এ-যুগের সবচেয়ে বড় ডাকাত
এক
আজ পর্যন্ত অনেক ডাকাত ও খুনির গল্প শোনা গেছে, কিন্তু, ফরাসি-ডাকাত বোনোটের ভয়ংকর দলের কাছে সেসব গল্প হচ্ছে খুব ঠান্ডা গল্প!
১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ডিসেম্বরের সকালবেলায় ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরছে।
প্যারিসের এক বড় ব্যাঙ্ক সবে দরজা খুলেছে। কেবি ও পিম্যান নামে ব্যাঙ্কের দুই কর্মচারী কয়েক লক্ষ টাকা নিয়ে এখনি আসবে, কর্তৃপক্ষ তাদেরই জন্য অপেক্ষা করছেন।
ব্যাঙ্কের কাছেই রাস্তার ওপরে একখানা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তার জানলা-দরজা বন্ধ, কিন্তু মেশিন বন্ধ নয়।
কেবি ও পীম্যানকে দেখা গেল,–তারা গল্প করতে করতে ব্যাঙ্কের দিকে এগিয়ে আসছে।
তারা ব্যাঙ্কের দরজার কাছে এল। হঠাৎ বন্ধ মোটরগাড়ির দরজা খুলে দুজন লোক রাস্তার উপরে লাফিয়ে পড়ল–তাদের হাতে রিভলভার।
তাদের রিভলভার গর্জন করলে–কেবি মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল। একজন লোক তার হাতের টাকার ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করতে লাগল, কিন্তু কেবি আহত হয়েও ব্যাগ ছাড়তে রাজি নয় দেখে সে আবার রিভলভার ছুঁড়ে তাকে একেবারে কাবু করে ফেলে। তারপর সে ব্যাগ নিয়ে এক লাফে মোটরের উপর চড়ে বসল।
রাস্তা তখন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। অনেক লোক মোটরের দিকে ছুটে এল, এবং সঙ্গে সঙ্গে মোটরের ভিতর থেকে দুদিকে দুখানা হাত বেরিয়ে পড়ল–প্রত্যেক হাতেই এক-একটা রিভলভার অগ্নি উদগার করছে। জনতার বীরত্ব উপে গেল–যে যেদিকে পারলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালে। একখানা লরি পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে। কিন্তু পারলে না–মোটরখানা। তিরের মতন বেগে তাকে এড়িয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল।
পুলিশের টনক নড়ল। তাদের চরেরা চারিদিকে খোঁজ নিয়ে এসে খবর দিলে, মোটরের মধ্যে ছিল বোনোট নামে একজন লোক ও তার সঙ্গীরা। মোটরখানাও একটা নদীর ধারে পাওয়া গেল–সেখানা চুরি করা মোটর।
কিন্তু বোনোটকে পুলিশ কিছুতেই আর ধরতে পারে না! সে ভারি চালাক–আজ এ বাসা, কাল ও-বাসা করে বেড়াতে লাগল, কোথাও দু-একদিনের বেশি থাকে না। পুলিশ যখনি খোঁজ পেয়ে তাকে ধরতে যায়, তখনই গিয়ে দেখে বোনোট আগেই তাদের ফাঁকি দিয়ে সরে পড়েছে!
এইভাবে এগারো বার সে পুলিশের চোখে ধুলো দিলে।
থিয়েইস নামক স্থানে দুজন ধনী লোক বাস করত–স্বামী ও স্ত্রী। এক রাত্রে কারা তাদের খুন করে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল। পুলিশ সন্ধান নিয়ে জানলে, এ হচ্ছে, বোনোটের দলের কাজ।
একদিন একজন পুলিশের লোক হঠাৎ দেখতে পেলে, চমৎকার একখানা মোটর চালিয়ে বোনোট রাজপথ দিয়ে যাচ্ছে। সে একলাফে মোটরের পাদানির উপর উঠে পড়ল–কিন্তু বোনোটের গুলি খেয়ে পরমুহূর্তেই তাকে ইহলোক থেকে বিদায় নিতে হল। সে-মোটরখানাকেও পরে শহরের একজায়গায় ভাঙাচোরা অবস্থায় পাওয়া গেল এবং সেখানাও চুরি করা মোটর।
মাসখানেক পরে কাউন্ট রৌগেট তাঁর মোটরে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন, আচম্বিতে তিনজন বন্দুকধারী লোক এসে গাড়ি থামিয়ে বললে, গাড়িখানা এখনি আমাদের ছেড়ে দিতে হবে।
ড্রাইভার ইতস্তত করলে সঙ্গে-সঙ্গে বন্দুকের গুলিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল। কাউন্ট গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়লেন, কিন্তু তিনিও গুলি খেয়ে যত জোরে পারেন পা চালিয়ে দিলেন।
বন্দুকধারীরা হচ্ছে, বনোট ও তার দুইজন সঙ্গী। কাউন্টের গাড়িতে আরও কয়েকজন দলের লোককে তুলে নিয়ে তারা আর-এক ব্যাঙ্কের দরজার এসে দাঁড়াল। তারপর দরজার দুইজন লোককে পাহারা দেওয়ার জন্যে রেখে তিনজন সঙ্গী নিয়ে বোনোট বুক ফুলিয়ে ব্যাঙ্কের ভিতরে প্রবেশ করলে।
তারপর তারা দু-চোখা গুলি চালাতে লাগল। ব্যাঙ্কের তিনজন লোককে হত ও আহত করে ভাণ্ডার লুটে টাকা নিয়ে ডাকাতের দল আবার সরে পড়ল।
এবারে পুলিশ অনেকটা সাবধান হয়েই ছিল। মোটরে ও মোটরবাইকে চড়ে দলে-দলে পুলিশ, ডাকাতদের পিছনে-পিছনে ছুটল।
কিন্তু তাদের কাছে যায় কার সাধ্য! গাড়ির ভিতর থেকে রাশি-রাশি গুলি ছুটে আসছে! একটা স্টেশনের কাছে এসে ডাকাতরা মোটর থেকে নেমে ট্রেনে চড়ে বসল। পুলিশের লোকেরা পরের স্টেশনে গিয়ে তাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তার আগেই পথের একটা বাঁকের মুখে এসে ট্রেন যখন তার গতি কমিয়ে দিলে, বোনোট নিজে লোকজন নিয়ে গাড়ি থেকে অদৃশ্য হল।
প্যারিসে সমস্ত লোক খেপে উঠে বলতে লাগল–পুলিশ কোনও কাজের নয়, তাদের অকর্মণ্যতায় আমরা এইবারে ধনেপ্রাণে মারা পড়ব।
পুলিশের বড়কর্তা প্রমাদ গুণে নিজেই কোমর বেঁধে কার্যক্ষেত্রে নামলেন। এমন ভয়ানক সাহসী ডাকাতের কথা তিনি কখনও শোনেননি। ইচ্ছা করলে এরা অনায়াসেই বিদেশে গিয়ে পুলিশকে কলা দেখাতে পারে, কিন্তু তা না করে পুলিশের চোখের সামনেই শহরে বসে এরা যা খুশি তাই করছে। পুলিশের বড়সাহেব বোনোটকে আবিষ্কার করবার জন্যে একশো কুড়িজন ডিটেকটিভ নিযুক্ত করলেন!
.
দুই
গজির ব্যবসা ছিল, চোরাই-মাল কেনা! পুলিশ সে-খবর রাখত। ডিটেকটিভ জোইন ও কোলমার একদিন সদলবলে গজির বাসায় গিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চয় বোনোটের খবর রাখো। শিগগির তার ঠিকানা বলো।
গজি বললে, দোতলায় একটা ঘরে একখানা খাতায় বোনোটের ঠিকানা লেখা আছে। আমি এখনি গিয়ে নিয়ে আসছি।
জোইন ও কোলমারের কেমন সন্দেহ হল, তাঁরাও গজির সঙ্গে-সঙ্গে উপরে গেলেন।
একটা ঘরের সামনে গিয়ে গজি বললে, ওই যাঃ, ঘরের চাবিটা নীচে ফেলে এসেছি। আপনারা একটু দাঁড়ান, চাবি নিয়ে আমি এখনি ফিরে আসছি।–সে আবার একতলায় নেমে গেল।
কিন্তু ঘরের দরজায় চাবি দেওয়া ছিল না। কারণ, কোলমার ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
জোইন ও কোলমার রিভলভার বার করে ঘরের ভিতরে ঢুকলেন–তৎক্ষণাৎ নিবিড় অন্ধকার ভেদ করে আর-একটা রিভলভারের অগ্নিশিখা গর্জে উঠল!
কোলমার তখনি সেইদিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং অন্ধকারেই কাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে মাটির উপরে পেড়ে ফেললেন।
কিন্তু সে কাবু না হয়ে উলটে রিভলভার ছুঁড়ে কোলমারকেই জখম করলে। তারপর জোইনের পালা! বোনোটের রিভলভার আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে, জোইনও ধরাশায়ী হলেন।
রিভলভারের শব্দে নীচে থেকে একজন পুলিশের লোক ছুটে এল। একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে সে দেখলে, ঘরের মেঝের উপরে রক্তগঙ্গার মাঝখানে তিন-তিনটে মৃতদেহ স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে। তার পায়ের শব্দ পেয়ে বোনোটও মৃত্যুর ভান করে আড়ষ্ট হয়ে রইল!
পাহারাওয়ালাটা তাড়াতাড়ি খবর দেওয়ার জন্যে আবার নীচের দিকে ছুটল। সেই ফাঁকে উঠে পড়ে বোনোট জানলা খুলে বেরিয়ে ছাদে চড়ে চম্পট দিলে!
তিনদিন পরে বোনোট গ্রেনঘড নামে এক দপ্তরিকে আক্রমণ ও আহত করলে। সে মিথ্যা সন্দেহ করেছিল যে, ওই দপ্তরিই তার বিরুদ্ধে থানায় খবর দিয়ে এসেছে।
.
তিন
ডুবইস ছিল বোনোটের বিশেষ বন্ধু। গোয়েন্দারা খবর পেলে, বোনোট তার বন্ধুর মোটরগাড়ির কারখানায় লুকিয়ে আছে।
তখন পুলিশের ফৌজ সেইদিকে ছুটল!
বোনোট তখন কারখানার বাইরে একখানা মোটরবাইকে চড়বার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ পুলিশের আবির্ভাব দেখেই সে বাড়ির বাইরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ছুটল এবং সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারও ছুঁড়তে লাগল। দুজন ইনস্পেকটর তার অব্যর্থ লক্ষ্যে আহত হলেন। পুলিশের পল্টনও বাড়ি আক্রমণ করলে, কিন্তু অত্যান্ত গুলিবৃষ্টির চোটে সকলে আবার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল।
কারখানা বাড়িটা ছিল একেবারে খোলা জায়গায়। কোনও দিক দিয়েই লুকিয়ে তার কাছে এগুবার উপায় ছিল না।
চারিদিক থেকে খবর পেয়ে দলে দলে তোক বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে ছুটে এল–পুলিশকে সাহায্য করবার জন্যে।
কিন্তু বোনোট ও তার স্যাঙাত ডুবইসের রিভলভারের ঘন-ঘন গর্জন শুনে কেউই আর বাড়ির কাছে ঘেঁষতে ভরসা করলে না!
বেলা দশটার সময় পুলিশসাহেব বুঝলেন, কেবল পাহারাওয়ালাদের সাহায্যে বোনোটকে বন্দি করা যাবে না। তখন খবর দিয়ে সৈন্যদের আনানো হল।
খড়ে-বোঝাই মালগাড়ির আড়ালে লুকিয়ে সৈন্যেরা ডিনামাইট দিয়ে বাড়ির দেওয়ালের খানিকটা উড়িয়ে দিলে।
কিন্তু তবু বিশেষ সুবিধা হল না। বরং, ভাঙা-দেওয়ালের ভিতর দিয়ে বোনোট ও ডুবইসের বন্দুক আরও বেশি গুলিবৃষ্টি করবার সুযোগ পেলে!
বৈকাল পর্যন্ত সমান যুদ্ধ চলল–একপক্ষে পুলিশবাহিনী, সৈন্যদল ও সারা শহরের বাসিন্দা, ও অন্যপক্ষে মাত্র দুটি প্রাণী। এমন যুদ্ধ কখনও হয়নি!
কিন্তু অসম্ভব কবে সম্ভব হয়? সৈন্যেরা ডিনামাইটের সাহায্যে বাড়ির আরও খানিকটা ভেঙে ফেলে তার চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দিলে।
তারপর সকলে একসঙ্গে বাড়িখানাকে আক্রমণ করলে।
বাড়ির ভিতর থেকে আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
নীচের তলায় দেখা গেল, ডুবইসের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, তার গায়ে তিন-তিনটে গুলির চিহ্ন! উপর-তলার ভগ্নস্তূপের ভিতরে গিয়ে পুলিশসাহেব প্রথমটা কিছুই দেখতে পেলেন না।
তারপর দেখলেন, রাশিকৃত আজে-বাজে জিনিষের তলা থেকে একখানা হাত দেখা যাচ্ছে। এবং সেই হাতে রয়েছে একটা রিভলভার!
হাতসুদ্ধ রিভলভারটা কাঁপাতে কাঁপাতে উঠে আর-একবার অগ্নিবৃষ্টি করলে।
সেইসঙ্গে পুলিশসাহেবও রিভলভার ছুঁড়লেন।
হাতখানা নেতিয়ে মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল।
সেই হাত ধরে পুলিশসাহেব বোনোটকে টেনে বার করলেন।
বোনোটের তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। তার দেহের বারো জায়গায় ও মাথার তিন জায়গায় বুলেটের ক্ষতচিহ্ন!
শহরের বাসিন্দারা বোনোটের দেহকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবার উপক্রম করলে। অনেক কষ্টে তাদের নিবারণ করে বোনোটকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু বিশ মিনিট পরেই তার প্রাণ বেরিয়ে গেল।
তার জামার ভিতরে পাওয়া গেল লেখাটুকুঃ
আমি আমারই মতো জীবনযাপন করব। প্রত্যেক লোকেরই বাঁচবার অধিকার আছে। কিন্তু তোমাদের ওই পাপী ও নির্বোধ সমাজ যখন আমাকে বাঁচতে দিতে রাজি নয়, তখন কি আর করা যায়? আমাকে মরতেই হল।
.
চার
ডাকাত সর্দার বোনোট মরল বটে, কিন্তু তার ডানহাত ও বামহাত এখনও বেঁচে আছে। তার দল এখনও ভাঙেনি।
গার্নিয়ার আর ভ্যালেট, এরাই ছিল বোনোটের ডানহাত আর বামহাতের মতো।
কিন্তু সারা দেশের চোখে তারা কতদিন ধুলো দিতে পারে? হস্তাদুয়েক পরে খবর পাওয়া গেল, তারা নদীর ধারে একখানা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছে! কেবল তাই নয়, দরকার হলে লড়াই করবার জন্যে তারা এই বাড়িখানাকে কেল্লার রসদখানায় পরিণত করেছে এবং এ-বাড়িখানাও এমন জায়গায় আছে যে, কোনওদিক থেকেই লুকিয়ে তার কাছে ঘেঁষবার উপায় নেই।
তখনি বাড়িখানাকে অবরোধ করবার ব্যবস্থা হল। চোদ্দোখানা মোটর ভর্তি করে পুলিশের লোক ছুটল এবং তাদের সঙ্গে চলল শত-শত সৈন্য, কলের কামান-শ্রেণি ও অনেকগুলো সার্চলাইট! এ যেন কোনও দেশজয়ের আয়োজন!
আক্রমণকারীরা যথাস্থানে হাজির হয়ে সবিস্ময়ে দেখলে, খবর পেয়ে তাদের আগেই হাজার হাজার লোক শত-শত মোটরে চড়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
তখন রাতের বেলা। উজ্জ্বল সার্চলাইটগুলো কিন্তু রাতকেও দিন করে ফেললে। বড়-বড় লোহার থামের আড়ালে দেহ ঢেকে পুলিশ ও ফৌজ ডাকাতদের বাড়ি আক্রমণ করলে, কলের কামানগুলো চেঁচিয়ে লোকের কানে তালা ধরিয়ে দিতে লাগল, এবং চতুর্দিক কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, থেকে থেকে ডিনামাইটের গভীর গর্জনে!
গার্নিয়ার ও ভ্যালেটও হাত গুটিয়ে বসে রইল না, তাদেরও বন্দুকের গুলিতে আক্রমণকারীদের কেউ-কেউ হত ও আহত হল।
নয় ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলল অশ্রান্তভাবে। অসংখ্যের বিরুদ্ধে মাত্র দুইজনের আত্মরক্ষার এমন কাহিনি কোনও ইতিহাসেই লেখা নেই।
রাত চারটের সময়ে বন্দুক, রিভলভার ও কলের কামানের অগ্নিবৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত সেই ছোট বাড়িখানা ডিমাইটের মুখে প্রায় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল।
কিন্তু তখনও তার ভিতর থেকে আর একবার বুলেটের ঝড় ছুটে এল–সেই শেষবার। তারপর সব চুপচাপ। পুলিশ ও সৈন্যগণ সেখানে গিয়ে পেলে কেবল গার্নিয়ার ও ভ্যালেটের মৃতদেহ। অসংখ্য গুলির চোটে তাদের দেহ ঝুঁজরা হয়ে গেছে।
কিছুদিনের ভিতরেই বোনোট-সম্প্রদায়ের আর-সব লোকও ধরা পড়ল। অনেকের যাবজ্জীবন জেল হল এবং অনেকে গিলেটিনে প্রাণ দিলে। কেউ করলে আত্মহত্যা।
কিন্তু বোনোটের দলের কেউ কম যায় না। ক্যারুয়ি নামে বোনোটের এক সঙ্গীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে। কিন্তু পাছে সে আত্মহত্যা করে, এই ভয়ে তাকে উলঙ্গ অবস্থায় জেলখানায় বন্ধ করে রাখা হল। তবু একদিন সে ফাঁক পেয়ে বানরের মতো দেওয়াল বেয়ে পাঁচতলার ছাদের উপরে গিয়ে উঠল এবং চিৎকার করে বললে, ঘড়িতে যেই বারোটা বাজবে, অমনি আমি এখান থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেব!
জেলের কর্তা কাকুতিমিনতি করে বললেন, ছিঃ অমন কাজ কি করতে আছে? লক্ষ্মী ছেলেটির মতন নীচে নেমে এসো!
ক্যারুয়ি সেকথা আমলেই আনলে না।
জেলের কর্তা তখন পাঁচতলার ছাদে লোক পাঠিয়ে তাকে ধরবার উদ্যোগ করলেন। ক্যারুয়ি তখন কাকুতিমিনতি করে বললে, ছিঃ, অমন কাজ কি করতে আছে? বেলা বারোটার আগে কারুকে ওপরে পাঠিও না, তাহলে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হবে যে।
জেলের কর্তা তার কথা আমলেই আনলেন না, তাকে ধরবার জন্যে লোক পাঠালেন। কিন্তু সে লোক উপরে আসবার আগেই ক্যারুয়ি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করলে!
এই বোনোট ও তার দলের কথা যখন মাঝে মাঝে ভাবি তখন মনে হয় যে, বিপথে চালিত হয়ে এদের এমন অতুলনীয় বীরত্বও ব্যর্থ হয়ে গেল। নিজেদের সাহস ও শক্তির অপব্যবহার না করলে পৃথিবীর শ্রদ্ধা-পূজা লাভ করে আজ হয়তো তারা নিত্য স্মরণীয় হতে পারত।
হিংসুক পশুজীবন যাপন করে বলেই বাঘ-সিংহকে কেউ বীর বলে ডাকে না।