেন কিছুক্ষণ আগেই এক অপরিচিতের পায়ে…

হরি পরামাণিক কাছেই দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে পিণ্ড ধরিয়ে জলে ভাসাতে বলেন নিতাই।

হরি তাঁকে ডেকে বলে, “একটা প্রশ্ন ছিল বাবামশাই! সে যে যাওয়ার সময় বলে গেল তার ডাক এসেছে, কোথা থেকে ডাক এসেছিল বাবামশাই?”

হরির দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসেন নিতাই। বলেন, “হয়তো এমন কোনও জগতে হরি, যেখানে মানুষে মানুষে সম্পর্কের আসল গিঁটটা আরও যত্ন নিয়ে বাঁধার সময় পাবে ও।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *