ওন্নে মাত জো, লালিত্বা আ যাই!

ওন্নে মাত জো, লালিত্বা আ যাই!

(১)

কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে গিয়েছে৷ সারাদিন ঘরে গল্পের বই পড়েই কাটছে৷ বিকেলে মাঠের দিকে একটু ঢোঁ মেরে আসি৷ সেদিন কি জানি ঘরে মন টিকছিলো না৷ বড্ড একঘেয়ে লাগছিলো৷ সাইকেলটা বের করে বেরিয়ে পড়লাম প্রতীকের বাড়ির উদ্দেশ্যে৷ অনেকদিন যাওয়া হয় নি৷ একটু আড্ডা দিলে একঘেয়েমিটা কাটবে৷

পৌঁছে দেখি ব্যাটা বারান্দাতেই বসে আছে৷ কিন্তু সে একা নয়, তার সাথে আছে এক বৃদ্ধ৷ একটা চেয়ার টেনে প্রতীকের পাশে এসে বসলাম৷ আমি, আপাদমস্তক ওনার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ সারা শরীরে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট৷ কপালের, গালের চামড়ায় ঢেউ খেলানো ভাঁজ পড়েছে৷ বয়স আন্দাজ সত্তরোর্ধ হবে৷ পরনে সুতির হাফহাতা সাদা গেঞ্জি ও ধুতি৷ বৃদ্ধ পিছন দিকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারে বসে আছে৷ চোখ বন্ধ৷ ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়৷

প্রতীক জানায় ওই বৃদ্ধ ওর দাদু৷ সে দাদুকে আলতো করে নাড়া দিয়ে বলে, ‘দাদু ওঠো, দেখো কে এসেছে৷’ বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়৷ চোখগুলো তাঁর দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের ক্লান্তিতে ভরা৷ প্রতীক আমার পরিচয় দেয়৷ এরপর দাদুর সঙ্গে আলাপচারিতার শেষে, তাঁর কাছে অনেকরকম গল্প শুনতে থাকি৷ কিভাবে উনি তাঁর জীবনের বহু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, সে সব গল্প৷ ১৯৬৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে এসেছিলেন৷ তারপর অতিকষ্টে তাঁর ছেলেবেলা কাটে এবং কি ভাবে লরি চালিয়ে আজ নিজে তিনি বারোটি লরির মালিক৷ সেই সবই বলছিলেন৷ বুঝতে পারলাম, ইনি তাঁর জীবনের নানা রঙিন-বেরঙিন সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী, সেই সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী৷

কি যেন মনে হল, হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘দাদু আপনি কখনো ভূত দেখেছেন? মানে কখনও কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন?’

বলতে না বলতেই প্রতীক ফোড়ন কেটে বললো, ‘তোর শুধু ভূত আর ভূত! ভূত ছাড়া অন্য কোন কথা নেই?’

‘না নেই! বলুন না দাদু, দেখেছেন?’

দাদু কিন্তু সেদিন আমার সাপোর্ট নিয়ে প্রতীককে ধমকে দিয়েছিলো৷ যাই হোক, দাদু জানালো তাঁর অনেক ভূত দেখার অভিজ্ঞতা আছে৷ সে শুনেই তো আমি বড়ো বড়ো চোখ করে, আগ্রহের সাথে বললাম, ‘বলুন না দাদু, একটা ঘটনা বলুন!’

দাদু বললো, ‘বেশ বলবো৷ কিন্তু তোমার সময় হবে তো? ঘটনাটা বেশ বড়ো কিন্তু৷ দেরি-টেরি হলে বাড়িতে বকবে না তো?’

বেপরোয়ার সুরে বলি, ‘আরে না না! অনেক সময় আছে৷ সবে দশটা বাজে৷ বাড়ি ফিরতে এখন প্রায় দু-ঘন্টা৷ আপনি শুরু করুন৷’

‘বেশ তাহলে শোন…৷’ দাদু বলা শুরু করলেন৷ তিনি যেটা বললেন-

(২)

আজ থেকে প্রায় আটচল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা৷ বোলপুরের পাঁচশোয়া গ্রামে, মা, বোন আর আমি, এই ছিল আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসার৷ আমার মা সেলাই এর কাজ করে তিনটে পেট চালাত৷ তখন ‘ময়মনসিংহ’ থেকে পাকিস্তানীদের অত্যাচারে সবে সবে এসেছি এখানে৷ ভারত তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হবু বাংলাদেশকে৷ চারিদিকে যুদ্ধের এক হুলুস্থুলু ব্যাপার৷ বেকারত্বে, দরিদ্রতায় দুই বাংলা ছেয়ে গেছিল৷ এরই মধ্যে আমাদের দীন দরিদ্র সংসার৷ কিশোর বয়স অতিক্রম করে সবে কুড়িতে পা দিয়েছিলাম৷ বেশিদূর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি৷ তাই সংসারের হাল ধরতে একদিন ঠিক করলাম লরি চালিয়ে উপার্জন করব৷ কিন্তু এই ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে কে চাকুরি দেবে, তাও আবার এমত পরিস্থিতিতে? তখন বিহারে আমার এক বন্ধু সুরেশ্বর লরি চালাত৷ আমি ঠিক করলাম ওর ওখানে যাব৷ যেমন ভাবা তেমন কাজ৷ চিঠিতে আমি সুরেশ্বরকে আমার অবস্থার কথা জানালাম৷ কিছুদিন পর-পরই চিঠির উত্তর এল৷ চিঠিতে সে জানিয়েছে, তার মালিকের কাছে আমার ব্যাপারে কথা বলেছে৷ সে আমার চাকুরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে৷

মাস খানেকের মধ্যেই রওনা দিলাম৷ বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম বিশম্বরপুর, সেখানেই থাকত সুরেশ্বর৷ পৌঁছোতে সেদিন অনেক রাত হয়ে গেছিল৷ সুরেশ্বর আমার জন্য স্টেশনেই অপেক্ষা করছিল৷ স্টেশন থেকে নেমে একটা রিক্সা ভাড়া করলাম৷ এখনকার মত সেকালে, রাস্তায় এত বাতি ছিল না৷ স্টেশনের কাছে হাতে গোনা দু-একটা ইলেকট্রিক বাতির ল্যাম্পপোস্ট৷ তারপর বাকি রাস্তা অন্ধকার৷ কিছুক্ষন পরেই রিক্সা এসে থামল একটা বড় বাড়ির সামনে৷ দেখে মনে হচ্ছিল সেটা জমিদার বাড়ি৷ সুরেশ্বর আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল একটি ঘরে৷ বললো, ‘আজ থেকে এটা তোর ঘর৷ পাশের ঘরটা আমার৷ নে অনেকটা পথ এসেছিস, সামনে কল আছে, হাত মুখ ধুয়ে চলে আয়৷ আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি৷ খেয়ে শুয়ে পর৷ কাল সকালে যেতে হবে মালিকের দপ্তরে৷

আমি মুখ, হাত ধুয়ে এসে বিছানায় গা গড়িয়ে দিলাম৷ এতটা পথ সফরের ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ শুয়ে শুয়েই ঘরটাকে দেখছিলাম৷ একজনের থাকার জন্য ঘরটা বেশ বড়৷ ইঞ্চি কয়েক মোটা, চুন-সুরকির তৈরি মসৃণ পুরু দেওয়াল, উত্তর আর পশ্চিমে ছোট্ট দুটো জানলা, বড় বড় কড়িকাঠ আর সেখানে ঝোলানো একটা বাল্ব৷ তখন বিহারে হাতে গোনা কয়েকটা বাড়িতেই ইলেকট্রিসিটি ছিল৷

এভাবে একসময় আমার চোখ পড়ল পশ্চিমের জানালার তাকটার দিকে৷ সেটার উপরে কয়েকটা কাঁচের শিশি আর তার পাশেই একটা পুরানো, তর্জনীর মাপের ফ্রেম করা সাদাকালো একটা ছবি৷ আমি উঠে বসলাম৷ ছবিটা ভালো করে দেখতে যাব তখনই পিছন থেকে শুনতে পেলাম সুরেশ্বরের গলা৷

‘তোর খাবার এনেছি, খেয়ে নে জলদি!’

ভীম সমান এক থালায় খাবার নিয়ে এল সে৷ মোটা মোটা বিহারী রুটি, হাফ ইঞ্চি পুরু তো হবেই! চাপ চাপ মুসুর ডাল, পাঁচমিশালি একটা কি তরকারি আর বাঁশের আচার৷

বললাম, ‘এতো, একদম এলাহি ব্যাপার!’

‘না না! এ আর এমন কি; কিন্তু তাহলেও, ভেতো বাঙালি৷ আমাদের এদিকে ভাত এক প্রকার হয় না বললেই চলে৷ একটু অসুবিধা তো হবেই তোর৷’

রুটি জিনিসটা আমার একবারে পছন্দ নয়৷ কিন্তু কি করা যাবে, মুখের উপর বলতেও পারি না৷ যতই হোক অসময়ে সাহায্য তো করছে, এসব বললে অকৃতজ্ঞের পরিচয় দেওয়া হবে৷ নিজেকে এইসব কথা বলে সান্ত্বনা দিয়ে খেতে শুরু করলাম৷

বিহারী রুটির আলাদাই এক মর্ম আছে৷ বাংলার রুটিতে কিন্তু সেই স্বাদ নেই যেটা ওদের রুটিতে আছে৷ অথচ আশ্চর্যের, দুটো বানানোর পদ্ধতি কিন্তু একই৷ শুধু একটু মোটা এই যা ফারাক৷ আমরা বাঙালিরা যেমন মাছে ভাতে বাঙালি, এরাও তেমনি রুটি তরকারিতে বিহারী৷

ক্ষিদে কিন্তু বেশ পেয়েছিলো৷ কারণ, দুটো রুটির সাথে সংগ্রামে চিরকাল ব্যর্থ আমি ততক্ষণে তিন তিনটে মোটা রুটি সাবাড় করে দিলাম৷

খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখি, সুরেশ্বর পশ্চিম দিকের জানলার কাছে কিছু একটা করছে৷ আমি কি করছিস রে, বলতেই সে যেন চমকে উঠল৷

বললো,’কই না তো, কিছু করি নাই! এমনিই…৷’

লক্ষ করলাম, সেই ছবিটাকে সে তাড়াতাড়ি জামার বুক পকেটে ভরে নিলো৷ আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলাম না৷

যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘শুয়ে পর এবার৷ অনেক রাত হয়েছে৷ কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে৷’

ও চলে যেতেই আমি বালিশে মাথা রেখে সুখনিদ্রায় নিদ্রাচ্ছন্ন হলাম৷ সুরেশ্বরের বাংলাটা বেশ স্পষ্ট৷ কর্মসুবাদে বেশ কয়েকটা বছর বাংলায় কাটানোর জন্যই হয়ত, তখন থেকেই ওর সাথে পরিচয়৷

সকালে ঘুম ভাঙলো সুরেশ্বরের ডাকে৷ ‘উঠে পড়! মুখ ধুয়ে চলে আয়, বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব৷’

গতকাল অনেক রাত্রে আসায় কারোর সাথে আলাপচারিতা হয়নি৷ আমি চাতালে গেলাম যখন তখন দেখি ওখানে জনা পনেরোর মত মানুষের সমাবেশ৷ একান্নবর্তী পরিবার৷ কেও চা করছে তো কেও বা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গল্প করছে৷ সুরেশ্বর সকলের সাথেই আমার আলাপ করালো৷ সুরেশ্বর বাংলা বলতে পারলেও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা বাংলা ঠিক মত জানে না৷ আমার আবার হিন্দিটা তেমন আসে না৷ আধো হিন্দি আধো বাংলা মিশিয়ে জগাখিচুরি করে কোনমতে নিজের পরিচয়টা দিলাম আর কি৷ খুব মিশুকে পরিবার৷ বেশিরভাগ পুরুষ নিজেদের ক্ষেতে কাজ করে৷ মহিলারা বাড়িতে থাকে, হেঁসেল সামলায় আর পাঁপড় বানিয়ে দোকানে বিক্রি করে৷ সুরেশ্বরই কেবল লরি চালায়৷ সকলেই খুব পরিশ্রমী৷ মহিলা, পুরুষ সকলেই উপার্জন করে৷

সকাল সোয়া সাতটা নাগাদ আমি আর সুরেশ্বর বেরিয়ে পরলাম৷ আমরা যাব লাছোয়ার৷ বিশম্বরপুরের পাশের গ্রাম৷ ওখানেই মালিক লোকটার দপ্তর৷ খুব একটা দূর নয়৷ বাসে করে পৌঁছতে মিনিট কুড়ির মত লাগল৷ দপ্তরে গিয়ে মালিকের সাথে সাক্ষাৎ করে চাকরিটা পাকা করে নিলাম৷

মালিক লোকটার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম৷ লোকটা পাঞ্জাবি, নাম হরবন্ত সিং৷ বাংলা না বলতে পারলেও বুঝতে প্রায় সবই পারে৷ হিন্দিতে কথা বললেও পাঞ্জাবীর টান ছিল৷ আমাকে সুরেশ্বর সাহায্য করছিল অবশ্য৷ দেশভাগের সময় ভিটেমাটি ছেড়ে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছিলো৷ তারপর থেকে খুব কষ্টে বড় হয়েছে৷ নিজ পরিশ্রমে ব্যবসা ফেঁদেছিল৷ কথা বলে বুঝলাম, বেশ কড়া মেজাজের হলেও মনের দিক দিয়ে কিন্তু ভাল৷ হরবন্ত জি বললো, ‘শুনো বেটা! তুম অভি সুরেশ্বর কে সাথ কাম কারোগে; উসকা খালাসি রাহোগে৷ আচ্ছি তারাসে কাম শিখলো, ড্রাইভারি শিখলো, ফির তুমকো মে লরি চালানে দুঙ্গা৷ ঠিক হ্যা; আব যাও বেটা, কাল সে চলে আনা৷’

এরপর থেকে সুরেশ্বরের সাথে আমার কর্মজীবন শুরু হল৷ বেশ কয়েকমাস কেটে গেল এভাবে৷ আমি সুরেশ্বরের বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিলাম৷ মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের কিছুটা পাঠাতাম বাড়িতে আর বাকিটা জমিয়ে রাখতাম৷ দুবেলা খাবারের জন্য যেটুকু প্রয়োজন হত সেটুকু খরচ নিতাম ওখান থেকে৷ খাবার খরচটুকু ছাড়া সেরকম খরচ ছিল না বললেই চলে৷ তাই সঞ্চয় হচ্ছিল ভালোই৷

ছুটি সেরকম পেতাম না৷ দুর্গা পুজোর সময় দিন দশেকের মত ছুটি মিলত৷ খুব বিশেষ প্রয়োজনে ছুটি দিত তবে সেটা বেশিদিনের জন্য নয়৷ বাড়ির জন্য মন যে খারাপ করত না তা নয়৷ তবে সুরেশ্বরের বাড়ির লোকজনের সঙ্গ আমার সেই মনখারাপের উপশম করত৷

(৩)

একবার দুর্গাপুজোর সময় কিছু প্রয়োজনীয় মালপত্র পৌঁছনোর দায়িত্ব এল আমাদের উপর৷ কাজ শেষ করতে করতে ষষ্ঠী চলে এল৷ দেখলাম এবারে আর বাড়ি ফিরে লাভ নাই, বরং এবারের পুজোটা এখানেই কাটিয়ে দি৷ লাছোয়ার গ্রামে নাকি খুব জাগ্রত মায়ের মন্দির আছে৷ এতদিন এখানে আছি কিন্তু কাজের চাপে কোনদিন ঘুরে দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে নি৷ কথাটা সুরেশ্বরের কাছে পাড়লাম৷

‘লাছোয়ারে একটা মায়ের খুব জাগ্রত মন্দির আছে না? ওখানে যাব বুঝলি! অষ্টমির খ্যান ওখানেই দেখব৷’

কথাটা শোনার সাথে সাথেই ওর মুখের জৌলুস যেন নিমেষের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল৷ নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল৷ যেন এমন এক কথা বলে ফেলেছি যেটা সে স্বপ্নেও প্রত্যাশা করে নি৷

নাড়া দিয়ে বললাম, ‘কি হল রে? থ মেরে গেলি যে বড়; কিছু অন্যায় আবদার করে বসলাম নাকি?’

‘অন্যায় আবদার? না না, তা নয়!’

‘তাহলে? ওরকম হাঁ করে রইলি যে কথাটা শুনে!’

‘তাহলে আবার কি! যাব দেখতে৷ তবে লাছোয়ার ছাড়া অন্য কোথাও যাব৷ এদিকের আশপাশের অনেক গ্রামেই পুজো হয়৷ সেগুলো দেখতে যাব৷’

আমি একটু অবাক হলাম ওর কথা শুনে৷ লাছোয়ারে পুজো দেখতে এত কি আপত্তি? সে উঠে চলে যাচ্ছিল৷ আমি হাত ধরে টেনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘লাছোয়ারে পুজো দেখতে যেতে অসুবিধা কোথায়?’

একটু আমতো আমতো করছিল বটে কিন্তু আমি চেপে ধরাতে বাধ্য হয়ে বলতেই হল৷

‘সে আমার ঠাকুরদার আমলের কথা৷ ঠাকুরদার এক বোন ছিল৷ নাম ছিল ললিতা৷ বাবার মুখেই শোনা৷ যেমন ছিল রূপ, তার সেরকম ছিল সঙ্গীতে পারদর্শীতা৷ গান-বাজনা খুব ভালোবাসত৷ পরিবারের সকলেই খুব ভালবাসত তাকে৷ সবথেকে বেশি আদরের ছিল তার দাদার, মানে আমার ঠাকুরদার৷ ঠাকুরদা এমনিতে খুব ভালমানুষ ছিল কিন্তু তার একটি দোষ ছিল, সেটা ছিল রাগ৷ রাগ বলা ভুল হবে, বদমেজাজ৷ প্রচন্ড বদমেজাজী ছিল ঠাকুরদা৷ আর তার এই বদমেজাজের জন্যই একদিন এক অঘটন ঘটে গেল৷ চৈত্র মাসের বাসন্তীপুজো উপলক্ষে একদিন সন্ধ্যাবেলায় পাশের গাঁয়েই এক জলসা বসেছিল৷ বাড়িতে মিথ্যা বলে, বান্ধবীর বাড়ি যাবার নাম করে ললিতা যায় সেই জলসায়৷ তখনকার সমাজে রাতবিরেতে মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ছিল৷ জলসার আসরে মত্ত হয়ে সেদিন তার সময়ের কোন খেয়াল রইল না৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হল৷ যখন সে বাড়ি ফিরল তখন অনেক রাত৷ বাড়ির সকলেই খুব বকাঝকা করল৷ এমনিতে ঠাকুরদা বাড়ি ফিরতে অনেক রাত করত, কিন্তু সেদিন কোন কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল৷ ললিতার কীর্তিকলাপ শুনে ঠাকুরদার রাগ কোন বাধা মানল না৷ আমাদের তখন কাঠের ব্যবসা ছিল৷ সেই কাঠ কাটার কুড়ুল নিয়ে মাঝ উঠানে পুরো পরিবারের সামনে ললিতার মুন্ডু ধর থেকে এক কোপে আলাদা করে দিল ঠাকুরদা৷’

শুনেই আমি শিউরে উঠলাম৷ বললাম, ‘বলিস কি রে! শুধু রাত করে বাড়ি ফিরে আসার অপরাধে মেরে দিল?’

‘হ্যাঁ! ঠাকুরদার এই বদমেজাজী স্বভাবের জন্য খুন হতে হল তার সবথেকে আদরের বোনকে৷ আরও শুনেছিলাম, গলা কেটেও নাকি শান্ত হয়নি ঠাকুরদা, রাগ মেটাতে ওর দেহটাকে কুপিয়ে কুপিয়ে কুচি – কুচি করেছিল৷ সেই খবর যাতে পাঁচকান না হয় তাই সেইরাত্রেই টুকরো গুলোকে বস্তায় ভরে পুঁতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে৷ ঠাকুরদা যখন বেরিয়ে যায়, তখন বাবা, কাকারা চুপি-চুপি ঠাকুরদার পিছু নিয়েছিল৷ তারা লুকিয়ে দেখেছিলো, লাছোয়ারের দুর্গামন্দিরের পাশের ভোগঘরের পিছনের দিকে ঠাকুরদা, ললিতার লাশের টুকরোগুলো পুঁতেছিল৷ তারপর থেকেই…৷’

সুরেশ্বর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল৷ মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল৷ এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর সে আবার সরব হল৷

ওই মন্দির চত্ত্বরে আমাদের বংশের সকলের যাওয়া বারণ৷ সেই ঘটনার মাসখানেক পর হঠাৎই একদিন ঠাকুরদাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে পাশের গ্রাম থেকে খবর পাওয়া গেল, লাছোয়ার মন্দিরে নাকি ঠাকুরদার লাশ পাওয়া গিয়েছে৷ সেখানে গিয়ে দেখলো, মন্দিরের দাওয়ার নীচে ঠাকুরদার নিথর দেহ৷ একদিকে রক্তাক্ত কাটা মাথা, আরেকদিকে দেহটা পড়ে৷ গলার জায়গাটা থেকে রক্ত বেরিয়ে সেখানের মাটিটাকে লাল করে তুলেছিল৷

এরকমই আরেকবার আমার ছোট কাকা একবার পুজোর সময় লাছোয়ার মন্দিরে পুজো দেখতে যায়৷ আর ফিরে আসে নি৷ প্রায় তিন, চারদিন নিখোঁজ ছিল৷ কিছু দিন পর মন্দিরের পছনের পুকুরটায় কাকার পচা গলা লাশ ভেসে উঠেছিল৷’

বললাম, ‘পুলিশ এসে তদন্ত করে নাই? খুঁজে বের করতে পারে নাই কে বা কারা খুনগুলো করছিল?’

‘সে খুন হলে তবে তো খুঁজে বের করবে৷’

ওর প্রত্যুত্তরে খুব অবাক হলাম৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে! খুন নয়, তাহলে?’

অনেকদিন তদন্ত চলেছিল বটে৷ অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ, জেরা, মারধর করেও কোন কিনারা করতে পারে নি৷ পারবেই বা কি করে, মানুষে করলে তবে তো পারবে৷

আমি তখন অনেক ছোট৷ মায়ের কাছে শুনেছিলাম৷ একবার এপথ দিয়ে যাওয়ার সময় কোন এক হিমালয়বাসী সাধু আমাদের বাড়িতে এসেছিল৷ উনি বাড়িতে ঢুকেই নাকি বলেছিল ‘শ্রাপ হে! উসকা শ্রাপ হে; পাপ কিয়া থা, ঘোর পাপ৷ পুরা বংসজ্ মে শ্রাপ হে৷ বঁচনা চাহতা হে তো ইস বংসজ্ কা কোয়িভি উস্ মন্দির মে মত জানা৷ নেহি তো মত নিশ্চিত হে!’

ঠাকুরদা আর কাকাকে যে ললিতাই মেরেছিল, তাতে কোন সন্দেহ ছিল না৷ ললিতা তার প্রতিশোধ নিয়েছিল। ঠাকুরদার কর্মের ফল ঠাকুরদা পেয়েছিল৷ কিন্তু ওর ক্ষোভের কোপে পড়তে হল আমাদের পুরো পরিবারকে, বা বলা যায় পুরো বংশকে৷ অনেক ওঝা, তান্ত্রিক দেখিয়ে, যাগযজ্ঞ করেও কোন ফল হয় নি৷ অবশ্য একটা উপায় বলেছিল তারা সকলেই৷ ললিতার শাপ খন্ডাতে হলে তার দেহটাকে দাহ করতে হবে৷ মারা যাওয়ার পর তার সৎকার হয় নি৷ তাই তার অতৃপ্ত আত্মা এখনও ওখানেই বিরাজ করছে৷ যদি তার কঙ্কালের সৎকার করা হয়, তবেই সে মুক্তি পাবে৷ আমাদের পরিবার অভিশাপ মুক্ত হবে৷ কিন্তু করবে কে? গেলেই তো মৃত্যু নিশ্চিত!’

‘কেন? লোক লাগিয়ে মাটি খুঁড়িয়ে কঙ্কাল বের করে আনালেই তো হয়৷ তারপর তোরা সৎকার করে দিবি৷’ বললাম আমি৷

‘কি ভাবছিস? এই সহজ কথাটা আমাদের মাথায় আসে নাই? অতো সোজা হলে তো হয়েই যেত৷ কিন্তু সেটা হবে না, মাটি খোঁড়া থেকে, সৎকার সবটাই আমাদেরই করতে হবে৷ বাইরের লোকে করলে হবে না৷’

কথাটা শেষ করেই সুরেশ্বর তার জামার বুক পকেট থেকে পুরানো ফ্রেমে বাঁধা ছোট্ট একটা ছবি বের করে আমাকে দেখাল৷ ফ্রেমের কাঁচ জায়গায় জায়গায় ঘষা খেয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছিল৷ সাদাকালো ছবিটার অনেকাংশই চটে গেছিল৷ একটু ভাল করে লক্ষ করতেই মনে পড়ল, এটা সেই ছবিটাই যেটা প্রথমদিন ওর বাড়িতে দেখেছিলাম৷ আমি সুরেশ্বরকে বললাম এটা সেই ছবিটাই না, যেটা প্রথম দিন ওর বাড়িতে এসে দেখেছিলাম৷ এই ছবিটাই সেদিন ও লুকিয়ে পকেটে ভরেছিলো৷ ভেবেছিলো আমার অলক্ষেই কাজটা সেরে ফেলেছে, কিন্তু ততক্ষণে আমি যে দেখে নিয়েছিলাম৷

সে বললো, ‘আসলে তুই যে ঘরটায় ছিলিস, সেটা ছিল ললিতার ঘর৷ তোর আসার আগে ওই ছবিটা সরাতে ভুলে গেছিলাম৷ সেদিন তোর খাবার আনতে গিয়ে মনে পড়ল৷ পাছে ওই ছবি দেখে আমাকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করিস, সেই ভয়ে আমি ওটা তাড়াতাড়ি সরাতে গেছিলাম৷ আমি তোকে এতসব জানতে দিতে চাইনি, খামোকা ভয় পেতিস তাই৷’

সে রাতে কিছুতেই ঘুম এল না৷ সুরেশ্বরের বলা কথাগুলো কেবলই ভিড় করে আসছিল৷ মানুষ কত নির্দয় হলে এরকম ফুলের মত এক ফুটফুটে, নিজের বোনকে খুন করতে পারে! মনে মনে ললিতার একটা ছবিই এঁকে নিলাম বলতে গেলে৷ যৌবনের প্রারম্ভেই তার প্রাণহানি হল৷ দোষ কিছুই না, সে কেবল সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারাযুক্ত লোকেদের বানানো নিয়ম এর উলঙ্ঘন করেছিল তাই!

(৪)

পরদিন সকালে সুরেশ্বর এসে আমাকে জানাল, তার কোন এক বন্ধু নাকি ওই গ্রামে থাকে৷ সে, তাকে বলে দেবে, আমাকে লাছোয়ার মন্দিরের পুজো দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ সুরেশ্বর স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, সে আমাদের সঙ্গে যাবে তবে মন্দির চত্বরে ঢুকবে না৷ বাইরে অপেক্ষা করবে৷

ইচ্ছা থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে প্রথমে একটু আপত্তি জানিয়েছিলাম, কিন্তু শেষে ওর জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেলাম৷

সেদিন মহাষ্টমী৷ বিকাল বিকাল আমি আর সুরেশ্বর রওনা দিলাম লাছোয়ার গ্রামের দিকে৷ সেখানে সুরেশ্বরের বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের দিকে৷ ছেলেটা বেশ ভাল৷ বয়স আমাদের মতন হবে৷ নাম শুভঙ্কর৷ বাংলা বুঝতে পারে, বলতেও পারে অল্প-স্বল্প৷ কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলাম মন্দিরে৷ দূর থেকেই দেখলাম, লোকজনের সেরকম ভিড় ছিল না৷ দেখে মনে হল বেশিরভাগই বিহারী৷ হাতে গোনা দু’একটা বাঙালি৷ মন্দিরটা বেশ বড়৷ সেটাকে ঠিক মন্দির বলা চলে না, সেকেলের জমিদার বাড়ির মত কতকটা৷ উঁচু দালান বেয়ে সিঁড়ি উঠেছে প্রাঙ্গনে, বড় মোটা থামের ওপারে মা’র বিগ্রহর পুজো চলছে৷

একজায়গায় এসে থামল সুরেশ্বর৷ আমকে বলল এখান থেকেই মন্দির চত্বর শুরু হচ্ছে৷ আমি বুঝতে পারলাম, হিন্দিতে শুভঙ্করকে বললে আমাকে মন্দির ঘুরিয়ে আনতে আর বেশি দেরি না করতে৷ শুভঙ্কর সব ঘটনাই জানত৷

মন্দিরে ঢুকে মায়ের রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷ আহাঃ কি রূপ, কি তেজ! দিব্য দর্শন যাকে বলে৷ মায়ের কাত্যায়নী প্রতিমা৷ দশ হাতে অস্ত্রধারী মা যেন প্রস্তুত সংসারের সব অসুররূপী পাপনাশ করতে৷

মন্দির থেকে বেরিয়ে শুভঙ্কর আমাকে নিয়ে গেল একটা ঘরের সামনে৷ মন্দিরের পাশেই ঘরটা৷ বেশ বড়, দোতলা ঘর৷ মন্দির সংলগ্ন ঘরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলল সেটা মন্দিরের ভোগ ঘর, এখানেই মায়ের ভোগ রান্না করা হয়৷ ভোগ ঘর বলতেই আমার মনে পড়ে গেল, সুরেশ্বর এটার কথাই বলেছিল৷ এর পিছনেই তো ললিতার টুকরো করা লাশ পোঁতা আছে৷ কি মনে হল, শুভঙ্করকে বললাম পিছনটা একবার ঘুরে দেখতে চাই৷ সে ভাঙা ভাঙা বাংলায় জানাল সন্ধ্যা হওয়ার আগে ফিরতে হবে, সুরেশ্বর বাইরে অপেক্ষা করছে৷

পশ্চিম আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম সূর্য তখন দিগন্তে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসছে৷ ঘরটার পিছনে গিয়ে দেখলাম জানালাগুলোর নীচে ময়লা আবর্জনার গাদ৷ আনাজের খোলা ইত্যাদি এই জানালা দিয়ে ফেলে দেয় হয়ত৷ কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট পুকুর চোখে পড়ল৷ মনে পড়ে গেল, সুরেশ্বরের কাকার লাশ এই পুকুরেই পাওয়া গেছিল৷ ভাবতেই গা টা শিউরে উঠল৷ কি ভয়ানক! একটা জিনিস লক্ষ করলাম৷ আন্দাজ, দশ গজের ব্যবধানে মাঠের আয়তক্ষেত্রাকার কিছুটা জায়গা ন্যাঁড়া টাঁড় মত, কোন ঘাস জন্মায় নি৷ খুব আশ্চর্য লাগল! একবার ভাবলাম, তাহলে কি ললিতার লাশ ওখানেই পোঁতা আছে? কিন্তু লাশ পোঁতা থাকলে তো মাটি উর্বর হত, এরকম শুষ্ক হত না৷

এসব ভাবছি ঠিক তখনই হাতের উপর একবিন্দু জলস্পর্শ পেলাম৷ আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম, কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল৷ চারিদিক জুড়ে অন্ধকার নেমে এল৷ দেখতে না দেখতেই প্রচন্ড ঝড় উঠল৷ বৃষ্টি নামল বলে৷ শুভঙ্কর আর আমি ছুটতে লাগলাম৷ দেখলাম মন্দির ফাঁকা, কেও নেই৷ ঝড়ের দাপটে ঘন্টাগুলো সশব্দে ঢং ঢং করে বেজে চলেছিল৷ দেখলাম সুরেশ্বর একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাদের আসতে দেখেই বলল, ‘তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চল৷ বৃষ্টি নামলো বলে৷’

বলতে না বলতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ মুষল ধারা বৃষ্টি৷ পরক্ষণেই কালো আকাশের বুক চিরে, প্রচন্ড শব্দে কাছাকাছি কোথাও একটা বাজ পড়ল৷ এই ঝোড়ো-বৃষ্টিতে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়৷ সুরেশ্বরকে বললাম ঝড় থামা পর্যন্ত ভোগঘরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য৷ এককথায় স্রেফ বারণ করে দিল, ‘মরে গেলেও ও চত্বরে পা রাখব না!’

বললাম, ‘দেখ মায়ের মন্দিরে ভয় নেই৷ এই অবস্থাতে বাইরে থাকলে এমনিতেই মারা পড়ব৷’

সুরেশ্বর হয়ত রাজি হত না, যদি অদূরের গাছটা বজ্রপাতে মড়্ মড়্ করে ভেঙে না পড়ত৷

আমরা তাড়াতাড়ি ভোগ-ঘরের চাতালে গিয়ে আশ্রয় নিলাম৷ লক্ষ করলাম সুরেশ্বর বারবার আড়চোখে তার চারপাশে লক্ষ রাখছে৷ বুঝতে পারলাম ও বেশ ভয় পাচ্ছে৷ অভয় দিতে আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম৷ টিনের চালার ফুটোগুলো দিয়ে জল পড়ছিল, চাতালেও বৃষ্টির ছিটে আসছিল৷ অগত্যা বাধ্য হলাম ভিতরে গিয়ে ঝড় থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে৷

অন্ধকার ঘর৷ শুভঙ্কর পকেট থেকে দেশলাই বের করে, মোমবাতি খুঁজতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পর একটা লম্ফ জ্বালিয়ে নিয়ে এল৷ দেখলাম ঘরটায় স্টোভ, রান্নার বাসনপত্র, হাতা-খুন্তি ইত্যাদি রন্ধন সামগ্রী রাখা ছিল৷

এভাবে যে কতক্ষণ কেটে গেল জানি না৷ বৃষ্টি থামার নাম নেই বরং আরো বেড়েই চলেছিল৷ কানের পর্দা ফাটানোর মত বাজও পড়ছিল থেকে থেকেই৷ ঝড়ের সোঁ সোঁ শব্দ, অনবরত বেজে চলা মন্দিরের অস্থির ঘন্টার শব্দ, বাইরের জমকালো অন্ধকার আর বৃষ্টি৷ সব মিলিয়ে এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল৷ এমন সময় দোতলার ঘর থেকে, ভারি কিছু একটা জিনিস পড়ার শব্দে আমরা সকলেই বেশ ভয় পেলাম৷ পাওয়ারই কথা৷ একে এই পরিবেশ তার উপর জায়গাটার এত ভয়ানক ইতিহাস৷ মনে সাহস এনে বললাম, ‘চলত, দেখি কিসের আওয়াজ৷’

লম্ফর আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল শুভঙ্কর৷ সুরেশ্বর ভয়ে তটস্থ৷ আমাকে শক্ত করে ধরে পিছন পিছন আসছিল৷ লম্ফের আলোয় দেখলাম উপরের ঘরটা বেশ বড়৷ জিনিসপত্র বলতে কয়েকটা ডেকচি আর দুটো খালি লোহার বড় ড্রাম রাখা৷ ঘরটার উত্তরদিকের জানালাটার খোলা পাল্লা দুটো ঝড়ের দাপটে সশব্দে নড়ে চলেছিল৷ সেই জানালা দিয়ে হিম-শীতল ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটা ভিতরে প্রবেশ করে চলেছিল৷ লক্ষ করলাম জানালাটার নিচে আরেকটা ড্রাম পড়ে আছে৷ সম্ভবত ওটা পড়ে যাওয়াতেই শব্দটা এসেছিল৷ যেন একটু স্বস্তি পেলাম৷ সুরেশ্বরও বেশ স্বস্তিবোধ করল৷

ড্রামটাকে তুলে যথাস্থানে রেখে জানালার পাল্লাটা বন্ধ করতে যাচ্ছি, একটা ঝোড়ো হাওয়া আমার বুকে প্রচন্ড জোরে এসে ভেঙে পড়ল! আমি ছিটকে পড়লাম ড্রামগুলোর উপর৷ নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াতে যাব এমন সময় ঝড়, বৃষ্টির শব্দের মধ্যেই পুরো ঘর জুড়ে গম-গম করে উঠল খিল-খিল এক হাসির শব্দ৷ সে হাসিতে তাচ্ছিল্যভাব, আমাদেরই উদ্দেশ্যে৷ চোখের নিমেষে ঘটে যাওয়া এইসব দেখে ভয়ে, আতঙ্কে সুরেশ্বরের মুখ দিয়ে কেবল একটি শব্দ বের হল, ‘ললিতা আবাত হো!’

একটা ভয়ের শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ললিতার নাম শুনে৷ পড়ি কি মরি করে তিন জন ছুটে গেলাম নীচে৷ সদর দরজার কড়া ধরে টানতেই বুঝতে পারলাম বাইরে থেকে দরজা কেও বন্ধ করে দিয়েছিল৷ জানালা দিয়ে বেরোবার উপায় নেই, শিক আর তারের জালি দিয়ে ঘেরা৷ এমন সময় মনে পড়ল উপরের জানালা দুটো বেশ বড় এবং খোলামেলা ছিল৷ একজন সহজেই সেটা দিয়ে গলে যেতে পারবে৷ ঘরের যা উচ্চতা দোতলার জানালা দিয়ে ঝাঁপালে, বড়জোর হাতে পায়ে চোট লাগতে পারে৷ প্রাণে মরব না৷ কিন্তু এই ঘরে আর এক মুহূর্ত থাকলে মরণ নিশ্চিত৷

আমি কথাগুলো সুরেশ্বর আর শুভঙ্করকে বলছিলাম৷ এমন সময় একটা ভারি চাপা শব্দে আমাদের চোখ গেল সিঁড়ির দিকে৷ একটা ভর্তি চটের বস্তা সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে আমাদের অদূরে এসে পড়ল৷ সুরেশ্বর ভয়ে খপ্ করে আমার হাত ধরল৷ ধীর পায়ে সাহস করে আমি এগিয়ে গেলাম বস্তাটার দিকে৷ পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা মুখটা৷ শুভঙ্করকে আলো দেখাতে বলে আমি ভয়ে ভয়ে দড়িটা খুলতে লাগলাম৷ মুখটা খুলতেই আমার সারা শরীরের রক্ত জল হয়ে গেল, আতঙ্কে আমার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে এল৷ দেখলাম এক অল্পবয়সী কিশোরীর কাটা মাথা, আর তার শরীরের টুকরো অংশ দিয়ে বস্তাটা ভর্তি৷ আচমকা কাটা মাথাটা চোখ মেলে তাকাল৷ আতঙ্কে আমি ছিটকে কয়েক পা পিছিয়ে এলাম৷

এবার চোখের সামনে ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্যকর, হাড় হিম করা ঘটনা৷ বস্তা থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে মেঝেতে পড়ল৷ ধীরে ধীরে সেই হাতে ভর দিয়ে একে একে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল শরীরের এক এক অংশ৷ প্রথমে পিঠ তারপর মাথা তারপর বুক, পেট৷ এভাবে বস্তাবোঝাই টুকরো লাশটা ধীরে ধীরে একটা আকার নিতে থাকল৷ একসময় সেটা এক কিশোরীর আকার নিল৷ অস্ফূট, ভয়ার্ত স্বরে সুরেশ্বরের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘ললিতা আওয়াতিয়া!’

আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ললিতা৷ তার শরীরের সুস্পষ্ট ক্ষতচিহ্নগুলো থেকে রক্ত ঝরে পড়ছিল৷ কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওর ওই মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে কষ্ট হয়েছিল৷ একবার ভাবলাম, সুদর্শনা, নিটোল স্বাস্থ্যবতী এই বিহারী কিশোরী, তার ভরা যৌবনেই নির্মম মৃত্যুর হাতছানির ডাকে কিভাবে পাড়ি দিয়েছিলো৷ কি নিষ্পাপ করুণ সেই চাউনি৷ কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়৷

দেখতে দেখতেই ললিতার শরীরের পরিবর্তন হতে লাগল৷ আঙুলের নখগুলো লোহার ফলকের মত লম্বা আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল৷ শরীর রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে এল৷ মুখ দিয়ে আঠালো লালা জাতীয় কিছু একটা বেরোচ্ছিল৷ ক্ষতচিহ্নগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর আর বীভৎস হয়ে উঠল৷ দেখলাম চোখের মণিটা মোমবাতির মত গলে পড়ে গেল আর সেই জায়গাটা পরিণত হল দুটো বড়-বড়, গভীর, খালি কোঠরে৷ সেখান দিয়ে দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চাপ চাপ কালো রক্ত৷

ললিতার এই রূপ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না৷ আমার গা গুলাচ্ছিল৷ বমি বমি পাচ্ছিল৷ মাথাটা খুব ভারি হয়ে আসছিল৷ মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাব৷ এরপর ললিতা সুরেশ্বরের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করল৷ ঠিক তার পরমুহূর্তেই চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখলাম ললিতা আমার পাশে দাঁড়িয়ে৷ তার শক্ত নিষ্ঠুর হাত চেপে ধরেছে সুরেশ্বরের গলা, নখগুলো বিঁধে গিয়ে সুরেশ্বরের গলা থেকে চুঁইয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়ল৷ মাটি থেকে শূন্যে তুলে ধরল৷ সুরেশ্বরের মুখ থেকে খুব চাপা একটা আর্তনাদ মৃদু শোনা যাচ্ছিল৷ ওর ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখগুলো প্রমাণ দিচ্ছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসার৷

চোখের সামনে বন্ধুর এই অবস্থা দেখে আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব৷ তাড়াতাড়ি কিছু না করলে সুরেশ্বরকে আর বাঁচানো যাবে না৷ এর মধ্যেই লম্ফের আলোয় দেখলাম শুভঙ্কর পিছন থেকে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে আসছে৷ হাতে শাবল জাতীয় কিছু একটা৷ শুভঙ্কর সেই শাবল এর ধারালো দিকটা ললিতার ঘাড় লক্ষ করে সজোরে ছুড়লো৷ শাবলের ফলাটা ললিতার ঘার এফোঁড় ওফোঁড় করে গলা দিয়ে বেরিয়ে এল৷ সাথে সাথে চাপ চাপ রক্ত ছিটকে এসে লাগল সুরেশ্বর ও আমার গালে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে কানফাটানো তীক্ষ্ণ আর্তনাদে সারা ঘর কেঁপে উঠল৷ ললিতা ঘরের এক অন্ধকার কোণে মিলিয়ে গেল৷ সুরেশ্বর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল৷

কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হওয়ার পর আমার কাঁধে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল৷ শুভঙ্করও এসে সুরেশ্বরকে উঠতে সাহায্য করল৷ ভাঙা ফ্যাঁশ-ফ্যাঁশে গলায় সে বলল, ‘আর এক মুহূর্ত এখানে নয়! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চল এখান থেকে৷’

হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ল, ‘শুভঙ্কর তোমার মনে আছে বিকেলে এই ঘরটার পিছন দিকটা ঘুরে আসার জন্য জেদ করেছিলাম আমি? তখন আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম যেটা হয়ত তুমি করো নি৷ পিছনের মাঠটার কিছুটা জায়গা ন্যাঁড়া মতন৷ খরার জমি যেমন হয় ঠিক তেমন৷ আমার মনে হয় ওই খানেই ললিতার লাশ পোঁতা আছে৷ অপঘাতে মরা ললিতার অতৃপ্ত আত্মার জন্যই হয়ত ওই জায়গাটা এখনও অনুর্বর হয়ে রয়েছে৷ সুরেশ্বরের কথামত যদি ওর কঙ্কালটা দাহ করা যায় তাহলে ললিতার অভিশাপ কেটে যাবে৷ আমাদের কাছে এটাই একমাত্র পথ ওর অভিশাপ থেকে নিস্তার পাওয়ার৷’

সুরেশ্বর ও শুভঙ্কর দুজনেই সম্মতি জানাল৷ শুভঙ্কর কোথা থেকে একটা ফাওড়া জোগাড় করে আনল৷

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ঝড়-বৃষ্টি থেমে গিয়েছে৷ বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদো গন্ধে চারিদিক মো-মো করছিল৷ ঝড়-বৃষ্টির জেরে কেমন যেন এক ঠান্ডা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল৷ আমি বারকয়েক হ্যাঁচকা টান মেরে দরজাটা আবারও খোলার চেষ্টা করলাম, এই আশায় যে যদি দরজাটা খুলে যায়৷ কিন্তু না, কোনমতেই খোলা গেল না৷

আর কাল বিলম্ব না করে আমরা উপরের ঘরে গেলাম৷ জানালাটা দিয়ে উঁকি মেরে একবার নীচে তাকিয়ে দেখে নিলাম৷ তারপর সাহস করে, মনে মনে মা-এর নাম স্মরণ করে লাফ দিলাম৷ মাটিতে পড়তেই কায়দা করে ডিগবাজি খেয়েছিলাম বলে ব্যথাটা সেরকম পাই নি৷ তাছাড়াও বৃষ্টির জন্য মাটি ভিজে নরম হওয়াতে সুবিধা হয়েছিল৷ শুভঙ্কর উপর থেকে ফাওড়াটা মাটিতে ফেলে দিয়ে সেও লাফ দিল৷ কিন্তু সুরেশ্বরের বেলায় আবার এক অঘটন ঘটে গেল৷ বুঝতে পারলাম যে সুরেশ্বর লাফ দিয়েছে কিন্তু সে নীচে পড়ল না৷ বরং জানালার দিক থেকে ভেসে এল আমাদের উদ্দেশ্যে তার সাহায্য ভিক্ষার চিৎকার৷ অমাবস্যা, তারপর এই মেঘলা রাত্রের অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না৷ শুভঙ্কর লম্ফটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল৷ কালবিলম্ব না করে সেটা জ্বালানো হল৷ সেটার আলোয় দেখলাম শিহরণ জাগানো দৃশ্য৷ ললিতা সুরেশ্বরের একটা পা চেপে ধরে ছিল৷ তার গলাতে শুভঙ্করের লক্ষ করে ছোঁড়া শাবলটা তখনও গাঁথা৷ সুরেশ্বর বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করেই চলেছিল৷ এমন সময় হঠাৎ ললিতা, সুরেশ্বরের পা ছেড়ে দিল৷ সে সজোরে এসে পড়ল মাটিতে৷ বেকায়দায় পড়লেও, ভাগ্য ভাল থাকায় মাথায় কোনরকম চোট পায় নি৷ তবে হাঁটুর উপর ভর করে পড়ায় পা’টা জখম হয়েছিল৷

ছুটে গেলাম ওর কাছে৷ দুজনে মিলে তুলে-ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু না, টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে আবার লুটিয়ে পড়ল সে৷ আমাকে কাছে টেনে কাঁপা কাঁপা ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমাকে নিয়ে ভাবিস না এখন৷ আর বেশি দেরি করলে আমরা কেও বেঁচে ফিরব না৷ তাড়াতড়ি যেটা করতে এসেছিলি সেটা করে ফেল৷ তবেই আমরা ওর হাত থেকে নিস্তার পাব৷’

আমি আর শুভঙ্কর, আর সময় নষ্ট না সুরেশ্বরকে ওখানেই ফেলে রেখে সেই জায়গার মাটি খুঁড়তে লাগলাম৷ কিছুটা খুঁড়তেই, একসময় ফাওড়াটা শক্ত কিছু একটাই লাগল৷ হাতে করে বাকি মাটি সরিয়ে দেখলাম একটা হাড়ের টুকরো৷ বৃষ্টিতে ভিজে মাটি নরম হয়ে গেছিল বলে খুঁড়তে বেশি সময় লাগল না৷ হাড়ের টুকরোগুলোকে সব একজায়গায় জড়ো করলাম৷

এমনসময় পিছন থেকে শুনতে পেলাম, সুরেশ্বরের চিৎকার৷ পিছনে তাকাতেই দেখলাম, সুরেশ্বর অসহায়ের মত মাটিতে পড়ে আছে৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে ললিতা৷ গলায় গাঁথা, কালো রক্তাক্ত শাবলটা ধীরে ধীরে সে গলা থেকে বের করে আনছে৷ বুঝতে পারলাম এবার কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে৷ আমি আর দেরি না করে লম্ফর কেরোসিন তেলটা হাড়গুলোয় ছিটিয়ে দিলাম৷ কিন্তু আগুন যে সুরেশ্বরকেই দিতে হবে, আমাদের দিলে হবে না৷ একটা হাড়ের টুকরো ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম, সঙ্গে দেশলাইটাও৷ বললাম ওটায় আগুন দিতে৷ সুরেশ্বর প্রাণপনে দেশলাই হাতড়ে কোন রকমে একটা কাঠি জ্বালাল৷ ললিতা ততক্ষণে শাবলের ফলাটা ওর দিকে তাক করে শূন্যে তুলে ধরেছিল৷ পলকের মধ্যেই হাড় লক্ষ করে ছুড়ে দিল জ্বলন্ত কাঠি৷ আমরাও প্রস্তুত হয়েই ছিলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে শুভঙ্করও লম্ফটা ফেলে দিল হাড়গুলোর উপর৷

দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন৷ সেই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলতে দেখলাম হাড় গুলোকে৷ পিছন থেকে শুনতে পেলাম নারী কণ্ঠের গগনবিদারী এক আর্তনাদ তার সাথে সুরেশ্বরের মর্মান্তিক চিৎকার৷ তাহলে কি ললিতা তার প্রতিশোধ নিয়েছে আরও একবার? সুরেশ্বরের বুকে শাবল গেঁথে তার রক্তে নিজের তৃপ্তি মিটিয়েছে৷ সত্যি করেছে অভিশাপের ভবিষ্যৎবাণী? পুরো ব্যাপারটা এতোই তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কিছুই বুঝতে পারলাম না৷

পিছনে তাকিয়ে দেখতে যাব এমন সময় এক প্রচন্ড দমকা হাওয়ার ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়লাম৷ চোখের সামনে দগ্ধ হাড় গুলোর জ্বলন্ত আগুন ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে লাগল৷ চারিপাশে নেমে এল অমাবস্যার কালো অন্ধকার৷

(৫)

যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলাম হ্যারিকেন হাতে জনাপাঁচেক লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে৷ তাদের মধ্যে সুরেশ্বর ও শুভঙ্করও উপস্থিত ছিল৷ জামা কাপড় জল-কাদায় ভিজে জ্যাব-জ্যাব করছিল৷ হঠাৎ মনে পড়ে গেল জ্ঞান হারাবার আগের মুহূর্তটার কথা৷ তড়িঘড়ি উঠে বসলাম৷ সুরেশ্বর, শুভঙ্কর দুজনকেই জিজ্ঞেস করলাম ওরা ঠিক আছে কিনা? সুরেশ্বর জানালো তার পায়ে একটু ব্যথা ছাড়া বাকি সব ঠিক আছে৷ পাশে থেকে একজন লোক হিন্দিতে জানাল, সে মন্দিরের পুরোহিত৷ বৃষ্টি থামার পর মন্দিরে আসার সময় ভোগঘরের সামনের গাছটার নীচে আমাদের পড়ে থাকতে দেখে৷ প্রথমে ভেবেছিল, বজ্রাঘাতে হয়ত মারা গিয়েছি৷ তারপর কাছে এসে যখন দেখে শ্বাস চলছে তখন লোকজন ডেকে এনে আমাদের জ্ঞান ফেরায়৷

সুরেশ্বরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু আমরা এখানে এলাম কি করে?’

সুরেশ্বর চোখ টিপে, ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলল৷

এসব কথার মাঝেই দেখলাম উপস্থিত জনতার মধ্যে একজন ভোগ ঘরের তালা খুলতে গেল৷ পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা দেখেই সে ভোগঘর তালাবন্ধ করে পালিয়েছিল৷

সেদিনের পর থেকে সুরেশ্বরের পরিবারের উপর থেকে ললিতার অভিশাপ কেটে গেল৷ সেই রাত্রে একটা পুরো বংশ ললিতা নামক মারণ-অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা পেল৷

আজও সেই ঘটনা মনে করলে আমি ভয়ে শিউরে উঠি৷ মনের কোন এক অনন্ত, অন্ধকার কোণ থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, ‘ওন্নে মাত জো, লালিত্বা আ যাই!’ (ওখানে যেও না, ললিতা চলে আসবে!)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *