প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 6

ওই দেখা যায় বাড়ি আমার

ওই দেখা যায় বাড়ি আমার

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মাঝামাঝি জায়গায় শ্যামবাজারের দিকে যেতে বাঁ-পাশে রাস্তার ওপর একটা বাড়ি আছে। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা অন্ধগলি। গলিটার পরেই একটা ক্ষতবিক্ষত পার্ক আছে। সেই পার্কের এক কোণে পরম অশ্রদ্ধায় পড়ে আছেন সে যুগের প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ। উদার অনাবৃত পাথরের শরীরে বায়স-বিষ্টার প্রলেপ। প্রাচীন এক সুবৃহৎ বৃক্ষের ডালপালা ঝুঁকে এসেছে। সুবৃহৎ একটি বিজ্ঞাপন সেই মূর্তির মুখের সামনে ঊর্ধ্বে ঝুলে আছে। সন্ধানী সতর্ক চোখ কোনওরকমে খুঁজে নিতে পারে সেই ইতিহাস পুরুষের অবহেলিত ক্ষুদ্র মূর্তিটিকে। আর মনে-মনে ভাবতে পারে—ব্যাবসার এই শহরে, ‘ভাও’ ছাড়া আর কোনও প্রশ্ন বেঁচে নেই।

প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে আমি ওই পথিপার্শ্বস্থ বাড়িটির দিকে যতক্ষণ পারি তাকিয়ে থাকি। সামনের দিকটা অর্ধবৃত্তাকার। নীচে থেকে তিনতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে কারুকার্যময় বিশাল দুটি থাম। ছাদের আলসে শুধু নিরাপত্তার বন্ধনী নয়, নয়নসুখকর এক ভিনদেশীয় গঠনভঙ্গিমা। সামনের দিক থেকে বাড়িটির সামান্যই দেখা যায়, পাশে সরে এলে বাকি অংশে চোখ পড়ে। ঋজু-ঋজু জানালা। চন্দ্রাকার খিলান। এখানে ওখানে লেগেআছে রঙিন কাচের বাহার! হয় তো সেই বিখ্যাত বেলজিয়াম গ্লাস। প্রবেশপথের মাথার ওপর, বলিষ্ঠ থামের গায়ে, সর্বোচ্চ তলের সামনে ছাদের আলসেতে শিল্পীর কর্নিকের পলস্তারায় বিস্ময়কর কারুকার্য। স্থাপত্যের জ্ঞান আমার নেই। আমার দুটো চোখ আর সামান্য একটু বাঙালি-সুলভ অনুভূতি আছে। সেই অনুভূতির সহায়ে আমি সময়ের পথ ধরে ইচ্ছামতো সামনে এগোতে পারি আবার ভাটার স্রোতে উজিয়ে যেতে পারি পেছনে। বাড়িটির গায়ে গজিয়ে উঠেছে বেপরোয়া বটগাছ। তাকে আর চারা বলা যায় না। বেঁটে একটি বটবৃক্ষ। হিলহিলে শিকড় নামিয়ে দিয়েছে কার্নিস বেয়ে, দেওয়াল বেয়ে অক্টোপাসের বাহুর মতো। এই সাবলীল বটগাছটি আমাকে অতীতে ঠেলে নিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এমন একটা সুন্দর বাড়িতে কেউ বসবাস করে না কেন? হোক না প্রাচীন। গৃহসমস্যার এই ভয়ংকর যুগে, এইরকম স্থানে, এইরকম একটা বাড়ি কেন ভূতুড়ে চেহারা নিয়ে পড়ে আছে। খড়খড়ি, শার্সি, সব বন্ধ। বাড়িটির ভেতরে যাওয়ার উপায় আমার নেই; কিন্তু কল্পনায় আমি দেখতে পাই, অনেক উঁচু সিলিংঅলা বিশাল বিশাল ঘর। টানা লম্বা বারান্দা। ঘুরে চলে গেছে, এপাশ থেকে ওপাশে। মার্বেল পাথরের শীতল মেঝে। বহুকাল কেউ তেমন করে অকজ্যালিক অ্যাসিড ঘষে পরিষ্করা করেনি, তাই মলিন হয়ে আছে। ভেতরের বারান্দায় অবশ্যই কাঠের জাফরি লাগানো আছে। চিনে মিস্ত্রির হাতের কাজ। জায়গায় জায়গায় ঝুলে গেলেও অতীতকালের আলপনা। বট যখন আছে, পোষা জাপানি পায়রার বদলে গোলাপায়রা নিশ্চয় বাসা বেঁধেছে। তাদের অকৃপণ বিষ্ঠাবর্ষণে বারান্দার মেঝে, ভেতরের উঠান চিত্রবিচিত্র। আমি শুনতে পাই অতীতের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে ম্যাকাও পাখির চিৎকার। দেখতে পাই ঘরে-ঘরে ঝুলছে বিশাল-বিশাল ঝাড়লণ্ঠন। ভিকটোরিয়ান ফার্নিচার। পুরু গালিচা। বিশাল ডিভান। বিরাট আকৃতির সোফা সেট। মার্বেল পাথর লাগানো সরু-সরু কর্নার টেবিল, যার চারটে পায়া পাতার বাহার নিয়ে নীচের দিকে নেমে এসেছে সারসের পায়ের মতো। সেকালের অফুরন্ত একটা বৈভবের ছবি ভেসে ওঠে আমার মনে। একটা কাল, যেকালে আমি ছিলুম না, যেকালে আমার পূর্বপুরুষরা স্বপ্নের নায়কের মতো ঘুরে বেড়াতেন। সেই কালের অবশিষ্ট স্মৃতি আমাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। উত্তর পুরুষের যাবতীয় অক্ষমতা আমাকে পীড়া দেয়। ওই বাড়িটির দিকে তাকিয়ে আমি হিসাব মেলাবার চেষ্টা করি, এই রাজপথের দুধারে যখন বড় টাকার খেলা চলছে, তখন একখণ্ড শূন্যতা কেন এখনও প্রাচীনকালের কাঠামোয় এইভাবে বন্দি হয়ে আছে। এ যে বড় মহার্ঘ অবহেলা! আর তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি আদালত কক্ষ ভেসে ওঠে একাধিক বিবদমান ভ্রাতার চেহারা। শুনতে পাই এ-বারান্দায় ও-বারান্দায় তাদের কর্কশ কণ্ঠস্বর। তাদের বধূদের পশ্চাৎপট আস্ফালন। আবার এমন দৃশ্যও ভেসে ওঠে, কোনও নিরীহ চেহারার কুসীদজীবী সোৎসাহে এগিয়ে দিচ্ছেন টাকার থলি। মুখে অমায়িক হাসি, নিন না ছোটবাবু, আপনার টাকার অভাব। আমি তো আছি। চুনোট করা ধুতি আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পরিহিত ছোটবাবু সেই তলহীন ভরসার অতলে তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে সেই যে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, সেই মামলা হয়তো আজও ঝুলে আছে। আইন ছুঁয়ে আছে বলে বাড়িটি আজ ব্রাত্য। কি যে কী আমি বলতে পারব না, তবে পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাওয়ার একটা জ্বালাময় অনুভূতি আমাকে কাতর করে তোলে।

ছাত্রজীবনে আমার সময় কাটত একটি বনেদি বাড়িতে। সেই বাড়ির চারটে থাম উলটে ফেললে যা ইঁট বেরোত, তাতে মধ্যবিত্তের সাদামাটা একটি বিলিতি বাড়ি অনায়াসে হয়ে যেত। চারটি বিশাল, সুউচ্চ থামের মাথায় একটি ঢালাও ছাদ। সেই ছাদের তলায় কেটে-কেটে থাকে-থাকে সাজানো হয়েছে একতলা, দোতলা, তিনতলা। প্রবেশ বারান্দাটি এত প্রশস্ত ছিল যে স্বচ্ছন্দে সেখানে ফুটবল খেলা যেত। ওই ছাদের নীচে তলায় তলায় বারান্দা। সে এক মজার ব্যাপার। পাশ দিয়ে উঠে গেছে রহস্যময় সিঁড়ি। গোল খিলানের তলা দিয়ে সিঁড়ি পাক মেরে-মেরে কোথায় যে নিয়ে যেতে পারে ধারণা ছিল না। পূর্ণধাপ, আধকাটা ধাপ সোজা যেতে-যেতে বাঁ-দিকে ঢুকে আবার ডানদিকে মোচড় মেরেছে। সিঁড়ি দিয়ে তলার হিসেব করার উপায় ছিল না। পুরো বাড়িটাই আমার কাছে ছিল রহস্যের মতো। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর উপন্যাসে বর্ণিত বাড়িটির সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম পরে, তিনি যখন লিখলেন তখন। আমি যখন সেই বাড়িটির সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখন বোলবোলার কাল শেষ হয়ে গেছে। বাড়িটি প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। স্তূপাকার। ছাদের অংশবিশেষ নেমে এসেছে। সিঁড়ির অনেকটাই ধ্বসে গেছে। শুধু বলিষ্ঠ থাম চারটি বিক্ষত যোদ্ধার মতো অতীত ঐশ্বর্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আমি, আমার বন্ধু সেই থামের তলায়, শীতের দুপুরে চুপচাপ বসে থাকতুম। বনেদি পরিবারের রুচিশীল সন্তান, পূর্বপুরুষের কট্টর সমালোচক, শীতের দুপুরে আমার পাশে বসে সাহিত্য আলোচনা করত। আমার চেয়েও তার পড়াশোনার ব্যাপ্তি ছিল অনেক বেশি। কন্দর্পের মতো চেহারা। ভালো ধ্রুপদ গাইত। আমাদের মাথার ওপর কয়েক হাজার পায়রার অবিরত কোঁতপাড়া। সারাদিনই সর্বত্র বালি ঝরে-ঝরে পড়ত। মাঝেমধ্যে বিশাল বাড়ির পেছনের কোনও অংশ ধ্বসে পড়ত। একদা ওই বাড়িটিতে বসে ক্ষীরোদপ্রসাদ নাটক লিখেছিলেন। শুধু বাড়ি নয়, সঙ্গে ছিল শীতের বক-নামা, হাঁস-উড়ে-আসা স্বচ্ছ ঝিল, আর চোখ ভেসে যাওয়া জমি। আমি বৈষয়িক প্রশ্ন করে আমার বন্ধুকে বিব্রত করতুম না। আমি সেই বয়সে আমার অপরিণত বুদ্ধি নিয়েই বুঝে গিয়েছিলাম—এবাড়ি মেরামতের সাধ্য একালের নেই। থাকলেও অপব্যয় হবে। এবাড়ি প্রয়োজনের অতিরিক্ত, পূর্বপুরুষের অহংকার। এবাড়ি কাজের লোকের নয়, কল্পনাবিলাসী পরশ্রমভোগীর।

এবাড়ি গণতান্ত্রিক নয়, স্বেচ্ছাচারী। বাড়িটা ভেঙে পড়ছে বলে আমার যত দু:খ ছিল, আমার বন্ধুর ততটা দু:খ ছিল না। সে জানত , ওই বাস্তু অবাস্তব এক আয়োজন। বর্তমানের চোখে বিলাসী অথর্বের মতোই অপমানকর। আমার চোখের সামনে সেই বাড়ির সংলগ্ন বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ভাগে ভাগে হাতবদল হল। ঝিলের তিনের চার ভাগ চলে গেল মাটির তলায়। দেখতে-দেখতে অতীতের প্রহরী সেই কলোসিয়াম অজস্র একালের বাড়ির অন্তরালে চলে গেল ইতিহাসের হৃৎস্পন্দনের মতো। একটা অংশ আজও আছে। আজও আমার মতো অবস্তুতান্ত্রিক, কল্পনাবিলাসী অপদার্থ, সেই গলিত ইমারতের সামনে দাঁড়িয়ে বিভোর হয়ে যায়। যা ছিল, যা নেই, তার কথা ভেবে সেকালের সঙ্গে একালের একটা বন্ধনসেতু খোঁজার চেষ্টা করে। অবিশ্বাসী মনকে বোঝাতে চায়, এ আমাদের সমাধি নয় শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা। তেলরঙে আঁকা ধূসর পূর্বপুরুষের প্রতিকৃতি তাকিয়ে আছেন খসেপড়া সিঁড়ির দিকে একটা অশুভ দৃষ্টি দিয়ে, যার অর্থ, তোমরা এসো না, আমরা একক অহংকারে থাকতে চাই। প্রেতের মতো, বাস্তুপুরুষের মতো, একক এবং অদ্বিতীয়। নীলরক্তের আমরাই একমাত্র অধিকারী।

এ শুধু একটি উদাহরণ নয়। এমন শতশত উদাহরণ এই গঙ্গার উভয় তীরে ছড়িয়ে আছে। যে বাঙালির হাতে অঢেল ঐশ্বর্য ছিল, অবসর ছিল, তাঁদের মধ্যে ছিল গৃহবিলাস আর উদ্যানবিলাস। কানন-ভ্রমণপ্রিয়, দাসদাসী-পরিবৃত বাঙালি শাসক ইংরেজকুলের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছিলেন ম্যানর অ্যান্ড ম্যানসান বানিয়ে। আমার ঠিক মনে পড়ছে না, হয় অবনীন্দ্রনাথ, না হয় গগনেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যে বাড়িতে কোনও রহস্য নেই, সে বাড়ি বাড়িই নয়। বাড়িতে আনাচকানাচ থাকা চাই, চাই চোরকুঠরি, তলের ভেতর লুক্কায়িত তল, চাই ভূগর্ভস্থ আস্তানা। একই বাড়িতে সাতটি সাত ধরনের সিঁড়ি। সেকালের ঘরের উচ্চতা, একালের চোখে অপচয়।

সেই লাগামছেঁড়া অদূরদর্শিতার মাসুল আজ উত্তরপুরুষকে দিতে হচ্ছে। একজনের সাধনা পরবর্তী সাতজনে কাজিয়া করে শেষ করে দিলে। আমারই চোখের সামনে সেকালের এক মানী মানুষের গঙ্গাতীরবর্তী প্রাসাদোপম বাড়ি তাঁর তিন ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবে, পাড়ার এক শ্রেণির অভিভাবকদের দখলে চলেগেছে। তাঁরা সেখানে ব্যাবসা খুলেছেন। কেনাবেচার ব্যাবসা। জানলা, দরজা খুলে-খুলে বিক্রি করে দিচ্ছে। মার্বল পাথরের মেঝে সাফ। রাস্তায় ফেলে ফার্নিচার নিলাম। বাড়িটি কোর্টে আটকে থাকবে। যত দিন যাবে ততই বাড়ি আর থাকবে না, থাকবে গহ্বরঅলা দেওয়ালঘেরা একখণ্ড স্মৃতিমুখর শূন্যতা। আইনমুক্ত সম্পত্তিতে এখন ঢুকে পড়ছে বড় টাকা, ব্যবসায়ীর টাকা, যে টাকায় বাঙালির কোনও অধিকার নেই। সেকালের কল্পনা, রহস্য, বিলাসিতা, রুচি, অহংকার সমতল হয়ে যাচ্ছে। আকাশের দিকে ঠেলে উঠছে একালের বাড়ি, কাজের বাড়ি, যার কোনও চরিত্র নেই। যার একটিই মাত্র কায়দা ভূমিসংলগ্ন সুউচ্চ শূন্যতাকে কত সহস্রখণ্ড করা যায়।

এক সময় যাঁদের বিপুল বিশাল ছিল, তাঁরা আজ কালের নিয়মে হয় অনিকেত, না হয় ক্ষীয়মাণ, বিস্রস্ত, জেরবার, জীর্ণ। আমি বিষয়ী নই, বিষয়াকাঙ্ক্ষা নেই। আমি জাতিবিদ্বেষী নই, তবু, কেন জানি না, আমার দু:খ হয়। যখন দেখি গঙ্গার ধারের জলটুঙিঅলা ছবির মতো একটি বাগানবাড়ি চলে গেল একালের এক উৎকট রুচির ব্যবসায়ীর হাতে, আমি তখন হাহাকার করে উঠি। যেন আমারই বাড়ি চলে গেল অন্যের হাতে। আমার গায়ে লাগার কথা নয়। আমি থাকি দু-কামরার ক্ষুদ্র ভাড়া বাড়িতে। চিরকাল সেইখানেই থাকব। আমার তো আনন্দ হওয়াই উচিত। অন্যের সর্বনাশে বাঙালির তো প্রফুল্ল হওয়ারই কথা। আমি হতে পারি না। আমি দেখতে পাই সবুজ লনে লোহার কারবারির বোধহীন দাপাদাপি। যে-বাড়ির দোতলার ঘর থেকে এক সময় রাগসঙ্গীতের সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত, এখন সেই ঘরে তারস্বরে বাজে স্টিরিও। ফিল্মি সঙ্গীতের আর্তনাদ। পৃথুলা কোনও মহিলা আভিজাত্য ভুলে উচ্চ কণ্ঠে ডাকেন—এ রামুয়া, রামুয়া রে। ওই অলিন্দে আমার শৈশবে, চকিতে এক লহমার জন্যে যে রমণীদের আমি দেখেছি, তাঁদের রূপ ছিল অন্য রকম, তাঁদের সুর ছিল সুরে সাধা। নয়া জমানার মালিকদের মতো তাঁরা অসুর ছিলেন না। সেই বাগানে সাত রকমের রঙ্গন আজও থোকা হয়ে ফুটে থাকে। ফোটে সতেরো রকমের গোলাপ; কিন্তু কাদের জন্যে ফোটে? সে চোখ কোথায়। লনের চারপাশে সরল রেখার মতো দেবদারুর মস্তশাখায় গঙ্গার আধ্যাত্মিক বাতাস দোল খায়। কোনও প্রাণ কিন্তু আকুল হয় না। এই বাড়ির হাতবদলের ইতিহাস বড় করুণ। অভিজাত বাড়ির উত্তরপুরুষ এই বাগানটি বাঁধা রেখে মদ্যপান করেছিলেন, রেসের মাঠে ঘোড়া ধরেছিলেন। মাত্র দেড় লক্ষ টাকার ফূর্তির খেসারত। বাড়িটির ঘরে-ঘরে যে কার্পেট পাতা আছে, তারই দাম দেড় লক্ষ। যেসব ছবি আর শিল্পবস্তু আছে তার দামও অনেক। আমি সেই আমুদে মানুষটির মনোবেদনা নিজের মনে অনুভব করি। আজ যদি তিনি জীবিত থাকেন, কোথাও, অবশ্যই বৃদ্ধ। রক্তের উন্মাদনা স্থিত হয়েছে। একান্তে বসে এই বাড়িটির কথা ভাবেন, একদিন যা ছিল তাঁরই, সেখানে আর তিনি ফিরতে পারবেন না কোনওদিন।

এ তো গেল এক ধরনের হাতবদল। অসহায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সম্পত্তি। অন্য ধরনের হাত বদলও আছে। যা আজকাল সর্বত্র হচ্ছে। আশাতীত বিরাট অঙ্কের টাকা ধার করে দিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কলকাতার চটকদার এলাকায় বনেদি বাড়ি কিনে নিচ্ছেন। টাকায় সঙ্গে মালিককে দেওয়া হচ্ছে নির্মীয়মাণ বহুতল বাড়ির একটি ফ্ল্যাট। জমির মালিক রূপান্তরিত হচ্ছেন ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের মালিকে। টাকাটা তিনি ব্যাঙ্কে রেখে সুদ খাবেন আর দুই কি তিন কামরার পরিসরে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন পরিবারটিকে ছোট্ট রাখা। সত্য মিথ্যা জানি না, আমি শুনেছি, কলকাতার এক প্রাচীন বাঙালি ব্যাবসা, বহুতল বাড়ি সমেত পঁচিশ কোটি টাকায় হাত বদল হয়ে গেছে। রিয়েল এস্টেস্টের ব্যাবসা কলকাতায় জাঁকিয়ে উঠেছে। স্রোতের মতো টাকা বইছে, সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বাঙালির ভূসম্পত্তির অহঙ্কার। কোথা থেকে আসছে এত টাকা! ধীরে-ধীরে কলকাতা, এমন কি বৃহত্তর কলকাতা বাঙালির হাতছাড়া হতে চলেছে। এই হাতবদল রোকার ক্ষমতা বাঙালির নেই। বাঙালি আর বাগানবাড়ির স্বপ্ন দেখে না। বছরে একবার হয় তো কোনও বাগানে যায় পিকনিকে। অথচ বাঙালির রক্তে আছে গান, কবিতা, ফুল উদ্যান, নিজস্ব জমি, ছাদ, চাঁদের আলো। কথাতেই আছে, সায়েবের গাড়ি, বাঙালির বাড়ি।

আমার মনে আছে, আমার পিতা শুধুমাত্র ডালভাত খেয়ে আর সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে চড়ে সঞ্চয় করতেন। আমাদের বলতেন, জামাকাপড়ের বিলাসিতা ছাড়। ফূর্তি পরে হবে, আগে মাথার ওপর একটা ছাদ হোক। আমরা তখন অসন্তুষ্ট হতাম। ভাড়া বাড়িতে তো বেশ ভালোই আছি। কেন এত কষ্ট। কেন মাছ খাব না, মাংস খাব না! কেন ছুটিতে বিদেশ ভ্রমণে যাব না! কেন অন্যের বই চেয়ে এনে নোট করব! কেন জুতোতে পড়বে তালির পর তালি! পিতা জমি দেখতে শুরু করলেন। তিনশো টাকা কাঠা। বললেন, দাম আর একটু কমুক। উত্তরোত্তর দাম বাড়তেই লাগল। মধ্যবিত্ত মানুষের একার সঞ্চয় একটুকরো জমির নাগাল আর কোনও দিনই পেল না। বলেছিলেন, বাগানঘেরা ছোট্ট একটা বাড়ি হবে। বাড়ি হলে ঘর সাজানো ফার্নিচার হবে। হবে লাইব্রেরি। বসার ঘর। আর হবে মনের মতো একটি ঠাকুর ঘর। জমি না হোক, বাড়ির প্ল্যানটা আগেই ছকা হয়ে গিয়েছিল। তিন হাজার টাকা কাঠার জলা-বোজানো তিন কাঠার একটা টুকরো একবার প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন; কিন্তু মায়ের অসুখে সব সঞ্চয় শূন্য হয়ে গেল। আবার নতুন করে শুরু করেছিলেন। তখন জমির দাম চড়তে চড়তে পঁচিশে গিয়ে ঠেকেছে। মায়ের মৃত্যু, চাকরি প্রায় শেষ। কৃচ্ছ্রসাধনে প্রায় সন্ন্যাসী মানুষটি তাঁর স্বপ্ন আমার কাছে জিম্মা করে দিয়ে একদিন হাসতে-হাসতে চলে গেলেন। পঁচিশ এখন পঁচাত্তরে উঠেছে। একালের মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বলে কিছু নেই। সবই ঋণ।

মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী মানুষকে জমি দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল কল্যাণীতে। অনেকেই নেচে উঠেছিলেন। ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার/চৌদিকে মালঞ্চের বেড়া।’ যোগাযোগের অসুবিধায় কল্যাণী তেমন সফল হল না। আমার এক বন্ধু জমি কিনেছিলেন। অনেকের মতোই তিনি আর বাড়ি করেননি। একদিন শীতের দুপুরে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জমি দেখাতে। আগাছার জঙ্গলে সব হারিয়ে গেছে। একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘মনে হয় এইটা আমার জমি।’ আগাছা ভেদ করে বেরিয়ে এল একটা গিরগিটি। ঘূর্ণায়মান চোখে আমাদের দেখে উঠে গেল জারুল গাছে।

কল্যাণীর পর হল সল্টলেক। প্রথমদিকে জমির দাম ছিল সাধ্যসীমার মধ্যে। পরে দাম বেড়ে গেল। বেড়ে গেল ক্রেতার সংখ্যা। চালু হল লটারি। একথা এখন সকলেরই জানা, টাকার লোভে, জমি সেখানে বাঙালি মধ্যবিত্তের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তবু সল্টলেকে কিছু বাঙালির স্বপ্ন সফল হয়েছে। মনোরম সব বাড়ি উঠেছে। নিজের হাতে বাগান করেছেন। তেলওয়ালা, ঘিওয়ালাদের প্রলোভনের ফাঁদ এড়িয়ে ক’দিন থাকতে পারবেন, সেই হল কথা। পয়সার তাণ্ডব চলছে। বাঙালি ব্যাবসা করতে জানে না। ভূস্বামী হওয়ার স্বপ্ন তাদের দেখার অধিকার নেই। যেখানে কোনও সরকারি পরিকল্পনা নেই, সেখানে জমির কাঠা, দেড়, দুই, আড়াই, তিন লাখ। বাড়ি তৈরির খরচও সেই রকম। এক টাকায় একখানা ইট। আমার সঠিক জানা নেই, তবে আমি শুনেছি সাদামাটা একটা বাড়ি তৈরির খরচ, প্রতি বর্গফুট দুশো টাকা। কজনের সাধ্যে কুলোবে। বাগানঘেরা ছোট্ট বাড়ির স্বপ্ন অতলে লীন। বাঙালি এখন মাথা গোঁজার ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট পেলেই সুখী। আজকাল হাউসিং কো-অপারেটিভ হয়েছে। এক লাখ পঁচাশি, দু’লাখে দুটি দুটি ঘর, একচিলতে বারান্দা, সঙ্কীর্ণ একটি রান্নাঘর, একটি বাথরুম, এক চৌকো খাবার জায়গা মেলে। ওই আশাতীত। ওই ফ্ল্যাটই বা কজন কিনতে পারেন! যাঁরা ভালো চাকরি করেন, অফিস থেকে ঋণ পান তাঁরাই পারেন ফ্ল্যাট কিনতে। জানালায় মানিপ্ল্যান্ট দোলাতে।

আমরা যাঁরা কিছুই পারি না, নোনাধরা চারদেওয়ালের অন্ধকারে প্রায় নরক যন্ত্রণা ভোগ করি। অন্যের সঙ্গে ভাগ করে বাথরুম ব্যবহার করি, জল নিয়ে নিত্য চুলোচুলি করি। আমরা দেখি, শহর আর শহরতলিতে নিশ্বাস নেওয়ার মতো আর এক চিলতে জমি রইল না। সাবেক কালের বেহিসাবি বাড়ি গুঁড়িয়ে চৌরস করে পিঠে ভাগের মতো জমি ভাগ হচ্ছে। ভালো ভালো নামে তৈরি হচ্ছে কলোনি। জলা, জঙ্গল যেখানে যা কিছু ছিল সব চলে যাচ্ছে ইটের খাঁচার তলায়। এক শ্রেণির মানুষের হাতে অনেক পয়সা। সেদিন আমার সহধর্মিণী এক জ্যোতিষীর সামনে আমার হাত পেতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন তো এর হাতে বাড়ি আছে কি না?’ জ্যোতিষী বললেন, ‘আর কী, মেরেই তো এনেছেন! আর ক’বছর এরপর তো চলেই যাবেন নিজ নিকেতনে।’

আমার কোনও ক্ষোভ নেই। একটিই দু:খ জাফরি, জানালা, রঙিন কাচ, বারান্দার নকশাকরা ঢালাই লোহার গ্রিল, কাঠের সিঁড়ি, খাঁজকাটা থাম, খোলামেলা বাগান, যা কিছু সুন্দর আয়োজন, সব শেষ হয়ে গেল। প্রয়োজন সৌন্দর্য্যকে হত্যা করেছে। সেদিন এক অভিনেত্রী বললেন, তিনি দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন—আমার অসহ্য লাগে, চোখে জল এসে যায়। সারাটা দিন শুধু ভাঙার শব্দ। বাঙালিরা পূর্বপুরুষের একশো বছরের প্রাচীন দোরদালান সব ভেঙে মাঠময়দান করে দিচ্ছে। স্কাইস্ক্র্যাপ্যার উঠবে। ছোট-ছোট পায়রার খোপ। সেদিন দেখি ধ্বংস-স্তূপের ওপর পড়ে আছে একটি মার্বেল ফলক। রায়বাহাদুর হরপ্রসাদ ব্যানার্জি। ভোরে শিশির পড়ে মনে হচ্ছে, ফলকের চোখের জল।

সিনেট হল ভেঙে ফেলার সময় আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চোখের সামনে সেই ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছিলাম। কালের নির্দয় প্রহারে উলটে পড়েছে শিক্ষাসত্রের বড় বড় থাম। সেদিন আমার দু:খের সাথী হয়েছিল ঝাঁকঝাঁক পায়রা। ভাঙন আর দেখতে চাই না। কোথাও বাঙালির বাড়ি তৈরি হতে দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ি। বিভোর হয়ে যাই। মনে করি আমারই স্বপ্ন রূপ নিচ্ছে। ইট, বালি, চুন, সুরকি, সিমেন্টের গন্ধ। ছোট হলেও আমার চোখে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। যজ্ঞের হোতা আমারই মতো মধ্যবয়সি এক পুরুষ। তাঁর তিলতিল সঞ্চয়ের টাকা ইটের খাঁজে-খাঁজে। প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে এসেছে। নিজেই জল ঢেলে ইট ভেজাচ্ছেন। সিমেন্টের গুঁড়োয় চটি সাদা হয়ে গেছে। ভারার ওপর দাঁড়িয়ে আছে মিস্ত্রি। ইটে কর্নিক ঠুকছে। দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা জোগাড়ে তার তন্বী শরীর নিয়ে ভারা বেয়ে উঠছে। লম্বা বাঁশের ডগায় ঝুলছে একটা চুপড়ি আর ঝাঁটা। বুরি নজরবালে তেরা মুহ কালা। আমার নজর বুরি নয়। আমি সংগঠনের দৃশ্য উপভোগ করি। মনে-মনে প্রার্থনা করি, সংগ্রামী মানুষটির মঙ্গল হোক। ভিটে অনেকেরই সহ্য হয় না। এঁর যেন সহ্য হয়। অন্তত কুড়িটা বছর যেন ভোগ করে যেতে পারেন। আমার পাড়ায় এক ভদ্রলোক বাড়ি ফেঁদেছিলেন। ছোট্ট এক চিলতে জমি। মিস্ত্রিদের সঙ্গে সপরিবারে কাজ করতেন। আমি উৎসাহ দিতুম। ভিত উঠল। ড্যাম্পকোর্সিং হল। ভদ্রলোক বললেন যা জমেছিল তাতে আপাতত এই পর্যন্ত হল। বছর ঘুরে গেল। সময়ের সামনে চলা। আগাছার তলায় হারিয়ে গেল ভিটে। একদিন ভদ্রলোকের বড় ছেলেকে জিগ্যেস করলুম, ‘কী হল বাকিটা?’ ছেলেটি করুণ হেসে বললে, ‘আর বোধ হয় হবে না। দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে।’ এইসব বাড়ি হল সাধনার বাড়ি। রক্ত দিয়ে তৈরি। বড় টাকার অসভ্য উৎপাত নয়। এর মর্ম আমি বুঝি।

সেদিন ভোরে বেড়াতে-বেড়াতে গঙ্গার পারে গিয়ে দেখি, একখণ্ড জমির ওপর একটি বাড়ি উঠেছে। সিঁড়ি, একতলার ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে। দিনের আলো সবে ফুটেছে। কেউ কোথাও নেই। অদূরে গঙ্গার ঝাপসা বুকে ভেসে আছে গোটা দুই জেলে নৌকা। পাশেই একটি আশ্রম। বিশাল বিশাল প্রাচীন গাছের আড়ালে বাড়িটি ফুটে আছে জীবনসাধনার মতো। অবারিত সেই বাড়িটির মধ্যে অনধিকারীর মতো প্রবেশ করলুম। ঘেরা বারান্দা। দুটি শোওয়ার ঘর। মাঝারি মাপের মেঝে ঢালাই হয়েছে। সিমেন্টের কাজ বাকি। ঘরের পরেই নির্গমন পথ। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে রান্নাঘর, বাথরুম। মনে-মনেই বললুম, এই দুটি আর একটু প্রশস্ত হলে বেশ হত। তারপরেই ভাবলুম, মাপা জমিতে এর বেশি আর কি হবে। গঙ্গার দিকে বড়-বড় জানালা হয়েছে। খুব আনন্দ হল। পশ্চিমে সূর্য যখন হেলবে, জলের বুকে যখন রোদের কাচ ভাঙবে তখন এই ইজিচেয়ারে, পায়ের কাছে লোমঅলা কুকুর। সিঁড়ি ভেঙে ছাদে গেলাম সামনে টলটলে গঙ্গা, পাশে আশ্রম, মাথার ওপর ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা গাছের প্রহরা। ওপারে মন্দিরের চূড়ায় প্রথম সূর্যের আলো। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। মনে-মনে একটা চেয়ার পাতলুম ছাদে। পশ্চিমমুখো। সেই চেয়ারে ধবধবে সাদা থান পরিহিতা, গৌরবর্ণ এক বৃদ্ধাকে বসালুম, তাঁর হাতে তুলে দিলুম রুদ্রাক্ষের মালা। গৃহস্বামীর মা। কার গৃহ, তাঁর মা আছেন কি—না জানি না। তবে আমার মায়ের এইরকম একটা স্বপ্ন ছিল। দেওয়ালঘেরা নিজস্ব একখণ্ড শূন্যতার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *