০৩. রাজদ্রোহের মামলা
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনের ফৌজদারী আদালত-ওল্ড বেইলী।
লোকে লোকারণ্য, আজ একটা রাজদ্রোহের মামলা চলেছে। খুব সম্ভব, জুরীরা দোষীই সাব্যস্ত করবেন আসামীটাকে। জুরীরা সাধারণত তাই করে থাকেন, রাজদ্রোহের মামলা পেলে। রাজার প্রতি একটা কর্তব্য আছে তো ভদ্রলোকদের! তাছাড়া, মাঝে মাঝে ফাঁসিটা-আষ্টা নাগরিকদের দেখবার সুযোগ দেওয়াও দরকার বই কি! নইলে, তারা টেস্লো দেয় কিসের জন্য?
তার উপর, রাজদ্রোহের আসামীর যা দণ্ড, তা শুধু ফাঁসির মত নিরামিষ নয়। প্রথম অবশ্য ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাণটা বেরিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নামিয়ে ফেলতে হবে তাকে। তারপর গলার দড়ি খুলে নিয়ে তা দিয়ে বাঁধতে হবে হাত-পা। সেই অবস্থায় তাকে শুইয়ে রেখে, পেট ফেড়ে নাড়িভুড়ি বার করে ফেলা হবে তার। সে নাড়িভুড়ি তার সমুখেই পোড়ানো হবে আগুন জ্বেলে। এদিকে জ্ঞান থাকতে-থাকতেই অনেক কিছু করতে হবে তাকে নিয়ে। দেরি করা চলে না। এক-একখানি হাত, এক-একখানা পা ধীরে-সুস্থে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে কাটা হবে তরোয়াল দিয়ে। কখনও কখনও তরোয়াল ব্যবহার না করে, ঘোড়ার পেছন-পায়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় হাত-পা। পরস্পরের বিপরীত-দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে দু’টো তেজী ঘোড়া। একটার পেছন-পায়ে বাঁধা হল আসামীর হাত, আর-একটার পেছন-পায়ে তার পা দুখানা। তারপর দু’টো ঘোড়াকেই মারা হলো জোরসে চাবুক। তারা ছুটলো বায়ুবেগে। অপরাধীর হাত ছিঁড়ে ছুটে চললো উত্তর দিকে, পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল দক্ষিণে। কী স্বর্গীয় উল্লাস দর্শকদের! এরকম মজা কি পয়সা দিয়েও সাকাসে দেখা যায়? সুসভ্য ইংরেজ গভর্নমেন্ট দেড়শো বছর আগেও নাগরিকদের আনন্দের জন্য এ-রকম সব মনোরম ব্যবস্থা রেখেছিলেন আইনে। এই অল্প কয়েক দিনেই অনেক অধঃপতন হয়েছে দেশটার, উঠে গেছে সে-সব কানুন….
যাই হোক, হাত-পা কেটে বা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার পরেও প্রাণ বলতে যদি কিছু অবশেষ থাকে আসামীর দেহে, তবে তার অবসান করবার জন্য এইবার গলায় এক ঘা তলোয়ার বা কুড়াল বসানোর জন্য জল্লাদকে ডাকা হয় চটপট। আজকের আসামীটাকে দেখলে তো বেশ ভালো বলেই মনে হয়। দিব্য ভদ্রলোকের মত চেহারা, বছর পঁচিশ বয়স হবে, বেশ পুষ্ট নধর দেহ, পোশাক সাধারণ হলেও পরিচ্ছন্ন। বর্তমান বিপদের জন্য মুখটা বিবর্ণ, কিন্তু কোনরকম চাঞ্চল্যের পরিচয় নেই তার ভাবভঙ্গির ভিতর। বেশ গম্ভীর সংযত ভাবেই সে নমস্কার করলো জজ ও জুরী মহোদয়গণকে।
আসামীর উকিল একগোছা কাগজ নিয়ে ক্রমাগত নাড়া-চাড়া করছেন। আর, তার কাছেই আর-একটি পরচুলা-পরা (তখন সব উকিলই পরচুল পরতেন) উকিল বসে-বসে ছাদের কড়িকাঠ গুনছেন। সরকারী উকিল সওয়াল শুরু করলেন।
“কয়েক বৎসর থেকেই আসামী চার্লস ডার্নে ক্রমাগত ইংলিশ চ্যানেল পারাপার করছে। কী এত প্রয়োজন তার ফ্রান্সে? কেন যায় সে ঘন-ঘন ও-দেশে? খুব সন্দেহজনক নয় কি তার গতিবিধি?
