ঐতিহাসিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাস
এ বছর দেখছি কোথাও কোথাও পলাশী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য বোধ হয় পরাধীনতার গ্লানি স্মরণ করে স্বাধীনতা ও স্বাজাত্যের মহিমা কীর্তন করা। ইতিহাস পাঠকের দৃষ্টি আবেগে আচ্ছন্ন হওয়া অবাঞ্ছিত। নিরপেক্ষ বিচারেই ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কেননা তেমন শিক্ষাই কেবল ব্যক্তিক কিংবা জাতিক জীবনে ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব।
আগের যুগে রাজার রাজ্য ছিল, জনগণের রাষ্ট্র ছিল না। কাজেই জমিদারের চর দখলের মতোই দেশ কাড়াকাড়ি চলত রাজায় রাজায়। দেশের জনগণের তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না। ভাড়াটে লেঠেলের মতোই ভাড়াটে সৈন্যেরা পয়সার বিনিময়ে ও ফাউস্বরূপ লুটের মালের লোভে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করত মনিবের পক্ষে। এসব যুদ্ধ-ব্যবসায়ীর দেশ-জাত চেতনা ছিল না। যে কড়ি দেবে, তার কাজে জান কবুল –এই ছিল তাদের নীতি। তাই ব্রিটিশেরা দেশী সৈন্য দিয়েই ভারত দখল করেছিল। সেই যে কথায় আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলুখড়ের প্রাণ যায় তা প্রায় আক্ষরিকভাবেই সত্য ছিল। রাজা বদল হলে প্রজার মনে কোনো ভাবান্তর হত না। কেবল প্রশাসনিক নীতি পরিবর্তনের ফলে প্রজার আর্থিক ও বৈষয়িক ক্ষতিবৃদ্ধির কারণ ঘটত। শাসকের চরিত্র-ভেদে শাসন-শোষণের মাত্রাভেদ অবশ্যই হত।
বাঙলাদেশ চিরকালই বিদেশী শাসিত। মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন-তুর্কী-আফগান-মুঘল কিংবা ইংরেজ–ওদের কেউ বাঙালি ছিল না। শশাঙ্ক-নরেন্দ্র গুপ্ত কিংবা যদু-জালাল উদ্দীন বাঙালি হয়েও বাঙালির স্বাজাত্যবোধের অভাবে বেশি দিন টিকতে পারেননি। রাজা-প্রজার সম্পর্ক বান্দা-মনিবের কিংবা শাসক-শাসিতের ছিল বলেই রাজকীয় ব্যাপারে তথা রাজনীতিতে জনগণের স্বাদেশিক বা স্বাজাতিক চেতনা ছিল অনুপস্থিত। কাজেই মধ্যযুগের কোনো যুদ্ধকে কিংবা হার-জিৎকে জাতীয় সংগ্রাম বা জাতীয় জয়-পরাজয় বলে চিহ্নিত করা চলে না। এ ছিল শাসকগোষ্ঠীর গোত্রীয় লজ্জা গৌরবের ও শ্রেণীগত লাভ-ক্ষতির বিষয়।
পলাশীর পটভূমিকা আলোচনা করলেও আমরা এ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াব। ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দ থেকেই বাঙলাদেশ নামত মুঘল শাসনে আসে। ১৬১৭ খ্রীস্টাব্দ অবধি এখানকার ভূঁইয়াদের সাথে দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের মাধ্যমে মুঘল অধিকার টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চলে।
তার পরেও মীর জুমলা-শায়েস্তাখানের সুবাদারি (১৬৮৮ খ্রী.) অবধি বাঙলা দেশ মোটামুটিভাবে সেনানী-শাসক (Military Governor) দ্বারা শাসিত হয় এবং অধিকাংশ সময়ে বিহার-উড়িষ্যাও বাঙলা-সুবাভুক্ত থাকে। মুঘল আমলে বাঙলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ, অনেকটা ঔপনিবেশিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। দিল্লী ছিল সাত সমুদ্রের না হলেও তেরো নদীর ওপারে। মুঘলেরা এ অঞ্চলে শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, স্বাদেশিক রাজার মতো পোষণের দায়িত্ব কিংবা প্রজার কল্যাণ সাধনের কর্তব্য গ্রহণ করেনি। এ ছিল খাজনা আদায়ের জমিদারি ও শুল্ক উসুলের বন্দর। . ১৭০৭ খ্রীস্টাব্দে আওরঙজীবের মৃত্যুর পরে মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত ভাঙতে থাকে। ফররুখ শিয়রের ঢাকা ত্যাগের পর ১৭১২ খ্রীস্টাব্দ থেকে পূর্বতন দিওয়ান এবং আওরঙজীবের বিশ্বস্ত কর্মচারী মুর্শিদকুলি খাঁ এখানে জেঁকে বসেন। তাঁর সময় থেকেই স্বল্পমেয়াদী সুবাদারি দিল্লীর সম্রাটের প্রতি নামমাত্র আনুগত্যে পুরুষানুক্রমিক নওয়াবীতে অবসিত হল।
এই মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা ও উড়িষ্যার নায়েব নাজিম সুজাউদ্দিনের দরবারেই ধর্না দেন বেকার আলিবর্দী। আলিবর্দীর পিতামহ ছিলেন আওরঙজীবের ধাত্রীপুত্র। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আলী ছিলেন আওরঙজীবের পুত্র আজম শাহর পানপাত্র বাহক। আজমের বিপর্যয় ও মৃত্যুতে (১৭০৭ খ্রী.) তাঁর পরিবারে দুর্দিন দেখা দেয়। পিতৃহীন আলিবর্দী ভাগ্যান্বেষণে সপরিজন চলে আসেন উড়িষ্যায়। উড়িষ্যায় তিনি তাঁর আত্মীয় নায়েব-সুবাদার সুজাউদ্দিনের অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন। নিজের যোগ্যতায় এবং মুর্শিদকুলি খাঁর ও মাতুল বংশীয় সুজাউদ্দিনের কৃপায় তিনি ক্রমে বিহারের নায়েব সুবাদার পদে উন্নীত হন।– মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর জামাতা নওয়াব সুজাউদ্দিনের সময়ে আলীবর্দীর প্রতিষ্ঠা আরো বাড়তে থাকে। তাঁর ভ্রাতা হাজী আহমদও দরবারে আমীর পদে উন্নীত হন। সুজাউদ্দিন-পুত্র সরফরাজ খাঁর আমলে আলিবর্দী ছিলেন বিহারের নায়েব সুবাদার। উৎকোচে দিল্লী-দরবারের আমীরদের বশ করে তিনি বাঙলার সুবাদারি সনদ লাভ করেন এবং তাঁর ভাই হাজী আহমদের মধ্যস্থতায় মুর্শিদাবাদ-দরবারে ষড়যন্ত্র করে আমীরদের স্বপক্ষে এনে গিরিয়ার প্রান্তরে নামমাত্র যুদ্ধে সরফরাজ খাঁকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদারি মসনদ তথা নওয়াবী লাভ করেন।
আলিবর্দীর পনেরো বছর নওয়াবীকালে বারোটি যুদ্ধ ঘটে। মুর্শিদকুলির জামাতাদি আত্মীয়েরা, বিহারের বিদ্রোহী সামন্তরা এবং মারাঠারা তাঁকে তাঁর ষড়যন্ত্র-লব্ধ রাজ্য সুখে ভোগ করতে দেননি। ফলে যুদ্ধ-সংক্রান্ত ব্যয়বাহুল্য তো ছিলই, তাছাড়া প্রশাসনিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাও যুদ্ধকালে সম্ভব ছিল না। তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক বগীর লুটতরাজে ছিল বিধ্বস্ত। এখানেই শেষ নয়, উড়িষ্যার আয় চৌথরূপে ছেড়ে দিতে হল এবং অধিকন্তু নগদ বারো লক্ষ টাকা বার্ষিক কর ভোসলাকে দিতে হত। সিরাজউদ্দৌলা যখন নওয়াব হলেন তখন দিল্লীর সনদ যোগাড়ের পয়সা ছিল না তার। আবদালী ও দিল্লীর সম্রাটের হুমকিতে বিচলিত সিরাজউদ্দৌলা কলকাতার ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করলেন, যাতে বিপদকালে ইংরেজদের সাহায্যে দিল্লী-প্রেরিত বাহিনী ঠেকানো যায় এই ভরসায়। আহমদ শাহ আবদালী-লুণ্ঠিত দিল্লীর রাজার তখন অভিযান করার মতো অবস্থা ছিল না। কাজেই সে দিক থেকে কোনো বিপদ ঘটেনি।
গিরিয়ার যুদ্ধে ও পলাশীর যুদ্ধে আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও পরিণামগত কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। বাঙালির এতে জানবার, বুঝবার ও ভাববার কিছুই ছিল না। কেবল রাজ্য কাড়াকাড়ির চিরকালীন তামাশাই দেখবার ছিল এবং তারা রসিক-দৃষ্টি দিয়ে দেখেওছে। সে যুগে দেশ ছিল রাজার রাজ্য। রাজ্য রক্ষার গরজ, প্রজা শাসনের দায়িত্ব এবং রাজ্য হারানোর দুর্ভাগ্য সবই ছিল রাজার। প্রজার কাছে এসব ছিল মনিব ও মালিক পরিবর্তনের একটি সাময়িক দুর্ভাগ্য মাত্র। সে মালিক স্বদেশী কিংবা বিদেশী, স্বজাতি কিংবা বিজাতি –এ বিচার তারা কোনো দিনই করেনি। এ বিচারে কেউ কখনো অভ্যস্তও ছিল না। এমনকি আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি এ চেতনা–এ দৃষ্টি ভারতের রাজন্যবর্গের মধ্যে অনুপস্থিত দেখি। ষোলো শতক থেকেই। পর্তুগীজদের মাধ্যমে য়ুরোপীয় শক্তির প্রভাব ও অধিকার এদেশে দৃঢ়মূল ও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু বিদেশী-বিজাতি বলে তাদের কেউ ঠেকানোর চেষ্টা করেনি। কেবল প্রতিষ্ঠাকামী প্রবল প্রতাপ উঠতি শক্তিরূপে সমীহ-ই করেছে। এবং স্বস্বার্থে এদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বদলে সহযোগিতাই করেছে এদেশের রাজন্যবর্গ। কর্নাটে ফরাসির ও বাঙলায় ইংরেজের ভূমিকা, মুঘল বাদশাহ কর্তৃক ইংরেজকে বাঙলা-বিহারের দেওয়ানী দান, টিপুসুলতানকে সাহায্যদানে নিজাম মারাঠার অস্বীকৃতি, সিপাহী বিপ্লবকালে রাজন্যবর্গের ব্রিটিশ-প্রীতি প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। অতএব স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক চেতনা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও ছিল না। তাদের ছিল-দেশ-জাত মানুষ নিরপেক্ষ রাজ্য-চেতনা। কাজেই দেশী-বিদেশী যে-কোনো রাজশক্তিকে তারা সুবিধা ও প্রয়োজনমতো কখনো মিত্ররূপে, কখনোবা প্রতিদ্বন্দ্বীরূপেই ভেবেছেন। অবশ্য এরই নাম রাজনীতি।
মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজউদ্দৌলা অবধি সবাই দুর্বল প্রভুর স্বৈরাচারী সুবাদার মাত্র। আঠারো উনিশ শতকে কখনো কখনো কোনো কোনো রাজা-বাদশা, সামন্ত ও ধর্মনেতা স্বস্বার্থে স্বাধর্মিক জাতীয়তার বুলি আওড়িয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের সে-প্রয়াস মুঘল-মারাঠা কিংবা ইংরেজ-সাম্রাজ্যে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। নাদির শাহ কিংবা আহমদ শাহ আবদালীর ভারত অভিযানে মারাঠা শক্তি ঘা খেয়েছে বটে, কিন্তু মুঘল শক্তিই হয়েছে বিলুপ্ত, যার ফলে ইংরেজ-শক্তি হল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবার শিখ-হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশীসুলভ ঈর্ষা-বিদ্বেষ বশে যতটা সাম্প্রদায়িক হতে পেরেছিল, ওহাবী আন্দোলন ততটা ইংরেজদ্রোহী হতে পারেনি।
অতএব আমাদের দেশের রাজনীতিতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে স্বাদেশিক, স্বাজাতিক কিংবা স্বাধর্মিক জাতীয়তার কোনো ভূমিকা ছিল না। কাজেই ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে আলিবর্দী, কিংবা মীর জাফর আলী খাঁর ভূমিকা অভিন্ন। এবং সরফরাজ, সিরাজউদ্দৌলা কিংবা মীর কাসিমের দুর্ভাগ্যও নিত্যঘটিত ব্যক্তিগত ঘটনা। বস্তুত পলাশীর বিজয়ে নয়, দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক ইংরেজকে দিওয়ান নিযুক্তির ফলেই বাঙলায় তথা ভারতে ইংরেজ-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। কেননা ওটাই ছিল তাদের Locus standi, ওতেই দেশের রাজনীতিতে ওদের দৌরাত্ম্যের দাবী ও অধিকার স্বীকৃতি পেল।
আধুনিক স্বাদেশিক বোধ ও স্বাজাতিক চেতনা নিয়ে মুঘল সুবাদার অবাঙালি সিরাজউদ্দৌলাকে জাতীয় বীর ও বাঙলার স্বাধীনতার প্রতীকরূপে গ্রহণ করলে ইতিহাসের তথ্য ও মর্যাদা লঙ্ন করাই হবে। বস্তুত পলাশীর যুদ্ধের গ্লানি বা লজ্জা কোনোটাই বাঙালিকে স্পর্শ করার কথা নয়। যেমন মৌর্যযুগ থেকে সুন্দর শ্যামল স্বর্ণ-প্রসূ বাঙলাকে নিয়ে যত লড়াই হয়েছে বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে, তার কোনো জয়-পরাজয়ই বাঙালির গৌরব কিংবা গ্লানির বিষয় নয়।
বাঙালারি স্থায়ী কলঙ্কের কথা এই যে, ইদানীং পূর্বযুগে বাঙালি কৃচিৎ স্বদেশ স্বশাসনে রাখবার চেষ্টা করেছে। দেশের মানুষ দ্বারা শাসিত না হলে রাজনৈতিক অর্থে মানুষ কখনো স্বাধীন হয় না। এই তাৎপর্যে পাল কিংবা স্বাধীন সুলতানী আমলও (১৩৩৯-১৫৩৮ খ্র.) বাঙলা বা বাঙালির পক্ষে গৌরবের ও গর্বের নয়।