ঐন্দ্রজালিক

ঐন্দ্রজালিক

[একটুখানি ভূমিকার দরকার। লর্ড লিটন (১৮০৩–১৮৭৩) হচ্ছেন ইংরেজদের একজন প্রধান ঔপন্যাসিক। রোমান্টিক-সাহিত্যে তাঁকে প্রথম শ্রেণির লেখক বলেই গণ্য করা হয় এবং আজও অটুট আছে তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা। আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘রজনী’ রচনার সময়ে লর্ড লিটনেরই একখানি উপন্যাস থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন।

‘The Haunted and the Haunters: or the House and the Brian’ নামে লর্ড লিটনের একটি অত্যন্ত বিখ্যাত কাহিনি আছে, সেটি অবলম্বন করেই ‘ঐন্দ্রজালিক’ রচিত হয়েছে। বিলাতের প্রায় সমস্ত ভৌতিক গল্পসংগ্রহের মধ্যেই এখনও এই কাহিনিটি স্থানলাভ করে।

গল্পটি অবশ্য সেকেলে। রচনাকাল কিছু-কম এক শতাব্দী আগে। কিন্তু লক্ষ করে দেখেছি, এ শ্রেণির গল্প সেকেলে হলেই ছোটোরা পড়তে বেশি ভালোবাসে। তবে গল্পটি লেখা হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্যে। আর আমি খোরাক পরিবেষণ করতে চাই ছোটো ছোটো পড়ুয়াদের কচি কচি হাতে। কাজে-কাজেই লর্ড লিটনের রচনার সেকেলে রূপ না বদলালেও, তার কতক কতক অংশ আমি পরিবর্জন ও পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। এবং দেশ-কাল-পাত্র বদলে ঘটনাস্থল করেছি কলকাতায়, আর আমার পাত্র-পাত্রীরাও অবাঙালি নয়। অতঃপর কথা শুরু হল। তোমরা মন দিয়ে পড়ো এবং শখ করে ভয় পাও। ইতি— ]

জনৈক সাহিত্যিক ও দার্শনিক বন্ধু একদিন আমাকে ডেকে খানিকটা গম্ভীরভাবে ও খানিকটা কৌতূকচ্ছলে বললেন, ‘ধারণা করতে পারো কি, কলকাতা শহরের মধ্যেই আমি একখানা হানাবাড়ি আবিষ্কার করেছি?’

‘হানাবাড়ি! সত্যি?’

‘সত্য-মিথ্যা জানি না ভাই, তবে ব্যাপারটা মোটামুটি এই হপ্তা-ছয়েক আগে একখানা বাড়ির উপরে লেখা আছে দেখলুম— ”এই বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাইবে!” ভিতরে ঢুকে বাড়িখানা পছন্দ হল। বাড়িখানা ভাড়া নিলুম, কিন্তু পালিয়ে আসতে বাধ্য হলুম তিনদিন পরেই। স্ত্রী ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসলেন, ওখানে কিছুতেই তিনি আর একদণ্ডও থাকবেন না। তা তিনি কিছু অন্যায় কথাও বলেননি।’

‘তুমি কিছু দেখেছ?’

‘মাপ করো ভাই, সব কথা শুনলে তুমি হয়তো ঠাট্টা করবে।’

‘ঠাট্টা করব না, বলো।’

‘আমি বিশেষ কিছু বলব না। তবে এইটুকু খালি শুনে রাখো যে, বাড়িখানার মধ্যে একটা আসবাবহীন ঘর আছে, সেখানে গেলেই কী এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে যেত আমাদের দেহ-মন। অথচ সেখানে আমরা কিছু দেখিও নি, শুনিও নি। শেষপর্যন্ত আমাদের তাড়াতে বাধ্য করলে সেই ভীষণ আতঙ্কই! বাড়িখানা আছে এক বুড়ির জিম্মায়। চতুর্থ দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাকে ডেকে বললুম, ”এ বাড়িখানায় আমাদের পোষাচ্ছে না, আমরা আজকেই উঠে যাব।”

বুড়ি শুকনো স্বরে বললে, ”আপনারা কেন উঠে যাচ্ছেন আমি তা জানি। তবু তো আপনারা তিন-তিন রাত্রি এখানে কাটিয়ে গেলেন। আর কোনো ভাড়াটিয়া এখানে উপর-উপরি দুই রাত্রি কাটাতেও ভরসা করেনি। বোধ হচ্ছে আপনাদের উপরে তারা খুব বেশি মাত্রায় সদয়।”

আমি হাসবার চেষ্টা করে শুধোলুম, ”তারা? তারা আবার কারা?”

”তারা যারাই হোক, এ বাড়িতেই থাকে। আমি তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। অনেক কাল আগে এই বাড়িতেই আমি তাদের দেখেছিলুম। অবশ্য এটাও আমি জানি যে, একদিন তারাই হবে আমার মৃত্যুর কারণ। কিন্তু মরতে আমি ভয় পাই না। বুড়ো হয়েছি, শীঘ্রই মরতে তো হবেই! আর মরবার পর আমিও তাদের সঙ্গে বাস করব এই বাড়িতেই।”

বুড়ির কথাবার্তার ধরনধারণ শুনে বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল। তার সঙ্গে আর আলাপ করতে ভরসা হল না। ভগবানকে ধন্যবাদ, এত সহজে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি।’

বন্ধুর কাছে সমস্ত শুনে আমি বললুম, ‘তুমি যে জাগ্রত করলে আমার আগ্রহকে! ঠিকানা দাও, আমিও ওই বাড়িতে রাত কাটাতে চাই।’

বন্ধু ঠিকানা দিলেন।

মদনবাবু স্ট্রিটের ওপর সেই বাড়িখানা। কিন্তু তার গায়ে টাঙানো নেই কোনো ভাড়াপত্র। সদর দরজাতে বাহির থেকে তালা দেওয়া। প্রত্যেক জানলাও বন্ধ।

কী করব ভাবছি, এমন সময়ে এক ছোকরা এসে শুধোলে, ‘কাকে চাই?’

‘এই বাড়িখানা ভাড়া দেওয়া হবে না?’

‘ভাড়া! যে বুড়ির জিম্মায় বাড়িখানা ছিল, সে তিন হপ্তা আগে মারা পড়েছে। বাড়ির মালিক জগদীশবাবু দেখাশোনা করবার জন্যে নতুন লোক খুঁজছেন, কিন্তু লোক পাচ্ছেন না।’

‘পাচ্ছেন না। কেন?’

‘এটা হচ্ছে হানাবাড়ি। যে বুড়ি এখানে থাকত, একদিন সকালে দেখা গেল বিছানার উপরে সে মরে আড়ষ্ট হয়ে আছে— কটমট করে দুই চোখ খুলে। সবাই বলে, ভূতে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।’

‘বাজে কথা রাখো। বাড়ির মালিক জগদীশবাবুর ঠিকানা জানো।’

‘জানি। দশ নম্বর দীনেশ দাস স্ট্রিট।’

‘তিনি কী করেন?’

‘কিছুই করেন না, এমনকী বিয়েও করেননি। একলা থাকেন, ধনী ব্যক্তি।’

কাছেই দীনেশ দাস স্ট্রিট। জগদীশবাবুর সঙ্গে দেখা করলুম। তাঁর বয়স হবে বছর পঞ্চাশ। বুদ্ধিমানের মতো চেহারা, ভাবভঙ্গি মার্জিত।

বললুম, ‘শুনছি আপনি একখানা হানাবাড়ির মালিক। আমি জেনে-শুনেই বাড়িখানা ভাড়া নিতে চাই।’

বেশ নম্রভাবে জগদীশবাবু বললেন, ‘দয়া করে ভাড়ার কথা ভুলে যান, ও বাড়ি আমি আর ভাড়া দেব না। তবে বিনা ভাড়াতেই বাড়িখানা আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি, যদি আপনি ওর বদনামের কারণ আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে আমার যথেষ্ট উপকার হয়। বদনামের জন্যে বাড়িখানা আমার কোনো কাজেই লাগে না; এমনকী, মাহিনার লোভেও বাড়িখানা কেউ জিম্মায় রাখতে চায় না।’

‘কিন্তু এতদিন এক বুড়ি তো ওখানে বাস করত?’

‘হ্যাঁ, সে এখন মারা পড়েছে। একসময়ে আমার খুড়োর কাছ থেকে বাড়িখানা ভাড়া নিয়ে সে ওইখানেই বাস করত আর তখন তার অবস্থাও ছিল ভালো। সে বেশ লেখাপড়া জানত, তার মনেরও জোর ছিল খুব। ইদানীং গরিব আর অসহায় হয়ে পড়েছিল বটে, কিন্তু একমাত্র সে ছাড়া ওই বাড়িতে আর কেউ বাস করতে পারত না। তার মৃত্যুও রহস্যময়। পুলিশ তদন্তের ফলে যা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে করে বাড়ির বদনাম আরও বেড়ে গিয়েছে। শুনতে পাই, কেবল রাত্রে নয়, দিনেও ওখানে অলৌকিক উপদ্রব হয়।’

‘বাড়ির এই বদনাম হয়েছে কত দিন?’

‘তা আমি ঠিক জানি না। তবে সেই বুড়ির মুখে শুনেছি, ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর আগে সে যখন এ বাড়িখানা ভাড়া নিয়েছিল, ভৌতিক উপদ্রব হত তখনও। আমার নিজের প্রথম জীবনটা কেটে গিয়েছে বাংলাদেশের বাইরেই। কয়েক বৎসর আগে আমার নিঃসন্তান খুড়ো মারা গেছেন। তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। কাজেই ও-বাড়ির পুরানো খবর আমার জানা নেই। কিন্তু আমি এখানে এসে পর্যন্ত দেখছি, কোনো ভাড়াটিয়াই ওখানে দুই-তিন রাত্রির বেশি থাকতে চায় না বা পারে না। আর প্রত্যেক ভাড়াটিয়ার মুখেই শুনি নতুন নতুন গল্প; কোনো গল্পের সঙ্গে কোনো গল্পেরই মিল নেই।’

‘ও-বাড়িতে রাত কাটাবার কৌতূহল কি আপনার কোনোদিন হয়নি?’

‘রাত কখনো কাটাইনি বটে, তবে একবার দিনের বেলায় ওখানে ছিলুম ঘণ্টা তিনেক। ফলে কৌতূহল মেটেনি বটে, কিন্তু দমন করতে বাধ্য হয়েছি। আর ওখানে পদার্পণ করবার সাধ বা সাধ্য আমার নেই। আমি কী দেখেছি আর কী শুনেছি আপনার কাছে তাও বলতে চাই না। তবে আপনাকে এ উপদেশ দিতে পারি, আপনারও পক্ষে উচিত, ওখানে রাত্রিযাপন না-করা।’

আমি দৃঢ়স্বরে বললুম, ‘না, ওখানেই আমি রাত কাটাব! আমার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছি। নিজেকে সাহসী বলে প্রচার করতে চাই না, তবে ভূতুড়ে বাড়িতে গিয়েও যে আমি ভয় পাব না, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।’

জগদীশবাবু আর কিছু না বলে বাড়ির কতকগুলো চাবি আমার হাতে সমর্পণ করলেন।

ভূতুড়ে বাড়িতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবার অধীর আগ্রহ নিয়ে ফিরে এলুম নিজের বাড়িতে। ডাকলুম বিশ্বস্ত ভৃত্য নিবারণকে।

নিবারণ হচ্ছে জোয়ান যুবক, যেমন নির্ভীক তেমনি আমুদে।

বললুম, ‘নিবারণ, মনে আছে পাঁচপাড়ার সেই পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির কথা লোকে বলত যেখানে একটা মুণ্ডহীন কবন্ধ ভূত রোজ রাত্রে দেখা দেয়?’

‘মনে আছে কর্তা!’

‘আমরা কিন্তু সারা রাত সেখানে থেকেও কোনো মুণ্ডহীন দেহ বা দেহহীন মুণ্ড দেখতে পাইনি।’

‘হ্যাঁ কর্তা। এমনকী, একটা মুণ্ডওয়ালা ভূতও দয়া করে উঁকি মারতে আসেনি।’

‘কিন্তু খবর পেলুম এই কলকাতাতেই এমন একখানা বাড়ি আছে, সত্যসত্যই যা ভূতুড়ে। আজ রাতটা আমি সেইখানেই কাটাতে চাই। সেখানে ভয়ানক একটা-কিছু দেখতে পাবার সম্ভাবনা আছে। তুমি কি সেখানে আমার সঙ্গে থাকতে রাজি আছ?’

সানন্দে নিবারণ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ কর্তা, আমি যাবই যাব! ভূত আমার পুত শাঁকচুন্নি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছেন ভয়টা আমার কি!’

‘হয়েছে, আর বলতে হবে না। তবে এই নাও চাবি আর বাড়ির ঠিকানা। আমার মোটমাট নিয়ে তুমিই আগে সেখানে যাও। সব ঘরের জানলা খুলে দেবে, অনেক দিন সেখানে আলো-বাতাস ঢোকেনি। তারপর একখানা ভালো ঘর বেছে নিয়ে বিছানা পেতে রাখবে। আর ভালো কথা। আমার রিভলভার আর ছোরাখানাও নিয়ে যেতে ভুলো না যেন। তোমার বুকে রাম-লক্ষ্মণ, আর আমার হাতে রিভলভার-ছোরা, এর মহিমায় আমরা কি ডজন খানেক ভূতের মহড়া নিতে পারব না?’

‘খুব পারব কর্তা।’

‘বেশ, তবে যাও।’

সন্ধ্যার পর রাত্রের আহার সেরে যাত্রা করলুম ভূতুড়ে বাড়ির দিকে। সঙ্গে চলল আমার শখের বুল-টেরিয়ার, পৃথিবীর কোনো কিছুর তোয়াক্কা যে রাখে না।

গ্রীষ্মকালের রাত্রি। আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘ, তাদের আনাগোনার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে চাঁদের মুখ মাঝে মাঝে। কিন্তু সে ম্লান চাঁদের মুখ। মেঘরা একেবারে বিদায় না নিলে উজ্জ্বল হবে না চন্দ্রমুখ।

যথাস্থানে এসে সদরের কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিলে নিবারণ।

‘কী খবর নিবারণ?’

‘ভালো খবর কর্তা, ভালো খবর!’

কিঞ্চিৎ নিরাশ হয়ে বললুম, ‘সে কি হে! কিছু দেখও নি, শোনোও নি?’

‘কি জানেন কর্তা, একটা আজব কিছু শুনেছি বটে।’

‘কীরকম, কীরকম?’

‘আমার পিছনে পিছনে যেন কাদের পায়ের শব্দ! আশেপাশে যেন কাদের ফিস ফিস কথা! তা ছাড়া আর কিছু নয়।’

‘ভয় পাওনি তো?’

‘রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছেন ভয়টা আমার কি?’

নিবারণের মতন সঙ্গী পেয়ে কতকটা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলুম। তারপরই দেখলুম আমার কুকুরের অদ্ভুত ব্যবহার। প্রথমটা সে বেশ প্রফুল্লভাবে বাড়ির ভিতরে দৌড়ে গেল, কিন্তু তারপরেই ল্যাজ গুটিয়ে ফিরে এসে বন্ধ সদর দরজাটা আঁচড়াতে ও কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগল। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। ব্যাপার কী?

আদর করে বার কয়েক তার মাথা চাপড়াতে সে যেন খানিকটা শান্ত হল এবং আমার সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগল। কিন্তু আর সে নিজের অভ্যাসমতো ছুটে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে না, চলতে লাগল আমার পায়ে পায়ে জড়িয়ে।

আগে দেখা দরকার বাড়ির ঘরগুলো।

প্রথমে পরীক্ষা করলুম একতালাটা। সব ঘরই স্যাঁৎসেঁতে, ধূলিধূসরিত। উঠানের অবস্থাও তাই, এবং এইখানেই ঘটল প্রথম অদ্ভুত ঘটনা।

শান-বাঁধানো উঠান বটে, কিন্তু উপরে জমে আছে পুরো ধুলো। হঠাৎ দেখলুম আমার সামনেই ধুলোর উপরে এক পদচিহ্ন!

ইঙ্গিতে নিবারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলুম সেইদিকে।

তারপর দুইজনেই একসঙ্গে স্পষ্ট দেখলুম, প্রথম পদচিহ্নের পরেই ফুটে উঠল দ্বিতীয় পদচিহ্ন, তারপর আবার তৃতীয় এবং চতুর্থ এবং পঞ্চম পদচিহ্ন! তারপরই খাড়া দেওয়াল, আর কোনো পদচিহ্ন দেখা গেল না।

কিন্তু লক্ষ করলুম, এগুলোর প্রত্যেকটাই হচ্ছে শিশুর পায়ের ছাপ।

দুজনেই নীরবে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে প্রবেশ করলুম একখানা মাঝারি আকারের ঘরের ভিতরে। বোধ হয় এটা ছিল বৈঠকখানা। এখনও সেকেলে সোফা, কৌচ, চেয়ার, আয়না ও ছবি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো রয়েছে। নিশ্চয়ই সেই বুড়ি এগুলো ব্যবহার করত এবং তার মৃত্যুর পর আসবাবগুলো এখনও এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়নি।

ঘরখানাকে আরও ভালো করে দেখবার জন্যে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়লুম। পাশের টেবিলের উপরে নিবারণ তার হাতের বাতিদানটা স্থাপন করলে। আমি তাকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিতে বললুম। এই সময়ে ঘটল দ্বিতীয় ঘটনা।

নিবারণ পিছন ফিরতেই ওধারের দেওয়ালের কাছ থেকে একখানা চেয়ার হঠাৎ জীবন্ত হয়ে একেবারে নিঃশব্দে এগিয়ে আমার কাছ থেকে হাত-দুই তফাতে এসে আবার নিশ্চল হয়ে পড়ল।

‘বাঃ, এ যে দেখছি টেবিল-চালানোরও চেয়ে মজার ব্যাপার!’ চুপি চুপি এই কথা বলে আমি চাপা গলায় হেসে উঠলুম, কিন্তু আমার কুকুর কেঁদে উঠল উচ্চকণ্ঠে।

পিছন ফিরে দরজা বন্ধ করছিল বলে চেয়ারের আশ্চর্য কীর্তি নিবারণের দৃষ্টিগোচর হয়নি। সে তাড়াতাড়ি কুকুরটার কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

আমি তখনও সেই চেয়ারখানার দিকে তাকিয়ে রইলুম একদৃষ্টিতে। মনে হল তার উপরে বসে আছে যেন নীলাভ কুয়াশা দিয়ে গড়া একটি মনুষ্য-মূর্তি। কিন্তু মূর্তিটা এত অস্পষ্ট যে আমার চোখের ভ্রমও হতে পারে।

কুকুরটা এইবার চুপ করেছে। বললুম, ‘নিবারণ, আমার সামনের চেয়ারখানা ওপাশের দেওয়ালের কাছে রেখে এসো তো!’

চেয়ারখানা নিয়ে কয়েক পদ অগ্রসর হয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নিবারণ ফিরে বললে, ‘কর্তা!’

‘কী নিবারণ?’

‘আমার পিঠের ওপরে আপনি এত জোরে চড় মারলেন কেন কর্তা?’

‘আমি মারিনি নিবারণ।’

‘তবে কে মারলে?’

‘বোধ হয় কোনো জাদুকর এখানে ভোজবাজির খেল দেখিয়ে আমাদের অবাক করে দিতে চায়। ভেল্কিটা যে কী ধরতে পারছি না বটে, কিন্তু আজ রাত ফুরোবার আগেই তাকে আমরা ধরে ফেলবই ফেলব!’

বৈঠকখানার বাইরে এসে তালাবন্ধ করলুম দরজায়। প্রত্যেক ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই একই সাবধানতা অবলম্বন করেছি। ‘সাবধানের মার নেই’— কথায় বলে।

তিনতলার একখানা ঘরে নিবারণ করেছিল আমার শয়নের ব্যবস্থা। সেই ঘরে ঢুকলুম। বেশ ঘরখানি, রাস্তার দিকে পরে পরে তিনটে জানলা। একখানা সেকেলে পালঙ্কের উপরে আমার বিছানা পাতা। এই ঘরের দেওয়ালের মাঝখানে আর একটা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে যাওয়া যায়। নিবারণ সেখানা নিজের রাত্রিবাসের জন্যে নির্বাচিত করেছিল।

সেই ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলুম, কিন্তু দরজা খুলল না।

নিবারণ সবিস্ময়ে বললে, ‘এ কীরকম হল কর্তা! দরজা তো খোলাই ছিল! আর ভিতর থেকেও তো বন্ধ হতে পারে না, দরজার খিলটা ভাঙা!’

কিন্তু তার মুখের কথা ফুরোতে-না-ফুরোতেই দরজাটা আবার খুলে গেল আপনা আপনি!

আমরা দুজনেই তাকালুম দুজনের মুখের দিকে এবং দুজনের মনের ভিতরে নিশ্চয় এই সন্দেহই জেগে উঠল— ঘরের ভিতরে লুকিয়ে আছে বাইরের কোনো লোক।

বেগে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলুম। আমার পিছনে পিছনে নিবারণ।

কেউ নেই সেখানে! ছোট্ট একখানা ঘর, ছোট্ট জানলা একটিমাত্র। কোনোদিকে নেই দ্বিতীয় দরজা পর্যন্ত। একখানা চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাবও দেখলুম না। আত্মগোপন করবার উপায় নেই তার মধ্যে কোথাও।

হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে দরজাটা নিঃশব্দে আবার বন্ধ হয়ে গেল তেমনি আপনা আপনি! বন্দি, আমরা বন্দি!

সর্বপ্রথমে এই অনুভব করলুম কী এক অবর্ণনীয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আমার মনের অন্দরে।

দমেনি কিন্তু নিবারণ। বললে, ‘কর্তা, ওরা কি ভেবেছে আমাদের ফাঁদে ফেলবে? ওই বাজে নড়বড়ে দরজাটা আমার একটা লাথিও সহ্য করতে পারবে না।’

‘তার আগে হাত দিয়ে টেনে দেখ দরজাটা খোলে কিনা। ততক্ষণে জানলার ধারে গিয়ে দেখে আসি, বাইরে কী আছে।’

উঁকি মেরে দেখলুম, বাইরে রয়েছে আর একটা শান-বাঁধানো আঙিনা। তেতালার সেই জানলার তলায় পা রেখে দাঁড়ানো চলে এমন কোনো কার্নিস পর্যন্ত নেই! এ জানলা দিয়ে ভিতরে ঢোকা বা বাইরে বেরুনো— দুইই অসম্ভব।

ওদিকে প্রাণপণ টানাটানির পরেও দরজা যখন খুলল না, নিবারণ ফিরে বললে, ‘হুকুম দিন কর্তা, লাথি মেরে দরজাটা ভেঙে ফেলি!’

আমার বুক ছ্যাঁৎ-ছ্যাঁৎ করছিল বটে, কিন্তু নিবারণের কোনোরকম ভাবান্তরই হয়নি। এখনও তার মুখ রীতিমতো প্রফুল্ল। তার উপরে আমার শ্রদ্ধা হল। এমন সঙ্গী পাওয়া বহু ভাগ্যের কথা। বললুম, ‘তাই করো নিবারণ, দরজাটা ভেঙেই ফ্যালো।’

পড়তে লাগল দরজার উপরে দমাদম লাথি। নিবারণ দস্তুরমতো বলিষ্ঠ ব্যক্তি, কিন্তু তারও প্রচণ্ড লাথির পর লাথির চোটে দরজাটা কেঁপেও উঠল না একবার! শেষটা হাঁপিয়ে পড়ে সে ছেড়ে দিলে ব্যর্থ প্রচেষ্টা! আমিও চেষ্টা করলুম, ফল হল একই।

আবার মন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে আতঙ্কে। এবারের আতঙ্ক আরও প্রবল। মনে হতে লাগল যেন কোনো অপার্থিব, দূষিত বাষ্প কক্ষতল থেকে ঊর্দ্ধে উঠে মানুষের পক্ষে বিষাক্ত এক প্রভাব বিস্তার করছে সমস্ত ঘরখানার মধ্যে।

তারপরই আর এক ব্যাপার। সেই আশ্চর্য দরজাটা আবার আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে একটু-একটু করে এবং নিঃশব্দে, অতি নিঃশব্দে! খুলে যাচ্ছে অতি নিঃশব্দে আপনা-আপনি।

ছুটে খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। আমরা দুজনেই দেখলুম— অতিশয় বিস্ফারিত চক্ষেই দেখলুম, মস্ত একটা বিবর্ণ আলোক— মস্ত একটা মনুষ্য-মূর্তির মতোই, কিন্তু গঠনহীন ও অবাস্তব, আমাদের সামনে নড়েচড়ে উঠল এবং তারপর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বয়ে নামতে লাগল নীচের দিকে। আলোটাকে অনুসরণ করলুম আমি এবং নিবারণ করলে আমাকে অনুসরণ।

আলো প্রবেশ করলে দোতালার একখানা ঘরের ভিতরে। এবং তারপর এক প্রান্তের একটি শয্যার উপরে গিয়ে তা পরিণত হল হঠাৎ সর্যপের মতো ছোটো, কিন্তু বিদ্যুতের মতো সমুজ্জ্বল একটি বর্তুলে। এক মুহূর্ত সেখানে স্থির হয়েই কাঁপতে কাঁপতে একেবারে নিবে গেল সেই অদ্ভুত আলোকবিন্দু।

শয্যার পাশেই একটা আলমারি। তার একটা দেরাজ টেনে দেখি, ভিতরে রয়েছে একখানা পুরাতন, বিবর্ণ রুমাল। খুব সম্ভব সেই বুড়িই ছিল এর মালিক। আর এই ঘরখানাই ছিল তার শয়নগৃহ।

কেন জানি না, জাগ্রত হয়ে উঠল আমার কৌতূহল! আর একটা দেরাজ ধরে মারলুম এক টান। তার ভিতরেও রয়েছে নারীদের ব্যবহার্য পোশাক-পরিচ্ছদের এটা-ওটা-সেটা এবং বিবর্ণ হলদে ফিতে দিয়ে বাঁধা খান দুই চিঠি। ঝোঁক সামলাতে পারলুম না, চিঠি দু-খানা হস্তগত করলুম। সেখানে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই দেখতে পেলুম না। আবার জ্বলে উঠল না সেই অস্বাভাবিক আলোকটাও। কিন্তু শুনতে পেলুম একটা অভাবিত শব্দ! হ্যাঁ, স্পষ্ট শুনতে পেলুম কারুর পদশব্দ! আমরা অগ্রসর হচ্ছি, আর ঠিক আমাদের সামনে সামনেই অগ্রসর হচ্ছে সেই পদধ্বনি! চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কানে শুনছি কেবল সেই পদধ্বনি— অদৃশ্য চরণের ভয়াবহ পদধ্বনি! কে যেন হেঁটে চলেছে আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে— কিন্তু আমাদের আগে আগেই!

চিঠি দু-খানা ছিল আমার হাতে। কিন্তু ঘর থেকে যেই বাইরে পা দিয়েছি, কে যেন আমার কবজি চেপে ধরে হাত থেকে চিঠি দু-খানা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে— দুর্বল, কোমল সেই হাতের স্পর্শ! আরও জোর করে চেপে ধরলুম চিঠি দু-খানা, সঙ্গেসঙ্গে আর অনুভব করলুম না সেই অদৃশ্য হাতের স্পর্শ।

আমার জন্যে নির্দিষ্ট শয়নগৃহে প্রবেশ করতেই আবিষ্কার করলুম, আমার কুকুরটা ঘরের এককোণে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছে।

বললুম, ‘নিবারণ, আমার রিভলভার আর ছোরা এনে এই টেবিলের উপরে রাখো। তারপর কুকুরটার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দাও।’

নিবারণ আমার আদেশ পালন করলে। কুকুরটা কিন্তু গায়ে হাত বুলানোর আরাম গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না; থামল না তার ঠক ঠক করে কাঁপুনি।

কিন্তু আমি তার উপরে চোখ রাখতে পারলুম না, কারণ সেই চিঠি দু-খানা পড়বার জন্যে তখন যারপরনাই বেড়ে উঠছিল আমার মনের আগ্রহ। একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের ধারে বসে একমনে পত্রপাঠ করতে লাগলুম।

চিঠি দু-খানা ছোটো। তারিখ দেখে বোঝা গেল ঠিক ছত্রিশ বছর আগে লেখা। স্ত্রীকে সম্বোধন করে চিঠি দু-খানা লিখেছে কোনো স্বামী। লেখার ধরন দেখলেই ধরা যায়, পত্রলেখক রীতিমতো শিক্ষিত। কিন্তু জায়গায় জায়গায় পাওয়া যায় যেন কোনো গুপ্ত অপরাধের ইঙ্গিত। যেমন

১. ‘খুব সাবধান, জানাজানি হয়ে গেলে সবাই আমাদের অভিশাপ দেবে।’

২. ‘রাত্রে ঘরের ভিতরে আর কোনো লোক নিয়ে শুয়ো না। তোমার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা কওয়ার বদ-অভ্যাস আছে।’

৩. ‘যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। আমাদের ভয় কী, আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। মরা মানুষ আর বাঁচে না।’— এইখানে মেয়ে হাতে ব্রাকেটের ভিতরে লেখা— (‘হ্যাঁ, মরাও আবার বেঁচে ওঠা!’)

চিঠি দু-খানা টেবিলের উপরে রেখে দিয়ে মনে মনে তার মর্মার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করলুম খানিকক্ষণ।

তারপর টেবিলের উপরে দু-দুটো বাতি জ্বেলে তার উপরেই রাখলুম আমার ঘড়ি, রিভলভার ও ছোরা। নিবারণকে ডেকে বললুম, পাশের ঘরে গিয়ে সে যেন ঘুমিয়ে না পড়ে, আর দুই ঘরের মাঝখানকার দরজা যেন খোলা রাখে।

স্থির করলুম, নিদ্রাদেবীকে বিদায় দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়েই আজকের রাতটা কাটাতে হবে। যা-কিছু দেখব, যা-কিছু শুনব, যা-কিছু ঘটবে, আমি প্রস্তুত হয়ে থাকব সবকিছুর জন্যেই।

শুয়ে পড়েছি বিছানায়। পুস্তক পাঠ করছি, উপন্যাস নয়— প্রবন্ধপুস্তক। যা জাগ্রত করে অলীক কল্পনাকে, আজকের মতো রাতে এমন কোনো গ্রন্থ বর্জন করাই উচিত।

বাতির শিখা নিষ্কম্প ও সমুজ্জ্বল। পাশের ঘরে গিয়েছে নিবারণ। কুকুরটাও পাপোশের উপরে গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিশ মিনিট কাটল। এখন রাত বারোটা।

হঠাৎ মনে হল, সাঁ করে আমাকে ছুঁয়ে বয়ে গেল একটা দমকা কনকনে হাওয়া!

ঘরের দরজাটা কি তবে খুলে গিয়েছে? মাথা তুলে দেখি— না, যেমন বন্ধ ছিল তেমন বন্ধ আছে দরজা।

টেবিলের দিকে আকৃষ্ট হল দৃষ্টি। একটু আগেকার নিষ্কম্প দীপশিখা এখন থর-থর-থর কম্পমান! কোথাও কেউ নেই, অথচ টেবিলের উপর থেকে আমার ঘড়িটা ধীরে ধীরে যাচ্ছে সরে, সরে, সরে— তারপর একেবারেই অদৃশ্য!

বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়লুম। চট করে টেবিলের উপর থেকে তুলে নিলুম আমার রিভলভার আর ছোরাখানা— ওভাবে হারাতে রাজি নই আমার আত্মরক্ষার অস্ত্র!

খাটের শিয়রের দিকে জোরে জোরে কিন্তু ধীরে ধীরে তিন বার আওয়াজ হল— ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক!

পাশের ঘর থেকে নিবারণ শুধোলে, ‘ও শব্দ করছেন আপনিই কি কর্তা?’

বললুম, ‘না, খুব হুঁশিয়ার থাকো!’

কুকুরটা জেগে উঠে থেবড়ি খেয়ে বসল এবং তার কান দুটো নড়তে লাগল একবার সু%মুখ ও একবার পিছন দিকে। তার চক্ষু অত্যন্ত আশ্চর্যভাবে আমার মুখের উপরে নিবদ্ধ। আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়াল— তার সর্বাঙ্গের লোম খাড়া, দেহ আড়ষ্ট, দৃষ্টি বন্য!

নিবারণও পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তেমন চরম আতঙ্কে বিকৃত মানুষের মুখ আমি আর কখনো দেখিনি! তার মুখের ভাব এমন বদলে গিয়েছে, রাজপথে দেখলে তাকে আর চিনতে পারতুম না।

দ্রুতপদে আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে ফিস ফিস করে বলে গেল, ‘পালান, পালান, পালান! আমাকে সে ধরতে আসছে!’ একটানে দরজা খুলে সে বাইরে গিয়ে পড়ল।’

‘দাঁড়াও নিবারণ! দাঁড়াও, দাঁড়াও!’

কিন্তু সে আমার কথা কানেও তুললে না— বেগে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। এক এক লাফে তিন-চার ধাপ পার হয়ে সে চলে গেল চোখের আড়ালে। সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনলুম সদর দরজা খোলার শব্দ। তারপরই সব চুপচাপ। হানাবাড়িতে আমি একাকী।

এখন উপায়? কাপুরুষের মতো আমিও পালাব? না, অসম্ভব! যা থাকে কপালে, শেষ পর্যন্ত দেখবই দেখব! ঘরে ঢুকে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলুম। নিবারণের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালুম। কিন্তু সেখানে এমন কিছুই নেই যা দেখে সে ভয় পেতে পারে। সেই মূর্তিমান আতঙ্ক তার ঘরে ঢুকলই বা কেমন করে? যেইই এখানে আসুক, আগে তাকে আমার ঘর দিয়ে আসতেই হবে।

আবার নিজের ঘরে এলুম। নিবারণের ঘরে লাগিয়ে দিলুম তালা।

কুকুরটা এখন ঘরের কোণে। এমনভাবে সে দেওয়াল ঠেসছে, যেন প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে যেতে চায়। কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকলুম। কিন্তু সে বোধ করি ভয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে। সে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, তার চোয়াল বয়ে টসটস করে লাল ঝরতে লাগল। আমি তাকে ছুঁলেই নিশ্চয় সে আমাকে কামড়ে দিত। আমাকে সে চিনতে পর্যন্ত পারলে না। তাকে আর ঘাঁটানো নিরাপদ নয় বুঝে আবার টেবিলের ধারে এসে চেয়ারের উপরে বসে পড়লুম। রিভলভার ও ছোরা টেবিলের উপরে স্থাপন করে বই নিয়ে পড়তে লাগলুম।

পড়তে পড়তে লক্ষ করলুম, বাতির আলো আর আমার হাতের কেতাবের মাঝখানে এসে পড়েছে একটা ছায়া। মুখ তুলে যা দেখলুম তা বোধ হয় ঠিকভাবে বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়।

শূন্যের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করছে একটা অন্ধকার, কিন্তু আকার তার অনিশ্চিত। তাকে ঠিক মনুষ্য-মূর্তি বলতে পারি না; তবে মানুষের মূর্তির সঙ্গে না বলে যদি বলি, মানুষের ছায়ামূর্তির সঙ্গে তার কতকটা সাদৃশ্য আছে, তাহলে হয়তো অনেকটা ঠিক বলা হবে। শূন্যতা এবং আলোক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সে বিরাজমান এবং আকার তার বিরাট! তার দেহের নিম্নার্দ্ধ আছে কক্ষতলে, কিন্তু উপরার্দ্ধ স্পর্শ করেছে ছাদের কড়িকাঠ!

নিদারুণ একটা শৈত্য এসে আক্রমণ করলে আমার সর্বাঙ্গ। বরফের পাহাড়ের উপরে নিক্ষিপ্ত হলেও আমি এতটা শীতলতা অনুভব করতে পারতুম না। তাকিয়ে আছি— তাকিয়ে আছি এবং তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন আমি দেখলুম, খুব উঁচু থেকে আমাকে লক্ষ করছে দু-দুটো ভাঁটার মতো চক্ষু! একমুহূর্ত জেগে রইল চোখ দুটো, তারপর মুহূর্তেই হল অদৃশ্য। কিন্তু তাদের বদলে সেখানে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলতে লাগল দুটো বিবর্ণ নীল আলো! নীল আলো— একটা-দুটো!

কথা কইবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। তখন মনে মনে বললুম, ‘এই কি ভয়? না, এটা ভয় নয়।’

চেয়ার ছেড়ে ওঠবার চেষ্টা করলুম— কিন্তু মিথ্যা চেষ্টা! যেন মহাভার কোনো শক্তি আমাকে চেপে আছে। যেন আমার ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বিপুল ও আচ্ছন্নকারী কোনো মহাশক্তি! অকূল সাগরে প্রবল ঝটিকা, বিজন অরণ্যে হিংস্র ব্যাঘ্র বা অতল জলে ভীষণ কুম্ভীরের সম্মুখীন হলে মানুষের যে অবস্থা হয়, আমার তখনকার অবস্থাও কী তেমনি অসহায়।

এই অসহায় ভাবটা ক্রমেই এতটা বেড়ে উঠল যে, ভাষায় তা বর্ণনা করা অসম্ভব। তবু সাহস না থাক, হারালুম না আমার গর্ব। মনে মনে জোর করে বললুম, ‘থাকুক সামনে শরীরী বিভীষিকা— ভয় পাব না, আমি ভয় পাব না! আমার যুক্তি বলছে— যা দেখছি, সব মিথ্যা; এ ভ্রান্তি ভিন্ন অন্য কিছুই নয়— একে আমি ভয় করি না!’

অবশেষে প্রাণপণ চেষ্টায় হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে রিভলভারটা তুলে নিতে গেলুম— সঙ্গেসঙ্গে যেন বিদ্যুতাহত ও শক্তিহীন হয়ে নীচের দিকে ঝুলে পড়ল আমার বাহুখানা।

বিপদের উপরে আবার বিপদ! বাতিদুটোর শিখা দপ করে নিবে গেল না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে একেবারে মিলিয়ে গেল। বাতি যেন তার অগ্নিজিহ্বা আস্তে আস্তে টেনে নিলে মুখের ভিতরে! মিনিট কয়েকের ভিতরেই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল নীরন্ধ্র অন্ধকার।

অন্ধকারের মধ্যে আমি, আর সেই ভয়াল কৃষ্ণচ্ছায়া-মূর্তি। মানুষ আর কত সইতে পারে! সমস্তরই চরম অবস্থা আছে তো, অতিরিক্ত বাতাস ভরলে রবারের বল যেমন ফেটে যায়, আমিও হঠাৎ সেই নিদুটীর মায়াজাল বিদীর্ণ করে আত্মস্থ হলুম এবং ফিরে পেলুম আমার কণ্ঠস্বর— অর্থাৎ চীৎকার করবার শক্তি।

খুব জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলুম, ‘আমি ভয় পাইনি, আমার আত্মা ভয় পায়নি— না, না, না!’

সঙ্গেসঙ্গে অনুভব করলুম আর আমি চলচ্ছক্তিহীন নই! বেগে দৌড়ে জানলার কাছে গিয়ে সরিয়ে দিলুম পর্দাখানা। আগে আলো চাই, আলো! অন্ধকারে আলো! নরককূপে স্বর্গীয় আলো!

ওই তো চন্দ্র! নির্মল, প্রশান্ত, জ্যোতির্ময়! অসীম নীলিমা থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে দুগ্ধধবল আলোকধারা— না, না, দীপ্তিমান আনন্দধারা! মাথার উপরে চাঁদ, পায়ের তলায় পথিকহীন ঘুমন্ত রাজপথ, কিন্তু বৈদ্যুতিক দীপমালায় উদ্ভাসিত।

ঘরের ভিতরদিকে ফিরে তাকালুম। খানিকটা জ্যোৎস্না এখানেও এসে পড়েছে, অন্ধকার একেবারে দূর না হলেও কতকটা পাংলা হয়ে এসেছে। সেই কালো ছায়ামূর্তিটা অদৃশ্য। যদিও ওধারের দেওয়ালের উপরে আমার চোখ এখনও যেন দেখতে পেলে মূল ছায়ার একটা অস্পষ্ট ছায়া!

নজর গেল টেবিলের দিকে। চোখ উঠল আবার চমকে। টেবিলের কাঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল একখানা কবজি পর্যন্ত হাত— আমারই মতন রক্তমাংস দিয়ে গড়া বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের একখানা হাত! টেবিলে ছিল সেই চিঠি দু-খানা, হাত গিয়ে পড়ল তারই উপরে। পরমুহূর্তে হাত আর চিঠি দুইই অদৃশ্য!

আবার খাটের শিয়রে তিন বার শুনলুম সেই উচ্চ শব্দ— ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক! বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! আবার কি এই অলৌকিক নাটকের নূতন কোনো দৃশ্য অভিনীত হবে, ও কি তারই সংকেত-ধ্বনি?

ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক! শব্দ যেই থামল অমনি আমার মনে হল, সারা ঘর জুড়ে যেন কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল কোনো অজানা জীবনের স্পন্দন!

ঘরের চার দেওয়ালের প্রান্ত থেকে, কক্ষতলের উপর থেকে, ছাদের তলা থেকে জ্বলে-জ্বলে উঠতে লাগল আগুনের ফিনকি বা দীপ্যমান বর্তুল বা এতটুকু-এতটুকু আলোর ফানুস! নানা রঙের রাশি রাশি বর্তুল— সবুজ, হলদে, বেগুনি, নীল ও টকটকে রাঙা রাঙা। পূর্বে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে, উপরে-নীচে, এখানে-ওখানে-যেখানে-সেখানে যেদিকে তাকাই সেইদিকেই দেখি যেন সব একরত্তি আলেয়ার আলো— তাদের গতি কখনো দ্রুত, কখনো মন্থর!

আগেকার মতোই একখানা চেয়ার জ্যান্ত হয়ে উঠল আচম্বিতে! দৃশ্যমান কেউ তাকে টেনে নিয়ে গেল না, সে কিন্তু নিজে নিজেই হড়হড় শব্দে এগিয়ে আমার সামনের টেবিলের ওপাশে গিয়ে আবার জড়ের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!

হঠাৎ সেই আসনের উপরে মূর্তিধারণ করলে এক নারী। জীবন্ত আকৃতি নয়, মৃতবৎ পাংশুবর্ণ। যৌবনী, কিন্তু সৌন্দর্য তার শোকার্ত। তার কণ্ঠ ও স্কন্ধ বেশ নগ্ন, তার আলুলিত কেশ যেন তিমিরের নির্ঝর। সে আমার পানে নয়— তাকিয়ে ছিল ঘরের দরজার দিকে। সে যেন কাকে দেখতে চায়, কার পদশব্দ শুনতে চায়— কার জন্যে অপেক্ষা করতে চায়!

দেওয়ালের গায়ে সেই ভয়ঙ্কর ছায়ার ছায়া তখনও বর্তমান! সে যেন আরও বেশি কালো হয়ে উঠল আর আমি যেন আবার দেখলুম, ছায়ার উপরার্দ্ধে জ্বলে জ্বলে উঠছে দুটো চক্ষু এবং তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে চেয়ারের উপরকার সেই নারীমূর্তির দিকেই!

তারপরে ঘরের দরজা খুলল না বটে, কিন্তু দরজার সামনেই আবির্ভূত হল এক পুরুষমূর্তি। যুবক। কিন্তু তেমনি মড়ার মতো পাংশুবর্ণ।

পুরুষমূর্তি পায়ে পায়ে এগিয়ে এল নারীমূর্তির দিকে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের কাছ থেকে সেই বীভৎস কালো ছায়াটাও অগ্রসর হয়ে দাঁড়াল এসে তাদের কাছে। অকস্মাৎ তাদের প্রত্যেকেই ঢাকা পড়ে গেল নিবিড় এক অন্ধকারের ঘেরাটোপের মধ্যে। তারপর জ্বলে উঠল আবার একটা বিবর্ণ আলো এবং দেখা গেল সেই দুটো ভূতুড়ে নরনারীর মূর্তি যেন সেই অতিকায় ছায়ামূর্তির কবলগত! নারীর বক্ষদেশে রক্তচিহ্ন; এবং সেই ভূতুড়ে পুরুষ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একখানা ভূতুড়ে তরবারির উপরে এবং তার সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরছে রক্ত আর রক্ত আর রক্ত! তারপর সেই বিরাট ছায়ামূর্তির বিপুল কালিমা গ্রাস করে ফেললে সেই পুরুষ ও নারীকে!

আবার জ্বলে জ্বলে উঠল ছোট্ট-ছোট্ট আলো-ফানুসগুলো। আবার তারা ব্যস্তভাবে আনাগোনা ও ছুটোছুটি করতে লাগল এদিকে-ওদিকে, উপরে-নীচে সর্বত্র! তারা হয়ে উঠল আরও বেশি পুঞ্জীভূত, তাদের গতি যেন আরও বেশি বন্য ও দিগ্ববিদিগ-জ্ঞানহারা!

মূর্তিধারণ করলে একটি বৃদ্ধা নারী, আর আমার চোখের সামনে টেবিলের উপর থেকে যা অদৃশ্য হয়েছিল, সেই চিঠি দু-খানাই রয়েছে তার হাতে। তারপরেই নারীমূর্তির পায়ের তলায় মেঝের উপরে জাগল আর এক দৃশ্য। একটা ছন্নছাড়া, অপরিচ্ছন্ন শিশুমূর্তি হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে— তার মুখে-চোখে দুর্ভিক্ষ ও আতঙ্কের আভাস। নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে থাকতে থাকতে দেখি, বৃদ্ধার মুখের উপর থেকে ধীরে ধীরে জরার চিহ্ন মুছে গিয়ে ফুটে উঠেছে যৌবনের লালিত্য। তারপরই এগিয়ে এল সেই অপার্থিব কালো ছায়া, তার নিরেট কালিমার মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে গেল আর সমস্তই!

ঘরের ভিতরে এখন খালি ক্ষুদ্র লৌকিক জীব আমি, আর সেই বিপুল অলৌকিক ছায়ামূর্তি! আবার দেখা দিলে তার কেউটের মতো দুটো উৎকট চক্ষু! আলো-বুদবুদগুলো আবার অনিয়মিত, এলোমেলো গতিতে উঠছে-নামছে, ছুটোছুটি করছে, ঘরের ভিতরে এসে-পড়া চন্দ্রকিরণের সঙ্গে করছে মেলামেশা। তারপর সেই আলো-বর্তুলগুলোর ভিতর থেকে যেন ডিমের খোলা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে লাগল কীরকম সব রাশি রাশি কিম্ভূতকিমাকার কীটের পর কীট! যেমন বীভৎস ও রক্তহীনের মতো তাদের দেখতে, তেমনি নমনীয়, চটপটে ও স্বচ্ছ তাদের দেহ— তারা শূন্যপথ দিয়ে পরস্পরকে ধরবার জন্যে ছুটোছুটি করছে, পরস্পরকে ধরে গ্রাস করেছে, ক্রমেই দলে বেশি ভারী হয়ে আমাকে চারিদিক থেকে পালে পালে ঘিরে ফেলছে! এমন আকারহীন আকার কখনো দেখেনি মানুষের চক্ষু, তাদের সঠিক বর্ণনাও করতে পারবে না মানুষের লেখনী! আকারহীন আকার— ধারণাতীত! পরস্পরকে ধরছে, পরস্পরকে গ্রাস করছে!

মাঝে মাঝে নিজের দেহের উপরে স্পর্শ অনুভব করছিলুম। ওই কিম্ভূতকিমাকার কীটগুলোর স্পর্শ নয়, অদৃশ্য সব হাতের স্পর্শ! একবার অনুভব করলুম কয়েকটা ঠান্ডা কনকনে আঙুল আমার গলা টিপে ধরবার চেষ্টায় আছে। কিন্তু আমি মনের জোর হারিয়ে ফেললুম না। কারণ বেশ বুঝলুম একবার যদি আমার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে আমার দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক বিলুপ্ত হতে বিলম্ব হবে না একটুও!

আর কোনোকিছুর দিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে অটলভাবে আমি তাকিয়ে রইলুম কেবল সেই মহা অশুভোৎপাদক, অতিকায় ছায়ামূর্তির দিকে— এতক্ষণে তার ক্রুর সর্প চক্ষু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অতিশয়! আমি উপলব্ধি করলুম ওর মধ্যে নিহিত আছে এক প্রবল ইচ্ছা— হ্যাঁ, অমঙ্গল সৃষ্টি করবার জন্যে একটা উগ্র ও মারাত্মক ইচ্ছা। সেই প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে আমিও জাগ্রত করে রাখলুম নিজের দুর্দনমীয় ইচ্ছাশক্তিকে।

দেখতে দেখতে ঘরের ভিতরটা কেমন লালচে আভায় ভরে উঠল— যেন কাছেই কোথাও ভীষণ অগ্নিকাণ্ড হয়েছে! সঞ্চারিত কীটগুলো ম্লান পীতবর্ণ হয়ে এল। ঘরের ভিতরে আবার জাগল কম্পন এবং আবার শুনলুম তালে তালে সেই তিনটে শব্দ— ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক, ঠকা-ঠক-ঠক! এবং সমস্তই বিলুপ্ত হয়ে গেল সেই কালো ছায়ার ঘন কালিমার মধ্যে; যার ভিতর থেকে হয়েছিল তাদের সৃষ্টি, তার ভিতরেই হল তাদের অস্তিত্ব লোপ।

ঘরের অন্ধকার সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কালো ছায়াও হয়ে আসছে ক্ষীণ, ক্রমেই ক্ষীণ। এবং ছায়া হচ্ছে যত ক্ষীরতর, টেবিলের উপরে বাতিদুটোরও শিখা হয়ে উঠছে ততই উজ্জ্বলতর। সারা ঘরখানার অবস্থা এখন শান্ত ও স্বাভাবিক। আশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।

ঘরের এক জায়গায় কুকুরটা স্থির হয়ে শুয়ে আছে। তাকে ডাকলুম, সে জাগলও না, নড়লও না। কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। সে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে। তার চোখ দুটো বেরিয়ে পড়েছে। জিভখানাও মুখের বাইরে ঝুলছে। চোয়ালে জমে আছে ফেনা।

কোলে করে তার দেহটাকে সরিয়ে আনলুম। তার মৃত্যুর জন্যে আমার মন হল শোকগ্রস্ত, সে ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয়। মনে জাগতে লাগল আত্মধিক্কার— তার এই শোচনীর পরিণামের জন্যে আমিই দায়ী!

প্রথমে ভেবেছিলুম সে মারা পড়েছে দারুণ আতঙ্কেই। এখন পরীক্ষা করে দেখছি, তা নয়। তার কণ্ঠদেশ ভেঙে গিয়েছে— মেরুদণ্ড থেকে মোচড় দিয়ে বার করে আনা হয়েছে! অন্ধকারের মধ্যেই কি হয়েছে এই কাণ্ড? এর জন্যে কি দায়ী আমারই মতো কোনো মানুষের অস্থিমাংস দিয়ে গড়া হাত?

আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার! আমার ঘড়িটাও আবার টেবিলের উপরেই ফিরে পেলুম। কিন্তু তার কল বন্ধ। পরে ঘড়িওয়ালার কাছে পাঠিয়েও তাকে আর ঠিক সচল করতে পারিনি। কল চলে, কিন্তু খানিক চলেই থেমে যায়। একেবারে অকেজো ঘড়ি।

নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলুম। এইখানেই রইলুম সূর্যোদয় পর্যন্ত। কিন্তু বাকি রাতটুকুর মধ্যে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। যাবার আগে আর একবার নিবারণের ঘরে গিয়ে দাঁড়ালুম। এইখানেই আমরা বন্দি হয়েছিলুম, এইখানেই সর্বপ্রথমে আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল অবর্ণনীয় আতঙ্কে এবং আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এইখান থেকেই যতকিছু অমঙ্গলের উৎপত্তি। এমনকী, এখন এই আলো-মাখা ভোরবেলাতেও আবার বুকের মধ্যে অনুভব করলুম তেমনি বিষম আতঙ্কের শিহরণ! আধ মিনিটের বেশি সেখানে আর অপেক্ষা করতে পারলুম না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলুম এবং কালকের মতো আবার শুনতে পেলুম আমার আগে আগে আর কারুর পদশব্দ!

তারপর নীচে নেমে যখন সদর দরজা খুললুম তখন স্পষ্ট শুনতে পেলুম, আমার পিছন থেকে নারীকণ্ঠে কে হেসে উঠল!

ভেবেছিলুম বাড়িতে এসে নিবারণের দেখা পাব। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।

পরদিনই জগদীশবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। হানাবাড়ির চাবির গোছা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে বললুম, ‘আমার কৌতূহল তৃপ্ত হয়েছে। কালকের রাত্রের কথা শুনতে চান?’

জগদীশবাবু বললেন, ‘ওরকম কথা অনেক শুনেছি, আর শোনবার আগ্রহ নেই। আমি খালি জানতে চাই, আপনি এই ভূতুড়ে সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন কি না?’

‘আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আপনাকেও আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

‘বলুন।’

‘আপনি ”হিপনেটিজম” বা সম্মোহনবিদ্যার কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘জানেন তো, সম্মোহিত ব্যক্তি সম্মোহনকারীর প্রভাবে পড়ে নিজের অজ্ঞাতসারেই নানা কাজ করে? সম্মোহনকারী ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও বিদ্যমান থাকে তার সম্মোহনের প্রভাব? সে দূর থেকেই যা দেখাতে চায়— তা যত উদ্ভট বা আশ্চর্যই হোক না কেন, সম্মোহিত ব্যক্তি দেখে সেইসব বস্তু বা দৃশ্য?’

‘এইরকম সব কথা শুনেছি বটে। কিন্তু সম্মোহনবিদ্যার সঙ্গে আমার বাড়ির ভৌতিক ঘটনাগুলোর সম্পর্ক কী?’

‘বলছি। আপনি প্রেততত্ত্ববিদদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন?’

‘না।’

‘তাঁদের কার্যকলাপের কথা শুনেছেন?’

‘শুনেছি।’

‘তাঁরা টেবিল-চেয়ার সচল করেন, শরীরী প্রেতও নাকি দেখান। ভারতের এক শ্রেণির জাদুকরের কীর্তিও পৃথিবী-বিখ্যাত। তাদের খেলার নাম ”রোপ-ট্রিকরা বা দড়ির ফাঁকি”। জাদুকরের একগাছা মোটা দড়ি সোজা লাঠির মতো শূন্যে বহু ঊর্দ্ধে উঠে উঠে গিয়ে স্থির হয়ে থাকে। তারপর একটা ছেলে সেই দড়ি অবলম্বন করে উপরে উঠে সকলের চোখের আড়ালে কোথায় মিলিয়ে যায়। তারপর নাকি শূন্য থেকে ঝুপ ঝুপ করে নীচেয় এসে পড়ে ছেলেটার খণ্ড খণ্ড দেহ। জাদুকর আবার দেহের খণ্ড অংশগুলো জুড়ে ছেলেটাকে বাঁচিয়ে তোলে।’

‘আপনার বক্তব্য কী, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘জগদীশবাবু, আমার মতে ওইসব ব্যাপারের প্রত্যেকটিরই মধ্যে কাজ করে, সম্মোহন। আমার সৃষ্ট মোহিনী শক্তির গণ্ডীর ভিতরে যে এসে পড়বে, তাকে আমি যা দেখাব, সে তাই দেখবে, আমি যা শোনাব, সে তাই শুনবে। তারা হবে আমার মস্তিষ্ক বা ইচ্ছাশক্তির দাস— আমার প্রভাবে সকলরকম অসম্ভবই তাদের কাছে হবে সম্ভবপর।’

‘বেশ। আমি তর্ক করতে চাই না। তারপর আপনি কী বলতে চান?’

‘জগদীশবাবু, আমার বিশ্বাস আপনার ওই বাড়ির ভিতরে ওইরকমের কোনো মস্তিষ্কের প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাজ করে। সে কে বা তার কার্যপদ্ধতি কী আমি তা জানি না। হয়তো আজ সে জীবিত নেই, কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব তবু লুপ্ত হয়নি।’

‘আপনার মত শুনে বিস্মিত হচ্ছি।’

‘আমি যে ঘরে শুয়েছিলুম, তার সঙ্গে সংলগ্ন একখানা ছোটো ঘর আছে। খুব সম্ভব যতকিছু উপদ্রব আর অমঙ্গলের মূল আছে ওই ঘরেই। যদি আমার কথা শোনেন, তবে ওই ঘরটা ভেঙে ফেলুন।’

‘বেশ, ভেবে দেখব।’

‘আপনার বাড়ি যে বুড়ির জিম্মায় ছিল, বোধ হয় তাকেই লেখা দু-খানা চিঠি আমি পড়ে দেখেছি। অত্যন্ত সন্দেহজনক চিঠি। বুড়ির ঘরের দেরাজেই চিঠি দু-খানা রেখে এসেছি। আপনিও পড়ে দেখতে পারেন। তারপর যদি ইচ্ছা করেন, বুড়ির পূর্বজীবন সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর নেবেন।’ এই বলে আমি গাত্রোত্থান করলুম।

জগদীশবাবু বললেন, ‘যথাসময়েই সব খবর পাবেন। নমস্কার।’

হপ্তা খানেক পরে জগদীশবাবুর কাছ থেকে এই পত্রখানি পেলুম

প্রিয় মহাশয়,

আপনার কথামতো আমি সেই হানাবাড়িতে গিয়েছিলুম। বৃদ্ধাকে লেখা সেই চিঠি দু-খানা আমিও পাঠ করেছি এবং পাঠ করে বিস্মিত হয়েছি। যথাস্থানে খবর নিয়ে যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে এই—

বৃদ্ধার নাম সৌদামিনী। সে সম্পন্ন গৃহস্থের মেয়ে। আগে সহোদরের কাছেই থাকত। তার সহোদর বিপত্নীক, ছয় বৎসর বয়সের একটি পুত্রের পিতা। সেই ছেলেটির লালনপালনের ভার ছিল সৌদামিনীর উপরে।

ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বৎসর আগে সৌদামিনী তার সহোদরের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এমন একটি লোককে বিবাহ করেছিল, পূর্বজীবনে যে নাকি ছিল ডাকাত। বিবাহের ঠিক একমাস পরেই তার সহোদর হাবড়ার পোলের তলায় জলে ডুবে মারা পড়ে। কিন্তু লাশ পাওয়া যাবার পর দেখা যায়, তার গলায় রয়েছে আঙুলের চিহ্ন— যেন কেউ গলা টিপে হত্যা করেছে সোদামিনীর সহোদরকে। কী কারণে জানি না, ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশ বেশি মাথা ঘামায়নি।

ভ্রাতুষ্পুত্রের অভিভাবিকা হয় সৌদামিনীই। কিন্তু পিতার মৃত্যুর ছ-মাস পরেই শিশুপুত্রটিও মারা পড়ে। সে মৃত্যুর কারণও দৈবদুর্ঘটনা। শিশু নাকি কেমন করে তিনতলা থেকে একতলার উঠানের উপরে পড়ে যায়। তখন পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয় ওই সৌদামিনীই।

বিবাহের পর বৎসর ঘুরতে না ঘুরতেই তার স্বামীও হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়। তারপর আর সে ফিরে আসেনি। কানাঘুসায় শোনা যায়, বিদেশে কোথায় নাকি ডাকাতি করতে গিয়ে সে মারা পড়েছে। কিন্তু স্বামীর অভাব হলেও সৌদামিনীর অর্থের অভাব রইল না। তবে সে সুখও হল না বেশি দিনের জন্যে স্থায়ী। হঠাৎ একটি বড়ো ব্যাঙ্ক লাল বাতি জ্বেলে ব্যর্থ করে দিলে তার আর্থিক সৌভাগ্য। এই হল সংক্ষেপে সৌদামিনীর ইতিহাস। এইবারে আমার কথা বলি।

আপনি যে ছোটো ঘরখানা ভেঙে ফেলবার পরামর্শ দিয়েছেন, সেখানে বসে আমি এক ঘণ্টাকাল কাটিয়ে এসেছি। অবশ্য আমি সেখানে কিছু দেখিও নি, শুনিও নি, কিন্তু কেন জানি না, সারাক্ষণই আমার মনের ভিতরে জেগে উঠছিল কী এক প্রবল আতঙ্ক! মেঝে ভেদ করে যেন কেমন একটা বিষাক্ত ভাব বাইরে বেরিয়ে স্তম্ভিত করে দিচ্ছিল আমার সর্বাঙ্গ!

আমি আপনার পরামর্শ মতোই কাজ করব। জনকয় মজুর ঠিক করেছি, তারা আসছে রবিবার সকালেই ওই ঘরখানা ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করবে। সেই সময়ে আপনি উপস্থিত থাকলে অত্যন্ত আনন্দিত হব। ইতি—

যথানির্দিষ্ট দিনে ও যথাসময়ে আবার হানাবাড়িতে হল আমার আবির্ভাব। দেখি মিস্ত্রি ও মজুরদের নিয়ে আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছেন জগদীশবাবু।

সে রাত্রে নিবারণ যেখানে বাসা বেঁধেছিল আবার ঢুকলুম সেই ঘরে।

জগদীশবাবু মজুরদের ডেকে বললেন, ‘আগে চৌকিখানা ঘরের বাইরে নিয়ে যাও।’

চৌকি সরতেই হল নতুন এক আবিষ্কার। মেঝের উপরে রয়েছে একটা চোরা দরজা। লোহার শিকল ও তালা দিয়ে সেটা বাহির থেকে বন্ধ।

হাতুড়ি ও শাবল প্রভৃতির সাহায্যে তালা ও শিকল ভেঙে ফেলা হল। দরজা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল স্যাঁৎসেতে বদ্ধ বাতাসের দুর্গন্ধ। বেশ বোঝা গেল, বহুকাল ব্যবহার করা হয়নি এই চোরকুঠারি।

উঁকি মেরে দেখলুম ভিতরে আছে খালি অন্ধকার। সন্দিগ্ধভাবে বললুম, ‘এর মধ্যে সাপ আছে কী ব্যাঙ আছে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। আলো না নিয়ে নীচেয় নামা নিরাপদ নয়।’

জগদীশবাবুর হুকুমে দুটো লণ্ঠন সংগৃহীত হল অনতিবিলম্বেই।

ছোট্ট একখানা ঘর, কোনোদিকেই নেই বাইরের আলোবাতাসের পথ। মেঝের উপরে পুরু ধুলো। আসবাবের মধ্যে রয়েছে কেবল একটা ছোটো লোহার সিন্দুক।

জগদীশবাবু সাগ্রহে বলে উঠলেন, ‘গুপ্তধন নাকি?’

আমি বললুম, ‘ওর মধ্যে যদি গুপ্তধন থাকে, তাহলে এটাও মনে রাখবেন যে, তার উপরে পাহারা দেবার জন্যে এখানে যকের অভাবও নেই।’

জগদীশবাবু শিউরে উঠে দুই পা পিছিয়ে গেলেন।

সিন্দুকটায় মরেচে ধরে গেছে বটে, কিন্তু অত্যন্ত মজবুত। চাবি ছিল না, তাই সকলে মিলে অনেক চেষ্টার পরে তার কল ভেঙে ফেলা হল।

কিন্তু ভিতরে পাওয়া গেল না কোনো ধনদৌলত বা বহুমূল্য জিনিস; আমিও করিনি ওসব কিছু পাবার আশা। পেলুম খালি একখানা হাতে-লেখা পুথি এবং তার উপরে বসিয়ে রাখা একখানা চীনেমাটির রেকাবি।

আস্তে আস্তে রেকাবিখানা হাতে করে তুলে নিলুম। তার মধ্যে জলের মতো টলটল করছে কী-একটা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও তরল পদার্থ। তারই ভিতরে বসানো আছে ‘কম্পাস’ বা দিগদর্শন যন্ত্রের মতো দেখতে একটি ছোটো যন্ত্র। একটি কাঁটাও রয়েছে যন্ত্রের মধ্যে এবং সেটা অতি দ্রুতগতিতে ঘোরাফেরা করছে এদিকে আর ওদিকে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সেই জলের মতো তরল পদার্থটা থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত একটা গন্ধ! তা তীব্রও নয়, অপ্রীতিকরও নয়, কিন্তু আমার দেহ, মন ও শিরা-উপশিরার মধ্যে আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করলে সেই অজানা গন্ধ!’ কেবল আমার উপরে নয়, আর সকলেরই উপরে সেই প্রভাব গিয়ে পড়তে বিলম্ব হল না।

আমার হাতের আঙুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত চলাচল করতে লাগল এমন অসহনীয় বিদ্যুৎপ্রবাহ যে, রেকাবিখানা আর ধরে থাকতেও পারলুম না, মাটির উপরে পড়ে সেখানে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল সশব্দে! তরল পদার্থটা মেঝের উপরে গড়াতে লাগল এবং যন্ত্রটাও ছিটকে পড়ল একদিকে।

সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের চারদিকের দেওয়াল কাঁপতে কাঁপতে দুলতে লাগল— যেন কোনো বিপলবপু মহাদানব তাদের উপরে ধাক্কার পর ধাক্কা মারছে প্রচণ্ড আক্রোশে! যাদের পায়ের তালে হয় ভূমিকম্প, এমন কোনো মহাদানব!

ভীষণ আতঙ্কে আমরা চোরকুঠারির বাইরে পালিয়ে এলুম।

কিন্তু পালাবার সময়ে পুথিখানা সঙ্গে আনতে ভুলিনি। সেখানা হচ্ছে হাতে-লেখা ‘মহানির্বাণ-তন্ত্র’। পুথির ভিতরে পেলুম একখণ্ড কাগজ। তার উপরে লেখা এই কথাগুলি—

এই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে সচেতন বা অচেতন, জীবন্ত বা মৃত যা-কিছু আছে, যন্ত্রের কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে তারাও চলবে আমার ইচ্ছাশক্তির বশবর্তী হয়ে। অভিশপ্ত হোক এই বাড়ি— অশান্তিপূর্ণ হোক এখানকার প্রত্যেক আত্মা!

* * *

পুথি ও কাগজখণ্ড অগ্নিকবলে সমর্পণ করে জগদীশবাবু সেই ছোটো ঘরখানাও করেছিলেন ভূমিসাৎ।

তারপর সে বাড়িতে আর কোনো উপদ্রবের কথা শোনা যায়নি!

* মনোরথ, শরৎসাহিত্য ভবন, সম্পাদক হেমেন্দ্রকুমার রায়, ১৩৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *