এ ডিসেন্ট ইন টু দ্য ম্যায়েস্ট্রোম্
পাহাড়ের চূড়া। আমরা ইতিমধ্যেই পাহাড়ের চূড়ায় হাজির হয়ে গেছি।
সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে চারদিকের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলেন।
বার-কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে শেষমেশ তিনি বললেন–কিছুদিন আগে হলে পরিস্থিতি এমনটা হতো না, অবশ্যই অন্যরকম হতো।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালাম। তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–হ্যাঁ, যদি আর কিছুদিন আগে হতো তবে আমার ছোট সন্তানটা আর তোমাকে অনায়াসেই এ রাতটা দেখিয়ে নিয়ে যেতে আমার পক্ষে কোসো বাধাই থাকত না।
আমি চোখের মণি দুটোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম–হুম।
তিনি বলেই চললেন–কিস বছর তিনেক আগে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে যায় যা আগে কোনোদিন কারো জীবনে ঘটেনি। আর যদি নিতান্তই ঘটে থাকে তবে এমন কথা বলার জন্য সে আর ইহলোকে থাকেনি।
শুধু কি এ-ই, তখন পুরো ছয়টা ঘণ্টা একনাগাড়ে যে ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে আমাকে কাটাতে হয়েছিল, তাতেই আমার দেহ-মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সে পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মুহূর্তের জন্য থেমে একটু দম নিয়ে তিনি আবার মুখ খুললেন–তোমার ধারণা, আমি বুড়ো মানুষ, তাই না? আসলে কিন্তু আমি মোটেই তা নই। যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছতে পুরো একটা দিনও কিন্তু আমার লাগেনি।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো মুখ তুলে তাঁর দিকে সবিস্ময়ে তাকালাম।
আমার মুখের বিস্ময়ের ছাপটুকু তাঁর নজর এড়াল না। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তিনি এবার বললেন–হ্যাঁ ঠিকই বলছি, পুরো একটা দিনও লাগেনি। বুড়ো হতে, মানে মাথার কুচকুচোলো চুলকে সাদা করতে আমার শক্ত সাবুদ হাত-পা-কে দুর্বল করে তুলে আর স্নায়ুগুলোকে আমি অল্পসময়ে এবং অল্পায়াসেই শিথিল করে তুলতে পেরেছিলাম।
এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখের স্লান হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই তিনি এবার বললেন–কি হে, আমাকে দেখে কী একজন জবুথবু বুড়ো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না?
আমি মুহূর্তের মধ্যে তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে নীরবে মুচকি হাসলাম।
তিনি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগলেন–বিশ্বাস কর, আজ আমি বুড়ো মানুষের মতোই সামান্য হাঁটাচলা করলে, কায়িক পরিশ্রম করলে রীতিমত হাঁপাতে থাকি, আর শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। এমনকি একটা ছায়াকে দেখলেও ভয়ে জড়সড় হয়ে যাই।
হুম! আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম।
তিনি বলেই চললেন–আরও আছে, এই যে ছোট পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছ, ওটার দিকে চোখ পড়লেই আর মাথাটা চক্কর মেরে ওঠে, জান কী?
একটু আগেই সামান্য বিশ্রামের মাধ্যমে একটু দম নিয়ে নেবার জন্য সে ছোট পাহাড়টার গায়ে এমন সাবধানতার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যে, তার শরীরের বেশির ভাগ অংশটাই পাহাড়টার একেবারে পিচ্ছিল অংশটায় এলিয়ে পড়েছিল। তিনি যে কিভাবে আচমকা নিচে পড়ে যান, কালো পাথরের সে ছোট পাহাড়টা নিচের পাহাড়গুলো থেকে একদম খাড়াভাবে প্রায় পনেরো ষোলো শো ফুট নিচে নেমে গেছে। ব্যাপারটা বাস্তবিকই অভাবনীয়।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি হলে কিন্তু ভুলেও এমন কাজ করতাম না। পৃথিবীর কোনোকিছুর লোভেই আমি পাহাড়ি প্রান্তের দুগজের মধ্যে যেতাম না। কেউ জোর করেও আমাকে নিতে পারত না। অথচ তিনি কি করে যে এমন একটা কাজ করলেন, আমি ভেবে কিছুতেই কুলকিনারা পেলাম না।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, বন্ধুবরের এমন ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মধ্যে উত্তেজনা এমন তীব্র হয়ে পড়েছিল যে, উপায়ান্তর না দেখে হঠাৎই ভূমিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে আশপাশের ঝোঁপঝাড়কে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
সত্যি কথা বলতে কি, তখন আমি ভয়ে এমনই মুষড়ে পড়েছিলাম যে, এমনকি মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকাতেও ভরসা পেলাম না।
অনেকক্ষণ সেখানে দুরু দুরু বুকে শুয়ে পড়ে থাকার পর বুকে কিছুটা সাহস সঞ্চার করা সম্ভব হলো। এবার হঠাৎ করে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো আমি ধীরে ধীরে উঠে বসতে চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, অল্পায়াসেই উঠে বসতে সক্ষম হলাম। তারপর দূরবর্তী দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেও অসুবিধা হলো না।
আমার পথপ্রদর্শক এগিয়ে এলেন, আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর সহানুভূতির স্বরে বললেন–একটা কথা বলব, শুনবে কী?
কথা? কী কথা? আমি বললাম।
কথাটা হচ্ছে, এসব অসার অবাস্তব কল্পনা তেমাকে মন থেকে মুছে ফেলতে হবে, জয় করতেই হবে।
হুম।
তোমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ কী, বলতে পার?
আমি কপালের চামড়ায় ভজ এঁকে বললাম–কী? কী সে উদ্দেশ্য?
তোমাকে এখানে নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, যে ঘটনাটার কথা তোমাকে বললাম, সে জায়গটাকে যাতে তুমি চোখের সামনে, খুব ভালোভাবে দেখতে পাও, আর সে ঘটনাস্থলটাকে তোমার চোখের ঠিক সামনে রেখেই কাহিনীটা তোমাকে শোনাতে পারি, বুঝলে তো?
হুম।
এবারনিজস্ব ভাব-ভঙ্গিতে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন–এখন আমরা কোথায় আছি, বলতে পার?
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।
তিনি পূর্ব প্রসঙ্গ সম্বন্ধেই বলে চললেন–আমরা এখন নরওয়ের উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করছি, অর্থাৎ ৬৮° দ্রাঘিমায়–নর্থল্যান্ড প্রদেশের অন্তর্গত ভয়ঙ্কর লকোডেল অঞ্চলে।
মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি এবার বললেন- এখন আমরা যে পাহাড়টার শীর্ষদেশে অবস্থান করছি, এর নাম হেসেগেন। মেঘে ঢাকা হেলসেগেন চূড়া বলেই সবাই একে জানে। কথা বলতে বলতে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–এবার শরীরটাকে একটু তোলার চেষ্টা করে দেখ তো, পার কি না?
আমি সামান্য নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করলে তিনি বললেন–শোন, যদি মনে কর মাথা চক্কর মারতে পারে তবে ওই লম্বা ঘাসের গোছাটাকে মুঠো করে ধরে থাক। ওই ভাবে–ওই ভাবেই, এবার নিচের দিককার বায়ুস্তর আর তীরের দূরবর্তী সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ কর।
মাথা চক্কর মারছে। সে অবস্থাতেই তার নির্দেশিত দিকে তাকালাম। সমুদ্রের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। সে-মুহূর্তেই মনের কোণে উঁকি দিল নিউবীয় ভৌগোলিকের বিবরণসমৃদ্ধ মারে টেম্রোরাম-এর কথা। এর চেয়ে বেশি তো দূরের ব্যাপার, এরকম অবর্ণনীয় শোচনীয় বিষণ্ণতায় পূর্ণ একটা দৃশ্যের কথা মানুষে ভাবতেও পারে না।
সমুদ্রের দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়, অস্বাভাবিক কালো আর সমুদ্রের ওপর ঝুঁকে পড়া সারিবদ্ধ পাহাড়। সবকিছু যেন বিষণ্ণতায় ভরপুর। আর সে বিষণ্ণতাকে যেন আরও বেশি মর্মান্তিক করে তুলেছে পাহাড়ের দৈত্যাকৃতি সাদা চূড়ার ওপর ক্রোধোন্মত সমুদ্রের নিরবচ্ছিন্ন আর্তস্বর। সে আর্তনাদ কাঁপন ধরিয়ে দিতে লাগল।
পাহাড়ের যে শিখরটার ওপর আমরা অবস্থান করছিলাম, তার ঠিক বিপরীত দিকে প্রায় পাঁচ-ছয় মাইল দূরবর্তী সমুদ্রের বুকে একটা জনমানবশূন্য দ্বীপ দেখা গেল। আরও একটা ছোট দ্বীপ দেখতে পেলাম। স্থলভূমি থেকে প্রায় দুমাইল দূরে সেটার অবস্থান। অস্বাভাবিক রকমের পর্বতময়। তা একেবারেই অনুর্বর। বহুসংখ্যক কালো পাহাড়ের শ্রেণি তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।
খুব বেশি দূরবর্তী দ্বীপ আর উপকূল রেখার মধ্যবর্তী সমুদ্রের রূপ কেমন অস্বাভাবিক দেখাতে লাগল। সমুদ্রের চেহারা যে এমন হতে পারে, কল্পনাই করা যায় না।
ঠিক তখনই প্রলয়ঙ্কর ঝড় শুরু হয়ে গেল। সে কী ঝড়ের বুক-কাঁপানো গর্জন! তবে সমুদ্রে তেমন ঢেউ লক্ষিত হয়নি। আর পাহাড়গুলোর গায়ের সমুদ্রে ছাড়া অন্য কোনো স্থানে তেমন ফেনার ছড়াছড়িও দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে বলা চলে সমুদ্র ছিল মোটামুটি শান্ত-স্বাভাবিক।
আমার বুড়ো বন্ধুটি অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বলতে আরম্ভ করল–ওই যে দূরের দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, তার কী নাম, জান?
