এ চোর সে চোর নয়
সে কালের রাজপুত্ররা বন্দিনি রাজকন্যাকে উদ্ধার করে আনতেন। সে তো অপহরণ নয়। অনেকের বইয়ের আলমারিতে ভালো ভালো বই যেন বন্দিনী রাজকন্যা। বছরের পর বছর কাচের ঘেরাটোপে অবরুদ্ধ। যাঁরা বই কেনেন শুধু মাত্র ড্রয়িংরুম সাজাবার জন্যে, তাঁদের হাত থেকে বই উদ্ধার করে আনা চুরি নয়, পবিত্র এক কর্তব্য। ছলে, বলে, কৌশলে ঝেঁপে নিয়ে এসো। কথাতেই আছে, বোকারা বই কেনে আর পড়ে বুদ্ধিমানে।
সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, বই চেয়ে নিয়ে ফেরত দিতে ভুলে যাওয়া। ইচ্ছাকৃত ভুল। এর মধ্যে একটু কৌশল আছে। বইপাগলের কাছ থেকে বই নিলে তাগাদা মেরে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেন। আগে মালিক চিনতে হবে। শৌখিন মালিক হলে, তাঁর আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, পছন্দমতো বইখানি বের বরে নিয়ে অন্য বইগুলো সরিয়ে সরিয়ে ফাঁকটা ভরাট করে দিতে হবে, তারপর বলতে হবে, এই বইটা আমি একটু পড়তে নিচ্ছি। সেই সঙ্গে একটু তোল্লাই মতো এমন কালেকশন আমি খুব কমই দেখেছি। এরপর, দিন যাবে, সাত দিন, এক মাস, এক বছর। আর ওমুখো নয়। ফাঁকটা ভরিয়ে আসার কারণ, যাতে ফাঁক দেখে বইটার কথা না মনে পড়ে যায়। এই ভাবে ধীরে ধীরে কায়দা করে বই সরাতে হয় না বলিয়া পরের দ্রব্য লওয়াকে বলা হয় চুরি। এ তো বলে নেওয়া, অতএব চুরি নয়। এর নাম বন্দিমুক্তি। ভার লাঘব করা। পোকায় কাটার চেয়ে অন্যে নিয়ে কেটে পড়ুক। সবাই জানেন মার্ক টোয়েনের সেই উক্তি, বই পড়ে আছে ডাঁই হয়ে। প্রশ্নকারীকে বললেন, বই যে-ভাবে এসেছে, সে-ভাবে তো বুকশেল্ফ, আসবে না। বই চুরি করা যায়, বইয়ের শেলফ তো চুরি করা যায় না। আমাদের দেশেই এমন অনেক নামি মানুষ ছিলেন, যাঁরা গ্রন্থাগার থেকে বই লুকিয়ে নিয়ে চলে আসতেন। নাম করব না। তাঁদের এই কর্মকাণ্ডের মরসুম ছিল শীতকাল। গায়ে একটি শাল চড়িয়ে, এ-র্যাক ও-র্যাক সে-র্যাকের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। নামি, বিদগ্ধ মানুষ। গ্রন্থাগারে পদার্পণ মানে ধন্য হয়ে যাওয়া। যখন বেড়িয়ে গেলেন শাল মুড়ি দিয়ে কিছু বইও সঙ্গের সঙ্গী হল। গ্রন্থাগারিকরা এঁদের চিনতেন, এখনও চেনেন, কিছু বলতে পারেন না। বলাটা অভদ্রতা। বইয়ের দোকান থেকে যাঁরা বই তোলেন, তাঁদের আমরা বলি, বুক লিফটার। শপ লিফটারদের মতোই সমান অপরাধী। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা এই চোরাই বই বিক্রি করেন না। অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে সামলাতে পারেন না নিজেকে। একজন মানুষকে যদি তাঁর সব ভালোবাসার বই কিনতে হয়, তাহলে তিনি দেউলে হয়ে যাবেন। অতএব সহজ উপায় মোহিত হয়ে তুলে নেওয়া, তারপর যা হয় দেখা যাবে। জ্ঞান যিনি চুরি করেন তিনি জ্ঞানের মর্ম বোঝেন। তিনিও জ্ঞানী।
একটি ঘটনা আমি জীবনে ভুলব না। এক সাধকের জীবনী জানার খুব প্রয়োজন হয়েছিল আমার। এক গবেষক পণ্ডিত আমাকে বললেন, জাতীয় গ্রন্থাগারে যাও, সেখানে একটি পাণ্ডুলিপি পাবে যথারীতি গ্রন্থাগারে গিয়ে অনুরোধ জানাতে, আমাকে বললেন, বসুন। বসে আছি। হঠাৎ দেখি আমাকে ঘিরে অনেকে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রথমে ভাবলুম, পাণ্ডুলিপি চাওয়ায়, সবাই বোধহয় আমাকে মহাজ্ঞানী ভেবেছেন, তাই দর্শন করতে এসেছেন। আমার ভুল ভাঙতে দেরি হল না। একজন রুক্ষভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে যে পাণ্ডুলিপিটা আছে আপনি জানলেন কী করে?’ অন্য সবাই কোরাসে বললেন, ‘বলুন, বলুন।’ বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। ব্যাপার সুবিধের নয়। কেঁউ কেঁউ করে বললুম, ‘কেন বলুন তো!’ ‘পাণ্ডুলিপি চুরি হয়ে গেছে আমাদের কালেকশান থেকে। যে আপনাকে পাঠিয়েছে সে-ই চোর। আপনাকে পাঠিয়েছে থেফট ডিটেকটেড হয়েছে কি না জানতে। নামটা আমরা জানতে চাই।’ ভদ্রলোক থানার বড় দারোগার মতো এক ধমক দিলেন, ‘কাম আউট উইথ দি নেম।’
জীবনে এমত অপদস্থ কখনও হইনি। ভদ্রলোকের নাম বলতে পারছি না। বলতে চাইছি না, আর কর্তৃপক্ষও ছাড়বেন না। সে প্রায় দাগি আসামিকে লালবাজার লক আপে কনফেশন আদায় করার মতো কেস। দুর্লভ পান্ডুলিপি কালেকশান থেকে চলে গেছে, সহজে ছাড়া পাই! শেষে নাম বলতেই হল। নাম শুনে তাঁরা হাঁ হয়ে গেলেন। তিনি যে ভীষণ নামি মানুষ! তাঁর বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই। সত্য মিথ্যা জানি না, সেই নামি মানুষটিকে অকারণে সন্দেহ করা হয়েছিল কি না তাও বলতে পারব না। তবে পাণ্ডুলিপি কালেকশান থেকে উধাও হয়েছিল, এটা সত্য। আর সেই সত্য হল, ছলে-বলে-কৌশলে, নিজের সঞ্চয়কে সমৃদ্ধ করো। প্রেমে আর রণে যেমন কোনও নীতি থাকে না, পরের বইকে নিজের করার ব্যাপারেও কোনও নীতি নেই। সুভদ্রাহরণ পালার মতো। ভালো লেগেছে মেরে দিয়েছি। বাংলায় আর একটি কথা আছে—বই আর বউ হাতছাড়া করেছ কী মরেছ।
আমার নিজের কথা বলি, বইয়ের ব্যাপারে আমার চরিত্র তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরের বইকে আমি নিজের মতো করেই দেখি। আত্মবৎ পরদ্রব্যেষু। লোষ্ট্রবৎ নয়। বই আমার কাছে, ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিক। আসবে কিন্তু ফিরবে না। অতিথি কী আশ্রিতাকে ফেরাতে নেই। আমার এক বন্ধুর বাড়ির আলমারি থেকে কয়েকখানা ছেঁড়া ছেঁড়া বই উদ্ধার করে আনলুম। অর্থাৎ পড়ার জন্যে চেয়ে আনলুম। পড়েই ফেরত দেব, ভাববেন না কিছু। তারপর আমার যা টেকনিক, ‘লাই লো।’ বেশ কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকো। দেখা যাক মালিকের তাগাদার বহরটা কেমন। তিন মাস পার হয়ে গেল। তখন বইগুলোকে বেশ খরচ করে বাঁধিয়ে, সোনার জলে নিজের নাম লিখিয়ে শেল্ফজাত করে ফেললুম। সাত বছর পরে হঠাৎ একদিন আমার সেই বন্ধু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন। দুজনেরই বয়স সাত বছর বেড়েছে। ছাত্র থেকে চাকুরে। বইগুলোর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। বন্ধু আমার আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই দেখছে। এটা টানছে, ওটা টানছে। হঠাৎ সে তিনখানা বই বের করে এনে বললে, ‘আশা করি তোমার পড়া হয়ে গেছে এতদিনে! এইবার আমি নিয়ে যেতে পারি নিশ্চয়!
আই হাঁ হয়ে গেলুম। এত খরচ করে বইগুলো বাঁধালুম। চামড়ার বাইন্ডিং। সোনার জলে লেখা। একেবারে ভোল পালটে দিয়েছিলুম। প্ল্যাস্টিক সার্জারি। একেবারে চেহারা বদলে দেওয়া। সেই ইনভেস্টমেন্ট এইভাবে বিফলে গেল। আমারি বঁধূয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া, এ যেন সেই ব্যাপার। বউ ডিভোর্স করে চলে যাচ্ছে, এই রকম একটা অনুভুতি।
আমার সেই মহা ধড়িবাজ বন্ধু বললে, ‘বুঝলে, একটু ধৈর্য, আর পরিশ্রম। বইগুলো কিছুকালের জন্যে হাতছাড়া হয়ে যায় ঠিকই, একটু হাঁটাহাঁটিও করতে হয়, কিন্তু অধিকাংশই ফিরে আসে নতুন করে। এই যেমন এল। বুঝলে, বই হল জ্ঞান। সেইজন্যেই বলে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। এতে ভুল করে তুমি তোমার নামটা লিখে ফেলেছ, তা, টু আর ইজ হিউম্যান, টু ফরগিভ ডিভাইন। কিছুই না, স্পিরিট দিয়ে নামটা মুছে ফেলব।’ সেই আমার শিক্ষা হয়েছিল, দাদারও দাদা আছে।