০৬. ঝড় বুঝি উঠছে
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনে সোহো-পল্লীর এক গৃহে এক সুখী পরিবার। ডার্নে লুসীকে বিয়ে করেছেন। লুসী ম্যানেট আজ লুসী ডার্নে। তাদের একটি ছোট্ট মেয়েও হয়েছে, মায়ের নামে তাকে ডাকা হয় ছোট্ট লুসী বলে।–এই কয়টি মাত্র প্রাণী নিয়ে সেই ছোট্ট পরিবার। তবে হ্যাঁ, পরিবারভুক্ত না হয়েও এঁদের একটি অতি আপনজন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন তিনি হলেন মিস্টার লরী, টেলসন ব্যাঙ্কের কর্মাধ্যক্ষ।
আর এই পরিবারে মাঝে মাঝে দুই-এক ঘণ্টার জন্য একজন সুপরিচিত অতিথির দেখা মেলে, সে হচ্ছে সিডনী কার্টন, যার সঙ্গে ছিল ডার্নের আশ্চর্য চেহারার মিল। বৎসরে তিন-চারবারের বেশি সে আসে না। এসেও ছোট্ট লুসী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বেশি কথা সে বলে না। দু’এক ঘণ্টা! তারপরেই সে চলে যায় আবার। দিন দিন ধাপের পর ধাপ নেমে যাচ্ছে সে, তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। মুখে ভদ্রতার অভাব না দেখিয়েও অন্তরে সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করে, শুধু এক লুসী ছাড়া। লুসীর হৃদয় বেদনায় করুণ হয়ে ওঠে, সিডনীর বিবর্ণ মলিন মুখের দিকে চাইলেই।
ওদিকে প্যারী নগরে ডিফার্জের মদের দোকান আগের চাইতেও সরগরম। মাদাম ডিফার্জের সেলাইয়ের বিরাম নেই। একা মাদাম ডিফার্জ নয় আবার! আজকাল ঐ দোকানের এক অংশে বহু নারী এসে সেলাই নিয়ে বসে। সংকেতে কথা হয়। গুপ্তচরের ভয়ে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। ডিফার্জ সদা সতর্ক!
একদিন গভীর রাত্রে।
দোকান বন্ধ করে ডিফার্জ-দম্পতি চুপি চুপি কথা কইছে। স্বামী বলছে–আর কতদিন বলো দেখি? কতদিন আর অপেক্ষা করতে হবে এমনি ধারা?
স্ত্রী উত্তর দিচ্ছে–হয়তো বহুদিন! জমি তৈরি করার সময়টা দীর্ঘই হয়ে থাকে! ভূমিকম্পের কথা ভাবো! এক মিনিটে গোটা দেশটা ধ্বংস করে দেয় সে। কিন্তু ভূমিকম্পের উপযোগী অবস্থা তৈরি হয় মানুষের চোখের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে। বজ্রপাতের কথা ভাবো! বাজ মাথায় পড়লে এক সেকেন্ডে মানুষ মরে। কিন্তু বজ্রপাতের উপযোগী অবস্থার আবহাওয়া তৈরি হয় দীর্ঘদিন ধরে। আমরাও প্রস্তুত হচ্ছি। একদিন বাজের মত পড়বো গিয়ে অত্যাচারীর মাথায়, ভূমিকম্পের মত এসে গুঁড়িয়ে দেবো অত্যাচারী বড়লোকদের সমস্ত শক্তি!
স্বামী বললে–একদিন? আমরা বেঁচে থাকতে-থাকতে আসবে কি সে-একদিন?
–নাই-বা এলো? প্রস্তুতি চলছে তো! দেশের প্রতি নগরে, প্রতি গ্রামে জ্যাকস্ ভাইদের সংঘ গড়ে উঠেছে। পুলিশে জ্যাক্স্, সেনাদলে জ্যাক্স্, দোকানে জ্যাক্স্, হোটেলে জ্যাকস্। একদিন এক শুভ মুহূর্তে এরা মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠবে সবাই, অত্যাচারী রাজার সিংহাসন টলমল করে কেঁপে মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে অমনি। প্রতীক্ষা করো।
প্রতীক্ষা আর বেশি দিন করতে হলো না। বাসুকির সহস্র ফণা দুলে উঠলো একদিন প্রভাতে! ধরণী কেঁপে উঠলো থর-থর…থর…থর…।
রোগা, শুকনো দাঁড়কাক যেন হাজারে-হাজারে উড়ছে ডিফার্জের দোকানের চারিপাশে। কিন্তু এরা দাঁড়কাক নয়, মানুষ। এদের মাথার উপর ইস্পাতের ঝিলিক খেলে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। যে-কোন অস্ত্র হাতের কাছে পেয়েছে, তাই নিয়ে ছুটে এসেছে এরা। সারা সেন্ট আন্টইন-পাড়া এক সুরে গর্জন করছে, হাতিয়ার তুলে হাজারে-হাজারে অনাবৃত বাহু বাতাসে দুলছে শীতের দিনে পাতাঝরা অরণ্যে মলিন কালো বৃক্ষশাখার মত!
হাতে হাতে অস্ত্র, হাজারে হাজারে! কোথা থেকে এলো এত অস্ত্র? কেউ বলতে পারে না–কোথা থেকে এলো। কিন্তু এসেছে তারা…অজানা লোকেরা বিতরণ করেছে সেই অস্ত্র ভিড়ের ভিতর। বন্দুক, কার্তুজ, বারুদ, লোহার ডাণ্ডা, বাঁশের লাঠি, কাঠের মুগুর, ছুরি, কাটারি, কোদাল, কুড়াল–আঘাত করবার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, এমন কোন জিনিসই বাদ পড়েনি। যাদের ভাগে কোন হাতিয়ার পড়লো না, তারা রাস্তা খুঁড়ে পাথর আর ইট তুলতে লাগলো। সেন্ট আন্টইনের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় বিকার চেপেছে, বিকারের রোগীর মতই দপ্ করছে তাদের নাড়ী, জ্বলজ্বল করছে তাদের টকটকে লাল চোখ। জীবনটাকে সবাই মনে করছে খেলার বস্তু, আর সে খেলার বস্তুটাকে গুড়ো করে ভেঙে ফেলবার জন্যই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এই হাজার হাজার লোক–যারা দাঁড়কাকের মত এসে ভিড় করেছে ডিফার্জের দোকানের সমুখে, এই সাংঘাতিক সকালবেলায়।
দাঁড়কাকেরা ঘুরছে ডিফার্জকে কেন্দ্র করে। ধ্বংসের এই মহাযজ্ঞের প্রধান পুরোহিত সে। অস্ত্রবিতরণে ডিফার্জ, আদেশদানে ডিফার্জ, সকল ব্যাপারে ডিফার্জ! কাউকে পিছনে হটিয়ে দিচ্ছে, কাউকে সমুখে টেনে আনছে, কাউকে অস্ত্র দিচ্ছে, কারুর অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে, হুকুম দিচ্ছে, শাসন করছে, উপদেশ দিচ্ছে, মিনতি করছে–সারা গায়ে বারুদ আর ঘাম, চরকির মত ঘুরছে অনবরত।
–তিন নম্বর জ্যা, তুমি আমার কাছে থাক!–এই বলে সে চিৎকার করে উঠলো–এক নম্বর আর দু’নম্বর জ্যাস্ত তামরা এক-একটা দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করো, এগিয়ে গিয়ে! আমার স্ত্রী কোথায়? আমার স্ত্রী?…মাদাম ডিফার্জের উত্তর শুনতে পাওয়া গেল কাছেই! মাদাম ডিফার্জ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ আর তার হাতে সেলাই নেই, তার বদলে আছে একখানা কুঠার। কোমরবন্ধে একখানা বাঁকা ছোরা, আর একটা গুলিভরা পিস্তল। ডিফার্জ জিজ্ঞাসা করলো–তুমি কোন্ দিকে যেতে চাও?
উপস্থিত তোমাদের সঙ্গেই যাচ্ছি। কিন্তু আমি নেবো মেয়েদের দলের নেতৃত্ব। শয়তানদের হত্যা করার কাজে মেয়েরা কি অক্ষম?
বজ্রনাদ ____ করে উঠলো ডিফার্জ–দেশপ্রেমিক বান্ধবেরা! আমরা প্রস্তুত। চলো– ___ চলল!
এক গর্জন উঠলো বহু সহস্র কণ্ঠ থেকে। সেই বিরাট জনতা ছুটলো এবার, যেন কূল ছাপিয়ে সমুদ্র ছুটলো তরঙ্গে-তরঙ্গে। সমগ্র নগরী প্লাবিত, মগ্ন হয়ে গেল সেই তরঙ্গের নিচে। গির্জায়-গির্জায় বাজছে আতঙ্কের ঘণ্টা, জয়ঢাক বাজছে তোরণে-তোরণে, উদ্বেল সমুদ্র ধেয়ে গিয়ে ভেঙে পড়লো ব্যাস্টিল-কারাদুর্গের পাঁচিলের ওপর।
গভীর পরিখা ব্যাস্টিলের চারিপাশে। একটার পর একটা টানা-সেতু-নীরেট পাথরের প্রশস্ত দেওয়াল, তার মাথায় আটটা গুম্বজ,-গুম্বজে-গুঁজে কামান, বন্দুক, আগুন, বিস্ফোরক! মৃত্যুকে তুচ্ছ করে আগুন আর ধোঁয়ার ভিতর এগিয়ে চললে পাগল জনতা, আগুন আর ধোঁয়া অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়ে গুম্বজে-গুম্বজে কামান নিলো দখল করে।
মদের দোকানী ডিফার্জ চোখের পলকে গোলন্দাজ হয়ে দাঁড়ালো। ঘণ্টার পর। ঘণ্টা কামান দাগতে লাগলো ব্যাস্টিলের দুর্গপ্রাচীরে। গভীর পরিখা পার হয়ে, টানা-সেতু উত্তীর্ণ হয়ে, নীরেট পাথরের দেয়াল টপকে, গুম্বজে-গুম্বজে কামানের পাশে দাঁড়ালে গিয়ে বিরাট জনসমুদ্র। ডিফার্জ গর্জন করে ওঠে থেকে থেকে– কমরেডরা! বিশ্রাম নেই…শত্রু মাররা! এগিয়ে চলো ব্যাস্টিলের মাঝখানে! জ্যাক। নম্বর এক! জ্যাক্স্ নম্বর দুই! জ্যাক্স্ নম্বর এক হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর দু’ হাজার! জ্যাক্স্ নম্বর পঁচিশ হাজার! ভগবানের ভক্ত, ভগবানকে ডেকে নাও! শয়তানের যে সঙ্গী, শয়তানকে সে স্মরণ কর! এগিয়ে চলো বন্ধু! এগিয়ে চলল! শত্রু মারো!
কামান, বন্দুক, আগুন আর ধোঁয়া। সেতুর পর সেতু পেরিয়ে, পরিখার পর পরিখা উত্তীর্ণ হয়ে, গুম্বজের পর গুম্বজে চড়ে নীরেট দেয়ালের মাথায় গিয়ে ওঠে বিরাট জনসমুদ্র। অস্ত্রের মুখে রৌদ্র জ্বলে ঝক্ঝক্! মশালের মুখে আগুন জ্বলে জু-জুল! খড়ের গাদায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে আগুন আর ধোঁয়া! আর্তনাদ, অভিশাপ, গোলাবৃষ্টি–বিরাট জনসমুদ্র এগিয়ে চলে ব্যাস্টিলের কেন্দ্রস্থলে। উথলে ওঠে জনসমুদ্রের তরঙ্গ, চিরতরে ডুবে যায় ফরাসীদেশের অত্যাচারী রাজতন্ত্র! নিরুপায় দেখে দুর্গরক্ষীরা সাদা নিশান উড়িয়ে সন্ধির প্রার্থনা জানালো।
ঝড়ের বেগে ধেয়ে যায় জনতা, তার মাথার উপর চকিতে উড়লো একবার সেই শ্বেতপতাকা, অমনি উল্লাসে গর্জন করে প্রাচীরের মাথার দিকে ছুটলো জনতা, যেন আকাশপানে লাফিয়ে উঠলো সমুদ্রের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গদোলার মাথায় চড়ে ডিফার্জ আর তার সঙ্গীরা গিয়ে পড়লো ব্যাস্টিলের মাঝখানে। একজন প্রহরীকে সমুখে দেখে তার গলার কলার চেপে ধরলো ডিফার্জ :
–১০৫, নর্থ টাওয়ার, জিনিসটা কি?
ভীত ত্রস্ত প্রহরী বুঝতে পারলো না—১০৫?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা কি কোন বন্দীর নাম? ১০৫, নর্থ টাওয়ার?
–ও একটা কারা-গহ্বরের নাম!
–দেখাও সেটা!
ঘুরতে-ঘুরতে কক্ষের পর কক্ষ, সিঁড়ির পর সিঁড়ি, দ্বারের পর দ্বার, সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে চললো প্রহরীর পিছনে-পিছনে ডিফার্জ আর তিন নম্বর জ্যাক্স্! অবশেষে ছোট একটা গর্ত! কক্ষ বলা ভুল তাকে। যেন পাথরের ভিতর খোদাই করে বার করা হয়েছে একটা গর্ত! একটা মাত্র জানালা, তাতে মোটা-মোটা লোহার গরাদে!
সেই ঘরের দেয়ালে ডিফার্জ দেখে, তখনও রয়েছে একটা নাম লেখা, আঁচড় কেটে-কেটে। ডিফার্জ পড়লো–আলেকজান্ডার ম্যানেট!
সেই গর্তের মেঝে খুঁড়ে, চিমনী ভেঙে, লোহার খাট আর টুল উল্টেপাল্টে তালাসী করলো ডিফার্জ। হ্যাঁ, পেলো বইকি! চিমনীর কোন্ ফাঁকে সে আবিষ্কার করলো একতাড়া কাগজ!
তারপর তারা বেরিয়ে পড়লো, ১০৫ নম্বর নর্থ টাওয়ার থেকে। প্রাঙ্গণে তখন ডিফার্জের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই। ডিফার্জ এসে আবার নেতৃত্ব গ্রহণ করলো সেই বিরাট জনসমুদ্রের। ১০৫-এর মতই ছোট-ছোট গর্ত থেকে সাতজন বন্দীকে করা হল মুক্ত! আর ব্যাস্টিলের সবচেয়ে মজবুত, সবচেয়ে উঁচু গুম্বজ থেকে ধরে আনা হলো সাতজন উঁচুদরের রাজকর্মচারীকে!
তারপর সেই সাতজন বন্দীকে কাঁধে করে নিয়ে বেরুলো সেই বিরাট জনতা– ব্যাস্টিলের কারাদুর্গ থেকে। কাঁধে তাদের সাতজন মুক্ত রাজবন্দী, আর সেই জনসমুদ্রের মাথার উপর উঁচু-বাঁশে-বসানো সাতটি রক্তঝরা নরমুণ্ড! সেই অত্যাচারী সাতজন রাজকর্মচারীর সদ্য-কেটে-আনা মুণ্ড! যুগের পর যুগ অত্যাচারিত, অপমানিত জনতার সেই পাগল প্রতিহিংসা রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেল মানুষের ইতিহাসে। যুগ পালটে গেল।
***
এই যুগ-পালটানো ঘটনার অল্প পরেই একদিন টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে কথা হচ্ছিলো মিস্টার লরীর সঙ্গে চার্লস্ ডার্নের। ব্যাঙ্কের প্যারী-শাখার কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলার দরকার হয়েছে। সেখানে আর কারবার চলছে না। কাগজপত্র যথাসম্ভব নিয়ে আসতে হবে লন্ডন অফিসে। সব হয়তো নিয়ে আসা সম্ভব হবে না–কারণ ফরাসী সীমান্তে কড়া পাহারা বসিয়েছে বিদ্রোহীরা। যা নিয়ে আসার উপায় নেই, তা লুকিয়ে রেখে, বা নষ্ট করে দিয়ে আসতে হবে। এ গুরুভার কাজের জন্য মিস্টার লরীকে দু’চার দিনের জন্য যেতেই হবে প্যারীতে একবার। ডার্নেকে ডেকে পাঠিয়েছেন লরী এই সংবাদই দেবার জন্য। ডার্নে ও ম্যানেটকে না জানিয়ে লরী যেতে পারেন না, কারণ, ওঁরাই এখন লরীর একমাত্র আপনার জন পৃথিবীতে।
লরী এ-সময়ে প্যারী যাবেন শুনেই ডার্নের চক্ষুস্থির! প্যারী যাবেন? যে-প্যারীতে এখন মৃত্যুর প্রলয়নাচ চলেছে চব্বিশ ঘণ্টা? যে প্যারী ছেড়ে পালাবার জন্য ব্যগ্র সবাই? ফ্রান্সের রাজা-রানী বন্দী! জমিদার ও ভূতপূর্ব শাসকেরা–যে পেরেছে, সেই পালিয়েছে। যে পারেনি সে গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছে। গিলোটিন-বড়লোকদের মাথা কাটবার জন্য বিদ্রোহীরা নতুন কল তৈরি করেছে ঐ গিলোটিন! খ্যাঁচ্, খ্যাঁচ –অস্ত্র পড়ছে অপরাধীর শিরে, একের পর এক! মাথার পর মাথা লুটিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচেকার ঝুড়ির ভিতর! এই গিলোটিনে দৈনিক দুশো-একশো লোক প্রাণ দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের অবিশ্বাস বা সন্দেহভাজন যে, তার আর নিস্তার নেই গিলোটিন থেকে। যে কেউ একটা যেমন তেমন অভিযোগ করলেই হল। সঙ্গে-সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি বন্দী হবে। সঙ্গে-সঙ্গে তার বিচার হবে এবং সঙ্গে-সঙ্গে গিলোটিন।
কিন্তু ডার্নের সমস্ত প্রতিবাদ, সমস্ত অনুনয় ব্যর্থ হয়ে গেল। লরী এতকাল টেলসন ব্যাঙ্কের নিমক খেয়েছেন, এখন তিনি গিলোটিনের ভয়ে ব্যাঙ্কের কাজে অবহেলা করবেন? বিশেষ করে লরী হলেন ইংরেজ, হঠাৎ কোন ইংরেজকে গিলোটিনে পাঠাতে ফরাসী-বিদ্রোহীরাও সাহস পাবে না।
লরী সেইদিনই রাত্রে রওনা হবেন। মনস্থির করে ফেলেছেন একেবারে।
লরীকে নিরস্ত করতে না পেরে ডার্নের বড়ই চিন্তা আর ভয় হল তার জন্য। কিন্তু উপায় তো নেই। তিনি চলে আসবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময়ে ব্যাঙ্কের মালিকদের ভিতরই একজন এসে লরীর হাতে দিলেন একটা চিঠি। চিঠির খামখানা নোংরা হয়ে গেছে, যেন বহু হাত ঘুরে এসেছে সে। লরী চিঠিখানা হাতে নিয়ে বললেন–না, মহাশয়! বহু খোঁজই তো করা হল। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।
ফরাসীদেশ থেকে কিছুদিন ধরে নিত্যই নতুন-নতুন লোক পালিয়ে আসছে ইংলন্ডে। জমিদার, সামরিক-কর্মচারী, মন্ত্রী, ম্যাজিস্ট্রেট–সবাই পালিয়ে আসছেন প্রাণ হাতে করে। এঁরা সবাই প্রায় একবার করে টেলসন ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে দেখা দিয়ে যান। অনেকের হিসাব আছে এ-ব্যাঙ্কে। অনেকের ছিল, এখন নেই, কিন্তু পূর্বের খাতিরে ধার পাওয়ার প্রত্যাশা করেন। কেউ আবার আসেন–পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সাক্ষাৎ এখানে পাওয়া যাবে এই আশায়। ফরাসীদেশের লোকমাত্রেই জানে–পলাতক-ফরাসীদের আড্ডা লন্ডনে ঐ একটিই আছে—টেলসন ব্যাঙ্কের অফিস। তাই কোন পলাতক-ফরাসীকে পত্র লিখতে হলে ফ্রান্সবাসী ফরাসীরা টেলসনের ঠিকানাতেই পত্র দেয়। লরীর হাতের চিঠিখানাও ঐ জাতীয় একখানা চিঠি! লরী মাথা নাড়লেন–না, রোজই তো খোঁজ করা যাচ্ছে। এ-নামের কাউকে দেখতে পাই না।
চিঠিখানা টেবিলের উপর পড়ে আছে। ডার্নে শিরোনামাটা পড়লেন। তাঁর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধক্ করে লাফিয়ে উঠলো। মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নাম লেখা আছে–মার্কুইস এভরিমন্ডি।
মাকুইস এভরিমন্ডি? সে তো ডার্নে! ফরাসীদেশে তো ডার্নের ঐ নাম! গুপ্তহন্তার হাতে তাঁর পিতৃব্য খুন হওয়ার পরে ডানেই তো এখন মার্কুইস বা জমিদার! সে অভিশপ্ত নামের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখবেন না বলেই ডার্নে ইংলন্ডে নিজেকে ডানে নামে পরিচিত করেছেন। কিন্তু এখন-কে তাকে চিঠি লিখলো পিছনে-ফেলে-আসা ফরাসীদেশ থেকে?
ডার্নে লরীকে বললেন–এভরিমন্ডি? ভদ্রলোকটি আমার পরিচিত। চিঠিখানি যদি আমায় দেন, আমি দিয়ে দিতে পারবো।
লরী খুশি হয়েই পত্র দিয়ে দিলেন ডার্নেকে।
ডার্নের প্রকৃত নাম ডাক্তার ম্যানেট ভিন্ন কেউ জানে না। ম্যানেটও জেনেছিলেন সবে লুসীর বিবাহের দিন। জেনেই তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল বিবাহ ভেঙে দেওয়ার। কিন্তু তা তিনি পারেননি, লুসীর মুখ চেয়ে। লুসী যে ভালোবাসে ডার্নেকে! তাই পরম শত্রুর পুত্রকে তিনি জামাতা বলে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ডার্নেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি যেন নিজের আসল নাম লুসীকে বা লরীকে না বলেন।
ডার্নে পত্র পড়ে দেখলেন–তার ফরাসীদেশের কর্মচারী গ্যাবেল লিখেছে চিঠি। এভরিমন্ডি-জমিদারীর গোমস্তা বলে, সে বন্দী হয়েছে, শীঘ্রই তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তাকে বাঁচাতে হলে, এভরিমন্ডি-মার্কুইসের অবিলম্বে ফ্রান্সে যাওয়া প্রয়োজন। তা নইলে প্রভুর অপরাধে ভৃত্য প্রাণ হারাবে!