এ কি পিতৃ-হত্যা? (অর্থাৎ পিতৃ-হত্যাপরাধে অভিযুক্ত পুত্রের অদ্ভুত রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
ঘটনা—বহুদিবসের। ঘটনাস্থল এই সহরের মধ্যস্থিত কোন দরিদ্র পল্লী। ঘটনার নায়ক সেই দরিদ্র পল্লীনিবাসী কোন এক নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তি না হইলেও তাদৃশ ধনশালী ব্যক্তি নহে। সুতরাং এ ঘটনা পাঠকবর্গের হৃদয়ে জাগরিত না থাকিবারই কথা। সেই পুরাতন ঘটনার আদ্যোপাত্ত বিবরণ অদ্য আমি পাঠকবর্গের সন্নিকটে বর্ণন করিতে উদ্যত হইলাম। দেখি, ইহাতেও কোন পাঠকের হৃদয়-মুকুরে সেই পুরাতন ঘটনার অন্ততঃ কথঞ্চিত্ত প্রতিবিম্ব আসিয়া পতিত হয় কি না?
.
আমি-বোধ হয়, পূর্ব্বে একবার বলিয়াছি যে, ‘কোন ব্যক্তি সর্ণকর্তৃক দংশিত হইয়াছে’ এই সংবাদ কোন সপ দংশন চিকিৎসাকারীর কর্ণগোচর হইলে শ্রবণমাত্রই যেমন তাঁহাকে সেই দৃষ্ট ব্যক্তির নিকট গমন করিয়া তাহার চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হইতে হয়; ‘কোনস্থানে কোন হত্যাকাণ্ড সংসাধিত হইয়াছে’ এই সংবাদ পাইবামাত্র আমাদিগকেও সেইরূপ হত্যাস্থলে উপনীত হইয়া সেই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হয়।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইবার কিয়ৎক্ষণ পরে সংবাদ পাইলাম, “জেলিয়াটোলার ভিতর জনৈক মুসলমানের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। দেখিয়া বোধ হইতেছে যে, সেই ব্যক্তি কাহারও কর্তৃক হত হইয়াছে, এবং তাহারই পুত্র হত্যাপরাধে ধৃত হইয়াছে।”
এই সংবাদ পাইবামাত্র কালবিলম্ব না করিয়া জেলিয়াটোলায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। জেলিয়াটোলা কোথায়, তাহা বোধ হয়, পাঠকবর্গের মধ্যে অনেকেই অবগত নহেন। মেছুয়াবাজার রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পূর্ব্বে যে একটি প্রকাণ্ড দীর্ঘিকা ছিল, এবং যে দীর্ঘিকা মৃত্তিকা দ্বারা পূর্ণ করিয়া আমাদিগের ভূতপূর্ব্ব লেপ্টে নান্ট গবর্ণর স্যার চার্লস্ এলিয়ট সাহেব বালকদিগের ক্রীড়াস্থল করিয়া দিয়াছেন, সেই দীর্ঘিকার সন্নিকটবর্তী একটি স্থানকে এখনও জেলিয়াটোলা বলিয়া থাকে। সেইস্থানে উপনীত হইয়া দেখিলাম যে, পূর্ব্বকথিত দীর্ঘিকার তীরে সেই হতব্যক্তি পতিত রহিয়াছে। আরও দেখিলাম, অষ্টাদশবর্য বয়স্ক একটি যুবক বন্ধনাবস্থায় সেইস্থানে রহিয়াছে, এবং সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত কর্মচারীবর্গের অধিকাংশ ব্যক্তিই সেই যুবককে নানারূপ প্রশ্ন করিতেছেন। আমি সেইস্থানে উপস্থিত হইবার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে জানিতে পারিলাম যে, মৃতব্যক্তির নাম জালালউদ্দীন। যে স্থানে উঁহার মৃতদেহ পতিত রহিয়াছে সেইস্থান হইতে একটু দূরে জেলিয়াটোলার প্রান্তভাগে উহার বাসস্থান। জালালউদ্দীন কোন্ দেশীয় লোক, তাহার প্রকাশ না থাকিলেও, বহুকাল পর্য্যন্ত তিনি যে এইস্থানে বাস করিতেছেন, একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন। জালালউদ্দীন নিতান্ত দুর্দশাপন্ন ব্যক্তি নহেন, বরং তাঁহার কিছু যে সঙ্গতি আছে, একথাও সকলে বলিয়া থাকেন। বহুদিবস অতীত হইল, জালালউদ্দীনের স্ত্রী কেবলমাত্র একটি পুত্র-সন্তান রাখিয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। জালালউদ্দীন মুসলমান হইলেও কিন্তু এ পর্যন্ত আর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন নাই। প্রথমতঃ তিনি তাঁহার পুত্রটিকে নিজেই লালন পালন করেন, এবং পরিশেষে তাহাকে সামান্যরূপ লেখাপড়া শিক্ষা প্রদান করিয়া পাবলিক ওয়ার্কস্ ডিপার্টমেন্টে ড্রাম্যানের কার্যে নিযুক্ত করিয়া দেন। যে অষ্টাদশবর্ষ বয়স্ক যুবকটি সেইস্থানে বন্ধনাবস্থায়, রহিয়াছে, উহার নাম “সমসুদ্দিন আহাম্মদ।” এই সমসুদ্দিনই জালালউদ্দীনের একমাত্র পুত্র, এবং পিতৃ-হত্যা-অপরাধে আজ সে অভিযুক্ত। গত দুই বৎসর হইতে সমসুদ্দিন ড্রাফ্টম্যানের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছে। উহার মধ্যে কলিকাতার আফিসে প্রায়ই সে থাকিতে পায় নাই। এই দুই বৎসর পর্য্যন্ত ক্রমাগত তাহাকে মফঃস্বলে মফঃস্বলে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইতেছে। একস্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিবার সময় সমসুদ্দিন উর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীদিগকে লুকাইয়া কখনও কখনও কলিকাতায় আসিয়া আপনার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যায় সত্য; কিন্তু দুই এক দিবসের অধিক কখনই সে সেইস্থানে অবস্থিতি করিতে সমর্থ হয় নাই। সমসুদ্দিনের বেতন অধিক নহে, ত্রিশ টাকামাত্র। সেই বেতন হইতে নিজের আবশ্যকমত ব্যয় বাদ দিয়া যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকে, প্রত্যেক মাসে সমসুদ্দিন তাহা আপনার পিতার নিকটে পাঠাইয়া দেয়। পিতা জালালউদ্দীনকে অপর কোন কার্য্য করিতে হয় না, বা তাঁহার পূর্ব্বসঞ্চিত অর্থ নিজের ভরণ পোষণের নিমিত্তও ব্যয় করিতে হয় না। কারণ পুত্র-প্রদত্ত অর্থ হইতেই তিনি আপনার সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন।
জেলিয়াটোলার ভিতর প্রকাশ যে, যৌবনাবস্থায় জালালউদ্দীন যখন জাহাজে কনট্র্যাক্টের কার্য্য করিত, সেই সময় তাঁহার অধীনে অনেক কুলি নিযুক্ত ছিল, এবং কিছুদিবস তাঁহার কার্য্য সুশৃঙ্খলার সহিত চলিয়াছিল। তিনি বিস্তর অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, এবং সেই সময়ের উপার্জিত অর্থের কিয়দংশ এখন পর্যন্তও সঞ্চিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু কি পরিমিত অর্থ যে তাঁহার নিকট সঞ্চিত আছে একথা পাড়ার কেহই বলিতে পারে না, বা তাঁহার পুত্র সমসুদ্দিনও এ বিষয়ের কোন প্রকার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হয় নাই।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এই সকল অবস্থা অবগত হইয়া প্রথমতঃ মনে করিলাম যে, সমসুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি, সে তাহার পিতৃহত্যা সম্বন্ধে কোন কথা স্বীকার করে কি না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল যে, কিরূপ অবস্থার সমসুদ্দিন এই ভয়ানক অপরাধে ধৃত হইয়াছে, তাহার আনুপূর্বিক অবস্থা সর্ব্বপ্রথম উত্তমরূপে বিগত হওয়া আবশ্যক। এই ভাবিয়া যে কৰ্ম্মচারীবর্গ সেই অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন উচ্চ পদস্থ কর্ম্মচারীকে কহিলাম, “মহাশয়! সমসুদ্দিন তাহার পিতাকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হইয়াছে দেখিতেছি, কিন্তু কিরূপে সে ধৃত হইয়াছে, তাহার আনুপূর্বিক অবস্থা আমি জানিতে বাসনা করি। যদি তাহাতে আপনার কোনরূপ প্রতিবন্ধক না থাকে, তাহা হইলে যতদূর সম্ভব, বর্ণন করিয়া আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন।”
আমার কথার উত্তরে কর্মচারী কহিলেন, “আপনার নিকট সমস্ত অবস্থা বর্ণন-করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমি যতদূর নিজে অবগত আছি, এবং যতদূর অপরের নিকট হইতে সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহা আপনার নিকট বর্ণন করিতেছি। ইহা ব্যতীত যে সকল ব্যক্তিকর্তৃক আসামী ধৃত হইয়াছে, তাহারাও এইস্থানে উপস্থিত আছে। আমরা তাহাদের নিকট হইতে যে সকল কথা শুনিয়াছি, তাহা আপনি শ্রবণ করিলেই বুঝিতে পারিবেন সমসুদ্দিন পিতৃ-হত্যা অপরাধে কতদূর অপরাধী।
“মৃত জালালউদ্দীন যেরূপ অবস্থায় এখন পতিত আছেন, তাহা আপনি স্বচক্ষেই দর্শন করিতেছেন। মৃত্যুর সময় উনি কিন্তু ওরূপ অবস্থায় ওইস্থানে পতিত ছিলেন না, উঁহার শরীরের ঊর্দ্ধ ভাগের প্রায় অধিকাংশ জলের ভিতর, ও অধোভাগ সমস্তই মৃত্তিকার উপর পতিত ছিল। তাহার সম্মুখভাগ নিম্নদিকে ও পৃষ্ঠভাগ উর্দ্ধদিকে রক্ষিত ছিল, এবং তাহার মস্তকের সন্নিকটবর্তী দীর্ঘিকার জল প্রায় রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছিল। এ অবস্থা কিন্তু আমরা কেহই স্বচক্ষে দর্শন করি নাই; যে দুই তিন ব্যক্তি কর্তৃক সমসুদ্দিন ধৃত হইয়াছে, তাহাদিগের প্রমুখাৎ আমরা এই কথা অবগত হইতে পারিয়াছি। সেই ব্যক্তিগণ এখনও এইস্থানে বর্তমান আছে। কিরূপ অবস্থায় সমসুদ্দিন ধৃত হইয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা আমার প্রমুখাৎ অবগত না হইয়া তাহাদিগের প্রমুখাৎ অবগত হইলেই আপনি প্রকৃত অবস্থা অতি সহজেই বুঝিতে পারিবেন।”
এই বলিয়া তিনি তখন একপ্রান্তে উপবিষ্ট তিনজন লোককে আপনার নিকটে ডাকিলেন; আদেশ প্রাপ্তিমাত্র তাহারা কর্ম্মচারীর নিকট আগমন করিলে তিনি কহিলেন, “তোমরা যে সকল অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছ, তাহা এই কর্মচারীর নিকট বর্ণন কর। কোন কথা গোপন করিও না, বা মিথ্যা করিয়া কোন কথা বলিও না।”
উত্তরে তাহারা কহিল, “মহাশয়! আমরা মিথ্যা কথা বলিব কেন? যে সকল অবস্থা আমরা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছি, এবং যাহা আপনার নিকট আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিয়াছি, তাহা ভিন্ন অপর কোন বিষয় আমরা অবগত নহি।” এই বলিয়া প্রথম ব্যক্তি বলিতে আরম্ভ করিল, “মহাশয়! আমরা কলিকাতায় থাকি না, আমাদিগের তিনজনেরই বাসস্থান হাবড়া। কোন কার্য্যবশতঃ অদ্য আমরা কলিকাতায় আসিয়াছিলাম। যে কার্য্যের নিমিত্ত আমরা কলিকাতা সহরে আসিয়াছিলাম, সেই কার্য্য সম্পন্ন করিয়া প্রত্যাগমন করিবার সময় ভাবিলাম যে, যখন এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, তখন আমাদের বহুকাল হইতে পরিচিত এই দীঘির পাড়-নিবাসী সেতাবদ্দির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাই। এই ভাবিয়া আমরা এই দীঘির ধার দিয়া গমন করিতেছিলাম, আমি অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছিলাম। আমার অনুসঙ্গী এই দুই ব্যক্তি আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিল! যে সময় আমরা এইস্থান দিয়া গমন করিতেছিলাম, এই পল্লী অধিক লোকের দ্বারা পূর্ণ থাকিলেও সেই সময় এই স্থানে আর কোন ব্যক্তি ছিল বলিয়া আমার মনে হয় না। কেহ থাকিলেও অন্যদিকে আমাদিগের মন সবিশেষরূপে আকৃষ্ট হওয়ায় আমরা তাহাদিগকে দেখিতে পাই নাই। যে স্থানে এখন মৃতদেহ পতিত রহিয়াছে, সেইস্থান হইতে প্রায় শত হস্ত অন্তর স্থানে যখন আমরা উপস্থিত হইলাম, তখন এই মৃতদেহ ও হত্যাকারীর উপর আমাদিগের নয়ন আকৃষ্ট হইল। দেখিলাম, এই হতব্যক্তির প্রায় অর্দ্ধেক নিম্ন অবয়ব মৃত্তিকার উপর পতিত রহিয়াছে, এবং অপর অর্ধেক ঊর্দ্ধ অবয়ব জলের ভিতর পতিত থাকায় এই হত্যাকারীর যুবক তাহাকে জল হইতে উঠাইবার চেষ্টা করিতেছে। এই অবস্থা দেখিতে দেখিতে আমরা আরও কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলাম। সেই সময় দেখিলাম যে, এই যুবক উহাকে জল হইতে উঠাইয়া মৃত্তিকার উপর স্থাপিত করিল, এবং এই মৃতব্যক্তির বক্ষঃস্থল হইতে একখানি প্রকাণ্ড ছুরী টানিয়া বাহির করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমাদের মনে যে কিরূপ অনির্বচনীয় ভাবের উদয় হইল, তাহা আপনারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন! আমরা ভাল মন্দ বিবেচনা করিবার সময় না পাইয়া, ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া গিয়া সেই ছুরীর সহিত হত্যাকারীকে ধৃত করিলাম ও দেখিলাম, বৃদ্ধের বক্ষঃস্থলে ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন রহিয়াছে, এবং তখন পর্যন্তও সেই ক্ষতস্থান দিয়া রক্তধারা বহির্গত হইয়া নিকটবর্ত্তী জলরাশিকে রক্তবর্ণে রঞ্জিত করিতেছে। যে স্থানে আমরা এই নরঘাতককে ধৃত করিয়াছিলাম, সেই সময় সেইস্থানে হত ও হত্যাকারী ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না। আমরা ইহাকে ধৃত করিবামাত্র চীৎকার করিতে করিতে প্রথমতঃ ইহার হস্ত হইতে ছুরী কাড়িয়া লইলাম, এবং পরিশেষে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া উহাকে এইস্থানে বসাইলাম। আমাদের চীৎকার শব্দে নিকটবর্তী লোক সকল আসিয়া এইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং ক্রমে ক্রমে লোকের জনতা অতিশয় বাড়িয়া গেল। সেই সময় এক ব্যক্তি আগমন করিয়া কোথা হইতে একজন পাহারাওয়ালাকে ডাকিয়া আনিল। পরিশেষে থানায় সংবাদ পৌঁছিল। এক এক করিয়া ক্রমে আপনারা সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমরাও ছুরি’ ও এই হত্যাকারীকে আপনাদিগের হস্তে অর্পণ করিলাম। ইহাই আমরা জানি, এই কথাই আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি।” এই বলিয়া সেই ব্যক্তি চুপ করিল।
আমি। যে যুবককে তোমরা হত্যাপরাধে ধৃত করিয়াছ, তাহার নাম কি?
১ম ব্যক্তি। ইহার নাম সমসুদ্দিন।
আমি। যে ব্যক্তি মৃত-অবস্থায় ঐ স্থানে পতিত রহিয়াছে, তাহার নাম কি?
১ম ব্যক্তি। উহার নাম জালালউদ্দীন।
আমি। ইহারা কতদিবস হইতে তোমাদের নিকট পরিচিত?
১ম ব্যক্তি। ইহারা উভয়ে আমাদের নিকট সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত।
আমি। যদি ইহারা তোমাদের নিকট সম্পূর্ণরূপেই অপরিচিত হইল, তাহা হইলে তোমরা ইহাদিগের উভয়ের নাম জানিলে কি প্রকারে?
১ম ব্যক্তি। ইহাদিগের নামও আমরা পূর্ব্বে অবগত ছিলাম না। কিন্তু আপনারা যে সকল অনুসন্ধান করিতেছেন, বা যাহাকে তাহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা আমরা এইস্থানে বসিয়া বসিয়া দেখিতেছি ও শুনিতেছি। সুতরাং ইহাদিগের নাম আপনারা যখন জানিতে পারিয়াছেন, আমরাও সেই সময় অবগত হইয়াছি। অবয়ব মৃত্তিকার উপর পতিত রহিয়াছে, এবং অপর অর্দ্ধেক ঊর্দ্ধ অবয়ব জলের ভিতর পতিত থাকায় এই হত্যাকারী যুবক তাহাকে জল হইতে উঠাইবার চেষ্টা করিতেছে। এই অবস্থা দেখিতে দেখিতে আমরা আরও কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলাম। সেই সময় দেখিলাম যে, এই যুবক উহাকে জল হইতে উঠাইয়া মৃত্তিকার উপর স্থাপিত করিল, এবং এই মৃতব্যক্তির বক্ষঃস্থল হইতে একখানি প্রকাণ্ড ছুরী টানিয়া বাহির করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমাদের মনে যে কিরূপ অনির্বচনীয় ভাবের উদয় হইল, তাহা আপনারাই বিবেচনা করিয়া দেখুন! আমরা ভাল মন্দ বিবেচনা করিবার সময় না পাইয়া, ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া গিয়া সেই ছুরীর সহিত হত্যাকারীকে ধৃত করিলাম ও দেখিলাম, বুদ্ধের বক্ষঃস্থলে ভয়ানক আঘাতের চিহ্ন রহিয়াছে, এবং তখন পর্য্যন্তও সেই ক্ষতস্থান দিয়া রক্তধারা বহির্গত হইয়া নিকটবর্ত্তী জলরাশিকে রক্তবর্ণে রঞ্জিত করিতেছে। যে স্থানে আমরা এই নরঘাতককে ধৃত করিয়াছিলাম, সেই সময় সেইস্থানে হত ও হত্যাকারী ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না। আমরা ইহাকে ধৃত করিবামাত্র চীৎকার করিতে করিতে প্রথমতঃ ইহার হস্ত হইতে ছুরী কাড়িয়া লইলাম, এবং পরিশেষে উত্তমরূপে বন্ধন করিয়া উহাকে এইস্থানে বসাইলাম। আমাদের চীৎকার শব্দে নিকটবর্তী লোক সকল আসিয়া এইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং ক্রমে ক্রমে লোকের জনতা অতিশয় বাড়িয়া গেল। সেই সময় এক ব্যক্তি আগমন করিয়া কোথা হইতে একজন পাহারাওয়ালাকে ডাকিয়া আনিল। পরিশেষে থানায় সংবাদ পৌঁছিল। এক এক করিয়া ক্রমে আপনারা সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমরাও ছুরী ও হত্যাকারীকে আপনাদিগের হস্তে অর্পণ করিলাম। ইহাই আমরা জানি, এই কথাই আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। এই বলিয়া সেই ব্যক্তি চুপ করিল।
আমি। যে যুবককে তোমরা হত্যাপরাধে ধৃত করিয়াছ, তাহার নাম কি?
১ম ব্যক্তি। ইহার নাম সমসুদ্দিন।
আমি। যে ব্যক্তি মৃত অবস্থায় ঐ স্থানে পতিত রহিয়াছে, তাহার নাম কি?
১ম ব্যক্তি। উহার নাম জালাল উদ্দীন।
আমি। ইহারা কতদিবস হইতে তোমাদের নিকট পরিচিত?
১ম ব্যক্তি। ইহারা উভয়ে আমাদের নিকট সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত।
আমি। যদি ইহারা তোমাদের নিকট সম্পূর্ণরূপেই অপরিচিত হইল, তাহা হইলে তোমরা ইহাদিগের উভয়ের নাম জানিলে কি প্রকারে?
১ম ব্যক্তি। ইহাদিগের নামও আমারা পূর্ব্বে অবগত ছিলাম না। কিন্তু আপনারা যে সকল অনুসন্ধান করিতেছেন, বা যাহাকে তাহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা আমরা এইস্থানে বসিয়া বসিয়া দেখিতেছি ও শুনিতেছি। সুতরাং ইহাদিগের নাম আপনারা যখন জানিতে পারিয়াছেন, আমরাও সেই সময় অবগত হইয়াছি।
আমি। যখন এই হত্যাকাণ্ডের উপর তোমাদিগের নয়ন প্রথম আকৃষ্ট হয়, সেই সময় হতব্যক্তি কিরূপ অবস্থায় ছিল, এবং হত্যাকারীই বা ঠিক সেই মুহূর্ত্তে কিরূপ অবস্থায় কি কার্য্য করিতেছিল, তাহা ভালরূপ স্মরণ করিয়া আমার নিকট বলিতে পার কি?
১ম ব্যক্তি। আমার যতদূর স্মরণ আছে, তাহাতে আমার বোধ হয়, হতব্যক্তির অর্দ্ধেক অংশ জলের ভিতর ও অর্দ্ধেক অংশ স্থলের উপর পতিত ছিল, এবং হত্যাকারী যেন উহাকে জল হইতে উঠাইবার বাসনায় আপনার হস্ত বিস্তারিত করিতেছিল।
আমি। তোমরা যখন সৰ্ব্বপ্রথম দেখিয়াছ, সেই সময় মৃতব্যক্তির অবয়ব কিরূপ অবস্থায় ছিল, অর্থাৎ উহার পৃষ্ঠ, পার্শ্ব বা উদরের মধ্যে কোনটি ঊর্দ্ধর্ভাগে ও কোনটিই বা নিম্নভাগে ছিল?
১ম ব্যক্তি। আমার বোধ হয়, উহার পৃষ্ঠদেশ উর্দ্ধর্ভাগে ছিল, অর্থাৎ উপুড় হইয়া পড়িয়াছিল।
আমি। তুমি একটু পূর্ব্বে বলিয়াছ যে, এই হত্যাকারী প্রথমতঃ উহাকে জল হইতে উঠায়, এবং পরিশেষে উহার বক্ষঃস্থল হইতে ছুরী উঠাইয়া লয়। সেই ছুরী সম্মুখ দিক হইতে, কি পশ্চাদ্দিক হইতে বিদ্ধ হইয়াছিল, তাহা ডাক্তারের পরীক্ষায় অনায়াসে আমরা অবগত হইতে পারিব। তথাপি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যদি তুমি স্মরণ করিয়া বলিতে পার, সেই ছুরীর মুষ্টিভাগে অর্থাৎ বাঁট পৃষ্ঠের দিকে, কি সম্মুখের দিকে ছিল?
১ম ব্যক্তি। আমার বেশ মনে হয়, ছুরীর মুষ্টিভাগ হতব্যক্তির সম্মুখ দিকে ছিল, এবং হত্যাকারী সম্মুখ দিক হইতেই সেই ছুরী বাহির করিয়া লয়।
আমি। যে স্থানে এই মৃতব্যক্তিকে তুমি প্রথম দেখিতে পাও, সেইস্থান দীঘির ঘাট হইতে কতদূর অন্তর?
১ম ব্যক্তি। ঘাট হইতে একবারেই অন্তর নহে, অথচ ঠিক্ ঘাটের উপরেও নহে। ঘাটের পার্শ্বেই আমি উহাকে প্রথম অবস্থায় দেখিতে পাই।
আমি। যে সময় তোমরা হত্যাকারীকে ধৃত কর, সেই সময় সেই ঘাটের উপর, কি তাহার সন্নিকটে অপর কোন দ্রব্য দেখিতে পাইয়াছিলে কি?
১ম ব্যক্তি। কেবলমাত্র একটিবনা সেইস্থানে পড়িয়াছিল দেখিয়াছিলাম। ইহা ব্যতীত আর কোন দ্রব্য সেইস্থানে পড়িয়াছিল কি না, সে বিষয় আমি লক্ষ্য করি নাই।
আমি। যখন তোমরা সমসুদ্দিনকে এই হত্যাপরাধে অস্ত্রের সহিত ধৃত কর, তখন সে কি বলিয়াছিল?
১ম ব্যক্তি। যখন আমরা উহাকে প্রথম ধৃত করি, তখন উহার মুখ দিয়া কোন কথাই নির্গত হয় নাই। পরিশেষে যখন উহার হস্ত হইতে ছুরী কাড়িয়া লইয়া উহাকে বন্ধন করিতেছিলাম, সেই সময় একবারমাত্র বলিয়াছিল, “আপনারা আমাকে বন্ধন করিতেছেন কেন? আমি পিতৃহন্তা নহি।”
আমি। ইহার পর যে পর্য্যন্ত এ তোমাদিগের নিকটে ছিল, তাহার মধ্যে আর কিছু বলিয়াছিল কি?
১ম ব্যক্তি। আর কোন কথাই বলে নাই, কেবল চুপ করিয়া বসিয়াছিল।
আমি। আমার এতগুলি প্রশ্নের যেরূপভাবে তুমি উত্তর প্রদান করিলে, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি যে, তুমি একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি। এরূপ অবস্থায় এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে তোমার মতামত কি, সে বিষয়ে আমি তোমাকে আরও দুই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। কারণ, এ ঘটনা তুমি যতদূর দর্শন করিয়াছ, ততদূর আর কেহই দেখে নাই। এ সম্বন্ধে আমার প্রথম প্রশ্ন এই যে, এই পিতৃহত্যা পুত্র দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে কি না?
১ম ব্যক্তি। আমার বিশ্বাস যে, এই পুত্রই উহার পিতাকে হত্যা করিয়াছে।
আমি। তোমার এ বিশ্বাসের মূল কি?
১ম ব্যক্তি। যখন আমাদের সম্মুখে পুত্র পিতার বক্ষঃ হইতে ছুরী উন্মোচিত করিয়াছে, সেই সময় সেইস্থানে জনপ্রাণীর লেশমাত্র ছিল না। এরূপ অবস্থায় এই পুত্র ভিন্ন আর কাহার দ্বারা এই হত্যা সাধিত হইতে পারে?
আমি। তুমি যাহা বলিলে, তাহা আমি প্রকৃত বলিয়া মানিয়া লইলাম। কিন্তু বল দেখি, ইহা কি হইতে পারে না, যে অপর কোন ব্যক্তি কোন কারণবশতঃ ইহার বক্ষঃস্থলে ছুরী বিদ্ধ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, এবং বৃদ্ধ পূর্ব্ববর্ণিত মত এইস্থানে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। পরিশেষে মৃত্যুর পর পিতার অনুসন্ধান করিতে করিতে পুত্র এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, ও যেরূপ অবস্থায় বৃদ্ধ পড়িয়াছিল, সেইরূপ অবস্থায় উহাকে দেখিতে পাইয়া তোমার বর্ণনামত উহাকে জল হইতে উঠাইয়াছিল। উহার বক্ষঃস্থলে ছুরী বিদ্ধ দেখিতে পাইয়া, সেই ছুরী উন্মোচিত করিয়া লইতেছিল, এবং সেই সময় তোমরা আসিয়া ইহাকে ধৃত করিয়াছ। এ অনুমান কি হইতে পারে না?
১ম ব্যক্তি। আপনার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। কোন কোন ব্যক্তির মুখে আমি পূর্ব্বে শুনিয়াছি, যে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হইলেই তাহার শরীরে আর রক্তের লেশমাত্রও অবশিষ্ট থাকে না। সত্য মিথ্যা জানি না, একথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে পুত্র আসিয়া এইস্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে বৃদ্ধের মৃত্যু হয় নাই। কারণ যখন উহার পুত্র আমাদিগের সম্মুখে উহার বক্ষঃস্থল হইতে ছুরী উন্মোচিত করিল, সেই সময় অধিক পরিমাণে রক্ত নির্গত হইতে আমরা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছি। ইহাতে আমার অনুমান হয় যে, ছুরী উন্মোচিত হইবার অতি সামান্যক্ষণ পূর্ব্বে সেই ছুরী বিদ্ধ হইয়াছিল। সুতরাং আমরা যখন অপর কোন লোককে সেই সময় সেইস্থানে দেখিতে পাই নাই, তখন সেই ছুরী পুত্র ভিন্ন অপর আর কাহারও দ্বারা বিদ্ধ হইয়াছে, ইহা আমার বিবেচনা হয় না।
আমি। তোমার অনুমানই যদি সত্য হয় এবং পুত্রই যদি পিতার বক্ষে ছুরী বিদ্ধ করিয়া থাকে, তাহা হইলে পুনরায় জল হইতে পিতাকে উঠাইয়া পুনরায় সেই ছুরী উন্মোচিত করিবার প্রয়োজন কি?
১ম ব্যক্তি। এই ছুরী যদি পুত্রের হয়, এবং মৃতদেহের সহিত এই ছুরী প্রাপ্ত হওয়ার পর অন্যান্য লোকের দ্বারা যদি প্রমাণিত হয় যে, এই ছুরী পুত্রের, তাহা হইলে পরিশেষে পুত্রকেই ধৃত হইতে হইবে; এই ভয়ে ভীত হইয়া বোধ হয়, সে ছুরী উন্মোচিত করিয়াছিল। আরও বোধ হয়, তাহার ইচ্ছা ছিল যে, এই ছুরী লইয়া সকলের অলক্ষ্যে এ এইস্থান হইতে প্রস্থান করিবে; কিন্তু ঈশ্বর ইহার সে বাঞ্ছা পূর্ণ করিতে দিলেন না। ছুরী উন্মোচন করিবার সময় আমাদিগের কর্তৃক ধৃত হইল।
আমি। আর একটি কথা—বৃদ্ধ যদি পশ্চাদ্দিক হইতে আক্রান্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে ছুরীর মুষ্টিকা তাহার সম্মুখে থাকিবে কেন? আর যদি সম্মুখ হইতেই কেহ তাহার বক্ষে এই ছুরী বিদ্ধ করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার চিৎ হইয়া পড়িবারই সম্ভাবনা। তবে এরূপ ঘটনায় বৃদ্ধ উপুড় হইয়া পতিত আছে, এইরূপ অবস্থায় উহাকে প্রাপ্ত হওয়া গেল কেন?
১ম ব্যক্তি। ইহা আর বিচিত্র কি? প্রথমেই হয় ত বৃদ্ধ চিৎ হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল। পরিশেষে যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া উঠিবার চেষ্টা করায় উপুড় হইয়া যাওয়া কোনরূপেই অসম্ভব নহে।
শেষ প্রশ্নের উত্তর প্রাপ্ত হইয়া উহাদিগকে আমি আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম না। পূর্ব্ব হইতে তাহারা যে স্থানে বসিয়াছিল, পুনরায় সেইস্থানে গিয়া উপবেশন করিল।
এই প্রবন্ধের পুলিস পাঠকগণকে বোধ হয়, আমার এইস্থানে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক যে, সেই ব্যক্তির মতামত সম্বন্ধে যে প্রশ্নগুলি আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহা আসামী ও অপরাপর ব্যক্তিগণের অগোচরে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যে ব্যক্তিগণ কর্তৃক হত্যাপরাধে সমসুদ্দিন ধৃত হইয়া ছিল, তাহাদিগের নিকট হইতে পূৰ্ব্ববর্ণিত অবস্থা সকল অবগত হইয়া আমি পুনরায় সেই কৰ্ম্মচারীকে কহিলাম, মহাশয়! ইহারা যে সকল বিষয় অবগত আছে, তাহা আমি শ্রবণ করিলাম। ইহা ব্যতীত আর কোন বিষয় আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছেন কি না, তাহাও জানিতে বাসনা করি।”
আমার কথার উত্তরে কর্মচারী কহিলেন, “ইহা ব্যতীত যে সকল বিষয় আমরা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাও এক এক করিয়া আপনার নিকট বলিতেছি। বৃদ্ধ জালালউদ্দিনের বাড়ীতে কেবলমাত্র একটি পরিচারিকা ভিন্ন আর কেহই থাকে না। সে নিতান্ত বৃদ্ধা না হইলেও অনুমানে বোধ হয়, তাহার বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরের ন্যূন নহে। তাহার নিকট হইতে আমরা কেবল এইমাত্র অবগত হইতে পারিয়াছি, যে, গত তিন চারি বৎসর হইতে জালালউদ্দীনের শরীর সুস্থ নহে, প্রায় প্রত্যহই জ্বর হইয়া তাহাকে সবিশেষ ক্লেশ প্রদান করিতেছে। তাহার উপর গত তিন চারি দিবস কিছুমাত্র আহার করেন নাই, অনশন করিয়াই প্রায় দিন অতিবাহিত করিতেছিলেন। অদ্য বৈকালে একটি বদনা হস্তে লইয়া ধীরে ধীরে বাড়ী হইতে বহির্গত হন। কি নিমিত্ত বা কোথায় যে গমন করিতেছেন, তাহা কিছুই বলিয়া যান না। তাঁহার প্রকৃতিই সেই প্রকারের ছিল, বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার সময় তিনি কখন কাহাকেও বলিয়া যাইতেন না যে, তিন কোথায় গমন করিতেছেন। অধিকন্তু গমনকালে যদি কেহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিত যে, তিনি কোথায় গমন করিতেছেন, এবং প্রত্যাগমন করিতে তাঁহার কত বিলম্ব হইবে, তাহা হইলে তিনি তাহার উপর একবারে খড়্গহস্ত হইতেন।
“জালালউদ্দীনের বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার অতি অল্পক্ষণ পরেই তাঁহার পুত্র সমসুদ্দিন হঠাৎ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। ইনি কলিকাতায় ছিলেন না, বোধ হয়, তাঁহার কর্ম্মস্থান হইতে তখনই বাড়ীতে আগমন করেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমেই সেই পরিচারিকাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁহার পিতা কোথায়? তাঁহার কথার উত্তরে পরিচারিকা কহে যে, তাঁহার পতি একটি বদ্না হস্তে করিয়া তখনই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন। পরে যে দিকে বৃদ্ধ গমন করিয়াছেন, তাহাও পরিচারিকা সমসুদ্দিনকে দেখাইয়া দেয়। পরিচারিকার নিকট এই সকল অবগত হইয়া সমসুদ্দিন তৎক্ষণাৎ সেইদিকে গমন করেন। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই জালালউদ্দীন হত হইয়াছেন, এবং সমসুদ্দিন তাঁহার পিতাকে হত্যা করিয়াছেন; এই কথা পাড়ার ভিতর প্রকাশ হইয়া পড়ে। কেবলমাত্র এই ব্যাপার আমরা সেই পরিচারিকার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইহা ব্যতীত যদি তাহাকে আরও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা করিতে পারেন। কারণ, সেই পরিচারিকাকেও আমরা এইস্থানে রাখিয়াছি।” এই বলিয়া তিনি সেই পরিচারিকাকে আমাদিগের নিকটে আসিতে কহিলেন। পরিচারিকা নিকটেই বসিয়াছিল, সে আদেশ পাইবামাত্র আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। উহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন জানিয়াও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কতদিবস জালালউদ্দীনের বাড়ীতে কর্ম্ম করিতেছ?”
পরিচারিকা। কতদিন তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু অনেক দিন সমসুদ্দিন আমার সম্মুখেই জন্মাইয়াছে, এবং আমার দেখতাই এত বড়টি হইয়াছে।
আমি। সমসুদ্দিনের জননী কতদিবস হইল, মরিয়া গিয়াছেন?
পরিচারিকা। অনেক দিবস, তখন সমসুদ্দিনের বয়স নিতান্ত কম।
আমি। ইহাকে প্রতিপালন করিয়া তবে এত বড়টি কে করিয়াছে?
পরিচারিকা। পিতাই উহাকে প্রতিপালন করিয়াছেন।
আমি। পিতা-পুত্রে সদ্ভাব কেমন?
পরিচারিকা। খুব।
আমি। আজ হঠাৎ সমসুদ্দিন বাড়ী আসিল কেন, তাহা বলিতে পার?
পরিচারিকা। না মহাশয়! তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। আজ সে যখন বাড়ীতে আগমন করিয়াছিল, তখন তাহার সহিত অপর আর কোন দ্রব্যাদি কিছু ছিল দেখিয়াছ?
পরিচারিকা। অপর আর কোন দ্রব্যাদি দেখি নাই। কেবলমাত্র একটি ব্যাগ দেখিয়াছি।
আমি। যখন সে তাহার পিতার অনুসন্ধান করিতে গমন করিতেছিল, তখন সেই ব্যাগ সে তাহার সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল কি?
পরিচারিকা। না। সেই ব্যাগ সে আমার হস্তে প্রদান করে। আমি উহা ঘরের ভিতর রাখিয়া দি। সে খালি হাতে গিয়াছিল।
আমি। যে ছুরীর দ্বারা তোমার মনিবকে হত্যা করা হইয়াছে, তাহা তুমি দেখিয়াছ?
পরিচারিকা। দেখিয়াছি।
আমি। এ কাহার ছুরী, তাহা তুমি বলিতে পার?
পরিচারিকা। না।
আমি। এ ছুরী তোমার মনিবের বাটীতে কখনও দেখিয়াছ বলিয়া বোধ হয়?
পরিচারিকা। না মহাশয়! ইহার পূর্ব্বে ঐ ছুরী আমি আর কখনও দেখি নাই।
পরিচারিকাকে এই কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার পর পূর্ব্বোক্ত কর্ম্মচারী মহাশয় অপর একটি লোককে ডাকাইলেন। ডাকিবামাত্র সে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন কর্ম্মচারী মহাশয় কহিলেন, “এই ব্যক্তি ইহার বাড়ীর সম্মুখে বসিয়াছিল, সেই সময়ে এ ব্যক্তি জালালউদ্দীনকে একটি বদ্াহস্তে করিয়া তাহার বাড়ীর সম্মুখ দিয়া দীঘির দিকে গমন করিতে দেখিয়াছে। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই বৃদ্ধের পুত্র সমসুদ্দিনও সেইদিকে গমন করিয়াছিল, এবং গমনকালে এই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, সে তাহার পিতাকে কোনদিকে গমন করিতে দেখিয়াছে, কি না। উত্তরে সেই ব্যক্তি বলিয়া দেয় যে, সে তাহার পিতাকে দীঘি-অভিমুখে গমন করিতে দেখিয়াছে। উহার কথা শ্রবণ করিয়া সমসুদ্দিন দীঘি-অভিমুখে গমন করে, এবং তাহার গমন করিবার অতি অল্প সময় পরেই জালালউদ্দীনের হত্যা-সংবাদ চতুৰ্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।”
কর্ম্মচারীর প্রমুখাৎ এই সকল কথা অবগত হইয়া সেই ব্যক্তিকে আর অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিলাম। তথাপি কেবল একটিমাত্র প্রশ্ন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম। উহার সারমর্ম্ম এইরূপ:—
“যে সময় সমসুদ্দিন তাহার পিতার অনুসন্ধানে গমন করিয়াছিল, তখন তাহার হস্তে ছুরী বা অপর কোন দ্রব্য ছিল কি না?” উত্তরে সেই ব্যক্তি কহিল, “সমসুদ্দিনের নিকট আমি সেই সময় কোন দ্রব্যই দেখিতে পাই নাই।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কর্মচারী মহাশয়ের নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, সমসুদ্দিনের বিরুদ্ধে পূর্ব্ববর্ণিত প্রমাণ ব্যতীত এ পৰ্য্যন্ত অপর আর কোনরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হয় নাই, এবং অপর আর কোনরূপ প্রমাণ যে সহজে সংগৃহীত হইতে পারিবে, সে ভরসাও নাই। কারণ, অনেক কর্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন, তাঁহারাও সকলেই সবিশেষরূপে চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছেন; কিন্তু ঘটনাস্থলের প্রমাণ এ পর্যন্ত কেহই আর কোনরূপ সংগ্রহ করিতে পারেন নাই।
যে অপরাধে সমসুদ্দিন ধৃত হইয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে সে নিজে কতদূর স্বীকার করে, তখন তাহাই জানিবার ইচ্ছা হইল। যে স্থানে আমরা উপবিষ্ট ছিলাম, সমসুদ্দিন সেইস্থান হইতে একটু দূরে রক্ষিত ছিল। তাহাকে নিকটে আনাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি নিমিত্ত তুমি আপন পিতাকে হত্যা করিলে?” উত্তরে সমসুদ্দিন কহিল, “আপন পিতাকে আমি হত্যা করিব কেন? বিনাকারণে আপনারা আমাকে পিতৃ-হত্তা স্থির করিয়া লইয়াছেন কিরূপে?”
আমি। যেরূপ অবস্থায় তুমি ধৃত হইয়াছ, সেরূপ অবস্থায় কে বলিবে যে, তুমি পিতৃ-হস্তা নহ?
সমসুদ্দিন। তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি ও বুঝিতে পারিয়াছি বলিয়াই, বাক্শক্তি বিরহিতের ন্যায় একপার্শ্বে বসিয়া আছি। দেখিতেছি যে, বিনাদোষে ঈশ্বর আমার অদৃষ্টে কিরূপ দণ্ডপ্রদান করেন।
আমি। তবে কি তুমি বলিতে চাহ যে, তুমি তোমার পিতৃ-হত্যা সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ?
সমসুদ্দিন। আমি মনে মনে বেশ জানি যে, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ পাপ নাই; কিন্তু আমার কথা কে বিশ্বাস করিবে?
আমি। তুমি প্রকৃতকথা বলিলে অবশ্যই তোমার কথায় সকলের বিশ্বাস হইবে। তুমি কিরূপ অবস্থায় হঠাৎ কলিকাতায় আগমন করিলে, কেনই বা তুমি তোমার পিতার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলে, এবং কেনই বা তুমি তোমার পিতার বক্ষঃস্থল হইতে ছুরী উন্মোচিত করিলে? এ সকল বিষয় তুমি আমাদিগকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দাও, তাহা হইলে আমরা বুঝিতে পারিব যে, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা প্রকৃত, কি না?
সমসুদ্দিন। আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস করুন বা না করুন, যেরূপ অবস্থায় পড়িয়া আমি ধৃত হইয়াছি, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ আমি আপনাদের নিকট বর্ণন করিতেছি। আপনারা অনুসন্ধান করিয়া বোধ হয়, অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, আমার নিতান্ত শৈশবাবস্থায় আমার মাতা ইহজীবন পরিত্যাগ করেন। সংসারে অপর কেহ না থাকায় পিতাই আমাকে প্রতিপালন করিয়াছেন, এবং তাঁহারই প্রসাদে যৎসামান্য লেখাপড়া শিখিয়া আপনার জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিতে সমর্থ হইয়াছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ সর্ব্বদা তাঁহার নিকটে থাকিয়া তাঁহার চরণ দর্শন করিতে সমর্থ হই নাই। কাৰ্য্যোপলক্ষে প্রায় সর্ব্বদাই আমাকে মফঃস্বলে নানাস্থানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়। সুযোগ পাইলে মধ্যে মধ্যে আসিয়া পিতাকে দর্শন করিয়া যাই সত্য; কিন্তু সে সুযোগ অতি বিরল। গত কল্য হঠাৎ পিতার একখানি পত্র আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইল। এই পত্র পাঠ করিয়া অবগত হইলাম যে, তিনি অসুস্থ ও তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা যে, এই সময় একবার তিনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। এই মর্ম্মের পত্র পাইয়া যাঁহার অধীনে আমি কৰ্ম্ম করিয়া থাকি, তাঁহার নিকট অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া কেবলমাত্র তিন দিবসের ছুটি পাইলাম। ছুটি পাইবামাত্র সেইস্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া কেবলমাত্র একটি ব্যাগ লইয়া কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইলাম। বাটীতে আসিয়া পিতাকে দেখিতে পাইলাম না। পরিচারিকার নিকট অবগত হইলাম যে, কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমার পিতা বাটী হইতে বহির্গত হইয়া দীঘি-অভিমুখে গমন করিয়াছেন। পিতাকে দেখিবার নিমিত্ত আমার মন এতই ব্যস্ত হইয়াছিল যে, তাঁহার অপেক্ষায় তাঁহার বাটীতে প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত প্রতীক্ষা করিতে না পারিয়া পরিচারিকার নির্দ্দেশ অনুযায়ী দীঘি অভিমুখে আগমন করিলাম। দীঘির সন্নিকটবর্তী হইবার সময় একটি লোকের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, কিঞ্চিৎ পূৰ্ব্বে পিতা প্রকৃতই সেই দীঘি-অভিমুখে গমন করিয়াছেন। এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি আরও দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলাম। ক্রমে দীঘির ধারে আসিয়া উপনীত হইল। দূরবর্তী একটি লোকের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। বোধ হইল, সেই ব্যক্তি এই দীঘির জলের সন্নিকটে যেন হঠাৎ পতিত হইল। আমি উহাকে উঠাইবার নিমিত্ত দ্রুতবেগে ওইস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। যে ব্যক্তি পড়িয়া গিয়াছিল দেখিলাম, তাহার অবয়বের কিয়দংশ মৃত্তিকার উপর ও কিয়দংশ জলের ভিতর। তখন পর্যন্তও আমি জানিতে পারি নাই যে, আমার পিতারই এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে। আমি উঁহাকে যখন জল হইতে উঠাইলাম, তখনই দেখিলাম, ইনিই আমার পিতা। আরও দেখিলাম, উহার বক্ষঃস্থলে একখানি ছুরী বিদ্ধ রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে যে কি ভয়ানক ভাবের উদয় হইল, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি হিতাহিত-জ্ঞান-বৰ্জ্জিত হইয়া তখন যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পিতার বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ সেই ছুরী আমি যেমন উন্মোচন করিলাম, অমনি সেই ক্ষতস্থান হইতে আরও অধিক পরিমাণে রক্ত বাহির হইয়া সেইস্থান পূর্ণ করিল, এবং সেই রক্ত দীঘির জলে পড়িয়া সেইস্থানের জল রক্তবর্ণ করিয়া তুলিল। আমার পিতাও সেইস্থানে চিরদিবসের মত শয়ন করিলেন। এই সময় দুই তিন জন লোক আসিয়া আমাকে ধৃত করিল, এবং আমার দ্বারা যে এই হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হইয়াছে, তাহা চতুর্দ্দিকে প্রচার করিয়া দিল। ইহাই আমি জানি। ইহা ব্যতীত যদি আরও কিছু আমার সেইস্থানে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে ঘটিয়া থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। সুতরাং সে বিষয়ে আমি কিছু বলিতে পারিব না।
এই বলিয়া সমসুদ্দিন নীরব হইল।
আমি। যে ছুরী তুমি তোমার পিতার বক্ষঃস্থল হইতে উন্মোচিত করিয়াছিলে, সে ছুরী কাহার?
সমসুদ্দিন। এ ছুরী যে কাহার, তাহা আমি বলিতে পারি না। ইহার পূর্ব্বে এই ছুরী আমি আর কখনও দর্শন করি নাই।
আমি। দূর হইতে তুমি তোমার পিতাকে পতিত হইতে দেখিয়াছ, সেই সময় সেইস্থানে অপর কোন ব্যক্তিকে তুমি দেখিতে পাইয়াছিলে?
সমসুদ্দিন! না। আমি অপর আর কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।
আমি। যদি সেই সময় সেইস্থানে অপর কোন লোক উপস্থিত ছিল না, তাহা হইলে এই হত্যা যে তোমার দ্বারা হয় নাই, তাহার প্রমাণ কি?
সমসুদ্দিন। প্রমাণই যদি করিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমার এ দুর্দ্দশা হইবে কেন?
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কর্ম্মচারী মহাশয়ের নিকট হইতে আরও অবগত হইলাম যে, পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব পরিচ্ছেদে আসামীর বিপক্ষে যে সকল প্রমাণের কথা তিনি আমার নিকট উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা ব্যতীত এ পর্যন্ত আর কোন প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। আরও কোন প্রমাণ যে সহজে সংগৃহীত হইবে, তাহাও তাহার বোধ হয় না।
এইরূপ অবস্থায় সেই সকল প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়াই সমসুদ্দিনকে এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক স্থির করা হইল। সেই সময় সেইস্থানে পুলিসের নিয়মিতরূপ অন্যান্য অনুসন্ধান শেষ করিয়া কৰ্ম্মচারীমাত্রই আপন আপন কাৰ্য্যে প্রস্থান করিলেন। আমিও সেইদিবস আপনার নির্দিষ্ট স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম।
সমস্ত রাত্রির মধ্যে অপর আর কোন কার্য্যে আমাকে হস্তক্ষেপ করিতে না হইলেও, সে রাত্রিতে গভীর নিদ্রায় সুষুপ্তি সুখ অনুভব করিতে পারিলাম না। সমসুদ্দিন সম্বন্ধীয় নানাকথা মনে উদিত হইয়া নিদ্রার অতিশয় ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। ভাবিলাম, যেরূপ অবস্থায় সমসুদ্দিন ধৃত হইয়াছে, তাহাতেই বা কেমন করিয়া বলিব যে, এই হত্যাকাণ্ড তাহার দ্বারা সাধিত হয় নাই। অথচ তাহার অবস্থা যতদূর অবগত হইতে পারা যায়, তাহাতে পরিষ্কার জানা যাইতেছে যে, পিতার সহিত তাহার শত্রুতা থাকা দূরে থাকুক, বরং বিলক্ষণরূপ মিত্রতা ভাবেরই অনুমান হয়। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যই বা কি, তাহার অণুমাত্রও এ পর্যন্ত নির্ণীত হয় নাই। যে পুত্রকে পিতৃভক্ত বলিয়া বোধ হইতেছে, যাহার চরিত্র বিশিষ্টরূপে অনুসন্ধান করিয়াও কোন প্রকার দোষযুক্ত লক্ষিত হইতেছে না, সেই বা পিতৃ হত্যা করিয়া চিরদিবসের নিমিত্ত আপনাকে অসুখী করিবে কেন? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তার পর আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত করিলাম যে, সমসুদ্দিনের বিপক্ষে যতই কেন প্রমাণ থাকুক না; আমি কিন্তু একবার ভালরূপে চেষ্টা করিয়া দেখিব, এই হত্যা-ব্যাপারে সমসুদ্দিন নির্দোষ কি না। আর যদি তাহাকে নির্দোষই সাব্যস্ত করিতে পারি, তাহা হইলে এই হত্যা কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহাও জানিবার নিমিত্ত কোনরূপ চেষ্টার ত্রুটি করিব না।
পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি পুনরায় ঘটনাস্থলে অর্থাৎ যে স্থানে জালালউদ্দীন হত এবং সমসুদ্দিন ধৃত হইয়াছিল, সেইস্থানে গিয়া উপনীত হইলাম। পূৰ্ব্বদিবস আমি সেই স্থানে গিয়াছিলাম সত্য কিন্তু সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া পাড়ার ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম না। আজ কিন্তু প্রথমেই পাড়ার ভিতর প্রবেশ করিলাম। পাড়ার ভিতর প্রবে করিয়া এ-স্থান ও-স্থান করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। আমার ইচ্ছা—প্রতিবেশীবর্গ এই হত্যাসম্বন্ধে কিরূপ অভিমত প্রকাশ করে, তাহা যে কোন প্রকারে জানিতে পারি। পাড়ার ভিতর ভ্রমণ করিতে করিতে অনেকের মুখে অনেক কথা শুনিতে পাইলাম। কেহ বলিতেছে, সমসুদ্দিনই পিতাকে হত্যা করিয়াছে। কেহ বলিতেছে, অপর আর কোন ব্যক্তি কর্তৃক জালালউদ্দীন হত হইয়াছে, হত্যার পর সমসুদ্দিন সেইস্থানে আগমন করায় ধৃত হইয়া বিনাদোষে হাজতে গিয়াছে। এইরূপ নানাজনের মুখে নানাকথা শ্রবণ করিয়া আমি সেইস্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিতেছি, সেই সময় সম্মুখেই একজন পরিচিত মুসলমানকে দেখিতে পাইলাম। ইনি বহুদিবস হইতে আমার নিকট পরিচিত হইলেও ইহার বাসস্থান যে কোথায়, তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করায় আজ জানিতে পারিলাম যে, সেই দীঘির অতি নিকটে তাঁহার বাসস্থান। এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া তাঁহার সঙ্গে তাঁহার বাড়ীতে গমন করিলাম। তিনি যত্নের সহিত আমাকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গিয়া তাঁহার দলিজে আমাকে বসিতে দিলেন, এবং তিনি আমার নিকট উপবেশন করিলেন। প্রথমতঃ আমাদিগের মধ্যে অন্যান্য অনেক কথা হইল ও পরিশেষে এই হত্যা-সম্বন্ধীয় কথা আসিয়া পড়িল। তাঁহার সহিত কথোপকথনে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, হত্যাকারী সম্বন্ধে তাঁহারও মনে বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। তাঁহার বিশ্বাস যে, সমসুদ্দিন তাহার পিতাকে হত্যা করে নাই।
আমার এই পরিচিত ব্যক্তির আন্তরিক বিশ্বাসের কথা জানিতে পারিয়া আমার পূর্ব্ব সন্দেহ আরও দৃঢ়মূল হইল। তখন আমি তাঁহাকে কহিলাম, “দেখ ভাই! সমসুদ্দিনের কোন দোষ নাই, ইহাই যদি তোমার বিশ্বাস হইয়া থাকে, তাহা হইলে এ কাৰ্য্য কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহাও অবগত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু সেই কার্য্য তোমার দ্বারা যত সহজে সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা, আমাদিগের দ্বারা তত সহজে কিছুতেই সম্পন্ন হইতে পারিবে না। কারণ, এ প্রদেশীয় পুলিসের উপর প্রজাবর্গের সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস না থাকায় সহজে কেহ কখন কোন কথা পুলিসের নিকট বলিতে সাহসী হয় না। এরূপ অবস্থায় বল দেখি, এই স্থানের অধিবাসীবর্গ অকপটচিত্তে তোমার নিকট যে সকল কথা বলিবে, সেই সকল কথা আমাকে বিশ্বাস করিয়া প্রকাশ করিয়া বলিবে কি? কখনই না। এই হত্যাকাণ্ড তোমার বাড়ীর অতি সন্নিকটে ঘটিয়াছে। সুতরাং যদি কেহ কিছু দেখিয়া থাকে, তাহা তোমার প্রতিবেশীবর্গের মধ্যেই কোন না কোন ব্যক্তি হইবে। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি একটু চেষ্টা কর, তাহা হইলে তোমার প্রতিবেশীবর্গের মধ্যে যদি কেহ কিছু অবগত থাকেন, তাহা নিশ্চয়ই তুমি জানিতে পারিবে।”
উত্তরে সেই পরিচিত ব্যক্তি কহিলেন, “আপনার এই কর্ম্মের নিমিত্ত আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব, এবং যদি কিছু অবগত হইতে পারি, তৎক্ষণাৎ তাহা আপনার নিকট সংবাদ দিব।”
ইঁহার কথায় আমি অতীব সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান পূর্ব্বক সেই সময় সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া দীঘির একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্তে গমন করিলাম। এবং সেইস্থানের পল্লীর ভিতর প্রবেশ করিয়া যদি কাহারও নিকট কোন সংবাদ প্রাপ্ত হই, এই আশায় নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কিন্তু আমার মনোরথ সিদ্ধ হইল না। এইরূপে সেইস্থানে ভ্রমণ করিতে করিতে ক্রমে আরও দুই তিন জন পরিচিত লোকের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তাঁহারাও যদি কোনরূপে আমাকে সাহায্য করিতে পারেন, এই আশায় আমার মনের ভাব তাঁহাদিগের নিকটও প্রকাশ করিলাম। তাঁহারাও তাঁহাদিগের সাধ্যমত চেষ্টা দেখিবেন বলিয়া আমাকে বাক্যদান করিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
যে পরিচিত ব্যক্তির সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেইদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে পুনরায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। আমাকে দেখিবামাত্র তিনি ডাকিলেন, ও আমাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার দলিজে গমন করিলেন। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে তিনি কহিলেন, যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনি আমার উপর ভারার্পণ করিয়া গিয়াছিলেন, তাহার নিমিত্ত আমি সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি, এবং এইস্থানের প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি; কিন্তু এই পর্যন্ত সবিশেষ কোন কথাই প্রাপ্ত হই নাই। তবে আমার প্রতিবেশী আবদুল নামক এক ব্যক্তির নিকট হইতে কেবলমাত্র একটি কথা জানিতে পারিয়াছি। কিন্তু তাহা যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কথা বা সেই কথার উপর নির্ভর করিয়া আমরা যে বিশিষ্ট কোনরূপ উপকার প্রাপ্ত হইব, তাহা বোধ হয় না। সুতরাং তাহা আপনার নিকট বলিবারও বোধ হয়, ততদূর প্রয়োজন নাই। তবে যদি আপনারা সামান্য কথাতেই কোন কথা বাহির করিতে পারেন, তবে শুনিতে পারেন।
আমি। উপকার হউক বা না হউক, সে বিষয় পরে দেখা যাইবে। কিন্তু আবদুল তোমাকে কি বলিয়াছে, তাহা আমার নিকট বলিতে তোমার কোন প্রতিবন্ধক আছে কি?
পরিচিত ব্যক্তি। আপনার নিকট কোন কথা প্রকাশ করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। তবে আমার মতে তাহা কোন প্রয়োজনীয় কথা নহে বলিয়া আপনাকে বলি নাই। যদি জানিতে চাহেন বলিতেছি –শ্রবণ করুন। আবদুল বলিতেছিল যে, যে সময় সমসুদ্দিন তাহার পিতাকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হয়, সেই সময় দীঘির নিকট অপর কোন ব্যক্তি ছিল না, কেবলমাত্র লালচাঁদ নামক এক ব্যক্তি জলের ভিতর ছিল। যেমন দীঘির একদিকে সমসুদ্দিন ধৃত হইল, অমনি লালচাঁদ সন্তরণে সেই দীঘি পার হইয়া অপর দিকে গিয়া উঠিল, এবং সেইস্থান হইতে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিল।
আমি। এই ঘটনা আবদুল নিজচক্ষে দেখিয়াছে, কি অপর কাহারও নিকট শ্রবণ করিয়াছে?
পরিচিত ব্যক্তি। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। কারণ, আমি তাহা আবদুলকে জিজ্ঞাসা করি নাই।
আমি। আবদুল থাকে কোথায়?
পরিচিত ব্যক্তি। সে আমার প্রতিবেশী, নিকটেই থাকে।
আমি সে যাহা অবগত আছে, তাহা আমার নিকট বলিবে কি?
পরিচিত ব্যক্তি। আপনার নিকটে না বলিবার কোন কারণ আমি দেখি না।
আমি। যদি সে আমার নিকট প্রকৃতকথা বলিতে সঙ্কুচিত না হয়, তাহা হইলে তাহার নিকট গমন করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে হয় না?
পরিচিত ব্যক্তি। তাহাকে যদি আপনি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহাতে কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু তাহার নিকট গমন করিবার কোন প্রয়োজন নাই। আপনি এইস্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহার বাড়ীতে গমন করিয়া দেখি, সে এখন বাড়ীতে আছে কি না। যদি আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়, তাহা হইলে আমি তাহাকে এইস্থানে আনয়ন করিতেছি।
এই বলিয়া তিনি দলিজ হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। আমি সেইস্থানেই বসিয়া রহিলাম, এবং বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম যদি আবদুলের কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে, লালচাঁদই কি জালালউদ্দীনকে হত্যা করিয়া সন্তরণে দীঘি পার হইয়া প্রস্থান করিল; আর সমসুদ্দিন বিনাদোষে ধৃত হইয়া কারাগারে আবদ্ধ হইল?
আমি সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় দেখিলাম যে, পরিচিত ব্যক্তি আবদুলকে সঙ্গে লইয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং আমাকে কহিলেন, “ইহার নাম আবদুল। ইনি আমার একজন আত্মীয়। ইনি যাহা অবগত আছেন, তাহা কখন গোপন করিবেন না, বা মিথ্যা কথা বলিবেন না। আপনি ইহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।”
আমি। মহাশয়ের নাম আবদুল?
আবদুল। হাঁ মহাশয়! আমার নাম আবদুল সেখ।
আমি। যে দিবস জালাল উদ্দীন হত হয়, সেইদিবস আপনি কোথায় ছিলেন?
আবদুল। এইস্থানেই ছিলাম। আমার দলিজে বসিয়া দেখিতেছিলাম।
আমি। যে সময় সমসুদ্দিন ধৃত হয়, সেই সময় আপনি আপনার দলিজে ছিলেন?
আবদুল। হাঁ মহাশয়! সেই সময় আমি দলিজেই ছিলাম।
আমি। যে সময় সমসুদ্দিন ধৃত হয়, সেই সময় ধৃতকারী ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিকে আপনি সেইস্থানে বা তাহার নিকটবর্তী অন্য কোন স্থানে দেখিতে পাইয়াছিলেন কি?
আবদুল। ঠিক সেইস্থানে আমি কাহাকেও দেখিতে পাই নাই। কিন্তু লালচাঁদ নামক এক ব্যক্তিকে ঠিক সেই সময় সাঁতার দিয়া দীঘি পার হইতে আমি দেখিয়াছি।
আমি। ঠিক কোন্ সময়ে তাহার উপর আপনার প্রথম নজর পড়ে?
আবদুল। সমসুদ্দিনকে ধৃত করিয়া ধৃতকারীগণ যখন গোলমাল করে, সেই সময়ে সেইদিকে আমার নয়ন প্রথম আকৃষ্ট হয়; সেই সময় আমি দেখিতে পাই। লালচাঁদ সাঁতার দিয়া অপর পারে গমন করিতেছে।
আমি। অপর পারে উঠিয়া লালচাঁদ কি করিল, বলিতে পারেন কি?
আবদুল। কিনারায় উঠিয়া আস্তে আস্তে সেইস্থান হইতে পাড়ার ভিতর প্রস্থান করিল।
আমি। ইহার পর সেইদিবস লালচাঁদকে আপনি আর দেখিয়াছিলেন কি? যদি দেখিয়া থাকেন, তাহা কোথায় দেখিয়াছেন, মনে হয় কি?
আবদুল। আমার যতদূর মনে আছে, তাহাতে বোধ হয়, যখন পাড়ার সকলেই গিয়া হত্যার স্থানে উপস্থিত হয়, সেই সময় লালচাঁদও সেইস্থানে গিয়াছিল। আমি তাহাকে সেইস্থানেও দেখিতে পাইয়াছিলাম।
আমি। লালচাঁদ কোথায় থাকে, বলিতে পারেন কি?
আবদুল। দীঘির অপর পার্শ্বে, অর্থাৎ সাঁতার দিয়া যে তীরে লালচাঁদ উঠিয়াছিল, এবং যে পাড়ার ভিতর সে গমন করিয়াছিল, সেই পাড়ার ভিতর একখানি ঘরে বাস করিয়া থাকে।
আমি। কি কার্য্য দ্বারা সে তাহার জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে?
আবদুল। অতি নীচ কাৰ্যই করিয়া থাকে। বোধ হয় মুটিয়াগিরি করিয়া থাকে।
আমি। সে কোন্ দেশীয় লোক?
আবদুল। আমার বোধ হয়, সে পূৰ্ব্বদেশীয় লোক হইবে।
আমি। আপনি তাহার বাড়ী চিনেন বোধ হয়?
আবদুল। চিনি।
আমি। আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া লালচাঁদকে একবার আমাকে দেখাইয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে সবিশেষ উপকৃত হই।
আবদুল। দেখাইয়া দেওয়া পরের কথা, আপনি এইস্থানে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা সেইস্থানে গমন করিয়া দেখি, লালচাঁদ বাসায় আছে কি না? যদি তাহাকে দেখিতে পাই, তাহা হইলে তাহাকে আপনার নিকট লইয়া আসিতেছি। তাহাকে আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা এইস্থানে বসিয়াই জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন।
এই বলিয়া আমার সেই পরিচিত ব্যক্তি ও আবদুল উভয়েই লালচাঁদের অনুসন্ধানে গমন করিলেন। আমি একাকী সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া নানাপ্রকার ভাবিতে লাগিলাম। আন্দাজ অর্দ্ধঘণ্টা পরে উহারা লালচাঁদকে সঙ্গে করিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “মহাশয় আপনি যে লালচাঁদের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, এ-ই সেই লালচাঁদ। আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, ইহাকে তাহা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।”
আমি। তোমার নাম লালচাঁদ?
লালচাঁদ। হাঁ মহাশয়! আমারই নাম লালচাঁদ সেখ।
আমি। যে সময় জালালউদ্দীন হত হয়, সেই সময় তুমি দীঘিতে কি করিতে গমন করিয়াছিলে?
লালচাঁদ। মহাশয় আমরা গরিব লোক। সমস্ত দিবস মজুরি করিয়া আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকি। যে কার্য্য করি, তাহাতে কার্য্যাত্তে স্নান না করিলে কোনরূপেই চলে না। আমি আমার কার্য্য হইতে প্রত্যাগমন করিয়া নিয়মিতরূপ দীঘিতে স্নান করিতে গিয়াছিলাম। স্নান করিতে করিতে হঠাৎ সাঁতার দিবার ইচ্ছা হইল, সুতরাং সাঁতার দিতে দিতে প্রায় দীঘির অর্দ্ধেক গমন করিলাম। সেই সময় দেখিলাম যে, দুই তিন জন লোক দ্রুতবেগে আগমন করিয়া সমসুদ্দিনকে ধৃত করিল, এবং সে তাহার পিতাকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া গোলযোগ করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি যে ঘাটে স্নান করি, সাঁতার দিয়া সেই ঘাটে প্রত্যাগমন করিলাম, এবং দ্রুতপদে জল হইতে উঠিয়া আপন বাসায় গমন করিলাম। সেইস্থানে অগ্রে বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছিল, তাহার অবস্থা দেখিবার নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, তখন সেইস্থান লোকে লোকারণ্য হইয়া গিয়াছে। এই ত মহাশয় আমি অবগত আছি, ইহা ব্যতীত আমি আর কিছুমাত্র অবগত নহি।
লালচাঁদের কথা শ্রবণ করিয়া, তাহার উপর পূর্ব্বে আমার যে সন্দেহের উদয় হইয়াছিল, তাহা অনেক দূর হইল। কিন্তু তাহাকে লইয়া তাহার কথার সত্যাসত্য জানিবার নিমিত্ত একটু অনুসন্ধান করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া লালচাঁদের কথা প্রকৃত বলিয়া প্রমাণিত হইলে তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিলাম। সে হৃষ্টমনে আপন স্থানে প্রস্থান করিল। আমিও সেই দিবসের নিমিত্ত আপন স্থানে গমন করিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিয়া সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। কিন্তু সে রাত্রিতেও ভালরূপ নিদ্রা হইল না। সেই মোকদ্দমা সম্বন্ধে নানাকথা মনে উদিত হইয়া সম্পূর্ণরূপে নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইল। এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন কি না, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। প্রয়োজন হইলেই বা কেন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া আবশ্যক, তাহাও মনে মনে চিন্তা করিলাম; কিন্তু অপর কোন পন্থাই সম্মুখে দেখিতে পাইলাম না। অনেক চিন্তার পর হঠাৎ মনে হইল,—যে অস্ত্র দ্বারা বৃদ্ধ জালালউদ্দীন হত হইয়াছে, সেই অস্ত্র সম্বন্ধে এ পর্যন্ত কোনরূপ অনুসন্ধানই হয় নাই। সেই ছুরী সমসুদ্দিন কোথা হইতে প্রাপ্ত হইল, তাহা যদি জানিতে পারা যায় এবং অব্যবহিত পূর্ব্বে সেই ছুরী সমসুদ্দিনের অধিকারে ছিল, ইহা যদি প্রমাণিত হয়, তাহা হইলে সমসুদ্দিন কর্তৃক যে এই হত্যা সংসাধিত হইয়াছে, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিবে না। আমাদিগের অন্তঃকরণে সমসুদ্দিন সম্বন্ধে সময় সময় যে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে, তখন জানিব, আমাদিগের সেই সন্দেহ সম্পূর্ণরূপ অমূলক।
অপরদিকে অনুসন্ধানে যদি তাহার বিপরীত ফল হয়, অর্থাৎ সেই ছুরী কখনও যে সমসুদ্দিনের হস্তে পতিত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া না যায়; কিম্বা সেই ছুরী অপর কোন ব্যক্তির অধিকারে ছিল, এবং তাহার নিকট হইতে উহা সমসুদ্দিনের প্রাপ্ত হইবার কোনরূপ সুযোগ নাই, তাহা হইলে আমাদিগের মনের সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইবে। তখন বুঝিব যে, পিতৃ-হত্যা অপরাধে সমসুদ্দিন ধৃত হইলেও, সেই অপরাধ তাহা-কর্তৃক কৃত হয় নাই,—সে বাস্তবিক বিনাদোষে ধৃত হইয়া হাজতে গিয়াছে। আর যে ব্যক্তি হত্যা করিয়াছে, সে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতেছে।
এই প্রকার চিন্তার পর মনে মন স্থির করিলাম যে, প্রত্যূষেই সেই ছুরী লইয়া পুনরায় ঘটনাস্থলে গমন করিব, এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে চেষ্টা করিব যে, যে ছুরীর দ্বারা জালালউদ্দীন হত হইয়াছে, সেই ছুরী কাহার?
রাত্রিকালে মনে মনে যেরূপ সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, পরদিবস অতি প্রত্যূষে তাহাই করিলাম। যে ছুরী দ্বারা জালালউদ্দীন হত হইয়াছিল, সেই ছুরীখানি হস্তে করিয়া সেই দীঘির পারে গমন করিলাম। জালানউদ্দীনের বাড়ীতে যে একজন পরিচারিকা ছিল, সেই ছুরীখানি প্রথমে তাহাকে দেখাইলাম। সেই ছুরী দেখিবামাত্র সে নিতান্ত ভীতা হইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, এবং কম্পিত হৃদয়ে আমাদিগের নিকট হইতে দূরে গমন করিয়া আমাদিগকে পশ্চাতে করিয়া দাঁড়াইল। সেই ছুরীখানি তাহাকে একবার দেখিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিলাম; কিন্তু আমাদিগের সেই অনুরোধ রক্ষিত হইল না। সেই ছুরীর দিকে তাহার দৃষ্টি কিছুতেই ফিরাইতে পারিলাম না। সেই ছুরী আর না দেখিয়াই সে বার বার বলিতে লাগিল, “আমি এই ছুরী কখন দেখি নাই, উহা আমাদিগের ছুরী নহে।”
পরিচারিকার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, ছুরী সম্বন্ধে সে কোন কথা অবগত নহে, এবং সে এরূপ ভীত হইযাছে যে, তাহার নিকট হইতে কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা নাই।
এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমরা সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া আমার সেই পরিচিত ব্যক্তির নিকট গমন করিলাম। তাঁহাকে সেই ছুরীখানি দেখাইলাম, এবং আমার অভিসন্ধির বিষয় তাঁহাকে কহিলাম। তিনি এ বিষয়ে যথাসাধ্য আমাকে সাহায্য করিবেন বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলেন।
ইতিপূর্ব্বে দীঘির অপর দিকে আমার পরিচিত অপর দুই তিন ব্যক্তির সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, একথা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। তাহাদিগের মধ্যে একজনের নাম সেখ তালেবালি। আমি পরিশেষে তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া তালেবালির সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমাকে দেখিবামাত্র তালেবালি কহিল, “কৈ মহাশয়! আপনি আমাদিগের নিকট আগমন করিবেন বলিয়া সে দিবস চলিয়া গেলেন; কিন্তু তাহার পর আর এদিকে একবারের নিমিত্তও আসিলেন না।”
আমি। কার্য্যের গতিতে আমি আর এদিকে আসিতে পারি নাই, বা আপনার সহিত আর সাক্ষাৎ করিতেও সমর্থ হই নাই। কেন মহাশয়! কোন সংবাদ পাইয়াছেন কি?
তালেবালি। এমন কিছু সংবাদ পাই নাই। তবে
আমি। তবে কি? তাহার অর্থই আপনি কোন নূতন কথা প্রাপ্ত হইয়াছেন কি? যদি জানিতে পারিয়াছেন, তবে অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি?
তালেবালি। ইহার ভিতর অনুগ্রহের বিষয় কিছুই নাই।
একে আপনি বহুপূর্ব্ব হইতে আমার নিকট পরিচিত। তাহার উপর এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারি, তাহার নিমিত্ত আপনি উপরোধ করিয়া গিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আমি যদি কিছু অবগত হইতে পারিয়াই থাকি, তাহা আপনাকে বলিব না কি? অবশ্যই বলিব। বলিতে কোন বাঁধা নাই। কিন্তু আমি যাহা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহা বলিবার পূর্ব্বে আপনাকে দুই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে চাহি।
আমি। আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। আমি যতদূর অবগত আছি, তাহা আপনাকে তখনই কহিব।
তালেবালি। যে ছুরী দ্বারা জালালউদ্দীন হত হইয়াছে, সেই ছুরী আপনি স্বচক্ষে উত্তমরূপে দেখিয়াছেন কি?
আমি। খুব ভালরূপে দেখিয়াছি।
তালেবালি। উহা কি প্রকারের ছুরী, তাহা বিশেষ করিয়া আমাকে বলুন দেখি?
আমি। ছুরীর অবস্থা বর্ণন করিবার প্রয়োজন কি? তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?
তালেবালি। সেই ছুরীখানি কি প্রকারের, তাহা আমি জানিতে চাহি।
আমি। ছুরীর অবস্থা বর্ণন না করিয়া যদি আমি উহা আপনাকে দেখাইতে পারি, তাহা হইলে আপনার অভীষ্টসিদ্ধ হইতে পারে কি?
তালেবালি। যদি আমি ছুরীখানি স্বচক্ষে দেখিতে পাই, তাহা হইলে আরও উত্তম হয়। সেই ছুরীখানি এখন কোথায় আছে?
আমি। উহা এখন আমারই নিকট আছে।
এই বলিয়া আমার সমভিব্যাহারী যে ব্যক্তির নিকট আমি সেই ছুরী রাখিয়াছিলাম, তাহার নিকট হইতে উহা গ্রহণ করিয়া তালেবালির হস্তে প্রদান করিলাম। তালেবালি সেই নরঘাতী অস্ত্র আপন হস্তে লইয়া অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত উত্তমরূপে দেখিলেন, ও পরিশেষে কহিলেন, “ঠিক হইয়াছে, এই ছুরীই বটে।”
তালেবালির কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে একটু আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম যে, তালেবালি এই ছুরী সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কোন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন। আমি মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, সেই সময় তালেবালি কহিলেন, এই ছুরী দ্বারা সমসুদ্দিন তাহার পিতা জালালউদ্দীনকে হত্যা করিয়াছে। কিন্তু এই ছুরী কাহার বা কোথা হইতে সমসুদ্দিন এই ছুরী সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইল, সে বিষয়ে কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?
আমি। অনুসন্ধান করিয়াছি সত্য; কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারি নাই।
তালেবালি। আমি যে একটু সামান্য সংবাদ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ উপকার হইবে কি না, জানি না। কারণ, সমসুদ্দিন কি প্রকারে এই ছুরী সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে, তাহার কিছুই জানিতে পারি নাই। কেবল এইমাত্র জানিতে পারিয়াছি, এই ছুরী কাহার।
আমি। আপনি যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহা নিতান্ত মূলহীন সংবাদ নহে। কারণ, এ ছুরী কাহার, তাহা জানিতে পারিলে, সমসুদ্দিন কি প্রকারে এই ছুরী তাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা অবগত হইলেও হইতে পারিব। এ ছুরী কাহার, তাহা আপনি ঠিক জানিতে পারিয়াছেন কি?
তালেবালি। সংবাদ ঠিক্ কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু যাহা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহা আপনাকে বলিতেছি। আপনি একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেই জানিতে পারিবেন, আমার সংবাদ প্রকৃত কি না?
আমি। আচ্ছা তাহাই হইবে। এখন আপনি কি সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন, বলুন দেখি।
তালেবালি। আমি জানিতে পারিয়াছি, এই ছুরী গোলাম রব্বানি নামক এক ব্যক্তির।
আমি। গোলাম রব্বানি কোথায় থাকেন, এবং তিনি কিরূপ অবস্থার লোক?
তালেবালি। যে স্থানে জালাল উদ্দীনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার সন্নিকটেই গোলাম রব্বানির বাসস্থান। গোলাম রব্বানি এইস্থানের একজন মান্যমান ব্যক্তি। টাকাপয়সাও তাঁহার যথেষ্ট আছে। চাকর চাকরাণীও বোধ হয়, চারি পাঁচ জনের কম হইবে না।
আমি। আপনার সহিত গোলাম রব্বানির পরিচয় আছে কি?
তালেবালি। বেশ পরিচয় আছে। তিনি আমার অনেক দিবসের পুরাতন বন্ধু।
আমি। আমি যদি তাঁহার নিকট গমন করিয়া এই কথা জিজ্ঞাসা করি, তাহা হইলে তিনি সহজেই হয়ত ভীত হইয়া পড়িবেন, এবং প্রকৃতকথা গোপন করিয়া প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হইবার পথ রোধ করিয়া দিবেন। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার সহিত তাঁহার নিকট গমন করেন, এবং এই ছুরীর কথা জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে বোধ হয়, তিনি কোন কথা গোপন না করিলেও করিতে পারেন। এ সম্বন্ধে আপনার যাহা অভিমত হয়, তাহাই করুন। কারণ, আপনি আমাকে একটি সংবাদ প্রদান করিয়া সবিশেষ উপকৃত করিলেন; তাহার উপর আপনার নিকট পুনরায় উপকার প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত অনুরোধ করা লজ্জাকর কথা।
তালেবালি। ইহা আর উপকার কি? চলুন –আমি আপনার সহিত গোলাম রব্বানির নিকট গমন করিতেছি, তাঁহার নিকট আমি আপনার পরিচয় করিয়া দিব। তিনি মিথ্যা বলিবার লোক নহেন, আপনি যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তিনি তাহার প্রকৃত উত্তরই প্রদান করিবেন।
এই বলিয়া তালেবালি আমাকে সঙ্গে লইয়া গোলাম রব্বানির বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। গোলাম রব্বানি বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদিগকে বসিবার আসন প্রদান করিলে, তালেবালি তাঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলেন ও কহিলেন, “ইনি মহাশয়কে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছেন।”
গোলাম রব্বানি। আপনার যাহা কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, তাহা আপনি আমাকে এখনই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। আমি সে বিষয় সম্বন্ধে যতদূর অবগত আছি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিব।
আমি। যে দিবস জালালউদ্দীন হত হয়, সেইদিবস মহাশয় বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন কি?
গোলাম রব্বানি। বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলাম।
আমি। জালালউদ্দীনের মৃতদেহ আপনি দর্শন করিয়াছিলেন কি?
গোলাম রব্বানি। দেখিয়াছিলাম।
আমি। যে ছুরী দ্বারা জালালউদ্দীন হত হয়, সেই ছুরীখানিও আপনি দেখিয়াছেন কি?
গোলাম রব্বানি। না, সে দিবস আমি ছুরী দেখিতে পাই নাই।
আমি। যদি আপনি সেই ছুরী দর্শন না করিয়া থাকেন, তাহা হইলে উহা কি প্রকারের ছুরী, তাহা আমি আপনাকে বলিয়া দিতেছি। আমাদিগের এ প্রদেশে যে প্রকার ছুরীকে সকলে ভোজালে ছুরী বলিয়া থাকে, উহা সেই প্রকারের ছুরী। কিন্তু প্রভেদের মধ্যে এই যে, ভোজালে ছুরীর বাঁট, কাষ্ঠ কি অস্থি নির্ম্মিত হইয়া থাকে, ইহার বাঁট লৌহ নির্ম্মিত; কাষ্ঠ বা অস্থির কিছুমাত্র সংস্পর্শ নাই। এখন আমি আপনাকে এইমাত্র জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি যে, এই পাড়ার ভিতর সেইরূপ ছুরী কাহারও নিকট আপনি কখন দেখিয়াছেন কি?
গোলাম রব্বানি। সেইরূপ ছুরী আমি অপর কাহারও নিকট দেখি নাই। কিন্তু আমার নিজের সেই প্রকারের চারিখানি ছুরী আছে।
আমি। আপনার ছুরী চারিখানি একবার আমি দেখিতে পাই কি?
গোলাম রব্বানি। দেখিবার আর প্রতিবন্ধক কি আছে?
এই বলিয়া তিনি হাসেম নামক তাঁহার একজন পরিচারককে ডাকিলেন, ডাকিবামাত্র হাসেম সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময় তিনি হাসেমকে কহিলেন, “আমার বড় ছুরী কয়খানি এখনই এইস্থানে আনয়ন কর।” আদেশ পাইবামাত্র হাসেম বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে তিনখানি ছুরী আনিয়া আপনার প্রভুর সম্মুখে রাখিয়া দিল।
গোলাম রব্বানি। তিনখানি ছুরী আনিলে দেখিতেছি, আর একখানি কোথায়?
হাসেম। অনুসন্ধান করিয়া পাইতেছি না।
গোলাম রব্বানি। পাইতেছি না বলিলে চলিবে না! অনুসন্ধান করিয়া এখনই এখানে আনিয়া উপস্থিত কর।
প্রভুর কথা শ্রবণ করিয়া হাসেম পুনরায় বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। আমি সেই ছুরী তিনখানির প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, যে ছুরীর দ্বারা জালালউদ্দীন হত হইয়াছে, সেই ছুরী ও এই তিনখানি ছুরীর মধ্যে কিছুমাত্র পার্থক্য নাই। তথাপি গোলাম রব্বানিকে কোন কথা না বলিয়া হাসেমের প্রত্যাশায় সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম, এবং বসিয়া বসিয়া সেই ছুরীগুলি উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম।
অনেকক্ষণ পরে হাসেম নিতান্ত বিষণ্নমনে প্রত্যাগমন করিল ও কহিল, “তন্ন তন্ন করিয়া সন্ধান করিয়া দেখিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই আর একখানি ছুরী প্রাপ্ত হইলাম না।”
যে ছুরী দ্বারা জালালউদ্দীন হত হইয়াছিল, পরিশেষে সেই ছুরী বাহির করিয়া গোলাম রব্বানিকে দেখাইলাম। দেখিবামাত্র তিনি কহিলেন, “এই ছুরীখানি আমার। এই চারিখানি ছুরী আমি একই সময়ে একজন কর্ম্মকারের দ্বারা একইরূপে প্রস্তুত করাইয়া লই। কিন্তু সমসুদ্দিন এই ছুরী কি প্রকারে প্রাপ্ত হইল?”
এই ব্যাপার দেখিয়া গোলাম রব্বানি একটু চিন্তিত হইলেন ও হাসেমকে কহিলেন, “কি প্রকারে চারিখানি ছুরীর মধ্য হইতে একখানি স্থানান্তরে গমন করিল, তাহা অপরাপর পরিচারকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া এখনই আমাকে বল—নতুবা নিশ্চয় জানিও যে, তোমাদিগের সকলকেই এখনই আমি দূর করিয়া দিব।”
মনিবের এই কথা শ্রবণ করিয়া হাসেম কহিল, “কাহার নিকট আর জিজ্ঞাসা করিব? এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, আমার দোষেই এই ছুরীখানি হারাইয়া গিয়াছে।”
গোলাম রব্বানি। কিরূপে হারাইয়া গিয়াছে?
হাসেম। তিন চারি দিবস হইল, ছুরী চারিখানির উপর হঠাৎ আমার লক্ষ্য হওয়ায় দেখিলাম, উহাতে ময়লা ধরিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া এই চারিখানি ছুরী বাহির করিয়াই আমি উত্তমরূপে পরিষ্কার করিলাম, এবং ধৌত করিবার নিমিত্ত উহা দীঘির ঘাটে লইয়া গেলাম। সেই ঘাটের সন্নিকটবর্তী হইবামাত্র অপর আর একজন পরিচারক দ্রুতপদে আমার নিকট গমন করিয়া কহিল যে, আপনি আমাকে শীঘ্র ডাকিতেছেন। ইহা শ্রবণ করিবামাত্র ওই ছুরী চারিখানি ঘাটের পার্শ্বে জলের ভিতর দূরে নিক্ষেপ করিয়া আমি দ্রুতপদে আপনার নিকট আগমন করিলাম, এবং আপনার আদেশ মত কার্য শেষ করিয়া, পুনরায় সেই ছুরীগুলি আনিবার মানসে দীঘিতে গমন করিলাম। যে স্থানে ছুরীগুলি আমি নিক্ষেপ করিয়াছিলাম, সেইস্থান অধিকতর পক্ষে পূর্ণ ছিল। পঙ্কের মধ্যে অনুসন্ধান করায় তিনখানি ছুরী প্রাপ্ত হইলাম। সেই সময় ভাবিলাম যে, প্রথমে এই তিনখানি ছুরী উত্তমরূপে ধৌত করিয়া লই; পরিশেষে অপর আর একখানির অনুসন্ধান করিব। এই ছুরী তিনখানি ধৌত করিতে করিতে আপনি আমাকে আবার ডাকিলেন; সুতরাং অপর ছুরীখানির কথা একবারেই ভুলিয়া গিয়া তিনখানি ছুরী লইয়া আগমন করিলাম। ইহার পর এই ছুরীর কথা আর আমার মনে হয় নাই। এইরূপে একখানি ছুরী হারাইয়া গিয়াছিল।
এই কথা শ্রবণ করিয়া আমার সেইস্থানের অনুসন্ধান শেষ হইল। সেই সময় আমার মনে হইল যে, হাসেম ছুরীগুলি সবলে নিক্ষেপ করায় একখানি ছুরী পাঁকের ভিতর ঊর্দ্ধমুখে পুঁতিয়া যায়, এবং সেই ছুরীখানি হাসেম ভ্রমক্রমে সেইস্থানেই ফেলিয়া যায়। পরিশেষে রুগ্ন জালালউদ্দীন জল লইবার উদ্দেশ্যেই হউক বা অপর আর কোন কারণেই হউক, বদ্াহস্তে সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হন, এবং তাঁহার পদ হঠাৎ স্খলিত হওয়ায়, ঘাটের পার্শ্বেই তিনি সেই ছুরীর উপর পতিত হন। সেই ছুরী তাঁহার বক্ষঃস্থল সবলে ভেদ করিয়া হৃদয়ের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। যে সময় জালালউদ্দীনকে তাহার পুত্র সমসুদ্দিন প্রথম জল হইতে উত্তোলন করে, সেই সময় জালালউদ্দীনকে উপুড় অবস্থায় পাওয়া গিয়াছিল, একথা পাঠকগণ সকলেই অবগত আছেন। এখন বেশ অনুমান হইতেছে যে, এরূপ উপুড় অবস্থায় পতিত হইবার কারণই এই। অপর কর্তৃক এই ভীষণ ছুরী জালালউদ্দীনের হৃদয়ে সবলে বিদ্ধ হইলে কখনই তিনি ছুরীর সহিত উপুড় হইয়া পতিত হইতেন না, বা ছুরীর বাঁটের ভিতর মৃত্তিকার চিহ্নও নয়ন গোচর হইত না। এই সকল অবস্থা মনে মনে সবিশেষরূপে আলোচনা করায় আমার বেশ অনুমান হইল যে, সমসুদ্দিন তাহার পিতাকে হত্যা করে নাই, বিনা—অপরাধে সে হাজত ভোগ করিতেছে।
পরিশেষে এই সকল অবস্থা আমার ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীদিগকে কহিলাম। আমার এই অনুমান যে অমূলক, প্রথমে তাঁহারা তাহাই আমাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু পরিশেষে সকলকেই আমার মতের পোষকতা করিতে হইল, এবং সকলকেই একবাক্যে কহিতে হইল যে, সমসুদ্দিন বিনা অপরাধে ধৃত হইয়াছে।
আমার মতের পোষকতা করিবার পূর্ব্বে যে ডাক্তার সাহেব কর্তৃক জালালউদ্দীনের লাস ছেদিত হইয়া পরীক্ষিত হইয়াছিল, সেই ডাক্তার সাহেবের সহিত আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীগণ এ বিষয়ের পরামর্শ করিলেন। সেই সময় ডাক্তার সাহেব বলিয়াছিলেন যে, যেরূপ অবস্থায় ছুরী হৃদয়ের ভিতর প্রবিষ্ট হয়, তাহার অবস্থা উত্তমরূপে পর্যালোচনা করিলে বেশ অনুমান হয় যে, সেই ছুরী অপরের কর্তৃক প্রবিষ্ট হইবার অপেক্ষা আপনা কর্তৃক প্রবিষ্ট হইবারই সম্ভাবনা অধিক। ঊর্দ্ধমুখে প্রোথিত ছুরীর উপর কোন ব্যক্তি পতিত হইলে, তাহার শরীরে উহা যেরূপভাবে প্রবিষ্ট হইবার বা শরীরে যেরূপভাবে ক্ষত হইবার সম্ভাবনা, পুষ্করিণীর পঙ্কে সেইরূপ ভাবে প্রোথিত ছুরী উহার শরীরেও সেইরূপভাবে প্রবেশ করিয়াছে, এবং উহার শরীরের ক্ষতের অবস্থাও সেই প্রকার বলিয়া বোধ হয়।
এই ঘটনার পরই সমসুদ্দিন হাজত হইতে আনীত হইল, এবং সে যে তাহার পিতাকে হত্যা করে নাই, তাহার পিতা আপনিই হত হইয়াছেন, এই কথা তাহাকে বলিয়া তাহাকে মুক্তি প্রদান করা হইল। অব্যাহতি পাইয়া সমসুদ্দিন হাসিতে হাসিতে আপন গৃহাভিমুখে গমন করিল। মোকদ্দমার অনুসন্ধানও এইস্থানে শেষ হইল।
[মাঘ, ১৩০২]