আমি বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম–না, জানি না। নরওয়ের তাকে বলে ভুরুখ।
ভুরুখ?
হ্যাঁ। আমার মাঝখানের দ্বীপটার নাম মসকো।
আর ওই মাইল খানেক উত্তরে যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, ওটার নাম?
ওটাকে বলে আমপরেন।
তারপর আরও দূরের কয়েকটা দ্বীপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে বলতে লাগলেন–ওইটার নাম ইসখেসেন, কিন্ডহেম, হট, বহম, আর ওইটার নাম সুয়ারভেন।
আমি তার একের পর এক দ্বীপের দিকে আঙুল ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে চোখের মণি দুটোকেও ঘোরাতে লাগলাম।
তিনি এবার আরও দূরবর্তী কয়েকটা দ্বীপের দিকে এক এক করে অঙ্গুলিনিদের্শ করে বলতে লাগলেন–আরও দূরে, ভুরুখ আর মসৃকো দ্বীপের মাঝখানে ওই দেখা যাচ্ছে, ওটারহম, স্যান্ডফ্লোসেন, স্টকহম আর এই যে দ্বীপটা দেখা যাচ্ছে, ওটার নাম ফ্লিমেন।
এগুলো কিন্তু দ্বীপগুলোর আসল নাম। কিন্তু এরকম নামকরণের দরকার যে কেন হয়েছিল, তা তুমি তো বলতে পারবেই না, এমনকি আমিও না।
মুহূর্তের জন্য নীরবে উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করে এক সময় ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–বন্ধু, কিছু শুনতে পাচ্ছ কী?
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম–কী? কীসের কথা বলছেন?
কিছু শুনতে পাচ্ছ না?
কই, না তো।
ভালো কথা, পানির কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে কী?
আমি পানির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। নতুন কোনোকিছু নজরে পড়ল না।
বুড়ো লোকটা আমার দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে নীরবে মুচকি হাসলেন।
লফডেনের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে আমরা প্রায় দশ মিনিট আগে হেলসেগেন পর্বতের চূড়ায় উঠেছি। অতএব পাহাড়ের চূড়ায় ওঠামাত্র সমুদ্রটা অকস্মাই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠার পূর্ব মুহূর্ত অবধি আমরা একটা বারের জন্যও সমুদ্রটাকে দেখার সুযোগ পাইনি।
আমার বুড়ো বন্ধু কথা বলার সময়ই আমি একেবারেই হঠাৎ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন একটা জোড়ালো শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটা আমেরিকার বিস্তীর্ণ তৃণাঞ্চলে একপাল মোষ চরার মতো আর্তনাদ যেমন শোনায়, অবিকল ঠিক সে রকমই আমার কানে বাজল। ঠিক তখনই বিশেষ একটা ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। নাবিকরা যাকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী চরিত্র আখ্যা দিয়ে থাকে, সেটা যেন একেবারেই দ্রুত, বিদ্যুৎগতিতেও বলা চলে পূর্বগামী একটা স্রোতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। অত্যাশ্চর্য ঘনাটার দিকে আমি নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনেই সে স্রোতটায় অবিশ্বাস্য গতিবেগ সঞ্চারিত হলো। শুধু কি এই? গতির প্রাবল্য প্রতিটা মুহূর্তে বেড়ে যেতে লাগল। চোখের পলকে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একেবারে ভুরুখ অবধি সম্পূর্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠই যেন চাবুকের আঘাতে বাঁধনহারা ক্রোধে রীতিমত ফুঁসতে আরম্ভ করল।
তবে এও সত্য যে, এ আলোড়নটাকে উপকূল আর মসকোর মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়েই অবস্থান করতে দেখা গেল।
একটা ব্যাপার আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, অসীম জলধারা যেন ভয়ানক আলোড়নের জন্য হাজার পরস্পর বিরোধী জলধারায় বিভক্ত হয়ে হঠাৎ অভাবনীয় বিক্ষোভে সামিল হয়েছে, ফেটে পড়ছে।
একটা বা দুটো নয়, সবগুলো স্রোত ভয়ঙ্কর ফুলে ফেঁপে অবর্ণনীয় দ্রুতগতিতে পূর্বদিকে বয়ে চলেছে। জলপ্রপাতের ক্ষেত্রে জলরাশি প্রচণ্ড বেগে পাহাড়ের গা-বেয়ে নিচে নেমে আসে, খুবই সত্য। ঠিক জলপ্রপাতের মতোই জলধারার দ্রুততা লক্ষিত হলো। জলপ্রপাতের স্রোতধারা ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলতে পারে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
পরিস্থিতি কিন্তু দীর্ঘসময় অপরিবর্তিত রইল না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটার পুরো পরিবর্তন ঘটে গেল। পানির উপরিতলের অশান্ত ভাবটা কিছুটা বদলে গেল। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলেও কিছুটা শান্ত তো হলই।
পানিতে ঢেউ প্রায় অদৃশ্য হয়ে এলো। ফেণাও অনেকাংশে ছড়িয়ে পড়ল। যেখানে ফেণার চিহ্নমাত্রও ছিল না সেখানে পেঁজা তুলার মতো প্রচুর পরিমাণে ফেণা জমতে আরম্ভ হলো। শেষমেশ সে ফেণাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘেঁয়ে ফেলল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ফেণাগুলো আবার একত্রে পুঞ্জিভূত হতে হতে ঘূর্ণাবর্তের ঘূর্ণমান গতির রূপ ধারণ করল।
আমি ব্যাপারটার দিকে গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মনে হলো ঘূর্ণমান ঘূর্ণাবর্তটা যেন বৃহত্তর ঘূর্ণাবর্তের অঙ্কুর ছাড়া কিছু নয়।
অকস্মাৎ, একেবারেই অকস্মাৎ! সেটা যেন এক মাইলেরও বেশি ব্যাসার্ধযুক্ত একটা বৃত্তের আকৃতি ধারণ করল। আর ঘূর্ণাবর্তের চারদিক ঘিরে জলকণার একটা চওড়া বেষ্টণিও তৈরি হয়ে গেল।
সে ফেঁদলটার মুখের ওপর ছিটকে যাচ্ছে না।
যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, ভেতরের সে মসৃণকণা, চকচকে ঘন কালো রঙ বিশিষ্ট পানির প্রাচীরটা ৪৫° কোণে দিগন্তের দিকে সামান্য হেলে ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে চলেছে, আর বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে খুবই তীব্র একটা শব্দ। কেমন সে শব্দটা? কিছুটা আর্তনাদ আর কিছুটা গর্জন যেন তার সঙ্গে মিশে রয়েছে।
সে শব্দ, সে আর্তনাদটা এমনই ভয়ঙ্কর যে, নায়েগ্রার দুর্দান্ত বেগবতী জলপ্রপাতও কখনই এমন ভয়ঙ্কর শব্দ আর তীব্র যন্ত্রণার মাধ্যমে পরম পিতার কাছে আর্জি জানায় না। ভয়ঙ্কর সে শব্দটা কানে যেতেই আমার বুকের মধ্যে রীতিমত ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল।
পাহাড়টা থর থর করে কেঁপে উঠল। মনে হলো যেন মূল থেকে শিখর দেশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পাহাড়টাই থেকে থেকে দারুণভাবে কেঁপে উঠছে। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হলো তা ভাষার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পাথরগুলো রীতিমত দুলতে শুরু করল।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমি আতঙ্কে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার স্নায়ুবিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে গেল। সে উত্তেজনাকে সামাল দিতে না পেরে আমি হাতের নাগালের মধ্যে ঝোঁপঝাড় লতাপাতা যা পেলাম তাকেই আঁকড়ে ধলাম। মনে হলো আমার সামনের দৃশ্যগুলো অনবরত ঘুরছে তো ঘুরছেই। আমার আরও মনে হলো, যে কোনো সময় পাহাড় থেকে পা-হড়কে সুগভীর খাদের মধ্যে পড়ে যাব।
আমি শেষমেশ নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই বুড়ো ভদ্রলোকটিকে বললাম দেখুন, আমি কিন্তু ঘূর্ণাবর্তটা সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিয়েছি।
বুড়ো ভদ্রলোক বলেন–কী? কী সে ধারণা, জানতে পারি কী?
আমার বিশ্বাস, এটা মালস্ট্রামের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। অনেকেই এটাকে এ নামেই সম্বোধন করে থাকে। আমরা, নরওয়ের অধিবাসীরা একে কী বলি জান?
কী? আপনারা একে কী বলেন?
আমরা একে বলি মত্সকো-স্ট্রাম।
দেখুন, এ ঘূর্ণাবর্ত সম্বন্ধে যে বিবরণ শোনা যায়, তা জানা থাকলেও এখন যা চাক্ষুষ করলাম, আমি কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য দেখার জন্য মনের দিক থেকে মোটেই তৈরি ছিলাম না।
হুম!
দেখুন, জোনাস র্যামাসের বিবরণ আমি পড়েছি। সে বিবরণ পাঠ করে এ ঘটনার যে মহত্ব অথবা তার আতঙ্ক বা স্তম্ভিত হবার মতো নতুনত্ব দর্শকের মনে যারপরনাই ভীত-সন্ত্রস্ত এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট করে তোলে, তার সামান্যতম ধারণাও পাওয়া যায় না।
আমার পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আসলে আমার জানাই নেই যে, লেখক কোথা থেকে এবং কিভাবে আলোচ্য ঘটনাটাকে চাক্ষুষ করেছিলেন। তবে সেটা হেলসেগেনের ওপর থেকে নয় বা প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের সময় নয়, এ বিষয়ে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও সে দৃশ্যটার ধরণ খুবই কমভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকলেও তার লিখিত বিবরণীর অংশবিশেষ নিচে উল্লেখ করছি
সে বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেছেন–মকো এবং লকডেনের মধ্যবর্তী স্থানের পানির গভীরতা ৩৬-৪০ ফ্যাদমের ভেতরে।
কিন্তু অন্যদিকে, ভুরুখের দিকে পানির গভীরতা খুবই কম। আর তা এতই কম যে, পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে বা ধাক্কা লেগে ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে কোনো জাহাজের পক্ষেই স্বাভাবিকভাবে সেখান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কেবলমাত্র ঝড়ের সময় বা অশান্ত আবহাওয়াতেই নয়, নিতান্ত শান্ত আবহাওয়াতেও সে রকম দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে।
আর জোয়ারের সময়? তখন তো মসকো আর লকডেনের ভেতর দিয়ে এমন উত্তাল উদ্দাম গতিতে স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু হয় যে, সবচেয়ে বেশি গর্জনকারী এবং ভয়ঙ্করতম জলপ্রপাতের শব্দও তার মতো বুক কাঁপানো হতে পারে না। আর তা এত দূর থেকে শোনা যায় যে, বেশ কয়েক লীগ [এক লীগ=প্রায় তিন মাইল] দূর থেকে শোনা যায় বললেও কম করেই বলা হবে। আর তার গর্ত এতই গভীর ও আয়তনে বড়সড় যে, কোনো জাহাজ হঠাৎ করে তার চক্করের মধ্যে পড়ে গেলে যে একেবারে অতলে পৌঁছে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। আর গর্তের তলদেশে গিয়ে পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
পরে ক্রমে পানির স্রোত কমতে কমতে শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এলে সে ভাঙা টুকরোগুলো দুম্ দাম করে ছিটকে পানির ওপর পড়ে।
তবে এরকম পরিস্থিতি সর্বদা নয়, কেবলমাত্র জোয়ার-ভাটার আগে চোখে পড়ে। আবার আবহাওয়া শান্ত থাকলেও এরকম অবস্থা নজরে পড়ে। আর এ পরিস্থিতি কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মাত্র মিনিট পনেরো এ অবস্থা স্থায়ী হয়।
পানির স্রোত যখন সবচেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টি করে আর ঝড়ের জন্য তার তীব্রতা আরও অনেকাংশে বেড়ে যায় তখন তার থেকে এক নরওয়ে মাইলের মধ্যে আসা বড়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
অসাবধানতাবশত সতর্কতা অবলম্বন না করার জন্য কত ছোট-বড় নৌকা, ইয়ট আর ছোট-বড় জাহাজ যে-পানির টানে এগিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
কেবলমাত্র নৌকা বা জাহাজের কথাই বা বলি কেন? অতিকায় কোনো তিমিও যখন পথ চলতি সে ভয়ঙ্কর স্থানটার কাছাকাছি চলে আসে, ভয়ঙ্কর সে ফাঁদটায় মাথা গলিয়ে দেয়, তখন তার আত্মরক্ষার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়, নিজেকে অদৃষ্টের হাতে সঁপে দেওয়া ছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তরই থাকে না। অনন্যোপায় হয়ে অদৃষ্ট বিড়ম্বিত জানোয়ারটা তখন যেভাবে ভয়ঙ্কর আর্তনাদের মাধ্যমে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে থাকে, তা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়।
একটা ভালুক এক সময় সাঁতরে লকডেন থেকে মসকো যাবার চেষ্টা করছিল। ভয়ঙ্কর সে স্রোতটার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে সাঁতরে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে স্রোতের টানে সে নির্দিষ্ট স্থানটায় চলে গিয়ে যেভাবে বিকট স্বরে আর্তনাদ জুড়ে দিয়েছিল, তা তীর থেকে পরিষ্কার শোনা গিয়েছিল।
আছে, আরও আছে, পাইন ও ফারগাছের অতিকায় বহুঁকাণ্ড ভয়ঙ্কর সে ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে সে গুঁড়িগুলো এক এক করে ওপরে উঠে আসে তখন পরিষ্কার মনে হয়েছিল, সেগুলোর গায়ে বুঝি ছোট ছোট লোম গজিয়েছে।
ষোল শ পঁয়তাল্লিশ খ্রিস্টাব্দের কথা।
সে-বছর সেক্সাগোসিয়া রবিবার কাকডাকা ভোরে ভয়াল এ ঘূর্ণাবর্ত এমন ভয়ঙ্কর, গগনবিদারী শব্দ এতই উত্তাল-উদ্দাম হয়ে উঠেছিল যে, উপকূলের ছোটবড় বহু বাড়ির পাথরের চাঁইগুলো পর্যন্ত তীব্র গতিতে চারদিকে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, তা আরও খোলসা করে বলে কারো মধ্যে করুণা সঞ্চার করা সম্ভব নয়, মোটেই নয়।
লেখক যযামাস র্যামাসের লেখা এ বিবরণ বিভিন্ন কারণে আমার মনোপুত হলো না। সত্যি কথা বলতে কী ভালুক আর তিমির কাহিনী দুটো তো নিতান্তই হাসির উদ্রেক করে। বলা হয়েছে, ঝড়ের কবলে পড়ে অতিকায় সব জাহাজ পাখির পালকের মতো ডুবে যায়। তাই যদি হয় তবে ভালুক আর তিমি গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করবে এটাই তো স্বাভাবিক। বরং তা যদি না করত তবেই অবাক হবার মতো ব্যাপার হতো, তাই না।
আর কালচার ও অন্যান্য সবার বিশ্বাস, মালস্ট্রামের পানির তলায় ঠিক কেন্দ্রস্থলে সুগভীর একটা গর্ত পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ দিয়ে বহুদূরবর্তী কোনো স্থান পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। তারপর সেখান থেকে গর্তের মুখটা আবার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আবার কেউ কেউ এ প্রসঙ্গে বোথুনিয়া উপসাগরের নাম করতেও ছাড়েন নি।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আসলে অলস কল্পনা হলেও তখন আমার মনও সে মতামতকেই সমর্থন করেছিল, অর্থাৎ আমি মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছিলাম।
কিন্তু পথপ্রদর্শককে আমার মতামত ব্যক্ত করা মাত্রই তিনি তা মুহূর্তের মধ্যেই নস্যাৎ করে দিলেন। তারপর নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন–নরওয়ের প্রায় প্রতিটা মানুষ এ-বক্তব্যকে মেনে নেয়, তবুও তিনি নিজে একমত প্রকাশ, সমর্থন নারাজ। অর্থাৎ এটা তাঁর নিজের মতো নয়।
পরমুহূর্তেই তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন–একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–বলুন, কি জানতে চাইছেন?
