২. ডিফার্জের দোকানে
প্যারী মহানগরীর এক গরিব পাড়া–সেন্ট আন্টইন। তারই এক রাস্তার ধারে ডিফার্জের মদের দোকান। দোকানের সামনে প্রকাণ্ড একটা মদের পিপে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। মদের স্রোত বইছে রাস্তায়। লাল মদে রাস্তাটা যেন রক্তনদী হয়ে গিয়েছে। অবশ্য, এমন দিনও এসেছিল দু’দিন পরেই, যখন সেন্ট আন্টইনের ঐ রাস্তা দিয়ে বাস্তবিকই বয়ে গিয়েছিল সত্যিকার রক্তের স্রোত। কিন্তু সে-কথা পরে।
আজ কিন্তু বিনা পয়সায় মদ খাওয়ার এই সুযোগ পেয়ে পল্লীর নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সবাই, তা আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে। উঁচু-নিচু পাথরের রাস্তার ছোট-বড় গর্তগুলি মদের চৌবাচ্চায় পরিণত হয়েছে। তা থেকে আঁজলা ভরে-ভরে পান করেছে ওরা সাধ মিটিয়ে। কেউবা পেয়ালা ভর্তি করে ঢালছে বালতির ভিতর, কেউ আবার রুমাল ভিজিয়ে তাই নিংড়ে দিচ্ছে শিশুর মুখে। একটা উৎসব চলেছে যেন পাড়ার ভিতর। ছুটোছুটি, হাসাহাসি,নাচতেও শুরু করেছে কেউ-কেউ হাত ধরাধরি করে।
দোকানের দোরে দাঁড়িয়ে ডিফার্জ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাড়ার লোকদের এই মাতামাতি। পিপে ভেঙেছে, সেটা আড়তদারের লোকসান, ডিফার্জের নয়। তাই এত বড় লোকসান দেখেও সে বিচলিত হয়নি। সে বরং খুশিই হয়েছে এতে। পাড়ার গরিবেরা একটু আনন্দ পায় যদি তো পাক না। পয়সা দিয়ে খাবার মত অবস্থা তো ওদের নয়।
অবশেষে রাস্তার গর্তে মদ আর যখন রইলো না, সেই সময় আধা-মাতাল একটা নোংরা চেহারার লোক আঙুলের ডগায় একটুখানি মদ লাগিয়ে পাশের বাড়ির দেয়ালের গায়ে লিখলো
“রক্ত! রক্ত!”
লেখাটা চোখে পড়া মাত্র ধীর শান্ত ডিফার্জ হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল সেখানে। হাতে করে কাদা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘষে দিলো ঐ লেখার উপরে। তারপর লেখকের জামার উপরে নিজের কাদা-মাখা হাতখানা মুছতে-মুছতে তিরস্কার করে উঠলো–এ-সব রসিকতা করবার জায়গা কি রাস্তার উপরে, গ্যাসপার্ড? তোমায় দেখছি পাগলা গারদে পাঠানোর দরকার।
গ্যাসপার্ড হেসে ডিগবাজি খেতে-খেতে চলে গেল। ডিফার্জও ঢুকলো নিজের দোকানে। সেখানে বসে দোকানের তদ্বির করছে তার স্ত্রী মাদাম ডিফার্জ।
মাদাম ডিফার্জ সর্বদাই তার সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। চোখ তুলে চাইবার অবসর নেই কোনদিকে। সেই সেলাইয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে কেউ লক্ষ্য করতে যদি, চক্ষুস্থির হয়ে যেতো তার। নানা রঙের সুতোয় কাপড়ের ভাঁজে-ভাঁজে শুধু নাম লেখা! হাজারো নাম! কাদের এ সব নাম, কে জানে তা!
স্বামীকে দেখে একটিবার মাত্র একটুখানি কাশতে শোনা গেল মাদাম ডিফার্জকে। স্বামীর মনে হলো–কেউ অপরিচিত ব্যক্তি এসেছে হয়তো, তা নইলে এমনভাবে অসময়ে কাশতো না তার স্ত্রী। সে খরিদ্দারদের ভিড়ের ভিতর মিশে গেল।
.
কেউ বসে আছে মদের গেলাস নিয়ে। কোথাও-বা দুই বন্ধু মিলে ডোমিনো খেলতে বসেছে। মাথা নেড়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানালো ডিফার্জ, মাথা নেড়েই গ্রহণ করলো সবাইয়ের সম্ভাষণ। এক জায়গায় তিনজন লোক দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে কথা বলছিলো, গেলাস হাতে নিয়ে।
একজন বলছিলো–রাস্তার মদটা বোধ হয় সবই উদরস্থ করেছে পাড়ার লোকে, কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–হ্যাঁ, আর এক ফোঁটাও নেই জ্যাক্স্!
তিনমূর্তির ভিতর দ্বিতীয় বললো কালো রুটি খেয়ে-খেয়েই জীবন কাটে এদের! মদ তো বড় একটা পায় না খেতে…কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–ঠিকই বলেছো জ্যাক্স্!
তৃতীয় ব্যক্তি এবারে বললো–যা হোক তবু মুখ বদলাবার একটা সুযোগ পেলো আজ এই অভাগার দল। ঠিক কথা কি না..জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–তা ঠিক বইকি, জ্যাক্স্।
তিন-তিনবার এই একই নামের আদান-প্রদান মাদাম ডিফার্জের মনোযোগ এড়ায়নি। প্রতিবারই ঈষৎ কুঁচকে উঠেছে তার ভ্র, আর, প্রতিবারই একটুখানি কেশেছে সে। ডিফার্জ তখন তোক তিনটিকে পরিচিত করে দিলো তার স্ত্রীর সঙ্গে। মাদাম ডিফার্জ একটুখানি মাথা নামিয়ে গ্রহণ করলো তাদের নমস্কার, আর সঙ্গে সঙ্গে চকিত দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো একবার লোক তিনটিকে। তার সেলাই কিন্তু একটুও থামলো না, সমান ভাবেই চলতে লাগলো।
ডিফার্জ লোক তিনটিকে বললো–হ্যাঁ! যে ঘরখানা তোমরা দেখতে চাইছিলে, তা ছ’তলার উপর। সোজা উপরে উঠে গেলেই দেখতে পাবে।
মদের দাম চুকিয়ে দিয়ে ওরা উপরে উঠে গেল। ওরা চলে যেতেই একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক পিছনের বেঞ্চ থেকে উঠে এসে ডিফার্জকে বললেন–আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
ডিফার্জ বললো–নিশ্চয়!
এক মিনিটের বেশি কথা হল না। প্রথম শব্দটি শুনেই চমকে উঠেছিল ডিফার্জ, তারপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সে শুনলো ভদ্রলোকের কথাটি, শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দোকানের একদিকে বেঞ্চের উপর বছর-সতেরো বয়সের একটি তরুণী বসে ছিলেন। তাকে ডেকে নিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিও বেরিয়ে গেলেন ডিফার্জের পিছনে পিছনে। মাদাম ডিফার্জ তখন আপন মনে সেলাই করে চলেছে…সে কিছুই দেখতে পেলো না বোধ হয়।
অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে। ধীরে-ধীরে ওঠাই ভালো!–ডিফার্জ বেশ বিরক্ত সুরেই বললো কথাগুলো। তার পিছনে-পিছনে মিঃ লরী উঠছেন কুমারী ম্যানেটকে নিয়ে।
মিঃ লরী ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন–উনি কি একা?
ডিফার্জ বললো-একা ছাড়া তার কাছে কে থাকবে?
–সর্বদাই একা থাকেন তিনি?
–একা তো থাকেনই–তা ছাড়া সব সময় দরজা বন্ধ করে থাকেন…দীর্ঘ দিন কারাগারের খুপরিতে বন্দী থাকতে-থাকতে তার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, খোলা দরজা তিনি সহ্য করতে পারেন না!
–কিছু পরিবর্তন হয়নি?
–যেদিন প্রথম ব্যাস্টিলের লোক এসে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেল ওঁকে, সেদিন যে-রকম দেখেছি ওঁর অবস্থা, আজও অবিকল তেমনি।
–খুবই বদলে গেছেন কি তিনি?
–বদলে? ভয়ানক একটা অস্বাভাবিক স্বরে ডিফার্জ বলে উঠলো কথাটা; আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা ভীষণ শপথ উচ্চারণ করে দেয়ালে মারলো একটা ঘুষি। মিঃ লরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না–মঁসিয়ে ম্যানেটের পরিবর্তনের রকমটা কী সাংঘাতিক।
সিঁড়ির মাঝপথে দু’বার বিশ্রামের জন্য থেমে, অবশেষে ওঁরা এসে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছুলেন। সেখান থেকেও আবার একটা সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো একটা চিলে কুঠুরিতে। তার দোর তালাবন্ধ। আর, দোরের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সেই তিনটি জ্যাস, একটু আগে যাদের কথা কইতে দেখা গিয়েছিল ডিফার্জের সঙ্গে। ডিফার্জের পিছনে দু’জন অপরিচিত লোক দেখে ওরা তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে নেমে চলে গেল। মিঃ লরী রুষ্টভাবে ডিফার্জকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কি লোক ডেকে-ডেকে আনো নাকি মঁসিয়ে ম্যানেটকে দেখবার জন্য?
ডিফার্জ উত্তর করলো–বিশেষ-বিশেষ লোককে আনি বৈকি ওঁর অবস্থা দেখবার জন্য।
–বিশেষ্য-বিশেষ? কী রকম?–প্রশ্ন করলেন মিঃ লরী।
— বিশেষ লোক, অর্থাৎ তাদের নাম হবে জ্যাক্স্, আমারই মত। আপনি ইংরেজ, ওসব বুঝবেন না। ফরাসীদেশের পক্ষে কী যে এখন প্রয়োজন, তা আমার চেয়ে আপনার ভালো জানবার কথা নয়!–এই কথা বলেই আর উত্তরের অপেক্ষা না । করে দরজার উপর জোরে জোরে বার কয়েক আঘাত করলো ডিফার্জ। যেন, ঘরের ভিতরকার লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় সে এইভাবে। তারপর সে তালা খুলে ফেললো। ঘরের ভিতরে এগিয়ে গিয়ে কী-যেন একটা কথা বললো সে। অতি ক্ষীণ স্বরে একটা উত্তরও শোনা গেল সে-কথার। মিঃ লরী প্রবেশ করলেন, লুসী ম্যানেটকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন, নইলে লুসীর পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না হয়তো।
লুসী বললো–আমার ভয় করছে!
মিঃ লরী বললেন–ভয় কি? কিসের ভয়?
লুসী কানে-কানে বলে–কি জানি, কি দেখবো।
ঘরখানা একেবারে ছোট এবং অন্ধকার। এক দিকের একটা জানলা দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে ভিতরে। ভালো করে জানলা খুলে দিলে আরও আলো আসতে পারতো অবশ্য, কিন্তু তা খোলা হয়নি। হয়তো এ-ঘরের অধিবাসীর চোখে বেশি আলো সহ্য হয় না বলেই।
সেই সামান্য আলোতে একখানা নিচু বেঞ্চিতে বসে এক পকেশ বৃদ্ধ আপন মনে জুতো সেলাই করছে।
ডিফার্জ বললো–সুপ্রভাত!
বৃদ্ধের মাথাটা এক সেকেন্ডের জন্য একটুখানি উঁচু হল, তারপর তার অতি ক্ষীণস্বর ভেসে এলো যেন অতি দূর থেকে–সুপ্রভাত!
–খুবই পরিশ্রম করছেন তো?–বললো ডিফার্জ।
অনেকক্ষণ কোন উত্তর নাই। অবশেষে আর-একবার সেই নতমস্তক উঁচু হল– এক সেকেন্ডের জন্য, এবং সেই স্বর আবার শোনা গেল-হা, আমি কাজ করছি! এবারে দুটি ঘোলাটে কোটরগত চক্ষু এক মুহূর্তের জন্য চেয়ে দেখলো-ডিফার্জের দিকে। তারপরে আবার নুয়ে পড়লো জুতো সেলাইয়ের উপর।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ডিফার্জ বললো–আর একটু বেশি করে খুলে দিতে চাই এই জানলাটা, বেশি আলোতে আপনার অসুবিধে হবে কি?
–কী বলছো?
–আর একটু আলো সহ্য করতে পারবেন কি?
–আলো আনো যদি, আমায় সহ্য করতেই হবে!–শেষ দু’টি কথার উপরে। আপনা থেকেই যে জোর পড়লো একটু, তা বোধ হয় বৃদ্ধ বুঝতেই পারলেন না। জানলাটা আর-একটু বেশি করে খুলে দিলো ডিফার্জ। অমনি জোরালো আলোর ঝলকে ঘর ভরে উঠলো। সেই আলোয় এইবার গৃহের বাসিন্দাটিকে বেশ ভালো ভাবে লক্ষ্য করা সম্ভব হল। অর্ধেকটা-সেলাই-করা একটা জুতো কোলে নিয়ে তিনি বসে আছেন। বেশি আলো তিনি অনেকদিন চোখে দেখেননি। হঠাৎ সেই বেশি আলোর ভিতর পড়ে তার চোখ জ্বালা করছিল বোধ হয়, তাই একখানা হাত আড়াল করে ধরেছেন চোখের উপর। জুতা-সেলাইয়ের কিছু যন্ত্রপাতি এবং কয়েক টুকরো চামড়া পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। সাদা দাড়ি যেমন-তেমন করে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। শীর্ণ কপালের নিচে অতিরিক্ত রকম বড় দুটো চোখ। একে তো সে চোখ স্বভাবতই বড়, তার উপর মুখের শীর্ণতা আর মাথার এলোমেলো চুলের রাশ এ-দুয়ের দরুন আরো বেশি বড়ো দেখাচ্ছে। জামা-কাপড় শত জায়গায় ছেঁড়া। শার্টের গলা খোলা; তার নিচে থেকে বুকের হাড়-পাঁজর গুনে নেওয়া যায়। তার গায়ের চামড়া, পরিধানের কাপড়, পায়ের মোজা–এ-সবেতে রৌদ্র-বাতাস লাগেনি বহুদিন; সবই বিশ্রী রকমের নোংরা আর হলদে হয়ে গেছে–কোষ্টা চামড়া আর কোন্টা কাপড়–তা চিনে বার করা শক্ত।
যে-হাতখানি দিয়ে আলো আড়াল করেছিলেন বৃদ্ধ, তার হাড় পর্যন্ত যেন স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল সেই আলোর ভিতর। কাজ বন্ধ করে একদম চুপচাপ তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, লক্ষ্যহীন দৃষ্টি তার চোখে। কথা শুনলে কোন্দিকে তাকাতে হবে, তা যেন হঠাৎ ঠাহর পান না তিনি! একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে চোখ ফিরিয়ে খুঁজতে থাকেন–শব্দটা এলো কোথা থেকে!
ডিফার্জ বললো–আপনি কি ঐ জুতো জোড়া আজই শেষ করতে চান? প্রশ্ন করেই সে মিঃ লরীকে ইশারা করলো কাছে আসবার জন্য।
–কী বললে তুমি?
–জুতোটা কি আজই শেষ করতে চান?
–না, শেষ করতেই চাই–এমন কিছু নয়। তবে হয়ে যেতে পারে। এই বলে তিনি আবার কাজে হাত দিলেন।
মিঃ লরী ধীরে-ধীরে এগিয়ে এলেন। কুমারী ম্যানেট দরজার পাশেই অপেক্ষা করতে লাগলো। মিঃ লরী ডিফার্জের পাশে এসে দাঁড়াবার মিনিট-দুই পরে বৃদ্ধ আবার মুখ তুলে চাইলেন। একজন লোকের জায়গায় দু’জন দেখেও কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করলেন না তিনি, একবার কেবল তার হাতের আঙুল উঠলো গিয়ে ঠোঁটের কাছে। আঙুল এবং ঠোঁট দুই-ই বর্ণহীন ফ্যাকাসে।
ডিফার্জ বললো–আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।
–কী বললে?
–একটি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।
জুতোর উপর থেকে চোখ একবার উপরে উঠলো বটে, একপলকের জন্য, হাত কিন্তু কাজ করতেই থাকলো।
ডিফার্জ বললো-জুতোটা ভদ্রলোককে দেখান না! ঠিক হচ্ছে কি না, বলতে পারবেন ইনি! এই বলেই সে জুতোটা তুলে নিয়ে লরীর হাতে দিয়ে আবার বললো–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না ভদ্রলোককে!
এবারে একেবারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধ নীরব, তারপর উত্তর হলো–কী তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, ভুলে যাচ্ছি আমি।…কী বলছিলে?
–আমি বলছিলাম–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না এঁকে!
–এটা মেয়েদের জুতো। তরুণীদের বেড়াবার জুতো, আজকালকার ফ্যাশান এইরকমই। ও ফ্যাশান আমি কখনো চোখে দেখিনি, তবে একটা নমুনা দেখেছিলাম।
ডিফার্জ বললো–যিনি তৈরি করছিলেন, তার নামও জানতে চান এই ভদ্রলোক।
হাতে জুতো নেই, একবার ডান হাতের কব্জি বাঁ হাতে, এবং বাঁ হাতের কব্জি ডান হাতে নিয়ে যেন নাড়ী টিপতে লাগলেন বৃদ্ধ। তারপর গালের দাড়িতে বুলোতে লাগলেন হাত…এক মুহূর্ত বিরাম নেই তার। মনটা ভরে আছে আঁধারে, দীর্ঘ দিনের জমাট আঁধার। ডিফার্জের কথা বিজলীর ঝিলিকের মত সে-আঁধার এক একবার চিরে দিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পরের মুহূর্তেই সারা অন্তর আগের মতই জমাট অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আবার। তাকে সেখান থেকে তুলে আনা সহজ নয়। দুর্বল রোগী যখন মূর্ছা যায়, তখন তার চেতনা ফিরিয়ে আনা শক্ত। যে লোক মরতে বসেছে, সংসারের খুঁটিনাটির ব্যাপারে তার আগ্রহ ক্ষণিকের জন্য জাগিয়ে তোলা আরও শক্ত। কিন্তু ও সবের চাইতেও বুঝি শক্ত এই সব-ভুলে-যাওয়া বৃদ্ধের মনে স্মৃতি জাগিয়ে তোলা। অন্তত মিঃ লরীর তো তাই মনে হল।
কিন্তু যতই শক্ত হক, সেই চেষ্টাই তবু করতে হবে এখন ডিফার্জ, মিঃ লরী আর লুসী ম্যানেটকে।
ডিফার্জ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে–ভদ্রলোকেরা আপনার নামটা জানতে চাইছেন।
বৃদ্ধ নীরব। ডিফার্জ তখন আবার জিজ্ঞাসা করে।
–আমার নাম…আমার নাম হলো ১০৫, নর্থ টাওয়ার।
–সে কি!
–হ্যা…১০৫, নর্থ টাওয়ার।
একটা ক্লান্তির শব্দ। দীর্ঘশ্বাস নয়, কাতর কোন উক্তি নয়! দেহ-মন যে একটা দারুণ ক্লান্তির ভারে ভেঙে পড়েছে, বাইরে তারই একটুকুন একটা প্রকাশ ছোট্ট একটা অস্পষ্ট শব্দের ভিতর দিয়ে! শব্দটা বেরুলো মুখ থেকে। তারপরই আবার কাজ শুরু। কিন্তু তার মনোযোগ আবার ভঙ্গ হল, এবারে ডিফার্জের কথা নয়, প্রশ্ন এলো মিঃ লরীর কাছ থেকে।
–আপনি কি চিরদিনই জুতো তৈরি করছেন?
ঘোলাটে দুটো চোখ একবার তাকালো ডিফার্জের দিকে, যেন ডিফার্জকে বলতে চায়–এ প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও। কিন্তু ডিফার্জ নীরব। তখন বৃদ্ধের দৃষ্টি মিঃ লরীর দিকে ফিরলো।
–আমি চিরদিন জুতো তৈরি করছি কি না? না, তা করিনি। এ আমি এখানেই শিখেছি। নিজে নিজেই শিখেছি। শিখবার অনুমতি অবশ্য নিয়েছিলাম আমি–
বলতে-বলতেই আবার ডান হাতে বাঁ হাতের কব্জি, বাঁ হাতের ভিতর ডান হাতের কব্জি–আর দাড়িতে হাত বুলোনো। তারপর দৃষ্টি আবার পড়লো এসে মিঃ লরীর মুখের উপর। এক-পলক সে মুখখানি দেখে নিয়ে হঠাৎই যেন চমকে উঠলেন বৃদ্ধ, মনে পড়ে গেল মিঃ লরীর প্রশ্ন, আর সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে তার থেমে যাওয়া। কী-যেন গল্প তিনি রাত্রিবেলা বলতে শুরু করেছিলেন; বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর জেগে উঠলেন ভোরবেলায়, আর জেগে উঠেই সেই অর্ধেক-বলা গল্পের খেই ধরে নতুন করে বলতে শুরু করলেন–
–হ্যাঁ, আমি অনুমতি নিয়ে নিজে নিজেই শিখেছি এটা। অনেক দিনের চেষ্টায় একটু-একটু করে শিখতে হয়েছে। তারপর থেকে বরাবরই করছি এই কাজ। এই বলে বৃদ্ধ মিঃ লরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। একখানা জুতো তখনও মিঃ লরীর হাতেই রয়েছে। সেখানা ফিরে পাওয়ার জন্যই হাত বাড়ানো। জুতো ফেরত দিয়ে মিঃ লরী বললেন :
মঁসিয়ে ম্যানেট! আমায় কি একটুও মনে পড়ে না আপনার?
হাতের জুতো হাত থেকে পড়ে গেল বৃদ্ধের। প্রশ্নকর্তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বসে রইলেন তিনি।
ডিফার্জ তার হাতের উপর হাত রেখে বললো–মঁসিয়ে ম্যানেট, এই লোকটির কথা কি কিছুই মনে পড়ে না আপনার? ওঁকে দেখুন ভাল করে! কোন ব্যাঙ্কারকে নিতেন কি আপনি পুরোনো দিনে? কোন ব্যবসাকর্মের কথা মনে পড়ে–আগেকার পুরোনো দিনের? আপনার কোন আত্মীয়-স্বজনের কথা?
বহু, বহু বৎসরের নির্জন কারাকক্ষের বন্দী নীরবে স্থির নয়নে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন–একবার ডিফার্জকে, আর একবার মিঃ লরীকে–তাঁর স্মৃতিকে আড়াল করে, যে কালো কুয়াশার পর্দা ঝুলছে আজ বহু বৎসর ধরে, তা যেন হঠাৎ কোথায় একটুখানি ফাঁক হয়ে যায় এক লহমার জন্য। বহুদিনের মুছে-যাওয়া, নিবে-যাওয়া চেতনার ঝিলিক যেন কপালের মাঝখান থেকে একবার এক-মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠলো চকিত দীপ্তি নিয়ে। তারপরই সে আলোর উপর ঘনিয়ে এলো আবার বিস্মৃতির কালো মেঘ! ম্লান হয়ে গেল স্মৃতির সে ক্ষণিক আলো,–নিবে গেল, মুছে গেল তা একেবারে। গেল বটে, কিন্তু সে যে এসেছিল–তাতে সন্দেহ নেই। মিঃ লরীর আর কোন সন্দেহ নেই যে, ইনিই ডাক্তার ম্যানেট।
ডিফার্জ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো–আপনি কি চিনতে পেরেছেন ওঁকে?
–হ্যাঁ। এক মুহূর্তের জন্য। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু অবশে পেয়েছি দেখতে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও, পেয়েছি দেখতে সেই অতিপরিচিত মুখখানি। ইনিই ডাক্তার ম্যানেট!
সহসা কিন্তু তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ডিফার্জকে টেনে নিয়ে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড়ালেন সরে গিয়ে। লুসী ম্যানেট এসে চুপি-চুপি দাঁড়ালো তার হতভাগ্য কবর থেকে ফিরে পাওয়া পিতার পাশে। হাত বাড়ালে লুসীর হাত স্পর্শ করতে পারতো ম্যানেটের মাথা। তবু ম্যানেট একেবারেই জানতে পারেননি লুসীর উপস্থিতির কথা। নীরবে তিনি ঝুঁকে পড়েছেন সেলাইয়ের উপরে।
হঠাৎ বৃদ্ধের দরকার হল ছুরি। ছুরি খুঁজবার জন্য একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে তাকাতে লাগলেন তিনি। ও কি দেখা যায় এত কাছে? চমকে উঠলেন বৃদ্ধ। তিনি লুসীর বসনের একাংশ দেখতে পেয়েছেন!
হাতে ছুরি, চোখে পাগলের মত দৃষ্টি নিয়ে যে-ভাবে লুসীর পানে চাইতে লাগলেন বৃদ্ধ ম্যানেট, তাতে ডিফার্জ আর লরী ভয় পেয়ে ছুটে আসবার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই বুঝি হতভাগ্য উন্মাদ দেয় ওর বুকে ছুরি বসিয়ে! ভয়ে বুঝি লুসী অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু না, লুসীর আজ আর ভয় নেই। সে মিঃ লরী আর ডিফার্জের মতলব বুঝতে পেরেছে। সে হাত নেড়ে নিবারণ করলে ওঁদের। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে নিজের হস্ত চুম্বন করতে লাগলো সে, বারবার দুই হাত এনে বুকের উপর জড়িয়ে ধরতে লাগলো, যেন বৃদ্ধ পিতার শুষ্ক শিরই সে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের স্নেহকোমল বুকের উপরে। তার সে করুণ দৃষ্টির অর্থ পাগলের পক্ষেও ভুল বোঝা বা না-বোঝা অসম্ভব। কোন স্নেহের সম্ভাষণ তার মুখ থেকে উচ্চারিত না হলেও তার দু’টি ওষ্ঠ যেভাবে ফুলে ফুলে উঠছিল, তাতে পাগলকেও বুঝি বিচলিত হতে হল। অনেকক্ষণ ধরে লুসীর দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে বৃদ্ধ বলে উঠলেন–
০-তুমি-তুমি তো কারাধ্যক্ষের মেয়ে নও!
লুসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–না।
–কে তুমি তবে?
লুসীর সারা দেহ আবেগে কাঁপছিল…কথা বলবার শক্তি যেন তার ছিল না। কোন উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে সে বৃদ্ধের পাশে বসলো। বেঞ্চের উপরে। ভয়ে সংকোচে সরে যেতে চান বৃদ্ধ, কিন্তু লুসী বৃদ্ধের হাতের উপরে রাখলো নিজের হাত। সে-স্পর্শে হঠাৎ আশ্চর্যভাবে শিউরে উঠলো বৃদ্ধের সারা অঙ্গ, ধীরে হাতের ছুরি তিনি নামিয়ে রাখলেন পায়ের কাছে, তারপর বিস্মিত তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে তিনি চেয়ে রইলেন এই মমতাময়ী তরুণীর দিকে।
সোনালী রঙের এলো-চুল ছড়িয়ে পড়েছিল লুসীর কাঁধের উপর। একটু-একটু করে বৃদ্ধের হাত এগিয়ে যেতে লাগলো সেই দিকে। এক-গোছা চুল হাতে তুলে নিলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগলেন যেন!
আর থাকতে না পেরে লুসী নিজের কোমল উষ্ণ হাত দুখানি তুলে দিলো বৃদ্ধের কণ্ঠে। বৃদ্ধ সেদিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন। তারপর নিজের গলা থেকে খুলে নিলেন–নোংরা সূতায় ঝোলানো একটা ততোধিক নোংরা ছোট্ট পুঁটুলি। খুলতে লাগলেন সেই পুঁটুলি ধীরে-ধীরে কম্পিত হস্তে।
তার ভিতর থেকে বেরুলো একগাছা লম্বা চুল, লুসীর চুলের মতই উজ্জ্বল সোনালী, লুসীর চুলের মতই মসৃণ চিকণ! হারিয়ে গেছে তার যে অতীত জীবন, তারই এক কণা অবশেষ এই একগাছি চুল। সংসার গেছে, সম্পদ গেছে, ঘর গেছে, ঘরণী গেছে, শুধু হারিয়ে-যাওয়া সেই ঘরণীর একগাছি সোনালী চুল যায়নি শুধু তাই।
একবার সেই একগাছি সোনালী চুল, আর একবার লুসীর মাথার সোনালী চুলের গোছার দিকে বৃদ্ধ বারবার আকুল দৃষ্টিতে চান। তার মনের ভেতর অকস্মাৎ জেগে ওঠে স্মৃতির ক্ষীণ আলো। চিৎকার করে ওঠেন–এ তো সেই একই চুল! কী করে হল? কেমন করে? কেমন করে? কখন? কী এসব?
বৃদ্ধ সোজা উঠে দাঁড়িয়ে লুসীর মুখটা তুলে ধরে বলেন–কে তুমি? তুমি…তুমি কি সেই?
হাঁটু গেড়ে বৃদ্ধের সমুখে বসে পড়লো লুসী। আর্তকণ্ঠে বলে উঠলো–আমি তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ে। বাবা! বাবা! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
বৃদ্ধের দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অবিরল চোখের জল।