2 of 2

এ পরবাসে – মধুময় পাল

এ পরবাসে – মধুময় পাল

যাকে বলা হয় এগোনো, সেটা কখনো বস্তুত পালানো হয়।

আকাশের উপদ্রুত কোণে বোমাবাজি চলছিল। বৃষ্টি হতে পারে।

সুপারি কিলারের মতো হাড়—হিম ইমেজে রাউন্ড মেরে গেল পুলিশের গাড়ি। স্যালুট দিল তিনটে ক্লাব।

পা নয়, যেন পদাতিক সমবায়ে ছুটছে বিনোদ। বাড়ির দিকে এগোনো কিংবা পালানো।

ফুচকাওয়ালাকে ঘিরেছে তরুণীরা। টকজল টুবটুব, টুপটুপ।

চারটে নেড়ির বিপুল গলাবাজি। এ ভরা শ্রাবণে ওরা ভরাট রোমান্টিক হয়। ছালচামড়ায় ক্ষতচিহ্ন নিয়ে নেড়ি—পুংরা ঘোরে পাড়ায় পাড়ায়।

শরীর শরীর, তোমার সেক্স নাই, বিনু? কানের পাশে বলল সঙ্গিনী।

বিনোদের বলতে ইচ্ছে হল, ধরতে পাললে বুঝিয়ে দেব কত ধানে….। বলে না। মনে মনে বলে, তোমার তো শরীর নাই।

সাইবার কাফের রোয়াক থেকে উঠে দাঁড়ালেন সেই বর্ষীয়সী সাদা চুলের তুষার—মাথা নিয়ে। এগিয়ে এলেন। কটা বাজে? এটা তাঁর প্রতিদিনকার জিজ্ঞাসা। আরও কাউকে করেন কিনা জানে না বিনোদ। জবাব দেয়। তিনি বলেন, আপনের সময় হয় নাই।

মানে কী? সঙ্গিনীর প্রশ্ন।

বিনোদের জবাব, কী জানি।

ডানদিকে বাঁক নিল বিনোদ। পুকুর বোজাচ্ছে রামুয়া ওরফে জয়রাম মিশ্র। বিহারের বাসিন্দা। অস্ত্রপাচারে দুবার ধরা পড়েছে। সেই থেকে এখানে ঠেক। ক্লাস এইটের বাবলিকে বিয়ে করেছে। কিছুটা তোলতাই, বাকিটা প্রশাসনিক। বাংলার জামাই, আহা রে! পৃথিবীর চক্করের টাইম ধরে শিফটিংয়ে রামুয়ার দুটো লোক নলি সাঁটিয়ে পুকুরপাড়ে অলওয়েজ ফিট। তারা বাঙালি। চাকরিবাকরি নেই, বাপ—মার মাল্লুর জোর নেই, বাইক দিতে পারে না, প্রেম—ট্রেম লাগে, তাই ঘ্যামা পুজো করে, মন্ত্রী আনে উদবোধনে, মাচা—নাচা—গানা হয়, বন্ধ কারখানার দেওয়ালের ইট বেচে, পুলিশকে খবর বেচে, রাস্তার গাছ বেচে ইত্যাদি।

অসীমের দোকানে দাঁড়ানোর কী দরকার ছিল? ওই এক ভাঁড় চা। তার লোভে? এখন বউয়ের ভয়ে এমন ছুটছ যে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। সঙ্গিনী বলে।

বিনোদ জবাব দেয় না।

সঙ্গিনী হাসে। বলে, বাতেলার স্থানাভাব ঘটিয়াছে? অফিসে ভালোমানুষ। ট্রেনে বোবা। অসীমের দোকানে এসেই বাতলিং! ওরা তোমাকে দেখে আর মনে মনে হাসে। ভাবে বিশুদ্ধ গাম্বাট।

অফিসের খবর তুমি জানলে কীভাবে?

বোঝা যায়।

অসীমের দোকানে কী বলি তুমি শোনো কীভাবে?

ওই মরা হরতুকি গাছে বসে। ওই যে ঢাকার শাঁখার দোকান, তার পেছনে গাছটা। মেরে ফেলেছে। এবার কেটে ফেলবে। চারটে গুমটি হবে। কাউন্সিলর টাকা খেয়ে বসে আছে। কিসসু খবর রাখো না। বিকেল থেকে ওভারব্রিজের মাথায় বসে রেল কলোনির মদের দোকানের ভাষণ শুনি। সন্ধের ট্রেনে তোমাকে নামতে দেখে হরতুকির ডালে আসি। সেখান থেকে তোমার ভাষণ।

বেশ করো। বিনোদ বলে। কাজ নেই, কম্মো নেই! আর—একটু এগিয়ে ঝিলে গেলে পারো। মাছ আছে। অনেক পুরোনো। প্রথম লোকসভা ভোটের সময়কার। খপ করে ধরে কাঁচা খাবে।

কাঁচা খাব কেন? রান্নাঘরে রেখে আসব। তোমার বউ রেঁধে দেবে।

বউ তুলে কথা বলবে না। বিনোদ বলে।

সঙ্গিনী হাসে, ইস, কী দরদ! মরে যাই!

ক বার মরবে?

মরলে তোমার ঘর গোছাই কী করে? দোতলার মাঝের ঘরটা গুদাম করে রেখেছিলে। গিয়ে দেখো। চিনতে পারবে না। কী ছিল? হেগে—মুতে… সরি!

দুটো ধাক্কা খায় বিনোদ। দুটো নয়, তিনটে।

পুরসভা বাম্প বানিয়েছে। ফট করে বেপট উঁচু। পাশের ল্যাম্পপোস্টে চিরস্থায়ী অন্ধকার। প্রথম ধাক্কা সেখানে।

দ্বিতীয় ধাক্কা। বউ যদি কোনো কারণে দোতলায় উঠে গোছানো ঘর দেখে। কে করল পরিষ্কার? কে গোছালো? এ তোমার কাজ নয়। তোমাকে এতকাল দেখছি। বলো, কার কাজ? কে এসেছিল? তো নারীকণ্ঠের চিল্লানি শুনে রসের গন্ধে পাড়ার লোক ঝাঁপিয়ে পড়বে। নিশ্চয় এক্সট্রা মেয়েমানুষ কেস। উদাস উদাস ছিরুদাস সেজে থাকে। কেঁপে ওঠে বিনোদ।

তৃতীয় ধাক্কা, হেগেমুতে….। যে গলা ‘কেন যামিনী না যেতে জাগাতে না’ গেয়ে আবিষ্ট করে, যে গলা ‘এখুনি কি হল তোমার যাবার সময় হায় অতিথি’—র জিজ্ঞাসায় অন্তর্মুখর করে তোলে, যদিও সে—সব মুহূর্তের মুখ দেখতে পায় না বিনোদ, শুধু শোনে, সেই গলায় ওই শব্দটা দুর্গন্ধের মতো লাগে।

ডেঙ্গির মৃতদেহ বেরিয়ে এল একা। একটা গলি থেকে। শুধু চালক, সৎকার সমিতির গাড়ির। গাড়ি জুড়ে ব্লিচিং—প্রতাপ। গলি থেকে একটু দূরে টুলে দাঁড়িয়ে দেওয়াল ধরে ভাষণ দিচ্ছে কাউন্সিলর। সে—ও একা।

তোমাদের এখানে উন্নাইন হয়নি। সঙ্গিনী বলে। বিনু, ডেঙ্গি সম্পর্কে তুমি কিছু বলবা না?

অ্যাই, ভাট বকা বন্ধ করো তো। নিজেকে খুব চালাক ভাবো? উন্নয়ন বলতে কী হয়? বিনোদ বলে।

আসলে কী জানো, আমাদের পাড়ায় ডেঙ্গিতে মারা গেলে মেয়র আসে। পাঁচটা ধর্মগ্রন্থ থেকে আট—দশ লাইন করে মুখস্থ বলে। তারপর বলে, মা—বাবাদের সচেতন হতে হবে। নিজেদের সংযত করতে হবে। তারা এমন কিছু করবে না যাতে সন্তানরা বিপথে যায়। সন্তানরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই তো কবি বলেছেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এই যে দুধভাত এটা তো আমিই দিচ্ছি। দিনরাত কাজ করছি। ডেঙ্গি প্রাচীনকালেও হত। রবীন্দ্রনাথ ডেঙ্গির ভয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়েছিলেন। ডেঙ্গি আমাদের ভূত, ডেঙ্গি আমাদের ভবিষ্যৎ। উন্নয়নে কেউ বাধা দিতে পারবে না। তো মেয়র বলে কথা, তাকে অমান্য করি কী করে? আমাদের পাড়া পশ এলাকা। রোজ কাগজে থাকে।

এবার চুপ করো, চুন্নি! বাড়িতে ঢুকব। অনেক ভ্যাক ভ্যাক হয়েছে। আমি একটা ভদ্রলোক। পাড়ায় আমার মান—সম্মান আছে। বাড়িতে বউ আছে। তার সঙ্গে আমার দায়িত্বশীল সম্পর্ক। বিনোদ বাড়িতে ঢোকার আগে গ্রিলের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে।

বাড়ি থেকে কয়েক হাত দূরে একদল কুকুর উৎকট চিৎকার জুড়ে দেয়। কুকুরগুলো বিনোদকে চেনে। তাকে দেখে চেঁচানোর কথা নয়। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করে, তোমাকে দেখতে পেল নাকি? গন্ধ পেল? কুকুরগুলো চেঁচাতে চেঁচাতে এগিয়ে আসে। বিনোদের দিকে মুখ তুলে চেঁচায়।

সঙ্গিনী বলে, সব কটা মেয়ে কুকুর, খেয়াল করেছ? তোমাকে বিপজ্জনক ভাবছে না তো? এ সময় ওদের খুব প্রেম হয়। না না, একটা ছেলে কুকুর আছে। থাক, ওদিকে তাকানোর দরকার নেই। দেখো, পূর্ণিমার চাঁদ যেন খাগড়ার কাঁসার থালা।

গ্রিলের গেটে শব্দ হয়। বিনোদ বলে, তোমাকে পেটাব।

অ্যাই, আরেকবার চুন্নি ডাকবে? ডাকো না, প্লিজ! একবার। সঙ্গিনী বলে।

কে? কে এলো? কুকুরগুলো চেঁচায় কেন? বেপাড়ার কুকুর ঢুকেছে নিশ্চয়। বিনোদের বউ, সঞ্চিতার গলা শোনা যায়।

শাঁকচুন্নি! বিনোদ আবছা করে ডাকে।

এবার বউয়ের কাছে যাও। আদর খাও। দেরি কোরো না যেন। আমি ওপরে যাচ্ছি। শরীর শরীর, তোমার সেক্স নাই, বিনু? সঙ্গিনীর ফিসফিসানি শুনল বিনোদ।

সঙ্গে কে এল আবার? কী চায়? মনসা পুজোর চাঁদা? ও আমি দিয়ে দিয়েছি। তুমি দাতাগিরি করতে যেয়ো না। অন্য পাড়ার পুজোয় আমরা চাঁদা দিই না। এখন যাও তো বাপু! সবে বাড়ি ঢুকল লোকটা। উৎপাতের একশেষ। বলি, শশা এনেছে? না আনলে, কাল সকালে মুড়ির সঙ্গে শশা পাবে না। ঘড়ির দোকানে গিয়েছিলে? এ একটা দোকান হয়েছে বটে। সব ঘড়ি মড়া। আমার চালু ঘড়িটাও মেরে ফেলল। তোমারও আর দোকান জোটে না! আমার যেমন কপাল। অযোধ্যা ইস্ত্রির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তোমার প্যান্ট—শার্ট ছ টাকা। শাড়ি নেবে কুড়ি টাকা। তাও স্রেফ ইস্ত্রি। বিরজুর বউ কত নেয় খোঁজ নিয়ো। অবশ্য তোমাকে বলা যা, দেওয়ালকে বলাও তাই। সঞ্চিতা থামে। কিংবা হয়তো আরও পরে থামত।

বিনোদ বলে, আমার সঙ্গে কেউ আসেনি। ওপরে যাচ্ছি। যা গুমোট সারাদিন। খুব ঘাম হয়েছে। স্নান করতে হবে। আমার হলে তোমাকে চা বসাতে বলব।

সঞ্চিতা পারতপক্ষে ওপরে ওঠে না। কিন্তু, যদি কোনো কারণে ওঠে। কোনো খেয়ালে। কোনো প্রয়োজনে। উঠতেই পারে। সেক্ষেত্রে ওকে বারণ করার প্রশ্নই ওঠে না। একবার যদি উঠে পড়ে, সর্বনাশ। জুতো খুলে, সঞ্চিতা যে ঘরে বসে আছে, সেখানে উঁকি মেরে বিনোদ বলল, আজ অসম্ভব গুমোট। গা দিয়ে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। স্নান না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। চট করে চলে আসব।

এত কথা বলতে হল সঞ্চিতাকে স্বাভাবিক রাখতে। আসলে বিনোদ ভীষণ নার্ভাস ফিল করছে।

দরজা খুলে, আলো জ্বালতেই, আরেব্বাস! এ তো মলের বইয়ের দোকান। পরিপাটি, নিখুঁত সাজানো। কী করে হল? বিনোদের এই ঘরে হাজার খানেকের ওপর বই আছে। ঘর অনুপাতে অসম্ভব বেশি। শেয়ালদা স্টেশনে পঞ্চাশ দশকের উদবাস্তুদের ভিড়ের মতো। বনগাঁ লোকালের ভিড়ের মতো। কাটোয়া লোকালের ভিড়ের মতো। আলমারিতে জায়গা নেই। দাঁড় করিয়ে রাখা বইয়ের মাথায় শোয়ানো অনেক। জানালার নীচে একটার ওপর একটা চাপিয়ে গাদা করে রাখা বিস্তর। আলমারিদের মাথায় প্রায় রোজ চাপছে। চাপতে চাপতে ছাদ ছুঁয়ে ফেলার উপক্রম। মাটিতে ডাঁই করে রাখা বেশ কিছু। চলার সময় পায়ে ঠোক্কর লাগে। যে বইটা দরকার সেটা খুঁজে না পাওয়াই এই গুদামের দস্তুর। বিনোদ যতবার গোছাতে গিয়েছে ততবার অগোছালো হয়েছে। সেই গুদাম এমন শোরুম, কী করে হল? এত বই কোথায় গেল? ফেলে দিল কি?

চাপা গলায় বলে, ঘর সাজাতে গিয়ে বই ফেলে দিয়েছ কি?

পাগল! সব বই ঠিক জায়গায় আছে। একবার দেখে নেবে পুরোটা। আর ভুল হবে না। নিজে এলোমেলো না করলে যখন যে বই দরকার, পেয়ে যাবে। পাশের ঘর থেকে জবাব ভেসে এল।

শোনো, এ ঘরে এসো। নীচে বউ শুয়ে আছে। টিভি দেখছে না। কানে যেতে পারে। বিনোদ বলে।

তোমাকে আগেই বলেছি, আমার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পাবে না। আমাকে বিশ্বাস করো না। আর বউকে ভয় পাও। গলায় একটু বকুনির সুর পেল বিনোদ। এই এলাম। বলো।

যে জায়গা থেকে স্বর এল, সেখানটা শূন্য। ডানদিক শূন্য। বাঁদিক শূন্য। দরজা শূন্য। জানালা শূন্য। ছাদ শূন্য। বইয়ের ভিড়ে জানালা চাপা পড়েছিল, এখন আকাশ আসছে। শূন্য।

আমাকে ডাকো।

চুন্নি!

না না, ওই নামে, শাঁকচুন্নি। আদর করে ডাকো। ঘর সাফাইয়ের মজুরি দেবে না? আমি তোমার কাছে বেশি কিছু চাইনি, বিনু!

আমার শাঁকচুন্নি! এসো, আমার কাছে এসো। আমার চুন্নি, আমার মুন্নি, আমার বুন্নি। বিনোদ আপ্লুত। যে তার বই ভালোবাসে, সে তাকে ততটাই ভালোবাসে। আমার শাঁকচুন্নি!

উমমম।

বউয়ের জবরদস্ত গলা আসে। কী গো, এখনও স্নানে গেলে না? বাথরুমে জলের শব্দ শুনছি না কেন? কী করছ ওপরে? কী হচ্ছে?

বিনোদ বলে, ঘামটা শুকোচ্ছি। এই যাব। এখখুনি হয়ে যাবে। যা গুমোট সারাদিন।

তুমি বউকে সত্যি খুব ভয় পাও।

বউকে নয়, আমাকে। চেঁচামেচি জুড়ে দিলে আমার কিছুই করার থাকবে না। কাউকে কিছু বলতে পারব না। বললে শয়তান ভাববে।

বাথরুমের কল খুলে দাও। জলের শব্দে ঠান্ডা থাকবে। একটু গান গেয়ে নাও। বাথরুম সং। এ মণিহার আমার নাহি সাজে বা যায় যায় দিন বসে বসে দিন। বউ বুঝবে স্নান করছ।

বিনোদ জিজ্ঞেস করে, তুমি খুব ফাজিল। পাজিও। বাথরুমে ঢুকবে না তো?

তুমি চাইলে ঢুকতে পারি। জলের শব্দের ভেতর গল্প করব।

বিনোদ বলে ওঠে, না না। প্লিজ, বাইরে থাকো। আমি এখখুনি বেরিয়ে আসব। প্লিজ, চুন্নি!

লজ্জা পাচ্ছো? থাক তবে। ভেবেছিলাম….। বাদ দাও। তোমার বউয়ের নামে সেভিংস স্কিমের গন্ধ। চিটফান্ডের গন্ধ।

হা হা হা হা। হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে বিনোদ। পাজি কোথাকার! সঞ্চিতা একটা বিখ্যাত বইয়ের নাম।

বউয়ের গলা শুনতে পায় বিনোদ। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বলছে। ওপরে কী হচ্ছে?

বিনোদ জবাব দেয়, কী হবে? সুভাষদা ফোন করেছে। ফরেস্ট বাংলোর ব্যবস্থা হল। নভেম্বরে। তুমি কথা বলবে?

পরে বলব। কোথায় হল? সস্তা হবে তো? দেখো না, সরকারি গাড়ির ব্যবস্থা যদি করতে পারে। ওপরমহলে ওঁর হাত আছে।

বাঃ, ভালোই গুল মারতে পারো। যাও, বেচারা অনেকক্ষণ ডাকছে। কাপড় বদলে নাও। আমি বাইরের ঘরে আছি।

তুমি যে বাইরের ঘরে কী করে বুঝব? শাঁকচুন্নি, আমার সঙ্গে মজা? বিনোদ বলে।

একটু পরেই শুনতে পায়, বাইরের ঘর থেকে ভেসে আসছে ‘বিরহ বড়ো ভালো লাগে’।

পায়জামা পরে বিনু। গেঞ্জিও বের করল। এই গরমে পরতে ইচ্ছে করছে না। তবু পরল। চুন্নি আছে।

বিনু, একটা কথা বলব?

বলো।

আমার জন্য এক কাপ চা আনা সম্ভব হবে? ভীষণ ইচ্ছে করছে। পীযূষের সঙ্গে কত রাতে দূর দূরের ধাবায় যেতাম ঘন দুধের চা খেতে। পীযূষ মশলা চা চাইত। দিনগুলো হঠাৎ ফুরিয়ে গেল। আলো নিভে গেল। সব ভালোবাসা একদিনে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেল। পীযূষ মানে একটা আনলিমিটেড স্পিরিটি। ক্লান্তি নেই। ঘুম নেই। মনখারাপ বলে কিছু নেই। ওর সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। অথচ ওকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। সরি, আবোলতাবোল বকলাম। মনে পড়ল তাই। আমি কী বোকা! তুমি কীভাবে আমার জন্য চা আনবে? কী বলবে বউকে?

বিনোদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। ভাবল। বলল, দেখি, পারি কি না। মনে হচ্ছে পারব। সঞ্চিতা জানে, আমি চা খেতে খুব ভালোবাসি। বড়ো কাপে চা আনব। নিজে করে নেব। বলব, আর কিছু লাগবে না। টিফিন বানাতে হবে না। ওর খাটনি বেঁচে যাবে। হয়তো জানতে চাইবে, অফিসে খেয়েছি কিনা। বা অন্য কোথাও। কী খেয়েছি। এর বেশি নয়। সুতরাং তোমার চা আসছে, শাঁকচুন্নি। ওপরে কাপ আছে।

নীচে নেমে বিনোদ দেখে, সঞ্চিতা সিরিয়ালে ডুবে। এ সময় ওকে ডাকলে বিরক্ত হয়। সিরিয়াল ছেড়ে উঠতে হলে থমথমে মুখ, কোঁচকানো ভুরু, নাক। বিনোদ বলে, শুধু চা খাব। নিজে করে নিচ্ছি। নীরেনদার মেয়ে দারুণ রেজাল্ট করেছে। চিকেন প্যাটিস আর জলভরা খাওয়াল। ভীম নাগের জলভরা। অনেক কাল বাদে। ডিপার্টমেন্টের সবাই খেলাম।

সিরিয়াল চলছে। কোনো এক বয়স্ক মহিলা হয়তো ছোটো বউয়ের পক্ষ নিয়ে অশান্তি বাধিয়েছে। সঞ্চিতার প্রতিক্রিয়া শোনা গেল। ছোটো বউ বড়োলোকের বাড়ির মেয়ে বলে যা খুশি করবে? বড়ো বউটাই বা কী…! বড়ো কাপে চা বানিয়ে দোতলায় উঠে যায় বিনোদ।

গুদাম থেকে শো—রুম হয়ে ওঠা বইঘরে জানালার পাশে খালি কাপ চোখে পড়ে বিনোদের। বলে, তুমি কোন ঘরে?

জবাব শোনে, কাপ ধুয়ে রেখেছি। তুমি ঢেলে দাও। আমি নিয়ে নেব। বাইরের ঘর থেকে গলা এল সম্ভবত।

বিনোদ চা ঢেলে চেয়ার টেনে বসে। জানালা থেকে কাপটা উঠে ভাসতে থাকে। ভাসতে ভাসতে, দুলতে দুলতে কাত হয়, সোজা হয়।

ভালো হয়েছে। বেশ ভালো। তার মানে, চা বানানোর অভ্যাস তোমার আছে। পীযূষ ছিল ঠিক উলটো। ওর সব আসবে দামি রেস্তোরাঁ থেকে। জলও। চা খাবে? চলো প্লাজা বা ধাবা। আমাদের কাজের মেয়েটির সত্যি কোনো কাজ ছিল না। মাসের অর্ধেক দিন রান্না নেই। ঘর গোছানোর কাজ আমার হাতে। অন্য কারও কাজ পছন্দ হয় না। মেয়েটি আমার সঙ্গে বাজার যেত, নাটক দেখতে যেত। চায়ের কাপ ভাসে, দোলে। বিনোদ অনুমান করে চুন্নি দেওয়ালে হেলান দিয়ে আছে।

বিনোদ হঠাৎই প্রশ্ন করে বসে, তুমি আর পীযূষবাবু তো একসঙ্গে…

হ্যাঁ, তুমি যা জানতে চাইছ, বলছি। ওই রাধানগরের দিকে। আমরা ফুলকুসমা থেকে ফিরছিলাম। পীযূষ ড্রাইভ করছিল। রাশ ড্রাইভিং ওর নেশা। রাত আটটা সাড়ে আটটা হবে। হঠাৎ উলটো দিক থেকে একটা ট্রলার। ভুলটা পীযূষেরই। ওভারটেক করছিল। বেরোতে পারেনি। দুটো বিশাল গাড়ির মাঝখানে পড়ে চিড়েচ্যাপটা। ক্র্যাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও মারা যায়। আমি লোকাল হেলথ ক্লিনিকে আধঘণ্টা পর। আমাদের কথা ছিল, একসঙ্গে মারা গেলে, পরেও একসঙ্গে থাকব। আমার লেট দেখে কিংবা আমি বেঁচে যেতে পারি ভেবে ও পুরন্দরপুরে আত্মঘাতী একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে চলে গেল। মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছিল চারটে শয়তান। লজ্জায় ফাঁসি দেয় মেয়েটা। আমি খবর পেয়েছি। তবে পুরন্দরপুরে আর যাইনি। কারণ, মরার পরে মেয়েটা একটু শান্তিতে থাকুক। পীযূষ ওকে খুব ভালোবাসবে।

ফাটাফাটি গল্প। শিরোনাম, মরণের পরে। বিনোদ বলে, তা শাঁকচুন্নিদেবী, আপনি আমার কাঁধে চাপলেন কেন? কী মনে করে? এত র‌্যাশনাল মহিলা আপনি, আপনার স্বামীর কাছে অন্য মেয়ে শান্তিতে ভালোবাসায় থাকবে, এটা বোঝেন। আর, আমার একখানা আস্ত জলজ্যান্ত স্ত্রী এবং হাড্ডিচোষ সমাজ আছে জেনেও শান্তিতে থাকতে দেবেন না আমাকে? কী অপরাধ করলাম?

শিশুকণ্ঠের মতো কলকল হাসিতে ভরে যায় ঘর। বাইরের ঘর থেকে হাসিটা এল। কাপটা জানালায়। শ্রীযুক্ত বিনোদবিহারী বাঙাল মহাশয়, আপনি দেখিতে যেমন বোকার মরণ, আদতেও তেমনই। আমি আপনার ঘাড়ে চাপি নাই। সঙ্গী হইয়াছি মাত্র। আপনার এমন কোনো গুণ নাই যে আমি আপনার স্কন্ধাসীন হই। শুধু শরীর শরীর, তোমার সেক্স নাই, বিনু!

বাইরের ঘরের মেঝেয় চেয়ার ঘষটানোর শব্দ হল।

তোমার বেতের চেয়ারটা সত্যি বেশ নরম, আরামদায়ক। হ্যাঁ, তুমি জানতে চাইতেই পারো, এত লোক থাকতে তোমার সঙ্গী হলাম কেন? পীযূষ ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছে চলে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছি, সত্যি কথা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তখুনি একটা পুরুষ ধরে পীযূষকে দেখিয়ে দিতে চাই। আমি হরিণখালি, মহিষডোবা, দ্বারবাসিনী, কাঁসারিপাড়া, চন্দননগর ইত্যাদি এলাকায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেখলাম যে—জীবনে আমি কিছুদিন আগেও ছিলাম, সেখান থেকে আজ কত দূরে। যে—জীবনে থেকেও আমি জীবন দেখিনি, সেটাও দেখলাম। যাদের হাতে দেশ চালানোর ভার, তারা দেশের কথা ভাবে না, দেশের মানুষের সর্বনাশের কথা ভাবে। এরা কী ডেঞ্জারাস বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের পাড়ার মেয়রকে দেখেছি, এরা মেয়রের সাতগুণ বাপ! বড়ো বড়ো বাড়ি দেখে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়তাম আর শুনতাম কীভাবে ডিল হচ্ছে, ফিক্সিং হচ্ছে, আবার বাণী বানানো হচ্ছে। খুব রাগ হত। মনও খারাপ হত। ঠিক করলাম এই সব পাপের ঘরে আর ঢুকব না। ছাদে বা চিলেকোঠার মাথায় বসে থাকি। চাঁদ দেখি, তারা দেখি। গাছ তো প্রায় শেষ। পাখিদেরও ঘর জোটে না। এ সময় একটা জিনিস আবিষ্কার করি। বিশ্বাস করো, আমার গলায় কোনোদিন গান ছিল না। হঠাৎ গান এল। এল যখন, ঝরনার মতো। এক রাতে, চন্দননগরে পাকড়াশিদের বাড়ির ছাদে গেয়ে উঠলাম ‘যখন এসেছিলেন, অন্ধকারে চাঁদ ওঠেনি, সিন্ধুপারে চাঁদ ওঠেনি’। জানি না কীভাবে এল, পীযূষের জন্য মন খারাপে নাকি দেশের জন্য দুঃখে? জানি না। তবে কষ্ট থেকে গান এসেছে, এটা বুঝি।

বিনোদ বাধা দিয়ে বলে, এ তো বড়ো গল্প। গ্যাটিস দিয়ে উপন্যাসও হতে পারে। নীতিকথা আছে। সরকারি পুরস্কার মেলার চান্স আছে।

ইয়ারকি হচ্ছে? ডাকব সঞ্চিতাকে? সত্যি কথা মানুষ বিশ্বাস করে না।

এও তো একটা বাণী, চুন্নি!

শোনো, তোমাকে দেখি ভদ্রেশ্বর স্টেশনে। টিকিটঘরের পাশে ব্রিটিশ আমলের চাতালে। এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলে। অমলতাস গাছে বসে তোমার কথা শুনতে থাকি। বাঙালির সব ছিল, সব গেছে/বাঙালি জানে না তাদের কী ছিল, কী হারিয়েছে/বাঙালি আগে কখনো এত গরিব ছিল না/কখনো এত অসহায় অপদার্থ ছিল না/একটি জাতির এভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম/এরপর কি আমরা শেষ হয়ে যাব ইত্যাদি বলছিলে। মনে হল লোকটা খারাপ নয়। বয়স হয়েছে, তবে ভাবতে জানে। বাঁধা বুলির লোক নয়।

মাইরি! লিখে দেবে? এক কাপ চায়ে এত? এ জন্যই তো অসীমের দোকানে দাঁড়াই। বিনোদ বলে।

যা বলছি শোনো। কয়েকদিন ফলো করি। দেখি, একটু দুর্বলতা আছে। অল্পবয়সি মেয়ে দেখলে চুলবুল করে, কান্নি মেরে দেখে। ও ঠিক আছে। খেলার ক্ষমতা নেই।

কণ্ঠস্বর তাক করে খবরের কাগজ ছোঁড়ে বিনোদ। আস্তে। কোথাও ধাক্কা লেগে কাগজ পড়ে বেতের চেয়ারে। তার মানে ওইখানে আছে। দেখা যাচ্ছে না।

সেই থেকে কয়েকদিন হল আছি তোমার সঙ্গে। তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছি। হাতের কাছে বই এনে রেখেছি। অন্য ফাইলে ঢুকে যাওয়া নোটবই ঠিক জায়গায় রেখে দিয়েছি। হারিয়ে যাওয়া লাইন মনে করিয়েছি। তুমি বুঝতে পারোনি।

বিনোদের মনে পড়ে। গত কয়েকদিন সত্যি সে কাজের জিনিস দরকারের সময় হাতের কাছে না পেয়ে পাগল পাগল হয়ে যায়নি। ভেবেছে, নিজে বোধ হয় গোছানো হয়েছে। সে ডাকে, চুন্নি! আমার শাঁকচুন্নি!

নীচ থেকে ডাক আসে সঞ্চিতার, তোমার খাবারটা নিয়ে যাবে। কাল ভোরে আমাকে উঠতে হবে। ঠাকুরমশাই বলেছেন…

যাচ্ছি। বিনোদ জানায়। তুমি কি আমার সঙ্গে খাবে চুন্নি!

আমিষ আমার চলবে না। তুমি খেয়ে নাও। এই ফাঁকে আমি সদানন্দধাম থেকে দুধ—খই খেয়ে আসি। ওখানে আমাদের ব্যবস্থা আছে। রাতে হালকা খেলে সুস্থ থাকা যায়।

এখুনি আসবে তো? বিনোদ জিজ্ঞেস করে।

নিশ্চয়। ঘাড়ে যখন চেপেছি…

বইয়ের জানালার আকাশে একটা আলো উড়ে গেল।

একা বসে খাওয়া বিনোদের অনেক দিনের অভ্যাস। এ সময় সে কোনো ক্রাইম সিরিয়াল দেখে। আজ ভুলে গেল। ভূতে সে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করতে চাইল। অনেকগুলো কবে ও কে ভিড় করে এল মনে। যেন মনে হল, একটা আঁচল সরে গেল? যেন দেখল ভেজা তোয়ালেটা চেয়ার থেকে জানলার গ্রিলে মেলে দিয়েছে? যেন মনে হল পুবের জানালায় দেওদারের ওপার থেকে তাকে লক্ষ করছে? যেন দেখল বিছানা পরিষ্কার, বই নেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে, ডায়েরি ফাইল গোছানো? হঠাৎ বিদ্যুৎ গোলযোগে মোম খুঁজে জ্বেলে দিয়েছিল টেবিলে? প্রথম শুনল ‘যখন এসেছিলে অন্ধকারে,/চাঁদ ওঠেনি সিন্ধুপারে।/ হে অজানা তোমায় তবে বুঝেছিলাম অনুভবে…’? বাইরের ঘর থেকে ভেসে আসছিল। তখন মধ্যরাত। বিনোদ উঠে যেতেই গান চলে গেল। জানালার ওপারে পুকুর, পাড়ার আলো, কিছু ছায়া, মাঝখানে কাঁপতে—থাকা শূন্যতা, যেমন থাকে। কবে প্রথম বিনোদ ডাকল, শাঁকচুন্নি? মনে হয়, বহুদিন আগে ডাকটা ভেতরে জমা হয়েছিল। কবে চুন্নি বলল, শুধু শরীর শরীর, তোমার সেক্স নাই বিনু? কথাটা পাথর—চাপা ছিল অনেক যুগ।

ওপরে এসে বিনোদ দেখে মশারি টানানো হয়ে গেছে। অন্ধকার ঘরে সুর ভাসছে, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়’। বাইরে থেকে আলো আসছে। গুম গুম ডাকল দূরের আকাশ। একটা হাওয়া এল।

শুয়ে পড়ো।

তুমি কি আজও বাইরের ঘরে?

‘কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে’—বাইরের ঘরে চলে গেছে চুন্নি।

বিনোদ ডাকে, চুন্নি!

শুয়ে পড়ো। মশা যেন না ঢোকে। সাবধান।

চুন্নি!

‘তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে’।

পাড়ার বেশিরভাগ বাড়ি বিছানায়। ভাঙা কথা আসছে একটা আধটা। কুকুর ডাকছে। দেওদার দুলছে বাতাসে।

তুমি জানালার দিকে ফেরো। এদিকে তাকাবে না। আমাকে দেখার চেষ্টা করবে না। ভয় পাবে। চুপ করে শুয়ে থাকবে। বাধ্য ছেলের মতো।

বিনোদ জানালার দিকে সরে গেল। জানালা দিয়ে দেখতে থাকল দেওদারে অন্ধকার দুলছে। চুন্নি মশারি তুলে ভেতরে ঢুকল। বালিশ নেই। শুয়ে পড়ল। ঠকঠক শব্দ হল। তেমন আপন কেহ নাহি…। ঘুমোও বিনু।

নাকে লাগে গানের গন্ধ, চুলের গন্ধ, ঠোঁটের গন্ধ, পিঠের গন্ধ, বুকের নিজস্ব ফলের গন্ধ, হাড়ের গন্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *