এ কি! খুন!! (ছোরাবিদ্ধ স্ত্রীর সহিত ধৃত স্বামীর আশ্চর্য রহস্য)
প্রথম পরিচ্ছেদ
যে সকল লোমহর্ষণকারী হত্যাকাণ্ডের নায়ক স্থির না হয়, অথবা যে মোকদ্দমার হত্যাকারী পলায়িত বা লুক্কায়িত থাকে, সেই সকল মোকদ্দমার সন্ধানের ভার অধিকাংশই আমার হস্তে পতিত হয়। যে সকল স্থানে চুরি, জুয়াচুরি, জাল প্রভৃতির কোন সন্ধান প্রথমে পাওয়া যায় না, সেই সকল স্থানেও আমাকে সর্ব্বদা গমন করিতে হয়। কিন্তু আজ যে অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে অর্পিত হইল, তাহা অন্য প্রকার। ইহা যদিচ একটি খুনি মোকদ্দমা, কিন্তু হত্যাকারী অজ্ঞাত বা পলায়িত নহে, হত্যা করিবার পরই ধৃত হইয়াছে। পুলিসের অনুসন্ধান শেষ হইয়া গিয়াছে, মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট হত্যাকারী প্রেরিত হইয়াছে। মাজিষ্ট্রেট সাহেব উহার বিপক্ষে কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া প্রথমে নিজে সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, উক্ত হত্যা সেই ব্যক্তিদ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, এবং পরিশেষে শেষ বিচারের নিমিত্ত উহাকে দায়রায় সোপরদ্দ করিয়াছেন।
এই মোকদ্দমার কোন কোন অংশ আমাকে অনুসরণ করিতে হইবে, তাহা বলিবার পূর্ব্বে এই মোকদ্দমার আর কি, তাহা যতদূর প্রথমে অবগত হইতে পারিয়াছিলাম তাহাই পাঠকগণের চক্ষুর সম্মুখে উপস্থিত করা আমার কর্তব্য—কর্ম্মের প্রথম অংশ।
সালের মাঘ মাসের দিবা বারটার সময় গোপাল বোসের লেনের ভিতর হঠাৎ “খুন হইয়াছে” বলিয়া কোন ব্যক্তি চিৎকার করিয়া উঠিল। উক্ত গলির নিকটবর্তী বড় রাস্তার উপর একজন পুলিস-প্রহরীর পাহারা ছিল, এই গোলযোগ শুনিয়া দ্রুতপদে সে সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিল। সেইস্থানের অপর কয়েকজন লোকও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। প্রহরী সেই গলির ভিতর উপস্থিত হইয়া দেখিল, সেইস্থানে একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর কম্পাস গাড়ি ও উহার চতুর্দিকে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছে একজন মুসলমান কোচমান কোচবাক্সের উপর বসিয়া রহিয়াছে। গাড়ির দরজা খোলা। গাড়ির ভিতর একটি প্রায় বিংশতিবর্ষ বয়স্কা স্ত্রীলোক মৃত-অবস্থায় পতিতা, তাহার বক্ষের উপর সাংঘাতিক আঘাতের ভীষণচিহ্ন, প্রায় সমস্ত শরীর ও সমস্ত বসন রক্তে আপ্লুত। গাড়ির ভিতর পর্যন্তও রক্তে রক্তবর্ণ হইয়াছে, ও উহার ভিতর হইতে রক্ত পতিত হইয়া, গাড়ির নিম্নস্থিত মৃত্তিকা পর্য্যন্তও লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়াছে। সেই মৃতযুবতীর সম্মুখে লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়া একটি পঞ্চবিংশবর্ষ বয়স্ক যুবক উপবিষ্ট, তাহার হস্তে একখানি প্রায় এক ফুট লম্বা রক্তাক্ত ভীষণ ছুরিকা। অনেকে তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কিন্তু যুবক কোন কথারই উত্তর প্রদান করিতেছেন না। প্রহরী সেইস্থানে গমন করিয়া এই ব্যাপার দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইল, এবং যুবককে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “তোম্ কোন্ হায়? কাহে এ আওরত কো খুন কিয়া?”
যুবকের মুখে এতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন কথা ছিল না; কিন্তু প্রহরীর কথা শ্রবণে একবার সে তাহার দিকে তাকাইল, তাহার চক্ষু প্রহরীর চক্ষুর সঙ্গে মিলিল। প্রহরী অমনি দুই পদ পশ্চাৎ হঠিয়া দণ্ডায়মান হইল। সেই সময়ে সেই যুবার চক্ষু যে কিরূপভাব ধারণ করিয়াছিল, তাহা আমি দেখি নাই। সুতরাং তাহার যথাযথ বর্ণন করিতেও আমি সমর্থ নহি; কিন্তু যতদূর শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহাতে অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, হত্যা করিবার অব্যবহিত পরেই সেই হত্যাকারীর চক্ষু যেন জলের ভিতর ভাসিতেছিল। স্বচক্ষে অনেক হত্যাকারীকে দেখিয়াছি, এবং অপরের প্রমুখাৎও অনেক হত্যাকারীর কথা শ্রবণ করিয়াছি; কিন্তু হত্যার অব্যবহিত পরেই হত্যাকারীর চক্ষুতে যে বারিবিন্দু দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কখনও দেখি নাই বা শ্রবণ করি নাই।
প্রহরীর কথা শ্রবণ করিয়া সেই যুবক কহিল, “আমি যেই কেন হই না, তাহা তোমার জানিবার প্রয়োজন কি? আমি হত্যা করিয়াছি। তুমি আমাকে যে স্থানে ইচ্ছা হয়, সেইস্থানে লইয়া যাইতে পার।”
প্রহরী এই কথা শ্রবণ করিয়া তাহাকে আর কিছুই বলিল না, কিন্তু সেই কোচমানকে তাহার গাড়ি আস্তে আস্তে থানাভিমুখে লইয়া যাইতে কহিল। প্রহরীর আদেশমত কোচমান ধীরে ধীরে গাড়ি লইয়া গমন করিতে লাগিল, প্রহরী সেই গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলিল; সেইস্থানে উপস্থিত ব্যক্তিগণও সেই সঙ্গ পরিত্যাগ করিতে পারিল না, দেখিতে দেখিতে সকলে থানায় গিয়া উপস্থিত হইল।
থানার প্রধান-কর্ম্মচারী সেই সময় আফিসে বসিয়াছিলেন সংবাদ পাইবামাত্র তিনি গাড়ির নিকট আগমন করিলেন এবং গাড়ির ভিতরকার লোমহর্ষণ-ঘটনা দেখিয়া বিস্মিত ও চিন্তিত হইলেন। বিস্মিত হইবার কারণ এই ভয়ানক দৃশ্য এবং চিন্তিত হইবার কারণ—সেই যুবকের হস্তে নর-রুধির রঞ্জিত সেই ভীষণ ছুরিকা এখনও বর্তমান!—কি উপায়ে সেই ছুরিকা তাহার নিকট হইতে সহজে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবেন, তাহারই নিমিত্ত চিন্তিত হইলেন।
ছুরি দেখিয়া কৰ্ম্মচারী যেরূপ চিন্তিত হইয়াছিলেন, ক্রমে কাৰ্য্যে দেখা গেল, সেরূপ চিন্তার কোন কারণই নাই। যে হেতু চাহিবামাত্র যুবক সেই ছুরিখানি বিনা-আপত্তিতে কর্ম্মচারীর হস্তে অর্পণ করিল।
ছুরিখানি হস্তে পাইবামাত্র কৰ্ম্মচারী উহা অপর আর একজন কর্মচারীর হস্তে প্রদান করিলেন, সে উহা লইয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিল। যুবককে গাড়ি হইতে নামিতে বলিলে, বিনা-আপত্তিতে সে গাড়ি হইতে নামিয়া আফিসের ভিতর প্রবেশ করিল। প্রধান কর্ম্মচারীর সঙ্কেত মত সেইস্থানে সেই যুবক অপর দুইজন প্রহরী কর্তৃক ধৃত হইয়া সুদৃঢ় হাতকড়ির দ্বারা আবদ্ধ হইল।
সেই সময়েই এই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরিত হইল। যে স্থানে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছিল, সেইস্থানে অনুসন্ধান পূর্ব্বক সেই যুবকের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষী সংগ্রহ হইল, তাহাদিগের এজাহার গৃহীত হইল। সেই যুবককে জিজ্ঞাসা করায় সে আপন দোষ স্বীকার করিয়া কহিল, “যাহাকে আমি হত্যা করিয়াছি—সে আমার স্ত্রী। তাহার চরিত্রের উপর আমার একান্ত সন্দেহ হওয়ায়, আমার হৃদয়ে, দারুণ ক্রোধের উদ্রেক হয়; কিন্তু সেই বিজাতীয় ক্রোধ কোনরূপেই সংযত করিতে না পারিয়া, এই গাড়ির ভিতর সেই ছুরির দ্বারা আমি স্বহস্তে তাহাকে হত্যা করিয়াছি, এবং ইহার জন্য উপযুক্ত দণ্ডগ্রহণেও আমি প্রস্তুত আছি।” যুবক এই সকল কথা স্বীকার করিল সত্য, কিন্তু সে যে কে? ও তাহার নাম কি? কোথায় তাহার বাসস্থান? তাহার কিছুই বলিল না, এবং তাহার স্ত্রীর নামও প্রকাশ করিল না, বা তাহার পরিচয়ও কোনরূপে প্রদান করিল না। এই সকল বিষয় জানিবার নিমিত্ত পুলিস বিলক্ষণ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া বিচারার্থ আসামীকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। সেইস্থানে অগত্যা “নাম প্রকাশে অনিচ্ছু একজন যুবক” এইরূপ নাম সাব্যস্ত করিয়া তাহার বিপক্ষে এই মোকদ্দমা চালাইতে লাগিলেন। সেই গলির অধিবাসী দুই এক ব্যক্তি, কোচমান ও অন্যান্য কয়েকজন ব্যক্তির এজাহার ক্রমে গৃহীত হইতে লাগিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে যে সকল সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ;–
প্রথম সাক্ষী সেই গাড়ির কোচমান কহিল, “হাবড়া ষ্টেশনে সেই স্ত্রীলোকটি কালীঘাট গমন করিবার নিমিত্ত আমার গাড়ি ভাড়া করিয়া উহাতে আরোহণ করিল, এবং কালীঘাট-অভিমুখে গমন করিতে কহিল। আমি যেমন গাড়ি হাঁকাইয়া দিব ভাবিলাম, অমনি সেই সময় পশ্চাদ্দিক হইতে দ্রুতপদে এই যুবক আসিয়া সেই গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল। যে গাড়ির ভিতর একটি রমণী একাকিনী উপবিষ্টা, সেই গাড়ির ভিতর একটি পুরুষকে হঠাৎ আগমন করিতে দেখিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি কে? এবং কোথাই বা গমন করিবে?’ উত্তরে পুরুষটি কহিল, ‘ইনি আমার স্ত্রী রাগ করিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন। আমি সন্ধান পাইয়া ইহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিয়াছি, ও গাড়ির ভিতর উহাকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া আমিও এই গাড়ির ভিতর উঠিয়াছি। তোমাকে কালীঘাটে যাইতে হইবে না, কলিকাতায় আমাদিগের একজন নিতান্ত আত্মীয় লোক বাস করেন, সেইস্থানে চল।’ এই যুবক সেই স্ত্রীলোকটির সম্মুখে এই সকল কথা কহিল, কিন্তু স্ত্রীলোকটি তাহার কোনরূপ প্রতিবাদ করিল না। কাজেই এই যুবকের কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহারই নির্দ্দেশ-মত গাড়ি চালাইতে লাগিলাম। যখন আমার গাড়ি গোপাল বোসের লেনে গিয়া উপস্থিত হইল, সেই সময় গাড়ি যেন কেমন একরূপ নড়িয়া উঠিল, এবং কিরূপ এক প্রকার অস্ফুট শব্দ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। আমি গাড়ি থামাইলাম, এবং গাড়ির ভিতর লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম, স্ত্রীলোকটির শরীর একবারে রক্তে ভাসিয়া গিয়াছে। সেই সময় উহার হাত পা নড়িতেছিল, দেখিতে দেখিতে স্থির হইয়া গেল। যুবকটির হস্তে দেখিলাম, রক্তাক্ত একখানি ছুরিকা, তাহার শরীরও রক্তাক্ত। সে সেই স্ত্রীলোকটিকে সোজা করিয়া বসাইতে চেষ্টা করিতেছে। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া আমি উহাদিগকে কিছু না বলিয়া, ‘খুন হইয়াছে, খুন হইয়াছে বলিয়া, চীৎকার করিতে লাগিলাম। দেখিতে দেখিতে পাড়ার লোকজন অনেক আসিয়া উপস্থিত হইল। ক্রমে একজন প্রহরীও সেইস্থানে উপস্থিত হইয়া আমাদিগের সকলকে থানায় লইয়া গেল।”
পাড়ার কয়েক ব্যক্তিও এইরূপ কথাই কহিলেন। তাঁহারা বলিলেন যে, খুন হইয়াছে শুনিয়া যখন তাঁহারা গাড়ির নিকট গমন করেন, সেই সময়ে দেখিতে পান, সেই স্ত্রীলোকটি রক্তে আপ্লুত হইয়া সেই গাড়ির ভিতর পতিত, এবং যুবকটি রুধির-রঞ্জিত ছুরিকাহস্তে তাহার সম্মুখে উপবিষ্ট। এই দুইজন ব্যতীত অপর কেহই সেই সময়ে গাড়ির ভিতর ছিল না। কোচমান তাহার গাড়ির উপরেই কোচবাক্সে বসিয়াছিল।
প্রহরী যেরূপে সংবাদ পাইয়া সেইস্থানে গমন করে, এবং গাড়ির ভিতর যেরূপ অবস্থা দেখিতে পায়, যুবককে জিজ্ঞাসা করায় তাহার নিকট হইতে যে প্রকার উত্তর প্রাপ্ত হয়, এবং পরিশেষে তাহাদিগকে যেরূপভাবে থানায় লইয়া যায়, তাহার যথাযথ বর্ণন করিল। কেবলমাত্র এই পুরুষটি সেই স্ত্রীলোকের সহিত এই গাড়ির ভিতর ছিল, এবং অপর কোন লোক এই গাড়ির ভিতর প্রবেশ করে নাই, সে সম্বন্ধেও দুই তিন জন লোক সাক্ষ্য প্রদান করিল। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, বক্ষঃস্থলে অস্ত্রের সাংঘাতিক আঘাতই এই স্ত্রীলোকটির মৃত্যুর কারণ।
মাজিষ্ট্রেট সাহেব আসামীকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “আমাকে অধিক কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। জিজ্ঞাসা করিলেও তাহার কোন উত্তরও পাইবেন না। তবে কেবল আমি এইমাত্র বলিতেছি যে, উক্ত হত-স্ত্রীলোকটি আমার স্ত্রী, কিন্তু উহার নামও বলিব না। বাসস্থান বলিব না, কোথায় যাইতেছিলাম, তাহাও বলিব না, এবং কোথা হইতে আসিয়াছি, তাহাও বলিব না, তবে কিন্তু বলিব—আমিই হত্যাকারী। সেই ছুরির সাংঘাতিক আঘাতেই আমি তাহাকে হত্যা করিয়াছি; কিন্তু কেন যে হত্যা করিয়াছি, তাহাও আমি বলিব না।”
মাজিষ্ট্রেট সাহেব এই কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, এ সকল কথা তুমি নাই বল, কিন্তু তোমার দ্বারা যে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, ইহা কি প্রকৃত?”
“যখন আমি বলিতেছি, এই হত্যা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে; তখন আমার কথা প্রকৃত বলিয়া বিশ্বাস না করিবেন কেন? প্রতিবাদী যখন তাহার দোষ নিজমুখে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছে, তখন তাহার কথার উপর অবিশ্বাস করার কোনরূপ কারণই আমি দেখি না। আপনি আমার কথার উপর নির্ভর করিয়া অনায়াসেই আমার প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিতে পারেন।”
“তোমার কথার উপর বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করিবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আমার আছে, তোমাকে দণ্ড দেওয়া সম্বন্ধে আমি তোমার কোনরূপ মতামত গ্রহণ করিব না, কিন্তু আমি যে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহার যথাযথ উত্তর দেওয়া তোমার আবশ্যক। কারণ, ইহাতে তোমার ইষ্টভিন্ন অনিষ্ট ঘটিবার সম্ভাবনা নাই। যদি তুমি তোমার নাম বল, তোমার বাসস্থান কোথায় তাহা আমাকে বলিয়া দেও, এবং তোমার আত্মীয়স্বজন কে আছে, তাহা যদি আমরা জানিতে পারি, তাহা হইলে হয় ত তাঁহারা তোমার সাহায্য করিতে পারেন। কোন উপযুক্ত আইনজীবীর সাহায্য লইয়া তোমাকে বাঁচাইবার চেষ্টাও দেখিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় আমার প্রস্তাবে তোমার সম্মত হওয়া উচিত।”
“মহাশয় আমাকে ক্ষমা করিবেন, এই সকল কথা আমি কিছুই বলিব না। কারণ, আমি কাহারও অনুগ্রহপ্রার্থী নহি। আমার দ্বারা যে কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার উপযুক্ত দণ্ড আমার লওয়া উচিত; সুতরাং আমি কাহারও সাহায্য প্রার্থনা করি না। আপনি আমাকে ও সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। আমার কর্ম্মের উপযুক্ত দণ্ড আপনি প্রদান করুন, আমি হাসিতে হাসিতে সেই দণ্ড গ্রহণ করিব।”
উহাকে আর অধিক কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া, বিচারক তাহাকে দায়রায় সোপরদ্দ করিলেন, এবং আসামীকে কহিলেন, “তুমি যেরূপ গুরুতর অপরাধ করিয়াছ, সেই অপরাধের দন্ড প্রদান করা আমার সাধ্যাতীত; সুতরাং তোমার মোকদ্দমা ঊর্দ্ধতন আদালতে প্রেরিত হইল, সেইস্থানেই তোমার বিচার হইবে।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
দায়রা বসিতে এখনও একমাস বিলম্ব আছে, এই সময়ে একদিবস আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারী আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, “সম্প্রতি গোপাল বসুর লেনে যে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, এবং যে অপরাধী মাজিষ্ট্রেট সাহেব কর্তৃক দায়রাতে প্রেরিত হইয়াছে, তাহা বোধ হয়, তুমি নিশ্চয়ই অবগত আছ, আর ইহাও বোধহয় তুমি জান যে, হত্যাকারী এ পর্য্যন্ত তাহার পরিচয় প্রদান করে নাই। কি নিমিত্ত যে এই হত্যা তাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার কারণ এখনও ঘোরতিমিরে আচ্ছন্ন। সম্প্রতি সরকারী কৌন্সলি, যিনি গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে এই মোকদ্দমা দায়রায় চালাইবেন, তিনি এই পত্র লিখিয়াছেন। খুনি মোকদ্দমার খুনের কারণ নির্দেশ না হইলে, সে মোকদ্দমায় শাস্তি পাওয়া সহজ নহে। এই নিমিত্ত এই অনুসন্ধানের ভার এখন তোমার হস্তেই অর্পণ করিলাম। সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখ, যদি কোন উপায়ে জানিতে পার, সেই ব্যক্তি কে এবং কি কারণেই বা সে এই স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করিয়াছে।”
নিম্ন-কর্মচারীর প্রতি আদেশ প্রদান করা ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর পক্ষে নিতান্ত সহজ কথা; কিন্তু কি উপায়ে যে সেই আদেশ প্রতিপালন করিতে হইবে, তাহার উপায় যে কেন কোন ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী বলিয়া দেন না, বা বলিতে পারেন। না, ইহাই বড় আশ্চর্য্যের কথা। যাহা হউক, যখন আদেশ পাইলাম, তখন পারি বা না পারি, সবিশেষ চেষ্টা করিতে হইবে। কিন্তু কিরূপে চেষ্টা করি, কোথায় যাই, কাহাকে জিজ্ঞাসা করি, ক্ষণকাল ভাবিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
নানাপ্রকার ভাবিতে ভাবিতে সে দিবস অতিবাহিত করিলাম, ক্রমে রাত্রিও গত হইয়া গেল। কিন্তু কোনরূপ উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, প্রত্যূষে উঠিয়া হরিণবাড়ীর জেলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যতদিবস পর্য্যন্ত বিচার শেষ না হইয়া যায় ততদিবস পর্য্যন্ত হত্যাকারীকে জেলের ভিতর আবদ্ধ থাকিতে হয়, ইহাই এতদ্দেশের নিয়ম। সেই হত্যাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার প্রত্যাশায় যখন আমি সেই জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম, তখন আমার পরিধানে পুলিসের কোন বস্ত্রই ছিল না,—পুলিসের বস্ত্র প্রায়ই আমাকে পরিধান করিতে হয় না। আমি সচরাচর যেরূপ বস্ত্র পরিধান করিয়া থাকি, সেইরূপ বস্ত্র পরিধান করিয়া জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
জেলের ইংরাজ কর্মচারী আমাকে চিনিতেন, সুতরাং বিনা-আপত্তিতেই তিনি আমাকে জেলের ভিতর প্রবেশ করিতে দিলেন। জেলের ভিতর গমন করিয়া কথিত হত্যাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা, সেই ইংরাজ কর্মচারীকে কহিলাম, এবং ইহাও কহিলাম, “হত্যাকারী যেন কোনরূপে জানিতে না পারে যে, আমি পুলিস-কর্মচারী এইরূপ ভাবে আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”
কর্ম্মচারী আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া একটি গৃহে আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই গৃহে উপবেশন করিলে, তিনি সেই হত্যাকারীকে আনিবার নিমিত্ত নিজেই গমন করিলেন।
এইস্থানে একটি বিষয় আমি পাঠকগণকে নিবেদন করিতে বিস্মৃত হইয়াছি। যখন আমি সেই হত্যাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় আমি আমার নিজের নিকট হইতে একখানি পরিষ্কার সাদা ধুতি, একটি সাদা কামিজ ও একখানি গরম র্যাপার সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম।
জেলের সেই কর্ম্মচারী সেই হত্যাকারীকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন, এবং আমি যে গৃহে উপবিষ্ট ছিলাম, সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেইস্থানে আর একখানি চেয়ার ছিল, তিনি তাহার উপর উপবেশন করিলেন; হত্যাকারী আমাদিগের সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিল।
হত্যাকারী যুবকের পরিধানে যে বস্ত্র ছিল, তাহা নিতান্ত মলিন হইয়া গিয়াছে। আমি তাহাকে কহিলাম, “তোমার পরিধেয় বস্ত্রাদি অতিশয় মলিন হইয়া গিয়াছে। এখন এই সকল পরিত্যাগ করিয়া এই পরিষ্কার বস্ত্রগুলি পরিধান কর।”
যুবক। আপনি কে? তাহা জানিতে না পারিলে, আপনার প্রদত্ত বস্ত্ৰ লইতে আমি বাসনা করি না।
যুবকের কথা শুনিয়া একবার মনে করিলাম, আমার প্রকৃত পরিচয় উহাকে প্রদান করি, এবং মিষ্ট কথায় উহাকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া দেখি, যদি সে উহার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল যে, যখন সে প্রথম অনুসন্ধানকারী পুলিসের নিকট আপনার পরিচয় দেয় নাই, মাজিষ্ট্রেট সাহেব পরিশেষে তাহার পরিচয় পাইবার নিমিত্ত সবিশেষ চেষ্টা করিয়াও কোন প্রকারে কৃতকার্য হইতে সমর্থ হন নাই, তখন আমাকে প্রকৃত পরিচয় দিবে কি? না দিলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে না, এবং এইস্থানেই আমাকে উপস্থিত উপায় পরিত্যাগ করিতে হইবে। অধিকন্তু শেষে কোন উপায়ে আমি উহার নিকট আর কোনরূপ কৌশল অবলম্বনে সমর্থ হইব না। এই ভাবিয়া উহার উত্তরে আমি কহিলাম, “আমার পরিচয় দিলে তুমি কি অবগত হইতে পারিবে? আমি তোমার পরিচিত নহি, বা পূৰ্ব্বে আমি যে তোমাকে আর কখন দেখিয়াছি, তাহাও আমার মনে হয় না!”
যুবক। যদি আপনি আমাকে না জানেন; বা আমিও যদি আপনাকে চিনিতে না পারি, তাহা হইলে কষ্ট স্বীকার করিয়া এই বস্ত্রাদি আমার নিমিত্ত আনয়ন করিবার আপনার প্রয়োজন কি?
আমি। আমার কোন প্রয়োজন নাই, বা আমি ইচ্ছা করিয়া তোমার বস্ত্রাদি আনি নাই। যিনি তোমার কোন নিকট আত্মীয়, এইরূপ কোন ব্যক্তির একান্ত অনুরোধ লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া, আমাকে এই বস্ত্রাদি তোমার নিমিত্ত আনিতে হইয়াছে। তুমি গ্রহণ কর, ভালই; নচেৎ উহা লইয়া গিয়া তাঁহার নিকট প্রত্যর্পণ করিব।
আমার কথা শুনিয়া দেখিলাম, যুবক একটু চিন্তিত হইল, এবং মনে মনে অস্ফুটস্বরে কহিল, “তবে কি আমার পিতা আমার এই অবস্থা জানিতে পারিয়াছেন?”
আমি। তোমার পিতা যে তোমার এই বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছেন, এবং এই বস্ত্রাদি যে তিনিই প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা ত আমি তোমাকে বলি নাই।
যুবক। আপনি বলুন আর নাই বলুন, পিতা ভিন্ন আমার এমন আর কে আছেন যে, আমার বিপদ্ দেখিলে তাঁহার হৃদয় আচ্ছন্ন হয়?
আমি। আমি যাঁহার নিকট হইতে আসিয়াছি, তিনি তোমার পিতা, কি না? তাহা আমি অবগত নহি। তবে তাঁহার নাম করিলে আমি বুঝিতে পারি যে, এই বস্ত্র প্রেরয়িতা তোমার পিতা কি না?
যুবক। না মহাশয়! আমি আমার পিতার নাম করিব না। কি জানি, যদি তিনি এই বিষয় অবগত হইতে না পারিয়াই থাকেন, তাহা হইলে আমার পরিচয় প্রকাশ হইয়া পড়িবে। তিনি এখন দূরদেশে আছেন, আমার বিশ্বাস সংবাদ না পাইলেও পাইতে পারেন।
আমি। তুমি কি বিবেচনা কর যে, তোমার পিতার এই সংবাদ পাইতে এখনও বাকী আছে? তুমি কি ভাব যে কলিকাতায় তোমার পরিচিত বা স্বদেশবাসী কি কেহই থাকেন না? সে দিবস তুমি যাহার বাসায় গমন করিতেছিলে, তুমি কি বিবেচনা কর যে, তিনিও ইহার বিন্দুবিসর্গও অবগত হইতে পারেন নাই? এই মোকদ্দমা লইয়া কলিকাতার ভিতর এত গোলযোগ হইয়া গিয়াছে, সম্ভ্রান্ত ধনী হইতে কুটীরবাসী পর্য্যন্ত সকলেই এই মোকদ্দমার কথা শ্রবণ করিয়াছে। ইহাতেও কি তুমি ভাবিতেছ, যে তোমার আত্মীয় বা স্বদেশবাসী ব্যক্তিগণ কলিকাতায় থাকিয়া ইহার কিছুই অবগত হইতে পারেন নাই? আর যদি তাঁহারা জানিয়া থাকেন, তাহা হইলে তুমি কি বিবেচনা কর যে, তোমার পিতা যত দূরেই থাকুন না কেন, এই সংবাদ তাঁহারা তাঁহাকে প্রদান করেন নাই?
যুবক। আপনি যাহাই বলুন, আমার পিতা জানিতে পারিয়া থাকুন বা নাই থাকুন, আমি কিন্তু আপনাকে কোন কথা বলিতেছি না, বা আপনার আনীত বা আমার আত্মীয়ের প্রেরিত পরিষ্কার বস্ত্রও আমি গ্রহণ করিতেছি না। যে ব্যক্তি জীবনের আশা পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, তাহার পক্ষে মলিন ও পরিষ্কার বস্ত্রে কোন প্রভেদই নাই।
আমি। ভাল, আজ তুমি বস্ত্রগ্রহণ করিলে না; কিন্তু দেখিও, যিনি বস্ত্র প্রেরণ করিয়াছেন, তিনি তোমার আত্মীয়স্বজনই হউন বা তোমার জনকই হউক, দুই এক দিবসের মধ্যে যখন তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আমি তোমার নিকট এইস্থানে আগমন করিব, তখন দেখিব, এই বস্ত্র তুমি গ্রহণ কর কি না?
আমার কথা শ্রবণ করিয়া যুবক আর কোন কথাই কহিল না, চুপ করিয়া বসিয়া থাকিল। তাহার নিকট হইতে অদ্য আর কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া, সেই দিবস সেই জেল পরিত্যাগ করিলাম। কর্ম্মচারী উহাকে আপন স্থানে রাখিয়া আসিলেন।
আমি মনে মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, উহার কথায় তাহার একটু আভাসও পাইলাম। জানিলাম যে, তাহার আত্মীয়ই হউন বা স্বদেশবাসীই হউন, তাহার পরিচিত কোন না কোন ব্যক্তি কলিকাতায় আছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, তাহার পিতা এখনও বর্তমান; কিন্তু কলিকাতার দূরবর্তী কোন স্থানে আছেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সেই দিবস আমি জেল হইতে আপনার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। যে উপায় অবলম্বন করিয়া উহার মনের কথা অবগত হইতে গমন করিয়াছিলাম, সেই উপায় ব্যর্থ হইল দেখিয়া, আর কোন্ উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে তাহারই চিন্তা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। ভাবিতে ভাবিতে সে দিবস চলিয়া গেল, রাত্রিও অতিবাহিত হইয়া গেল। প্রাতঃকালে উঠিয়া যে থানার এলাকায় উক্ত স্ত্রীলোকের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছিল, সেই থানায় গমন করিলাম।
এইস্থানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা আমার আবশ্যক। কারণ, পাঠকগণকে সেই বিষয় বলিতে আমি পূৰ্ব্বে বিস্মৃত হইয়াছি। যে সময় হত্যাকারীকে গাড়ির ভিতর পাওয়া যায়, সেই সময় তাহার পরিধেয় সমস্ত বস্ত্র রক্তাক্ত ছিল। থানার ভিতরে ধৃত হইবার পর, তাহার সমস্ত বস্ত্র তাহার শরীর হইতে বিচ্যুত করা হয়, এবং তাহার পরিবর্তে উহাকে অন্য বস্ত্র প্রদান করা হয়। যে বস্ত্র পরিধান করিয়া সে এখন হাজতে রহিয়াছে, উহা তাহার নিজের পরিধেয় বস্ত্ৰ নহে, পুলিস-প্রদত্ত বস্তু।
থানায় গমন করিয়া আসামীর পরিত্যক্ত সেই বস্ত্রগুলি আমি একবার নিজচক্ষে দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। থানার প্রধান কর্মচারী আমার কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, সেই বস্ত্রগুলি থানায় নাই। উহা এবং সেই স্ত্রীলোকের পরিহিত বস্ত্র, সমস্তই পরীক্ষার নিমিত্ত ‘কেমিকেল এক্জামিনারের নিকট প্রেরণ করা হইয়াছে।”
মেডিকেল কলেজে গমন করিয়া কেমিকেল একজামিনারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার সহিত যদিও পূর্ব্বে আমার সবিশেষ জানা-শুনা ছিল না, কিন্তু দেখিলাম, তিনি নিতান্ত ভদ্রলোক। আমার মনের ভাব, ব্যক্ত করিবামাত্র তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং বস্ত্রগুলি যে স্থানে ছিল, আমাকে সেইস্থানে লইয়া গিয়া দেখিবার নিমিত্ত সমস্ত বস্ত্রগুলিই আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি এক এক করিয়া সমস্ত বস্ত্র তাঁহার সম্মুখেই দেখিতে লাগিলাম।
সেই বস্ত্রগুলির মধ্যে কৃষ্ণবর্ণের একটি কোট ছিল। উহা যদিও পুরাতন, কিন্তু অধিক দিন যে ব্যবহার হইয়াছে দেখিয়া সেরূপ বোধ হইল না। বুঝিলাম, এই কোট হত্যাকারীর। এই কোটের ভিতর গলার কাছে সাদা কাপড়ের একখানি টিকিট, কোটের সহিত সেলাই করা আছে। উহা যদিও সাদারঙ্গের সত্য; কিন্তু এখন পরিষ্কার নাই, মলিন হইয়া গিয়াছে। কোট বা চাপকানে এইরূপ টিকিটে প্রায়ই সেই দ্রব্যের বিক্রেতার নাম থাকে, ইহাও আমি অবগত ছিলাম। সুতরাং সবিশেষ পরীক্ষাপূর্ব্বক দেখিয়া জানিতে পারলাম, উহাতে ইংরাজী অক্ষরে লেখা আছে “গাঙ্গুলি ব্রাদার, কলিকাতা, ৭।।/০।”
উক্ত কোটের বিষয় এইটুকু জানিতে পারিয়া, আমার মনে আশার সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, এই সূত্র অবলম্বন করিয়া যদি ইহার কোন প্রকার সন্ধান করিতে পারি, তবেই ভাল; নচেৎ এখন পর্যন্ত তাপর কোনরূপ উপায় দেখিতে পাইতেছি না, যাহাতে আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইতে পারে। যাহা হউক, সেই বস্ত্রগুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া, আমার আবশ্যকোপযোগী আর কোন বিষয়ই অবগত হইতে না পারিয়া, সেই বস্ত্রগুলি সেইস্থানে রাখিয়া সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম।
গাঙ্গুলি ব্রাদারের কাটা কাপড়ের দোকান অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা আমার পক্ষে নিতান্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হইল না। সেই দোকান সহজেই বাহির করিলাম। মহেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সেই দোকানের একজন অংশীদার। মহেন্দ্রবাবুর সহিত যদিও আমার ভালরূপ বন্ধুত্ব ছিল না, কিন্তু একটু চেনা-শুনা ছিল। আমি সেইস্থানে গমন করিয়া সমস্ত কথা তাঁহার নিকট কহিলাম। আমি যে বিষয়ের অনুসন্ধানে আজ নিযুক্ত হইয়াছি, এবং যে নিমিত্ত তাঁহার নিকট পর্য্যন্ত গমন করিয়াছি, তাহার সমস্ত কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম এবং পরিশেষে আমার সহিত গমন করিয়া পূর্বোক্ত কোটটি একবার দেখিবার নিমিত্ত তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম। তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং আমার সহিত মেডিকেল কলেজে গমন করিলেন।
সেই কোটটি কেমিকেল এক্জামিনারের নিকট ছিল। যে পর্য্যন্ত তাঁহার পরীক্ষা শেষ না হইবে, সেই পৰ্য্যন্ত উহা তাঁহার নিকট হইতে আনয়ন করিবার প্রথা এতদ্দেশে নাই। কাজেই মহেন্দ্রবাবুকে সেই কোট দেখাইবার নিমিত্ত সেইস্থানে লইয়া যাইতে হইল।
মহেন্দ্রবাবু সেই কোট দেখিয়া চিনিতে পারিলেন ও কহিলেন, ইহা তাঁহাদিগের দ্বারাই প্রস্তুত করা হইয়াছে। কিন্তু কাহার নিকট বা কতদিবস হইল, উহা তাঁহারা বিক্রয় করিয়াছেন, তাহা কিন্তু তখন বলিতে পারিলেন না।
মহেন্দ্রবাবু কাহার নিকট সেই কোট বিক্রয় করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারিলেন না সত্য কিন্তু সেই কোটে যে দাম লেখা আছে, সেই দামেই উহার বিক্রয় হওয়া সম্ভব একথা কহিলেন। আরও কহিলেন, তিনি যতদূর অবগত আছেন, তাহার ভিতর কাপড়ের উপর লিখিত দামের কমে কোন কাপড় কখন যে বিক্রীত হইয়াছে, তাঁহা তাঁহার মনে হয় না।
মহেন্দ্রবাবুর সহিত পরিশেষে তাঁহার সেই দোকানে প্রত্যাগমন করিলাম, এবং উভয়ে পরামর্শ করিয়া এই স্থির করিলাম যে, সেইস্থানে উপবেশন করিয়া অতীব সতর্কতার সহিত সেই দোকানের গত পাঁচ ছয় বৎসরের খাতা পরীক্ষা করিয়া দেখা ভিন্ন আর উপায় নাই। সেই মূল্যে যদি এই প্রকারের কোট কাহারও নিকট বিক্রীত হইয়াছে জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে সেই কোট খরিদকারীর কোনরূপ সন্ধান পাইলেও পাইতে পারিব।
পরামর্শে যাহা স্থির হইল, কার্য্যেও তাহা পরিণত করিলাম। পনর দিবস অবিরত পরিশ্রম করিয়া ছয় বৎসরের খাতা দেখা শেষ হইল। এই ছয় বৎসরের মধ্যে কেবল পাঁচটিমাত্র কোট ৭।।/০ মূল্যে বিক্রীত হইয়াছে জানিতে পারিলাম। একটি খরিদ করিয়াছেন সিমলার সুরেশচন্দ্র দত্ত, আর একটি টেংরার শ্রীশচীন্দ্র ঘোষ, তৃতীয়টি বহুবাজারের রামযাদু সরকার, চতুর্থটি ভবানীপুরের ত্রৈলোক্য বিশ্বাস, এবং পঞ্চমটি কাহার নিকট বিক্রয় হইয়াছে, তাহার নাম নাই, কেবল লেখা আছে, “নগদ বিক্ৰী।”
এই সূত্র অবলম্বনে এই বিষয়ের অনুসন্ধান হওয়া একবারে অসম্ভব জানিতে পারিয়াও, অন্য উপায় না পাওয়া পৰ্য্যন্ত কাজেই আমাকে এই পথ অবলম্বন করিতে হইল। যে চারি ব্যক্তির নাম পাওয়া গিয়াছিল, তাঁহারা সকলেই মহেন্দ্রনাথের পরিচিত খরিদদার; সুতরাং মহেন্দ্রবাবুর সাহায্যে তাঁহাদিগকে পাইতে কোনরূপ কষ্ট হইল না। সুরেশচন্দ্র দত্তকে তাঁহার সিমলার বাড়ীতেই পাইলাম। জানিলাম, যে কোট তিনি ক্রয় করিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার নিকটেই আছে। দ্বিতীয় ক্রেতা শ্রীশচন্দ্র ঘোষ যে সময় টেংরায় ছিলেন, সেই সময় তিনি তাঁহার কোট ক্রয় করেন। টেংরায় গিয়া জানিতে পারিলাম, প্রায় দুই বৎসর পূর্ব্বে শ্রীশচন্দ্র তাঁহার কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া টালিগঞ্জে অবস্থান করিতেছেন। টেংরার একটি লোক তাঁহার ঠিকানা জানিত, তাহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া টালিগঞ্জে গমন করিলাম। সেইস্থানে শ্রীশচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎও হইল; কোটের কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া অবগত হইলাম যে, সেই কোট এখনও তাঁহার নিকট বর্তমান আছে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বহুবাজারের রামযাদু সরকার পূর্ব্বে একটি বাসায় থাকিতেন। ছয়মাস গত হইল, সেই বাসা পরিত্যাগ করিয়া তিনি আপনার দেশে গমন করিয়াছেন। তাঁহার বাসস্থান বর্দ্ধমানের নিকটবর্তী একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে। কলিকাতায় রামযাদুর আর কোন সন্ধান পাইবার প্রত্যাশা না থাকায় ভবানীপুরে ত্রৈলোক্য বিশ্বাসের নিকট গমন করিলাম। জানিলাম, তিন মাস পূৰ্ব্বে ত্রৈলোক্য ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া পরলোকে গমন করিয়াছেন। সন্ধান করিয়া তাঁহার ভ্রাতার নিকট অবগত হইলাম, তাঁহার সেই কোট তাঁহার বিধবা স্ত্রীর নিকট এখনও বর্ত্তমান।
যেটি নগদ মূল্যে বিক্রীত হইয়াছিল, তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হইলাম না। মহেন্দ্র বাবুও অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কোন প্রকারেই মনে করিতে পারিলেন না যে, সেই কোট কাহার নিকট বিক্রীত হইয়াছে। সুতরাং বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, সেই কোট সম্বন্ধের সন্ধান প্রায় এইস্থানেই শেষ হইল।
ভরসার মধ্যে এখন রামযাদু সরকার। সেই কোট যদি তাঁহারই হয়, তাহা হইলেই আমার কষ্টের লাঘব হইবে ও আমি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব, এই ভাবিয়া আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না। সেই দিবসেই রামযাদু বাবুর দেশাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। বর্দ্ধমান হইতে তাঁহার বাটী চারি পাঁচ ক্রোশের বেশী হইবে না, পরদিবস দিবা আটটার মধ্যেই তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইলাম। দেখিলাম, স্থানান্তরে গমন করিবার অভিপ্রায়ে রামযাদু তাঁহার বাড়ী হইতে বহির্গত হইতেছেন। রামযাদুবাবুকে দেখিবামাত্র আমার সমস্ত আশা ভঙ্গ হইয়া গেল। কারণ, আমার মনে ধ্রুববিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, সেই কেমিকেল একজামিনারের নিকট যে কোট দেখিয়াছি, তাহা রামযাদুবাবুর ভিন্ন অপর কাহারও নহে, এবং কথিত হত্যাকারী স্বয়ং রামযাদু সরকার। সেই সময় রামযাদুবাবুকে দেখিয়া আমার যতদূর বিস্ময় না জন্মিয়াছিল, তাঁহার পরিধেয় কোট দেখিয়া, ততোধিক বিস্মিত হইয়াছিলাম। কারণ, আমি যে কোটের অনুসন্ধান উপলক্ষে এতদূর আগমন করিয়াছি, দেখিলাম, সেই কোট পরিধান করিয়াই রামযাদুবাবু আপনার বাড়ী হইতে বহির্গত হইতেছেন।
আমাকে দেখিয়া রামযাদুবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কাহার অনুসন্ধানে এখানে আগমন করিয়াছেন ও আপনিই বা কে?
তাঁহার কথায় আমাকে উত্তর প্রদান করিতে হইল। প্রথমে আমি আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিলাম; কিন্তু কি নিমিত্ত যে আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তাহা তাঁহাকে প্রথমে না বলিয়া, কেবল এইমাত্র কহিলাম, আপনার নিকট আমার কোন প্রয়োজন ছিল বলিয়াই, এখানে আসিয়াছিলাম।”
“আমার নিকট যদি কোন প্রয়োজন থাকে, তাহা হইলে আসুন—আমাদিগের বাড়ীর ভিতর গমন করি। আমি স্থানান্তরে গমন করিতেছিলাম, না হয়, আজ যাইব না। আপনাদিগের কার্য্য সমাপ্ত হইয়া গেলে, পরিশেষে স্বীয় কাৰ্য্যে গমন করিব।”
আমিও তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, তাঁহার সহিত তাঁহার বাটীতে গমন করিলাম। তিনি তাঁহার সদর বাটীতে আমাদিগের থাকিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়া, বাটীর ভিতর গমন করিলেন, ও কিয়ৎক্ষণ পরে বাহিরে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। তাঁহার বাটীর ভিতর গমন করিবার উদ্দেশ্য তখন বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, আজ আর তিনি আমাদিগকে সেইস্থান পরিত্যাগ করিতে দিবেন না, আহারাদি করাইয়া আমাদিগকে তিনি সেইস্থানেই রাখিবেন।
রামযাদুবাবু আমার নিকট উপবেশন করিয়া, ক্ষণপরে আমাকে কহিলেন, “মহাশয়! কি নিমিত্ত আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, যদি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে বলেন, তাহা হইলে চিন্তিত অন্তঃকরণকে স্থির করিতে পারি। কারণ, যখন আপনাদিগের নাম শুনিলেই ভয় হয়, তখন আপনাদিগের আগমনে যে কিরূপ ত্রাসের উদ্রেক হইয়াছে, তাহা আমিই বুঝিতে পারিতেছি। আপনারা তাহা অনুভব করিতে পারেন কি না, জানি না।”
রামযাদুবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া আমি একটু হাসিলাম ও কহিলাম, “আমার আগমনে আপনার কোনরূপ ভয় বা চিন্তা করিবার কারণ নাই। আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছিলাম, সেই কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে। এখন আমি এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া গমন করিতে পারি।”
“আপনি কি কার্য্যের নিমিত্ত আগমন করিলেন, এবং আপনার কার্যই বা কিরূপে শেষ হইল, তাহা আমি কিছুই বুঝিতে সমর্থ হইলাম না। সে যাহা হউক, যদি আপনার কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা না থাকে, তাহা হইলে কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছিলেন, তাহা জানিতে পারিলে অতীব সন্তুষ্ট হই। আর আজ আপনার এখান হইতে যাওয়া হইবে না। আজ এখানে অবস্থান করুন, কাল উভয়েই এইস্থান হইতে প্রস্থান করিব।
রামযাদুবাবুর এই কথা শ্রবণ করিয়া কহিলাম, “আচ্ছা, তবে আজ আপনার এখানেই অবস্থান করিব।” এই বলিয়া আমি কি নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করিয়াছিলাম, তাহা সমস্ত সবিস্তারে তাঁহার নিকট কহিলাম। এই হত্যাকাণ্ডের প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া যে সকল বিষয় আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই এক এক করিয়া আমি তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম, এবং কি সূত্র অবলম্বনে আমি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, কি নিমিত্তই বা তাঁহার বাড়ী পর্য্যন্ত গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, আর কি প্রকারেই বা সেইস্থানের অনুসন্ধান আমার শেষ হইয়া গিয়াছে, তাহাও তাঁহাকে সবিস্তারে কহিলাম।
আমার সমস্ত কথা তিনি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলেন ও কহিলেন, “এতক্ষণ পরে আমি সুস্থ হইলাম। কারণ, আমি ভাবিয়াছিলাম যে, আপনি আমার বিপক্ষেই কোনরূপ অনুসন্ধান করিতে আগমন করিয়াছেন।” আরও কহিলেন, “আপনি যে অনুমান করিয়াছেন তাহা সত্য; যে কোট আপনি আমার গায়ে দেখিয়াছেন, উহা সেই কোটই বটে। এই কোট আমি সাতটাকা নয় আনা মূল্যে গাঙ্গুলি ব্রাদারের দোকান হইতে ক্রয় করিয়াছিলাম। আমি যে বাসায় থাকিতাম, সেই বাসায় ললিতবাবু নামে আর একটি যুবক থাকিতেন। আমরা উভয়েই এই প্রকারের দুইটি কোট একদিবসে ক্রয় করিয়াছিলাম।”
রামযাদুবাবুর এই কথা শ্রবণ করিয়া আমার অন্তরে আরএকটু নূতন আশার সঞ্চার হইল। আমি কহিলাম, “ললিতবাবু যে কোট খরিদ করিয়াছিলেন, তাহা কি একই প্রকারের ও সমান মূল্যের?”
রামযাদু। এক জোড়া কোর্ট, উভয় কোট একই প্রকারের ছিল, দামও এক।
আমি। গাঙ্গুলি ব্রাদারের সহিত আপনার দেনা পাওনা ছিল কি? আপনি সেই কোট ধারে লয়েন, না উহার নগদ মূল্য প্রদান করেন?
রামযাদু। স্মরণ হইতেছে, আমি উহা সেই সময়ে ধারে লইয়াছিলাম। পরিশেষে সময়মত আমি সেই ঋণ পরিশোধ করিয়াছি।
আমি। আপনার মনে আছে কি, যে কোটটি ললিতবাবু লইয়াছিলেন, তাহার মূল্য তিনি সেই সময়ে প্রদান করেন, কি বাকি থাকে?
রামযাদু। আমার বোধ হয়, ললিতবাবু উহা নগদ মূল্যে খরিদ করিয়াছিলেন।
আমি। ললিতবাবুর পূরা নাম কি?
রামযাদু। শ্রীললিতমোহন মুখোপাধ্যায়।
আমি। তিনি এখন কোথায়, তাহা আপনি বলিতে পারেন?
রামযাদু। এখন তিনি যে কোথায়, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু তাঁহার ভ্রাতা যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কলিকাতার জেনারেল পোষ্ট আফিসের একজন কেরাণী। তাঁহার বাসা কোথায়, তাহা আমি অবগত নহি; তাঁহাদিগের বাসস্থানও আমি জানি না।
রামযাদুবাবুর নিকট এই কয়েকটি কথা অবগত হইয়া আমার মনে একটু আশা হইল। ভাবিলাম, কোট-সম্বন্ধীয় অনুসন্ধান ললিতবাবুর নিকটেই সম্ভতঃ শেষ হইয়া যাইবে। তবে তাঁহার নিকট হইতে যদি কোন প্রকার সন্ধান না পাওয়া যায়, তাহা হইলেই আবার অন্য কোনরূপ সূত্র বাহির করিয়া তাহারই আশ্রয় লইতে হইবে। আর উপস্থিত সূত্রে বৃথা কৰ্ম্মভোগই সার হইবে। যাহা হউক, রামযাদুবাবুকে আর কোন কথা না বলিয়া, সেইদিবস সেইস্থানেই অতিবাহিত করিলাম। পরদিবস, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া কলিকাতা অভিমুখে আগমন করিলাম। রামযাদু বাবুও আমার সহিত তাঁহার বাটী হইতে বহির্গত হইয়া আপনার গন্তব্য স্থানে প্রস্থান করিলেন। আমিও সময়-মত কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, কিন্তু সময় অভাবে সেই দিবস জেনারেল পোষ্ট আফিসে গমন করিয়া যোগেন্দ্রনাথের সন্ধান করিতে পারিলাম না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরদিবস বেলা দশটার সময় জেনারেল পোষ্ট আফিসে গমন করিয়া যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সন্ধান করিলাম। ললিতের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানাইলেন যে, ললিত এখন কলিকাতার প্রধান টেলিগ্রাফ আফিসে কর্ম্ম করেন। উভয় ভ্রাতা একই বাসায় থাকেন। জেলে-পাড়ার ভিতর তাঁহাদের বর্তমান বাসা।
যোগেনবাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া টেলিগ্রাফ আফিসেও গমন করিলাম। সন্ধান করিয়া ললিতবাবুকে বাহিরও করিলাম। তিনি আমাকে আফিসের বাহিরে দাঁড়াইতে কহিলেন। আমি তাঁহার নির্দেশানুযায়ী স্থানে প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা কাল দাঁড়াইয়া থাকিয়া পরে দেখিলাম, ললিতবাবু আমার নিকট আগমন করিলেন। তিনি আমার নিকট আসিলে পর, আমি তাঁহাকে আমার পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র।
আমি। যে সময়ে আপনি বহুবাজারে থাকিতেন, সেই সময়ে আপনাদিগের বাসায় রামযাদু নামে আর একটি বাবু থাকিতেন, আপনার মনে হয় কি?
ললিত। হাঁ মহাশয়! মনে আছে, রামযাদু ও আমি একই ঘরে থাকিতাম।
আমি। আপনি ও রামযাদু দুইজনে একদিবস গাঙ্গুলি ব্রাদারের দোকানে একই প্রকারের দুইটি গরম কোট ক্রয় করিয়াছিলেন, মনে হয় কি?
ললিত। হাঁ, অল্প অল্প মনে হইতেছে।
আমি। আপনি সেই কোটের মূল্য সাত টাকা নয় আনা নগদ দিয়াছিলেন, আর রামযাদুবাবুর কোটের দাম বাকি ছিল?
ললিত। বোধ হয়, আমি নগদ টাকা দিয়াই খরিদ করিয়াছিলাম।
আমি। আপনি যে কোটটি খরিদ করিয়াছিলেন, সে কোটটি এখন কোথায়?
ললিত। সে কোটটি যে কোথায়, তাহা আমি বলিতে পারি না। কারণ, আমি উহা নিজের জন্য খরিদ করি নাই, অপরের নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলাম।
আমি। কাহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলেন?
ললিত। কাহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলাম, তাহাও জানি না। আমার খুড়া মহাশয়ের পত্র-মত খরিদ করিয়াছিলাম। তাঁহার কোন বন্ধুর অনুরোধক্রমে মাপের সহিত তিনি আমার নিকট আটটি টাকা পাঠাইয়া দেন, এবং সেই মাপ—মত একটি কোট খরিদ করিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিতে লেখেন। আমি সেই কোট খরিদ করিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দেই।
আমি। আপনার খুড়া কোথা হইতে আপনাকে পত্র লেখেন, এবং কোট কিনিয়া আপনি কোথায় পাঠাইয়া দেন? ললিত। আমার খুড়া মহাশয় কানপুর হইতে আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন, আমিও সেই কোট খরিদ করিয়া তাঁহার নিকট সেইস্থানে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।
আমি। আপনার খুড়া মহাশয় এখন কোথায় আছেন?
ললিত। কানপুরেই আছেন, সেইস্থানেই তিনি ব্যবসা বাণিজ্য করিয়া থাকেন।
আমি। তাঁহার নাম কি?
ললিত। আমার খুড়া মহাশয়ের নাম কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
আমি। আপনার খুড়া মহাশয় সেই কোট কাহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলেন, তাহা আপনি জানেন কি? ললিত। আমি পূৰ্ব্বেই ত আপনাকে বলিয়াছি যে তিনি কাহার নিমিত্ত কোট খরিদ করিয়াছিলেন, তাহা আমি জানি না। তবে তিনি তাঁহার নিজের নিমিত্ত যে উহা খরিদ করেন নাই, ইহা স্থির।
ললিতবাবুর নিকট এই কয়েকটি কথা অবগত হইয়া আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। ললিতবাবুও আফিসের ভিতর গমন করিলেন।
এ সম্বন্ধে কলিকাতার অনুসন্ধান আপাততঃ শেষ হইল এখন কানপুরে গমন করিয়া কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অনুসন্ধান আবশ্যক হইল। যাহা অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধান চলিতেছে, শীঘ্রই তাহার শেষ মীমাংসা করা প্রয়োজন বিবেচনায়, সেই দিবস রাত্রি নয়টার সময় মেলট্রেণে কানপুর যাইবার অভিপ্রায়ে কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। নিয়মিত সময়ে গাড়ি কানপুরে গিয়া উপস্থিত হইল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া কোথায় যে গমন করিব, তাহা ক্ষণকালের নিমিত্ত চিন্তা করিলাম। ইতিপূর্ব্বে দুই এক বার যদিও আমি কানপুরে গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু কাহারও সহিত সবিশেষ আলাপ—পরিচয় না থাকায় প্রথম একটু ভাবিলাম সত্য কিন্তু পরিশেষে একখানি গাড়ি করিয়া সহরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
কানপুরে বাঙ্গালীর সংখ্যা নিতান্ত কম নহে, তথাপি কান্তিবাবুর অনুসন্ধান করিতে আমাকে সবিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। দুই এক জন বাঙ্গালীকে জিজ্ঞাসা করার পরই কান্তিবাবুর বাসার ঠিকানা জানিতে পারিলাম। যে সময়ে আমি কান্তিবাবুর বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে কান্তিবাবু বাসায় ছিলেন না; প্রায় দুই ঘণ্টাকাল কান্তিবাবুর বাসায় অপেক্ষা করার পর কান্তিবাবু বাসায় আসিলেন। আমাকে দেখিয়া কান্তিবাবু আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাঁহাকে আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিয়া কহিলাম, “আমি মহাশয়কে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত কলিকাতা হইতে এখানে আগমন করিয়াছি। যদি অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করেন, তাহা হইলে সবিশেষ উপকৃত হইব, ও পরিশেষে কি নিমিত্ত এই সকল কথা আমি মহাশয়ের নিকট হইতে অবগত হইতে চাহিতেছি, তাহার বিশিষ্ট কারণও মহাশয়কে কহিব।”
আমার কথায় কান্তিবাবু সম্মত হইলে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র ললিতমোহন মুখোপাধ্যায় যে এক সময়ে কলিকাতার বহুবাজারে থাকিতেন, তাহা আপনার মনে আছে কি?
কান্তি। খুব মনে আছে।
আমি। সেই সময়ে একটি গরম কোট খরিদ করিয়া আপনার নিকট পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত আপনি কোটের মাপ ও আটটি টাকা তাঁহার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন, স্মরণ আছে?
কান্তি। (একটু চিন্তার পর) হাঁ মনে হইতেছে, ললিত একটি কোট খরিদ করিয়া ডাকে আমার নিকট পাঠাইয়াছিল।
আমি। সেই কোটটি এখন কোথায়? আমি একবার তাহা দেখিতে ইচ্ছা করি।
কান্তি। সেই কোট আমার নিকট নাই, আমি উহা আমার নিজের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে আনাই নাই। রামসুন্দরবাবুর পুত্র উপেন্দ্রনাথের নিমিত্ত সেই কোট খরিদ করা হইয়াছিল।
আমি। রামসুন্দরবাবু এখন কোথায়, ও তাঁহার পুত্র উপেন্দ্রনাথই বা এখন কোথায় আছেন?
কান্তি। রামসুন্দরবাবু এইখানেই আছেন, তিনি এই স্থানের একজন প্রধান কন্ট্রাক্টর। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ যে কোথায় আছে, তাহা আমি অবগত নহি। অনেক দিবস আমি তাহাকে দেখি নাই।
আমি। রামসুন্দরবাবু এখান হইতে কতদূর অন্তরে অবস্থান করেন? এখন সেইস্থানে গমন করিলে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারে কি?
কান্তি। তাঁহার বাসা এ স্থান হইতে বহুদূর নহে, আমি আপনাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিকট গমন করিব। কিন্তু কি নিমিত্ত আপনি এই অনুসন্ধানে এতদূর আগমন করিয়াছেন, তাহা এখন আমি জানিতে ইচ্ছা করি।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
সেই সময়ে আমি কান্তিবাবুকে কহিলাম, “যে বিষয় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এতদূর পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছি, তাহার সমস্ত ব্যাপার এখন আমি আপনাকে বলিতে পারি, কিন্তু রামসুন্দরবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে, হঠাৎ আপনি তাহাকে কোন কথা বলিবেন না।” এই বলিয়া এই হত্যাকাণ্ডের সমস্ত কথা এক এক করিয়া, তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম। যেরূপ অবস্থায় রুধির-রঞ্জিত ছুরিকাহস্তে মৃতার সম্মুখে হত্যাকারীকে পাওয়া যায়, যেরূপ ভাবে হত্যাকারী আপনার দোষ স্বীকার করিয়া চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবার জন্য লোলুপ, পুলিস ও ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে যেরূপ ভাবে সে আপনার পরিচয় গোপন করিয়া আসিতেছে, তাহার কোন কথাই বলিতে আমি ত্রুটি করিলাম না। এক এক করিয়া সকল কথাই আমি কান্তিবাবুকে কহিলাম; এবং পরিশেষে যে নিমিত্ত এই অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হইয়াছে, জেলের ভিতর সেই হত্যাকারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যেরূপভাবে আমি তাহাকে বঞ্চনা করিবার উপায় করিয়াছিলাম, এবং তাহাতে কৃতকাৰ্য্য না হইয়া যে প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়া সেই কোটের অনুসন্ধান করিতে করিতে ততদূর পর্য্যন্ত গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপারও কান্তিবাবুকে সবিস্তারে বলিলাম। আমার সমস্ত কথা শেষ হইলে, কান্তিবাবু একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন ও কহিলেন, “এই সকল কথা যদি রামসুন্দরবাবু জানিতে পারেন, তাহা হইলে এক বিপদের উপর আর এক বিপদ্ আসিয়া উপস্থিত হইবে। উপেন্দ্রনাথ রামসুন্দরবাবুর একমাত্র পুত্র। এই কথা শ্রবণমাত্র বৃদ্ধ একবারে অধীর হইয়া পড়িবেন, এমন কি হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জ্জিত হইয়া আত্মঘাতী হওয়াও বৃদ্ধের পক্ষে অসম্ভব নহে। এরূপ অবস্থায় অন্য কোন উপায় অবলম্বন করা কৰ্ত্তব্য।”
কান্তিবাবুর কথা শুনিয়া ভাবিলাম যে, কান্তিবাবুর বুদ্ধি নিতান্ত অযুক্ত নহে। এরূপ অবস্থায় বৃদ্ধকে এই সংবাদ একবারে প্রদান করা কোনক্রমেই হইবে না। এই ভাবিয়া কান্তিবাবুর সহিত নানাপ্রকার পরামর্শের পর, পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, প্রথমে আমি গিয়া সেই বৃদ্ধের সহিত সাক্ষাৎ করিব না। কান্তিবাবু যেমন সর্ব্বদা তাঁহার নিকট গমন করিয়া থাকেন, আজও সেইরূপ ভাবে তাঁহার নিকট গমন করিবেন, এবং কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিয়া লইবেন—তাঁহার পুত্র উপেন্দ্রনাথ এখন কোথায় আছে, আর উপেন্দ্রনাথের যে কোট তিনি কলিকাতা হইতে আনাইয়া দিয়াছিলেন, সেই কোটই বা এখন কোথায়?
এইরূপ পরামর্শ স্থির হইবার পর, সময় মত কান্তিবাবু রামসুন্দরবাবুর বাসায় গমন করিলেন। আমি কান্তিবাবুর বাসাতেই রহিলাম। বাসার সকলের নিকট কান্তিবাবু আমার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন—আমি তাঁহার একজন আত্মীয় সুতরাং কান্তিবাবু ব্যতীত সেই সময়ে আমার প্রকৃত পরিচয় আর কেহই পাইল না।
সন্ধ্যার পর কান্তিবাবু বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, প্রায় দুইমাস পূৰ্ব্বে উপেন্দ্রনাথ কানপুর হইতে তাহার শ্বশুরালয় কাশীধামে গমন করেন। সেই সময়ে তাহার স্ত্রী তাহার মাতার নিকট কাশীতেই বাস করিতেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ কাশীতে পৌঁছিয়া পিতাকে দুইখানিমাত্র পত্র লেখেন, কিন্তু তাহার পর বৃদ্ধ রামসুন্দর উপেন্দ্রনাথের আর কোন সংবাদ প্রাপ্ত হন না। পত্রের উপর পত্র লেখেন, কিন্তু পত্রের কোনই উত্তর না পাইয়া নিতান্ত চিন্তিত হইয়া পড়েন, এবং পরিশেষে তাঁহার একজন উপযুক্ত কৰ্ম্মচারীকে উপেন্দ্রনাথের অনুসন্ধান করিতে কাশীতে প্রেরণ করেন। আজ দুইদিবস হইল, উক্ত কর্ম্মচারী কাশী হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। এই কর্মচারীর সহিতও কান্তিবাবুর সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার নিকট হইতে কান্তিবাবু আরও অবগত হইতে পারিয়াছেন যে, কৰ্ম্মচারী সন্ধান করিয়া যে স্থানে উপেন্দ্রনাথের শ্বশ্রুঠাকুরাণী বাস করিতেন, সেইস্থানে গমন করেন; কিন্তু সেইস্থানে কাহাকেও দেখিতে পান না। সন্ধান করিয়া অবগত হয়েন যে, উপেন্দ্রনাথের সেইস্থানে গমনের দুই এক দিবস পরেই তাঁহার শাশুড়ীর কাশীপ্রাপ্তি হয়। এই ঘটনার দুই দিবস পর পর্যন্ত সকলেই সেই স্থানে উপেন্দ্রনাথ ও তাঁহার স্ত্রীকে দেখিয়াছে; কিন্তু তাহার পর তাঁহারা উভয়েই যে কোথায় গমন করিয়াছেন, একথা আর কেহই বলিতে পারে না। কর্ম্মচারী প্রত্যাগমন করিয়া বৃদ্ধকে এই সংবাদ প্রদান করায়, বৃদ্ধ একবারে শয্যাশায়ী হইয়াছেন। পুত্রশোকে নিতান্ত বিহ্বল হইয়া, অবিরত অশ্রুজল বিসর্জ্জন করিতেছেন। কাহারও প্রবোধ মানিতেছেন না। তাঁহার পুত্র জীবিত আছেন, একথা তাঁহার হৃদয়ঙ্গম করান এখন নিতান্ত সহজ কাৰ্য্য নহে।
কাশীতে গমন করিবার সময় উপেন্দ্রনাথ কি কি বস্তু লইয়া গিয়াছেন, বাড়ীর চাকরের নিকট সেই বিষয়ের সন্ধান করায় কান্তিবাবু জানিতে পারিয়াছেন যে, যে কোটের অনুসন্ধান উপলক্ষে আমি এতদূর আগমন করিয়াছি, সে কোট তিনি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছেন।
কান্তিবাবুর সাহায্যে এতগুলি বিষয় অবগত হইয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলাম। আমার মনের মনে একটু আনন্দও হইল; যে বিষয়ের অনুসন্ধান উপলক্ষে আমি এত কষ্ট সহ্য করিয়াছি, আজ সেই কষ্টের সুফল লাভ হইল। হত্যাকারীর পরিচয় এতদিনে প্রাপ্ত হইলাম। যে বিষয়ের নিমিত্ত আমার ঊর্দ্ধতন কর্মচারীমাত্রেই নিতান্ত উদ্গ্রীব আজ সেই কার্য্যের শেষ হইল। অনুসন্ধানের মধ্যে এখন কেবল বাকি থাকিল হত্যা করিবার উদ্দেশ্য। যখন
লোক ঠিক হইল, তাহার বাসস্থান নির্ণয় হইল, তখন হত্যার উদ্দেশ্য যে সহজেই বাহির হইতে পারিবে, হৃদয়ে এ আশা স্থান পাইল।
এদিকে কিন্তু বৃদ্ধের অবস্থা শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয়ে অতিশয় দুঃখ হইল। তখন তাঁহার যেরূপ অবস্থা হইয়াছিল সেরূপ অবস্থায় তাঁহার নিকট উপস্থিত ঘটনার প্রকৃতকথা বলিয়া সে সময় তাঁহার হৃদয়ের প্রজ্বলিত পাবকের উপর ঘৃতাহুতি কি প্রকারে প্রদান করিব?
অষ্টম পরিচ্ছেদ
বর্তমান ঘটনা বৃদ্ধকে বলা উচিত কি না, সেই বিষয়ে কান্তিবাবুর সহিত নানাপ্রকার তর্ক-বিতর্ক হইয়া, পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে, এ বিষয় বৃদ্ধকে বলাই কর্তব্য! কারণ, প্রথমতঃ বৃদ্ধ যে পুত্রের কোনরূপ সন্ধান পাইতেছেন না, তাহার সন্ধান পাইবেন। দ্বিতীয়তঃ যে মোকদ্দমায় এখন উপেন্দ্রনাথ আসামী, বিনা-চেষ্টায় সেই মোকদ্দমা হইতে কোন প্রকারেই তাহার পরিত্রাণের উপায় নাই। তাহার পিতা যদি এ সংবাদ প্রাপ্ত না হয়েন, তাহা হইলে কেই বা মোকদ্দমার তত্ত্বাবধান করিবে? আর কেই বা অর্থের সাহায্য করিতে সমর্থ হইবে? এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া চিন্তিয়া, তাহার পরদিবস বৃদ্ধকে সংবাদ দেওয়াই স্থির করিলাম।
পরদিবস প্রাতঃকালে আমি ও কান্তিবাবু উভয়েই রামসুন্দরবাবুর বাসায় গমন করিলাম। সেই সময় রামসুন্দরবাবু বাড়ীর ভিতরে ছিলেন। কান্তিবাবু একজন পরিচারকের দ্বারা সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন যে, একটি বাবু উপেন্দ্রনাথের সংবাদ লইয়া আগমন করিয়াছেন।
রামসুন্দরবাবু এই সংবাদ পাইবামাত্র বাহিরে আসিলেন। আমরা উভয়েই সম্মুখে বসিয়াছিলাম; আমাদিগকে দেখিয়া রামসুন্দরবাবু কহিলেন, “উপেন্দ্রের সংবাদ কে আনিয়াছেন? আমার উপেন্দ্র এখন কোথায়? সে ভাল আছে ত?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “আমিই উপেন্দ্রবাবুর সংবাদ আনিয়াছি। তিনি যদিও এখন প্রাণগতিক ভাল আছে, কিন্তু তিনি নিতান্ত বিপদাপন্ন।”
“উপেন্দ্র আমার বিপদাপন্ন! সে এখন কোথায়? তাহার কি বিপদ্ ঘটিয়াছে?” এই বলিয়া বৃদ্ধ বসিয়া পড়িলেন। “উপেন্দ্রবাবু যে প্রকার বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন, তাহাই আপনাকে বলিবার নিমিত্ত আমি এতদূর আগমন করিয়াছি। আপনি স্থির না হইলে, সমস্ত কথা আমি আপনাকে কি প্রকারে বলিতে সমর্থ হই? উপেন্দ্রবাবু এখানে নাই, তিনি এখন কলিকাতায়। কোন ফৌজদারী মোকদ্দমায় পড়িয়া তিনি এখন আসামী হইয়াছেন। বিচার এখনও শেষ হয় নাই।” আমি একে একে এই কথাগুলি বলিলাম।
“উপেন্দ্র যে আমার জীবিত আছে, ইহা শুনিয়া আমি আজ কতক সুস্থ হইলাম। ফৌজদারী মোকদ্দমায় সে আসামী হইয়াছে, তাহাতে আমি ততদূর ভাবিত নহি। তাহার নিমিত্ত খরচ-পত্র করিব, উকীল কৌন্সলি বন্দোবস্ত করিয়া দিব; সে নিশ্চয়ই অব্যাহতি পাইবে। আপনি যে আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিতে আসিয়াছেন, আপনি কে?” বুদ্ধ যেন কিঞ্চিৎ সুস্থভাবে আমায় এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি উত্তর দিলাম, “আমি একজন পুলিস কর্ম্মচারী। আপনার পুত্রের অনুরোধ-ক্রমে আপনাকে এই সংবাদ প্রদান করিতে এতদূর আগমন করিয়াছি।”
“আপনি যখন পুলিস কর্ম্মচারী, তখন আপনি বোধ হয়, নিশ্চয়ই বলিতে পারিবেন যে, আমার উপেন্দ্রনাথ কিরূপ ফৌজদারী মোকদ্দমায় পড়িয়াছে, কে তাহার নামে নালিস করিয়াছে। কি নিমিত্তই বা তাহার নামে অভিযোগ হইয়াছে, এবং কিরূপেই বা সে কাশী হইতে আমাদিগকে সংবাদ না দিয়া, একবারে কলিকাতায় গমন করিয়াছে?”
বৃদ্ধের প্রশ্নে আমাকে তখন একটু ভাবিতে হইল। ভাবিলাম যদি এখন আমি বৃদ্ধকে সমস্ত কথা পরিষ্কাররূপে কহি, তাহা হইলে বৃদ্ধ ভাবি বিপদের আশঙ্কায় একবারে অধীর হইয়া পড়িবেন, হয় ত এক করিতে আর এক বিষম বিপদ উপস্থিত হইবে। শেষে বৃদ্ধকে সুস্থ করাও দায় হইয়া উঠিবে। এইরূপ নানাপ্রকার ভাবিয়া পরিশেষে আমাকে মিথ্যা কথা কহিতে হইল। এইরূপ মিথ্যা কথায় পাপ আছে কিনা, জানিনা; কিন্তু সেই কল্পিত পাপের বিভীষিকার দিকে মুহূর্তের নিমিত্ত লক্ষ্য না করিয়া কহিলাম, “আমি সেই সংবাদ আপনাকে প্রদান করিবার নিমিত্ত এইস্থানে আসি নাই, এবং সবিশেষ অবস্থাও আমি উত্তমরূপে অবগত নহি। কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমাকে কানপুরে আগমন করিতে হয়। কানপুরে আগমন করিবার পূর্ব্বে কোন কার্য্যের নিমিত্ত খুনি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত একজন আসামীর সহিত দেখা করিবার অভিপ্রায়ে হরিণবাড়ীর জেলে আমি গমন করিয়াছিলাম। সেইস্থানে আপনার পুত্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। আমি কানপুরে আগমন করিব জানিতে পারিয়া, আপনার পুত্র তাহার বিপদের সংবাদ আপনাকে প্ৰদান করিতে কহিল। আরও বলিয়া দিল, ‘আপনি যখন কানপুর হইতে প্রত্যাগমন করিবেন, সেই সময় আমার পিতাকে সঙ্গে করিয়া আনিবেন। তিনি এখানে আগমন না করিলে, এ বিপদ হইতে আমার উদ্ধারের কোন প্রকার উপায়ই হইবে না। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, তিনি কি মোকদ্দমায় অভিযুক্ত? তাহাতে তিনি আমাকে কেবলমাত্র ইহাই বলিয়াছিলেন, ‘আমি কোনরূপ গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া হাজতে আছি; পিতা এখানে আগমন করিলে সমস্তই জানিতে পারিবেন?”
“ইহা ব্যতীত আর কোনরূপ সংবাদ আমি আপনাকে দিতে পারিব না। এইরূপ অবস্থায় যদি আপনি আমার সহিত কলিকাতায় গমন করিতে চাহেন, তাহা হইলে যাইতে পারেন। আমি কল্য প্রাতঃকালেই এইস্থান পরিত্যাগ করিব, যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি এখানে আগমন করিয়াছিলাম, আমার সেই কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে।”
দেখিলাম, বৃদ্ধ আমার সমস্ত কথা বিলক্ষণ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলেন। পরদিবস আমার সহিত কলিকাতায় আগমন করাই তাঁহার স্থির হইল।
সেই দিবসও আমাকে কান্তিবাবুর বাসায় থাকিতে হইল। কান্তিবাবু কোন কথাই রামসুন্দরবাবুর নিকট প্রকাশ করিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে বৃদ্ধ তাঁহার সরকার ও একটি মাত্র চাকর সঙ্গে লইয়া, আমার সহিত কানপুর পরিত্যাগ করিলেন। সময়-মত আমরা সকলেই কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
যে দিবস আমরা কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম সেইদিবসই রামসুন্দরবাবু তাঁহার পুত্রের সহিত সাক্ষাৎ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন, এবং যাহাতে আমি তাঁহার সঙ্গে গমন করিয়া, উপেন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিতে পারি, তাহার নিমিত্ত আমাকেও বার বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমি যেন তাঁহার অনুরোধেই সম্মত হইয়া কহিলাম, “তাহাই হইবে, আজই আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া হরিণবাড়ীর জেলে লইয়া যাইব, এবং যাহাতে উপেন্দ্রনাথের সহিত আপনার সাক্ষাৎ করাইয়া দিতে পারি, তাহার বন্দোবস্ত করিব।” এই বলিয়া কেবলমাত্র বৃদ্ধকে সঙ্গে লইয়া, আমি সেইদিবসই হরিণবাড়ীর জেলে গমন করিলাম। যাইবার সময় পথিমধ্যে আমি তাঁহাকে কহিলাম’, ‘দেখুন রামসুন্দরবাবু! উপেন্দ্রনাথ এখন হাজতের আসামী। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করা নিতান্ত সহজ নহে। জেলের প্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ ব্যতিরেকে কেহই হাজতের আসামীর সহিত কথা কহিতে পারে না, সেই জন্যই হাজতের আসামীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রায় সকলেই সেইস্থানে প্রাতঃকালে গমন করিয়া থাকে। কারণ, সেই প্রধান কর্মচারীর সহিত প্রাতঃকালে ভিন্ন সাক্ষাৎ হইবার, বা তাহার নিকট হইতে অনুমতি পাইবার আর কোন উপায় নাই। এইরূপ অবস্থায় যখন আপনি এখনই গমন করিতেছেন, তখন যে উপেন্দ্ৰনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কথা কহিতে পারিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না। তবে উপায়ের মধ্যে এই আছে যে, আমি পুলিস কৰ্ম্মচারী আমি যখন ইচ্ছা তখনই জেলের ভিতর গমন করিয়া, যাহার সহিত ইচ্ছা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বা তাহার সরিত কথাবার্তা কহিতে পারি। যখন আপনি আপনার পুত্রকে নিতান্তই দেখিতে চাহিতেছেন, তখন আমি আপনার নিমিত্ত জেলের ভিতর গমন করিব, এবং সঙ্গে করিয়া উপেন্দ্রনাথকে এরূপ স্থানে আনয়ন করিব, যাহাতে আপনি জেলের বাহিরে দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহাকে দেখিতে পারেন। আপনি যে সকল বিষয় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিবেন, তাহাও আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আপনাকে বলিতে পারিব। ইহা ব্যতীত যদি আপনি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে বা পরামর্শাদি দিতে চাহেন, তাহা হইলে অপর কোনদিবস সময়-মত আসিয়া প্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ লইয়া, আপনি আপনার মনেবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিবেন।”
দেখিলাম, বুদ্ধ আমার কথায় সম্মত হইয়া আমার মতেই মত দিলেন। তাঁহাকে জেলের বাহিরে রাখিয়া আমি জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বৃদ্ধ জেলের দ্বারের সম্মুখে রেলের বাহিরে পুত্রকে দর্শন করিবার মানসে দণ্ডায়মান রহিলেন। আমি জেলের ভিতর গমন করিবার সময় তিনি আমাকে বলিয়া দিলেন, “উপেন্দ্রনাথ কি মোকদ্দমায় পড়িয়াছে, কেনই বা তাহার হাজত হইয়াছে, এবং ইহার নিমিত্ত কি প্রকার সংগ্রহ আবশ্যক, ইহার সমস্ত কথা ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া লইবেন, আরও জিজ্ঞাসা করিবেন যে, সে কলিকাতয় আসিয়াছে কেন? এবং তাহার পরিবারই বা এখন কোথায়?”
এ সমস্তই উপেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া, আমি তখন জেলের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, জেলের প্রধান কর্মচারীগণ আমাকে চিনিতেন। সম্মুখেই ‘জেলার’ সাহেবকে দেখিতে পাইয়া, তাঁহাকে আমার মনের কথা বলিলাম। তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া হত্যাকারীকে আমার সম্মুখে আনয়ন করিলেন। তাহাকে দেখিবামাত্র আমি কহিলাম, “উপেন্দ্রনাথ! আমি পুনরায় আগমন করিয়াছি, এবং ঐ দেখ, তোমাকে দেখিবার নিমিত্ত আরও এক ব্যক্তি আমার সহিত আসিয়া দ্বারের সম্মুখে দণ্ডায়মান আছেন।” এই বলিয়া বৃদ্ধ রামসুন্দরের প্রতি অঙ্গুলি সঙ্কেত করিয়া তাঁহাকে দেখাইয়া দিলাম।
উপেন্দ্রনাথ বৃদ্ধের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন সত্য, কিন্তু সেই দৃষ্টি ক্ষণস্থায়ী হইলমাত্র। মুহূর্তমধ্যে উপেন্দ্রনাথ আপনার মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার মুখ হইতে একটিও কথা নির্গত হইল না।
উপেন্দ্রনাথের সেই অবস্থা দেখিয়া আমার হৃদয়ে ভয় হইল। ভাবিলাম, উপেন্দ্রনাথ হত্যাপরাধে অভিযুক্ত; সুতরাং তাহার মন সততই যে অসীম চিত্তায় পরিপূর্ণ, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহার উপর উহার যে অভিসন্ধিই থাকুক, যে কারণে ইনি আপনার পরিচয় প্রদান করিতে একবারে অসম্মত, আজ যে কেবল তাহাই প্রকাশ হইয়া পড়িল, তাহা নহে; তাঁহার সেই স্নেহময় বৃদ্ধ পিতা তাঁহার বিপদের কথা শ্রবণ করিয়া, আর কোন প্রকারেই যখন আপনার মন স্থির রাখিতে পারিলেন না, পুত্রকে দেখিবার নিমিত্ত, এই ঘোর বিপদ্ হইতে তাহার প্রাণরক্ষা করিবার নিমিত্ত, যখন এতদূর পর্য্যন্ত আসিয়া উপনীত হইলেন, তখন উপেন্দ্রনাথের মনের ভাব যে কিরূপ হইল, তাহা অনুমান করা উপেন্দ্রনাথ ব্যতীত অপরের সাধ্য নহে। এরূপ অবস্থায় বিপদের উপর বিপদ্ ঘটিবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। সেই চিন্তারুগ্ন কারারুদ্ধ উপেন্দ্রনাথের পক্ষে এই সময়ে আপনার মনকে স্থির রাখা নিতান্ত সহজ নহে।
আমার সঙ্কেতানুযায়ী ‘জেলার’ সাহেব উপেন্দ্রকে একটি গৃহের ভিতর লইয়া গেলেন। উপেন্দ্রনাথ সেইস্থানে গিয়া বসিয়া পড়িলেন। আমিও সেইস্থানে উপবেশন করিলাম, জেলার সাহেবও আমার নিকট উপবেশন করিলেন।
আজ ভয়ানক পরীক্ষার দিন! এই ভয়ানক পরীক্ষা হইতে যদি উপেন্দ্রনাথ উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবেই জানিব যে, তিনি স্থির-প্রতিজ্ঞ। আজ বুঝিতে পারিব যে, উপেন্দ্রনাথ তাঁহার এই বিপদের সময়েও তাঁহার মনকে স্থির রাখিতে পারেন কি না। তিনি যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ, আজ বুঝিতে পারিব, সেই প্রতিজ্ঞা তাঁহার যৌবন-সুলভ আবিলময় চঞ্চল হৃায়ের অস্থায়িনী প্রতিজ্ঞা, কি দৃঢ় ও নিৰ্ম্মল হায়ের অবিনশ্বর খোদিত অক্ষর। আজ বুঝিতে পারিব, তাঁহার সেই অস্বাভাবিক ঘোর প্রতিজ্ঞার অর্থ কি?