ঘূর্ণাবর্তটাকে তো নিজের চোখেই দেখলে, কী বল?
হ্যাঁ, তা-তো দেখলামই।
আর সেটাকে তো খুবই ভালোভাবেই দেখতে পেয়েছ, তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
এবার যদি পাহাড়টাকে ডিঙিয়ে অন্যদিকে যাও তবে বুঝতে পারবে, বাতাস সেখানে সরাসরি পৌঁছায় না।
হুম।
আর পানির এ তীব্র তর্জন গর্জনকে যদি বন্ধ কর তবে তোমাকে এমন এক কাহিনী শোনাতে পারি যাতে তোমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মাবে যে, এ মসকো-স্ট্রাম সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা অবশ্যই থাকার কথা।
আমি তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে সে-মতোই কাজ করলাম।
আমার আগ্রহটুকু লক্ষ্য করে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন–
এক সময় আমাদের পরিবারের, মানে আমার আর আমার দুই ভাইয়ের মালিকানায় একটা স্কুনার টানা সত্তর মালের জাহাজ ছিল। আর সেটা ছিল এক মাস্তুল বিশিষ্ট।
সে জাহাজটা নিয়ে আমরা মাছ ধরতে যেতাম। আর মাছ ধরতে গিয়ে ক্রমে। এগোতে এগোতে প্রায়ই আমরা মত্সকো অঞ্চল অতিক্রম করে ভুরুখের কাছাকাছি বেশ কয়েকটা দ্বীপে পৌঁছে যেতাম।
এ-কথা সব মৎস্য শিকারিরই জানা আছে যে, কোনো সমুদ্রের যে কোনো ঘূর্ণিজলেই মওকা মাফিক প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। তবে একটা কথা, সে ব্যাপারে সাহস অবশ্যই থাকা দরকার। মানে ঘূর্ণিজলের বিপদ কিছু না কিছু থাকা চাইই চাই। যাক, যে কথা বলছিলাম, লকডেনের প্রতিটা নাবিকের মধ্যেই একমাত্র আমরা তিন ভাই-ই সে দ্বীপে গিয়ে মাছের কারবার চালাতাম। আর একটা কথা, সে দ্বীপাঞ্চলের পাথরের ফোকড়ে ফোকড়ে এমন বহু পছন্দ মাফিক স্থান আছে যেখানে হরেক আকৃতি ও রঙের। মাছ প্রচুর পরিমাণে মেলে।
আমরা তিন ভাই স্কুনার নিয়ে ভুরুখের কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে হানা দিতাম বলে আমরা সমুদ্রের বুক থেকে একদিনে যত মাছ তুলে আনতে পারতাম, অন্য সব মৎস্য শিকারিরা এক সপ্তাহেও সে পরিমাণ মাছ ধরতে সক্ষম হতো না। ফলে আমাদের কারবার অচিরেই ফুলে-ফেঁপে রমরমা হয়ে উঠতে লাগল।
আমরা স্কুনারটাকে নোঙর করে রাখতাম এখান থেকে পাঁচ মাইল উজানের একটা খাড়ির বুকে।
আবহাওয়া অনুকূল হলে তবেই সে পনেরো মিনিটের শান্ত সমুদ্রের সুযোগ নিয়ে মত্সকো স্ট্রামর প্রধান স্রোতে জাহাজকে ছেড়ে দিয়ে, স্রোতের টানে সেটাকে ভাসিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ওটারহম বা স্যান্ডফ্লেসেনের নিকটবর্তী কোনো এক স্থানে সুযোগ মতো নোঙর করতাম।
আমরা সেখানে থাকতাম যতক্ষণ পানি আবার শান্ত-স্বাভাবিক না হয়। এ জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করার পর পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবার নোঙর তুলে বাড়ির দিকে স্কুনারের মুখ ঘোরাতাম।
এভাবে যাওয়া-আসার পথে অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যাবে সে রকম পরিস্থিতি বুঝতে পারলে তবেই কিন্তু আমরা এ অভিযানে পা-বাড়াতাম। কিন্তু একটা কথা খুবই সত্য যে, এ-কাজে আমাদের কোনোদিনই হিসাব-নিকাশে ভুলচুক হত না।
দুবছরে কেবলমাত্র দুবার বাতাস একেবারে পড়ে গিয়েছিল। ফলে তখন আমাদের স্কুনার নোঙর ফেলে কাটাতে হয়। তবে এরকম ঘটনা আকছাড় ঘটে না, খুব কমই ঘটে থাকে। আর একবার আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ছিলাম। আমরা তো সে অঞ্চলে পৌঁছলাম। ব্যস, তার কিছুক্ষণ বাদেই প্রলয়ঙ্কর ঝড় শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্র উত্তাল-উদ্দাম হয়ে উঠল। সে যে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা কেবলমাত্র বলে কাউকে বুঝানো সম্ভব নয়। আর এরই ফলে আমাদের প্রায় পুরো একটা সপ্তাহ উপোষ করে কাটাতে হয় সে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা ভাবলে আমাদের গায়ে জ্বর আসার উপক্রম হয়।
আমরা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরতে কতবার যে কত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। অর্থাৎ সে সব বিপদের বিশভাগের এক ভাগ সমস্যার কথাও তোমার কাছে বলা সম্ভব হবে না।
শোন, এবার যে ঘটনাটার কথা তোমার কাছে বলব, সেটা তিন বছর আগে ঘটেছিল।
১৮ খ্রিস্টাব্দের কথা।
পৃথিবীর এ অংশের মানুষ কোনোদিনই সে তারিখটার কথা শত চেষ্টা করেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।
কেন? কারণ কি? কারণ, সে বিশেষ তারিখটাতেই ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিঝড় আকাশের বুক থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল। অথচ কেবলমাত্র সারা সকালই নয়, সকাল থেকে বিকেলের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল। মাথার ওপর সূর্যদেব অত্যুজ্জ্বল রূপ নিয়ে বিরাজ করছিল। ফলে স্বাভাবিক কারণেই আমাদের মধ্যে সে প্রবীন ও অভিজ্ঞতম নাবিকটা পর্যন্ত ঘৃণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি অচিরেই কি ঘটবে। এমন অভাবনীয় পরিবেশে যে হঠাৎ মহাপ্রলয় নেমে আসবে, তা তো কারো বোঝার কথাও নয়।
আমরা তিনভাই, অর্থাৎ আমি আর দুভাই বেলা দুটোর কাছাকাছি স্কুনার নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দ্বীপগুলোর নিকটবর্তী অঞ্চলে হাজির হলাম। তারপর ক্রমে এক একটা দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে জাল ফেলতে আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাছ। দিয়ে জাহাজটা বোঝাই করে ফেলতে পারলাম।
আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলাম, এত অল্প সময়ে এত মাছ আমরা এর আগে কোনোদিনই ধরতে পারিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠিক সাতটা বাজে। আমরা আনন্দে ডগমগ হয়ে নোঙর তুলে মাছ-ভর্তি জাহাজ নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। আমরা তড়িঘড়ি যাত্রা করলাম এ জন্য যে, আমরা যাতে আটটার কাছাকাছি সময়ে পানি যখন শান্ত-স্বাভাবিক থাকবে, তার মধ্যেই স্ট্রামের খারাপ অঞ্চলটা অতিক্রম করে ফেলতে পারি। আমাদের জাহাজটা উল্কার বেগে ধেয়ে চলল নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
নতুন করে হালকা হাওয়া বইতে শুরু করলেই আমরা আবার নোঙর তুললাম।
আমাদের জাহাজটা ঢেউয়ের তালে তালে দোল খেতে খেতে ধীর-মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে তো চলেছেই। বিপদের কোনোরকম আশঙ্কা আছে এমন কথা ঘুণাক্ষরেও আমার মনে আসেনি। কারণ সে-রকম কোনো সম্ভাবনা তিলমাত্রও নজরে পড়েনি।
আমরা সামান্য এগিয়ে যেতেই একেবারেই অকস্মাৎ হেলমেগনের ওপর দিয়ে একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম।
ব্যাপারটা বাস্তবিকই খুব অস্বাভাবিক তো বটেই, অভাবনীয়ও। অতীতে কোনোদিনই এমন কাণ্ড ঘটতে দেখিনি।
আমি যেন কিছু একটা নিদারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমি প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম। পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে জাহাজটাকে বাতাসের অনুকূলে রেখে আমরা অগ্রগতি অব্যাহত রাখলাম।
না। বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কারণ, ঘূর্ণি চক্করগুলোই আমাদের অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা করতে লাগল।
অনন্যোপায় হয়ে আমি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু মুহূর্তের জন্য পিছনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টিপাত করতেই অদ্ভুত প্রকৃতির একটা মেঘের দিকে আমার নজর গেল। তার রং তামাটে।
চোখের পলকে মেঘের টুকরোটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একেবারে দিগন্ত রেখা অবধি ঢেকে ফেলল। পরিস্থিতি যে কী ভয়ঙ্কর রূপ নিল, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে লাগল। যে বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে আমরা সামনের দিকে গতি অব্যাহত রেখেছিলাম তা একেবারে পড়ে গেল। যেটুকু আশা ছিল তাও আমাদের মন থেকে মুছে গেল।
উপায়ান্তর না দেখে আমরা জাহাজ থামিয়ে এদিক-ওদিক অনবরত চক্কর খেতে লাগলাম। এ পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে তা-ও ভেবে পেলাম না। বেশি। ভাববার অবসরই বা কোথায়।
এক মিনিট, মাত্র একটা মিনিট যেতে-না-যেতেই ঝড়টা প্রলয়ঙ্কর রূপ নিয়ে, রীতিমত ফুঁসতে ফুঁসতে আমাদের জাহাজটার ওপর আছড়ে পড়ল। আর দু মিনিটের মধ্যেই ঘন কালো যমদূতাকৃতি মেঘটা পুরো আকাশটা ছেয়ে ফেলল।
চোখের পলকে চারদিক এমন অন্ধকারে ঢেকে গেল যে, জাহাজের ভেতরে অবস্থানরত আমরা একে-অন্যকে দেখতে পাওয়া তো দূরের ব্যাপার, এমনকি নিজের হাতটাকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। কী যে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম তা আর বলার নয়। এর পর পরই যে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল, তার বর্ণনা দেওয়া বাস্তবিকই সাধ্যাতীত, চেষ্টা করাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
আমাদের জাহাজের নরওয়ের অভিজ্ঞ ও প্রবীনতম নাবিকটার এমন প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে অভিজ্ঞতা নেই।
আকস্মিক ঝড়ের প্রথম ধাক্কাতেই মাস্তুলগুলো এমন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল যে, হঠাৎ করে দেখলে যে কেউই বলবে, করাত দিয়ে যত্ন করে কেটে ফেলা হয়েছে।
তখনও বড় মাস্তুলটা অক্ষত রয়েছে। আমার ছোট ভাই সেটাকে রক্ষা করার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাকে রক্ষা করা তো দূরের ব্যাপার তাকে সঙ্গে নিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ল। ব্যস, চোখের পলক পড়তে না পড়তে মাস্তুলটার সঙ্গে সে-ও ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে তলিয়ে গেল।
আমি ছোট ভাইকে তো চোখের সামনেই হারালাম। সে নির্মমভাবে পানিতে ডুবে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেল।
আর আমার বড় ভাই, সে যে কেমন করে প্রাণে বেঁচে গেল তা বলতে পারব না। কারণ একটাই, তার মৃত্যু যে কিভাবে ঘটেছিল তা জানার কোনো উপায়ই আমার ছিল না। আর এক মুহূর্তের জন্য ফুরসৎ পাইনি যে, তার খোঁজ করব।
আর আমি, পরিস্থিতি খারাপ বুঝে ব্যস্ত হয়ে ডেকের ওপর চলে গেলাম। কোনোরকমে পালের দড়িদড়া কেটে ফেললাম। ব্যস, এবার টান টান হয়ে ডেকের ওপর শুয়ে পড়লাম। ডেকের সঙ্গে নিজেকে লেপ্টে দিয়ে অদৃষ্ট সম্বল করে শুয়ে পড়ে থাকলাম। হাতড়ে হাতড়ে কোনোরকমে সামনের মাস্তুলের বলয় দুটোকে বের করলাম। সে দুটোকে দুহাতে শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ডেকের ওপর পড়ে রইলাম।
কিন্তু হায়! কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও আমরা পুরোপুরি পানিতে ডুবে যাই। সে সময়টুকুতেও আমি হাত থেকে বলয় দুটোকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে দিইনি। শ্বাসরুদ্ধ করে বলয় দুটোকে ধরে রাখলাম। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণই বা থাকা সম্ভব? উপায়ান্তর না দেখে আমি কোনোরকমে ডেকের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসলাম। হাত দুটোর ওপর শরীরের ভার সঁপে দিলাম।
যাক, এভাবে কোনোরকমে মাথাটাকে তো রক্ষা করা গেল। কিছুক্ষন বাদে, একেবারে হঠাৎই আমাদের ছোট জাহাজ ভুস করে ভেসে উঠল। পানিতে-ডোবা কুকুর যেভাবে দুম করে পানি থেকে ভেসে ওঠে ছোট জাহাজটাও যেন একই রকমভাবে পানি থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। সে নিশ্চিত সলিল সমাধির কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করল।
ইতিমধ্যে আমার মনে জমাটবাধা ভীতি–মনে অবর্ণনীয় ঘোরটা কেটে গেল।
এবার আমি বিষণ্ণ মনে ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবতে লাগলাম। এমন আচমকা, একেবারে হঠাৎই কে যেন আমার একটা হাত চেপে ধরল। প্রথমটায় আমি যারপরনাই ঘাবড়ে গেলাম। তারপর আতঙ্ক ও বিস্ময়ের ঘোরটুকু কাটিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোমাত্র চমকে গেলাম। দেখলাম, আমার বড় ভাই আমার হাতটাকে সাড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে। চরম বিপদের মুহূর্তে মানুষ যা করে থাকে সে তাই করেছে। তাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরে খুশির জোয়ার বয়ে যেতে লাগল।
আমি নিঃসন্দেহ হয়ে পড়েছিলাম, আমার দাদাভাই নির্ঘাৎ পানিতে পড়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে।
কিন্তু আমার আনন্দ-উচ্ছ্বাসটুকু মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বরং মুহূর্তের মধ্যেই হতাশায় আমার বুকটা ভরে উঠল। আতঙ্কে আমি একেবারে চুপসে গেলাম। উন্মুক্ত সমুদ্রের বুকেও যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। কারণ, আমার দাদাভাই কানের কাছে মুখ এনে অনুচ্চ অথচ স্পষ্ট ও কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল–মস্কো স্ট্রাম; মস্কো স্ট্রাম! কথাটা শোনামাত্র আমি শিউরে উঠলাম। আর শরীরের সব কটা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল। রক্তের গতি হয়ে পড়ল দ্রুততর, আর শ্বাসক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
সত্যি কথা বলতে কি, সে মুহূর্তে আমার মানসিক পরিস্থিতি যে কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল তা কেউ, কোনোদিন জানতে পারবে না।
মুহূর্তের মধ্যেই আমার মধ্যে এক নতুনতর উপসর্গ দেখা দিল। আমার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপতে আরম্ভ করল। মনে হলো বুঝি কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে।
মস্কো-স্ট্রাম শব্দটার মাধ্যমে আমার দাদাভাই কী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল তা আমি ভালোই জানতাম। আর সে আমাকে কি বোঝাতে চেষ্টা করেছিল তা-ও আমার জানা ছিল।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, যে বাতাস আমাদের ঠেলে নিয়ে চলছে তাতে স্ট্রামের ঘূর্ণাবর্তে গিয়ে অবশ্য হুমড়ি খেয়ে পড়ব, আর সে চরম মুহূর্তের আর দেরিও বেশি নেই। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই যা আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারবে।
কিন্তু ইতিমধ্যেই ঝড়ের প্রথম তাণ্ডব অনেকাংশে কমে গেল। কেবলমাত্র যে ঝড়ের প্রকোপই কমল তাই নয়। আকাশেও দেখা দিল, অভাবনীয় পরিবর্তন। এটুকু সময়ের মধ্যে যে এত পরিবর্তন ঘটতে পারে, তা বাস্তবিকই ভাবা যায়নি।
এতক্ষণ দিগন্ত পর্যন্ত আলকাতরার মতো কালো একটা পর্দা যেন প্রকৃতিকে ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ–একেবারে হঠাৎই আমাদের মাথার ওপরে এক টুকরো প্রায় বৃত্তাকার পরিষ্কার আকাশ দেখা দিল। এক টুকরো স্বচ্ছ নীল আকাশ। স্বীকার না করে পারছি না, এত পরিষ্কার আকাশ আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। উজ্জ্বল নীল আকাশের গায়ে দেখা দিল অত্যুজ্জ্বল রূপালি চাঁদ। আর তার গা থেকে ঝলমলে আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল।
কেবলমাত্র সমুদ্রের জলরাশির গায়েই নয়। চারদিকের সবকিছু যেন উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার দৌলতে ঝলমলিয়ে উঠল। কিন্তু, কিন্তু হায় আল্লাহ। সে মনোলোভা উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার কী দৃশ্যই যে শেষমেশ দেখলাম তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। আমি এবার ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখন কোলাহল এমন তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল যে, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে সাধ্যমত গলা চেঁচিয়ে কথা বলা সত্ত্বেও সে আমার একটা শব্দও শুনতে পেল না। কিছু না শুনে, কিছু না বুঝেই সে কেবলমাত্র মাথাটা নাড়ল।
আমি তার মুখের দিকে চোখ ফেরাতেই–নজরে পড়ল, তার মুখটা চকের মতো সাদা হয়ে গেছে। কীসের যেন এক আতঙ্ক তার মন জুড়ে রয়েছে।
আতঙ্কিত চোখে সে নীরব চাহনি মেলে আমার মুখের দিকে তাকাল। যেন সে কিছু একটা বলতে চাইছে। আমি শুধুমাত্র এটুকুই বুঝলাম যে, সে আমাকে বলতে চাইছে শোনো, কি বলছি। প্রথম দিকে কিছু আমার বোধগম্য হলো না। ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর একটা ভাবনা আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমি ব্যস্ত হাতে পকেট হাতড়ে ঘড়িটা বের করলাম। সেটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে দেখলাম, বন্ধ হয়ে রয়েছে।
এবার চাঁদের আলোয় নিয়ে গিয়ে ঘড়িটা ভালো করে দেখে নিঃসন্দেহ হওয়ায় সেটাকে চোখের সামনে ধরতেই আমার দুচোখের কোল ঘেঁষে পানির ধারা নেমে এলো। হঠাৎ করে কর্তব্য স্থির করে উঠতে না পেরে আমি সমুদ্রের জলে ঘড়িটাকে ছুঁড়ে দিলাম। সাতটা বেজে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্র প্রায় শান্ত, ঢেউয়ের উন্মাদনা না থাকায় সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
স্ট্রামের ঘূর্ণাবর্ত এখন চরম রূপ ধারণ করেছে। পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর।
আমরা এতক্ষণ সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় খুবই দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
সমুদ্র ক্রমেই উত্তাল-উদ্দাম রূপ ধারণ করল। সমুদ্র যেন দৈত্যের রূপ ধারণ করল। চরম উন্মত্ততা নিয়ে সমুদ্র যেন এবার আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখের পলকে আমাদের এক ধাক্কায় যেন একেবারে পর্বতের চূড়ার সমান উচ্চাতায় তুলে দিল। উঁচুতে আরও উঁচুতে উঠে আমাদের মাথা যেন একেবারে আকাশের গায়ে ঠেকে যাওয়ার জোগাড় হলো।
আমার সামান্যতমও ধারণা ছিল না যে, কোনো সমুদ্র ফুলে-ফেঁপে এত ওপরে উঠে যেতে পারে। এরকম কথা কেউ বলেও আমার মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারত না। ব্যস, পরমুহূর্তেই সে ঢেউটা দুম্ করে ভেঙে গিয়ে আমাদের এক আছাড় মেরে একেবারে নিচে ফেলে দিল। আমরা পুরোপুরি ডুবে গেলাম।
আমার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। ঝিমঝিম করতে লাগল। তখন আমার মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাল যে, আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম। আর সে স্বপ্নের মধ্যেই উঁচু একটা পর্বতের চূড়া থেকে হঠাৎই পা হড়কে একেবারে নিচে পড়ে গেছি।
কিন্তু ওপরে অবস্থানকালেই একবার এক পলকে চারদিকে দৃষ্টিপাত করেছিলাম। ঠিক তখনই আমাদের যথার্থ অবস্থানটা সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারলাম। দেখলাম, মত্সকো স্ট্রাম ঘূর্ণাবর্তটা আমাদের থেকে খুব বেশি হলেও সামনে সিকি মাইলের মধ্যেই রয়েছে। সে-মুহূর্তে আকস্মিক অভাবনীয় আতঙ্কে আমার চোখ দুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর প্রচণ্ড আতঙ্কে চোখের পাতা একসঙ্গ জুড়ে গেল। আসলে চোখের সামনে ভয়ঙ্কর সে দৃশ্যটাকে বরদাস্ত করতে আমাদের চোখ দুটো অক্ষম হয়ে পড়ল।
বেশিক্ষণ নয়, মাত্র দুমিনিট, দুমিনিট পেরোতে-না-পেরোতেই হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ঢেউ থেকে নেমে গিয়ে সমুদ্র প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। আর সমুদ্রের একটা বড় ভগ্নাংশ, যতদূর চোখ যায় দেখা গেল ফেণা যেন ছেয়ে ফেলেছে।
আর আমাদের জাহাজটা বাঁ দিকে খাড়াভাবে বাঁক নিয়ে তীরগতিতে ছুটতে আরম্ভ করেছে। আর ঠিক বাতাসের কাঁধে ভর করে তখনই আচমকা সমুদ্রের তর্জন গর্জনকে ছাপিয়ে বুক-ফাটা এক আর্তস্বর এসে আমার মনে আঘাত হানল।
আমার মনে হলো হাজার কয়েক বাষ্পচারিত জাহাজ থেকে সবগুলো নল দিয়ে এক সঙ্গে তীর বেগে বাষ্প বের করে দেওয়া হয়েছে।
আমরা তখনও ঘূর্ণাবর্তের চারদিকের ফেণারাশির মধ্যেই অবস্থান করছি। আর এও মনে হলো, আর একটু পরেই তার অতল গহ্বরে আশ্রয় নেব, তলিয়ে গিয়ে চিরদিনের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
না, যা আশঙ্কা করেছিলাম আসলে কিন্তু আদৌ তা হলো না। জাহাজটা ডুবল তো নাই বরং ঢেউয়ের শিখরে বুদ্বুদের মতো ভেসে চলতে লাগল।
যে শুনবে সেই আমার কথাটাকে গালগল্প বলেই উড়িয়ে দেবে, আমি ভালোই জানি। কিন্তু তা মনে হলেও যা সম্পূর্ণ সত্য, বাস্তব তাই তুলে ধরছি। আমার মধ্যে তখন একটা ভাবনারই উদয় হলো–এভাবে মৃত্যুবরণে কি মহত্বের ব্যাপার-স্যাপার কিছু আছে? আর সৃষ্টিকর্তার শক্তির এক অত্যাশ্চর্য প্রকাশের মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবন রক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের জীবনরক্ষার উপায় ভাবাটা কি নিতান্তই নগণ্য ব্যাপার?
আমার ধারণা, সে মুহূর্তে কথাটা আমার মনের কোণে উঁকি দিতেই লজ্জায় আমার চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি নিজেকে একটু সামলে-সুমলে নিলাম। প্রচণ্ড একটা কৌতূহল আমার মধ্যে ভর করল। একেবারেই অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য সে কৌতূহল। কী সে কৌতূহল? ঘূর্ণাবর্তটার গভীরতা পরিমাপ করার জন্য আমার মধ্যে ইচ্ছা জাগল। আর তা আমাকে অস্থির করে তুলল।
নিজের চোখেই তো তুমি দেখলে, ঢেউয়ের পেটটা সমুদ্রের উপরিতল থেকে বেশ কিছুটা নিচু। আর সেটা এ মুহূর্তে আমাদের থেকেও উঁচু একটা কালো পাথরের দেওয়ালের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা কথা বলছি, প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবের মুখোমুখি যদি কোনোদিন না হয়ে থাক, সে সময় সমুদ্রে অবস্থান না করে থাক, তবে প্রবল বাতাস আর জলকণার একত্রে মেশামেশি হলে মনের কোণে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায় তা তোমার পক্ষে বোঝাই সম্ভব হবে না। তোমার চোখ দুটোকে তারা ধাঁধা লাগিয়ে যাবে। তোমাকে একেবারে বধির করে ফেলবে। আর দুহাতে সজোরে কণ্ঠনালী চেপে ধরবে। কাজ আর ভাবনা চিন্তা করার মতো ক্ষমতা লোপ করে দেয়।
সত্যি কথা বলতে কি, সেই ফেণার রাজ্যে কতবার সে চক্কর মেরেছি তা। বাস্তবিকই আমার পক্ষে বলা মুশকিল।
প্রায় একটা ঘণ্টা ধরে যে আমি কতবার ঘুরেছি, ভেসে বেড়ানোর পরিবর্তে উড়ে উড়ে বেরিয়েছি আর ক্রমেই তার ভেতরের ভয়ঙ্কর দিকটায় এগিয়ে চলেছি, এগোচ্ছি তো এগোচ্ছিই।
আমি কিন্তু সর্বক্ষণই বলয়টা জোর করে আঁকড়ে ধরেই থাকলাম।
এই তো গেল আমার অবস্থা। আর আমার ভাই পিছন দিককার গলুইয়ের ওপরের খালি একটা পিপা দুহাতে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এরকম চরম মুহূর্তে তার আর করারও তো কিছুই ছিল না।
যে গহ্বরটার একেবারে কোণার দিকে সে এগোতে লাগল। সেখানে পৌঁছে। যাবার পূর্ব মুহূর্তেই সে বলয়টাকে ছেড়ে দিল। এবার সে হঠাৎই পিপেটাকে ছেড়ে দিয়ে বলয়টার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তখন তার মধ্যে আতঙ্ক এমন চরমে উঠে গেল যে, আমার হাত দুটোকে সরিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাতে লাগল যাতে বলয়টাকে আঁকড়ে ধরা যায়। কিন্তু দুজনের ধরার মতো জায়গা না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না।
আমার তো আর জানতে বা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, আমি পাগলই হয়ে গেছি। তা সত্ত্বেও তাকে এ কাজটা করার জন্য অত্র আগ্রহান্বিত দেখে আমার মনটা যে দুঃখে কী পরিমাণ বিষিয়ে উঠল, তা বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভবই নয়।
আমি বলয়টা ছেড়ে দিয়ে তাকে ধরার সুযোগ করে দিলাম। আর নিজে চলে গেলাম পিছনের গলুইটার কাছে। সেখানে গিয়ে পিপেটার কাছে গুটিসুটি মেরে বসার চেষ্টা করলাম। গোছগাছ করে কোনোরকমে বসামাত্রই জাহাজটা হঠাৎ দক্ষিণ দিকে হেলে পড়ল। ব্যস, আমরা উভয়েই গহ্বরটার ভেতরে ছিটকে পড়ে গেলাম।
মুহূর্তের মধ্যে মাত্র একবার পরমপিতাকে স্মরণ করলাম। আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, বুঝতে পারলাম। ভয়ানক দ্রুতগতিতে অবতরণ করার সময়ও আমি পিপেটাকে ছাড়লাম না, বরং অধিকতর দৃঢ়ভাবে সেটাকে আঁকড়ে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলি।
আমি চোখ দুটো বন্ধ করেই রাখলাম। কয়েক সেকেন্ড চোখ খুলে তাকানোর সাহসই হলো না। তখন তো যে কোনো মুহূর্তে পরলোকে পাড়ি জমাতে পারি এরকম আশঙ্কা বুকে স্থায়ী আসন পেতেই রয়েছে। মৃত্যুশিয়রে তবুও বুঝতে পারলাম, সমুদ্রের পানির সঙ্গে মরণ লড়াই এখনও পুরোপুরি আরম্ভই হয়নি।
একের পর এক মুহূর্ত পেরিয়ে যেতে লাগল। আমার দেহে কিন্তু তখনও প্রাণের অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে, আমি জীবিতই রয়েছি।
নিচে নামার চেতনাটা বন্ধ হয়ে গেছে।
আমাদের জাহাজটা তখনও ফেনার বৃত্তটার মধ্যেই অবস্থান করছে। আর তার গতিবেগের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রায় আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।
বুকে সাহস সঞ্চয় করলাম। সাহস করে চোখ দুটো ধীরে ধীরে মেলোম।
সে যে কী অবর্ণনীয় ভয়, জমাটবাধা আতঙ্ক আর অব্যক্ত বিস্ময়ের অনুভূতি আমার মন-প্রাণ আচ্ছন্ন করে ফেলল, তা আমি শত চেষ্টা করেও কোনোদিনই মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না।
অতিকায় পরিধি এবং অন্তহীন গভীরতা বিশিষ্ট গহ্বরটার ভেতরের দেওয়ালের ঠিক মধ্যস্থলের একটা জায়গায় জাহাজটা যেন ভোজবাজির খোলের মতো লটকে রয়েছে।
আর সে গহ্বরটার তেলতেলে গা-টাকে আবলুস কাঠ বলে ভ্রম হওয়া কিছু মাত্রও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেটাকে যেমন দ্রুতগতিতে অনবরত চক্কর খেতে দেখলাম, আর মেঘের বৃত্তাকার ফাঁক ফোকড় দিয়ে থালার মতো গোলাকার কিরণচ্ছটা যেভাবে তার ওপর পড়তে লাগল তাতে আমার ধারণা হলো গহ্বরটার মসৃণ ও কালো দেওয়ালের সঙ্গে লম্বাভাবে সোনালি রঙের জলস্রোত গহ্বরটার একেবারে অন্তিম তলদেশ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। সে যে কী স্রোত তার বিবরণ আর না-ই বা দিলাম।
আসলে আকস্মিক পরিস্থিতিটার মুখোমুখি হয়ে আমি এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, কিছুই নিবিষ্টভাবে লক্ষ করতে পারিনি। আসলে লক্ষ্য করার মতো মানসিক পরিস্থিতি আদৌ আমার ছিল না।
সাহসে ভর করে যখন চোখ দুটো খুলেছিলাম তখন কেবলমাত্র গহ্বরটার বুক কাঁপানো ভয়ঙ্কর অতিকায়ত্বটাকেই দেখেছিলাম।
বুকে সাহস সঞ্চয় করে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হবার পর স্বাভাবিকভাবেই নিচের দিকে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।
বৃত্তাকার গর্তটা দিয়ে গহ্বরটার ভেতরে যেটুকু অদের অত্যুজ্বল আলো ঢুকতে লাগল তাতে আমার মধ্যে এটুকু ধারণাই হলো তা বুঝি গহ্বরটার একেবারে তলদেশ পর্যন্ত গিয়ে থমকে গেছে।
কিন্তু কুয়াশা এমন জমাটবেঁধে বসেছে যার ফলে সবকিছুর ওপর যেন একটা পুরু আস্তরণ সৃষ্টি করেছে। আর এরই ফলে সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখা সম্ভব হলো না। তার সে জমাটবাধা কুয়াশার আস্তরণটার ওপর অতিকায় একটা রামধনুকে লটকে থাকতে দেখলাম। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা সরু আর প্রায় ভেঙে পড়া সেতুটাকে মহাকাল আর অনন্তকালের মধ্যে একমাত্র পথ আখ্যা দিয়ে থাকেন, এটা প্রায় সেরকমই দেখতে।
এবার সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে আরও কয়েটা কথা বলছি। সে ফেণার রাজ্য থেকে আমরা যখন প্রথম গর্তটার মধ্যে হুড়মুড় করে পড়েছিলাম তখন আকস্মিক একটা টান চাপের ফলে চো-চো করে অনেকখানি তলায় চলে গিয়েছিলাম। তার পরই গতির সে দ্রুততা আর রইল না। ফলে তখন আমাদের গতি অনেকটা মন্থর হয়ে যায়। ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকি। তবে একেবারে সরাসরি নয়, চারদিকে হরদম ঘুরতে ঘুরতে নামলাম। কখনও নামি কয়েকশো গজ, আবার গহ্বরটার পুরো একটা পাক খেয়ে নেমে চললাম।
গহ্বরটার ভেতরে তলিয়ে যেতে যেতেই লক্ষ্য করলাম, সে ঘূর্ণিপাকে কেবলমাত্র আমাদের জাহাজটাই যে আটকা পড়েছে তাই নয়। আমাদের ওপরেও নিচে-সর্বত্র জাহাজটার ছোট বড় অংশ, আসবাবপত্রের টুকরো, কিছু অতিকায় কাঠের গুঁড়ি, ছোট বড় বহু সামগ্রি, বাক্সের ভাঙা অংশ, লোহার পাত, পিপে আর চোঙের মতো কিছু বস্তু প্রভৃতি ভাসতে দেখতে পেলাম।
আমরা গহ্বরটার ভেতরে যতই নামতে লাগাম ততই ভয়ঙ্কর পরিণামের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে পেলাম। আর যতই দেখছি, কৌতূহলও যেন ততই বাড়তে লাগল।
আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আর সে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা বোঝার আগ্রহও আমাকে কম পেয়ে বসল না। আর সে অফুরন্ত আগ্রহ বুকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এগিয়ে চলা অন্য সব দ্রব্য সামগ্রির দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে ঘুরে ফিরে তাকাতে লাগলাম।
বহু দ্রব্য সামগি দেখতে দেখতে এক সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমি না নিয়ে পারলাম না।
সিদ্ধান্ত তিনটি এরকম—
প্রথমত–বস্তুটা যত ভারি হবে সেটা ততই দ্রুত গতিতে নামতে শুরু করবে। দ্বিতীয়ত-সমান বিস্তৃত দুটো স্কুপের মধ্যে একটা গোলাকার, অর্থাৎ বলের আকৃতিবিশিষ্ট হলে আর অন্যটা যে কোনো আকৃতিবিশিষ্ট হলে বলের মতো গোলাকার বস্তুটি অপেক্ষাকৃত দ্রুত নামতে থাকবে। আর তৃতীয়ত সমান আয়তনবিশিষ্ট দুটো বস্তুর মধ্যে একটা যদি সমগোলাকার হয় অন্যটা যে কোনো আকৃতিবিশিষ্ট হয় তবে সমগোলাকার বস্তুটা অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে নামতে থাকবে।
কেবলমাত্র এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথাই বা বলি কেন? আরও একটা বিস্ময়কর ঘটনাও এ সিদ্ধান্তগুলোর অনুরূপ–সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করল। ব্যাপারটা হচ্ছে, প্রতিবার চক্কর খাওয়ার সময় আমাদের নজরে পড়ল অতিকায় একটা পিপে অথবা জাহাজের মাস্তুল বা তার পাইপ অথবা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গোড়ার দিকে যে সব বস্তু আমার নজরে পড়েছিল সেগুলো বর্তমানে আমাদের থেকে বহু ওপরে অবস্থান করছে। মনে হলো প্রথমবস্থায় তারা যেখানে অবস্থান করছিল সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য দূরত্বে চলে তো যায়নি বরং প্রায় একই জায়গাইে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এবার যা-কিছু কর্তব্য বলে মনে করলাম তার কিছুই করতে কিছুমাত্রও ইতস্তত করলাম না।
সবার আগে আমি মনস্থির করে ফেললাম, পানির পিপেটার সঙ্গে নিজেকে আচ্ছা করে বেঁধে ফেলব। তারপর একটু সুযোগ পেলেই সেটাসহ পানিতে লাপ দেব। আচ্ছা করে পিপেটার সঙ্গে বাঁধা-থাকার ফলে আমার পক্ষে পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকা মোটেও অসম্ভব হবে না। আমি পানিতে ভাসমান পিপেগুলোর দিকে ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চেষ্টা করলাম। আর সে সঙ্গে আমার ইচ্ছাটার কথাও তাকে বোঝাবার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম।
ভাইটি হয়তো আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারলে, বুঝেও যেন বুঝতে পারল না। এ-কথা বলার অর্থ–সে বার বার মাথা নেড়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল, সে জায়গা ছেড়ে আসতে নারাজ। হয়তো ভবিষ্যৎ অজানা বিপদাশঙ্কায় তার মন কিছুতেই আমার প্রস্তাবে রাজি নয়।
কিন্তু আমাদের উভয়ের মধ্যে তখন যা ব্যবধান তাতে করে আমার পক্ষে তার কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। কাছাকাছি যেতে পারলে হয়তো বা আমার বক্তব্য তাকে। ভালোভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতেও পারতাম।
তাই অন্য উপায় না দেখে আমি নিজেকে পিপেটার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে পিপেটাসমেত সমুদ্রে লাফিয়ে পড়লাম।
হ্যাঁ, আমি যে আশা বুকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কার্যত ঘটলও তাই। নইলে আমার পক্ষে তোমার কাছে এ কাহিনী ব্যক্ত করা কি করে সম্ভব হতো? অর্থাৎ আমি যখন তোমাকে কাহিনীটা বলার সুযোগ পেয়েছি, অতএব আশা করি তোমার বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্য দিয়েই আমার পিতৃদত্ত জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল, তাই না? অতএব আমি এবার যা-কিছু বলব আশা করি অবশ্যই তা অনুমান করতে পারছ। তাই তো তাড়াতাড়ি কাহিনীটার যবনিকার দিকে। এগিয়ে যাচ্ছি। আমি জাহাজ থেকে পিপেটাসহ ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই অর্থাৎ প্রায় এক ঘণ্টা পরেই সেটা আমার অভিন্নহৃদয় ভাইকে নিয়ে উল্কার বেগে অনেকখানি নেমে গেল। আর এদিকে আমাকে নিয়ে পিপেটা আরও কিছুটা তলিয়ে যাবার পরই ঘূর্ণাবর্তের প্রকৃতিটা দ্রুত পাল্টে যেতে আরম্ভ করল।
আরও অতিকায় ও গভীর গর্তটার কালো মসৃণ খাড়া দেওয়ালটা অল্প অল্প করে কমে যেতে আরম্ভ করল। কমতে কমতে এক সময় অনেকখানিই কমে গেল।
এদিকে ঘূর্ণাবর্তের চক্কর মারা অবস্থাটা ক্রমে ধীর মন্থর হয়ে যেতে আরম্ভ করল।
আর অচিরেই ফেণারাশি আর রামধনুও বেপাত্তা হয়ে গেল। আরও অবিশ্বাস্য ব্যাপার যা আমার নজরে পড়ল তা হচ্ছে, গহ্বরটার তলদেশটা যেন ধীরে ধীরে হলেও ক্রমেই ওপরে উঠে যেতে আরম্ভ করল। বেশ কিছুটা ওপরে উঠেও এলো।
আকাশে ঘন কালো মেঘ কেটে গিয়ে আকাশটাও পরিষ্কার হতে হতে একেবারে নীল বর্ণ ধারণ করল। বাতাসের তীব্রতাও লাঘব হতে হতে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলো। পশ্চিম আকাশের গায়ে থালার মতো গোলাকার চাঁদটা অত্যুজ্জ্বল রূপ নিয়ে চোখের সামনে দেখা দিল।
অচিরেই দেখলাম, আমি পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় রয়েছি অর্থাৎ ভেসে বেড়াচ্ছি।
পরমুহূর্তেই আমার চোখের সামনে লকডেনের তীরভূমি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল। আর আমি অবস্থান করছি, মসকো-স্ট্রামের আবর্তের ওপরে।
সমুদ্র শান্ত থাকার কথা, কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের দরুণ সমুদ্র উথাল পাথাল করছে, উত্তাল-উদ্দাম তার রূপ। এক একটা ঢেউ যেন আকাশটাকে ছোঁয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়ছে।
আমি ঢেউয়ের কবলে নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ঢেউ আমাকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দিল। আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্ট্রামের খালে ঢুকে পড়তে বাধ্য হলাম। আর তারপরই হাজির হলাম, জেলেদের ডেরায়।
আমি ক্লান্ত অবসন্ন। আর টিকে থাকার মতো সামান্যতম ক্ষমতাও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। ঠিক এ পরিস্থিতিতেই একটা নৌকা আমাকে তুলে নিয়ে প্রাণে বাঁচিয়ে দিল। সদ্যলব্ধ স্মৃতি আর অবর্ণনীয় আতঙ্কে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম।
আমি যাদের নৌকায় আশ্রয় পেলাম, যারা আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে ছি নিয়ে নৌকায় তুলে নিল, সবাই আমার প্রাক্তন সহকর্মী। নিত্যকার কাজের সঙ্গি। তা সত্ত্বেও তারা আমাকে চিনতেই পারল না। আমার দিকে এমন ঢ্যাবা ঢ্যাবা চোখ করে তাকিয়ে রইল যেন চোখের সামনে মানুষ ভূত দেখলে যা করে থাকে। একদিন, মাত্র একটা দিন আগেও আমার যে চুলগুলো কুচকুচে কালো ছিল সেগুলো এ মুহূর্তে তুমি যেমন সাদা দেখছ, ঠিক সেরকমই দেখতে পেল। অবাক হবার মতো কথাই তো বটে। তাদের আর যা-কিছু বক্তব্য সেগুলোর মধ্যে, আমার মুখটাই পুরোপুরি বদলে গেছে।
আমি তাদের কাছে আমার কাহিনী সবিস্তারে বলেছি, তারা বিশ্বাস করেনি, করতে পারেনি।
এবার তোমার দরবারে আমার কাহিনী পেশ করলাম। আমার এ প্রত্যাশা ও বিশ্বাসটুকু আছে, সবচেয়ে ফুর্তিবাজ ছেলেরা আমার এ কাহিনীকে বেশি হৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করবে আর বিশ্বাস করবে।