এ লড়াই বাঁচার লড়াই

এ লড়াই বাঁচার লড়াই

সারি সারি গাড়ি এগিয়ে চলেছিল জেরুসালেমের দিকে। মুহুর্মুহু উঠছিল আনন্দধ্বনি। অনেক গাড়ি আবার ফুল দিয়ে সাজানো। ঘাবড়াবেন না সুধী পাঠক! এটা কোনো বরযাত্রীর দলের কথা নয়। যুদ্ধে যাচ্ছিল আরবদের বিরাট বাহিনী।

কাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ?

অবশ্যই ইসরায়েল। ইউনাইটেড নেশনসের সমর্থনে সদ্য গঠিত দেশ ইসরায়েল তখন আরবদের সামনে নেহাতই এক শিশু। যুদ্ধে যাওয়ার আগেই তাই আরবরা ধরে নিয়েছিল যে, তারা হেলায় হারিয়ে দেবে ইহুদিদের। তাই এত আনন্দ, এত আয়োজন।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল ৫টি আরব দেশ- মিশর, জর্ডন, ইরাক, লেবানন ও সিরিয়া। মিশর আগেই ইসরায়েলকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে রেখেছিল। ইসরায়েলের পাশে কেউ নেই তখন। ইউনাইটেড নেশনস নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাটাকেই বেশি শ্রেয় মনে করল। জর্ডনের আরব বাহিনীর প্রধান তখন ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল— স্যর জন বাগট গ্লুব। সুতরাং ব্রিটিশরা এতে নাক গলাবে না এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। জেনারেল জর্জ ক্যাটলেট মার্শাল জুনিয়র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানকে পরিস্থিতির খতিয়ান দিলেন। তাঁর মতে ইসরায়েলের উচিত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভুলে আরবদের সঙ্গে সমঝোতা করা। কারণ আরবদের বিরাট সেনাবাহিনী ও উন্নত সমরাস্ত্রের সম্মুখে ইসরায়েল খুব সহজেই পরাস্ত হবে। আর তারপর আরবরা ইহুদিদের মেরেকেটে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে। ইসরায়য়েলের প্রধানমন্ত্রী তখন ডেভিড বেন-গুরিয়ন। আরবদের কাছে তিনি কিছুতেই মাথা নত করবেন না। সবরকম বিপদের কথা জেনেও তিনি আরবদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়ার সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন।

ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইন থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে আরব বাহিনী ইসরায়েলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জেনারেল জন গ্লুব, পদাধিকারবলে যিনি তখন গ্লুব পাশা, ঘোষণা করলেন— ‘এই যুদ্ধ এক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এবং তারপর আমরা ইহুদিদের তুলে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে সলিলসমাধি দেব।’

এই কথার মধ্যে যে কেবল অহংকার ছিল তা কিন্তু নয়। সত্যিই পরিস্থিতি এমনটাই ছিল তখন। আরবদের ঠেকানোর জন্য মাত্র ১৯ হাজার সেনা ছিল ইসরায়েলের হাতে। কী হবে ১৯ হাজারের বাহিনী দিয়ে? এদের মধ্যে আবার অনেক এমন সৈন্যও ছিল, যারা এর আগে কোনোদিন বন্দুক ছুঁয়েও দেখেনি। আর ওদিকে আরবদের কাছে কেবলমাত্র খাতায়-কলমেই ছিল ১,৬৫,০০০ জন সেনা।

ফারাকটা বুঝুন বন্ধু!

আরবদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে ইহুদিরা পিছু হটতে থাকে। ২০ মে আরবরা ওল্ড জেরুসালেম দখল করে। ২৬ মে আরব বাহিনী দখল করে হুৰ্ভা স্কোয়ার। আর তারপর ডায়নামাইট লাগিয়ে তারা সেখানকার সিনাগগগুলোকে উড়িয়ে দেয়। য়িৎজাক রাবিন তখন একজন মিলিটারি অফিসার (হ্যাঁ, ইনিই পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন)। তাঁর কথায়, ‘২১৩ জন ইহুদি রক্ষীর মধ্যে ৩৯ জন নিহত আর ১৩৪ জন আহত হয়েছিল। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। ওয়েস্টার্ন ওয়াল ইহুদিদের হাতছাড়া হল।’

ল্যাটরানের দুর্গ অবরোধ করে আরবরা পশ্চিম জেরুসালেমের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিল। বেন-গুরিয়নের নির্দেশে ইহুদিরা চেষ্টা করেও ল্যাটরান নিজেদের দখলে আনতে পারল না। জেরুসালেমে অবরুদ্ধ ইহুদিরা তখন অনাহারে মরতে বসেছে। ল্যাটরানের দক্ষিণে জেরুসালেমকে সংযুক্ত করার জন্য একটা বাইপাস বানানো হল, পরে যার নাম দেওয়া হয় বার্মা রোড।

এরকম পরিস্থিতিতে ইউনাইটেড নেশনস মধ্যস্থতা করার একটা প্রয়াস করল। ইউনাইটেড নেশনসের মধ্যস্থতাকারী ফোক বার্নার্ডট একটা প্রস্তাব দিলেন। এই প্রস্তাবে জর্ডনের কিং আবদুল্লাকে গোটা জেরুসালেম সমর্পণ করার কথা বলা হয়। বলা বাহুল্য, বেন-গুরিয়নের ইসরায়েল এই প্রস্তাব পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে দিল। এই সময় পশ্চিমের দেশগুলি নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করার জন্য আরব এবং ইসরায়েল দু’ পক্ষকেই অস্ত্র বিক্রি করা বন্ধ রাখে। ইসরায়েল কিন্তু ব্যাপারটা আগে থেকেই আঁচ করে নিয়েছিল। তাই তারা চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র আনার কায়দাটিও ছিল অভিনব। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন বালাক’। ইসরায়েলি পাইলটরা রাতে বিমানে করে রাইফেল, মেশিন গান, ৭৫ মিমি আর্টিলারি ও ট্যাঙ্ক পরিবহন করে আনে। এই অপারেশনের কথা অবশ্য এই বইতেই অন্যত্র বিস্তারে করা হয়েছে।

ইউনাইটেড নেশনসের মধ্যস্থতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আবার শুরু হল যুদ্ধ। এর পরদিনই একটি মিশরীয় স্পিটফায়ার যুদ্ধবিমান পশ্চিম জেরুসালেমে বোমাবর্ষণ করল। আরব বাহিনী নরেডামের দিকে এগোল। তারা সেখান থেকে ‘ডোম অফ রক’ ও ‘আল আকসা মসজিদ’ দেখতে পাচ্ছিল।

কিং আবদুল্লা গ্লবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা জেরুসালেমকে ধরে রাখতে পারব তো?’

গ্লুব উত্তর দিলেন, ‘ইহুদিরা আর কোনোদিনই জেরুসালেম ফেরত পাবে না।’

এবার খানিকটা চিন্তিত স্বরেই কিং আবদুল্লা বললেন, ‘যদি তোমার মনে হয় ইহুদিরা জেরুসালেম দখল করতে পারে, তাহলে সেটা বলে ফেলো। তাহলে আমি নিজেই সেখানে যাব, আর দরকার পড়লে জেরুসালেম আয়ত্তে রাখার জন্য সেখানেই নিজের প্রাণ দিয়ে দেব!’

এদিকে ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালীনই নিজের সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছিল তাদের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮৮,০০০। তখন যুদ্ধরত আরব সৈন্যসংখ্যা প্রায় ৬৮,০০০। ইহুদিরা আরবদের দখলে থাকা লিড্ডা ও রামলা পুনর্দখল করল।

ইউএন-এর মধ্যস্থতাকারী বার্নার্ডট এবার আরেকটা প্রস্তাব রাখলেন জেরুসালেমকে আন্তর্জাতিক শহর করে দেওয়া হোক। ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি জেরুসালেম আসেন। জেরুসালেমকে আন্তর্জাতিক করার প্রয়াস জায়নিস্টদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার করে। লেহির সদস্যরা বার্নার্ডটকে চরম শিক্ষা দেওয়ার ছক কষল। বার্নাডট যখন ইসরায়েলের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল, একটা চেকপয়েন্টে তাকে গুলি করে লেহির তিন সদস্যের একটা টিম। পরে হাসপাতালে বার্নার্ডট মারা যান। এই ঘটনার পর লেহিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে, আততায়ীদের মধ্যে কেউই ধরা পড়েনি।

১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা ও ইহুদিরা আরব জাতীয়তাবাদের শক্তিকে গুরুত্ব দেয়নি। আর এবার আরবরা ইহুদিদের জাতীয়তাবাদের শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সেই একই ভুল করল। ইহুদিরা তাদের দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছিল। ইতিহাস সাক্ষী আছে, ইহুদিরা এই ভূমি রক্ষা করার জন্য অ্যাসিরীয়, মিশরীয়, স্যাসিনীয়, ব্যাবিলনীয়দের বিরুদ্ধে লড়েছে। তারা তিন বার বিদ্রোহ করেছে রোমানদের বিরুদ্ধে। সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সময় উপস্থিত হয়েছিল। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার মন্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামা ইহুদি সেপাইদের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। আর এই মানসিকতা তাদের মধ্যে এনে দিয়েছিল এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস। এক ইঞ্চি জমি তারা ছাড়বে না! তারা কেবল এগোবে সামনের দিকেই, পিছিয়ে আসার কোনো প্রশ্নই ছিল না।

ইহুদিদের এই আত্মবিশ্বাস আরবদের বিস্মিত করল। তখন ওল্ড জেরুসালেমের প্রতিটি গলিতে চলছে লড়াই। ইহুদিরা ওল্ড জেরুসালেম দখল করার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আরব বাহিনীর অগ্রগতিকেও তারা আটকে রেখে দিয়েছিল।

এরপর ঘটল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সেপ্টেম্বর মাসেই ইসরায়েলি সেনা মিশরীয় সেনাকে পরাস্ত করে নেগেভ মরুভূমির এলাকা দখল করল। তারা মিশরীয় সেনাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরেও ফেলল। ইসরায়েলের কাছে এই পরাজয় মিশরের কাছে ছিল অত্যন্ত অপমানজনক। কারণ মিশরই প্রথমে হুমকি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল। মিশরের পরাজয়ে বাকি আরব দেশগুলোও হতোদ্যম হয়ে পড়ে। যে যুদ্ধ এক সপ্তাহে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা কয়েক মাস চলার পরও শেষ হল না।

১৯৪৮ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে জেরুসালেমের মিলিটারি কমান্ডার মোসে দয়ান জর্ডনের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির চুক্তি করেন। ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েল ৫টি আরব দেশের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই যুদ্ধবিরতির পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে ছিল ইউনাইটেড নেশনস। চুক্তি অনুসারে জেরুসালেমকে দু’ ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। ইসরায়েল পেল পশ্চিম দিকের অংশ আর আবদুল্লার কাছে রইল ওল্ড সিটি, জেরুসালেমের পূর্ব অংশ ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। এই চুক্তিতে ইহুদিদের ওয়েস্টার্ন ওয়াল, দ্য মাউন্ট অফ অলিভস সিমেটরি, কিদরন ভ্যালি টুমে আসার অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এটা রয়ে যায় শুধু খাতায়-কলমেই। এই চুক্তির ১৯ বছর পর অবধি একজন ইহুদিকেও ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনে প্রার্থনা করতে দেওয়া হয়নি। সিমেটরিতে স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।

.

১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের অপমান কিন্তু মিশর ভোলেনি। এই যুদ্ধেরই একজন আহত সৈনিক ছিল গামাল আব্দেল নাসের এবং এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে ছিল বদ্ধপরিকর। নাসের আরবদের মধ্যে খুব শীঘ্রই একজন জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হল। আরব দুনিয়ায় সে পরিচিত হল ‘আল রইস’ বা ‘বস’ নামে। সে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে তুলল জনতার মধ্যে। ১৯৫৪ সালে মোহম্মদ নাগিবকে সরিয়ে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে সে মিশরের ক্ষমতায় আসে।

ক্ষমতায় এসেই নাসের প্যালেস্টাইনের মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণে মদত দিতে থাকে। আর ইসরায়েলও সেই সব হামলার জবাব দিতে আরম্ভ করে। ১৯৫৬ সালে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিদায়ে হামলাকারীদের ইসরায়েলে প্রবেশ করানো হয়। তারা রাতের অন্ধকারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে গা-ঢাকা দিতে পারদর্শী ছিল। সোভিয়েত অস্ত্র হাতে আসায় তারা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নাসেরের নেতৃত্বে মিশর, জর্ডন ও সিরিয়া ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিল। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রেডিওতে নাসের ইসরায়েলকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দিল।

১৯৫৬ সালে মিশর চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করে। এই চেকোস্লোভাকিয়ার অস্ত্রই ইসরায়েল ব্যবহার করেছিল ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনা মেনে নেওয়া ইসরায়েলের পক্ষে কষ্টকর ছিল। মিশর চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে ৩২০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ট্যাঙ্ক, বম্বার ও ফাইটার প্লেন কিনে নেয়।

চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে সোভিয়েত অস্ত্র কেনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমেরিকা মিশরকে আসওয়ান ড্যাম তৈরিতে সহায়তা করতে অস্বীকার করে। ব্রিটেনও হাত গুটিয়ে নেয়। নাসের এবার একটা মোক্ষম চাল চালল। ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ ক্যানেলকে সে রাষ্ট্রায়ত্ব করার কথা ঘোষণা করে। সে আরও ঘোষণা করে যে, সুয়েজ ক্যানাল থেকে যে আয় হবে তা আসওয়ান ড্যাম তৈরির কাজে ব্যবহার করা হবে। নাসেরের এই ঘোষণা আরব বিশ্বে তাকে রাতারাতি নায়ক বানিয়ে দেয়।

এই ঘোষণায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। ১৮৬৯ সালে চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই ক্যানেল ব্যবহার করতে হত ব্রিটিশদের। সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানির কাছে এটা ছিল তাদের সম্পত্তি চুরি যাওয়ার সামিল। কিন্তু নাসের নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইল।

মিশরের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে চিন্তিত ছিল ইসরায়েল। আর ওদিকে ফ্রান্সের উপনিবেশ আলজেরিয়াতে বিদ্রোহীদের মদত দিচ্ছিল মিশর। সুতরাং ফ্রান্সও মিশরের ওপর চটে ছিল। ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল একটি গোপন চুক্তি সাক্ষর করে। সেই চুক্তি অনুসারে ইসরায়েল সুয়েজ ক্যানেলের কাছাকাছি গিয়ে নাসেরের বাহিনীকে আক্রমণ করবে। আর সেই সুযোগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স, মিশর ও ইসরায়েলকে তাদের নিজের নিজের বাহিনী সুয়েজ ক্যানেল থেকে সরিয়ে নিতে বলবে। আর তার পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের জন্য সুয়েজ খালকে উন্মুক্ত করার জন্য মিশরকে চাপ দেবে।

কিন্তু এই আক্রমণ করার জন্য ইসরায়েল কী পাবে?

ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে যুদ্ধের সময় এয়ার কভার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইসরায়েলকে তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থনের আশ্বাস জোগায়। ফ্রান্স ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ডিরেক্টর সাইমন পেরেস এই অস্ত্র সরবরাহের দিকটা দেখছিলেন। এদিকে নাসের তখন ফিদায়ে বাহিনীকে মদত দেওয়ার জন্য গাজা ভূখণ্ডে সেনা পাঠাচ্ছে। পেরেস জানতেন, নাসের যে কোনো মুহূর্তে ইসরায়েল আক্রমণ করতে পারে।

২৯ অক্টোবর বিকেল ৫:০০টার সময় ইসরায়েলি সেনা সিনাইতে প্রবেশ করে। প্রথমেই তারা সিনাইয়ের মিশরীয় এয়ারফোর্সের সঙ্গে তাদের হেডকোয়ার্টারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপর অ্যারিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে ইসরায়েলি প্যারাট্রুপার বাহিনী সিনাইয়ের মিতলা পাসের দিকে এগোয়। ৩০ অক্টোবর মরুভূমি এলাকায় তিনটি মিশরীয় মিলিটারি বেস দখল করার পর ইসরায়েলি বাহিনী সুয়েজ ক্যানেলের ৫০ কিমি দূরত্বের মধ্যে চলে আসে।

৩০ অক্টোবরই ব্রিটিশ সরকার ইসরায়েল ও মিশরকে সেনা সরানোর জন্য আলটিমেটাম জারি করে। কিন্তু মিশর এই আলটিমেটামকে অগ্রাহ্য করে। আর ইসরায়েল পূর্ব পরিকল্পনামতো আলটিমেটামকে না শোনার ভান করে। পরের দিন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ফাইটার প্লেন মিশরের এয়ারফিল্ডগুলোতে বোমাবর্ষণ করে। টানা প্রায় ছ’ দিন ইসরায়েলি ও মিশরীয় সেনা মুখোমুখি লড়াই করে। ওই ছ’ দিন ব্রিটেন বা ফ্রান্স কেউই তাদের সেনা নামায়নি। ইসরায়েলকে লড়তে হচ্ছিল একাই।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই আমেরিকা হস্তক্ষেপ করে। তারা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে পিছু হটতে নির্দেশ দিল। সোভিয়েতরাও এতে সায় দিল। চাপে পড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে পিছু হটতে হল। সিনাই থেকে সেনা সরানোর ব্যাপারে ইসরায়েলের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কারণ, গাজা ভূখণ্ড হয়ে উঠেছিল উগ্রপন্থীদের লঞ্চিং প্যাড। শেষে আমেরিকা সেফ প্যাসেজের গ্যারান্টি দেওয়ার পর ইসরায়েল সিনাই থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের তরফে ২৩১ জন নিহত হয় আর আহত হয় ৯০০ জন। মিশরের তরফে আহতের সংখ্যা ছিল ১,৫০০-৩,০০০ জন আর আহত প্রায় ৫,০০০ জন।