সেই সময় আমি উপেন্দ্রনাথকে ডাকিলাম, “উপেন্দ্রনাথ!”
উপেন্দ্রনাথ আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাঁহার চক্ষে যে দৃষ্টি আমি পূৰ্ব্বে দেখিয়াছিলাম, আজ সে দৃষ্টি নাই। ঘোর প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ, ভয়ানক বিপদ-সঙ্কুল বিষয়ে নির্ভয় চক্ষুর যে চাহনি, আজ সে চাহনি নাই। আজ তাঁহার চক্ষু সরল বালকের চক্ষু বলিয়া বোধ হইল। যে শুল্ক চক্ষু লইয়া সে দিবস উপেন্দ্রনাথ আমার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিলেন, এখন দেখিলাম, সে চক্ষু তিনি হারাইয়াছেন। তাহার পরিবর্তে পদ্ম-পত্রের জলের ন্যায় টলটলায়মান জলভরা চক্ষু লইয়া আজ তিনি আমার সম্মুখে বিরাজ করিতেছেন। স্ফটিকসদৃশ জলবিন্দু চক্ষুর এদিক ওদিক ঘুরিতেছে, কিন্তু পড়িতে পড়িতেও তাহা স্থানভ্রষ্ট হইতেছে না।
“উপেন্দ্রনাথ! তুমি এখন বুঝিতে পারিলে, পূর্ব্বে আমি তোমার নিকট কোনরূপ মন্দ অভিপ্রায়ে আসিয়াছিলাম, কি বাস্তবিকই তোমার কোন আত্মীয়ের নিকট হইতে আসিয়াছিলাম? বোধহয় বুঝিয়াছ। যখন বুঝিতে পরিয়াছ, তখন প্রকৃত কথা কহিবে কি? আর প্রকৃত কথা না বলিলেও কি তুমি এখন বিবেচনা কর যে, তুমি মরিতে পারিবে? যদি আমরা এ বিষয় কিছুই অবগত হইতে না পারিতাম, তোমার পিতা যদি তোমার সাহায্যের নিমিত্ত এখানে আগমন না করিতেন, তাহা হইলে হয়ত তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী কার্য্য করিলেও করিতে পারিতে। কিন্তু জানিও, এখন আর তাহা হইবে না। ভাল হউক, আর মন্দ হউক, তুমি তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে কোনক্রমেই পারিবে না। তোমার এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে আমরা বড় বড় কৌন্সলির মত লইয়াছি। পুলিস এই মোকদ্দমার প্রমান স্বরূপ যে সকল সাক্ষী উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহাদিগের জবানবন্দীর নকল তাঁহাদিগকে দেখাইয়াছি। কাগজপত্র দেখিয়া তাঁহারা সকলেই বলিয়াছেন যে, এ মোকদ্দমায় তুমি তোমার দোষ নিজমুখে স্বীকার করিলেও কোন প্রকারেই তোমার ফাঁসী হইবার সম্ভাবনা নাই। এরূপ অবস্থায় প্রকৃতকথা গোপন করা আর তোমার কোন প্রকারেই কর্তব্য নহে। বিশেষতঃ তোমার বৃদ্ধ পিতা কেবল প্রকৃত বিষয় অবগত হইবার মানসেই এতদূর পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছেন। তোমার এই বিপদের সংবাদ পাইবার পর তিনি কাশীধামেও গমন করিয়াছিলেন; সেইস্থানে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহাও তাঁহার জানিতে আর বাকি নাই। আমি তোমাকে যে সকল কথা বলিতেছি, যে বিষয় তোমার নিকট অবগত হইতে চাহিতেছি, তোমার পিতা স্বয়ং আসিয়াই সেই সকল বিষয় তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেন। কিন্তু তিনি পিতা, তুমি পুত্র; পাছে সকল কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতে তোমার লজ্জাবোধ হয়, এই নিমিত্ত তিনি নিজে তোমার নিকট হইতে সেই সকল কথা শ্রবণ করিতে না আসিয়া বাহিরে দণ্ডায়মান আছেন, এবং তাঁহার প্রতিভূস্বরূপ আমাকে তোমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। এখন আর কোন কথা তোমার গোপন করা উচিত নহে; বিশেষতঃ যে বিষয়ের অনেক কথা তিনি যখন জানিতে পারিয়াছেন, সেই বিষয় তখন গোপন করিয়া তোমার আর লাভ কি?” এই বলিয়া আমি নিরস্ত হইলাম।
উপেন্দ্রনাথ আমার সমস্ত কথা একান্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিয়া পরিশেষে কহিলেন, “মহাশয়! আপনি আমার আত্মীয় হউন, বা যে কেহই হউন না, যখন আপনি আমার পিতার সহিত আগমন করিয়াছেন, এবং যখন বুঝিতেছি, আমি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে আর কোনক্রমেই সমর্থ হইব না, তখন আমি আমার কোন কথা আপনাদিগের নিকট লুকাইব না, সমস্তই আমি পরিষ্কার করিয়া বলিতেছি। পিতাকে যাহা বলা বিবেচনা করেন, তাহাই কহিবেন, ভাল-মন্দ বিবেচনা করিবার ক্ষমতা এখন আমার নাই। লজ্জা ভয় এখন আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছে।” এই বলিয়া উপেন্দ্রনাথ চুপ করিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ
উপেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমার পিতাকে কহিবেন, তাঁহার এই কু-পুত্রের পক্ষে সংসার পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। যে আপনার হৃদয়কে আপনি চিনিতে পারিল না, এত বয়সেও যে ভাল-মন্দ বুঝিতে সমর্থ হইল না, তাহার এই সংসারে বাঁচিয়া থাকিবার প্রয়োজন কি? সামান্য ভ্রমের বশীভূত হইয়া যে পাপাত্মা আপনার হৃদয়ে দীপ্তিমান অমূল্যরত্নকে হেলায় হারাইতে পারে, এ সংসারে তাহার মুখ দেখাইবার অধিকার নাই।” এই বলিতে বলিতে উপেন্দ্রনাথের কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। প্রায় দশমিনিটে কাল সেইভাবে থাকিয়া পরে ভগ্নকণ্ঠে কহিতে লাগিলেন, “মহাশয়! আমার পিতাকে কহিবেন, তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া, কাশীতে উপনীত হইবার দুইদিবস পরেই আমার শ্বশ্রুঠাকুরাণী ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। মাতৃশোকে নিতান্ত অধীরা হইয়া আমার স্ত্রী অনবরত রোদন করিতে লাগিল। তাহাকে সান্ত্বনা করিয়া, শ্বশ্রুঠাকুরাণীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া রাত্রি নয়টার সময় বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। যে বাড়ীতে তাঁহারা বাস করিতেন, সেই বাড়ী সদর ও অন্দর দুই ভাগে বিভক্ত। তাহা বোধ হয়, আপনি অবগত থাকিলেও থাকিতে পারেন। বাহিরের অংশে আমার শাশুড়ী থাকিতেন, ভিতরের অংশ অপর কয়েকটি স্ত্রীলোকের দ্বারা অধিকৃত ছিল। যাহা হউক, বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দেখিলাম, একটি অপরিচিত যুবক দ্রুতবেগে আমাদিগের বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। তাহাকে দেখিয়া ভাবিলাম, বোধ হয়, ইনি আমার শ্বশ্রূঠাকুরাণীর কোন পরিচিত বা আত্মীয় হইবেন। সুতরাং সে সম্বন্ধে সেইদিবস কোনরূপ অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হইল না। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, আমার স্ত্রী মাতৃশোকে অধীরা হইয়া তখনও রোদন করিতেছে। তাহাকে অনেকরূপ বুঝাইয়া কতক পরিমাণে সান্ত্বনা করিলাম। ক্রমে সেই দিবসের রজনী প্রভাত হইয়া গেল।
“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শোকদুঃখ যে ক্রমে ভুলিতে হয়, তাহার পরদিবস হইতেই তাহা বুঝিতে পারিলাম। আমার স্ত্রী প্রথম দিবস যেরূপ শোকে অধীরা হইয়াছিল, দেখিলাম দ্বিতীয় দিবসে তাহার কিয়দংশ কমিয়া গেল। ভাবিলাম, আরও দুই দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, যেমন চতুর্থীর ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া যাইবে, অমনি আমি আমার স্ত্রীকে লইয়া কানপুরে গমন করিব।
“সেইদিবস সন্ধ্যার সময় কোন কার্য্যোপলক্ষে আমাকে বাহিরে গমন করিতে হয়। যখন আমি বাহির হইতে প্রত্যাগমন করিলাম, তখন রাত্রি দশটা অতীত হইয়াছে। আমি যেমন সদর দ্বার দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, অমনি সেই পূর্ব্বোক্ত মনুষ্যমূর্তি পুনরায় আমার সম্মুখে পড়িল। আজ বোধ হইল, যে যেন আমার স্ত্রীর গৃহের দিক হইতে আগমন করিতেছে। আমাকে হঠাৎ সম্মুখে দেখিয়া কোন কথা না বলিয়া সে বিদ্যুতের ন্যায় পলায়ন করিল। আজ তাহার এইরূপভাবে পলায়ন দেখিয়া আমার বড় ভাল বোধ হইল না, নানারূপ সন্দেহ আসিয়া আমার হৃদয়ে উপস্থিত হইল। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, আমার স্ত্রী জাগরিতা রহিয়াছে। তখন তাহাকে সেই অপরিচিত পুরুষের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু সে তাহার সম্বন্ধে কোন কথাই আমাকে বলিতে পারিল না। আমি বুঝিলাম, বলিল না। কেবল বলিল, ‘আমি ইহার কিছুই জানি না।
“বলিতে কি, আজ আমার স্ত্রীর চরিত্রের প্রতি হঠাৎ সন্দেহ উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, কাশীতে থাকিয়া আমার স্ত্রী অবিশ্বাসিনী হইয়াছে। তাহার চরিত্রের উপর সন্দেহ হইল সত্য; কিন্তু তাহাকে আমি সে দিবস আর কোন কথা কহিলাম না।
“পরদিবস সন্ধ্যার সময় আমাকে পুনরায় বাহিরে গমন করিতে হইল। সেইদিবস যখন আমি প্রত্যাগমন করিলাম তখন রাত্রি এগারটা বাজিয়া গিয়াছে। সদর দ্বার দিয়া নিয়মিতরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, দ্রুতপদে আমি আমার স্ত্রীর গৃহের ভিতর গমন করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের দ্বার খোলা, সেই গৃহের ভিতর একপার্শ্বে একটি মৃন্ময়-প্রদীপ টিপ্ টিপ্ করিয়া জ্বলিতেছে। আমার স্ত্রী শয্যার উপর শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছে বোধ হইল। আমি যখন গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই শয্যার এক পার্শ্বে-উপবেশন করিলাম, সেই সময় দেখিলাম, আবার সেই অপরিচিত যুবক সেই গৃহের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া, আমারই সম্মুখ দিয়া দ্রুতবেগে বহির্গত হইল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলাম; কিন্তু সে দ্রুতপদে একবারে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া, যে কোন্ গলির ভিতর প্রবেশ করিল, তাহার আর কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।
“আমি আমার স্ত্রীর গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া তাহাকে উঠাইলাম। যে অপরিচিত যুবক তাহার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল, সে কে, জিজ্ঞাসা করায় আমার স্ত্রী অতীব আশ্চর্য্যান্বিতা হইয়া কহিল, ‘আমি ইহার কিছুই জানি না।’
“একথা আমার ভাল লাগিল না। এক ব্যক্তি তাহার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল, আর সে তাহাকে জানে না, একথা বলিলে কে তাহার কথায় বিশ্বাস করিতে পারে? আর একথা আমি অপরের নিকট শ্রবণ করি নাই, এক দিন নয়, দুই দিন নয়, উপর্যুপরি তিনদিন তাহাকে আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। ‘জানি না’ এক কথায় কি করিয়া আমি আমার মনকে সন্তোষ বা প্রবোধ দিতে পারি। বলিতে কি, আজ আমার স্ত্রীর চরিত্রের উপর দারুণ সন্দেহ হইল; কেবল সন্দেহ কেন? আমি তাহাকে স্পষ্টই কহিলাম, কি কলঙ্কিনি! আমি এতদিবস জানিতাম না যে, তুই মানবীরূপে পিশাচী!’ এই বলিতে বলিতে আমার হৃদয়ে দারুণ ক্রোধের উদ্রেক হইল। আমি হিতাহিত জ্ঞানের মস্তকে পদাঘাত করিয়া নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় সবলে তাহার বক্ষঃস্থলে এক পদাঘাত করিলাম। মাতৃশোকে বিহ্বলা সেই দুৰ্ব্বলা অবলা আমার দারুণ পদাঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া, সেইস্থানে পড়িয়া গেল। আমি তাহারই উপর আরও দুই একটি পদাঘাত করিয়া নিতান্ত ক্রুদ্ধভাবে সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। আহা! সাধ্বী সেই পদাঘাত সহ্য করিয়া ধীরে ধীরে উঠিল, উঠিয়া বসিল। বসিয়া আমার পদযুগল ধরিয়া নিতান্ত কাতরকণ্ঠে কহিল, ‘নাথ! ‘আমি তোমার নিকট অবিশ্বাসিনী নহি, তোমার মূর্ত্তি ভিন্ন অন্য মূর্ত্তি আমি আর কখনও আমার হৃদয়ে স্থান দেই নাই। আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমি কিন্তু আপনার পাদস্পর্শ করিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি—আমি ইহার কিছুই জানি না। আমায় মিথ্যা কলঙ্কে কলঙ্কিত করিবেন না; আমি কোন দোষে দোষী নহি।’ এই বলিয়া আমার স্ত্রী আমার পদযুগল ধরিয়া রোদন করিতে লাগিল।
‘স্ত্রীর এই রোদন-ধ্বনিতে আমার দারুণ ক্রোধ আরও প্রচণ্ড রূপ ধারণ করিল। আমি তাহার হস্ত সবলে দূরে নিক্ষেপ করিলাম, এবং আরও দুই একটি পদাঘাত করিয়া কহিলাম, ‘পাপীয়সি! আমি তোর কথায় আর কখন বিশ্বাস করি না। তুই আমার সম্মুখ হইতে দূর হ, তোর পাপমুখ আমি আর ইহজীবনে দর্শন করিব না।’ এই বলিয়া বলপূৰ্ব্বক তাহাকে সেই গৃহ হইতে বহির্গত করিয়া, ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম।
“অনাথিনী বাহিরে গিয়া করুণস্বরে কহিল, ‘নাথ! আপনি যখন আমার চরিত্রের উপর অবিশ্বাস করিয়া, আমার মুখ দর্শন করিবেন না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, তখন আমিই আপনাকে আমার মুখ আর কোন্ লজ্জায় দেখাইব? কিন্তু মনে রাখিবেন, আমি অবিশ্বাসিনী নহি। যদি আপনার পায়ে আমার মন থাকে, তাহা হইলে ঈশ্বর আপনাকে জানাইবেন যে, আমার হৃদয় কালকূটে পূর্ণ, কি তোমারই পবিত্র প্রণয়ে ভরা!’
“বিজাতীয় ক্রোধে আমার হৃদয় পূর্ণ ছিল; সুতরাং সেই অনাথিনীর কোন কথা আমার মনকে আকৃষ্ট করিতে পারিল না। আমি জাগ্রত অবস্থায় সেই গৃহের ভিতর বসিয়া সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু একবারেরও জন্য দেখিলাম না যে, সেই নিশীথ রাত্রিতে অনাথিনী কোথায় গেল।
“পরদিবস প্রাতঃকালে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম, কিন্তু তাহার কোনরূপ সন্ধানই লইলাম না। তখন পৰ্য্যন্ত সেই দারুণ ক্রোধ আমার হৃদয়কে পরিত্যাগ করে নাই। সমস্ত দিবসও সেইরূপে অতিবাহিত হইয়া গেল। আহারাদি কিছুই হইল না, ক্ষুধাতৃষ্ণা একবারেই বুঝিতে পারিলাম না।
“রাত্রি নয়টার সময় আমি সেই গৃহের ভিতর একাকী বসিয়া অছি। গৃহ অন্ধকার, কিন্তু দ্বার খোলা। জানি না, কি কারণে হঠাৎ আমার দৃষ্টি সদর দ্বারের দিকে পতিত হইল। দেখিলাম, সেই অপরিচিত যুবক ধীরে ধীরে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছে। ভাবিলাম, যদি সে আসিয়া এই গৃহের ভিতর প্রবেশ করে, তাহা হইলে আজ নিঃসন্দেহ উহাকে হত্যা করিয়া প্রতিহিংসা সাধন করিব।
“যুবক ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া, আমার গৃহের সম্মুখ দিয়া অন্যদিকে গমন করিল। আমার গৃহে প্রবেশ করিল না দেখিয়া আমিও আস্তে আস্তে উঠিলাম, ও নিঃশব্দপদসঞ্চারে উহার অনুসরণ করিলাম। দেখিলাম, সে ক্রমে আমাদিগের অধিকৃত প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া, সেই বাটীর ভিতরের একটি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল। আমিও দূর হইতে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া স্বচক্ষে সমস্ত দেখিতে লাগিলাম।
“দেখিলাম, একটি গৃহের সম্মুখে গিয়া সে ধীরে ধীরে উহার দ্বারদেশে আঘাত করিল। দেখিতে দেখিতে সেই গৃহের দ্বার ভিতর হইতে খুলিয়া গেল। সেই গৃহে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। তখন তাহার সাহায্যে দেখিলাম যে, সেই দ্বার উন্মুক্তকারিণী, একটি বিংশ বৎসর বয়স্কা বিধবা স্ত্রী। দ্বার খুলিবামাত্র সেই পুরুষটি সেই গৃহের ভিতর যেমন প্রবেশ করিল, অমনি সেই গৃহের দ্বার পুনরায় ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিল।
“এতক্ষণে আমার চৈতন্য হইল। ঈশ্বর আজ আমার চক্ষু দ্বারা আমাকে দেখাইয়া দিলেন যে, কিরূপ ভ্রমে পতিত হইয়া পতিপ্রাণা অবলার উপর আমি কি ভীষণ অত্যাচার করিয়াছি! এই অবস্থা দেখিয়া আমি আর সেইস্থানে স্থির থাকিতে পারিলাম না, আমার হস্তপদ কাঁপিতে লাগিল। মস্তক ঘুরিয়া উঠিল, আমি সেইস্থানে বসিয়া পড়িলাম। কতক্ষণ যে আমি সেইস্থানে বসিয়াছিলাম, তাহা আমি জানি না; কিন্তু সেই দ্বার পুনরায় যেমন উন্মুক্ত হইল, অমনি আমারও চমক ভাঙ্গিল। আমি দ্রুতপদে সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই ব্যক্তি তখনও সেই গৃহের ভিতর উপবিষ্ট। আমাকে দেখিবামাত্র সে পলায়নের চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু আমি দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়াছিলাম বলিয়া তাহার মনোরথ পূর্ণ হইল না।
“আমাকে হঠাৎ সেই গৃহের ভিতর দেখিয়া সেই বিধবা যে কি করিবে, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, দ্রুতগতি আমার পদযুগল ধারণ করিল ও কহিল, ‘আপনি আমার পিতা। এই ভীষণ কলঙ্ক হইতে আজ আপনি আমাকে রক্ষা করুন; নচেৎ আমি আমার এই পোড়ামুখ আর কাহাকেও দেখাইতে পারিব না। যদি আপনি গোলযোগ করেন, বা আমার এই পাপাচারের কথা প্রকাশ করিয়া দেন, তাহা হইলে উদ্বন্ধনেই হউক, বা যে কোন প্রকারেই হউক, আমাকে আত্মঘাতী হইয়া লোকলজ্জা হইতে নিষ্কৃতি পাইতে হইবে।’
“বিধবার এই কথা শুনিয়া আমি ভাবিলাম, আমার গোলযোগ করিয়া প্রয়োজন কি? মিথ্যা স্ত্রী হত্যার পাতকী হই কেন? এই ভাবিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, ‘তুমি সেই যুবককে জিজ্ঞাসা কর, সে যদি আমার একটি প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দেয়, তাহা হইলে আমি কোনরূপ গোলযোগ করিব না। নচেৎ এই বাড়ীর সকলকে ডাকিয়া তোমাদিগের উভয়কেই বিলক্ষণরূপে অবমানিত করিব।’
“আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া উভয়েই কহিল, ‘যখন আপনাকে আমাদিগের পিতা কহিলাম, ও যখন আপনার অনুগ্রহের উপর আমাদিগের সমস্ত নির্ভর করিতেছে, তখন ভাল হউক বা মন্দ হউক, আমরা উভয়েই শপথ করিয়া বলিতেছি,—আপনার প্রশ্নের অবশ্যই প্রকৃত উত্তর দিব।’
“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি কাল আমার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলে কেন?’
“উত্তর পাইলাম, “এই গৃহ ইহতে বহির্গত হইয়া যাইবার সময় হঠাৎ আপনাকে দেখিতে পাই। কিন্তু পলায়নের আর কোন স্থান না পাইয়া আপনার গৃহের ভিতর প্রবেশ করি। সেই সময় আমি জানিতাম না যে, আপনি সেই গৃহেই থাকেন। পরিশেষে যখন দেখিলাম, আপনিও সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন, তখন আর কি করি, কাজেই আমি আপনার সম্মুখ দিয়া আপনার গৃহ হইতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া পলায়ন করিলাম। ইহা ব্যতীত আমার আর কোন প্রকার মন্দ অভিপ্রায় ছিল না।”
“এই কথা শ্রবণ করিয়া আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। উহাদিগের কলঙ্কের কথা আমি আর কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, সেই সময় ইহতে আমি আমার স্ত্রীর সন্ধান আরম্ভ করিলাম; কিন্তু সেই পরিব্রতার সন্ধান কোনরূপেই প্রাপ্ত হইলাম না। সেই সময় আমি বুঝিলাম যে, আমি না বুঝিয়া, সেই পতিপ্রাণার কথা না শুনিয়া কি ভয়ানক কাৰ্য্যই করিয়াছি!
“সেই রাত্রিতে ও পরিদিবস প্রাতঃকালে তাহার যে কত সন্ধান করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। প্রথমে কোনস্থানে কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া, পরিশেষে তাহার মাতার সবিশেষ পরিচিত একটি স্ত্রীলোকের নিকট গমন করিলাম। সেইস্থানে গিয়া সংবাদ পাইলাম যে, আমার স্ত্রী একদিবস তাঁহার বাড়ীতে ছিল। তাঁহার নিকট হইতে কয়েকটি টাকা ধার করিয়া, কলিকাতায় তাঁহার স্বামীর নিকট গমন করিবে বলিয়া চলিয়া গিয়াছে।
“আমি জানিতাম, কালীঘাটে তাহার মাসী থাকেন। এই সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র আমিও সেইদিবস কলিকাতাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। সময়-মত হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া আমাদিগের গাড়ি উপস্থিত হইলে আমি গাড়ি হইতে অবতীর্ণ হইয়া বাহিরে আসিবার কালে দেখিলাম, আমারই স্ত্রীর ন্যায় একটি স্ত্রীলোক একখানি গাড়িভাড়া করিয়া তাহাতে উঠিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমি দ্রুতপদে সেই গাড়ির নিকট গিয়া দেখিলাম, আমি যাহার সন্ধান করিতেছি, ইনিই আমার সেই হৃদয়-লক্ষ্মী। তাহাকে সেই সময়ে আর কিছু না বলিয়া আমিও সেই গাড়িতে আরোহণ করিলাম। আমার নির্দেশ-মত কোচমান গাড়ি চালাইতে লাগিল।
“গাড়ির ভিতর তাহাকে আমি কত বুঝাইলাম। আমি যে মহাভ্রমে পতিত হইয়া তাহার উপর পৈশাচিক ব্যবহার করিয়াছিলাম, তাহা তাহাকে বারম্বার বলিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম; তাহাকে বাড়ীতে ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সেই সাধ্বী অভিমান ভরে কহিল, ‘নাথ! আপনি যখন আমাকে অবিশ্বাসিনী বলিয়া পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন আর আমার দিকে লক্ষ্যও করিবেন না। আমি আপনার যোগ্যা নহি, বা আমি আমার এই মুখ আপনাকে আর দেখাইবার পাত্রী নহি।
“এই কথা শুনিয়া আমি অনুনয়-বিনয় করিয়া যেমন তাহার বস্ত্রাচ্ছাদিত হস্ত স্পর্শ করিতে গেলাম, অমনি সে আমাকে কহিল, ‘আপনি এই পাপীয়সী ও অবিশ্বাসিনীকে আর স্পর্শ করিবেন না। তবে আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে—ভালই হইয়াছে। স্বামীর সম্মুখে যাহাতে আমার মৃত্যু হয়, তাহার নিমিত্ত আমি কত দেবতার নিকট প্রার্থনা করিয়াছি, আজ দেখিতেছি, ঈশ্বর আমার সেই প্রার্থনায় কর্ণপাত করিলেন।’ এই বলিয়া তাহার বস্ত্রাচ্ছাদিত হস্ত বাহির করিল। সেই সময় দেখিলাম, উহার হস্তে ভীষণ ছুরিকা। তাহার হস্ত হইতে সেই ছুরিকা কাড়িয়া লইতে আমি চেষ্টা করিলাম, কিন্তু আমার চেষ্টা ব্যর্থ হইল। মুহূর্ত্ত মধ্যে সেই ছুরিকা সে আপনার বক্ষের ভিতর প্রবেশ করাইয়া দিল। আমি তাহার বক্ষঃস্থল হইতে সবলে সেই ছরিকা উঠাইয়া লইলাম সত্য; কিন্তু দেখিতে দেখিতে তাহার প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া গেল! আমারই নিমিত্ত আমারই সম্মুখে আপন জীবন বিসর্জ্জন করিল! তাহার নিমিত্ত আমার জীবন শেষ হওয়াই বাঞ্ছনীয়!”
এই বলিতে বলিতে উপেন্দ্ৰনাথ মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। আমি ও জেলার সাহেব সেই মূৰ্চ্ছা অপনোদনের নিমিত্ত প্রথমে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য হইতে না পারায়, জেলার সাহেব আর কয়েকজন কয়েদীর সাহায্যে তাহাকে জেলের হাসপাতালের ভিতর লইয়া গেলেন। আমি সেই স্থানেই বসিয়া রহিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে শুনিলাম, উপেন্দ্রনাথের মূৰ্চ্ছাভঙ্গ হইয়াছে। সেই সময়ে আমিও জেলের ভিতর হইতে বহির্গত হইয়া, সেই বৃদ্ধের নিকট গমন করিলাম।
প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্য্যন্ত সমস্ত কথা বৃদ্ধকে কহিলাম, এই ব্যাপার শুনিয়া বৃদ্ধ প্রথমে অতিশয় চিন্তিত হইলেন। পরিশেষে তাঁহার তত্ত্বাবধানে গুণে, ভাল কৌন্সলির সাহায্যে এবং ডাক্তারের সাক্ষীতে উপেন্দ্রনাথ সেই অভিযোগ হইতে দায়রার বিচারে নিষ্কৃতিলাভ করিলেন।
[পৌষ, ১৩০০]