ওপাশে – অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ বিকেলের আকাশে জমে ওঠা স্লেট রঙের খণ্ড খণ্ড মেঘ চিরে বিদ্যুতের সরু রেখা আড়াআড়ি ঝলসে গেল। হঠাৎই এক অতীন্দ্রিয় ইশারায় শরীর—মনে রোমাঞ্চ খেলে গেল।
এই মেঘ, এই বিদ্যুৎ ছিল আমার ছেলেবেলায়। জ্ঞান হবার পরের কোনো বিকেলে আমি দেখেছিলাম ওই বিদ্যুৎশিখা। আর সেই বিকেলেই আমার ভিতর গর্ভ নিল এক রহস্যময় কৌতূহল।
অলৌকিকতার প্রতি তীব্র অনুসন্ধিৎসা জড়িয়ে আছে আমার ছেলেবেলার দিনগুলোয়। সেদিনের ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার মতো গাঢ় মেঘ, সেই আঁকাবাঁকা রেখায় ঠিকরে ওঠা নীল বিদ্যুৎ, আমার সমগ্র জীবনকে অমোঘ নিয়তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।
সেদিনের অলৌকিক শিহরন বালক বয়সে মাঝে মাঝেই টের পেতাম। আচমকা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। আর অন্যরকম হাতছানি।
সেই বয়সে আমি ছিলাম নির্জন, লাজুক, আনমনা একটি ছেলে। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। কেউ আমার সঙ্গে মিশতেও চাইত না। এক ঘোলাটে অন্যমনস্ক ঘোরের মধ্যেই আমি স্কুলে যেতাম, পড়তে বসতাম অথবা জীবনের স্বাভাবিক কাজগুলো করার চেষ্টা করতাম।
মনে পড়ে, হা হা দুপুরে স্কুলবাড়ির সেই অন্ধ ঘর, চোখের সামনে হিজিবিজি আঁকা ঝাপসা ব্ল্যাকবোর্ড; ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে বেলা—বয়ে—যাওয়া গুঁড়ো গুঁড়ো রোদ্দুর মেঝেয় ছিটিয়ে রয়েছে।
অনিলবাবু ভরাট গম্ভীর স্বরে পড়াচ্ছেন, সমস্ত ঘরে আলো—আঁধারি, আর আমি খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন জানলার বাইরে হারিয়ে গেছি। কোনো অচেনা আকর্ষণে পাগলের মতো উড়ে চলেছি।
সে বয়সে আমি বাবা—মা ও অন্যান্য চেনা—পরিজনের কাছে সবসময় গল্প শুনতে চাইতাম। নানারকম অলৌকিক ঘটনা ও অভিজ্ঞতার গল্প।
আর শুনতে শুনতে নিজেকে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ফেলে দিতাম। ভাবতাম এই অভিজ্ঞতাগুলো যদি আমার জীবনে হয়! তারপর মনে মনে হিসেব কষতাম, তখন আমি কী করব! এবং শুরু হত অসহায় প্রতীক্ষা! অজানা কিছু হবার!
এভাবেই এক রহস্যময় তাড়না ভিতরে লালন করে একসময় আমি কৈশোরে পৌঁছলাম। কৈশোরের দিনগুলো ছিল আরও বেদনাময়। কখনো কখনো উন্মাদের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কিসের এক অদ্ভুত যন্ত্রণা হত।
বিকেলের নরম আলো গায়ে মেখে খেয়াঘাটে গিয়ে বসে থাকতাম। নৌকোগুলো একে একে ছেড়ে যেত। ঘাট থেকে ছেড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে ছোটো হতে হতে একসময় গঙ্গার বুকে মিলিয়ে যেত। যতক্ষণ দৃশ্যমান থাকত ঝাপসা অন্ধকার জলে দুলত তার বাঁকাচোরা অদ্ভুত ছায়া।
কোনো একটা নৌকো চলে যাবার পরে আমি নিঃশব্দে অপেক্ষা করতাম ওপার থেকে আবার ফিরে আসার। মনের মধ্যে অচেনা বিস্ময় জাগত। মনে হত সবটাই পারাপারের খেলা।
সেই নিঃসঙ্গ কৈশোরে নানারকম শিরশিরে অনুভূতি হত।
সন্ধের পর একা ঘরে বসে পড়াশুনো করতাম।
ঘরের ভিতর টিউবের ফ্যাকাশে আলো, দরজার বাইরে প্যাসেজটা গাঢ় অন্ধকার, দরজার পর্দাটা অল্প অল্প দুলছে। হঠাৎ আমার কেমন গা—ছমছম করে উঠত। মনে হত, দরজার বাইরে ওই অন্ধকার অংশে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে কাঁপা হাতে পর্দা সরালেই, একটা দ্রুত অপস্রিয়মাণ ছায়া দেখতে পাব।
কখনো রাতে শুয়ে রয়েছি, হঠাৎই শরীরের সমস্ত চেতনা জড়ো হয়ে লাফিয়ে শিয়রের দিকে চলে গেল। আমি প্রবল ইন্দ্রিয়ময় হয়ে উঠলাম। মনে হতে লাগল, নির্ঘাত আমার মাথার পিছনে মশারির আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘাড় ঘোরালেই তাকে দেখতে পাব। বুক ধকধক করত। আমি নিশ্চিত হয়ে যেতাম, কেউ রয়েছে।
কিন্তু না! স্বাভাবিকভাবেই কিছু দেখতে পেতাম না।
শুধুই পর্দার আড়ালের শূন্য মায়া আর অন্ধকার মশারির ফাঁকা অবস্থিতি। আমি হতাশ হয়ে পড়তাম। শুধু ক্ষণে ক্ষণে গা ছমছম করত। কৌতূহলের পারদ চড়চড় করে বেড়ে উঠত।
আগ্রাসী কৌতূহল এবং হতাশা একসঙ্গে মিশে মনের ভিতরে প্রবল যন্ত্রণা হত। ধীরে ধীরে আমার বেঁচে থাকার অর্থ পালটে যাচ্ছিল। অসহনীয় এক যন্ত্রণা আমার অজ্ঞাতসারেই আমাকে আমূল বদলে দিতে লাগল। এইভাবেই আমি পা দিয়েছিলাম প্রথম যৌবনে। আর তখনই নিয়তি নির্দিষ্ট এক ঘটনা আমাকে যেন আয়ুর অন্তিমে এনে দাঁড় করাল।
আমার পাশের বাড়িতে একটি মেয়ে থাকত। বছর চব্বিশ—পঁচিশের। কালো হলেও, বেশ সুশ্রী চেহারা। একদিন সেই মেয়েটি আমার বাড়ির পেছনদিকের জংলা বাগানে বুড়ো অশ্বত্থগাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করল।
কী করে সে অত উঁচু ডালে ফাঁস বেঁধেছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না।
এই অশুভ ঘটনাটা আমার মনে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমি মাঝে মাজেই আমাদের বিশাল পুরোনো দোতলা বাড়িটার পেছনের জানলায় এসে দাঁড়াতাম। ওখান থেকে অশুভ ইঙ্গিতবাহী গাছটাকে দেখা যেত।
একদিন সন্ধের ঠিক আগে আমি জানলার সামনে দাঁড়ালাম। জানলার বাইরে ক্রমশ মুছে যাওয়া বিকেলের রং। বাগানের সীমান্তে ঝোপ—আগাছার ভিতর ঝাঁকড়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রৌঢ় গাছটা। ভীষণ জীবন্ত অথচ স্থবির! তার ঝুপসি ডালপালায় সদ্য জমে ওঠা থিকথিকে অন্ধকার।
অন্ধকারের সেই ঘন মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভিতর থেকে এক অলীক বোধ উঠে এল।
আমার মনে হতে লাগল, আমার আশেপাশেই একটা অন্য পৃথিবী রয়েছে। এই আলো—রোদ—হাওয়ার আড়ালেই স্থির রয়েছে সেই অন্য জগৎ। আমাদের নিশ্বাস নেওয়া এই বাতাসের সঙ্গেই হয়তো মিশে আছে।
জায়গাটা হয়তো নিরালম্ব, স্যাঁতসেঁতে আর ছায়াময়।
আমার মনে হল, আমাদের এই রোদ—বৃষ্টি—বাতাসের পৃথিবীর ভিতরে কোথাও একটা নিরাকার শূন্য দরজা আছে। সেই গোপন দরজা দিয়ে অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করা যায়।
আমার বিশ্বাস হল, দরজাটা আমার আশেপাশেই কোথাও আছে। অথচ আমি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি না।
বুকের মধ্যে এই বোধ জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি প্রায় পাগলের মতো হয়ে উঠলাম। অপার্থিব চিন্তাগুলো ভারী পাথরের মতো চেপে মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন ও নিষ্ক্রিয় করে দিল। আমি কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারছিলাম না।
এই বিচিত্র অনুভূতির পর আমি তিন—চার দিন ঘুমোতে পারিনি। এক অজানা কষ্ট হৃৎপিণ্ড পিষে দিচ্ছিল।
শেষপর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না। আগেই বলেছি, আমার কোনো বন্ধু ছিল না। এই যুবক বয়সে আমার দূরের বা কাছের একমাত্র বন্ধু ছিল শোভন।
শেষ শীতের এক নিঝুম সন্ধেয় আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে শোভনকে বলে ফেললাম আমার অদ্ভুত ভাবনার কথা। ভেবেছিলাম, ও প্রলাপ মনে করে ব্যঙ্গ করবে।
কিন্তু না! ও শুনে একটু থমকে গেল। খানিকক্ষণ কিছু চিন্তা করল। তারপর থেমে থেমে নির্লিপ্ত অথচ গভীরভাবে বলতে লাগল, ‘তুই বোধ হয় ঠিকই ভেবেছিস। বহুদিন আগে প্যারাসাইকোলজির ওপর লেখা একটা বই পড়েছিলাম। সেখানে মানুষের মনের অস্বাভাবিক ক্ষমতার কথা বলা ছিল। মেডিটেশন অর্থাৎ ধ্যানের সাহায্যে মনকে অস্বাভাবিক সূক্ষ্ম ও গতিশীল করে তোলা যায়। মনের প্রসারতা অসম্ভব বেড়ে যায়। স্মৃতিবাহী চেতনার উন্মেষ ঘটে। তখন সেই মনের মাধ্যমে মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পেতে পারে। এমনকী সেই মনের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃতিক লোকেও যাতায়াত করা সম্ভব।’
ও চুপ করে গেল। একটু দম নিল। সম্ভবত দীর্ঘশ্বাসও ফেলল। তারপর কয়েক সেকেন্ড পরে আবার বলল, ‘তা তোর যখন অ্যাতো কৌতূহল, তুই একবার চেষ্টা করে দ্যাখ না’…
শোভন চলে গেল। কিন্তু যাবার আগে সেই ভৌতিক চিন্তার পাথরটা মাথায় শক্ত করে গেঁথে দিয়ে গেল।
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। সেই রাত্রেই খাওয়া—দাওয়ার পর ধ্যানে বসে গেলাম। মাঝে মাঝেই নিজের ওপরে ক্ষোভ এবং হাসি আসছিল। একে অপরের মুখে শোনা কথা, তারপর এসবের কোনো স্পষ্ট প্রক্রিয়া জানি না। আমি কি অন্ধকারে বাঘ শিকার করতে চলেছি! এসব বিষয় কি আন্দাজে হাতড়ানো যায়। নিজের ছেলেমানুষিতে আমি নিজেই লজ্জা পেতে লাগলাম।
তবু আমি বসে ছিলাম। ঘরের দরজা—জানলা আঁট করে বন্ধ করে, টিউব—বাতি নিভিয়ে, জিরো পাওয়ারের একটা চাপা নীল আলো জ্বেলে দিলাম।
সমস্ত ঘরে এখন অদ্ভুত ফ্যাকাশে নীলাভ অন্ধকার। আমি বিছানার ওপর শিরদাঁড়া সোজা করে ধ্যানের আসনে বসলাম। দুই চোখ বন্ধ করে মনকে একটা কাল্পনিক আলোকবিন্দুতে স্থির করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
প্রথম দিন বিক্ষিপ্ত—অশান্তভাবে বোধহয় ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করেছিলাম। আমি কিন্তু চেষ্টা ছাড়লাম না। প্রতিদিন রাত্রে ধ্যানে বসতাম। সমস্ত মানসিক শক্তি একত্র করে চেষ্টা করতাম বিন্দুর মধ্যে স্থির হয়ে যেতে।
এইভাবে কয়েকদিন চেষ্টা করার পর মন ক্রমে শান্ত হয়ে এল। একসময় আমি লক্ষ করলাম, মনটাকে বাধ্য ঘুড়ির মতো যে—কোনো চিন্তায় ছুড়ে দিয়েই আবার টেনে আনতে পারছি।
বুঝতে পারলাম, আর কিছু না হোক, আমি ধ্যানের মাধ্যমে নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে পারছি। এবার আমি ধ্যানে বসে বিন্দুতে স্থিত হবার পরে মনকে শূন্যে যতদূর পারি এলোমেলো ছুড়ে দিতে লাগলাম। ডুবন্ত মানুষ যেমন অসহায়ভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায়, অনেকটা তেমনভাবে মনকে হাওয়ায় ভাসিয়ে আমি যেখানে—সেখানে নিয়ে যেতে লাগলাম। দিকচিহ্নহীন হয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরের শূন্যতাকে ছুঁতে চাইতাম। মনকে পাক দিয়ে দিয়ে নানানভাবে শূন্যে ছেড়ে দিতাম। মনের সঙ্গে তখন এ এক অদ্ভুত খেলা।
এই পদ্ধতিতে বেশ কিছুদিন অন্ধ প্রয়াসের পরে, একদিন সকালে অনুভব করলাম আমার মন আশ্চর্যরকম শান্ত কিন্তু অসম্ভব গতিশীল হয়ে গেছে। মন যেন সর্বদা চলন্ত ট্রেনের কামরার মতো স্থির থেকেও মৃদু মৃদু দুলছে।
আর সেইদিন রাতেই এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা হল। রোজকার মতো ধ্যানে বসে মনকে শূন্যে ভাসিয়ে আঁকুপাঁকু হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম। ধ্যানে সময়জ্ঞান থাকে না। চোখের পাতাও বন্ধ থাকে।
তাও আন্দাজ বিশ—পঁচিশ মিনিট পরে, মনের ভিতর খানিকটা দূরে একটা কালো ফুটকির মতো চোখে পড়ল। এ আমার সেই কল্পিত আলোকবিন্দু নয়। এই বিন্দুর স্পষ্ট উপস্থিতি রয়েছে। মনের ভিতরের অন্ধকারের চেয়েও আরও অন্ধকার এই বিন্দুটা। অল্প অল্প নড়ছে বলেও মনে হল।
ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বিন্দুটা সাঁ—সাঁ করে পতঙ্গের মতো আমার দিকে ধেয়ে আসতে লাগল। খুব দ্রুত আমার কপালের কাছে এগিয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম সেটা বিন্দু নয়, একটা বড়োসড়ো কালো গোলক, বা, বলা ভালো, কালচে অন্ধকার বৃত্ত।
আমি বিচলিত হয়ে উঠে চোখ খোলার আগেই সেটা আমার কপালের ভিতর দিয়ে ঢুকে শরীরের নীচের দিকে নেমে গেল।
আর সঙ্গে সঙ্গে আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মতো থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। মাথার ভিতরকার স্নায়ুতন্ত্রে অসহনীয় বিক্ষেপ। মনে হতে লাগল, আমার সমস্ত স্নায়ুকে কেউ যেন আঙুলে পাকিয়ে চুল ছেঁড়ার মতো ছিঁড়ছে। সারা শরীরে অশান্ত সমুদ্রের উথালপাথাল। ওই আধো—অচেতন অবস্থাতেই মনে হল, আমার হাত—পাগুলো যেন কোনো অর্কিডের শাখাপ্রশাখা হয়ে গেছে। সমস্ত গায়ে কাঁটা—বেঁধা জ্বালা।
ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরতে মৃগী রোগীর মতো বিছানায় উঠে বসলাম। সারা মাথায় আগুনের জ্বলন, বুকের গভীরে ছলছলিয়ে উঠছে, ভয়, আর চেতনায় গতরাত্রের বিভীষিকা।
সেদিনই দুপুরের পরে কিন্তু শারীরিক—স্নায়বিক কষ্টগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। তবু এক দুঃসহ আতঙ্কে আমি আর ধ্যানে বসতাম না। মনকে এসব ভূতুড়ে চিন্তার আঠা ছাড়িয়ে অন্য দিকে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কিছুদিন পরে ধীরে ধীরে সেই কালরাত্রির ক্ষত মন থেকে প্রায় মুছে গেলেও, সবকিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারল না। কোথাও একটা অজানা অসংগতি থেকে গেল।
তখনও জানি না, হাইওয়ে ধরে হাওয়ার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সহসা একটা বাঁকের সামনে এসে পড়লে লরি যেমন থমকে যায়…আমার জীবনটাও তেমনি এক অদেখা বাঁকের মুখে এসে থেমে গেছে।
ওই যে বললাম, কোথাও কিছু একটা রয়ে গেল! আমি হঠাৎ হঠাৎ ভয় পেতে শুরু করলাম। শিউরে শিউরে উঠতাম। গায়ে রোঁয়া দিয়ে উঠত। এ সেই ছেলেবেলার গা—ছমছমে অনুভূতি নয়, তার চেয়েও অনেক অ—নে—ক তীব্র। মনে হত সমগ্র অস্তিত্বই যেন ভয়ের তাড়সে ঘুলিয়ে উঠছে। আচমকা ইন্দ্রিয়গুলো তীক্ষ্ন ও সতর্ক হয়ে যেত। যেন এখনই কিছু ঘটবে। আমি অসম্ভব স্পর্শকাতর হয়ে উঠছিলাম।
একেকদিন রাতে শোয়ার পর মনে হত, আমার প্রকাণ্ড বাড়ির সমস্ত অংশ, আনাচকানাচ থেকে অগুন্তি ছায়া—ছায়া অন্ধকার মানুষ বিছানার চারপাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
তারা যেন আকুল চেষ্টায় আমাকে ছুঁতে চাইছে। জাগিয়ে দিতে চাইছে। অথচ পারছে না।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে সন্ত্রস্তভাবে শুয়ে থাকতাম। তারপর এক লাফে উঠে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিতাম। বাকি রাতটুকু আর ঘুম হত না।
এইরকম অস্বস্তিকর যাপনের মধ্যেই একদিন একটা তুচ্ছ ব্যাপার ঘটে গেল।
আমাদের ওয়াশ বেসিনটা লাগানো আছে বাথরুমের ঠিক ডানপাশের দেওয়ালে। সেদিন সন্ধে নাগাদ বাথরুমের দরজার কাছে এসে দেখি, বেসিনের কলটা খোলা রয়েছে। একটানা জল বেরিয়ে বেসিনের গর্তে পড়ছে।
আমি কলের মাথাটা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিলাম। তারপর বাথরুম সেরে ভিতরের ঘরে চলে গিয়েছি।
রাতের খাওয়া সেরে হাত—মুখ ধোবার জন্য বেসিনের সামনে ফের আসতেই দেখি, কলটা আবার খোলা রয়েছে। আমি প্রথমেই কলটা বন্ধ করে দিলাম।
এসব তুচ্ছ ব্যাপারগুলো মানুষ মনের ভুল মনে করে ভুলে যায়। আমি কিন্তু উড়িয়ে না দিয়ে বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। এবং দৃঢ় সিদ্ধান্তে এলাম, যে এক্ষেত্রে আমার মন কখনোই ভুল করেনি। আমি নিশ্চিত কলটা আগে বন্ধ করে গেছি। তৎসত্ত্বেও সেটা খুলে গেছে!
এমনকী পরের দিন সকালে বাথরুমে যাবার সময়ও দেখি এক ব্যাপার। বেসিনের কল সেই খোলা রয়েছে। তার মুখ বেয়ে লম্বা মোটা ধারায় নির্বোধের মতো গড়িয়ে পড়ছে জল।
খুবই নগণ্য ঘটনা। কিন্তু আমার মনের দেওয়ালে তা গূঢ় ছোপের মতো লেগে রইল।
এরপর আরও কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল একইরকম নীরব অস্বস্তির মধ্যে। মনের গভীরে সেই সামান্য রেশ রয়ে গেছে, তখনই এক দুপুরবেলা….।
ডাইনিং—টেবিলে খাবারের প্লেট, জলের গেলাস সব সাজানো। অন্যমনস্কভাবে দুপুরের খাওয়া সারছিলাম। খাওয়া তখন শেষের দিকে। চেয়ারে বসে জলের গ্লাসটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই মুহূর্তের মধ্যে, আমার চোখে সামনে, গ্লাসটা আমার হাতের নাগাল থেকে সরসর করে সরে কিছুটা দূরে টেবিলের প্রায় শেষপ্রান্তে গিয়ে থামল।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সমস্ত শিরা—স্নায়ু ফেটে শরীরের ভেতর জড়িয়ে যাচ্ছিল। বরফ জমা ত্রাস। আমার চেতনায় চেনা—চেনা অথচ অস্পষ্ট একটা আশঙ্কা বেজে উঠল। অকস্মাৎ কুয়াশার মতো ফেনিয়ে উঠল বিশ্বাস।
আমার মনে হল, ওপাশে যাবার সেই অদৃশ্য গোপন দরজা কখন যেন খুলে গেছে। আমি জানতে পারিনি। আর খোলা দরজার ভিতর দিয়ে দুই পৃথিবী একাকার হয়ে গেছে। আমি নিজের অজান্তেই লৌকিক জগতের আড়ালের অলৌকিকতায় প্রবেশ করেছি।
এই বোধ জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল ভয়ের মধ্যেও এক নিষ্ঠুর আনন্দ অনুভব করলাম।
এরপরে ঠিক কতগুলো দিন কেটে গেল, তা আর সঠিক মনে নেই। তবে আমার সমস্ত পাজলটাই পিকচার পাজলের ঘুঁটির মতো এলোমেলো হয়ে গেল।
আমার মনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াগুলোই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। আমি দিন দিন বোধশূন্য ও জড় হয়ে উঠতে লাগলাম। তেমন করে ভয়ও আর পেতাম না।
এরপর একদিন যা হল, তাকে বলা যায়, আমার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতালব্ধ নাটকীয় ঘটনাচিত্রের ওপর চূড়ান্ত তুলির টান।
সেদিনটা বৈশাখের মাঝামাঝি। সন্ধের আকাশে মেঘ জমলেও শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। তাই বুকচাপা গুমোট।
রাত্রির মাঝ বরাবর মাথায় আলতো যন্ত্রণার মধ্যে আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই, শুনতে পেলাম পাশের ঘরে খটখট…খটখট…খটখট …একটানা অদ্ভুত একটা শব্দ। চাপা অথচ স্পষ্ট।
সামান্য পরেই বুঝতে পারলাম, শব্দটা স্থির নয়। সেটা ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে সরে সরে যাচ্ছে এবং ক্রমশ জায়গা বদল করছে।
তীব্র রহস্যময় কৌতূহলে আচ্ছন্নভাবে আমি নিঃশব্দে পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজায় উঁকি দিয়েই চিনতে পারলাম বিচিত্র শব্দের উৎসটিকে।
পুরোনো কাঠের দেওয়াল আলমারিটা জীবন্ত প্রাণীর মতো সমস্ত ঘরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার কাঠের চারটে পা অসমানভাবে মেঝের সঙ্গে ঠুকে শব্দ উঠছে খটখট…খটখট…।
না, ভয় পাইনি। শুধু নেশাগ্রস্তের মতো শরীরটাকে কোনোমতে টানতে টানতে নিজের ঘরে বিছানায় এনে ছুড়ে দিয়েছি।
গড়িয়ে গিয়েছি চেতনাহীনতার অতল অনন্ত খাদের গহনে…।
এখন আমি এক অন্য পৃথিবীতে দিন কাটাচ্ছি। না, দিন না, সময়। কিংবা হয়তো সময়ও না। কেননা, এখানে সময়ের কোনো বোধই নেই। কখনো শুধুই দিন। নিরন্তর রোদ, আলো। কখনো একঘেয়ে নির্দয় রাত্রি। মৃত্যুকূপের ঠাসবুনোট অন্ধকার।
আমি যেখানে রয়েছি, সেখানের কোনো কিছুই ঠিক আমাদের পৃথিবীর নিয়মে বাঁধা নয়। অথচ জায়গাটা পুরোপুরি লৌকিক পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এখানের কিছুই পার্থিব রীতি অনুযায়ী হয় না। আমি শুধু শুয়ে থাকি। ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানটা একটু একটু করে নীচে নামতে নামতে মাথার খুব কাছে চলে আসে। কখনো ঘরের দেওয়ালগুলো ভরে যায় অদ্ভুত সব কালো কালো মাকড়সায়। আবার মিলিয়ে যায়…..। আসবাবপত্রগুলো ইচ্ছেমতো এদিক—ওদিক নেচে বেড়ায়…।
এখানে ব্রণ—ওঠা দেওয়ালের বিবর্ণ আত্মায় পাপের মতো থোকা থোকা ঝুল জমে। সমস্ত ঘরের দেহে অসম্ভব পুরু ধুলোর পোঁচ। বাতাসের স্তরে স্তরে ভেসে বেড়ায় গাঢ় ধুলোর বিষ।
খিদে তেষ্টা ঘুম কিছুই আসে না।
আজকাল আমার ভিতর থেকে সরু হিলহিলে এক ‘আমি’ উঠে বসে; কিচেনে গিয়ে গ্যাসের নব ঘোরায়, চা তৈরি করে। বন্ধ বাথরুমে স্নান করতে করতে হেঁড়ে গলায় গান ধরে। কখনো ভরপেট খাওয়ার শেষে শব্দ করে ঢেঁকুর তোলে….
আমি একটা ঠান্ডা, সাদা মর্গের মতো বিছানায় শুয়ে থাকি।