জন বরসাদ হল ঐ ডার্নেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। “হল” না বলে, “ছিল” বলাই উচিত বোধহয়। কারণ, আসামীর জঘন্য আচরণের যা পরিচয় পাওয়া গিয়েছে, তাতে সাক্ষী মিঃ বরসাদের মত মহানুভব দেশপ্রেমিকের পক্ষে তাকে আর বন্ধু বলে মনে করা সম্ভব নয়। আসামীর জঘন্য আচরণের পরিচয় প্রথমে এই মিঃ বরসাদই পান, এবং নিছক দেশপ্রেমের তাগিদেই তাঁকে প্রকাশ করে দিতে হয়েছে উক্ত জঘন্য আচরণের কথা। জঘন্য আচরণটা কি?না, ডানে গুপ্তচর। মহা-মহিমান্বিত সদাশয় সর্বগুণান্বিত ইংলভাধিপ শ্রীল তৃতীয় জর্জের সৈন্যবাহিনীতে কত সৈন্য আছে, সে সব সৈন্য কোথায় কোথায় আছে, কী কী অস্ত্রে তারা শিক্ষালাভ করছে–এইসব গুরুতর বিষয়ের সমস্ত খুঁটিনাটি সংবাদ যে কোন উপায়ে সংগ্রহ করে তাই ফরাসীরাজ লুইয়ের দরবারে পেশ করাই হল তার পেশা। ঐসব সংবাদ সরবরাহ করতে তাকে নিজের চোখে দেখেছেন দেশপ্রেমিক বরসাদ। আসামী ঐসব বিবরণ যে কাগজপত্রে লিখে রেখেছিল, তা তার পকেটে ও টেবিলের দেরাজে পাওয়া গিয়েছে, পেয়েছে তারই ভৃত্য। উক্ত ভৃত্যও–তার গুপ্তচর-প্রভুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসেছে; এসেছে দেশপ্রেমেরই তাগিদে।”
সওয়াল শেষ করে সরকারী উকিল বরসাদ এবং রোজার ক্লাইয়ের সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন। বাদ ছিল ডানের বন্ধু, ক্লাই ছিল তার ভৃত্য। উকিল পূর্বেই যা বলে রেখেছেন, সাক্ষীরা পরে এসে বললো সেই কথাই। তবে জেরাতে ও-ছাড়াও দু’চারটে নতুন কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো। বরসাদের মুখ থেকে যা শোনা গেল তা কতকটা এই রকম :
–তুমি নিজে কোনদিন গুপ্তচর ছিলে?
–না। ও-রকম বদনাম যে দেয়, তাকে ঘৃণা করি আমি।
–কিসে চলে তোমার?
–সম্পত্তি আছে, মশাই!
–সম্পত্তিটা কোথায়?
–সেটা–সেটা ঠিক মনে পড়ছে না চট করে।
–সম্পত্তিটা কী?
–তাতে অন্যের কি প্রয়োজন, মশাই?
–সম্পত্তিটা কারও কাছ থেকে পাওয়া বোধ হয়?–হ্যাঁ, তা বই কি।
কার কাছ থেকে?
–দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল একজন
–খুবই দূর–বোধ হয়?
–তা, দূরই বটে!
–জেলে গিয়েছিলে কখনো?
–নিশ্চয়ই না।
–দেওয়ানি জেলে? দেনার দরুন?
–এ-মামলার সঙ্গে সে-কথার সম্বন্ধ কী, তা তো বুঝতে পারছি না।
–আবারও বলছি, দেওয়ানি জেলে গিয়েছিলে? উত্তর দাও।
–তা, হ্যাঁ—
–কতবার?
–দু’তিনবার হবে।
–না–পাঁচ-ছ’বার।
–তাও হতে পারে হয়তো!
–পেশা কি?
–ভদ্রলোক! ভদ্রলোকের আবার পেশা কি?
–লাথি খেয়েছো কখনো? কারো কাছে?
–তা—হয়তো–
–বহুবার?
–না, না!
–লাথি মেরে সিঁড়ির ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল কেউ?
–না, না। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ-ই লাথিটা পড়লো এসে! টাল সামলাতে না পেরে নিজেই পড়ে যাই!
–লাথি খেয়েছিলে, জোচ্চুরির দরুন তো?
–বলেছিল বটে সেই মিথক লোকটা। কিন্তু ওটা মিছে কথা! লোকটা মাতাল ছিল তখন!
–যদি বলি, জোচ্চুরিই তোমার পেশা? তাই করেই দিন চলে তোমার?
–কখনো না।
–আসামীর কাছে টাকা ধার করেছিলে?
–হ্যাঁ।
–সে টাকা শোধ দিয়েছিলে?
–না।
–আসামীর সঙ্গে যে বন্ধুত্বের কথা তুলেছে, সেটা কী রকম বন্ধুত্ব? তুমিই গায়ে পড়ে পড়ে খানিকটা আলাপ-পরিচয় জমিয়েছিলে, কী বলে? গাড়িতে, স্টীমারে, হোটেলে এবং রাস্তায়ই যা-কিছু আলাপ–কী বলো?
–না, তা হবে কেন?
–তুমি গভর্নমেন্টের মাইনে-করা গোয়েন্দা কি?
–বলেন কি মশাই?
–এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার দরুন বকশিশ পাবে কিছু?
–আরে বলেন কি মশাই?
–ভগবানের নামে দিব্যি করে বলতে পারো এ-কথা?
–লক্ষ বার!
আসামীর কোন এক সময়ের ভৃত্য রোজার ক্লাইকে সরকারী উকিল খুব জোর সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। সে নাকি কর্তব্যের জন্য সবই করতে পারে। সে নাকি উঁচুদরের দেশপ্রেমিক। জবানবন্দীতে সে বলেছিল–আসামীর পকেটে সে লম্বা লম্বা তালিকা দেখতে পেতো প্রায়ই। ক্যালে বন্দরে একদিন আসামী এই ধরনের কয়েকখানা তালিকা দিয়েছিল এক ফরাসী ভদ্রলোককে। এসব তালিকায় প্রায়ই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের কথা থাকত, যুদ্ধের সময় কোন্খানে ঘাঁটি করলে ভালো হবে, কোন্ জায়গা সকলের আগে দখল করবার দরকার হবে, এসব কথারই উল্লেখ দেখা যেত। সাক্ষী যখন বুঝতে পারলো যে তার প্রভু গুপ্তচর, তখন আর তার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হল না। দেশপ্রেমের প্রেরণায় সে গভর্নমেন্টের কাছে এসে প্রকাশ করতে বাধ্য হল তার প্রভুর জঘন্য বৃত্তির কথা। সে এক নম্বর সাক্ষীকে চেনে। জন বাদ নাম তার। প্রায় সাত-আট বৎসর থেকে চেনে।
জেরার মুখে ক্লাই প্রকাশ করে ফেললো–সে যেচে এসে আসামীর কাছে চাকরিতে ভর্তি হয়েছিল, এক স্টীমারের উপরে! কষ্টে পড়েছে, খেতে পাচ্ছে না ইত্যাদি বলেই সে আসামীর দয়া লাভ করেছিল। তারপর সে একটা রুপোর টি পট চুরি করে।
তৃতীয় সাক্ষী হলেন মিস্টার জার্ভিস্ লরী। সরকারী উকিলের সঙ্গে তার এইরকম প্রশ্নোত্তর হল :
–মিস্টার লরী, আপনি টেলসন ব্যাঙ্কের কর্মচারী?
–হ্যাঁ।
–১৭৭৫ সালের নভেম্বরে এক শুক্রবার রাত্রে ডোভার-মেলে যাত্রী ছিলেন আপনি?
-হ্যাঁ।
–ডাকগাড়িতে আর যাত্রী ছিল?
–দু’জন ছিল।
–তারা রাত্রির ভিতরেই রাস্তায় নেমে গিয়েছিল?
–গিয়েছিল।
–এই আসামী কি সেই দু’জনের ভিতর একজন? দেখে বলুন।
–বলা সম্ভব নয়। তারা দুজনেই এভাবে কাপড়-চোপড়ে ঢাকা ছিল, আর রাত্রি ছিল এমন অন্ধকার যে কারো মুখ বা আকৃতি কিছুমাত্র দেখতে পাইনি আমি।
–এ আসামীর সঙ্গে তাদের কারও কোন সাদৃশ্য ছিল না, এমন কথাও তো জোর করে বলতে পারেন না আপনি?
–তা পারি না।
–তাহলে এমনও হতে পারে যে, এ লোকটি ছিল সেদিন সে-গাড়িতে?
–তা হতেও পারে।
–এ আসামীকে আপনি দেখেছেন আগে?
–দেখেছি!
–কবে?
–ক্যালে থেকে আসবার সময়ে স্টীমারে। উনিও আসছিলেন।
–ক’টার সময়ে স্টীমারে উঠেছিল আসামী?
–রাত্রি বারোটার একটু পরে।
–অর্থাৎ, নিশুতি রাতে। ওসময়ে আর কেউ এসেছিল?
–না। উনি একাই এসেছিলেন।
–আপনি কি একা ভ্রমণ করছিলেন?
–আমার সঙ্গে দু’জন ছিলেন আরও। এক তরুণী মহিলা, এবং এক বৃদ্ধ। ভদ্রলোক। তারা এখানে উপস্থিত আছেন।
–ঐ সময় আসামীর সঙ্গে কোন কথা হয়েছিল আপনার?
–বিশেষ কিছু নয়।
সরকারী উকিল ডাকলেন–মিস্ ম্যানেট!
তরুণী মহিলাটি নিকটেই উপবিষ্ট ছিলেন, তার পিতার পাশে। সেইখানেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি, সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর পিতাও দাঁড়ালেন।
–কুমারী ম্যানেট! এই আসামীকে পূর্বে দেখেছেন কখনো?
–দেখেছি। যে স্টীমারের কথা আগের সাক্ষী এইমাত্র বললেন–সেই স্টীমারেই দেখেছি। মিস্টার লরীর সঙ্গিনী সেই মহিলা–আমিই।
–চ্যানেল পার হওয়ার সময়ে আসামীর সঙ্গে আপনার কোন আলাপ হয়েছিল–মিস্ ম্যানেট?
০০হয়েছিল।
–মনে করে বলুন তোকী কথা হয়েছিল!
–ভদ্রলোকটি যখন স্টীমারে উঠলেন—
–বলুন–আসামী।
–আচ্ছা। আসামী যখন স্টীমারে উঠলেন তখন খুব হাওয়া ছিল–ঝড়ের বেগে বইছিল হাওয়া। আমার পিতার স্বাস্থ্য তখন খুবই খারাপ ছিল। কীভাবে কোথায় তাঁকে রাখলে হাওয়া কম লাগবে তার গায়ে, সেই বিষয়ে দয়া করে উনি পরামর্শ দিয়েছিলেন আমায়। এইভাবেই আলাপের শুরু হয় তার সঙ্গে।
–উনি কি একা এসেছিলেন স্টীমারে?
–না, দু’জন ফরাসী ভদ্রলোক ছিলেন ওঁর সঙ্গে।
–কোন কাগজপত্রের আদান-প্রদান হয়েছিল কি–আসামী আর তাদের ভিতর?
–হ্যাঁ, তবে কী কাগজ, তা জানি না আমি।
–কী কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে আসামীর?
–উনি বলেছিলেন–খুব গোপনীয় কাজে উনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সে কাজ যে কী, তা প্রকাশ হয়ে পড়লে অনেক লোক বিপদে পড়ে যেতে পারে হয়তো। সেইজন্য উনি ভ্রমণ করছিলেন বেনামীতে। অনেকবার ফ্রান্স আর ইংলন্ডের মাঝে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে, এবং পরে আরও অনেকবার হয়তো ঘুরতে হবে, এ রকম কথাও বলেছিলেন তিনি।
–আমেরিকা সম্বন্ধে কিছু বলেছিল আসামী?
–আমেরিকার সঙ্গে ইংলন্ডের কলহ কী করে শুরু হল, তাই বলেছিলেন তিনি। তার মতে ইংলন্ডেরই অন্যায় ছিল এ কলহে। রহস্য করে তিনি একথাও বলেছিলেন যে, হয়তো ইতিহাসে জর্জ ওয়াশিংটনের নাম, রাজা তৃতীয় জর্জের সমানই গৌরব লাভ করবে একদিন। তবে কথাটা নিছক রহস্যই, আমাদের মহান্ রাজাকে খেলো করবার উদ্দেশ্য ওর ভিতর ছিল না মোটেই।
এইভাবে সাক্ষ্য দিতে, কুমারী ম্যানেট যে খুবই দুঃখ অনুভব করছেন, তা আদালত কক্ষে উপস্থিত অগণিত লোক কারুরই বুঝতে বাকি ছিল না। সত্যিই দুঃখের কারণ ছিল কুমারীর। ডার্নে যেরকম ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন জাহাজের উপর, তাতে তার কাছে কুমারী কৃতজ্ঞ হয়েই আছেন। অথচ সত্যের খাতিরে যে-কথা তাকে এখন বলতে হচ্ছে আদালতে, তা হয়ত জুরীর বিচারে ডানের বিরুদ্ধেই যাবে। ডার্নের যদি মৃত্যুদণ্ডই হয়, তবে তার জন্য কুমারী ম্যানেটকেও খানিকটা নিমিত্তের ভাগী হতে হবে বই কি!
অতঃপর সরকারী উকিল এই মহিলার পিতাকে সাক্ষ্য দিতে আহ্বান করলেন। ডাক পড়লো’ডাক্তার ম্যানেট!
–ডাক্তার ম্যানেট, এই আসামীকে দেখুন। পূর্বে একে দেখেছেন কখনো?
–একবার আমার লন্ডনের বাসায় এসেছিলেন উনি। তিন বা সাড়ে তিন বৎসর আগে।
–সীমারে একে দেখেছিলেন আপনি? আপনার কন্যার সঙ্গে আসামীর যে আলাপ হয়েছিল সেই স্টীমারে–তা শুনেছিলেন আপনি?
–আমি এ-সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারি না মহাশয়।
–না পিরবার কোন বিশেষ কারণ আছে কি?
–আছে।–অত্যন্ত নিম্নস্বরে এই কথা বললেন ম্যানেট।
–বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আপনাকে কি কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল স্বদেশে?
–দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ দিন!–এমন করুণ সুরে ম্যানেট এই কথা বললেন যে, উপস্থিত সমস্ত লোকের হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠলো তা শুনে।
–আপনি কি ঐ স্টীমারে উঠবার অল্পদিন আগে মুক্ত হয়েছিলেন–সেই কারাবাস থেকে?
–তাই শুনেছি বটে।
–আপনার কি সে-কথা কিছুই মনে নেই?
–কিছু না। কারাগারে কবরস্থ হবার কিছুদিন পরেই আমার স্মৃতি, বুদ্ধি, চৈত্য সবই লোপ পায়। আমার মাথা এবং মন তখন ছিল একেবারে শূন্য। সে সময় আমি জুতো সেলাই করতাম কেবল। নিজের এবং পৃথিবীর সম্বন্ধে আমি আবার সচেতন হয়ে উঠলাম, লন্ডনে আসবার পর, আমার এই কন্যার সেবায় ও সাহচর্যে। আমার মানসিক শক্তি ফিরে পাবার কত দিন আগে থেকে যে কন্যার সেই সেবা ও সাহচর্য আমি পাচ্ছিলাম–সে-সব কিছুই মনে নেই আমার।
সরকারী উকিল এইবার আর-একজন সাক্ষী ডাকলেন। সে লোকটির বক্তব্য এইরকম :
পাঁচ বৎসর আগে নভেম্বর মাসের এক শুক্রবার রাত্রে ডোভার-মেলের অনেক যাত্রীর ভিতর আসামী ছিল একজন। পথের কোন এক স্থানে সে নামে। তারপর মাইল-বারা পথ সে ফিরে আসে পায়ে হেঁটে, পুলিশের চোখে ধূলো দেবার জন্য। ফিরে আসে এক শহরে যার অতি নিকটে রয়েছে রাজার এক বৃহৎ সেনানিবাস। সেখানে এসে সেনানিবাসের খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করে সে। এই সময়ে এক হোটেলে সাক্ষী তাকে দেখতে পায়। জীবনে সেই একবারই দেখেছে আসামীকে; এই আসামী যে সেই ব্যক্তি, তাতে সাক্ষীর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
এ সাক্ষী সত্যই বিপদ ঘটাবে। আসামীর উকিল জেরা করেও ওর কোন গলদ এ টেল অব টু সিটীজ। বার করতে পারছেন না। এমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটলো।
আসামীর উকিলের নিকটেই আর-একজন উকিল ছাদের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন গোড়া থেকে, এ-কথা আগেই বলা হয়েছে। এই ভদ্রলোক হঠাৎ এক টুকরো কাগজে কি লিখে আসামীর উকিলকে ছুঁড়ে মারলেন। তিনি সে কাগজ পড়ে এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন একবার আসামীর মুখের দিকে, আর একবার সেই পত্ৰলেখক উকিল বন্ধুর দিকে! এইবার তিনি প্রশ্ন করলেন সাক্ষীকে
–তুমি সেই হোটেলে যাকে দেখেছিলে, সে যে এই আসামী, এ-কথা তুমি শপথ করে বলছো?
–অবশ্য।
–আসামীর সঙ্গে চেহারায় হুবহু মিল আছে, এমন কোন লোককে তুমি দেখেছো
কখনো?
–এমন মিল কারো দেখিনি–যাতে লোক ভুল হবে, মশাই!
–ঐ যে উকিল ভদ্রলোক বসে আছেন ছাদের দিকে তাকিয়ে, ওঁকে দেখ তো একবার! তারপর আসামীকে দেখ আবার! কী বলল এখন? একজনকে দেখে আর-একজন বলে ভুল হতে পারে কি?
উকিলের এই অদ্ভুত অনুরোধে শুধু সাক্ষী কেন, আদালতসুদ্ধ লোক বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। একজনকে দেখে আর-একজন বলে ভুল! ওরা কি যমজ ভাই। নাকি?–জজ, জুরী, উকিল, পুলিশ, শত-শত দর্শক–সবাই দম বন্ধ করে তাকাতে লাগলো–একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে। জজের আদেশে উকিল ভদ্রলোক মাথায় পরচুলা খুলে ফেলে দিলেন। এইবার আর কারোই সন্দেহ রইল না যে, একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে, দু’জনের মুখের চেহারায়। আসামী হয়তো একটু বেশি সংযত ও গম্ভীর, উকিল-লোকটির মুখে-চোখে হয়তো অসংযত জীবন যাপনের দরুন দু’চারটে বাড়তি রেখাপাত হয়েছে এখানে-ওখানে, কিন্তু মোটামুটি সাদৃশ্য অতিশয় প্রবল। যে-লোক এঁদের দুজনকেই খুব ভালরকম চেনে না, তার চোখে দু’জনের চেহারার ঐ অতি সামান্য পার্থক্যটুকু দিনের আলোতেও ধরা পড়া সম্ভব নয়।
“তাহলে কি মিস্টার কার্টনকেই এখন রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করতে বলছেন নাকি?” জজ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন আসামীর উকিলকে।
কার্টন হল ঐ উকিল-ভদ্রলোকের নাম, আসামীর সঙ্গে যাঁর চেহারার মিল মামলাটিকেই বানচাল করে দিতে বসেছে।
কার্টনকে অভিযুক্ত করার অভিসন্ধি কারোই ছিল না, কিন্তু ডার্নের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ যা-কিছু ছিল, তার অর্ধেকই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল। জুরীরা অনেক বিবেচনা এ টে অব টু সিটীজ ও বিতর্কের পরে রায় দিতে বাধ্য হলেন যে, আসামীকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করবার মত জোরালো প্রমাণ কিছুই পাওয়া যায়নি। অগত্যা জজ ডার্নেকে মুক্ত করে দিতে আদেশ দিলেন, ঘোর অনিচ্ছায়। অনিচ্ছা এইজন্য যে, জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে ডানের উচ্চ ধারণা ভয়ানক চটিয়ে দিয়েছে রাজভক্ত জজ বাহাদুরকে। কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ তার বিরুদ্ধে থাক বা না-থাক, ডার্নেকে দণ্ড দিতে পারলেই তিনি খুশি হতেন।
ডার্নে মুক্ত হলেন, এবং সেই থেকে ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে তার আত্মীয়তা গাঢ়তর হয়ে উঠলো। মামলার কালে লুসী ম্যানেট ও তাঁর পিতা ডানের উপর যে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, তার দরুন ডার্নে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে রইলেন তাদের কাছে।
ওদিকে একান্ত অপরিচিত মাতাল যুবক সিডনী কার্টনও এই সূত্রে পরিচিত হয়ে উঠলো ম্যানেট-পরিবারের সঙ্গে। ডার্নের সঙ্গে তার চেহারার মিল সকলেরই একটা বিস্ময়ের বস্তু হয়ে রইলো!
এই মিল যে ওদের সকলেরই জীবনের উপরে কতখানি ছায়াপাত করবে ভবিষ্যৎ-জীবনে, সে-কথা কিন্তু তখন কেউ বুঝতে পারেনি।