এই যুদ্ধের ফলে গোটা দুনিয়ার সামনে সুপ্রিম মিলিটারি পাওয়ার হিসাবে উঠে আসে আইডিএফ। মাত্র ১০০ ঘণ্টার মধ্যে সিনাই দখল করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ওই যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে আরেকটা যুদ্ধের বীজ বপন করে দিয়ে গিয়েছিল।

জর্ডনের সেনাপ্রধান তখনও গ্লুব। যুদ্ধের পরপরই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই যুদ্ধের পর আরবরা আর কোনো ব্রিটিশকে বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না।

১৯৪৮ সালের যুদ্ধে আরবদের পক্ষে আরেক সৈনিক ছিলেন ইয়াসের আরাফাত। ১৯৫৯ সালে আরাফাত ‘ফাতাহ্’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেন, যার এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে ধ্বংস করা। ইসরায়েলের শত্রুর তালিকায় ফাতাহ্ ছিল নবতম সংযোজন। ১৯৬৪ সালে নাসের কায়রোতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য আরবদের সঙ্গে একটা বৈঠক করে। আহমেদ আল-শুকায়রির নেতৃত্বে তৈরি হল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। ১৯৬৮ সালে ফাতাহ্ পিএলও-তে যুক্ত হয়ে যায়।

১৯৬৪ সালের মে মাসে জর্ডনের কিং হুসেইন চালু করলেন প্যালেস্টাইন কংগ্রেস। এই প্যালেস্টাইন কংগ্রেসই পিএলও-কে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৬৫ সালে হুসেইন গোপনে ইসরায়েলি বিদেশমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। গোল্ডা মেয়ার তাকে বলেন, ‘একদিন আমরা অস্ত্র ছেড়ে জেরুসালেমে একটা মনুমেন্ট বানাব, যা আমাদের মধ্যে শান্তির স্মারক হয়ে রইবে।’

মেয়ারের এই স্বপ্ন সত্যি হয়নি। এই দুটো দেশ আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জেরুসালেমকে দ্বিখণ্ডিত করা নিয়ে ইসরায়েলিদের মনে ক্ষোভের অন্ত ছিল না। জেরুসালেমের প্রাচীন মন্দিরের একমাত্র অবশেষ ওয়েস্টার্ন ওয়াল তত দিনে চলে গেছে ইহুদিদের নাগালের বাইরে। প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে তারা সেখানে প্রার্থনা করেছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে পুরোনো জেরুসালেম, হেব্রন চলে গিয়েছিল জর্ডনের হাতে। প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের কোনো পুণ্যস্থানই ইসরায়েলের কাছে ছিল না।

ন্যাশনাল ওয়াটার ক্যারিয়ার প্রোজেক্ট ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় জল- প্রকল্প। সিরিয়া এই ওয়াটার রিসার্ভারের জলের ৩৫% ডাইভার্ট করার কথা ঘোষণা করে। ইসরায়েল এই ডাইভার্সনের তীব্র বিরোধিতা করে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় যে, এর ফলে ইসরায়েল যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবে। সিরিয়া কোনো কথায় কান না দিয়ে ডাইভার্সন প্রোজেক্টের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। ফলত সংঘর্ষ শুরু হয়। এদিকে সিরিয়া ইসরায়েলের গ্রামগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তো ওদিকে ইসরায়েল সিরিয়ার প্রোজেক্টের যন্ত্রপাতির ওপর হামলা চালায়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। তারা মিশর ও সিরিয়াকে জানাল যে, ইসরায়েল উত্তরে ১২টা ব্রিগেড নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং তিনি সোভিয়েত অ্যাম্বাস্যাডর দেমিত্রি চুকাখিনকে আমন্ত্রণ করে বলেন, ‘দেখে যান যে আসল ঘটনাটা কী।’ সোভিয়েতদের কাছে এটা একরকম চ্যালেঞ্জই ছিল। অবশ্য চুকাখিন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। আমেরিকানরাও বলে, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, এই একটা স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট ছিল দাবানল লাগানোর জন্য। সিরিয়া সোভিয়েতদের কথাই বিশ্বাস করল।

এর কয়েক সপ্তাহ পরেই ১৫ মে ইসরায়েলের ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’র প্যারেড। অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল জেরুসালেমে। প্রতি বছরই এটা আলাদা আলাদা জায়গাতে অনুষ্ঠিত হয়। এই প্যারেডে ইসরায়েলের বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের প্রদর্শন করা হয়। তবে সেবারে সামান্য ব্যতিক্রম হল। ১৯৪৯ সালে জর্ডনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে সম্মান জানানোর জন্য অস্ত্রের প্রদর্শন অনেকটাই সীমিত ছিল। ট্যাঙ্কের সংখ্যাও ছিল অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক কম।

আর এই ঘটনাই মিশর ও সিরিয়ার মনে সন্দেহ জাগাল। তাহলে কি বাকি ট্যাঙ্কগুলো আর অস্ত্রশস্ত্র যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়েছে?

সেদিন প্যারেড চলাকালীন একজন ইসরায়েলি আধিকারিক একটা চিরকুট পাঠালেন আইডিএফ-এর চিফ অব স্টাফ য়িত্জাক রাবিনকে। লেখা ছিল—- মিশরের বাহিনী সিনাই উপদ্বীপ এলাকাতে প্রবেশ করেছে।

রাবিন সেটা প্রধানমন্ত্রী এসকোলকে পাঠালেন। এসকোলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। আনন্দের অনুষ্ঠানে যেন হঠাৎ কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এল।

ইসরায়েলি নেতৃত্ব তখন এটা বুঝতে পারছে না যে, এমতাবস্থায় কী করা উচিত। কিছুটা আশা তখনও ছিল যে হয়তো আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে কায়রো রেডিওতে ঘোষণা হল– ‘আমাদের সেনা যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি তৈরি।’

১৫ মে আরবরা ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের শোক পালন করে। নাসের ঘোষণা করল, ‘ভাইসকল, প্যালেস্টাইনে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য তৈরি হও।’ নাসের মনে মনে ইসরায়েলের ধ্বংসের ছবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।

ইসরায়েল কিন্তু তখনও অপেক্ষাই করছিল। এই অপেক্ষা ইসরায়েলে ‘হামতানাহ’ নামে খ্যাত, যার অর্থ— অপেক্ষার সময়। মিশরীয়রা পাঁচটা ডিভিশনে সিনাইয়ে সেনা পাঠায়। প্রত্যেকটা ডিভিশনে ছিল ১,৫০০ জন সৈন্য, ১০০টা ট্যাঙ্ক, ১৫০টা সশস্ত্র সৈন্য-পরিবাহী যান এবং সোভিয়েত আর্টিলারি। তারা তিরানের সমুদ্রপ্রণালী অবরোধ করে। এর ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দর ঈলাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৯৫৬ সালে ইসরায়েলের সুয়েজ অভিযানের পর ১৯৫৭ সালে ইউনাইটেড নেশনসের এমারজেন্সি ফোর্স গাজাতে এবং সিনাইয়ের একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত শারম আল-শেখে কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করে ও বেশ কিছু অবজারভেশন পোস্ট বসায়। এর উদ্দেশ্য ছিল মিশর থেকে ইসরায়েলে যে কোনো রকম অনুপ্রবেশ আটকানো।

তাহলে মিশরের সেনা কীভাবে সিনাইতে ঢুকল?

ইউএন-এর পাহারাদাররা কি তাদের বাধা দেয়নি?

নাকি তারা নাসেরের বাহিনীকে দেখতেই পায়নি?

যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নাসের ইউনাইটেড নেশনসের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টকে বলেন, ‘ইউএন-এর সেনা সরিয়ে নিন।’

ইসরায়েলের তরফে আশা করা হয়েছিল যে, ইউএন নিশ্চয়ই এর বিরোধিতা করবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সমস্ত ইউএন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। ১৯ মে নাগাদ আর কোনো ইউএন বাহিনীর অস্তিত্বই রইল না ওই অঞ্চলে। এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আসন্ন যুদ্ধে ইউনাইটেড নেশনসের তরফ থেকে কোনো নিরাপত্তা পাবে না ইসরায়েল।

বিপদ বুঝে ইসরায়েলের বিদেশমন্ত্রী আব্বা এবান ফ্রান্সে ছুটলেন। এই ফ্রান্সই সিনাই তথা সুয়েজ অভিযানে ইসরায়েলকে সঙ্গ দিয়েছিল। তাই পুরোনো বন্ধুর কাছে সাহায্যের আশায় ছিল ইসরায়েল। ফ্রান্স জানিয়ে দিল, তারা এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকতে চায়। এবান তখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি. গালেকে মনে করালেন ১৯৫৬ সালের প্রতিশ্রুতির কথা, যেখানে ফ্রান্স ইসরায়েলকে কথা দিয়েছিল যে মিশরের সঙ্গে সংঘর্ষে তারা ইসরায়েলকে সমর্থন করবে। তখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ডিয়ার এবান, ১৯৫৬ সাল আর ১৯৬৭ সাল এক নয়। তাই না?’

এবান দেখলেন এরপর আর কথা বাড়ানো চলে না। ফ্রান্স থেকে তিনি খালি হাতেই ফিরলেন। তার কানে বাজছিল একটাই কথা— ১৯৫৬ সাল আর ১৯৬৭ সাল এক নয়!

এরপর এবান ছুটলেন লন্ডনে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এবার হ্যারল্ড কিছুটা স্বস্তি পেলেন। উইলসন জানালেন যে, ব্রিটেন মিশরের এই অবরোধকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে না।

১৯৫৭ সালে আমেরিকা ইসরায়েলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যদি মিশর তিরান অবরোধ করে তাহলে ইসরায়েল তার সেলফ ডিফেন্সের অধিকার প্রয়োগ করতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে আমেরিকার সম্মতি থাকবে। আমেরিকা জানত যে, মিশরের এই অবরোধ অনৈতিক কিন্তু আমেরিকা তখন নিজেই ভিয়েতনামের যুদ্ধে জেরবার। সুতরাং আমেরিকার কাছেও হতাশা ছাড়া আর কিছুই পেল না ইসরায়েল। ডি. গালের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনও ইসরায়েলকে পরামর্শ দিলেন প্রথমে আক্রমণ না করার। তিনি বললেন, ‘ইসরায়েল যদি একা না এগোয়, তাহলে ইসরায়েল একা হয়ে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

তাহলে ১৯৫৭ সালে আমেরিকার দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতির কী হল? সবই কি তবে কথার কথা? এক দিকে মিশরের অবরোধ, অন্য দিকে আবার প্রথমে আক্রমণও করা যাবে না। এ তো রীতিমতো উভয়সংকট।

ইসরায়েলের জনতার মধ্যে তখন ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ২৭ মে ক্যাবিনেট ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিল যে তারা প্রথমে আক্রমণে যাবে না। তারা অপেক্ষা করবে। প্রধানমন্ত্রী ভয়ভীত ও উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার জন্য ২৮ মে রেডিওতে ভাষণ দিলেন। এই ভাষণ দেবার সময়টাই হয়তো এসকোলের জীবনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত। তার এই ভাষণ ‘স্ট্যামারিং স্পিচ’ নামে খ্যাত। তার ভাষণে জনগণের মধ্যে ভয় ও হতাশা আরো বেড়ে গেল। ইসরায়েলের অনেক নেতাও ক্যাবিনেটের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ছিল।

১৯৪৮-এর যুদ্ধের পর ইসরায়েলের সঙ্গে জর্ডনের সম্পর্ক ছিল মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ। ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে গত ১৯ বছর ধরে ইসরায়েলের সম্পর্ক বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু আরব দুনিয়ার চাপে পড়ে জর্ডন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হয়। ১৯ মে জর্ডনের রাজা হুসেন কায়রোতে আসেন নাসেরের সঙ্গে দেখা করার জন্য। জর্ডন, মিশর ও সিরিয়া একজোট হয় ইসরায়েল আক্রমণ করার জন্য। এর পরের দিনই ইরাকি ফৌজ মিশরে পৌঁছায়। ১৯৪৮-এর মতো এবারেও তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রহী।

পরিস্থিতি ক্রমশ ইসরায়েলের প্রতিকূলে যেতে থাকে। আমেরিকা ইসরায়েলকে মিসাইল, ট্যাঙ্ক ও জেট সরবরাহ করা বন্ধ করে দিল। তাদের অজুহাত ছিল— এখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ। এরপর ফ্রান্সও যখন ইসরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকার করল, তখন ইসরায়েলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কারণ এরকমটা তারা কোনো ভাবেই আশা করেনি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘যে দেশ প্রথম আক্রমণ করবে, ফ্রান্স তাকে বয়কট করবে।’ ফ্রান্সের ইসরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি না করার কারণটা ছিল অন্যরকম। ন্যায়-নীতির চেয়ে নিজেদের দেশের ও ব্যবসার স্বার্থই এখানে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্স বিশ্বাস করত না যে, এই যুদ্ধে ইসরায়েল জিততে পারে। সুতরাং আরব দুনিয়ার সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলার এটাই সুযোগ।

আইডিএফ-এর চিফ অব স্টাফ য়িত্জাক রাবিন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন। হঠাৎই তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। এটাকে তখন নিকোটিন পয়জনিং বলে চালাবার চেষ্টা করা হয়, কারণ সত্যি ঘটনা জানলে মানুষের আতঙ্ক আরও বেড়ে যেত। ইসরায়েলের সামনে কেবল একটা যুদ্ধ নয়, যেন তার স্বাধীনতার অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছিল।

ওই সময়ে ইউরোপ আর আমেরিকার ইহুদিরা ইসরায়েলের সমর্থনে নামল। তারা অর্থ দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করা শুরু করল এবং ওয়াশিংটনের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করল। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় প্রায় ১,৫০,০০০ লোকের মিছিল বের হল ইসরায়েলের সমর্থনে।

ওদিকে আরব বিশ্বও তখন জেগে উঠেছে। নাসের ঘোষণা করছে, ‘আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল ইসরায়েলকে ধ্বংস করা।’ পিএলও-এর চেয়ারম্যান হুংকার দিলেন, ‘আগুন যখন লাগবে, একটা ইহুদিও বাঁচবে না।’

কায়রো, বাগদাদ, দামাস্কাসে লোক বিক্ষোভে সামিল হল। তাদের মুখে ছিল স্লোগান— ‘ইহুদিদের মেরে ফেলো।’

ইসরায়েল নিজেকে তৈরি করছিল সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য। রামাত গান স্টেডিয়াম ৪০ হাজার লোকের সমাধির জন্য প্রস্তুত করা হয়। হোটেলগুলোকে খালি করে দেওয়া হয় আপদকালীন পরিস্থিতিতে মেডিকাল এইড দেওয়ার জন্য। স্কুলগুলোকে বম্ব শেল্টারে পরিণত করা হল। ইসরায়েলি শিশুদের ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছিল।

এসকোল উপলব্ধি করলেন যে, এরকম পরিস্থিতিতে গোটা দেশের মানুষকে এক জোট হয়ে লড়তে হবে। তিনি বিরোধী পক্ষের নেতাদেরকেও ক্যাবিনেটের অন্তর্ভুক্ত করলেন। বিরোধী পক্ষের নেতাদের মধ্যে মেনাকেম বিগিনও ছিলেন বেন-গুরিয়নের রাফি পার্টির মোসে দয়ানকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদে বসানো হল।

২ জুন, ১৯৬৭। ইসরায়েলের ক্যাবিনেট মিটিংয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করা হয়। ৪ জুন, রবিবার দয়ান ক্যাবিনেটের সামনে নিজের রণনীতি পেশ করলেন। মিশরীয়রা সিনাইতে ১,০০,০০০ সৈন্য ও ৯০০ ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছিল। উত্তরে সিরিয়া ৭৫,০০০ সৈন্য ও ৪০০ ট্যাঙ্ক তৈরি রেখেছিল। আর জর্ডন মোতায়েন করেছিল ৩২,০০০ সৈন্য ও ৩০০ ট্যাঙ্ক। তার মানে, ইসরায়েলকে লড়তে হত ২,০৭,০০০ সৈন্য ও ১৬০০ ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে।

আর ইসরায়েলের কাছে কী ছিল?

২,৬৪,০০০ সৈন্য ও ৮০০ ট্যাঙ্ক।

আর যুদ্ধবিমান?

আরবদের ছিল ৭০০ ফাইটার প্লেন, সেখানে ইসরায়েলের ছিল মাত্র ৩০০ টা। সুতরাং শুরু থেকেই পরিষ্কারভাবে ব্যাকফুটে ছিল ইসরায়েল।

মোসে দয়ান এবার আগেই আক্রমণ করার অনুমতি চাইলেন ক্যাবিনেটের কাছে। কারণ, তাঁর মতে আগে আক্রমণ করলে তবেই ইসরায়েলের পক্ষে এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব।

ক্যাবিনেট ১২-৫ ভোটে আগে আক্রমণ করার প্রস্তাবকে সমর্থন দিল। এবারের রণনীতি ছিল— আক্রান্ত হওয়ার আগেই আক্রমণকারীকে শেষ করে দাও, ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট।’

৫ জুন, ১৯৬৭। তেল আভিভ শহর থেকে মাত্র ১২ মাইল দূরে তেল নফ এয়ারফোর্স বেসে ৫৫ নম্বর প্যারাট্রুপার ব্রিগেডকে মোতায়েন করা হল। সকাল ৭:১০ নাগাদ ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান টেক অফ করল, আর খুব কম উচ্চতা দিয়ে দ্রুত উড়ে যেতে থাকল দক্ষিণের দিকে। ৭:৩০টার মধ্যে প্রায় ২০০ যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়েছে মিশরের দিকে। ইসরায়েল খুব ভালোভাবেই জানত যে, এই সময় মিশরের পাইলটরা প্রাতরাশ সারছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের বিমানগুলো অসুরক্ষিত অবস্থায় ছিল। তবে ইসরায়েলও সেদিন বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিল। মাত্র ১২টা যুদ্ধবিমান ছিল ইসরায়েলের সুরক্ষার জন্য, আর বাকি সব গিয়েছিল আক্রমণে।

যুদ্ধবিমানগুলো মিশরের রাডার ডিটেকশন এড়ানোর জন্য খুব নীচু দিয়ে উড়ছিল— কখনো কখনো মাটি থেকে মাত্র ১৫ মিটার উচ্চতায়। পাইলটদের কড়া নির্দেশ দেওয়া ছিল যে, কোনো ভাবেই রেডিও যোগাযোগ ব্যবহার করা যাবে না। অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতি হলে পাইলটদের বিমান সমুদ্রে ক্র্যাশ করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও জর্ডনের রাডারে ইসরায়েলি বিমানের গতিবিধি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল ইসরায়েলের। মিশর তাদের ফ্রিকোয়েন্সি কোড পালটে দিয়েছিল যেটা জর্ডনের জানা ছিল না, আর তাই তারা মিশরকে সময়মতো সতর্ক করতে পারেনি। এই ভুলের মাসুল মিশরকে দিতে হল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার আক্রমণে কয়েকশো মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস হল। এক-তৃতীয়াংশ পাইলট মারা গেল। ১৩টা এয়ার বেস নষ্ট হল। ২৩টা রাডার স্টেশন ধ্বংস হল এবং এয়ারক্রাফ্ট সাইটগুলো মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। মোট কথা, মিশরের বায়ুসেনা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

ইসরায়েল এই অপারেশনে ১৭টা যুদ্ধবিমান ও ৫ জন পাইলট হারিয়েছিল। সকাল ১০:৩৫ নাগাদ য়িত্জাক রাবিন নিশ্চিত হলেন যে, মিশরীয় বায়ুসেনা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মিশন সফল! যুদ্ধ শুরুর আগেই যুদ্ধটা প্রায় জিতে গিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েল জর্ডনের রাজা হুসেনকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ করেছিল। জর্ডনের সেনা অবশ্য তখন যুদ্ধে নেমে গেছে। তবু ইসরায়েল জর্ডনকে অনুরোধ করে, যদি জর্ডন যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, তবে ইসরায়েল ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে পুরো সম্মান জানাবে। কিন্তু জর্ডনের রাজার পক্ষে আরব দুনিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব ছিল না।

৫ জুন বেলা ১১:৫০ নাগাদ জর্ডন, সিরিয়া ও ইরাকের যুদ্ধবিমান একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে। প্রায় দু’ ঘণ্টার লড়াইয়ে ইসরায়েল আরবদের আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করে এবং বহু আরব বিমান ধ্বংস করে। জর্ডন ও সিরিয়ার এয়ার বেসগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। গোটা দিনে ইসরায়েল আরবদের ৪০০টা এয়ারক্রাফ্ট ধ্বংস করে। এক নতুন শক্তি হিসাবে উঠে আসে ইসরায়েলের বায়ুসেনা।

এদিকে স্থলযুদ্ধে ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডকে বাকি মিশর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরের দিন কোনো বুলেট খরচ না করেই ইসরায়েল শারম আল-শেখ দখল করে আর তিরান প্রণালী পুনরায় খুলে দেয়।

ইসরায়েলের সংসদের বিরোধী দলনেতা মেনাকেম বিগিন এবার প্রধানমন্ত্রী এসকোলকে বললেন, ‘পুরো জেরুসালেম দখল নিয়ে নিন। জর্ডন যুদ্ধে জড়িয়ে যে অন্যায় করেছে তার মূল্য তো তাকে দিতেই হবে। ইসরায়েলের পক্ষে পুরো জেরুসালেমের ওপর কবজা করার এটাই সুযোগ।’

এসকোল দোটানার মধ্যে পড়লেন। কারণ, তিনি ভাবছিলেন, জেরুসালেম দখল করতে গেলে যে সংঘর্ষ হবে, তার ফলে ইসরায়েলের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। তিনি নিজের মনের কথা বিগিনকে বললেনও।

বিগিন এসকোলকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ‘এই সুযোগ হারালে কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম কোনোদিন আমাদের ক্ষমা করবে না।’

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আইডিএফ-কে নির্দেশ দেওয়া হল— ওল্ড জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করো। ইসরায়েলি প্যারাট্রুপার বাহিনী বাসে করে জেরুসালেমে প্রবেশ করল।

তবে ইসরায়েলের পক্ষে জর্ডনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরুটা মোটেই ভালো ছিল না। ইসরায়েলি সেনার কাছে খবর ছিল যে, জর্ডনের বাহিনীতে সৈন্যের সংখ্যা নাকি তাদের সৈন্যসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু এই তথ্য ছিল ভুল। জর্ডন ঢের বেশি সেনা মোতায়েন করেছিল ওল্ড জেরুসালেমের বাইরে। ইসরায়েলি বাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ল। ৬ জুন রাত আড়াইটে নাগাদ সংঘর্ষ শুরু হয়, আর তা শেষ হয় সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে হওয়া সমস্ত আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষের মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষগুলোর মধ্যে একটা। ইসরায়েলের ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয় আর জর্ডনের তরফে মারা যায় ৭১ জন। এই সংঘর্ষের পর ইসরায়েল ওল্ড জেরুসালেমের সন্নিকটে নো- ম্যানসল্যান্ডে পৌঁছায়। সকাল ৯:১৫ নাগাদ ৫৫ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার মোটা গুর-এর কাছে নির্দেশ আসে, ‘গো টু দ্য ওল্ড সিটি অ্যান্ড ইমিডিয়েটলি ক্যাপচার ইট!’

প্যারাট্রুপার বাহিনী লায়নস গেটের দিকে এগোতে থাকে। এক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী টেম্পল মাউন্টে পৌঁছায়।

মোটা গুর রিপোর্ট করলেন, ‘টেম্পল মাউন্ট এখন আমাদের দখলে।’

কয়েক হাজার বছর পর ইতিহাস তৈরি হল। এই প্রথম ওয়েস্টার্ন ওয়াল স্বাধীন ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরায়েলের হাতে এল যে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র দু’ দিন পর, ৭ জুন মিশর ও জর্ডনের বাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাজিত হল। নাসের নিজের বাহিনীকে ফিরে আসার নির্দেশ দিল। কিন্তু মিশরের পক্ষ থেকে সংঘর্ষবিরতি স্বাক্ষর করতে চাইছিল না কেউই। নাসের চাইছিল ১৯৫৬ সালের মতো শর্তাধীন চুক্তি হোক, যাতে ইসরায়েল সিনাই এলাকা ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফরাসি প্রেসিডেন্ট ডি গালে ঠিকই বলেছিলেন— ‘১৯৫৬ সাল আর ১৯৬৭ সাল তো আর এক নয়।’ ইসরায়েল কোনো শর্তাধীন চুক্তি করতে রাজি হল না। উপায়ান্তর নেই দেখে নাসের ৮ জুন মধ্যরাত্রে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি সই করে।

এদিকে উত্তর দিকে সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ তো চলছিলই। ইসরায়েল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে, তারা গোলান মালভূমি সিরিয়ার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে। প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে ইসরায়েলি পক্ষ। ৯ জুন নাগাদ সিরিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে থাকে। ১০ জুন সিরিয়া সংঘর্ষ-বিরতি করতে বাধ্য হয়। ১০ জুন সিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

এই যুদ্ধেও জয়ের পতাকা ওড়াল ইসরায়েল। মিশরের প্রায় ১০-১৫ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায় ৫,০০০ সৈন্য নিখোঁজ হয়। জর্ডন হারায় ৭০০ জন সৈন্য; তাদের ক্ষেত্রে নিখোঁজ আর আহতের সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৬ হাজার। সিরিয়ার ক্ষতি তুলনামূলক কমই ছিল। ৪৫০ জন সৈন্যের প্রাণহানি এবং নিখোঁজের সংখ্যা ছুঁয়েছিল ২ হাজার। ইসরায়েলের তরফে নিহত সৈন্যসংখ্যা ৬৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ২,৫৬৭ জন ছিল।

এই যুদ্ধের ফল কী হয়েছিল জানেন?

ইসরায়েলের ভৌগোলিক আয়তন আগের তুলনায় প্রায় তিন গুণেরও বেশি বেড়ে যায়। গাজা ভূখণ্ড, সিনাই উপদ্বীপ অঞ্চল, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক (পূর্ব জেরুসালেম সহ) এবং গোলান মালভূমি ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই যুদ্ধে আরও একটা জিনিস প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, তা হল ইসরায়েলি সেনার পেশাদারিত্ব। ৫-১০ জুন অবধি চলা ছ’ দিনের এই যুদ্ধ বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে ‘সিক্স ডে’জ ওয়র’ নামে বিখ্যাত হয়ে গেছে।

.

১৯৭৩ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন ইসরায়েলে যে মিলিটারি প্যারেড হয়েছিল, সেটাই ছিল ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মিলিটারি প্যারেড এবং এই প্যারেড ছিল স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ইসরায়েলের শেষ মিলিটারি প্যারেড।

.

শেষ প্যারেড কেন?

খাতায়-কলমে কিন্তু বলা হয় যে, খরচ কমানোর জন্য মিলিটারি প্যারেড বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আসল কারণ কি এটাই?

ছ’ দিনের যুদ্ধের পর ইসরায়েল এক দুর্ধর্ষ মিলিটারি পাওয়ার হিসাবে উঠে এসেছিল। ইসরায়েলি জনতার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেছিল। তারা ভাবতে শুরু করেছিল যে, এটাই হয়তো শেষ যুদ্ধ; শত্রুপক্ষ হয়তো আর কোনোদিনই ইসরায়েলেকে আক্রমণ করার সাহস পাবে না। ইসরায়েলি সেনা আসলে অজেয়— এই ধারণা ঢুকে গিয়েছিল তাদের মাথায়।

ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্ত কিন্তু কখনোই শান্ত হয়নি। সিনাই উপদ্বীপে মিশরীয় ও ইসরায়েলি সেনার ঘাঁটিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল একটা সংকীর্ণ খাল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল বার-লেভ-লাইন। সেই খাল এতটাই সংকীর্ণ যে, দু’ পক্ষই একে অপরকে দেখতে পেত। ইসরায়েলের তরফে ভাবা হত, এই খাল থাকার ফলে মিশর আচমকা ইসরায়েলকে আক্রমণ করতে পারবে না। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও তাদের আটকে রাখতে পারবে ইসরায়েলি বাহিনী।

মিশর একের পর এক যুদ্ধ হেরেছে এবং একাধিক পরাজয়ের অপমান মিশর ভুলতেও পারেনি। যে কোনো মূল্যে ইসরায়েলের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া ছিল মিশর। ১৯৬৯ সালের ৮ মার্চ তারা ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। ইসরায়েলি সেনাও সেই হামলার পালটা জবাব দেয়। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত সংঘর্ষ জারি থাকে। এটাই ‘ওয়র অফ অ্যাট্রিশন’। আনুমানিক ৯২১ জন ইসরায়েলি প্রাণ হারায়, যাদের মধ্যে ৬৯৪ জন ছিল সৈন্য এবং বাকিরা ছিল সাধারণ মানুষ। ইসরায়েলের দু’ ডজন এয়ারক্রাফ্ট নষ্ট হয়। আরবদের তরফে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। মিশরের সৈন্য ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার জন নিহত হয়। ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ১০০ এয়ারক্রাফ্ট।

১৯৭০ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের বিশ্ব জায়নিস্ট কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নাখুম গোল্ডম্যানকে শান্তি প্রক্রিয়ার আলোচনার জন্য কায়রোতে আমন্ত্রণ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তখন গোল্ডা মেয়ার। তিনি ভাবলেন, এটা নিশ্চয়ই মিশরের একটা ফাঁদ। গোল্ডম্যানকে বললেন, ‘কায়রো যাওয়ার দরকার নেই।’

যুদ্ধ দেখে দেখে ক্লান্ত ইসরায়েলি জনতা তখন শান্তি চাইছিল। তারা ভাবল, গোল্ডা মেয়ার শান্তির পথকে অবরুদ্ধ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপে জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ১৯৭০ সালের ২৮ এপ্রিল ৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রী গোল্ডা

মেয়ারকে একটা চিঠি পাঠাল—- ‘টুয়েলফথ গ্রেডার্স লেটার’। সেই চিঠি গোটা দেশকে নাড়া দিয়ে গেল।

কী ছিল সেই চিঠিতে?

ওতে লেখা ছিল— আর কত যুদ্ধ লড়ব আমরা? সরকার এই শান্তি প্রক্রিয়াতে বাধা দিচ্ছে কেন? এই চিঠির পর প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের বিরুদ্ধে জনরোষ আরও বাড়ল।

হয়তো শ্রীমতি মেয়ার ব্যাপারটা ভেবে দেখতেন। হয়তো দু’ পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হত। কিন্তু নিয়তি অন্য কিছুই লিখেছিল ইসরায়েলের ললাটে। কয়েক মাস পরেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের মৃত্যু হয়। নাসের না পারল ইহুদিদের সমুদ্রে ফেলতে, না পারল শান্তিচুক্তি করতে।

নাসেরের মৃত্যুতে একটি অধ্যায় সমাপ্ত হল। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের কাহিনি তো থেমে থাকে না। শেহেরজাদের কিসসার মতোই শুরু হয়ে যায় আরেকটা অধ্যায়। ইসরায়েলকে ধ্বংস করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন ইয়াসের আরাফাত। প্যালেস্টাইনের হিংসাকে তিনি ছড়িয়ে দিলেন গোটা বিশ্বে। ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর তারা হামলা চালানো শুরু করল। ইউরোপেও জাল বিস্তার করল তাঁর সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ১৯৬৭-৭১ সালের মধ্যে অসংখ্যবার তারা ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। আরাফাতের লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের শেষ করা।

প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসবাদীরা ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটা সুইস এরোপ্লেন হাইজ্যাক করে মোট ৪৩ জন মানুষকে মেরে হত্যালীলা চালায়। এদের মধ্যে ১৭ জন যাত্রী ছিল ইহুদি। ওই একই দিনে মিউনিখের একটি বৃদ্ধাশ্রমে ঢুকে তারা ৭ জন বৃদ্ধ ইহুদিকে হত্যা করে।

ইসরায়েলের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং ১৯৬৭ সালের ছ’ দিনের যুদ্ধের পর বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি মানুষ চলে গিয়েছিল জর্ডনে। ১৯৭০ সালের মধ্যে পিএলও সেখানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। জর্ডনে হাশেমি রাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর জন্য তারা নাশকতামূলক কাজকর্ম শুরু করে। তারা জর্ডনের তিনটি বিমান হাইজ্যাক করে ও টেলিভিশনে লাইভ টেলিকাস্ট করে বিমানগুলোকে ধ্বংস করে। কিং হুসেইনের ওপরে ৩ বার ফেইলড অ্যাসাসিনেশন হয়। কিং হুসেইন এরপর পিএলও-কে সমূলে উৎপাটন করার জন্য জর্ডনের সেনাকে নির্দেশ দেন। এই অভিযান ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামে খ্যাত। পিএলও এবং জর্ডনের সেনার মধ্যে সংঘর্ষ গৃহযুদ্ধের আকার নেয়, যা শুরু হয় ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বর মাসে আর শেষ হয় ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে। কয়েক হাজার পিএলও জঙ্গি নিহত হয় সংঘর্ষে। আর এই লড়াইয়ের মাঝে পড়ে প্রাণ হারায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। জর্ডনের গৃহযুদ্ধের সুযোগে সিরিয়া জর্ডন দখল করার একটা সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পায়। কিন্তু গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের ট্যাঙ্কের উপস্থিতির জন্য তারা আর এগোয়নি। এখানে একটা কথা বলে রাখি বন্ধুরা, আমরা ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নিয়ে পরে আরও কিছু কথা বলেছি।

কিং হুসেইন পিএলও-এর হাত থেকে নিজের রাজত্ব রক্ষা করলেন বটে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটা দেশ এই সন্ত্রাসবাদীদের জন্য বরবাদ হয়ে গেল।

কোন দেশ?

লেবানন। জর্ডনের সেনার তাড়া খেয়ে লেবাননে পালিয়ে যায় পিএলও জঙ্গিরা। প্রাথমিক ভাবে তাদের আশ্রয় দিলেও ১৯৭৫ সাল নাগাদ লেবানন ভুলটা বুঝতে পারে। ‘মধ্যপ্রাচ্যের প্যারিস’ রূপে বিখ্যাত লেবাননে শুরু হল গৃহযুদ্ধ। আর এর জন্য দায়ী ছিল একটাই লোক— ইয়াসের আরাফাত।

নাসেরের পর মিশরের প্রেসিডেন্ট হন আনোয়ার সাদাত। সাদাতের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিশরের সম্পর্কের অবনতি হয়। এই অবনতি সত্ত্বেও কিন্তু রাশিয়া সমানে তাদের ফাইটার জেট, ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল, সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এবং স্কুড মিসাইল সরবরাহ করে চলেছিল। মিশরের পাশাপাশি সোভিয়েতরা সিরিয়াকেও নিয়মিত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। ফলে এই দুটো দেশই সোভিয়েত অস্ত্রে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। আর সবকিছু এত দ্রুত ঘটছিল যে, ইসরায়েলের কাছে তা মাথাব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

নাসেরের মতো সাদাতও মিশরের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাদাত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে- যৌথভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করা হবে।

মিশর ইসরায়েলের দক্ষিণ সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় মিলিটারি মহড়া শুরু করে দিল। ইসরায়েল হাইকমান্ড এটাকে রুটিন এক্সারসাইজ ভেবে অগ্রাহ্য করল। মিশরের আসল মতলব ছিল সুয়েজ ক্যানেল পেরিয়ে ইসরায়েলে হানা দেওয়া। আর এই খবর কিন্তু ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কানে গিয়ে পৌঁছাল। তা সত্ত্বেও ইসরায়েলি হাইকমান্ড এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিল না।

এই বছরই জর্ডনের রাজা হুসেইন গোপনে জেরুসালেম এসে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি গোল্ডা মেয়ারকে জানান যে, মিশর ও সিরিয়া ইসরায়েলে হামলা করার ছক কষছে। স্বাভাবিক ভাবেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিচলিত হয়ে পড়লেন। ইসরায়েল হাইকমান্ড তাঁকে আশ্বস্ত করল

চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি।

কিন্তু তারা এবারেও কোনো ব্যবস্থা করল না।

অক্টোবরের শুরুতে মোসাদ এজেন্ট আসরাফ মারওয়ান ইসরায়েলকে মিশরের হামলার ব্যাপারে সতর্ক করেন। এই আসরাফ মারওয়ান ছিলেন মিশরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাসেরের জামাই ও একজন ইসরায়েলের গুপ্তচর। আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর এই সতর্কবার্তা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেই পৌঁছায়নি।

১ অক্টোবর সাদার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট বেঞ্জামিন সিমন তোভ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডেভিড গেদালিয়াহকে একটা রিপোর্ট দেন, যাতে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন যে, মিশরীয় সেনা যুদ্ধের আয়োজন করছে। অবাক করার মতো ব্যাপার হল গেদালিয়াহ এই রিপোর্ট হেডকোয়ার্টারে পাঠানোর প্রয়োজনই মনে করেননি। সবকিছু খুব অদ্ভুত এবং উলটো পথে চলছিল।

অক্টোবরের ৪ ও ৫ তারিখ সমস্ত সোভিয়েত পরামর্শদাতারা মিশর ও সিরিয়া ত্যাগ করে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই ঘটনাও ইসরায়েলি হেডকোয়ার্টারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এই দুটো দিনেই আকাশ থেকে নেওয়া কয়েকটা ছবিতে সীমান্ত এলাকায় অনেক বেশি সংখ্যায় ট্যাঙ্ক, ইনফ্যান্ট্রি ইউনিট ও মিসাইলের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ৫ অক্টোবর রাত ১২:৩০এ মোসাদের হেডকোয়ার্টারে একটা জরুরি টেলিগ্রাম আসে। মারওয়ান অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের ব্যাপারে আবার সতর্ক করেন ইসরায়েলকে। তিনি মোসাদের প্রধান জ্বি জামিরকে জানান যে, ৬ অক্টোবর মিশর আক্রমণ করবে। আর বড় ব্যাপার ছিল যে এই দিনটি হল ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র দিন— য়ম কিপ্পুর।

পরের দিন, ৬ অক্টোবর, শুক্রবার ইসরায়েলি ক্যাবিনেট একটা জরুরি বৈঠক করল। চিফ অব স্টাফ জেনারেল এলাজার তৎক্ষণাৎ আকাশপথে হামলা চালানোর অনুমতি চাইলেন। কিন্তু অনুমতি মিলল না।

কারণ কী ছিল?

কারণ আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঁচ বছর কাটানো য়িজাক রাবিন মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার হেনরি কিসিঞ্জারকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিলেন যে, ইসরায়েল কখনোই প্রথমে আক্রমণ করবে না। সুতরাং, আগ বাড়িয়ে আকাশপথে হামলা চালানোর অনুমতি দেওয়া হল না। তার পরিবর্তে সেনাবাহিনীর একটা ক্ষুদ্র অংশ পাঠানো হল সিনাই উপদ্বীপে।

‘য়ম কিপ্পুর’ ইহুদিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটা দিন। যারা একেবারেই ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের ধার ঘেঁষে না, তারাও এই দিনটিতে উপবাস করে; যারা কোনোদিন সিনাগগের মুখ দেখেনি, তারাও এই দিনটিতে সিনাগগে যায় প্রার্থনা করতে। গোটা ইসরায়েল সেদিন শান্ত ছিল। দোকানপাট বন্ধ রাস্তায় গাড়িঘোড়া প্রায় ছিল না বললেই চলে।

বেলা ২টো নাগাদ সমস্ত নীরবতা খান খান করে দিয়ে সাইরেন বেজে উঠল। আকাশপথে হামলার সতর্কতা হিসাবে বাজছিল ওই সাইরেন। ‘সিক্স ডে’জ ওয়র’-এরপর এই প্রথম বার ওভাবে সাইরেন বাজল। রেডিওতে ঘোষণা হল—সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সকলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।

৩:৩০-এ ঘোষণা করা হল, মিশর ও সিরিয়া ইসরায়েল আক্রমণ করেছে। মুহুর্মুহু সাইরেনের আওয়াজে কেঁপে উঠছিল চতুর্দিক। হাজার হাজার মানুষ তখন ছুটছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।

বিকেল ৪:০০টের সময় সৈন্যবোঝাই গাড়িতে পথ ভরে গেল। তারা চলেছিল দক্ষিণের সীমান্তে। হাসপাতালগুলো থেকে খুব অসুস্থ রোগী ছাড়া বাকি সবাইকে ডিসচার্জ দেওয়া হল। উদ্দেশ্য একটাই— আসন্ন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের জায়গা দিতে হবে যে। প্রতিটা পরিবারের সমস্ত সক্ষম পুরুষদের ডেকে নেওয়া হল যুদ্ধের জন্য। একটু বাদেই ঘোষণা হল যে, মিশরের বাহিনী সুয়েজ ক্যানাল অতিক্রম করেছে। ৫টা নাগাদ ঘোষণা হল, আপার গ্যালিলিতে সিরিয়ার বিমান হামলা করছে।

ইসরায়েলের পক্ষে পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। সুয়েজ ক্যানাল পার করে ২ হাজার মিশরীয় সৈন্য তখন ঢুকে পড়েছে, আর তাদের সুরক্ষা দিয়ে চলেছিল ২৪০টা ফাইটার জেট।

আর এদিকে? ইসরায়েলের পক্ষে?

মিশরীয়দের আটকানোর জন্য মোতায়েন ছিল মাত্র ৪৩৬ জন ইসরায়েলি সেনা! ওধারে গোলান মালভূমি হয়ে গ্যালিলির দিকে এগিয়ে আসছিল সিরিয়ার ১,৪০০ ট্যাঙ্ক। কিন্তু সেই মুহূর্তে ৬০০টা সিরিয়ান ট্যাঙ্কের মোকাবিলা করার জন্য ছিল ইসরায়েলের মাত্র ৫৭টা ট্যাঙ্ক!

সেদিন মধ্য রাত্রে ইসরায়েল রিজার্ভে থাকা ২ লক্ষ সৈন্যকে যুদ্ধে পাঠায়। সেই সব সৈন্যদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল যারা আগে কোনোদিন কোনো যুদ্ধ লড়েনি। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বহু দিনের পুরোনো অস্ত্র, যার মধ্যে কিছু ছিল ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার গোছের ইসরায়েলিরা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল একবার দেখে নিই আমরা–তাদের লড়াই করতে পাঠানো হচ্ছিল ৩ লক্ষ সিরিয়ান ও ৮.৫ লক্ষ মিশরীয় সৈন্য বিরুদ্ধে। প্রতি বারের মতো যথারীতি এবারও মহানন্দে ইরাক য়ম কিপ্পুর যুদ্ধে যোগ দিল। তাদের অবদান ছিল ১৪ হাজার সৈন্য। লেবানন ও আরব লিগের সঙ্গে সামিল হল। আরবদের প্রতি ৬ জন সৈনিকের মোকাবিলা করার জন্য ইসরায়েলের কাছে ছিল মাত্র ১ জন সৈনিক। মাত্র ২৫ বছরের আয়ুসম্পন্ন একটা দেশ আরেক বার অস্তিত্ব সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।

যুদ্ধের প্রথম ৫ দিন ইসরায়েলের পক্ষে ছিল খুবই শোচনীয়। গোটা যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার অর্ধেকটা হয়ে গিয়েছিল ওই প্রথম ৫ দিনেই। ইসরায়েলি সেনার মনোবল তখন তলানিতে। মিশর যুদ্ধে জিতলে কী হবে সেটা ভেবেই সকলে শিহরিত হচ্ছিল। প্রথম ২ দিনেই ইসরায়েলের ১০% এয়ারক্রাফ্ট ধ্বংস হয়ে গেল। প্রথম ধাপে পাঠানো অর্ধেক ট্যাঙ্কও ওই ক’দিনে বিধ্বস্ত। ৮ অক্টোবর অবধি সিনাইতে পাঠানো ২৯০টা ট্যাঙ্কের মধ্যে ১৮০টা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে সাহায্যের আবেদন জানালেন। তিনি টেলিভিশনে এক ভাষণের মাধ্যমে জর্ডনকে অনুরোধ করলেন যাতে তারা এই যুদ্ধে যোগ না দেয়। আমেরিকার সাহায্য তখন দারুণ জরুরি ছিল। গোটা ইসরায়েল তখন অপেক্ষা করছিল আমেরিকার সাহায্যের।

১০ অক্টোবর টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। সোভিয়েদের তীব্র নিন্দা করলেন মেয়ার। তাঁর মত ছিল, মিশর ও সিরিয়ার এই আক্রমণের জন্য দায়ী সোভিয়েত রাশিয়া; কারণ সমস্ত অস্ত্র সরবরাহ করছে তারাই।

আমেরিকা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকে সাহায্য করতে রাজি হল। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তাঁর সিকিউরিটি অ্যাডভাইসরকে ইসরায়েলকে সমরাস্ত্র সরবরাহের করার নির্দেশ দিলেন

কিন্তু হঠাৎই আমেরিকার ইসরায়েলের প্রতি এতটা সদয় হওয়ার কারণ?

ক্ষমতার অলিন্দে এখনও একটা খবর ঘোরে, আমেরিকার কাছে গোপন সংবাদ ছিল যে, ইসরায়েল তার পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডারে হাত দিতে চলেছে!

৮ অক্টোবর সিনাইতে ইসরায়েল মিশরীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই এবার আইডিএফ নিজেদের রণনীতিতে সামান্য পরিবর্তন আনল। তারা এবার মনোযোগ দিল উত্তরে— সিরিয়া সীমান্তে। দক্ষিণে ইসরায়েলি সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হল যে কোনো ভাবে মিশরকে আটকে রাখো। দু’ দিনের মধ্যেই, ১০ অক্টোবর সিরিয়ার বাহিনীকে ইসরায়েলি সেনা ঠেলে পাঠিয়ে দিল সীমানার বাইরে। ১১ অক্টোবর দামাস্কাস ইসরায়েলি আর্টিলারির রেঞ্জের মধ্যে চলে এল। ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান সিরিয়ান ডিফেন্স মিনিস্ট্রির বিল্ডিংয়ে বোমাবর্ষণ করল। এই ঘটনায় আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল ইসরায়েল। মোসে দয়ান সিরিয়াকে হুমকি দিলেন, ‘সিরিয়ানরা যেন মনে রাখে, যে পথে তারা দামাস্কাস থেকে ইসরায়েলে এসে পৌঁছছে, সেই একই পথে ইসরায়েলও কিন্তু দামাস্কাস পৌঁছে যেতে পারে।

ইসরায়েলি সেনা দামাস্কাসের দিকে পা বাড়াতেই নড়েচড়ে বসল সোভিয়েত রাশিয়া। ১১ অক্টোবর আমেরিকাতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আনাতোলি ডোবরিলিন আমেরিকাকে সতর্ক করলেন যে, দামাস্কাসকে রক্ষা করার জন্য রাশিয়া তাদের যুদ্ধবিমান ও রণতরী ব্যবহার করবে। এর ২ দিন বাদে, ১৩ অক্টোবর রিচার্ড নিক্সন আমেরিকান বিমানগুলোকে ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে দিলেন। এটাই ‘অপারেশন নিকেল গ্রাস’।

সিরিয়া বাগে এসে গিয়েছিল। এবার পালা দক্ষিণে মিশরকে দেখে নেওয়ার। ১৪ অক্টোবর মিশর একটা মারাত্মক ভুল করে বসল। রাশিয়ান সারফেস-টু- এয়ার মিসাইল ১২ কিমি রেডিয়াস পর্যন্ত এয়ারক্রাফ্ট হামলা থেকে মিশরীয় সেনাকে সুরক্ষা দিতে পারত। কিন্তু মিশরীয় সেনা ১২ কিমির সেই লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করে হামলা চালাতে গেল। আর তখনই মোক্ষম আঘাত হানল ইসরায়েলি বায়ুসেনার বিমান। মিশর ২৫০টা ট্যাঙ্ক হারাল। ইসরায়েলের ক্ষতি হল নামমাত্র। ইসরায়েল মিশরের ভুলের পুরো ফায়দা তুলে নিল। মিশরের বাহিনীকে তারা কোণঠাসা করে দিল।

১৫ অক্টোবর জেনারেল অ্যারিয়েল শ্যারনের নেতৃত্বে ইসরায়েলি সেনা নতুন উদ্যমে মিশরীয় সেনার ওপর হামলা চালাল। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইসরায়েলের প্রায় ৩০০ জন সৈন্য নিহত হল। এক সপ্তাহের মধ্যে ইসরায়েলি সেনা সুয়েজ ক্যানাল অতিক্রম করে দখল নিল তার পশ্চিম পাড়ের। ১৯ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা মিশর ও ইসরায়েলকে সিজ-ফায়ার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে সংঘর্ষ কিন্তু চলতেই থাকে।

২২ অক্টোবর ইউনাইটেড নেশনসের সিকিউরিটি কাউনসিল রেজোলিউশন ৩:৩৮ পাশ করে এবং সন্ধ্যা ৬:৫২তে যুদ্ধবিরতির ডাক দেয়। মাত্র ২ মিনিট বাকি থাকতে ইসরায়েল রেডিওতে ঘোষণা করে, আমরা যুদ্ধবিরতির শর্ত মানতে রাজি আছি।

সংঘর্ষ তারপরেও জারি ছিল। ২৪ অক্টোবর, রাত ২টো। ইসরায়েলি বাহিনী তখন ঘিরে ধরেছে মিশরীয় সেনাকে। মিশর ও সিরিয়া যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হল।

এই যুদ্ধে আরবরা হারিয়েছে মোট ৪৩২টি যুদ্ধবিমান, যেখানে ইসরায়েল হারিয়েছে মোট ১০২টা ফাইটার জেট। আরবদের পক্ষে নিহত সৈন্যসংখ্যা ৮,২৫৪ আর আহত ১৯,৫৪০। ইসরায়েলের পক্ষে নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ২,৬৫৬ ও ৭,২৫০ জন। আরবদের তুলনায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম, কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের তুলনায় এবারের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ৩ গুণেরও বেশি।

এখনও পর্যন্ত য়ম কিপ্পুরের যুদ্ধই ছিল শেষ যুদ্ধ যেখানে ইসরায়েল অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। এই যুদ্ধে ইসরায়েল আরবদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়তে আসা মানে নিজেকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। এরপরেও ইসরায়েল একাধিক যুদ্ধ লড়েছে, তবে সেগুলোর কোনোটাতেই ইসরায়েলের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *