‘ওই যে তিনি চলেছেন সবার আগে’ – অমিতাভ চৌধুরী

‘ওই যে তিনি চলেছেন সবার আগে’ – অমিতাভ চৌধুরী

মহাত্মা গান্ধী এখন নামমাত্র। কিন্তু আমাদের ছাত্রজীবনে তিনি তা ছিলেন না। তাঁর পক্ষে বা বিপক্ষে যাই থাকুক না কেন, তিনি ছিলেন আমাদের চিন্তায় ও কর্মে সদাজাগ্রত প্রহরী— দি গ্রেট সেন্টিনেল। আমি গান্ধীভক্ত ছিলাম না, কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম। তাঁর মৃত্যুতে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন এমন একদিন আসবে যখন মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না যে, গান্ধীজির মত লোক আমাদের এই মাটির পৃথিবীতে হেঁটে বেড়িয়েছেন। আজ জর্জ বানার্ড শ’ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘ইট শো’জ হাউ ডেনজারাস ইট ইজ টু বি টু গুড।’ অর্থাৎ কিনা তাঁর মৃত্যু এটাই প্রমাণ করল যে, অতিরিক্ত ভাল মানুষ হওয়া কী বিপজ্জনক। সদ্যস্বাধীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মৃত্যুর দিন রাত্রে বেতার মারফত তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ‘দি লাইট ইজ আউট’ বলে। শান্তিনিকেতন কলেজে আমার রুমমেট — এখন বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক আশরফ সিদ্দিকি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, আততায়ী হিন্দু জেনে। যদি মুসলমান কেউ হত তাহলে সারা দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত। সুস্থ সবল একটি বৃদ্ধ মানুষের এমন মৃত্যু সারা পৃথিবীকে বিমূঢ় করে তুলেছিল। আমরা শান্তিনিকেতনবাসীরা একটু বেশি হয়েছিলাম। তার কারণ বছর দুই আগে তিনি অভিভাবকরূপে শান্তিনিকেতনে এসে আমাদের আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন যে, টাকার অভাবে বিশ্বভারতী বন্ধ হবে না। বন্ধ হয়ওনি। উনি শান্তিনিকেতনে শেষ এসেছিলেন ১৯৪৫ সালের শেষ দিকে আর তাঁরই নির্দেশমত বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয় ১৯৫১ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর।

সবে কলেজের ছাত্র। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম গান্ধীজি আসছেন সদলবলে। ১৯৪৫ সালের শেষদিকে তিনি এলেনও। তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের দাপাদাপি চলছে। আমরা তখন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্ধ ভক্ত। চারদিকে সুভাষ বসুর চার সেনাপতিকে নিয়ে হই চই— শাহনওয়াজ, সেহগাল, ধীলন ও লক্ষ্মী স্বামীনাথন। লালকেল্লায় তাঁদের বিচার চলছে। সারা দেশে তখন ‘নেতাজি—নেতাজি’। এমন সময় গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে আসছেন শুনে তাঁর প্রতি কিঞ্চিৎ বিরূপতা ছিল আমার মনে, বোলপুর স্টেশনে নেমে তিনি হলেন ‘তীর্থযাত্রী’। পায়ে হেঁটে আশ্রমে আসবেন। এলেনও। আমরা তখন স্বেচ্ছাসেবক সেজে চৈত্যের সামনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর দেখি ‘ওই যে তিনি চলেছেন সবার আগে আগে’। একদিকে নাত বৌ আভা গান্ধী অন্যদিকে সুশীলা নায়ার— দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি আসছেন। দূর থেকে তাঁকে দেখে ‘মাথা নোয়াব না’ এই পণ ভেঙে গেল সামনে আসার পর। যে—ই না আমার দিকে তাকালেন, অমনি আপনা আপনি মাথা মন্ত্রবৎ নিচে নেমে এল। জানালাম সশ্রদ্ধ প্রণতি। গান্ধীজি প্রথমে উত্তরায়ণে না গিয়ে সোজা এলেন গৌর প্রাঙ্গণের নতুন তৈরি মণ্ডপে। তখন বিকেল বেলা, সন্ধ্যে হয়—হয়ছে, উপাসনার স্থান হয়েছে সেখানে। ওপরে চাঁদোয়া টাঙানো, নিচে উঁচু বেদি। সেই উপাসানা অনুষ্ঠানের স্মৃতি এত বছর পরেও ভুলিনি। সূর্য ডুবছে খেলার মাঠের ওপারে, গান্ধীজি মাইকের সামনে বসে আছেন, একটু দূরে নন্দলাল বসু তাঁর সেই বিখ্যাত স্কেচ ‘প্রার্থনা সভায় গান্ধীজি’ আঁকছেন, আর চারদিকের নিঃশব্দ পরিবেশকে কিঞ্চিৎ দুলিয়ে উপাসনা বেদির তলায় বসে শান্তিদেব ঘোষ গান ধরলেন — ‘ওই আসন তলে মাটির পরে’। কী চমৎকার পরিবেশ, আমি এখনও চোখ বুজে সেই দৃশ্য দেখতে পাই। তারপর গান্ধীজি গেলেন উত্তরায়ণে। স্বেচ্ছাসেবকরূপে আমার কাজ হল ফটকে দাঁড়িয়ে লোক আটকানো। আমি তাই করলাম অনেক রাত অবধি। তারপর সকালবেলা। তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সঙ্গে ছোট্ট ছেলে রাজীব। গান্ধীজি চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর আসেন পণ্ডিত নেহরু। মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে তিনি চলে যান।

