এ তো আচিমিৎকার জিনিস!

এ তো আচিমিৎকার জিনিস!

সাত বছর বয়সে বিয়ে। চোদ্দো বছর বয়সে বিধবা। কিন্তু বিবাহিত সাত বছরের জীবনেও তাঁর স্বামী-সংসর্গ হয়নি। কারণ পণ নিয়ে কী একটা গোলমালে শ্বশুরবাড়ি তাঁকে নেয়নি। আমার ঠাকুরদার বাবা কালীকুমারও জেদি আর একরোখা মানুষ ছিলেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির অন্যায় দাবিদাওয়ার কাছে মাথা নোয়াননি। কিন্তু এর ফলে আমার সম্পর্কিত এই ঠাকুমার জীবনটাই বিশুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। অথচ তিনি ছিলেন পরমা সুন্দরী। যেমন টকটকে ফরসা রং, দীঘল চোখ, টিকোলো নাক, তেমনই মুখের আশ্চর্য ডৌল। বুড়ো বয়সেও তাঁর রূপের স্মৃতিচিহ্ন তাঁর সর্বাঙ্গে প্রকাশ পেত।

চোদ্দো বছর বয়সে বিধবা সরোজিনী বাপের বাড়ির গলগ্রহ বিশেষ। তবে যৌথ পরিবারে তেমন অসুবিধে হয় না। মিলেমিশে আদরে-অনাদরে জীবন কেটে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাটাতনে উঠতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর হাত আর পা ভাঙে। বিক্রমপুরের বাইনখাড়া গ্রামে আর হাড়ের ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে? কোনও এক হাতুড়ে এসেই ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গিয়েছিল। ঠাকুমার হাত-পা জোড়া লাগে বটে, তবে বাঁকা হয়ে। হাত বাঁকা, পা বাঁকা। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত। সেই থেকে ভাইপো-ভাইঝিরা বেঁকি পিসি বলে ডাকত।

ময়মনসিংহে আমার দাদু, অর্থাৎ তাঁর ধনভাইয়ের বাড়িতে যখন মাঝে মাঝে আসতেন, তখন তিনি প্রৌঢ়া। কিন্তু এত রূপ যে, ঘর যেন আলো হয়ে যেত। এমন রূপসির ঘর হল না, বর হল না। এটা যে কত দুঃখের তা আমরা সেই শিশুকালেও বুঝতাম। কিন্তু সরোজিনী ঠাকুমার তাপ-উত্তাপ ছিল না।

বরের কথা কি একটুও মনে আছে তাঁর? প্রশ্ন করলে খুব হাসতেন। বলতেন, মুখটাই তো দেখি নাই, মনে থাকবো ক্যামনে?

ক্যান, দেখ নাই ক্যান?

দেখুম ক্যামনে রে পোড়াকপাইল্যা? শুভদৃষ্টির সময়ে তো ঘুমে ঢুলতাছি। কী সব হইতাছিল চাইরদিকে কিছুই বুঝি নাই। মাইনসে কইল আমার নাকি বিয়া হইয়া গেছে।

দেশভাগ না হলে সরোজিনীর বাকি জীবনটা সুখে-দুঃখে কেটে যেত। কিন্তু দেশভাগ হওয়ার ফলে যৌথ পরিবার থেকে যে যার মতো ছিটকে গেল বিভিন্ন জায়গায়। অনাথা বিধবা সরোজিনী পড়লেন আতান্তরে। তাঁর আপনজন সেই অর্থে কেউ নেই। তাই কিছু দিন কলকাতায়, কিছু দিন অসমে এবং অন্যত্র আত্মীয়স্বজনদের কাছে থাকলেন। কিন্তু সকলেরই অসুবিধে। আচমকা দেশভাগের ফলে কারও অবস্থা ভাল নয়। শেষ অবধি তাঁর দুর্দশার খবর পেয়ে আমার মা আর বাবা ঠিক করলেন, তাঁকে আমাদের বাড়িতেই এনে পাকাপাকি ভাবে রাখবেন।

সেই থেকে তিনি আমাদের কাছে। ঠাকুমা তাঁকে ঠাকুরঝি বলে ডাকতেন। সেই জন্য আমরা ভাইবোনরা সবাই ডাকতাম ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝি আর ঠাকুমা পাশাপাশি দুটো চৌকিতে শুতেন। অনেক রাত অবধি তাঁরা গল্প করতেন। বেশির ভাগই পুরনো আমলের কথা, নানা স্মৃতিচারণ। তার মধ্যেই দুজনে ঝগড়াও লেগে যেত। ঝগড়া অবশ্য একতরফা। ঠাকুমা বকুনি দিতেন, ঠাকুরঝি চুপ করে থাকতেন। এক দিন দুজনের মধ্যে ভারী মজার ঝগড়া লেগেছিল। বাড়ির বাথরুমটা ছিল দূরে, উঠোনের অন্য প্রান্তে। খুব ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে উঠে ঠাকুরঝি বাথরুমে যেতে গিয়ে সামনে সাদা একটা মূর্তি দেখে ‘রাম রাম’ করতে করতে কেঁপে ঝেঁপে সেই মূর্তিটাকেই টাল সামলাতে আঁকড়ে ধরেন। আসলে তখন ঠাকুমাই বাথরুম থেকে ফিরছিলেন। সেটা বুঝতে পেরে ঠাকুরঝি বলে ওঠেন, দুর্গা দুর্গা, আপনে নাকি? ঠাকুমা তখন রেগে গিয়ে বললেন, ক্যান, আপনি কারে ভাবছিলেন? ঠাকুরঝি বললেন, আমি তো ভাবলাম ভূত বুঝি! ঠাকুমা খেপে গিয়ে বললেন, আপনের আক্কলটা কী কন তো? ভূতই যদি ভাবলেন তবে তারে সাপটাইয়া ধরলেন ক্যান? এই নিয়ে পরে তুমুল হাসাহাসি।

এক দিন আমাকে ডেকে ঠাকুরঝি বললেন, রুণু রে, আমার চুলগুলি বড় হইছে, একটা নাপিত ডাইক্যা কাটাইয়া দিবি? আমি বললাম, নাপিতে কী দরকার? আমিই দিমু অনে কাইট্যা। মায়ের ভারী কাঁচি আর বড় চিরুনি নিয়ে, ঠাকুরঝিকে খবরের কাগজের জামা পরিয়ে আমি চুল কাটতে লেগে গেলাম। শেষ অবধি কদমছাঁট হল বটে, কিন্তু মাথাটা বড্ড এবড়োখেবড়ো দেখাতে লাগল। হাত-আয়নায় নিজের চুলের দুর্দশা দেখে ঠাকুরঝি আর্তনাদ করে উঠলেন, সর্বনাশ! এইটা করছস কী? মাথাটারে তো নাশ করলি রে হারামজাদা! আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এই হেয়ারস্টাইলটা নতুন। কিন্তু যে দেখে, সেই হাসে। মা আমাকে খুব বকল, পিসিমার অমন সুন্দর চেহারাটার কী ছিরি করেছিস বল তো!

বিধবারা চানাচুর বা দোকানের শিঙাড়া, কচুরি খায় কি না, এ বিষয়ে শুদ্ধাচারী বিধবাদের অনেক সংশয় ছিল। প্রথম প্রথম ও-সব জিনিস খাওয়ার কথায় আঁতকে উঠতেন। পরে মা জোর করে খাওয়াত। ঠাকুরঝি প্রথমে চানাচুর খেয়ে সোল্লাসে বলে উঠেছিলেন, কী জিনিস খাওয়াইলা গো গায়ত্রী, এ তো আচিমিৎকার জিনিস। আচিমিৎকার মানে হল অতি চমৎকার। আর এই ভাবেই ক্রমে ক্রমে শিঙাড়া, কচুরি ইত্যাদি এবং পোলাওটোলাও খেয়েছেন। মাঝেমধ্যে বলতেন, দ্যাশের বাড়িতে থাকতে খাইতে খাইছি খেসারির ডাইল আর যত কচু-ঘেচু। এই তোমার কাছে আইয়াই জীবনে প্রথম ভালমন্দ খাইতাছি। তুমি বাইচ্যা থাকো গো বউ, অনেক দিন।

যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম এসেছিলেন, তখন তাঁর কাঠিসার চেহারা, মুখে চোখে দুশ্চিন্তা, ভয়, উদ‌্ভ্রান্তি। মায়ের যত্নআত্তি আর মিষ্টি কথার ফলে ধীরে ধীরে তাঁর দুশ্চিন্তা কেটে গেল। গায়ে কিছু লাবণ্যের সঞ্চার ঘটল। মুখে এল রক্তাভা। আশ্চর্য এই, অদেখা অজানা এক পুরুষের জন্য সারা জীবন কৃচ্ছ্রসাধন করার কষ্টের জন্য তিনি কখনও দুঃখ করতেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *