চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

এ বছর কেমন যাবে

এ বছর কেমন যাবে

১৩৯৩ হাজির!

হাজির হজৌর।

কী সংবাদ তোমার হে নববর্ষ?

আসতে হয় তাই এসেছি। উপায় ছিল না। সময়ের স্রোতে বিরানব্বই ভেসে গেছে। আমি তিরানব্বই। এসেছি। তোমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে স্টিম রোলারের মতো চলে যাব। কিছুই করতে পারবে না। তোমার বয়েস বেড়ে যাবে আরও কত বছর।

আমার কী হবে? কী ভেলকি দেখাবে তুমি এ বছর? তোমার গভীর জলে কী লুকিয়ে আছে তা তো জানা নেই।

জানবে কী করে? আমি তো আর মলমল পরা দিগম্বরা নই। এক ব্যাগ উপন্যাসও নই। পলিথিনে মোড়া উপহার সামগ্রী নই যে, হাতে পেলেই বুঝে যাবে কী মাল আছে গর্ভে। পোস্টমর্টেম না হলে জানবে কী করে, ব্যাটা কী খেয়ে মরেছে। ছিপ ফেলে বসে থাকো। যখন যা ওঠে। জীবন হল মাছধরা। ধৈর্য্য আর বরাত। রুই কাতলা উঠতেই পারে, নয় তো কাঁকড়ায় টোপ ঠুকরে বেরিয়ে যাবে। হাতে থাকবে হুইল ছিপ। বছর ঘুরে যাবে। ফাতনায় চোখ রেখে-রেখে চোখ ঠিকরে যাবে। তবু তোমায় বসে থাকতেই হবে। যে খেলার যা নিয়ম।

সে তো বুঝলুম। চার করে আর টোপ ফেলে বসে থাকার নামই জীবন; কিন্তু উপরি পাওনা তো কিছু থাকেই, যেমন ট্রেনের সিজন টিকিট, যেমন কলকাতার কলের জল, বাসের গুঁতো, শীতের সন্ধ্যার ধুলো আর ধোঁয়াভরা বাতাস, যেমন বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, যেমন পুলিশে পাকড়ালে রুলের গুঁতো, সেইরকম ফ্রি পাওনা কিছুই নেই?

অবশ্যই আছে। যেমন বয়স তোমার এক বছর বাড়বেই। বছর বছর বাড়বেই। সরকারি অফিসের ইনক্রিমেন্টের মতো। পায়ের কড়ার মতো। কলতলার শ্যাওলার মতো। বাড়বেই বাড়বে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। তুমি কবি হলে লিখতে পারবে এইভাবে :

আজকে খোকা, কালকে দাদা

অবশেষে দাদু

তবে এর একটা ফুটনোট আছে। জবরদস্ত ধাঁধাও বলতে পারো।

কীরকম?

বলো তো কাদের বয়েস বাড়ে না?

কাদের?

মেয়েদের বয়স বাড়ে না। বছর-বছর কমতেই থাকে। শহর কলকাতার দক্ষিণাঞ্চলের সামনাসামনি দুটি বাড়ি। বেলা একটা-দেড়টার সময় ওই রাস্তায় গেলে দেখতে পাবে দুই বারান্দায় দুই মহিলা। আড়ি পেতে তাদের দু’জনের কথা শুনো। এ মহিলা জিগ্যেস করছেন, আজ কী রান্না হল দিদি? সঙ্গে-সঙ্গে ওই মহিলার উত্তর—’আর বলবেন না বড়দি, আজ শুধু বেগুনপোড়া আর ভাত।’ তুমি দিদি বলে বলে আমার বয়স বাড়াবে, অতই সোজা, আমি তোমাকে বড়দি বলে আবার ছোট হয়ে যাব। তাছাড়া, জেনে রাখো ‘বয়স বিজ্ঞানী’ আর ‘তত্ব বিজ্ঞানীরা’ একেবারে খেপে গেছে। মেয়েদের বয়েস তারা আঠারো থেকে বিশে একেবারে ‘ফিকসড’ করে নেবে। বয়স বাড়বে কিন্তু আকৃতি পালটাবে না।

সে আবার কী? এমন আবার হয় না কি?

হচ্ছে রে বাবা, হচ্ছে। স্রেফ ‘অ্যাপলিকেশান’। এটা ওটা সেটা সময়মতো লাগিয়ে যাও! তারপর ‘সাপ্লিমেন্টেশান’।

সে বস্তুটা কী?

আরে বাবা, রোজ যা খাও তাতে হবে না। যৌবনদায়িনী মালমশলা সিস্টেমে ঢালতে হবে। দেওয়ালে একটা চার্ট ঝুলবে, ডায়েট চার্ট, সেই চার্ট মিলিয়ে চেটে যাও, খেয়ে নাও, চিবিয়ে যাও। তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করি, হনুমান দেখেছ?

মনে হয় দেখেছি। গ্রামের বাড়িতে। শহরে আর হনুমান কোথায়?

ভালো করে দেখেছ? হনুমান বুড়ো হয়? বুড়ো হনুমান দেখেছ কখনও?

বীর হনুমান দেখেছি, বিষম তার মেজাজ। খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসে। বীর হনুমান দেখতে পারো। সব হনুমানই বীর, তা না হলে রাবণরাজাকে ওভাবে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিতে পারে। বীর দেখেছ? বুড়ো দেখনি? কারণটা কী? হনুমানের ডায়েট। ‘কচি খাও, কাঁচা খাও, ধরে রাখো যৌবন।’ সরকার অবশ্য তোমাদের জন্যে সেই ব্যবস্থাই করছেন। কেন্দ্র আর রাজ্য, কয়লা, কেরোসিন, গ্যাস, তিনটেরই বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। মধ্যবিত্তের চুলো আর জ্বলবে না। তবে হ্যাঁ, একেই বলে বদান্যতা। টিভির রাহা খরচ তুলে নিয়েছেন। সন্ধেবেলা সপরিবারে টিভির সামনে বোসো আর আলু মূলো খাও, শশা খাও, গাজর খাও, লেটুস খাও, ছোলা খাও, বাদাম খাও। সব কাঁচা খেকো দেবতা হয়ে যাও। দেখবে চেহারায় কী প্লিজ ! চোখে কী জ্যোতি! বিজ্ঞাপনে যেন ঝকঝকে দাঁত দেখা যায় সেরকম দাঁত। সত্তরেও ফুট কড়াই খাচ্ছ হেসে-হেসে। বাবাজি হনুমানের ভালো দিকটা নিতে শেখো। বাঁদরকে আদর্শ করে বসে আছ সব? এই যে লোডশেডিং কেন হয় জানো?

জানি। আমাদের ভোগাবার জন্যে।

আজ্ঞে না। তোমাদের ভালোর জন্যে হয়। চোখ যত অন্ধকারে থাকবে তত জ্যোতি বাড়বে। অ্যাডাপটেশান কাকে বলে জানো? মানিয়ে নেওয়া। স্ত্রীর সঙ্গে মানাতে পারো। কর্মস্থলে ওপরওলার সঙ্গে পারো। অভাবের সঙ্গে পারো। স্বভাবের সঙ্গে পারো। অন্ধকারের সঙ্গে পারো না। হইহল্লা না করে চোখকে বিশ্রাম দাও। সারাদিন অনেক সুদৃশ্য-কুদৃশ্য দেখলে, রাতের বেলাটায় অন্তত আত্মদর্শনের চেষ্টা করো। জীবজন্তুরা অন্ধকারে থাকতে-থাকতে চোখে ফসফরাসের ডিপো পেয়েছে। অন্ধকারে চোখ জ্বলে। জানোয়ারে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা, এখনই একটু-একটু পারছ। পারছ না?

তা অবশ্য পারছি। ধেড়ে-ধেড়ে জিনিস মোটামুটি দেখতে পাই। খাট, টেবিল, চেয়ার।

হবে-হবে। দৃষ্টি ক্রমশই দেখবে সূক্ষ্মে চলে যাচ্ছে। স্ত্রীর গালের তিলটিও স্পষ্ট দেখতে পাবে। ‘ম্যানিপুলেশান’ তো খুব শিখেছ, আডাপটেশান’টা ভালো করে রপ্ত করে নাও, শান্তি পাবে।

সবই তো দেখছি, সাধন ভজনের ব্যাপার। করলে তবে মিলবে। অ্যায়সা কি কিছুই আসবে না!

অবশ্যই আসবে। যেমন একটা-দুটো করে পাকা চুল আসবে। ধীরে-ধীরে টাক আসবে। চোখে ছানি আসবে। কপালে ভাঁজ আসবে। মুখের বাত সারা শরীরে গেঁটে বাত হয়ে ছড়াবে। রক্তে উচ্চচাপ আসবে। স্মৃতি বিভ্রম আসবে। ধার দেনা আসবে। শেষ বয়সে আত্মীয়-স্বজন আসবে। বিয়ের চিঠি আসবে। চাঁদার তাগাদা আসবে। আলো জ্বালাও আর না জ্বালাও, বিশাল-বিশাল বিল আসবে। মেয়ের বিয়ে আসবে। জামাইয়ের বায়না আসবে। ছেলের প্রেম করা বউ আসবে। তুমি চাও না চাও, ঈশ্বর তোমাকে ছপ্পর ফুঁড়ে দেবেন।

বা:-বা:, সেরা-সেরা উপহার। কী আসবে না?

শান্তি আসবে না। যতই সাধনা করো শান্তি মিলবে না। যেমন, যতই সেবা করো স্ত্রী ক্যারেকটার সার্টিফিকেট কোনওদিন পাবে না। ঈশ্বর মানুষকে সব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছিলেন। আসি প্রভু বলে মানুষ প্রায় চলেও এসেছিল। ঈশ্বরের হঠাৎ কী খেয়াল হল পিছু ডাকলেন, ‘ওহে শোনো, দেখি, তোমার পুটলিটা খোলো। একটা আমি নিয়ে রাখলুম।’ ‘কী নিলেন আপনি?’ ‘সামান্য একটা জিনিস, শান্তি। এইটা তোমরা পেলে আমাকে ভুলে যাবে।’ বুঝলে কিছু! চিতায় না ওঠাতক শান্তি নেই।

বাঁচা গেছে। আর কী আসবে না?

যে দিন গেল সেই দিনটি আর ফিরে আসবে না। ঘাতকের মতো। গেল আর এল না।

না আসার দলে আর কী আছে?

স্বীকৃতি। স্বীকৃতি আসবে না। খেটে মরবে প্রাোমোশান আসবে না। করে মরবে প্রশংসা আসবে না। ভুগে মরবে তবু মৃত্যু আসবে না। ছোটখাটো জিনিসের মধ্যে কী কী প্রায়ই আসবে না জেনে রাখো। কর্পোরেশানের জল। কাজের লোক। টেলিফোন-এর ডায়াল টোন। রুটের বাস। বিদেশের পার্সেল। এমারজেন্সির ডাক্তার। গৃহশিক্ষক। গানের মাস্টারমশাই। বাড়ির তৈরির মিস্ত্রী, লনড্রিতে কাচতে দেওয়া জামা কাপড়, জ্যোতিষীর বলা ভাগ্য। স্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি। না আসার তালিকায় এদের তুমি স্বচ্ছন্দে লিখে রাখতে পারো, আর একটা অবশ্যই লিখে রাখবে সেটি হল, রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার। আজকাল তো আবার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে—অনেকটা সেই প্রবাদের মতো, পর্বত-এর কাছে মহম্মদ না গেলে পর্বতই চলে আসবে মহম্মদের কাছে। একই রিকশায় মা ছেলে আর খালি সিলিন্ডার। সিলিন্ডার নামল ফুটপাথের লাইনে, ছেলে নেমে গেল স্কুলে, মা ফিরে এল সিলিন্ডারের লাইনে। শেষবেলায় আধমরা হয়ে ফিরে এল।

এই তাহলে আমাদের ভাগ্য!

হ্যাঁ, এই তোমাদের ভাগ্য। তোমাদের ভাগ্য তৈরি হচ্ছে মুদির দোকানে। সেখানে মাস কাবারি খাতা আর গৃহিনীর হাতে সংসার। চালাও চালিয়ে যাও। লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন। প্রতি মাসেই পাওনার অঙ্ক দেখে কুকুর শাবকের মতো কুঁই কুঁই করবে; কিন্তু পাওনা তোমাকে মেটাতেই হবে। একেই উপনিষদ বলেছেন, নান্য পন্থা। বেশি ট্যাঁ ফোঁ করলেই সুগৃহিনী বলবেন—লুচি খাওয়ার সময় মনে ছিল না, মনে ছিল না, বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাপ-কাপ চা খাওয়ার সময়, চা আর চিনির কিলো কত? তোমাদের ভাগ্য পড়ে আছে পাড়ার ডিসপেন্সারিতে। গুপী ডাক্তার আসবেন, প্রেসক্রিপসান ছাড়বেন আর তোমাদের ভাঁড়ে মা ভবানী হবে। এখনকার অ্যালোপাথি বটগাছের মতো টান মারলেই দেখবে শেকড়বাকড় নিয়ে উঠে এল স্টুল ব্লাড, ইউরিন, স্পুটাম, এক্স রে স্ক্যানিং, সব জরাজরি, তুমি সর্বস্বান্ত।

এইবার জানতে ইচ্ছে করছে এই নশ্বর পৃথিবীতে কারা অমর?

শত্রু অমর। অবিনাশী। শত্রু মরে না। মরে না অ্যামিবারোসিস, জিয়ার্ডিয়াসিসের জীবাণু। মরে না মানুষের অহঙ্কার। উইপোকা, ছারপোকা, মশা মরে না। ভালোবাসা মরে না, ঘৃণাও মরে না।

আমার শেষ প্রশ্ন, বছরটা সত্যিই কেমন যাবে?

ভালোই যাবে। শুয়ে, বসে, ভুগে, ভুগিয়ে খ্যাচাখেচি, মান অভিমানে প্রতি বছর যেমন যায়, এ বছরও সেইরকম চলে যাবে। একেই বলে ‘চলছে, চলবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *