এ কী আজব গল্প – শৈলেন ঘোষ
আমি তোতা। আমার নাম শুনে হাসছ না কি? ভাবছ নাকি? আমি পাখি? না, না, আমি পাখি নই। আমি তোমাদেরই মতো, তোমাদেরই এক বন্ধু। আমি তোমাদেরই মতো ইস্কুলে পড়ি। বাড়িতে আমার মা আছেন, বাবা আছেন। আর আমি তো আছিই। মা ঘর—সংসার সামলান। বাবা ইস্কুলে পড়ান। আমি ওই ইস্কুলেরই ক্লাস এইটের ছাত্র। বাবা ইস্কুলে অঙ্ক শেখান। বুঝতেই পারছ বাবা খুব ভালো অঙ্ক জানেন। কিন্তু মজার কথা কী, আমার সব ভালো, ওই অঙ্কতেই যত আতঙ্ক। তার মানে এই নয়, আমি অঙ্ক বুঝি একেবারেই পারি না। পারি। কিন্তু বাবা যা চান ততটা আমি পারি না। সে আর কী করা! বাবা সেটা ভালোই জানেন। তাই চাপও বেশি দেন না। এমনকী আমার ওপর রাগও করেন না। আশ্চর্য কী, আমি বাবাকে কোনোদিনই কারও ওপর রাগ করতে দেখিনি। বাবা রাগতে জানেন না। তা—ই ইস্কুলে মাস্টারমশায়রা যেমন বাবাকে খুব পছন্দ করেন, তেমনই ছাত্ররাও ভালোবাসে। ছাত্ররা তো ভালোবাসবেই। কেন—না, বাবা প্রথমেই ক্লাসে ঢুকে চক—খড়ি দিয়ে বোর্ডে নানান সংখ্যা লিখে অঙ্কের ধাঁধায় কারও মনকে হারিয়ে যেতে দেন না। হ্যাঁ, তিনি অঙ্কও শেখান, তার সঙ্গে গল্পও বলেন। বাবা যে কত গল্প জানেন আমি শুনতে শুনতে হাঁ হয়ে যাই। আমি বাবার কাছেই শুনেছি, এই যে আমরা আজ এতসব ভোগের রসদ পাচ্ছি, এই যেমন ধরো টেলিভিশন থেকে হালফিল ফেসবুক পর্যন্ত, কিংবা ধরো ওয়াশিং মেশিন থেকে রেফ্রিজারেটার, অথবা রকেট ছুড়ে অন্য গ্রহের খবর সংগ্রহ, এর খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি বানাবার বুদ্ধিটা মানুষের মাথায় আসছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো গড়ছে কে? আমাদের হাত। আমাদের দু—হাতের দশটা আঙুল।
বটেই তো, তোমার শরীরে সব ঠিকঠাক আছে, অথচ দুটো হাত নেই! হাতের দশটা আঙুল নেই! কী হত তখন! ভাবলে ভয়ে ছমছম করে ওঠে বুকের ধুকধুকি। আরে বাবা মেশিন কি আর আঙুলের কাজ করতে পারে? তোমার বই—এর পাতা ওলটাবে কে? হাতের আঙুল। পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার কলম ধরবে কে? হাতের আঙুল। কম্পিউটারের মাউস ঘোরাবে কে? হাতের আঙুল। তোমার পিঠ সুড়সুড় করছে, কে চুলকোবে? সে—ও হাতের আঙুল। হাত আর হাতের আঙুল ছাড়া তোমার মুখে কি খাবারই উঠত?
যাকগে যাক, এসব কথা ছাড়ান দাও! বাবার মনে এমনতরো আরও কত যে গল্প জমা হয়ে আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। সে—সব গল্প বলতে গেলে আসলে আমার নিজের গল্পটাই বলা হবে না। সে এক সাংঘাতিক ঘটনা। সেই গল্পটাই বলি এবার।
সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবা আমায় সঙ্গে নিয়ে ইস্কুলে যেতেন। তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ছোটো ছিলুম বলে ছুটির পর ইস্কুল থেকে ফিরতুম বাবার সঙ্গে। এখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। বাবার সঙ্গে ইস্কুলে যাওয়ার সেই অভ্যেসটা এখন চালু আছে। তবে বড়ো হয়েছি বলে ইস্কুলের ছুটির পর এখন আর বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরি না। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে হই—হই করে বাড়ি ফিরি। অবশ্য, এ ব্যাপারে বাবা কোনো আপত্তি করেননি কোনোদিন। হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি থেকে ইস্কুলটা একটু দূরে। তবে, এমন নয় যে হাঁটতে হাঁটতে দম ছুটে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে হাঁটতে মজাই লাগে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যখন বন্ধুরা যে—যার নিজের বাড়ি পৌঁছে যায়, তখন আমি একেবারে একা হয়ে পড়ি। তখনও আমাদের বাড়ির গলিটার নাগাল পেতে আমাকে আরও মিনিট পাঁচেক মুখ বুজে পা ফেলতে হয়! আমাদের বাড়ির গলিটা বেশ নির্জন। এই বিকেলেও তেমন লোকজন দেখা যায় না। এই গলির মুখ থেকে আমাদের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। গলিতে ঢুকেই আমি ছুটি। রোজ ছুটে বাড়ি ফিরতে আমার খুব মজা লাগে। কিন্তু একদিন যে এক ভয়ানক বিপদ আমার জন্যে ওত পেতে লুকিয়েছিল, সেটা আমি ঘূণাক্ষরেও টের পাইনি।
রোজ যেমন হয়, সেদিনও তেমন ইস্কুলের ছুটির পর নিয়মমতো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরছি। একে একে বন্ধুরাও যে—যার বাড়ির রাস্তা ধরল। আমিও খানিক একলা হেঁটে আমাদের বাড়ির গলির মুখে পৌঁছে গেলুম। ওমা! গলিতে ঢুকতে যাব, হঠাৎ কী হল কে জানে, একটা লোক কোত্থেকে ছুটে এসে আমার নাকের কাছে একটা রুমাল নেড়ে দিল। একটা অসহ্য ঝাঁঝাল গন্ধ আমার নাকে ঢুকতেই—আমি আর কিছু জানি না। মানে, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
শুনলে অবাক হয়ে যাবে, কেমন করে, কবে কোথায় আমার জ্ঞান ফিরল আমি জানি না। আমি যে—ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি, মনে হল, যেন আমারই বিছানা। দেওয়ালে যে—ছবিটা টাঙানো, তাতে দেখছি আঁকা একটা বাড়িতে আগুন লেগে দাউ—দাউ করে জ্বলছে। দেখে, আমার কোনো হেলদোলই নেই। আমার যে একটা লোক আমার নাকে রুমাল ঠেকিয়ে, ঝাঁঝাল গন্ধ শুঁকিয়ে, আমাকে অজ্ঞান করে এখানে নিয়ে এসেছে, সেটা পর্যন্ত আমার মন থেকে উবে গেছে! এমনকী আমাদের যে একটা বাড়ি আছে, বাড়িতে আমার মা—বাবা আছেন, তা—ও আমার মন থেকে বিলকুল মুছে গেছে। আমার চোখে কিছুই উদ্ভট লাগছে না। মনেও কোনো ভয় নেই, চোখেও কোনো জল নেই। ভাবছ নিশ্চয়ই, কী আশ্চর্য! আশ্চর্যই বটে! কেন—না, আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি বেমালুম উঠে বসতে পারলুম। উঠে বসতেই একটা হোঁতকা মতো লোক আমার সামনে এসে আগডুম—বাগডুম কী যে বকছে, আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না। অথচ আমি যে তাকে দেখে, তার বকবকানি শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি, তেমনও নয়। উলটে আমি সিধেসাপটা তাকে বললুম, বেশ ঘুমিয়েছি।’
এবার সেই হোঁতকা লোকটা আগডুম—বাগডুম বকবকানি থামিয়ে স্পষ্ট বাংলায় বলল, ‘উঠে পড়ো। তাড়াতাড়ি মুখ হাত—পা ধুয়ে তৈরি হয়ে নে। যেতে হবে। কী খাবি? কালকের মতো আলুর চপ মুড়ি, না মামলেট—টোস্ট?’
তোমাদের খুব আশচর্য লাগলে আমি আর কী করব! সত্যি বলতে কী, আজ নয়, কালও যে আমার নিয়মমতো ঘুম ভেঙেছিল, কাল যে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি মুড়ি আলুর চপ খেয়েছি, একদম খেয়াল নেই। আসলে, কাল সারাদিন যে কী করেছি, আর আজ যে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে কোথায় যেতে হবে, তার একবর্ণও আমার জানা নেই। অথচ অবাক কথা, আমি লোকটাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলুম, ‘কাল যখন মুড়ি আলুর চপ খেয়েছি, আজ তবে মামলেট—টোস্টই হোক।’
তো, যেমন কথা, তেমনই মামলেট—টোস্টই খাওয়া হল। এবার কোথায় যাওয়া হবে তা তো জানি না।
‘নে, এই প্যান্টটা আর শার্টটা পরে নে।’ লোকটা অন্য আর একটা ঘর থেকে প্যান্ট—শার্টটা নিয়ে এসে আমায় দিলে। দেখে মনে হল নতুন আমি। চটপট পরেও ফেললুম। তারপর লোকটার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটা দিলুম। কোন রাস্তায় হাঁটছি, চেনা, না—অচেনা, হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছি, এসব নিয়ে কোনো দুর্ভাবনাই আমার মনে চেপে বসল না।
এরই ফাঁকে হঠাৎ কানে এল ক—টা কুকুরের বেদম চিৎকারের ডাক, ঘেউ—উ, ঘেউ—উ! পেছন ফিরে দেখি, একটা লোক যাচ্ছে, তার কাঁধে একটা বাঁদর বসে। আর তা—ই দেখে একদল কুকুর ঘেউ—উ ঘেউ—উz করে তার পিছু নিয়েছে। দেখে তো আমি হেসে মরি। লোকটার কিন্তু থোড়াই কেয়ার। দিব্যি নির্ভয়ে হেঁটে চলেছে! আমি যে হোঁতকা লোকটার সঙ্গে যাচ্ছিলুম, সে আমায় সাবধান করে বলল, ‘এই, চুপ! চুপ! অমন করে হাসিস না। কুকুরে কামড়ে দেবে!’
আমি থতমত খেয়ে মুখের হাসি থামিয়ে ফেললুম। কিন্তু বুঝতে পারলুম পেটের ভেতর হাসিটা দারুণ কিলবিল করছে। সেই হাসিটাকেই কোনো রকমে পেটের ভেতরই আটকে রেখে এগিয়ে চললুম।
আর একটুখানি হাঁটতেই কাঁধে—বাঁদর লোকটা একটা গলির পথে ঢুকল, আর আমরা যেমন সিধে পথে হাঁটছিলুম, তেমনই সিধে পথে চললুম। কিন্তু কুকুরগুলো আর লোকটার পিছু—পিছু গলিতে ঢুকল না। গলির মুখে কিছুক্ষণ ঘেউ—উ, ঘেউ—উ করে যে যার নিজের রাস্তা দেখল।
হোঁতকা লোকটা আমার কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর খুব মজা লেগেছে না?’
আমি উত্তর দিলুম, ‘মজা বলে মজা। দেখেছ, বাঁদরটা ওর কাঁধে বসে ল্যাজ দিয়ে গলাটা কেমন জড়িয়ে ধরে এদিক—ওদিক জুলজুল করে তাকাচ্ছিল।’
লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘বাঁদর দেখলে খুব মজা লাগে না?’
আমি বললুম, ‘মজা তো লাগেই, তার ওপরে ওদের রকমসকম দেখলে ভীষণ হাসি পায়।’
সে আবার বলল, ‘কত রকমের জন্তু আছে বল পৃথিবীতে!’
আমি উত্তর দিলুম, ‘আছেই তো। বাঘ—সিংহ থেকে শুরু করে…আমার কথা শেষ করতে না—দিয়ে, কথার মাঝখানেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘পৃথিবীতে এত যে জন্তু, তোর সবচেয়ে পছন্দ কোন জন্তু?’
আমি একনিশ্বাসে উত্তর দিলুম, ‘ঘোড়া।’
লোকটা একটু অবাকই হল। বলল, ‘সে কী রে! এত থাকতে ঘোড়া!’
আমি একটু হাসিমাখা মুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলুম।
লোকটি জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘ, সিংহ, হাতি, হরিণ—’
তাকে কথা শেষ করতে না—দিয়ে আমি উত্তর দিলুম, ‘ধুত! ঘোড়ার কাছে ওরা খোঁড়া।’
লোকটা এবার আমার কথা শুনে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘ধর, তোকে যদি এখন আমি একটা ঘোড়া উপহার দিই, তুই কী করবি?’
‘ঘোড়ার পিঠে বসব। বগল বাজিয়ে এদিক—ওদিক, যেদিকে খুশি ছুটে বেড়াব।’
সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তুই ঘোড়ার নাচ দেখেছিস কোনোদিন?’
আমি উত্তর দিলুম, ‘তা অবশ্য দেখিনি।’
‘দেখবি।’
‘দেখালে নিশ্চয়ই দেখব।’
‘তবে চ, তোকে ঘোড়ার নাচ দেখিয়ে আনি।’
আমি বললুম, ‘তাই চলো।’ বলে আনন্দে ডগমগ করতে করতে লোকটার সঙ্গে আমি ঘোড়ার নাচ দেখতে চললুম সেই সিধে রাস্তাটা ধরে।
তোমাদের বলব কী, সেই হোঁতকা লোকটা যেখানে আমায় নিয়ে এল, সেখানটা দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। কী যে এলাহি কাণ্ড চলছে সেখানে, কী বলব! অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা তাঁবু খাটানো। সেটা যেমন উঁচু, তেমনই পেল্লাই। চারপাশে লোক গিজগিজ করছে। সে বলল, ‘চল, ভেতরে যাব।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘এর ভেতরে ঘোড়ার নাচ হবে?’
সে বলল, ‘শুধু ঘোড়ার নাচ নয়, ভেতরে আরও অনেক কিছু হবে। সার্কাস হবে, সার্কাস।’
আমি ক্লাস এইটে পড়ি তখন, এ কথা তোমরা সবাই জানো। বাবা কতবার যে আমায় সার্কাসে নিয়ে গেছেন, সে আর নতুন করে কী বলব। কিন্তু এখন কোন জাদুবলে যে এই হোঁতকা লোকটা আমার মন থেকে সব লোপাট করে দিয়েছে, কে বলবে! তাই সার্কাসের নাম শুনে আমি হাঁদার মতো তার মুখের দিকে তাকালুম। সে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে চলল। ভেতর মানে যেখানে সার্কাস হয়, সেখানে নয়। একটা অন্য নিরিবিলি ঘরে। ঘরে ঢুকে দেখি, ছিমছাম পোশাক পরা একজন লোক চেয়ারে বসে টেবিলে কিছু কাগজপত্তর নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াতেই, সেই ছিমছাম পোশাক পরা লোকটি চমকে তাকিয়ে হোঁতকা লোকটিকে ডাক দিল, ‘আরে তুমি, এসো এসো!’
হোঁতকা লোকটা আমায় সঙ্গে নিয়েই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘এই যে, আপনার কথামতো এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছি। ছেলেটি বলছিল, ঘোড়ার পিঠে বসে ছোটাছুটি করতে ওর খুব ভালো লাগে।’
‘তাই নাকি! তবে তো ভালোই হল। এই রকমই একটি ছেলের এখন আমার খুব দরকার। যে—ছেলেটি এতদিন ঘোড়ার খেলা দেখাত সে হঠাৎ কাউকে কিছু না—বলে ছেড়েছুড়ে চলে গেছে। আমি পড়েছি বিপদে। আমি এখন ঘোড়ার খেলাই দেখাতে পারছি না। তুমি আমায় বিপদ থেকে বাঁচালে। দেখে তো মনে হচ্ছে, ছেলেটি বেশ চালাক—চতুর। দেখতে শুনতেও ভালো। ঘোড়ার পিঠে দু—চার দিন ট্রেনিং দিলেই অনেকটা রপ্ত করে ফেলবে বলে মনে হয়।’ এই পর্যন্ত বলেই ছিমছাম লোকটি হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
আমি একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। আসলে, তখন তো আমার নামটা পর্যন্ত আমার মন থেকে মুছে গেছে। চোখের পলকে হোঁতকা লোকটার দিকে তাকাতেই আমার কী মনে হল, আমি বলে ফেললুম, ‘আমার নাম বরবটি।’
আমার নাম শুনে হোঁতকা আর ছিমছাম দুটো লোকই হেসে গড়িয়ে পড়ল। আমি বোকার মতো ওদের হাসি দেখে নিজেও হাসতে লাগলুম।
অবশ্য হাসিটা বেশিক্ষণ গড়াল না। ছিমছাম লোকটি হোঁতকা মতন লোকটিকে বলল, ‘ঠিক আছে বাবা। বরবটি এখন এখানে একটু বসুক, তুমি এসো আমার সঙ্গে। আসল কাজটা সেরে ফেলা যাক।’ বলতে বলতে দুটো লোকই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একা চুপচাপ বসে রইলুম, আর সার্কাসে যেসব জীবজন্তু খেলা দেখায় তাদের, হট্টগোল শুনতে লাগলুম আমার একবারও মনে হল না, আসল কাজটা কী, কী কাজ সারতে গেল দুজনে!
তার পরের ঘটনাগুলো খুব সোজা:
হাসিমুখে দুজনে ফিরে এল একটু পরেই।
হোঁতকা লোকটা আমায় বলল, ‘সাবধানে থাকিস রে বরবটি। আমি চলি এখন। পরে আবার আসব।’
সেদিন থেকে ক—দিন নিয়মিত একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে আমায় নানান ধরনের খেলা দেখানোর কায়দা শেখানো চলল। সত্যি বলতে কী ঘোড়াটাকে যখন প্রথম দেখি, তখন থেকে এমন ভালো লেগে গেল! কী শান্ত ঘোড়াটা। ঘোড়াটার যেন আমাকেও খুব ভালো লেগে গেছে। কেন না, আমি যখন ওর পিঠে দাঁড়িয়ে খেলা শিখি, আমি বুঝতে পারি বেচারির কষ্ট হচ্ছে, তবুও আমাকে কোনো দিনও লাফিয়ে—ঝাঁপিয়ে ঝটকা মেরে ওর পিঠ থেকে ফেলে দেয়নি। সুতরাং খেলা শিখতে আমার মনে ভয় ছিল না কোনো। কত সহজে শিখে ফেললুম কত শক্ত শক্ত খেলা। সেই খেলাটা কী শক্ত, যেটা বাজনার তালে তালে ঘোড়ার নাচের খেলা। পেছনের দু—পা মাটিতে রেখে নাচে ঘোড়া। সামনের দু—পা শূন্যে। আমি শূন্যের সেই দু—পা মাটি থেকে লাফিয়ে ধরে ডিগবাজি খাই। একটা—দুটো, পাঁচটা—ছ—টা, দশটা পর্যন্ত। তা—ও সেই নাচের বাজনার তালে তালে। ভাবতে পারবে না, কী হাততালি পড়ে তখন!
এই ভাবেই বেশ চলছিল। ওরা আমার এই ঘোড়ার নাম রেখেছিল ‘কামাল’। কামাল বলেই সবাই ডাকত। আমি ডাকতুম ‘বন্ধু’ বলে। আমি একাই ডাকতুম। বললে বিশ্বাস করবে না, কী গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আমাদের। আমি যেমন ভালোবাসতুম তাকে, সে—ও তেমনই ভালোবাসত আমায়। আমাকে সামনে না—দেখলে সে খাবারই মুখে দিত না।
তার পরেই ঘটে গেল সাংঘাতিক ঘটনা।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। ভিড়ের ঠেলায় সার্কাসের গ্যালারি উপচে পড়েছে। এক—একটা খেলা শেষ হচ্ছে, হাততালিতে ফেটে পড়ছে সার্কাসের ঘেরাটোপ। যখন ঘোড়ার নাচের বাজনা বেজে উঠল, আর আমি ঘোড়ার পিঠে চেপে যখন খেলার চত্বরে হাজির হলুম, তখন যদি দর্শকদের আনন্দের ধুম দেখতে, নির্ঘাত ভাবতে, এ যেন খুশির তুফান আকাশ—বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে! প্রথমে যেমন রোজ হয়, সেদিনও তেমন ক—টা খেলা হল ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে। ক—টা খেলা হল, ঘোড়ার পেটে ঝুলে, ঘাড়ে দুলে। তারপরে শুরু হল ঘোড়ার নাচের খেলা। প্রথমে ঘোড়ার চার পায়ে ঝুমুর পরিয়ে দেওয়া হল। ঘোড়া বাজনার তালে তালে চার পা ফেলে, কোমর দুলিয়ে, ঘাড় হেলিয়ে ক—টা মজাদার নাচ দেখাল। তারপর, চারপায়ে নাচতে নাচতে হঠাৎ সামনের দু—পা শূন্যে তুলে ধেই—ধেই করতে লাগল, অমনই আমি ঘোড়ার শূন্যে তোলা দু—পা ধরার জন্যে মেরেছি লাফ। সঙ্গে সঙ্গে মট করে একটা আওয়াজ। আমি ভয়ে চমকে উঠেছি। বুঝতে পারলুম আমার লাফানোটা বেকায়দায় হয়ে গেছে। ফলে আমার শরীরের ভারে ঘোড়ার একটা পা বোধ হয় ভেঙে গেল। আর বলতে, সত্যি তাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আমি পড়লুম ছিটকে দশহাত দূরে। তারপর আমি আর কিছু জানি না। জ্ঞান হারালুম। হঠাৎ যখন আমার জ্ঞান ফিরল, দেখেশুনে আমি আঁতকে উঠেছি। মনে হল, আমি একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার শরীরের এখানে—ওখানে ব্যান্ডেজ। আমার আশেপাশে অনেক রুগি বিছানায় শুয়ে। অনেক নার্স এদিক—ওদিক ব্যস্ত পায়ে ঘোরাফেরা করছেন। আমার কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল। আচমকা আমার বাড়ির কথা সব মনে পড়ে গেল! এখানে আমি কেমন করে এলুম! আমার মা কই? বাবা কই? আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলুম। নার্স ছুটে এসেছেন, ‘কী হয়েছে ?’
আমি তেমনই চিৎকার করে বললুম, ‘আমি বাড়ি যাব।’
নার্স বললেন, ‘ডাক্তারবাবু ছুটি না—দিলে তুমি বাড়ি যাবে কেমন করে? তোমার যা আঘাত, তাতে এত তাড়াতাড়ি তোমার ছুটি হবে কী করে?
আমি নাছোড়বান্দা। নার্সকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কেন লাগল আঘাত? কেমন করে লাগল আমার, আমি তো জানি না।’
নার্স উত্তর দিলেন, ‘সে কী কথা! সার্কাসে ঘোড়ার খেলা দেখাতে গিয়ে তুমি যে পড়ে গেছলে, তা তোমার খেয়াল নেই? কী সাংঘাতিক ঘটনা! ভগবানের দয়ায় তুমি খুব বেঁচে গেছ। ঘোড়াটাকে তো বাঁচানো যায়নি!’
নার্সের এই কথা শোনার পর, কী আশ্চর্য, আমি যা একেবারেই ভুলে গেছলুম, একটি একটি করে তার সব মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা হোঁতকা মতো লোক আমার নাকের কাছে একটা রুমাল নেড়ে দিতেই তার ঝাঁঝাল গন্ধে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর আর কিছু জানি না। জ্ঞান ফিরলে একেবারে অন্য মানুষ। সার্কাসে আমি ঘোড়ার খেলা দেখাই। ঘোড়াটা আমার ভীষণ ভালোবাসে। আমিও ভালোবাসি। তাকে বন্ধু বলে ডাকি। হ্যাঁ, কাল সেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। আমি বেঁচে গেছি। নার্স বলছেন আমার বন্ধু ঘোড়া বেঁচে নেই। শুনে আমি এখন কান্নায় ভাসছি, আর ভাবছি আমি এখন কেমন করে মা আর বাবার কাছে যাব! তাঁরা না—জানি আমাকে পাগলের মতো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন!
আমি কোথায় এসেছি জানি না। আমাদের বাড়ি কোনদিকে তা—ও আমার জানা নেই। কিন্তু না, আমার আঘাত যতই গুরুতর হোক, ডাক্তারবাবু আমাকে ছুটি না—দিলেও আমি লুকিয়ে পালাব এখান থেকে। কিন্তু কেমন করে! আমি কি উঠে বসতে পারছি! দেখি তো! নার্সের সামনেই আমি উঠে বসার চেষ্টা করলুম। বসতে পারলুম। নার্স একটু ব্যস্ত হয়ে ধমক দিলেন, ‘এ কী করছ? উঠছ কেন?’
‘আমি একটু বাথরুমে যাব’, বলে আমি পা বাড়াবার চেষ্টা করলুম মাটিতে পা ফেলার।
নার্স হন্তদন্ত হয়ে আমাকে ধরে ফেললেন। ততক্ষণে আমার মাটিতে পা পড়ে গেছে। আমি দিব্যি একপা, দু—পা করে হেঁটেও ফেলেছি। বুঝতে পারলুম হাঁটতে আমি পারব। আঘাতটা আমার পায়ে লাগেনি। লেগেছে হাতে আর মাথায়। এই দু—জায়গাতেই ব্যান্ডেজ জড়ানো। আর যা লেগেছে, তার কোথাও কেটেছে, কোথাও ছড়েছে। তবে মাথার ভেতরে একটা যন্ত্রণা আমায় কষ্ট দিচ্ছে। বাঁ—হাতটা ভেঙেছে মনে হয়। কবজিটা মনে হচ্ছে, প্লাস্টার করে দিয়েছে।
নার্স আমায় আটকালেন। চেঁচালেন, ‘তোমায় বাথরুম যেতে হবে না। এখানে, বেডেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
আমিও জেদ ধরলুম, যাবই।
অগত্যা নার্স আমায় ধরে ধরে নিয়ে চললেন বাথরুমে। আমি বুঝতে পারলুম, হাঁটতে আমার কষ্ট হল না।
কে না—জানে, এই আলো—ঝলমল দিনের বেলায় তো আর নার্সের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালানো যায় না। সুতরাং আমাকে গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার দেখা হয়ে গেছে, হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছে না, সুযোগ পেলে আমি ঠিক পালাতে পারব। সুতরাং গভীর রাতের অপেক্ষায় আমি গুনতে লাগলুম।
ইতিমধ্যে সার্কাসের বড়োকর্তা হাসপাতালে এসে আমার খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। তিনি এতটাই মুষড়ে পড়েছেন যে, ছলছল চোখে আমাকে বলে যেতে ভুললেন না, অনেক চেষ্টা করেও ঘোড়াটাকে বাঁচানো গেল না।
সেটা আমি জানি। ঘোড়াটার জন্যে যে আমার মনও কতটা ভার হয়ে আছে, সেকথা আমি ছাড়া আর কে জানে! কিন্তু সে যা হবার সে তো হয়েই গেছে। তাকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এখন সব ছেড়ে মন যে আমার বাড়ির জন্যে ভীষণ ছটফট করছে। আমি মাকে, বাবাকে কখন যে দেখতে পাব, কেমন করে যে তাদের কাছে যাব, তার যে কিছুই জানি না আমি। আমার কী হবে? সার্কাসের মালিক যদি আমাকে না—ছাড়েন! ছাড়ার কথাও নয়। কারণ, এই বয়সের এমন একটা ওস্তাদ ছেলেকে সার্কাসের কোনো মালিকই কি ছেড়ে দেয়! সুতরাং কাউকে কোনো জানান না—দিয়েই আমাকে পালাতে হবে। পালাতে হবে গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে।
অবশ্য, এখন আর দিনের আলো নেই। সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। দিনেরবেলা যে নার্সরা রুগিদের দেখাশোনা করছিলেন, তাঁদের ডিউটি শেষ। এখন রাতের নার্স এসেছেন। আমাকে যিনি দেখাশোনা করবেন তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, ভালোমানুষ। এঁকে বোধহয় ফাঁকি দিতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। দেখা যাক, কী হয়।
ঘুমের রাত এল। ঘুম আসার আগে, হাসপাতালেই যেসব ডাক্তারবাবুরা থাকেন, তাঁরা প্রত্যেক রুগিকেই একবার করে দেখে গেলেন। এবার আলো নিভবে একটি একটি করে। খুব ঝিমঝিমে একটা আলো শুধু জ্বালা থাকল। এখন ঘুমোও।
আমার বেড দোতলায়। আমি দেখে রেখেছি, বাথরুম যেদিকে, সেদিকে একটু এগিয়েই নীচে নামার সিঁড়ি। সুতরাং গভীর রাতে নার্সের চোখ ঘুমে যদি একটুও ঢুলু—ঢুলু করে, তখনই পালানোর সুযোগটা নিতে হবে। আর যদি দেখে ফেলেন, তখন তো বলা যেতেই পারে বাথরুমে যাচ্ছি।
অবাক কথা কী, গভীর রাতে এমনই একটা সুযোগ আমি পেয়ে গেলুম। মিটিমিটি আলো। সবাই ঘুমে অচেতন। চারদিক সুনসান। এমনকী, নার্সও ঘুমোচ্ছেন। আমি নিঃসাড়ে বেড থেকে নেমে একাই বাথরুমের দিকে আলতো পায়ে হাঁটা দিলুম। বাথরুম পেরিয়ে সিঁড়িতে পা ফেললুম। নেমেও গেলুম। এমনই বরাত, দেখি গেটের দারোয়ানও দেওয়ালে মাথা এলিয়ে বেমালুম নাক ডাকাচ্ছে। ছুট্টে পেরোতে গেলুম গেটটা, পারলুম না। কোমরটা টনটন করে উঠল। বুঝতে পারলুম প্রচণ্ড ব্যথা সারা শরীরে। ছোটাছুটি করার ক্ষমতা নেই। পালাতে হবে সাবধানে পা ফেলে। শেষপর্যন্ত সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারলুম হাসাপাতাল থেকে। রাস্তায় বেরিয়ে অনেকটা লুকিয়েছাপিয়ে, আর অনেকটা হাঁসফাঁস করে খোলা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা নিরাপদ জাগয়ায় পৌঁছে গেলুম।
এইবারেই মুশকিল। যদিও তখন গভীর রাত। চারদিক ফাঁকা। কোথাও জনপ্রাণী নেই, তবুও ভয়তো আমার পিছু ছাড়ছে না। এমন করে ফাঁকা পথে হাঁটলে যে, আমি যে—কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারি, সেটা কে না—জানে। আমায় এখনই কোথাও—না—কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কোথায় লুকোব? আমি তো এখানকার ধুলো—মাটি কিছুই চিনি না।
আমি অনেকক্ষণ হেঁটেছি। আর কত হাঁটব! সত্যি বলছি, আর পারছি না। মনে হচ্ছে, গভীর রাত হালকা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার ততই মাথা ঝিমঝিম করছে। হাঁটতে হাঁটতে পা—ও আর বইছে না। সামনে কী আছে। কোথায় যাব! কিছু জানি না। আমায় যে একটু বসতে হবে এখনই। নইলে নির্ঘাত মাথা ঘুরে পড়ে যাব। ওই দিকে মনে হচ্ছে, কয়েকটা গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। একটু ঝোপঝাড়ও আছে। ওইদিকেই পা বাড়ালুম। এখানে এসে টাল সামলাতে পারলুম না। এসে গেছি ঝোপের কাছে। ঝোপের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলুম। তারপর হাঁপাতে লাগলুম।
একটু সামলে আবার উঠে পড়েছি। মনে হল, এই ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকা যায়, কিন্তু লুকিয়ে থাকা যায় না। দিনের আলো ফুটলে কারও নজরে পড়ে যেতে পারি। সুতরাং কুঁতিয়ে—কুঁতিয়ে আবার পা ফেললুম ঝোপ ডিঙিয়ে।
একটু হাঁটতেই মনে হল, এদিকটা যেন জঙ্গল—জঙ্গল। আর একটু হাঁটতেই দেখি, জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা গাড়ি, না, কী একটা পড়ে আছে। হ্যাঁ, কাছাকাছি গিয়ে দেখি, যা ভেবেছি তা—ই, একটা ঘোড়ায়—টানা গাড়ি। বসা যাবে কি? বসতে পারলে বেশ হয়। লুকিয়ে থাকা যাবে, আবার ধকলও সামলানো যাবে।
হ্যাঁ, অন্ধকারে আন্দাজে পা ফেলে ভাঙা গাড়িটার ভেতর ঢুকে বসার মতো একটু জায়গা পেয়ে গেলুম। এখানে আজকের রাতটা অন্তত নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। এই ঘুপচিতে কারও সাধ্যি নেই আমাকে খুঁজে বার করে।
আঃ! এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেলুম। না, গাড়ির ভেতর আরাম করে বসতে তেমন কিছু অসুবিধে হচ্ছে না। এবার আমার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে! অবশ্য এখানে নির্ভাবনায় একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। সুতরাং ঘুমে চোখ বুজে গেল আমার।
ওমা! একী! হঠাৎ আমার ঘুম কেন ভেঙে যায়! আমার মনে হল ভাঙা গাড়িটা যেন ছুটছে। তাই তো! এ কী অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আসছে কানে। কোত্থেকে ঘোড়া এল। গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি মেরে দেখি, আরে এ যে সেই সার্কাসের সেই সাদা ঘোড়া, আমার বন্ধু! আশ্চর্য! সবাই বলল, সে তো মরে গেছে। ভয়ে আমার বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়! আমাকে সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আমাকেও সে মেরে ফেলতে চায় নাকি! আমি আর কিছু ভাবতে না—পেরে আর্তনাদ করে উঠলুম, ‘আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!’
অবাক কাণ্ড, চোখের পলকে গাড়িটা থেমে গেল! কোথায় থামল অন্ধকারে আমি ঠিক ঠাওর করতে পারলুম না। কেউ আমাকে বাঁচাতেও এল না। ঢিপ ঢিপ করে কাঁপতে লাগল আমার বুক। থরথর করে কাঁপতে লাগল আমার সারা শরীর।
ঠিক এই মুহূর্তে একটা পাখি ডেকে উঠল। একটা কাকও কা—কা করে ডাক দিল। অনেকটা ভয় কাটল আমার পাখির ডাক শুনে। আর দেরি নেই, এবার ভোরের আলো দেখা যাবে। আচ্ছা, গাড়িটা তো থামল। কিন্তু ঘোড়াটার তো আর কোনো সাড়া পাচ্ছি না। তার টগবগিয়ে ছোটার শব্দ না—হয় থামল, কিন্তু তার পরে ঘোড়ার দম ফেলার আবছা শব্দও তো কানে আসবে! কই তেমন তো কিছু শুনছি না! সাহস হল না গাড়ি থেকে নামতে। ভোরের নরম আলোয় আবার উঁকি দিলুম। কই, আমার সেই বন্ধু ঘোড়াকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। নিমেষে কোথাও উধাও হয়ে গেল! ভোরের আলো আরও একটু উজ্জ্বল হতে, আমার কেমন যেন সাহস বেড়ে গেল। আমি খুব চাপা স্বরে ডাক দিলুম, ‘বন্ধু!’ ডাকতে ডাকতে গাড়ি থেকে নেমেও পড়লুম। তারপরেই থ হয়ে গেলুম। এ যে গাড়ি আমাদেরই বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে! একী সত্যি, না আমি স্বপ্ন দেখছি! আমি থাকতে পারলুম না। চিৎকার করে উঠলুম, ‘মা—, বাবা—,’ চিৎকার করে দুড়দাড়িয়ে ছুটে গেলুম দরজার দিকে। মারলুম ধাক্কা। দরজা খুলে গেল। দেখি সামনে মা। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লুম মায়ের বুকে। লাগল আমার ভাঙা হাতটায়। মাথাটাও কেমন যেন ঝিনঝিন করে উঠল। কিন্তু সে কি আর তখন মায়ের বুক জড়িয়ে ধরতে আমায় বাধা দিতে পারে। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আমি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলুম। মা—ও কাঁদছেন। ছুটে এসেছেন বাবাও। বুঝতে পারলুম তিনি আমার মাথা আলতো হাতে ছুঁয়ে ধরেছেন। আমি মুখ তুলে তাকালুম। দেখলুম, তাঁরও চোখে জল। মুখে হাসির আভাস। কান্না—হাসির সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। ছেলেকে যে ফিরে পেয়েছেন! সত্যি বলতে কী, আনন্দ যে মানুষকে এমন করে কাঁদায়, সে কথা কি এতদিন আমি জানতুম! না, আমার এই বয়সে তা জানার কথাও নয়। আজই প্রথম জানলুম!
আর, সব শেষে বলি, আমার বন্ধু ঘোড়া, যে গাড়িটা টেনে আমায় মা—বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল, সেই গাড়িটাও দেখি কোথায় উধাও হয়ে গেছে! আর কোনোদিন দেখতেও পেলুম না। এ কী আজব গল্প!