১২. ওপরে তাকাও, চিন্তায় বড় হও
ছেলেবেলায় শেখা কঠিন সত্যগুলোর মধ্যে একটা ছিল এ রকম, তুমি আসলে এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নও। আমার পঞ্চম জন্মদিনের কথা এখনো মনে আছে। আমার মা দোকান থেকে বাসায় ফিরে একটা কেকের মাঝখানে একটা মোমবাতি গুঁজে দিলেন। মোমবাতিটার আকৃতি ছিল ৫ সংখ্যার মতো। তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। ভাবলাম, তার মানে, দোকানের লোকজনও জানে, আজ আমার বয়স পাঁচ বছর হতে যাচ্ছে! তারা শুধু আমার জন্য এই মোমবাতি বানিয়েছে এবং তা রেখেও দিয়েছিল।
আমি অনেকটা এ রকমই ভেবে বসেছিলাম। আমার মাথায় কখনো আসেনি যে বিশ্বের অন্য শিশুরাও পাঁচ বছরে পা দিয়েছে কিংবা শিগগিরই পা দেবে। কাজেই ও রকম মোমবাতি দোকানে অনেক ছিল। তাহলে নক্ষত্র আর ছায়াপথের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
অ্যাস্ট্রোফিজিকস আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্ৰ নই।
আরও শেখায়, আমাদের মহাবিশ্বটা হয়তো একমাত্র মহাবিশ্ব নয়। এটা আমাদের একটা মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি শেখায়।
কিন্তু এভাবে কে ভাবতে পারে? এই মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কে জীবন উদযাপন করার সুযোগ পায়? নিশ্চয়ই তাঁরা কৃষিশ্রমিক নন, যাঁদের শুধু নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করার জন্য এক কাজ থেকে আরেকটা কাজের পেছনে অবিরাম ছুটে যেতে হয়, সেসব কৃষকরা তো এটা পারেন না। কারখানার শ্রমিকরাও পারেন না, যাঁরা অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ করেন। আবার নিঃসন্দেহে কোনো গৃহহীন মানুষও নন তাঁরা, সামান্য একমুঠো খাবারের খোঁজে যাঁদের নোংরা আবর্জনা ঘাঁটতে হয়। আসলে এসব করার জন্য আয়েশি সময়ের দরকার। শুধু বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পেছনে সময় ব্যয় করে এসব করা সম্ভব নয়। কিংবা সে জন্য তোমাকে তরুণ হতে হবে। যথেষ্ট আরামদায়ক অবস্থার দরকার হবে, যাতে তোমাকে খাদ্য কিংবা নিরাপত্তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে না হয়। সেই সঙ্গে প্রিয় অ্যাপস বা টেক্সট মেসেজ কিংবা নেটফ্লিক্সের সর্বশেষ সিরিজ থেকে চোখ সরিয়ে বাইরের আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকানোর ইচ্ছা থাকতে হবে।
তারপরও মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গোপন এক মূল্য দিতে হয়। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় দ্রুতগতিসম্পন্ন চাঁদের ছায়ার পেছনে কয়েকটি মুহূর্ত কাটানোর জন্য আমি যখন হাজারো মাইল ভ্রমণ করি তখন মাঝে মাঝে পৃথিবী আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। আমাদের প্রসারণশীল মহাবিশ্ব সম্পর্কে যখন ভাবি, মহাবিশ্বের চারমাত্রিক স্থান ও কালের চাদরের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ছায়াপথগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখন মাঝেমধ্যে আমি ভুলে যাই যে অসংখ্য মানুষ এই পৃথিবীতে খাদ্যহীন, আশ্রয়হীনভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর এদের মধ্যে তোমাদের মতো শিশুদের সংখ্যাও অনেক।
গ্রহাণুদের, ধূমকেতুর ও গ্রহদের প্রতিটিই মহাকর্ষের পরিচালনায় মহাজাগতিক ব্যালে ড্যান্সার। আমি যখন গ্রহাণুদের, ধূমকেতুর ও গ্রহদের কক্ষপথ অনুসরণ করি, তখন প্রায়ই ভুলে যাই, অনেক মানুষই দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর ও ভূমির নাজুক পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে স্বীকার করে না।
আবার মাঝেমধ্যে আমি ভুলে যাই, যারা নিজেরা চলতে-ফিরতে পারে না, তাদের ক্ষমতাবান মানুষেরা সহায়তা করতে পারলেও সেটি প্রায় বিরল একটি ঘটনা। মাঝেমধ্যে আমি এসব কথা ভুলে যাই। কারণ, এই বিশ্ব আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মনে এবং আমাদের বেঢপ আকৃতির ডিজিটাল মানচিত্রে যত বড় হোক না কেন, মহাবিশ্ব তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। অনেকের কাছে এটা হয়তো হতাশাজনক ভাবনা, কিন্তু আমার জন্য সেটা মুক্তির।
আমি নিশ্চিত, বয়স্করা তোমাকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা করেন। তাঁরা বলেন, তোমার সমস্যাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো তাঁরা তোমাকে মনে করিয়ে দেন যে বিশ্ব তোমাকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। কিন্তু ওই কথাটা আমাদের বড়দের নিজেদেরও বলা উচিত।
এখন এমন একটি বিশ্বের কথা কল্পনা করো যেখানে সবাই, বিশেষ করে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মানুষেরা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থানের কথা ভাবে। এতে আমাদের সমস্যাগুলো এমনভাবে কমে যাবে যে সেগুলো আর কখনো হয়তো দেখাই যাবে না। তাতে আমরা নিজেদের ছোট ছোট পার্থিব বিভিন্নতার জন্য যুদ্ধ ও তর্কবিতর্ক নয়, বরং সেগুলোকে উদযাপন করতে পারব।
*
নিউইয়র্ক শহরে ২০০০ সালের জানুয়ারিতে নতুনভাবে পুনর্নির্মাণ করা হেইডেন প্লানেটারিয়ামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য স্পেস শো দেখানো হয়েছিল। সেটার শিরোনাম ছিল ‘পাসপোর্ট টু দ্য ইউনিভার্স’। এতে প্লানেটারিয়াম থেকে দর্শকদের ভার্চুয়ালি খাড়াভাবে শূন্য উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মহাবিশ্বের কিনারা ছাড়িয়ে আরও দূরে। চলতি পথে দর্শকেরা পালাক্রমে পৃথিবী দেখতে পান, তারপর আমাদের সৌরজগৎ, পরে দেখেছিলেন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কয়েক শ বিলিয়ন নক্ষত্র। ছোট হতে হতে মহাকাশের এসব বস্তু একসময় প্লানেটারিয়ামের গম্বুজে প্রায় অদৃশ্য কিছু বিন্দুতে পরিণত হয়।
প্লানেটারিয়াম উদ্বোধনের এক মাসের মধ্যে এক অধ্যাপকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম আমি। যেসব জিনিসে মানুষের মধ্যে তুচ্ছতার অনুভূতি জন্মায়, তিনি সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কেউ যে এমন কোনো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, তা আমার জানা ছিল না। তিনি চাচ্ছিলেন, ওই স্পেস শোর আগে ও পরে দর্শকদের মধ্যে এখানকার প্রশাসন যেন একটা জরিপ চালায়। জরিপের উদ্দেশ্য, যাতে প্রদর্শনীটি দেখার পর তাদের বিষাদের গভীরতা বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘পাসপোর্ট টু দ্য ইউনিভার্স’ দেখে তাঁর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে।
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? প্রতিবার এই স্পেস শোটা দেখার পর (এবং আমাদের বানানো অন্যগুলোও যখন দেখি), আমার জীবন্ত আর উচ্ছ্বসিত ও ঐক্যবোধের এক অনুভূতি জন্মায়। একই সঙ্গে তিন পাউন্ডের মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে আমরা মহাবিশ্বে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছি, সেটা জেনে আমার মধ্যে জন্ম নেয় একধরনের বিশালত্বের অনুভূতি।
আমি বলতে চাই, আমি নই, বরং সেই অধ্যাপকই প্রকৃতিকে ভুলভাবে পড়ছেন। শুরু থেকেই তাঁর অহংবোধ অযৌক্তিকভাবে অনেক বেশি। তাঁর এ রকম ভাবনার পেছনে আছে এই ধারণা—মহাবিশ্বে মানবজাতি সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সহকর্মীদের প্রতি সব রকম বিনয়ের সঙ্গে বলছি, সমাজের শক্তিশালী দলগুলোই আমাদের অধিকাংশকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আমি নিজেও একসময় এভাবে ভাবতাম। কিন্তু সে ভাবনা বদলে গিয়েছিল বায়োলজি ক্লাসে এসে। সেখানে শিখেছিলাম, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতসংখ্যক মানুষ এসেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি অতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থাকে ও কাজ করে আমার দেহে ছোট্ট একটা অংশে। এ ধরনের তথ্য আপনাকে অনন্ত দুবার ভাবাবে যে কে বা কী আসলে দায়িত্বে রয়েছে।
আমি জানি তুমি কী ভাবছ : আমরা ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে স্মার্ট |
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দৌড়াতে পারা, হামাগুড়ি দিতে পারা কিংবা পিছলে যেতে সক্ষম যেকোনো জীবিত জীবজন্তুর চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। কিন্তু ঠিক কতটা স্মার্ট? আমরা খাবার রান্না করে খাই। কবিতা ও গান রচনা করি। শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চা করি। গণিতেও আমরা বেশ ভালো। তুমি যদি গণিতে খারাপও হও, তারপরও সবচেয়ে স্মার্ট শিম্পাঞ্জির চেয়েও তুমি অনেক ভালো। একটি শিম্পাঞ্জি অনেক বড় ভাগ অংক করতে পারে না।
কিন্তু মহাজাগতিক দৃষ্টিতে আমরা হয়তো স্মার্ট নই। এমন কোনো জীবের কথা কল্পনা করো, যাদের চিন্তা করার ক্ষমতার সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে আমাদেরটা হবে শিম্পাঞ্জির মতো। এ ধরনের একটি প্রজাতির কাছে আমাদের সর্বোচ্চ মানসিক দক্ষতাও খুব তুচ্ছ বলে মনে হবে। তাদের বাচ্চাকাচ্চারা হয়তো সিসিমপুরে এবিসি শেখার বদলে কলেজ লেভেলের গণিত শিখবে। এলিয়েনদের প্রিস্কুল থেকে মাত্রই বাসায় ফেরা ছোট্ট টিমির চেয়ে আইনস্টাইন হয়তো মোটেও স্মার্ট ছিলেন না।
শিম্পাঞ্জির সঙ্গে আমাদের জিনের পার্থক্য যৎসামান্য। জিন হলো এমন এক ধরনের কোড, যা মানবশিশুকে বাড়ার সময় পূর্ণবয়স্ক হিসেবে রূপান্তরিত করে। হ্যাঁ, আমরা কিছুটা বেশি স্মার্ট। কিন্তু আমরা আসলে বাকি প্রকৃতির মধ্যে সাধারণ এক প্রজাতি, যাদের অবস্থান এর ওপরে বা নিচে নয়, বরং এর ভেতরেই। আমরা কী দিয়ে তৈরি, জানতে চাও? মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আবারও এমন একটি বড় উত্তর দেয়, যা হয়তো তুমি ভাবতেও পারবে না। মহাবিশ্বের রাসায়নিক উপাদানগুলো উচ্চ ভরের নক্ষত্রগুলোর চুল্লির আগুনে তৈরি হয়। সেগুলো তৈরি হয় একটা বিপুল বিস্ফোরণে নক্ষত্রগুলোর জীবন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এভাবে নক্ষত্রগুলো তাদের পোষক বা মাতৃ ছায়াপথকে তারা জীবনের রাসায়নিক ভান্ডারে সমৃদ্ধ করে। আর এর ফলাফল? মহাবিশ্বের চারটি সাধারণ ও রাসায়নিকভাবে সক্রিয় মৌল—অর্থাৎ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ও নাইট্রোজেন। এগুলোই আবার পৃথিবীর জীবনের জন্য চারটি সবচেয়ে সাধারণ মৌল। এই মহাবিশ্বে আমরা শুধু সাদামাটাভাবে বাস করি না।
মহাবিশ্বও আমাদের ভেতরে বাস করে। বলা হয়ে থাকে, আমরা সম্ভবত এই পৃথিবীর কেউ নই। বিজ্ঞানীরা এমন সব তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন, যা তাঁদের—আমরা কে আর আমরা কোথা থেকে এসেছি—সে সম্পর্কে আমরা যা ভাবি, তা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
প্রথমত, আমরা আগেই দেখেছি, বড়সড় কোনো গ্রহাণু একটি গ্রহে আঘাত হানলে সেই সংঘর্ষের শক্তির কারণে চারপাশের এলাকা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে উঠতে পারে। সেখান থেকে মহাকাশে পাথর নিক্ষিপ্ত হতে পারে। তোমার বিছানায় ছোট একটা খেলনা ছুড়ে দিলে, সেটা যেমন লাফ দিয়ে ছিটকে ম্যাট্রেসে পড়ে যায়, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। তোমার প্রভাব থেকে আসা শক্তি খেলনাটাকে বাতাসে লাফ দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। একইভাবে গ্রহাণুরাও এত বেশি শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আঘাত করতে পারে যে গ্রহটার পৃষ্ঠ থেকে পাথর ছিটকে মহাকাশে চলে যেতে পারে। তারপর এই পাথরগুলো মহাকাশে চলতে চলতে অন্য আরেকটি গ্রহের পৃষ্ঠতলে নেমে আসতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জীবনের ক্ষুদ্র রূপ বা অণুজীবেরাও কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। মহাকাশ ভ্রমণের সময় বৈরী তাপমাত্রা চাপ ও বিকিরণ সহ্য করতে পারে তারা। এই গ্রহাণুর সংঘর্ষে এমন পাথুরে উৎক্ষেপণ যদি জীবসম্পন্ন কোনো গ্রহে সংঘটিত হয়, তাহলে আণুবীক্ষণিক জীবগুলো ওই পাথরের খাঁজে ও ছোট ছোট ফাটলের মধ্যে নিরাপদে টিকে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, সম্প্রতি প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আমাদের সৌরজগৎ গঠনের কিছু সময় পর মঙ্গল গ্রহ আর্দ্র ছিল। এমনকি সম্ভবত জীবনের টিকে থাকার উপযোগীও ছিল গ্রহটা। একত্র করা এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের জানায়, মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সূচনা হওয়া সম্ভব। পরে সেখান থেকে কোনো পাথরে ভর করে পৃথিবীতে প্রাণের বীজ বপন হয়েছিল। কাজেই কে জানে, সব পৃথিবীবাসী ‘হয়তো’ মঙ্গলবাসীদের বংশধর।
*
শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে মহাজাগতিক আবিষ্কারগুলো আমাদের নিজস্ব ভাবমূর্তির নিচে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা একসময় ভাবতাম, এই মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবী অনন্য। এরপর একসময় জ্যোতির্বিদেরা জানলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণমান অন্যান্য গ্রহের মতোই সাধারণ একটা গ্রহমাত্র। ঠিক আছে, কিন্তু এরপর আমরা ভাবতে শুরু করলাম, মহাকাশে সূর্য হচ্ছে অনন্য এক বস্তু। একসময় আমরা জানতে পারলাম, রাতের আকাশের অগণিত নক্ষত্রের মধ্যে সূর্যও সাধারণ একটা নক্ষত্রমাত্র।
বেশ। কিন্তু তারপর আমরা অনুমান করে বসলাম, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পুরো মহাবিশ্বে অনন্য।
কিন্তু না। একসময় আমরা প্রমাণ করলাম, রাতের আকাশে অগণিত ঝাপসা আলোগুলো মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ, যা আমাদের জানা মহাবিশ্বের পটভূমিতে বিন্দু বা ফুটকির মতো দেখায়।
এখন কত সহজে অনুমান করা যায়, এই সব মিলিয়ে একটাই মহাবিশ্ব। যদিও আধুনিককালে উদ্ভূত কিছু বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব আরও কিছু সম্ভাবনার কথা বলে। এ ধারণামতে, আমাদের মহাবিশ্ব হলো, অনেক মহাবিশ্বের মধ্যে মাত্র একটা। অর্থাৎ অনেক বড় কোনো মাল্টিভার্সের মধ্যে একটা সামান্য অংশমাত্র।
*
মহাবিশ্ব সম্পর্কে মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি বেরিয়ে আসে মৌলিক জ্ঞান থেকে। এখানে তুমি কতটুকু জানো, সেটাই শেষ কথা নয়। মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থানের মূল্য নির্ধারণে সেই জ্ঞান প্রয়োগের জন্য লাগে বিচক্ষণতা ও অন্তজ্ঞানও। এর স্বাভাবিক ধর্ম পরিষ্কার :
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের অগ্রগতির শেষ সীমা থেকে আসে। অবশ্য এটি এককভাবে শুধু বিজ্ঞানীদের সম্পদ নয়। এর অধিকার সবার।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিনীত।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আধ্যাত্মিক, তবে তা ধর্মীয় নয়।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ছোট ও বড়কে উপলব্ধি করতে শেখায়। আমাদের উপলব্ধি করতে শেখায়, মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল অতিক্ষুদ্র একটা সময়ে। এই বাক্যটি শেষ হতে যতটুকু সময় লাগে, তার চেয়েও ছোট ছিল সেই সময়টি। কিন্তু সেই মহাবিশ্ব এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু বিলিয়ন আলোকবর্ষজুড়ে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি অসাধারণ ধারণার দিকে আমাদের মন খুলে দেয়। তবে সেগুলো আমাদের মস্তিষ্ককে এমনভাবে খুলে দেয় না, যাতে আমাদের মস্তিষ্ক বিবশ, নির্বোধ হয়ে পড়ে এবং যা বলা হয়, তাই বিশ্বাস করে ফেলে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই মহাবিশ্বের দিকে আমাদের চোখ খুলে দেয়। তবে আমাদের চোখ মহাবিশ্বকে যত্নের সঙ্গে প্ৰাণ ধারণকারী এক শক্তি হিসেবে দেখে না। দেখে, একটি শীতল, নিঃসঙ্গ ও ভয়ংকর জায়গা হিসেবে, যা অপরিসীম শূন্যতা ও বিপদ সৃষ্টিকারী সব রকম বস্তুর মাধ্যমে নিমেষেই জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এটা আমাদের সব মানুষের মূল্য ও গুরুত্ব বুঝতে সহায়তা করে। এমনকি আমাদের বিরক্তিকর ভাইবোন বা নিপীড়নকারী সহপাঠীর মূল্য ও গুরুত্ব বুঝতে শেখায়।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীকে একটি নীল বিন্দু হিসেবে দেখায়। যেটি বিশাল মহাকাশের ভেতরে দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এই বিন্দুটি অতিমূল্যবান। কারণ, এ মুহূর্তে এটাই আমাদের একমাত্র আবাসস্থল। এটা আমাদের বিরল ও আনন্দদায়ক গ্রহটিকে যত্ন নিতে উৎসাহিত করে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহ, চাঁদ, নক্ষত্র ও নেবুলার ছবিতে সৌন্দর্য খুঁজে পায়। সেই সঙ্গে মহাকর্ষ এবং অন্য যেসব সর্বজনীন সূত্র তাদের পরিচালনা করে, তাদের তারিফও করে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পারিপার্শ্বিকতার চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরে দেখার সক্ষমতা দেয়। আমাদের বুঝতে শেখায়, জীবন আসলে অর্থ, জনপ্রিয়তা, পোশাক, খেলাধুলা কিংবা ক্লাসের গ্রেডের চেয়েও আরও বেশি কিছু।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মহাকাশ অনুসন্ধান কোনো প্রতিযোগিতার বিষয় হওয়া উচিত নয়। বিভিন্ন দেশের পরস্পরের বিরুদ্ধে পরবর্তী বড় অর্জন নিয়ে প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। বরং মহাজাগতিক অনুসন্ধান হলো, সব জাতি একসঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার খোঁজ করবে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জানায়, জীবনের সব রূপ বিরল। আবার আমরা অতীতে যা ভাবতাম, তার চেয়েও পৃথিবীর অন্যান্য ধরনের জীবসত্তার সঙ্গে আমাদের অনেক মিল রয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হবে, এমন কোনো জীবসত্তার সঙ্গেও আমাদের মিল থাকবে।
-মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেখায় যে যেসব পরমাণু ও কণা দিয়ে আমাদের দেহ গড়ে উঠেছে, তা গোটা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এরা আমাদের অন্য সবার মতো করে গড়ে তুলেছে।
*
কিছু মহাজাগতিক সত্য আমাদের সামনে এখনো অনাবিষ্কৃত পড়ে আছে। তা নিয়ে যদি দিনে একবার সম্ভব না হয়, তাহলে সপ্তাহে অন্তত একবার ভাবার সময় দিতে পারো। এসব রহস্য সমাধান হওয়ার জন্য একজন বুদ্ধিমান চিন্তাবিদের আগমনের অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষায় আছে কোনো বুদ্ধিদীপ্ত পরীক্ষা কিংবা সৃজনশীল কোনো মহাকাশ অভিযানের। আমরা হয়তো আরও ভেবে দেখতে পারি, এসব আবিষ্কার একদিন কীভাবে পৃথিবীর জীবনযাত্রা পাল্টে দেবে।
পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানের সময় সংক্ষিপ্ত। এই ক্ষুদ্র সময়ে অনুসন্ধানের সুযোগ পাওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের ও আমাদের বংশধরদের কাছে এদিক থেকে আমরা ঋণী। এর আংশিক কারণ, কাজটা বেশ মজার। সে জন্যই আমরা মঙ্গল গ্রহে নভোচারী পাঠাই কিংবা রোবট পাঠাই ইউরোপা বা তারও দূরের কোনো জায়গায়।
তবে এর পেছনে এর চেয়ে মহৎ আরেকটা কারণও রয়েছে। যেদিন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের বিকাশ থেমে যাবে, সেদিন আমরা আগের সেই ছেলেমানুষি দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ব। তখন আমরা হয়তো ভেবে বসতে পারি, মহাবিশ্ব আমাদের চারপাশে ঘুরছে। গোটা বিশ্বে একটামাত্র পাঁচের মতো জন্মদিনের মোমবাতি আছে টাইপের চিন্তা হবে সেটা। এই সংকীর্ণ ভাবনা মানুষের জ্ঞান ও সত্যের প্রতি অন্বেষাকে থামিয়ে দিতে পারে। কাজেই আমি এমন কোনো কাজ করতে তোমাকে উৎসাহিত করছি, যাতে ভবিষ্যতে এমন কিছু কখনো না ঘটে। মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কোনো আতঙ্কের মধ্যে নয়, বরং মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমরা কতটা পরম মমতায় আঁকড়ে ধরতে পারব, তার ওপর।
শব্দকোষ
অ্যান্টিম্যাটার : বস্তু বা পদার্থ হলো, যারা জায়গা দখল করে। যেমন প্রোটন, ইলেকট্রন ও অন্যান্য মৌলিক কণা। এসব কণার প্রতিপদার্থ জোড়াও আছে। সেগুলো সব দিক থেকে কণার বিপরীত ধর্মের। প্রতিকণা বা প্রতিবস্তু সাধারণত খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না। কোনো প্রোটন যখন তার প্রতিকণার জোড়া বা প্রতিপ্রোটনের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তারা পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে এবং শক্তি নিঃসৃত হয়।
গ্রহাণু: এই মহাকাশীয় পাথরগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এদের আকার ক্ষুদ্র পাথরকণা থেকে শুরু করে খুদে গ্রহের সমান হতে পারে।
পরমাণু : তুমি যা কিছু দেখো, স্পর্শ করো ও গন্ধ শোঁকো, তার সব পরমাণু দিয়ে তৈরি। এদের মধ্যে একটা নিউক্লিয়াস থাকে, যাকে বলা হয় কেন্দ্র। একটি পরমাণুর কেন্দ্রে অন্তত একটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন থাকে এবং অন্তত একটি ইলেকট্রন থাকে, যা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘোরে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে সরলতম ও প্রাচুর্যময় পরমাণুটির নাম হাইড্রোজেন। একমাত্র হাইড্রোজেন ছাড়া বাকি সব পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রনকণাও থাকে।
মহাবিস্ফোরণ: মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে। তখন মহাবিশ্বের সব পদার্থ ও শক্তি অকল্পনীয় রকম অতিক্ষুদ্র একটা জায়গায় ঘনীভূত অবস্থায় ছিল। এই ক্ষুদ্র বিন্দুটি বাইরের দিকে হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং গ্রহ ও জীবসত্তা।
ধূমকেতু : সৌরজগতের এই ভ্রমণকারী বরফ ও ধূলিকণা দিয়ে তৈরি। ধূমকেতু শৌখিন ও প্রফেশনাল জ্যোতির্বিদদের প্রিয় বস্তু। কোনো ধূমকেতু সূর্যের একটি নির্দিষ্ট সীমার কাছে এলে বরফ গলে যায়। তখন ধূমকেতুর পেছনে গ্যাস ও ধূলির একটা দৃশ্যমান লেজ দেখা যায়।
মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ: মহাবিশ্বের আদিম সময়ে যে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এখনো আমাদের চারপাশে বিরাজ করছে। এই আলো গোটা বিশ্বজগতে জ্বলজ্বল করছে। মহাবিস্ফোরণের পর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। কাজেই এই আলোও প্রসারিত হয়ে দীর্ঘ তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই সেটা এখন আমাদের চোখে দৃশ্যমান নেই, তা পরিণত হয়েছে মাইক্রোওয়েভে। এই মাইক্রোওয়েভ আমরা চোখে দেখতে না পেলেও আমাদের টেলিস্কোপ তা পরিমাপ করতে পারে। এভাবে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, আদিম মহাবিশ্বে ঠিক কী ঘটেছিল।
মহাজাগতিক রশ্মি: কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি। এই অতিশক্তিশালী রশ্মি গোটা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এই রশ্মির অতিক্ষুদ্র কণাগুচ্ছের মধ্যে ভয়াবহ শক্তি আটকে আছে। মানুষের জন্য মহাজাগতিক রশ্মি ক্ষতিকর হতে পারত। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের একটা নিরাপদ বেষ্টনী দিয়েছে।
কসমস : আমাদের বিশাল, বিস্ময়কর ও রহস্যময় মহাবিশ্বের আরেক নাম কসমস। বিশেষ একটা বিজ্ঞানবিষয়ক টিভি সিরিজের শিরোনামও কসমস।
ডার্ক এনার্জি : মহাবিশ্বের যে রকম প্রসারণ থাকার কথা ছিল, তার চেয়েও বেশি দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে বলে মনে হয়। মহাবিশ্বে মহাকর্ষ এবং পদার্থের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে এটা জানা গেছে। একটা রহস্যময় বল মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করছে। একে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি।
ডার্ক ম্যাটার : দূরের ছায়াপথ এবং ছায়াপথ গুচ্ছ গবেষণা করে জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা দেখতে পেয়েছেন, সম্ভবত একটা অজানা, অদৃশ্য পদার্থ নক্ষত্রগুলোকে দলবদ্ধ অবস্থায় ধরে রেখেছে। কিন্তু আমরা এই পদার্থ বা বস্তুকে দেখতে পাই না। বিজ্ঞানীরা একেই বলেন ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু। ওটা আসলে কী, তা যদি তুমি জানতে পারো, তাহলে আমাকে দয়া করে জানিয়ো।
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল : মহাবিশ্বের চারটি প্রধান বা মৌলিক বলের মধ্যে একটি হলো বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। এ বলটি অণুগুলোকে একত্রে আটকে রাখে এবং পরমাণুর ধনাত্মক চার্জযুক্ত কেন্দ্রের চারপাশের কক্ষপথে ইলেকট্রনকে ধরে রাখে।
ইলেকট্রন : ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জযুক্ত একটি কণা। আমরা যতটুকু জানি, ইলেকট্রনকে আর কোনো ছোট অংশে ভাঙা যায় না। কাজেই একে আমরা বলি মৌলিক কণা বা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেল।
মৌল : পরমাণু বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সেটা নির্ভর করে তার নিউক্লিয়াসে প্রোটনসংখ্যার ওপর। ১১৮টি মৌল দিয়ে গঠিত পর্যায় সারণিতে মহাবিশ্বে আমাদের জানা সব টাইপের পরমাণুর বর্ণনা করা হয়েছে।
এক্সোপ্লানেট : সূর্য বাদে অন্য কোনো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরা যেকোনো গ্রহকে বলা হয় এক্সোপ্লানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ (বা বাহ্যগ্রহ)। সবচেয়ে কাছের এক্সোপ্লানেটটাও আমাদের কাছ থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর লাগবে চার বছর। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার বহিঃসৌরগ্রহ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এদের কোনোটি কি জীবন ধারণের উপযোগী?
গ্যালাক্সি : মহাকর্ষের অধীনে একত্রে আটকা পড়া একদল নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা ও ডার্ক ম্যাটার।
মহাকর্ষ : মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বলের মধ্যে একটি। মহাকর্ষ শুধু তোমার পা’কে মাটির সঙ্গে আটকেই রাখে না, আরও অনেক কিছু করে। আইনস্টাইনকে ধন্যবাদ। কারণ, তাঁর কারণে আমরা জানতে পেরেছি, মহাকর্ষ আসলে স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়, সরলরেখাকে বাঁকিয়ে বক্ররেখায় পরিণত করে।
আন্তমহাজাগতিক স্থান : এটি হলো গ্যালাক্সিদের মাঝখানে অন্ধকার বিস্তৃতি। প্রথম নজরে একে শূন্য বলে মনে হয়। কিন্তু এখানে আসলে গ্যালাক্সি থেকে ছিটকে পড়া ভবঘুরে নক্ষত্র ও অতি উত্তপ্ত গ্যাস আছে। চতুর্থ অধ্যায় পড়ে দেখো।
লেপটন : মহাবিশ্বে প্রথম উদয় হওয়া দুই ধরনের কণার মধ্যে একটি। লেপটনরা নিঃসঙ্গ। এরা একসঙ্গে গুচ্ছবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে না। লেপটনের জন্য ভালো ও সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো ইলেকট্রন।
আলোকবর্ষ : জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা আসলে অনেক বিপুল দূরত্ব নিয়ে কাজ করেন। সে কারণে কিলোমিটার বা মাইল একক তাদের জন্য যথেষ্ট বড় নয়। তাই এসব এককের বদলে আলোকবর্ষ বা লাইট ইয়ার ব্যবহার করেন তাঁরা। এই একক হিসেবে, আলো এক বছরে যে দূরত্ব পাড়ি দেয়, সেটা এক আলোকবর্ষ। আলো প্রতি সেকেন্ডে পাড়ি দেয় ৩ লাখ কিলোমিটার বা ৩০ কোটি মিটার।
বস্তু বা পদার্থ : যা জায়গা দখল করে, তাকে বস্তু বা পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে তুমি ও তোমার চারপাশের সবকিছু। সেই সঙ্গে সবকিছু গাঠনিক একক অতিক্ষুদ্র কোয়ার্ক ও লেপটনও পদার্থ।
নিউট্রন : পরমাণুর কেন্দ্রে বা নিউক্লিয়াসে থাকে। নিউট্রন তৈরি হয় কোয়ার্ক দিয়ে, কিন্তু এর কোনো চার্জ থাকে না। মহাবিশ্বের অন্যতম চমকপ্রদ বস্তু হলো নিউট্রন স্টার। নিউট্রন স্টার আসলে নিউট্রন ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে।
নিউক্লিয়াস : পরমাণুর কেন্দ্রকে বলা হয় নিউক্লিয়াস। হাইড্রোজেন বাদে সব কটির পরমাণুর কেন্দ্র প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত।
ফোটন : আলোকশক্তির তরঙ্গের মতো প্যাকেট।
প্রোটন : পরমাণুর কেন্দ্রে বা নিউক্লিয়াসে থাকা ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণা। প্রোটন তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। মহাবিশ্বের জন্মের প্রায় প্রথম সেকেন্ডে প্রোটনদের উদ্ভব হয়েছিল। মহাবিশ্বের সরলতম ও সবচেয়ে সহজলভ্য মৌল হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটিমাত্র প্রোটন থাকে।
পালসার : একধরনের নিউট্রন স্টার। এরা স্পন্দিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোর বিম নিঃসরণ করে। অনেকটা মহাজাগতিক বাতিঘর হিসেবে কাজ করে পালসার।
কোয়ার্ক : মৌলিক কণা। অর্থাৎ কোয়ার্ককে তার চেয়ে ক্ষুদ্র কণায় ভাঙা যায় না। এই কণা ছয় ধরনের হয়। মহাবিশ্বের শুরুর দিকে লেপটনসহ যেসব কণা বা পদার্থ উদ্ভূত হয়েছিল, তার মধ্যে এরা অন্যতম। কোয়ার্ক ছাড়া আমরা প্রোটন, নিউট্রন তথা কোনো পরমাণু পেতাম না। অর্থাৎ কোনো কিছুই থাকত না।
শক্তিশালী বল : চারটি মৌলিক বলের মধ্যে একটি। শক্তিশালী বা সবল বল প্রোটন ও নিউট্রনকে নিউক্লিয়াসের মধ্যে একত্রে আটকে রাখে। চারটি বলের মধ্যে এই বলটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তবে এ বল শুধু খুবই ছোট দূরত্বে কাজ করে।
দুর্বল বল : যে মৌলিক বল তেজস্ক্রিয় ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে, সেটিই হলো দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়প্রক্রিয়ায় পরমাণু ভেঙে যায় এবং পদার্থের কিছু অংশ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অন্যান্য তিনটি বল বড় ও ছোট ধরনের পদার্থকে একত্রে ধরে রাখে, কিন্তু দুর্বল বল ধীরে ধীরে তা ভেঙে ফেলে।
ওয়ার্মহোল : আইনস্টাইনের মহাকর্ষের অদ্ভুত এক পরিণতি হলো ওয়ার্মহোল। তার আবিষ্কৃত বক্র স্থান ও কাল থেকে এটি পাওয়া যায়। এ ধারণামতে, মহাবিশ্ব তার নিজের ওপরই বেঁকে যেতে পারে। এভাবে মহাবিশ্বের দুটি জায়গার মধ্যে একটা টানেলের মতো সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করে। একেই বলা হয় ওয়ার্মহোল। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো টানেল কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে আইনস্টাইনসহ নামকরা অনেক বিজ্ঞানী এই ধারণাটা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের কাছেও ওয়ার্মহোল প্রিয় একটা হাতিয়ার।
পরিভাষা
অবলাল বা অবলোহিত আলো Infrared Light
অতিবেগুনি রশ্মি UV বা Ultraviolet Light
অক্সিজেন Oxygen
অণু Molecule
অণুজীব Microorganism
অদৃশ্য আলো Invisible Light
অলিম্পাস মনস Olympus Mons
আপেক্ষিকতা Relativity
আলোর গতি Light Speed
ইউরেনিয়াম Uranium
ইউরোপা Europa
ইরিডিয়াম Iridium
ইলেকট্রন Electrons
উল্কা Meteors
এক্স-রশ্মি বা এক্স-রে X-Rays
এক্সোপ্লানেট বা বহিঃসৌরগ্রহ Exoplanet
ওর্ট মেঘ Oort Cloud
ওয়ার্মহোল Wormholes
কণা ত্বরক যন্ত্র Particle Accelerators
কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর Black hole
কার্বন Carbon
কোমা ক্লাস্টার Coma cluster
কোয়ার্ক Quark
কোয়াসার Quasar
কেন্দ্রবিমুখী বল Centrifugal force
গামা রশ্মি Gamma Ray
গ্যাসীয় মেঘ Gas Cloud
গোলক Sphere
গোল্ডিলকস জোন Goldilocks Zone
গ্রহ Planet
গ্রহাণু Asteroid
চার্জ বা আধান Charge
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী বা অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট Astrophysicist
পজিট্রন Positron
পর্যায় সারণি Periodic Table
পারমাণবিক বোমা Atomic bomb
পরমাণু Atom
পারদ (মৌল) Mercury (Element )
পালসার Pulsar
প্যালাডিয়াম Palladium
প্ল্যাঙ্ক যুগ Planck Era
প্লুটো Pluto
প্লুটোনিয়াম Plutonium
পৃষ্ঠটান Surface Tension
প্রতিবস্তু Antimatter
ফোটন Photon
বামন ছায়াপথ Dwarf galaxy
বায়ুমণ্ডল Atmosphere
বায়োমার্কার Biomarker
বুধ (গ্রহ) Mercury (Planet )
বুদ্ধিমান জীবসত্তা Intelligent life
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল Electromagnetic force
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি Electromagnetic spectrum
বেতার তরঙ্গ Radio Wave
ব্যাকটেরিয়া Bacteria
বৃহস্পতি গ্রহ Jupiter
ভিনগ্রহবাসী বা এলিয়েন Alien
ভৌত সূত্র Physical law
মহাকর্ষ Gravity
মহাবিশ্ব Universe
মহাবিস্ফোরণ Big bang
মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েব পটভূমি বিকিরণ Cosmic microwave background
মহাজাগতিক রশ্মি Cosmic rays
মহাজাগতিক ধ্রুবক Cosmological constant
মাইক্রোওয়েভ এনার্জি Microwave Energy
মিথেন Methane
মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা Milky Way
মৌলিক বল Fundamental Force
তরঙ্গদৈর্ঘ্য Wavelength
তত্ত্ব Theory
তাপমাত্রা Temperature
থোরিয়াম Thorium
দুর্বল বল weak Force
ধূমকেতু Comet
ধ্রুবক Constant
নাইট্রোজেন Nitrogen
নিউটনের সূত্র Newton’s Law
নিউট্রিনো Neutrino
নিউট্রন Neutron
নিউট্রন নক্ষত্র Neutron Star
নিউক্লিয়াস Nucleus
নেপচুন Neptune
নেপচুনিয়াম Neptunium
টাইটেনিয়াম Titanium
টাইটেনিয়াম অক্সাইড Titanium Dioxide
ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তি Dark energy
ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু Dark matter
ডাইনোসর Dinosaur
হাইড্রোজেন Hydrogen
হ্যালির ধূমকেতু Halley’s Comet
হিলিয়াম Helium
যুগল তারা Binary star
লোহা Iron
লেপটন Lepton
লিথিয়াম Lithium
লোহিত দানব Red Giant
সর্পিল ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি Spiral Galaxies
সালোকসংশ্লেষণ Photosynthesis
সিলিকন Silicon
সোডিয়াম Sodium
সুপারনোভা বা অতিনবতারা Supernovas
সৌরজগৎ Solar System
রেডিও টেলিস্কোপ Radio Telescope
শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্র Conservation of energy law
শূন্যতার শক্তি Vacuum Energy