যা বলছিলাম, গান্ধীজি এলেন তো উৎসব শান্তিনিকেতনে। তিনি আছেন তাঁকে কবির উৎসর্গ করা ‘শ্যামলী’ বাড়ির পাশে। সঙ্গে আছেন সচিব প্যারেলাল নাতি কানু গান্ধী এবং আভা গান্ধী। দেখতাম দুপুরবেলা কানু গান্ধী তাঁর ঠাকুরদার গায়ে তেল দলাই মলাই করছেন এবং গান্ধীজি আপন মনে বই পড়ে যাচ্ছেন। এ আমার নিজের চোখে দেখা। খাওয়ার সময় রানীদি — রানী চন্দ থাতেন কাছে! হাত খেতেন না। কাঠের চামচ দিয়ে খাওয়া দাওয়া। লোকজনের আসার, দেখার, কথা বলার বিরাম নেই। বিকেলবেলা আবার উপাসনা, ‘আবার ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’। রোজ ভোরবেলা গান্ধীজি বেরতেন খোয়াইয়ের দিকে বেড়াতে। একদিন গিয়েছিলেন শিল্পী মুকুল দে’র স্টুডিও দেখতে। একদিন গেলেন শ্রীনিকেতনের কাছে এনড্রুজ হাসপাতালের শিলান্যাস করতে। আমি সেবার গান্ধীজির সঙ্গে ঠিক এক পা পেছনে থেকে— হেঁটে অনুষ্ঠান স্থলে গিয়েছিলাম। গান্ধীজির কোমরে ঝোলানো থাকত ঘড়ি। সেই ঘড়ি দেখে তিনি সব কাজ করতেন। গান্ধীজি যে গতিতে হাঁটতেন, আমার মত কিশোর বালকও হাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে। দু’রাত্তির কাটিয়ে গান্ধীজি শান্তিনিকেতন ছাড়েন। যাওয়ার আগে উত্তরায়ণে সব অধ্যাপক ও কর্মীদের এক সভা ডাকেন। কেন না রবীন্দ্রনাথের পর তিনি তখন অভিভাবক। তিনি উপদেশ দেন, কী কী করতে হবে। তারই মধ্যে একজন অধ্যাপক গান্ধীজিকে বলেন ছাত্ররা যদি তাঁর কথা না শোনে, তা হলে তিনি কী করবেন? গান্ধীজির তৎক্ষণাৎ জবাব— তাহলে আপনার উচিত চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া।’ ব্যাস, অধ্যাপক মশাই চুপ। বেলা এগারটা নাগাদ গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে। হেঁটে যাবেন বোলপুর রেল স্টেশন, দু’মাইল রাস্তা। সেখানে অপেক্ষা করছে স্পেশাল ট্রেন। গান্ধীজি উত্তরায়ণ ফটক যেই পার হবেন, তখন মা ইন্দিরার কোলে ছেলে রাজীব সেইখানে দাঁড়িয়ে। গান্ধীজি তাঁকে আদর করতে যাবেন চিবুক ধরে, শিশু রাজীব বলে ওঠে— বাপু দোয় হিন্দু। অর্থাৎ জয় হিন্দ। গান্ধীজি একগাল হেসে শিশুকে আদর করে বোলপুরের দিকে রওনা হলেন। (এই ছবির তিন চরিত্রই তিন গান্ধীর আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন নানা সময়।) উত্তরায়ণ থেকে মেন গেট পর্যন্ত পথের দু’ধারে আমরা বিদায় জানাতে দাঁড়িয়ে এবং অনবরত গান চলছে আশ্রম সংগীত—আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের সব হতে আপন; গান্ধীজি চলে গেলেন, কিন্তু আমাদের ছাত্রদের মনে দাগ কেটে দিয়ে গেলেন। তারপর প্রত্যেক দিন শুধু তাঁকে নিয়েই আলোচনা। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রবল প্রতাপের মাঝখানে এসে দাঁড়াল গান্ধীজি ব্যক্তিত্ব!

গান্ধীজির সঙ্গে শান্তিনিকতনের যোগাযোগ অনেক দিনের। ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যখন তিনি তাঁর ফিনিক্স স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে ভারতে এলেন, তখন তাঁর প্রথম আবাসস্থল ছিল ওই শান্তিনিকেতনই। ‘সংস্কার’ বাড়িতে ওঁরা থাকতেন। গান্ধীজি যখন পিয়ার্সন সাহেবের ক্লাস করছেন তখন হঠাৎ ক্লাসের মধ্যেই গান্ধীজির কাছে টেলিগ্রাম এল গোখলে মারা গিয়েছেন। তিনি চলে গেলেন ছেলে দেবদাস গান্ধী এবং মগনলাল গান্ধী প্রমুখ শিষ্যদের রেখে। তারপর আবার এলেন। তখন প্রথম আলাপ আচার্য জে বি কৃপালনীর সঙ্গে। কৃপালনীজির ভাইপো পড়ত শান্তিনিকেতনে। সেই আলাপ থেকেই ঘনিষ্ঠতা।

কৃপালনীজি গান্ধীজি নিয়ে বিহারের মজঃফরপুর কলেজে গেলেন যেখানে তিনি অধ্যক্ষ। সেখান থেকেই চম্পারণ সত্যাগ্রহ। তারপর একের পরে এক ঘটনা। — গান্ধীজি হয়ে গেলেন মহাত্মা গান্ধী— বাপু। গান্ধীজি তারপর শান্তিনিকেতন আসেন ১৯২০, ১৯২৫, ১৯৪০ ও ১৯৪৫ সালে। ১৯২০ সালে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা হয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের — যাঁকে তিনি ডাকতেন ‘বড়োদাদা’ বলে। সেবারই আলি ভাইয়ের শওকত আলি আসেন শান্তিনিকেতনে গান্ধীজির সঙ্গে জরুরি পরামর্শ করতে। সেই প্রথম একজন অহিন্দু শান্তিনিকেতনের জেনারেল কিচেনে সবার সঙ্গে দুপুরের খাবার খান। ১৯২৫ সালে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়ে বড়ো দাদার। ১৯৪০ সালে কস্তুরবা এলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সংবর্ধনা জানান আম্রকুঞ্জে। সেবারই গান্ধীজির বিদায়কালে বিশ্বভারতীয় দায়িত্ব নিতে তিনি মহাত্মাকে অনুরোধ করেন। গান্ধীজি বলেন, ‘ঠিক আছে, কোনও ভাবনা নেই।’

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুর আগে তিনি বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় করানোর জন্য দায়িত্ব দেন জওহরলালকে। জওহরলাল তার শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে বিল আনার ভার দেন। সেই অনুযায়ী ১৯৫১ সাল থেকে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গান্ধীজির আসার আর হল না। বহুদিন পর আশির দশকে আর এক গান্ধী আসেন শান্তিনিকেতনে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হয়ে। তিনি রামচন্দ্র গান্ধী— দেবদাসের ছেলে। তাঁর দিদি তারা গান্ধী পঞ্চাশের দশকে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। রামচন্দ্রকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাতি হিসেবে বিশেষ আদর টাদর পেতেন কিনা গান্ধীজির কাছে। ‘মোটেই না’— রামচন্দ্রের জবাব — ‘তবে আমি তখন খুব ছোট, মনে আছে উপাসনার সময় উপস্থিত থাকলে তাঁর মুখ দেখে মনে হত, খুব খুশি হয়েছেন।’ আমি রামচন্দ্রকে বলেছিলাম ‘জানো বোধ হয়, ‘শ্যামলী’ বাড়িটি রবীন্দ্রনাথ তোমার ঠাকুরদাকে দান করেছিলেন। তাঁর ওয়ারিশ হিসেবে তুমি ওই বাড়িটি দখল করে ওখানেই থাকো।’ শুনে রামচন্দ্রের কী দমফাটা হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *