এ আবার কি! (অর্থাৎ আত্মহত্যা না খুন? )
প্রথম পরিচ্ছেদ
বহুদিবসের ঘটনা নহে, অতি অল্পদিবস হইল, একদিবস সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে সংবাদ পাইলাম যে, কেওড়াতলার ঘাটে একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোককে সৎকার করিবার নিমিত্ত আনা হইয়াছিল। কিন্তু তাহার মস্তকে একটি আঘাতের চিহ্ন থাকায় সেই ঘাটের সব-রেজিষ্ট্রারের মনে সন্দেহ হয় যে, কাহারও কর্তৃক আঘাত প্রাপ্ত হইয়া, এই বৃদ্ধার মৃত্যু হইয়াছে। তিনি এই মৃতদেহের সৎকার কার্য্য বন্ধ রাখিয়া এই সংবাদ থানায় প্রেরণ করেন, এবং যে সকল ব্যক্তি এই মৃতদেহ সেইস্থানে আনয়ন করিয়াছিল, পুলিসের তথায় যাওয়া পর্যন্ত তাহাদিগকেও সেইস্থানে আটক করিয়া রাখেন।
থানার কর্ম্মচারীগণ এই সংবাদ পাইবামাত্র সেই ঘাটে গিয়া উপস্থিত হন। কিন্তু ব্যাপার শুনিয়া কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, এই অনুসন্ধানে তাহাদিগকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত আমাদিগের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
এই সংবাদ যখন আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল, তখন আমি ব্যতীত অপর কোন কর্ম্মচারীই আমাদের থানায় উপস্থিত ছিলেন না। সুতরাং ইহার অনুসন্ধানের ভার আমারই উপর ন্যস্ত হইল।
থানা হইতে বহির্গত হইয়া প্রথমেই কেওড়াতলার ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। পাঠকগণের মধ্যে বোধ হয় সকলেই অবগত আছেন, কেওড়াতলার ঘাট কালীঘাটের সন্নিকটে। বাহিরের অধিকাংশ মৃতদেহই এইস্থানে সৎকারার্থ আনীত হয়।
সেই ঘাটে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, একখানি ভাঙ্গা দড়ির খাটের উপর একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ রক্ষিত আছে। অনুমানে আমার বোধ হইল, মৃতার বয়ঃক্রম আশী বৎসরের ন্যূন হইবে না। শরীর নিতান্ত জীর্ণ শীর্ণ; দেখিয়া বোধ হয়, অনেক দিবস পর্য্যন্ত তাহাকে রোগ ভোগ করিতে হইয়াছে। শরীরের অবস্থা এইরূপ হইলেও কিন্তু তাহার বাম কপোলের ঊর্দ্ধদেশে মস্তকের উপর একটি আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট বিদ্যমান রহিয়াছে। আঘাতটি নিতান্ত সামান্য বলিয়া বোধ হয় না, দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন ইঞ্চি, ও প্রস্থে প্রায় আড়াই ইঞ্চি হইবে। এই আঘাতের চিহ্ন পুরাতন বলিয়া বোধ হয় না। বোধ হয়, বৃদ্ধা অদ্যই এই আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে, উক্ত স্থান দিয়া অদ্যই রক্ত বহির্গত হইয়াছিল বলিয়া আমার অনুমান হয়। কারণ, এখনও সেই আঘাতের নিকটবর্ত্তী স্থানে শুষ্ক রক্তের চিহ্ন বিদ্যমান রহিয়াছে, এবং ক্ষতস্থানের উপরের চর্ম্ম সেরূপ কঠিনত্ব পায় নাই। আরও দেখিলাম, সেই আঘাতের উপর কাঁচা মৃত্তিকা লাগার চিহ্ন বেশ স্পষ্ট যেন প্রতীয়মান হইতেছে।
মৃতার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কিরূপে এবং কাহা-কর্তৃক এই মৃতদেহ এইস্থানে আনীত হইয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত প্রথমেই ইচ্ছা হইল। সব-রেজিষ্ট্রারকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, অদ্য দিবা একটার সময় দুইটি পুরুষ—রামেশ্বর ও ভবতারণ, এবং একটি স্ত্রীলোক বিলাসী, এই তিনজনে মিলিয়া সেই মৃতদেহ সৎকার করিবার জন্য এইস্থানে আনয়ন করে। সৎকারের পূর্ব্বে নিয়মিতরূপে সেই কৰ্ম্মচারী যেমন সেই মৃতদেহ দেখিতে যান, সেই সময় দেখিতে পান যে, উহার মস্তকে একটি বৃহৎ ক্ষতচিহ্ন রহিয়াছে। কিরূপে উহার মস্তকে সেই আঘাতের চিহ্ন হইল, তাহা উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় কেহই তাহার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারে নাই। এইরূপ নানাকারণে কর্ম্মচারীর মনে সন্দেহ হয়; সুতরাং বাধ্য হইয়া তাহাকে থানায় সংবাদ পাঠাইয়া দিতে হয়।
কর্মচারীর কথা শুনিয়া এক এক করিয়া, রামেশ্বর ও ভবতারণকে ডাকিলাম। পৃথক পৃথকরূপে উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় উভয়েই কহিল, “আমরা বিলাসীর প্রতিবেশী। অদ্য দিবা এগারটার সময় বিলাসী আমাদিগের নিকট গমন করে ও কহে, অদ্য তাহার শাশুড়ীর গঙ্গালাভ হইয়াছে, লোকজন কেহই না থাকায় সৎকার করিবার নিমিত্ত তাহাকে কেহ লইয়া যাইতে পারিতেছে না। বিলাসী একে আমাদিগের প্রতিবেশী, তাহাতে উহার শাশুড়ী ভিন্ন অপর আর কেহই নাই জানিতাম। আরও জানিতাম, বৃদ্ধা অনেক দিবস হইতে রোগ ভোগ করিতেছে। এইরূপ নানাকারণে আমাদিগের মনে কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় নাই। বিলাসীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের মনে দয়ার উদ্রেক হয়, সুতরাং প্রতিবেশীর যেটুকু কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম, তাহাই আমরা সম্পন্ন করিয়াছি। সৎকারার্থ বৃদ্ধাকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যখন আমরা তাহার বাড়ীতে গমন করি, তখন দেখিতে পাই যে, তাহার সেই গৃহের দাওয়ার উপর বৃদ্ধার মৃতদেহ রক্ষিত আছে; এবং একখানি বস্ত্রের দ্বারা সেই মৃতদেহের আপাদ-মস্তক আবৃত রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়া একখানি খাট আনাইয়া বস্ত্রাবৃত অবস্থাতেই সেই মৃতদেহ তাহার উপর উঠাইয়া লই, ও পরিশেষে আমরা উভয়ে সেই মৃতদেহ সৎকারার্থ এইস্থানে আনয়ন করি। বিলাসীও আমাদিগের সহিত আগমন করে। যেরূপ ব্যাপারে পড়িয়া আমরা সেই মৃতদেহ লইয়া এইস্থানে আগমন করিয়াছি, তাহার সমস্ত অবস্থা আপনার নিকট কহিলাম, ইহা ব্যতীত আমরা আর কিছুই অবগত নহি। এখন দেখিতেছি, মহাশয়! পরের উপকার করাও অন্যায়! কারণ, যদি আমরা এইরূপে বিলাসীর উপকারার্থ আগমন না করিতাম, তাহা হইলে এই বিপদে আমাদিগকে পতিত হইতে হইত না।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রামেশ্বর ও ভবতারণের কথা শুনিয়া, পরিশেষে সেই বিলাসীকে ডাকাইলাম। তাহাকে ইহার আনুপূর্ব্বিক ব্যাপার জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “এই বৃদ্ধা আমার শাশুড়ী। বহুদিবস অতীত হইল—আমি বিধবা হইয়াছি। বিধবা হওয়ার পর হইতে আমি ও আমার শাশুড়ী উভয়েই আমাদিগের বাড়ীতে বাস করিয়া আসিতেছি। আমাদিগের আর কেহই নাই। বৃদ্ধার নিকট কিছু অর্থ ছিল, তাহা দ্বারা আমরা জীবন যাপন করিয়া আসিতেছি। ইহা ব্যতীত বড়বাজারে আমার স্বামীর একখানি হুঁকার দোকান ছিল, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর সেই দোকানের একজন কর্ম্মচারীকে উহা দেওয়া হয়। সেও মাসে মাসে কিছু কিছু অর্থ প্রদান করিয়া থাকে, তাহা হইতে আমার সাংসারিক আবশ্যক নানাকার্য্যে ব্যয় করিয়া থাকি। শুনিয়াছি, আমার শাশুড়ীর নিকট কিছু নগদ অর্থ, এবং কিছু অলঙ্কার-পত্র ছিল; কিন্তু আমি স্বচক্ষে তাহা কখনও দেখি নাই, বা তিনিও আমাকে কখন দেখান নাই। তবে কোন কথা পড়িলে সময় সময় বলিতেন যে, তাঁহার মৃত্যুর সময় তাঁহার যা কিছু অর্থ আছে, তাহা আমাকে দিয়া যাইবেন। মৃত্যুর সময় আমার সহিত সাক্ষাৎ না হওয়াতে তিনি কিছু বলিয়া, যাইতে পারেন নাই, বা কিছু প্রদান করিয়াও যান নাই। সুতরাং কি আছে, বা না আছে, তাহা এখনও আমি জানিতে পারি নাই।
“আমার শাশুড়ীর বয়ঃক্রম নিতান্ত ন্যূন হয় নাই, বোধ হয়, আশী বৎসর হইবেক। তাঁহার বয়স অধিক হইয়াছিল সত্য, কিন্তু কখনও তিনি কৃশ বা দুৰ্ব্বল হন নাই। সংসারের অধিকাংশ কৰ্ম্ম-কাৰ্য্যই তিনি নিজহস্তে সম্পাদন করিতেন, ও ইচ্ছামত এ-বাড়ী ও-বাড়ী ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন। ইহার পূর্ব্বে আমি একদিবসের নিমিত্তও কখনও তাঁহার শরীর অসুস্থ দেখি নাই।
“প্রায় একমাস হইল, প্রথমতঃ তাঁহার জ্বর হয়। চারি পাঁচদিবস পরেই তাঁহার সেই জ্বর সারিয়া যায়। কিন্তু হাত পা ফুলিতে আরম্ভ হয়, ও পরিশেষে তাঁহার পুনরায় জ্বর হয়। সে জ্বর আর তাহাকে পরিত্যাগ করে নাই। ক্রমে বৃদ্ধা অতিশয় ক্ষীণা ও দুর্ব্বলা হইয়া পড়েন।
“চারি পাঁচদিবস হইতে তাঁহার অবস্থা অতিশয় মন্দ হয়, চলাচল বন্ধ হইয়া যায়, শয্যাগত হইয়া পড়েন।
“যে বাড়িতে আমরা বাস করি, তাহা আমাদিগের নিজের বাড়ি; উহা প্রায় তিন বিঘা জমির উপর স্থাপিত। জমির অধিকাংশই বৃক্ষশ্রেণীতে আচ্ছন্ন, সুতরাং বাড়ী নিতান্ত ক্ষুদ্র। বাড়িতে থাকিবার উপযোগী কেবল দুইখানিমাত্র কাঁচাগৃহ আছে। উহার একখানি গৃহে আমার শাশুড়ী বাস করিতেন, আর অপরখানি আমারই দ্বারা অধিকৃত ছিল। আমার শাশুড়ীর পীড়ার যখন অতিশয় বৃদ্ধি হইল, তখন তিনি গৃহাভ্যন্তর পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহার গৃহের সম্মুখে বারান্দার উপর শয্যা করিয়া লইলেন, ও সেইস্থানেই শয়ন করিলেন। এই শয্যা হইতে আর তাঁহাকে উঠিতে হইল না, উহাই তাঁহার শেষ শয্যা হইল। যে কয়েক দিবস হইতে তাঁহার গাত্রোত্থান করিবার ক্ষমতা ছিল না, সেই কয়েক দিবস পর্য্যন্ত তাঁহার সমস্ত কার্য্য আমাকেই সম্পন্ন করিতে হইয়াছে। সাংসারিক নিয়মিত কাৰ্য্য সকল ব্যতীত তাঁহাকে উঠান, বসান, মলমূত্র প্রভৃতি পরিত্যাগ করান, সমস্তই আমাকে করিতে হইয়াছে। কিন্তু গত দুইদিবস হইতে সেই সকল কাৰ্য্য এত বাড়িয়া উঠিয়াছিল যে, একাকী আমার দ্বারা তাহা আর কোনক্রমেই সম্পন্ন হইতে পারে না।
“অদ্য প্রাতঃকালে আটটা পর্য্যন্ত আমি তাঁহার নিকটেই ছিলাম। ইহার মধ্যে কতবার যে তাঁহাকে উঠাইতে হইয়াছে, কতবার যে তাঁহার মলমূত্র পরিষ্কার করিতে হইয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি মনে করিলাম, এরূপ অবস্থায় কেবলমাত্র আমার দ্বারা বৃদ্ধার সেবা-শুশ্রূষাকোন প্রকারেই হইতে পারে না। অথচ এই সকল কার্য্যে আমাকে সাহায্য করিতে পারে, এরূপ কোন লোক আমাদিগের পাড়ায় নাই।
“সেই সময়ে আমার মনে হইল যে, ভবানীপুরের তরলা এই বিপদের সময় আমায় সাহায্য করিলেও করিতে পারে। যে স্থানে আমাদিগের বাড়ি, তাহার নিকটেই তরলা বাস করিত। তাহার সহিত আমার সবিশেষ প্রণয় ছিল। সে আমাকে এরূপ ভালবাসিত যে, যদি আমি তাহাকে কোন বিষয়ের জন্য অনুরোধ করিতাম, তাহার সহস্র ক্ষতি হইলেও সে আমার সেই অনুরোধ শুনিত, ও সেই কার্য্য নির্ব্বাহ করিত। তরলার স্বামী এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া ভবানীপুরে গিয়া বাস করে, সুতরাং তরলাকেও সেইস্থানে গমন করিতে হয়। ভবানীপুরে গমন করিবার পরও তরলা কতদিবস আমাদিগের বাড়ীতে আগমন করিয়াছে, ও কত রাত্রি অতিবাহিত করিয়া গিয়াছে। আমিও কতদিবস তাহার বাড়িতে বাস করিয়া আসিয়াছি।
“শাশুড়ীর এই অবস্থা দেখিয়া আমি মনে ভাবিলাম যে, এইরূপ অবস্থায় তরলাকে সংবাদ দেওয়াই কৰ্ত্তব্য। আমাদিগের এই অসময়ে সে যদি আগমন করে, তাহা হইলে আমরা বিশেষ উপকৃত হই। এই ভাবিয়া আমি শাশুড়ীকে একাকী রাখিয়া তরলাকে সংবাদ দিবার নিমিত্ত ভবানীপুরে গমন করিলাম, কিন্তু আমাদিগের দুর্ভাগ্যবশতঃ তরলার সহিত সাক্ষাৎ হইল না। জানিতে পারিলাম, অদ্য তিনদিবস হইল, সে তাহার ভগিনীর বাড়িতে গমন করিয়াছে।
“তরলার সাক্ষাৎ না পাইয়া ক্ষুণ্নমনে আমি ভবানীপুর হইতে আমার বাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম ও দেখিলাম, যে বারান্দায় আমি আমার শাশুড়ীকে রাখিয়া গিয়াছিলাম, সেই বারান্দার উপরই তিনি শয়ন করিয়া আছেন। কিন্তু যে স্থানের উপর শয়ন করিয়াছিলেন, ঠিক্ সেইস্থানের উপর নাই। আরও দেখিলাম, তাঁহার মস্তকের একস্থান জখম হইয়াছে, ও সেইস্থান দিয়া রক্ত বাহির হইতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে ভয় হইল, আমি কাহাকেও কিছু বলিলাম না।
“কিরূপে তিনি তাঁহার মস্তকে আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছেন, এই কথা তাঁহাকে আমি বার বার জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু তিনি আর কোন কথাই বলিতে পারিলেন না। এই ঘটনার অতি অল্প সময় পরেই তাঁহার মৃত্যু হইল। পাড়ার ব্যক্তিদ্বয়ের সাহায্যে তাঁহার সৎকার করিবার নিমিত্ত এইস্থানে সেই মৃতদেহ আনিলাম। পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা ত আপনি দেখিতেই পাইতেছেন।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রামশরণ, ভবতারণ, এবং বিলাসীর কথা শুনিয়া বৃদ্ধা কি প্রকারে আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। কেওড়াতলা ঘাটের অনুসন্ধান এইস্থানেই শেষ হইল। বৃদ্ধার মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ করিয়া আমরা সকলেই বৃদ্ধার বাড়িতে গমন করিলাম। বিলাসী তাহার বাড়ির অবস্থা যেরূপ বর্ণন করিয়াছিল, সেই বাড়ী প্রায় সেইরূপই দেখিলাম। গৃহের যে বারান্দা, বা দাওয়ার উপরে পীড়িত অবস্থায় বৃদ্ধা শয়ন করিয়াছিল, বিলাসী সেইস্থান দেখাইয়া দিল। দেখিলাম, এইস্থান প্রাঙ্গণ হইতে প্রায় চারি ফুট উচ্চ। আরও দেখিলাম, সেই গৃহের ছাঁইচে সারি, সারি কতকগুলি ইট বিছান রহিয়াছে। জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম, বৃষ্টির জল, চাল বাহিয়া যখন মৃত্তিকার উপর পতিত হয়, সেই সময় ঐ মৃত্তিকা খুঁড়িয়া যায় বলিয়া, ঐ সকল ইট বিছান হইয়াছে। আরও দেখিলাম, সেই সকল ইটের উপর ও তাহার পার্শ্ববর্তী স্থান সকল উত্তমরূপে ‘নিকান’ রহিয়াছে। বিলাসীকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “এইস্থান প্রত্যহ প্রত্যূষে সে উত্তমরূপে নিকাইয়া থাকে। কিন্তু অদ্য সে যতবার বৃদ্ধার মলমূত্র পরিষ্কার করিয়াছে, ততবারই সেইস্থান সে উত্তমরূপে নিকাইয়াছে, এই নিমিত্ত এইস্থান এখনও পরিষ্কার অবস্থায় আছে।”
বিলাসীর এই কথা শুনিয়া তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি যখন তোমার সাহায্যের জন্য ভবানীপুরে লোক ডাকিতে গমন করিয়াছিলে, তাহার কতক্ষণ পূর্ব্বে এইস্থান এইরূপে পরিষ্কার করিয়াছিলে?”
বিলাসী। এইস্থান উত্তমরূপে পরিষ্কার করিয়া, ও নিকাইয়াই আমি ভবানীপুরে গমন করিবার নিমিত্ত বহির্গত হইয়াছিলাম।
আমি। ভবানীপুর হইতে ফিরিয়া আসিতে তোমার কত সময় লাগিয়াছিল?
বিলাসী। বোধ হয়, এক ঘণ্টার অধিক হইবে না।
আমি। ভবানীপুর হইতে ফিরিয়া আসিবার পর এইস্থান তুমি পুনরায় পরিষ্কার করিয়াছিলে কি?
বিলাসী। করিয়াছিলাম বৈ কি?
আমি। পুনরায় সেইস্থান পরিষ্কার করার কারণ কি?
বিলাসী। আমি ভবানীপুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, দাওয়ার উপর বৃদ্ধা পুনরায় মলমূত্র পরিত্যাগ করিয়াছে। এই মলমূত্র আমাকে পরিষ্কার করিতে হয়; সুতরাং নীচে পর্য্যন্ত পরিষ্কার করি।
আমি। যখন তুমি দাওয়ার নীচে পরিষ্কার করিয়াছিলে, সেই সময়ে সেইস্থানে বিশেষ কোন দ্রব্য দেখিতে পাইয়াছিলে কি?
বিলাসী। এমন বিশেষ কোন দ্রব্য দেখিতে পাই নাই। কিন্তু একস্থানে একটু রক্ত পড়িয়াছিল, আমি সেইস্থান পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিলাম।
আমি। যে স্থানে রক্ত পড়িয়াছিল, তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকল সেই সময়ে ভিজা ছিল, কি শুখাইয়া গিয়াছিল?
বিলাসী। সে স্থান অল্প অল্প ভিজা ছিল, একেবারে শুখাইয়া যায় নাই।
আমি। সেই সময়ে সেই ভিজা জমির উপর তুমি কোন প্রকারের চিহ্ন লক্ষ্য করিয়াছিলে কি?
বিলাসী। আমার যেন বোধ হয়, যে স্থানে রক্ত পড়িয়াছিল, তাহার নিকটে কেমন এক প্রকার বড় চিহ্ন ছিল। কোন একটি বড় দ্রব্য রাখিলে যে প্রকার চিহ্ন হয়, ইহাও যেন সেই প্রকারের চিহ্ন।
আমি। সেই চিহ্ন ব্যতীত অপর আর কোন প্রকারের চিহ্ন তুমি লক্ষ্য করিয়াছিলে, মনে হয় কি?
বিলাসী। মনে হইতেছে, যেন আরও চিহ্ন ছিল।
আমি। সে কি প্রকারের চিহ্ন?
বিলাসী। অনুমানে বোধ হয়, মানুষের পায়ের চিহ্ন কয়েকটা যেন ছিল।
আমি। কোন্ স্থানে কোন্ কোন্ চিহ্ন তুমি নিজে লক্ষ্য করিয়াছিলে? সেই সেইস্থান ঠিক্ করিয়া আমাদিগকে দেখাইয়া দিতে পার কি?
বিলাসী। বোধ হয়, ঠিক্ স্থান দেখাইয়া দিতে পারিব না। তবে আন্দাজ মত দেখাইয়া দিতে পারি।
এই বলিয়া সেই দাওয়ার নিম্নের কয়েকটি স্থান আমাদিগকে দেখাইয়া দিল।
আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বৃদ্ধার টাকাকড়ি, অলঙ্কার-পত্র যাহা আছে, তাহা কোথায়?”
বিলাসী। কি আছে, না আছে, তাহার কিছুই আমি জানি না। যদি থাকে, তাহা হইলেও তিনি যে কোথায় রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাও আমি বলিতে পারি না।
আমি। তোমার কি আছে?
বিলাসী। টাকাকড়ি আমার কিছুই নাই।
আমি। গহনাপত্র?
বিলাসী। তাহাও নাই।
আমি। তোমার স্বামী যখন বর্তমান ছিলেন, তখন বোধ হয়, তোমার গহনাপত্র ছিল? এখন সেই সকল গহনাপত্র কি হইল?
বিলাসী। এক একখানি করিয়া ক্রমে সমস্তই বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছি।
আমি। বিক্রয়ই যদি করিয়া থাক, তাহা হইলে সে টাকা কি করিলে?
বিলাসী। খাইয়া ফেলিয়াছি।
আমি। তুমি পূর্ব্বে যেন আমাকে বলিয়াছ, তোমার শাশুড়ির নিকট যে টাকা ছিল, তাহারই দ্বারা তোমরা উভয়ে জীবন যাপন করিয়া আসিতেছ। ইহা ব্যতীত বড়বাজারের হুঁকার দোকান হইতে মাসে মাসে কিছু পাইয়া থাক, এরূপ অবস্থায় তোমার অলঙ্কার-পত্র বিক্রয় হইয়া যাইবে কেন?
বিলাসী। যখন বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছি, তখন আর আপনাকে কি বলিব?
যখন আমাদিগের মধ্যে এই প্রকার কথাবার্তা হইতেছিল, তখন সেই পাড়ার অনেক লোক সেইস্থানে উপস্থিত ছিল। তাহাদিগের মধ্যে হঠাৎ একজন বলিয়া উঠিল, “তোমার উপপতিকে যে এতদিবস খাওয়াইলে, সে কথা এখন বল না কেন?”
এই কথা শুনিয়া আমি বিলাসীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই ব্যক্তি যাহা বলিল, তাহা শুনিলে ত? কে তোমার উপপতি?”
বিলাসী। ও আমার শত্রু, ও মিথ্যা কথা বলিয়া আমার অখ্যাতি করিবার চেষ্টা করিতেছে। আমার উপপতি নাই।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বিলাসীর কথা শুনিয়া এবং তাহার বাড়ীর ব্যাপার উত্তমরূপে দেখিয়া মনে ভাবিলাম,—এ আবার কি? ইহা কি খুন, না আত্মহত্যা? অথবা স্বাভাবিক রোগেই ইহার মৃত্যু হইয়াছে?
আত্মহত্যা বলি কি প্রকারে? যে অস্ত্রের বা যে কোন কঠিন পদার্থের দ্বারা বৃদ্ধা আপন মস্তকে আঘাত করিয়াছে, তাহার কোন চিহ্ন ত তাহার নিকটবর্ত্তী কোনস্থানে পাওয়া যায় নাই; অধিকন্তু দাওয়ার নিম্নে একস্থানে রক্তের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। এরূপ অবস্থায় আত্মহত্যার দ্বারা যে বৃদ্ধার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা কিরূপে বলা যাইতে পারে?
যদি আত্মহত্যা না হইল, তাহা হইলে স্বাভাবিক রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে, তাহাই বা কি প্রকারে অনুমান করা যায়? ইহার মস্তকে যদি এরূপ গুরুতর আঘাতের চিহ্ন বিদ্যামান না থাকিত, তাহা হইলে অনায়াসেই বলিতে পারিতাম, রোগই ইহার মৃত্যুর কারণ। কিন্তু আর এক কথা, বিলাসী যখন তরলার বাড়ীতে গমন করিয়াছিল, সেই সময় বাড়িতে সেই বৃদ্ধা ব্যতীত আর কেহই ছিল না। সেই সময়ে হয় ত বৃদ্ধা রোগের জ্বালায় ছট্ফট্ করিতে করিতে দাওয়ার নিম্নে ইষ্টকের উপর পতিত হয়, ও সেই ইষ্টকের আঘাতেই ইহার মস্তক ক্ষত হয়। সুতরাং দাওয়ার নিম্নে রক্তের চিহ্ন স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। পরিশেষে আপনা-আপনিই একটু সুস্থ হইয়া দাওয়ার উপর উঠিয়া যে স্থানে শয়ন করিয়াছিল, বৃদ্ধা সেইস্থানে গমন করিয়াছিল। তৎপরে মৃত্যুর সময় উপস্থিত হইলে, তাহার ইহজীবন শেষ হইয়া গিয়াছে। ইহার পর বিলাসী যখন ভবানীপুর হইতে প্রত্যাগমন করে, তখন দেখিতে পায় যে, বৃদ্ধা ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে।
ভাল, আমার এই অনুমানই যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সকলের মনে আরও একটি সন্দেহ যে উদয় হইতে না পারে, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বে যে বৃদ্ধা আপনার শরীর ঠিক রাখিতে না পারিয়া, দাওয়া হইতে পড়িয়া যাইতে পারে, সে অপর কাহারও সাহায্য না লইয়া, মৃত্যুর এক অল্পক্ষণ পূর্ব্বে সেই উচ্চ দাওয়ার উপর আরোহণ করিতে সমর্থ হয় কি? আর যদি সমর্থই হয়, তাহা হইলে উহাকে সিঁড়ির ধাপ দিয়া উঠিতে হইবে; তাহা হইলে দাওয়ার নিকটে অথচ প্রাঙ্গণে পদচিহ্ন কাহার পড়িবে? এরূপ অবস্থায় পাঠকগণ যেরূপ বিবেচনা করিতে চাহেন, করিতে পারেন।
এখন আমাদিগের প্রধান বিবেচ্য—ইহা খুন, কি না? যদি বৃদ্ধা দাওয়া হইতে পড়িয়া না গিয়া থাকে, এবং তাহার মস্তকে প্রাঙ্গণস্থিত ইষ্টকের আঘাত না লাগিয়া থাকে, তাহা হইলে খুন না বলিয়া আর কি বলা যাইতে পারে? প্রাঙ্গণের উপর যে পদচিহ্নের কথা বিলাসী বলিতেছে, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই পদচিহ্ন হয় ত হত্যাকারীর। ইহা যদি হত্যা বলিয়াই বিবেচিত হয়, তাহা হইলে এ হত্যা কাহার দ্বারা সম্পন্ন হওয়া সম্ভব, এবং এই হত্যার উদ্দেশ্যই বা কি?
এই অশীতি বৎসর বয়স্কা স্ত্রীলোককে হত্যা করা সম্বন্ধে দুইটি ভিন্ন অপর উদ্দেশ্য থাকিতে পারে না। প্রথম মনোবিবাদ। কিন্তু কই, বৃদ্ধার সহিত অপর কাহারও যে কোনরূপ মনোবিবাদ আছে, তাহা ত কেহই বলিতেছে না। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য—বৃদ্ধার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করা। কিন্তু বৃদ্ধার কিছু ছিল, কি না, একথা যখন বিলাসী পর্যন্ত ও অবগত নহে, তখন অপর আর কোন্ ব্যক্তি জানিতে পারিবে যে, তাহার কিছু আছে, কি না? উপরন্তু এইরূপ অবস্থায় বিলাসী প্রকৃত কথা বলিতেছে, কি না, তাহাই বা কে বলিতে পারে?
যাহা হউক, এখন আমার মনে নিম্নলিখিত কতকগুলি চিন্তার উদয় হইতে লাগিল—
১ম। যাহার সহিত বিলাসী এতকাল একত্র বাস করিয়া আসিতেছে, তাহার কিছু আছে কি না, একথা বিলাসী একেবারেই যে কিছু জানিতে পারে নাই, ইহা কতদূর সম্ভবপর, তাহা বলা যায় না।
২য়। বিলাসীর নিজের অলঙ্কারাদি একখানিও নাই, ইহাই বা কেমন? হুঁকার দোকানের উপস্বত্ব হইতে যখন তাহার সমস্ত ন্যায্য খরচের সঙ্কুলান হইতেছে, তখন কিসের নিমিত্ত সে আপনার সমস্ত অলঙ্কার পত্র বিক্রয় করিয়া খরচ করিয়া ফেলিয়াছে?
৩য়। বিলাসীর উপপতি কথাটা কি? লজ্জার ভয়ে বিলাসী একথা অস্বীকার করিতে পারে। আর পাড়ার লোকে যখন সেই কথার পোষকতার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, তখন বিলাসীর কথার উপরেই বা বিশ্বাস করি কি প্রকারে?
৪র্থ। এরূপ ত হয় নাই যে, বিলাসী তাহার উপপতির পরামর্শ-মত, অথবা বিলাসীর সহায়তায় তাহার উপপতি, এই বৃদ্ধাকে হত করিয়া আপন আপন দুষ্কর্ম্মের সঙ্কীর্ণ পথকে পরিষ্কার করিয়াছে, অথবা তাহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া আপনাদিগের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়াছে?
৫ম। যদি বিলাসীর মনে কোনরূপ পাপের চিহ্ন অঙ্কিত না থাকিবে, তাহা হইলে যে সময় বৃদ্ধার মস্তকে সেই আঘাতের চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছিল, সেই সময় পাড়ার কোন লোকের নিকট সে কথা প্রকাশ না করিয়া এরূপভাবে গোপন রাখিল কেন? বিশেষতঃ ইহাও বড় আশ্চর্য্যজনক বিষয় যে, যখন রামেশ্বর ও ভবতারণের সাহায্যে বিলাসী আপনার শাশুড়ীর মৃতদেহ সৎকারার্থ কেওড়াতলায় আনয়ন করিল, তখন পর্যন্তও সেই প্রকার আঘাতের কথা উহাদিগের নিকট গোপন রাখিল!
এই প্রকার নানারূপ চিন্তার পর, বিলাসী ও বৃদ্ধা যে যে গৃহে শয়ন করিত, সেই সেই গৃহে একে একে প্রবেশ করিলাম। গৃহের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল না যে, সেই সকল স্থান হইতে কোন দ্রব্য অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে। তথাপি বাক্স, পেট্রা প্রভৃতি সমস্তই খুলিয়া দেখিলাম, কিন্তু নগদ অর্থ বা অলঙ্কারাদি কাহারও কোন বাক্সের ভিতর দেখিতে পাইলাম না। উপরন্তু পাড়ার অনেকেই কহিল যে, বিলাসী ও বৃদ্ধার অবস্থা নিতান্ত মন্দ নহে; ইহাদিগের উভয়েরই অলঙ্কার প্রভৃতি অনেক আছে। বিলাসী কিন্তু সে কথা মানিল না, বরং সর্ব্বসমক্ষে কহিল যে, বাড়ী ব্যতিরেকে তাহার আর কিছুই নাই!
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বিলাসীর এবং পাড়া-প্রতিবেশীর এই সকল কথা শুনিয়া আমরা সকলে তাহার বাড়ী পরিত্যাগ করিলাম। বিলাসী তাহার বাড়িতেই থাকিল। যাহাতে বিলাসী কোনরূপে ভীতা না হয়, এই নিমিত্ত একটি কনষ্টেবলকেও সেই রাত্রির নিমিত্ত সেইস্থানে রাখিয়া দিতে হইল।
সেইস্থান হইতে বহির্গত হওয়ার পর আমাদিগের প্রধান কার্য্য হইল—যদি প্রকৃতই বিলাসীর কোন উপপতি থাকে, অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা। পাড়ার ভিতর অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল। প্রথমে জানিতে পারিলাম যে, বিলাসীর প্রকৃতই একজন উপপতি আছে। পরে তাহার নামও বাহির হইয়া পড়িল; জানিতে পারিলাম—উহার নাম গগনচন্দ্র ঘোষ। বিলাসী জাতিতে সুবর্ণ বণিক হইলেও তাহার উপপতি, কিন্তু গোয়ালা। গগন ঘোষের নাম যখন আমরা জানিতে পারিলাম, তখন তাহার ঠিকানা বাহির করিতে আমাদিগের আর বিশেষ কোন কষ্টই হইল না। সেই রাত্রিতেই তাহার বাড়ী পাইলাম; কিন্তু গগনকে তাহার বাড়ীতে পাইলাম না। জানিতে পারিলাম, দিবসে সকাল সকাল আহার করিয়া সে তাহার কোন কুটুম্বের বাড়ীতে গমন করিয়াছে। সেইস্থান হইতে এ পর্যন্ত ফিরিয়া আইসে নাই।
গগনের বাড়ীতে কেবল এইমাত্র সংবাদ পাইয়া যে আমরা সেই রাত্রির নিমিত্ত নিশ্চিন্ত হইলাম, তাহা নহে। গগনের পরিবারবর্গের নিকট হইতে যাহাতে আরও কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারা যায়, তাহার চেষ্টার জন্য প্রবৃত্ত হইলাম।
গগনের বাড়ীর নিকট লক্ষ্মণচন্দ্র দাস নামক জনৈক ভদ্রলোকের বাসস্থান। আমরা তাঁহার বাড়ির নিকট গিয়া কোন বিষয়ের অনুসন্ধান করিতেছি, এই কথা জানিতে পারিলে, তিনি আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়া বোধ হইল, লোকটি অভদ্র নহে, এবং তাঁহার সাধ্যমত সকল বিষয়েই তিনি আমাদিগকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, গগনের বাড়ীর ভিতর তাহার যাওয়া আসা আছে, এবং উক্ত বাড়ির স্ত্রীলোকেরা সকলেই তাহার সহিত কথাবার্তা কহিয়া থাকে।
আমাদিগের অনুরোধে লক্ষ্মণচন্দ্র গগনের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও আমরা তাঁহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তিনি গগনের বাড়ীর ভিতরস্থিত সেই স্ত্রীলোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া, তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “গগন কোন সময় বাড়ি হইতে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে?”
লক্ষণ। দিবা দশটা এগারটার সময় এখান হইতে গমন করিয়াছে।
আমি। কোথায় গিয়াছে?
লক্ষ্মণ। কুটুম্বের বাড়ীতে গমন করিয়াছে।
আমি। কোন্ স্থানের কোন্ কুটুম্বের বাড়িতে গমন করিয়াছে?
লক্ষ্মণ। তাহা সে বলিয়া যায় নাই।
আমি। আজ যে বৃদ্ধা মরিয়া গিয়াছে, তাহার পুত্রবধূ বিলাসীকে আপনারা চেনেন কি?
লক্ষ্মণ। বিলাসী! আমি বলিয়া নহে, এ বাড়ীর সকলেরই নিকট পরিচিত।
আমি। সে কিরূপে পরিচিত হইল?
লক্ষ্মণ। গগনের সহিত তাহার ভালবাসা আছে, সেই নিমিত্ত সে প্রায় সৰ্ব্বদাই এখানে আসিয়া থাকে। ইহা ব্যতীত দুইমাস পূর্ব্বে বিলাসী ও তাহার শাশুড়ী চারি পাঁচমাস পর্য্যন্ত এই বাড়ীতেই বাস করিয়াছিল। তাহাদিগের থাকিবার নিমিত্ত গগন বাহিরের দুইটি গৃহই ইহাদিগকে প্রদান করিয়াছিল। প্রায় দুইমাস অতীত হইল, একদিবস বৃদ্ধার শরীর অসুস্থ বোধ হয়; সেইদিবস হইতে উহারা এইস্থান পরিত্যাগ করিয়া, আপনাদিগের বাড়ীতে গমন করে। তাহার পর আমাদের বাটীতে অপর আর কেহই ছিলেন না।
আমি। যে সময় বিলাসী ও তাহার শাশুড়ী এই বাড়ীতে বাস করিত, সেই সময় উহাদিগের অলঙ্কারাদি কোন প্রকার মূল্যবান দ্রব্য কিছু ছিল কি?
লক্ষ্মণ। সকলেই শুনিয়াছেন, যে, বৃদ্ধার অলঙ্কারাদি ও নগদ অর্থ কিছু আছে; কিন্তু কেহ কখন দেখেন নাই। বিলাসীর অলঙ্কারাদি যাহা ছিল, তাহার অধিকাংশই সকলে দেখিয়াছেন। তাহার গহনাপত্র নিতান্ত ন্যূন নহে।
আমি। বিলাসীর অলঙ্কার আপনারা কতদিন হইল, শেষ দেখিয়াছেন?
লক্ষ্মণ। প্রায় দুইমাস অতীত হইল, যখন তাহারা এই বাড়ী পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়াছিল, সেই সময় বিলাসীর অনেক অলঙ্কার এ বাড়ীর সকলেই দেখিয়াছিল।
আমি। গহনাপত্র ব্যতিরেকে ইহাদিগের তৈজসপত্র কিছু আছে, বলিতে পারেন?
লক্ষ্মণ। পিত্তল ও কাঁসার বাসন প্রভৃতিতে প্রায় দুই সিন্ধুক আছে।
আমি। সেই সকল বাসন কোথায় রাখিয়াছে?
লক্ষ্মণ। এই বাড়ীতেই আছে। যে গৃহে উহারা থাকিত, সেই গৃহের ভিতর দুইটি সিন্ধুক বাসন প্রভৃতির দ্বারা বোঝাই করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তাহা এই গৃহের ভিতর এখন পর্য্যন্তও আছে।
আমি। পিত্তল, কাঁসার বাসন প্রভৃতি যেমন উহারা এইস্থানে রাখিয়া গিয়াছে। গহনাপত্র প্রভৃতি উহারা কোথায় রাখিয়া দিয়াছে, ইহার সন্ধান কিছু বলিতে পারেন কি?
লক্ষ্মণ। বাড়ীর কোন স্ত্রীলোকেই বলিতে পারেন না যে, উহারা তাহাদিগের অলঙ্কার-পত্র অন্য কাহারও নিকট রাখিয়া দিয়াছে, বা আপনাদিগের নিকট রাখিয়াছে।
আমি। গগনের নিকট যদি উহারা সেই সকল অলঙ্কার-পত্র রাখিয়া দিত, তাহা হইলে আপনারা জানিতে পারিতেন কি না?
লক্ষ্মণ। জানিবারই সম্ভাবনা অধিক। কারণ, যদি গগনের নিকট অলঙ্কার-পত্র রাখিয়া দিত, তাহা হইলে ইহারা সকলেই তাহা দেখিতে পাইতেন। আর যদি গগন তাহার নিজের সিন্ধুকের ভিতর রাখিত, তাহা হইলে কোনদিবস না কোনদিবস বাড়িতে সে কথার গল্প করিত।
আমি। গগনের নিজের যে সিন্ধুকের কথা কহিলেন, সেই সিন্ধুকের চাবি কাহার নিকট থাকে? লক্ষ্মণ। গগন সে চাবি কাহাকেও দেয় না, তাহা সর্ব্বদাই গগনের নিকট থাকে।
আমি। সে সিন্ধুক কোথায় থাকে?
লক্ষ্মণ। গগনের শুইবার ঘরে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
লক্ষ্মণের মধ্যবর্তিতায় পূর্ব্বোক্ত কথা সকল জানিতে পারিয়া মনে মনে চিন্তা করিলাম :—
১ম। গগন বিলাসীর সহিত অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ, একথা যখন সকলেই অবগত আছে, এবং বিলাসী আপনার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া গগনের বাড়িতে পর্য্যন্ত বাস করিয়া গিয়াছে, তখন সে কথা বিলাসী গোপন করিল কেন?
২য়। বিলাসী তাহার নিজের তৈজসপত্র নিজেই গগনের বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছে, এবং যে গৃহে তাহারা বাস করিয়াছিল, এখন পর্য্যন্ত উহা সেই গৃহেই রক্ষিত আছে, এরূপ অবস্থায় বিলাসী সে কথা অস্বীকার করে কেন?
৩য়। তবে কি বিলাসী ও গগন উভয়ে মিলিয়া এই পাপ-কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছে? এবং গগন নিজেরই নিকট অলঙ্কার-পত্র রাখিয়া দিয়াছে? এই নিমিত্ত বিলাসী কোন প্রকারেই গগনের নাম আপনার মুখে আনে নাই। মনে ভয়—গগনের নাম কোনরূপে আমরা জানিতে পারিলে, পাছে তাহার বাড়ীতে গমন করি, বা তাহার বাড়ীতে কোনরূপে অনুসন্ধান করি, এবং অনুসন্ধান করিলে পাছে প্রকৃতকথা বাহির হইয়া পড়ে!
আমার মনে যখন এইরূপ কথা উদিত হইল, তখন পুনরায় ভাবিলাম যে, এরূপ অবস্থায় গগনের সিন্ধুক, বাক্স প্রভৃতি অনুসন্ধান করিয়া দেখা উচিত, কি না? আবার ভাবিলাম যে, আমরা হত্যা অপরাধের অনুসন্ধান করিতেছি, কিনা, তাহাও যখন আমরা এখন পর্য্যন্ত বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই, তখন গগনের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া তাহার অনুপস্থিতিতে তাহার খানা-তল্লাসি করা, আইনানুযায়ী ন্যায় সঙ্গত কাৰ্য্য, কি না? আবার গগন যদি প্রকৃতই কোন না কোনরূপে বৃদ্ধাকে হত্যা করা অপরাধে অপরাধী হয়, এবং অলঙ্কার-পত্র তাহার সেই গৃহে রাখিয়া স্থানান্তরে গমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে যখন আসিয়া জানিতে পারিবে যে, তাহার উপর সন্দেহ করিয়া পুলিস তাহার বাড়ীতে পর্য্যন্ত আগমন করিয়াছিল, তখন সে সেই সকল অপহৃত দ্রব্য আপনার বাড়ীতে আর রাখিবে কি? এরূপ অবস্থায় ন্যায় হউক বা অন্যায় হউক, গগনের গৃহ অনুসন্ধান না করিয়া আর থাকিতে পারা যায় কি?
এই প্রকার নানারূপ চিন্তার পর, লক্ষ্মণবাবুকে আমি কহিলাম, “যখন গগন বাড়ীতে নাই, এবং আমরা কোন দুয়ে বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছি, তখন তাহার নিজের বাক্স, সিন্ধুক প্রভৃতি না দেখিয়া, আমরা কোনরূপেই নিবৃত্ত হইতে পারিলাম না। আপনি স্ত্রীলোকগণকে বুঝাইয়া বলুন, এবং তাহার নিজের বাক্স, সিন্ধুক প্রভৃতি কোথায় আছে, তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিউন।”
লক্ষ্মণবাবু স্ত্রীলোকগণকে আমার কথা বুঝাইয়া দিলে, তাঁহাদিগের সম্পূর্ণ অনিচ্ছা থাকিলেও, আমরা গগনের বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। লক্ষ্মণবাবু সেইস্থানেই উপস্থিত ছিলেন; তদ্ব্যতীত আরও কয়েকজন পাড়ার ভদ্রলোককে সমভিব্যাহারে গগনের সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সিন্ধুকের চাবি গগনের নিকট, সুতরাং প্রথমে অপর কোন চাবি দ্বারা যদি সেই সিন্ধুক খুলিতে পারা যায়, তাহার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য না হইয়া, পরিশেষে সকলের সম্মুখে সেই সিন্ধুক ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম।
সিন্ধুকের ভিতর যে সকল দ্রব্য পাওয়া গেল, তাহা দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন। উক্ত সিন্ধুকের ভিতর একটি মৃৎপাত্রে কতকগুলি সুবর্ণ এবং রৌপ্যনির্ম্মিত অলঙ্কার রক্ষিত ছিল। সেই সকল অলঙ্কার বাহির করিয়া সর্ব্বসমক্ষে স্থাপিত করিলাম। উহা দেখিয়া সকলেই বলিয়া উঠিলেন, “নিজের অলঙ্কার ব্যতীত এত অলঙ্কার গগন কোথায় পাইল?”
বাটীর স্ত্রীলোকগণ অপর গৃহ হইতে এই সকল ব্যাপার দেখিতেছিলেন। এই সকল অলঙ্কার দেখিয়া তাঁহারও অতিশয় বিস্মিত হইলেন ও কহিলেন, “বিলাসীর গহনাও দেখিতেছি ইহার মধ্যে আছে! ইহার অনেক অলঙ্কার পূর্ব্বে আমরা বিলাসীর নিকট দেখিয়াছি।” স্ত্রীলোকগণের এই প্রকার কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করিল সত্য, কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, কাহাকেও কোন কথা না কহিয়া, সেই সকল অলঙ্কারের একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া, সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
উক্ত অলঙ্কার সকল লইয়া আমরা অপর কোনস্থানে গমন না করিয়া, বিলাসীর বাড়িতে গিয়া পুনরায় উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে, তখন পৰ্য্যন্ত বিলাসী শয়ন করে নাই: দাওয়ার উপর বসিয়া প্রাঙ্গণোপরি উপবিষ্ট কনষ্টেবলের সহিত কথাবার্তা কহিতেছে। আমরা তাহার বাড়ীর ভিতর পুনরায় প্রবেশ করিলে, বিলাসী যেন কেমন এক প্রকার চিন্তিত হইয়া পড়িল। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তাহার মনে যেন অতিশয় ভয়ের উদ্রেক হইয়াছে।
বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া আমরা বিলাসীকে আমাদিগের নিকটে আসিতে কহিলাম। সে দাওয়ার উপর হইতে অবতরণ করিয়া প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে আমাদিগের নিকটে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। আমরা যে সকল অলঙ্কার গগনের বাড়ি হইতে লইয়া গিয়াছিলাম, সেই সকল অলঙ্কার বিলাসীর সম্মুখে স্থাপিত করিয়া কহিলাম, “দেখ দেখি! এই অলঙ্কারগুলি কাহার?” উহা দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় বিলাসী একবার চতুর্দিক দেখিয়া লইল। বুঝিলাম, গগন আমাদিগের সঙ্গে আছে, কি না, তাহাই সে দেখিতেছে। পরিশেষে উক্ত অলঙ্কারগুলি উত্তমরূপে দেখিয়া বিলাসী অনায়াসেই কহিল, “না মহাশয়! এ অলঙ্কারগুলি কাহার, তাহা আমি চিনিতে পারিতেছি না। ইহার পূর্ব্বে এই সকল অলঙ্কার আমি আর কখনও ত দেখি নাই।” বিলাসীর কথা শুনিয়া আমরা অবাক্ হইলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
অলঙ্কারগুলি দেখিয়া বিলাসী যেরূপ কহিল, তাহাতে আমাদিগের মনে আরও সন্দেহ হইল। আমাদিগের মধ্যে কেহ কেহ বলিয়া উঠিলেন, “এখন আমাদিগের সমস্ত সন্দেহ মিটিয়া গেল। এখন আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ইহা আত্মহত্যা নহে, বা আপনা-আপনি পড়িয়া গিয়া বৃদ্ধা আঘাত প্রাপ্ত হয় নাই। বিলাসী পূর্ব্বে যে সমস্ত কথা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা। বিলাসীই তাহার শাশুড়িকে হত্যা করিয়াছে, এবং তাহার সমস্ত অলঙ্কার অপহরণ করিয়া আপনার অলঙ্কারের সহিত তাহার উপপতি গগন ঘোষের নিকট লুকাইয়া রাখিয়াছে। নতুবা নিজের অলঙ্কার নিজে চিনিতে পারিল না, এ আবার কেমন কথা?”
এই কথা শুনিয়া বিলাসী কাঁদিয়া ফেলিল ও কহিল, “ধর্ম্মাবতার! আমি পূৰ্ব্বে যাহা যাহা বলিয়াছি, তাহার একবর্ণও মিথ্যা নহে। আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি,—আমি আমার শাশুড়িকে হত্যা করি নাই, বা কাহাকেও করিতে দেখি নাই। আপনারা আমার বিপক্ষে যে সমস্ত বলিতেছেন, তাহা ঠিক নহে।”
বিলাসীর এই কথা শুনিয়া কেহ বা তাহাকে দুই একটি অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগিল, কেহ বা তাহাকে মারিতে দৌড়াইল। কৰ্ম্মচারীবর্গের এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া বিলাসী আর কোন কথা কহিল না, বরং নিতান্ত ভীত অন্তঃকরণে একপার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিল।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিলাসীকে যেরূপভাবে রাখা হইয়াছিল, এখন আর তাহাকে সেরূপভাবে রাখা হইল না। বৃদ্ধাকে হত্যা করার সমস্ত সন্দেহই এখন তাহার উপর পড়িয়াছে, সুতরাং তাহার উপর এখন রীতিমত প্রহরীর পাহারা পড়িল। তদ্ব্যতীত যাহাতে সে পলায়ন করিতে না পারে, তাহার নিমিত্ত সেই সময়ে সেইস্থানে উপস্থিত কর্ম্মচারীমাত্রই তাহার উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখিলেন। এক কথায় বিলাসী এখন এক প্রকার আবদ্ধ অবস্থাতেই রহিল।
বিলাসীর নিকট হইতে সহজে আর যে কোন কথা পাওয়া যাইবে, তাহা বোধ হইল না। তখন অনন্যোপায় হইয়া তাহাকেই লইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে মনস্থ করিলাম। আবার ভাবিলাম, প্রথমে গগন ঘোষের অনুসন্ধান করা কর্তব্য। কারণ, তাহাকে প্রাপ্ত হইলে কি প্রকারে বিলাসীর অলঙ্কার-পত্র তাহার গৃহে গেল, তাহা তাহার নিকট অনায়াসেই জানিতে পারিব। এই প্রকার ভাবিয়া বিলাসীকে উপযুক্ত প্রহরীর নিকট অর্পণ করিয়া, আমরা গগন ঘোষের অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলাম।
গগনের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম সত্য; কিন্তু কোথায় গমন করিলে তাহার অনুসন্ধান প্রাপ্ত হইতে পারিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় তাহার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। শহর ও শহরতলীর ভিতর কোন কোন স্থানে গগনের কুটুম্ব আছে, তাহা গগনের পরিবার-বর্গের নিকট হইতে অবগত হইয়া, গগনের অনুসন্ধানের নিমিত্ত সেই সেইস্থানে গমন করিলাম। কিন্তু কোনস্থানে তাহার কিছুমাত্র অনুসন্ধান না পাইয়া, নিতান্ত ক্ষুণ্নমনে পুনরায় বিলাসীর গৃহে প্রত্যাগমন করিলাম।
বিলাসীর বাড়ীতে আসিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে মনে হইল যে, আমরা যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না। মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু যাহা দেখিলাম, তাহাতে মনে মনে অতিশয় ক্রোধও হইল, লজ্জাও হইল। নিজের বন্দোবস্তের উপর নিজেই সহস্র দোষারোপ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, যে প্রহরী বিলাসীর উপর পাহারায় নিযুক্ত ছিল, সে অচেতন অবস্থায় বিলাসীর দাওয়ার উপর শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছে। সে এরূপ গাঢ়নিদ্রায় অভিভূত, যে কখন আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছি, সে তাহার বিন্দুমাত্রও জানিতে পারে নাই। প্রহরীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া পরিশেষে বিলাসীর অনুসন্ধান করিলাম। দেখিলাম, বিলাসী সেইস্থানে নাই। তখন সেই পাহারাওয়ালাকে উঠাইলাম। সে উঠিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে স্ত্রীলোকের উপর তোমার পাহারা ছিল, সে স্ত্রীলোকটি কোথায়?” সে আমাদিগের প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করিয়া, এদিক্ ওদিক্ দেখিতে লাগিল। বুঝিলাম, তাহার অনবধানতা বশতঃ বিলাসী প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়াছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া সেই বাড়ী, ও বাড়ীর সংলগ্ন বাগান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোন স্থানেই বিলাসীর কোনরূপ চিহ্নই দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে সেই পাড়ার ভিতরস্থিত প্রত্যেক স্থানেই অনুসন্ধান করিলাম, এবং প্রত্যেক বাড়ীরই সংবাদ লইলাম। কিন্তু কোনস্থানেই বিলাসীর কোনরূপ সন্ধান না পাইয়া এখন কি করা কর্তব্য, একস্থানে উপবেশন করিয়া তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।
সেই সময়ে হঠাৎ মনে হইল যে, বিলাসীর দুঃখে দুঃখ বোধ করে, এরূপ ব্যক্তি এ পাড়ার ভিতর নাই। তাই সে বৃদ্ধার সেবা-শুশ্রূষা করিবার নিমিত্ত ভবানীপুরে তরলাকে ডাকিতে গিয়াছিল। ইহাতে স্পষ্টই অনুমান করা যাইতে পারে যে, অন্যান্য স্ত্রীলোকগণ অপেক্ষা তরলাই তাহার অধিকতর বিশ্বাসের পাত্রী। এই ভাবিয়া সেই রাত্রিতেই আমরা ভবানীপুরে গমন করিলাম। অনেক অনুসন্ধান করিয়া পরে বেলতলায় তরলার বাড়িও পাইলাম; কিন্তু সেইস্থানেও বিলাসীর কোন প্রকার সন্ধান পাইলাম না। তবে জানিতে পারিলাম যে, তরলা প্রকৃতই বাড়িতে নাই, স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম, দিবাভাগে তরলার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত বিলাসী সেইস্থানে প্রকৃতই গমন করিয়াছিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
এইরূপে বিলাসী ও তাহার উপপতি গগন ঘোষের অনুসন্ধান করিতে করিতে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল; তাহাদিগের কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ক্রমে বেলা হইতে লাগিল, তথাপি উহারা যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সংবাদ কেহই প্রাপ্ত হইলেন না।
পূর্ব্বদিবস বৃদ্ধার মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত ভবানীপুরে প্রেরণ করা হইয়াছিল, একথা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। দিবা এগারটার সময় সেই মৃতদহে পরীক্ষার ফল অর্থাৎ পরীক্ষাকারী ডাক্তারের রিপোর্ট আসিয়া উপস্থিত হইল। উহা পাঠ করিয়াই বুঝিলাম, আমাদিগের অনুসন্ধান এইস্থানেই সম্পন্ন হইল। বিলাসী বা তাহার উপপতি গগন ঘোষ আপন-আপন বাড়িতে প্রত্যাগমন করুক বা না করুক, তাহাতে আর আমাদিগের কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কারণ, যে অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়া সমস্ত রাত্রি বিশেষ কষ্টভোগ করিয়াছি, এবং বিনা-আহারে ও বিনা-বিশ্রামে যে কার্য্যের নিমিত্ত সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছি, ডাক্তারের এই কথাতেই আমাদিগের সেই সকল পরিশ্রমের লাঘব হইল। লাঘবই বা বলি কেন, এই অনুসন্ধান-জনিত পরিশ্রমের এইস্থানেই শেষ হইল। বিলাসী ও গগন ঘোষকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করাও এইস্থানে শেষ হইল।
মৃতদেহ পরীক্ষাকারী ডাক্তার তাঁহার রিপোর্টে লিখিয়া দিয়াছিলেন,—“মৃতার বয়ঃক্রম অধিক হইয়াছে, এবং বৃদ্ধ অবস্থায় যে সকল রোগের প্রকোপ হইয়া থাকে, বৃদ্ধার সেই সকল রোগ প্রায় সমস্তই হইয়াছিল; তাহা ব্যতীত জ্বরের বেগ অতিশয় প্রবল হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। আমার বিবেচনায় বৃদ্ধা বার্দ্ধক্যজনিত স্বাভাবিক রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। বৃদ্ধার মস্তকে একটি আঘাতের চিহ্ন আছে সত্য; কিন্তু সেই আঘাত বৃদ্ধা তাহার মৃত্যুর অতি অল্প পূৰ্ব্বেই প্রাপ্ত হইয়াছে বোধ হয়। হঠাৎ দেখিলে সেই আঘাতকে অতিশয় গুরুতর বলিয়া অনুমান হয়; কিন্তু দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে অধিক হইলেও, উহার গভীরতা অতিশয় অল্প, কেবলমাত্র চামড়া কাটিয়া গিয়াছে। হাড়ের উপর কিছুমাত্র আঘাত লাগে নাই। এই আঘাতের সহিত বৃদ্ধার মৃত্যুর কোনরূপ সংশ্রব নাই। যে রোগে এবং যে সময়ে বৃদ্ধার মৃত্যু হইয়াছে, এই আঘাত প্রাপ্ত না হইলেও, সেই সময়ে এবং সেই রোগে বৃদ্ধার মৃত্যু নিশ্চয়ই ঘটিত।”
বৃদ্ধা হতা হইয়াছে বলিয়া, আমরা যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, এবং এখন পৰ্য্যন্ত যে সকল পন্থা অবলম্বন করিয়া আসিতেছিলাম, তাহা আমাদিগকে একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইল। যাহাদিগের উপর সন্দেহ হইয়াছিল, ও যাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়াছিলাম, এবং অপর নূতন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টায় বিশিষ্টরূপে চিন্তিত ছিলাম, সেসব কথাও মনে হইতে একেবারে দূর করিলাম। এক কথায় পরীক্ষাকারী ডাক্তারের এই রিপোর্ট পাইবার পরেই সমস্ত অনুসন্ধান একেবারে পরিত্যাগ করিয়া, আপন-আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।
আইনানুযায়ী এই অনুসন্ধান হইতে নিবৃত্ত হইলাম সত্য; কিন্তু মনের ধাঁধাঁ একেবারে মিটিল না! কি প্রকারে বৃদ্ধা তাহার মস্তকে সেই আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে, যে পর্য্যন্ত তাহার প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হইতে না পারিলাম, সেই পৰ্য্যন্ত মনে সুখ পাইলাম না।
এইরূপ অনুসন্ধান কার্য্য সম্পন্ন করিয়া আপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। কিন্তু গগন ঘোষকে প্রাপ্ত না হওয়ায় তাহার গৃহ হইতে প্রাপ্ত বিলাসী ও তাহার শাশুড়ীর অলঙ্কারগুলি অপর আর কাহারও নিকট প্রত্যর্পণ করিতে সাহস হইল না। সুতরাং সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করিবার সময় অনন্যোপায় হইয়া সেই অলঙ্কারগুলি আমরা সমভিব্যাহারে লইয়া আসিলাম।
এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু বিলাসী ও গগন ঘোষ তাহাদিগের বাড়িতে প্রত্যাগমন করিয়াছে, কি না, এই সংবাদ প্রায় প্রত্যহই লইতে লাগিলাম। দুই তিনদিবস পরে জানিতে পারিলাম যে গগন ঘোষ তাহার বাড়িতে প্রত্যাগমন করে নাই; কিন্তু বিলাসী তাহার বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়াছে।
নবম পরিচ্ছেদ
বিলাসীর প্রত্যাগমন সংবাদ জানিতে পারিয়া, একদিবস তাহাকে ডাকাইলাম। ডাকিবামাত্র বিলাসী আমার নিকট আগমন করিল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এতদিবস কোথায় ছিলে?”
বিলাসী। থাকিবার নির্দ্ধারিত স্থান আমার ছিল না। যেখানে পাইয়াছি, সেইস্থানেই আহার করিয়াছি। যে একটু স্থান দিয়াছে, তাহারই বাড়ীতে রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছি।
আমি। তুমি আপন গৃহসংসার পরিত্যাগ করিয়া এরূপভাবে পলায়ন করিয়াছিলে কেন?
বিলাসী। না পলাইয়া কি করি? যখন দেখিলাম, আপনারা সকলেই একবাক্যে বলিতেছেন যে, আমিই আমার শাশুড়ীকে হত্যা করিয়াছি, তখন পলায়ন ব্যতিরেকে আমার উপায় কি? বিনাদোষে ইচ্ছা করিয়া কে আপনাদিগের হস্তে পতিত হইতে চাহে, এবং কেই বা ইচ্ছা করিয়া ফাঁসীরজ্জু আপনার গলায় বেষ্টন করিতে চাহে। যখন দেখিলাম, আপনারা সকলেই আমার বিপক্ষে, তখন আপনাদিগের হস্ত হইতে পলায়ন করিয়া, কাজেই আমার প্রাণ বাঁচাইবার চেষ্টা দেখিতে পাইল।
আমি। তোমার উপর একজন প্রহরীর পাহারা ছিল। তাহার হস্ত হইতে কিরূপে পলায়ন করিতে পারিলে?
বিলাসী। যখন দেখিলাম, আমাদের সেই বাড়ির ভিতর আমি ও সেই প্রহরী ভিন্ন অপর আর কেহ নাই, তখন আমি দাওয়ার উপর একটি শয্যা পাতিয়া প্রহরীকে সেইস্থানে বসিতে কহিলাম, এবং অপর আর একটি শয্যা প্রস্তুত করিয়া আমি তাহার উপর শয়ন করিলাম। প্রহরীকে কহিলাম, “সমস্ত দিবস অতিশয় পরিশ্রম করিয়াছি, আর এখন রাত্রিও অধিক হইয়াছে; আমার শরীর নিতান্ত অবসন্ন হইয়া আসিতেছে, আমি এইস্থানে শুইয়া নিদ্রা যাই। তুমি আমার উপর পাহারা দাও।” এই বলিয়া আমি আমার শয্যার উপর শয়ন করিলাম, প্রহরী তাহার শয্যার উপর উপবেশন করিয়া আমার উপর পাহারা দিতে লাগিল। আমি নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছি, এইরূপ ভান করিয়া শুইয়া শুইয়া দেখিতে লাগিলাম, প্রহরী বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে লাগিল। ঢুলিতে ঢুলিতে আমাকে দুই একবার ডাকিল; কিন্তু আমার নিকট হইতে কোনরূপ উত্তর প্রাপ্ত না হইয়া ভাবিল যে, আমি নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছি। এই ভাবিয়াই বোধ হয়, সেও পরিশেষে শয্যার উপর শয়ন করিল, এবং ক্রমে নিদ্রিত হইয়া পড়িল। আমি যে সুযোগ অনুসন্ধান করিতেছিলাম, অনায়াসেই সেই সুযোগ প্রাপ্ত হইয়া আস্তে আস্তে আমার শয্যা পরিত্যাগ পূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিলাম। এক পা দুই পা করিয়া, ক্রমে বাড়ীর প্রাঙ্গণে অবতরণ করিলাম, ও পরিশেষে অন্ধকারের সহিত মিলিত হইয়া বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ক্রমে বাগান হইতে বহির্গত হইয়া, আমার ইচ্ছামত স্থানে গমন করিতে লাগিলাম।
আমি। আমাদিগের ভয়ে যদি পলায়নই করিলে, তাহা হইলে পুনরায় প্রত্যাগমন করিলে কেন? আমাদিগের কর্তৃক তোমার যে অনিষ্টের আশঙ্কা করিয়াছিলে, সেই আশঙ্কা এখন দূর হইল কি প্রকারে?
বিলাসী। যখন জানিতে পারিলাম, আমার শাশুড়ী কাহারও দ্বারা হত হয়েন নাই, স্বাভাবিক রোগে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ স্থির হইয়াছে, তখন আর আপনাদিগকে ভয় করিব কেন? যখন হত্যাই হয় নাই, তখন হত্যা-অপরাধে অপরাধী হইব কি প্রকারে?
আমি। তোমার শাশুড়ী যে স্বাভাবিক রোগে মরিয়া গিয়াছেন, একথা তোমাকে কে বলিল?
বিলাসী। যেই বলুক—এই কথা শুনিয়াছি বলিয়াই ফিরিয়া আসিয়াছি; নতুবা সহজে আমাকে আপনারা পাইতেন না।
আমি। তুমি বেশ বিবেচনা করিয়া দেখ দেখি, ইহার ভিতর আমাদিগের কোনরূপ চালাকি চলিতে পারে, কিনা? আমরা যখন এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতেছি, এবং তোমাকে ও গগনকে যখন আমাদিগের নিতান্ত প্রয়োজন, তখন তোমরা যাহাতে আপন-আপন বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হও, তাহার নিমিত্ত এই সামান্য কৌশলটুকু কি আমাদিগের দ্বারা ঘটিতে পারে না? ডাক্তার যে রিপোর্ট দিয়াছেন, তাহা বাহিরের লোকের জানিবার সুযোগ অতি অল্প। এরূপ অবস্থায় রিপোর্টের প্রকৃতকথা গোপন করিয়া যাহাতে তোমরা হাজির হও, তাহার নিমিত্ত যদি আমরা প্রচার করিয়া দেই যে, স্বাভাবিক রোগে বৃদ্ধার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা হইলে তোমরা ঘুরিয়া ফিরিয়া পুনরায় আমাদিগের হস্তে আসিয়া পড়িতে পার; আর ঘটিয়াছেও তাহাই। তুমি আমাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রত্যাশায় লুকাইয়াছিলে; কিন্তু আমাদিগের কৌশল জালে পড়িয়া কিরূপে তোমাকে পুনরায় আমাদিগের হস্তেই পড়িতে হইয়াছে, তাহাই একবার ভাবিয়া দেখ না কেন? তোমাকেও যেরূপ উপায়ে পাইয়াছি, আমার বিশ্বাস—গগনকেও সেইরূপে পাইব।
বিলাসী। আপনি যে কৌশলের কথা বলিলেন, সেইরূপ ভাবে কৌশল করিয়া আপনারা অনায়াসেই আপন কার্য্য উদ্ধার করিতে পারেন, যে বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু বর্ত্তমান ঘটনা সম্বন্ধে আপনি যাহাই বলুন, ইহা কিন্তু আপনাদিগের কৌশল নহে, ইহা প্ৰকৃতকথা। আমি সবিশেষ বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইতে পারিয়াছি যে, আমার শাশুড়ির স্বাভাবিক রোগেই মৃত্যু হইয়াছে!
আমি। তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে যে, ইহা আমাদিগের কৌশল নহে?
বিলাসী। সৰ্ব্বশেষ দিবসে আমি যে ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত্রিযাপন করি, তাঁহারা নিয়মিতরূপ সংবাদপত্র পাঠ করিয়া থাকেন। তাঁহারা সংবাদপত্র পাঠে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, এই বিষয় লইয়া আপনাদিগের মধ্যে গল্প করিতেছিলেন। আমি তাঁহাদিগের কথাগুলি বেশ শুনিতে পাই, এবং এই ঘটনায় যে আমরাই সংশ্লিষ্ট, তাহাও বেশ বুঝিতে পারি। আপনি আমাকে এখন যাহা কহিলেন, সেই কথাও সেই সময়ে আমার মনে উদয় হয়। সেই সময়ে আমি ভাবি যে, যাহাতে আমি আমার বাড়িতে প্রত্যাগমন করি, তাহারই নিমিত্ত সংবাদপত্রের সাহায্যে আপনারা এই মিথ্যা কথা প্রচার করিয়া, আমাকে প্রতারিত করিবার বাসনা করিয়াছেন। যাহা হউক, সেই বাড়ীর গৃহিণীর সাহায্যে আমি সমস্ত কথা কর্তার কর্ণগোচর করি, গোপন রাখিবার মধ্যে কেবল আমিই যে বিলাসী ও আমার শাশুড়ীর মৃত্যুর জন্য যে এত গোলযোগ বাঁধিয়াছে, তাহাই গোপন রাখি। আমি এই কথা গোপন করি সত্য; কিন্তু কর্তা আমাকেই বিলাসী বলিয়া সন্দেহ করেন। তিনি ইহার প্রকৃত তথ্য জানিয়া বলিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হন।
“যে ডাক্তার আমার শাশুড়ীর মৃতদেহ পরীক্ষা করেন, তাঁহার সহিত কর্তা মহাশয়ের আলাপ ছিল, বোধ হয়। যাহা হউক, তিনি আমার শাশুড়ীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অবগত হন, ও পরিশেষে আমাকে কহেন, “পূৰ্ব্বে সংবাদ পত্রে যে সংবাদ বাহির হইয়াছে, তাহা প্রকৃত। ইহাতে পুলিশ-কর্ম্মচারীর কোনরূপ কৌশল নাই।” যখন আমি এইরূপ প্রকৃত তথ্য অবগত হইতে পারিলাম, তখনই আমি আপনার বাড়িতে প্রত্যাগমন করিলাম। নতুবা আমাকে কখনই আপনারা পাইতে পারিতেন না।”
বিলাসীর কথা শ্রবণ করিয়া আমি অতিশয় আশ্চর্যান্বিত হইলাম, ও মনে মনে ভাবিলাম যে, কুলটা স্ত্রীলোকের কি অসাধারণ বুদ্ধি।
এই সময়ে বিলাসীকে পুনরায় সেই সকল অলঙ্কারের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সেই সমস্ত অলঙ্কারই যে তাহার, তাহা এবার সে স্বীকার করিল ও কহিল, “আমি গগনের নিকট এই সমস্ত দ্রব্য গচ্ছিত রাখিয়াছি।” কিন্তু গগন যে তাহার উপপতি, সে কথা কিন্তু সে এখনও স্বীকার করিল না। বুঝিলাম, স্ত্রীলোকের লজ্জাই এইরূপ অস্বীকার করিবার প্রধান কারণ। বিলাসীর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হওয়ার পর, তাহাকে সে দিবসের নিমিত্ত বিদায় দিলাম। বলিয়া দিলাম, “গগন বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলে, সময়মত একদিবস উভয়ে আমার নিকট আসিয়া তোমাদিগের অলঙ্কারগুলি লইয়া যাইও।” আমার কথা শ্রবণ করিয়া বিলাসী সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।
দশম পরিচ্ছেদ
এই ঘটনার তিন চারিদিবস পরে একদিবস বিলাসী ও গগন ঘোষ উভয়েই আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের যে সকল অলঙ্কার -পত্র আমার নিকটে ছিল, তাহা চাহিল। উহাদিগের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “অলঙ্কার-পত্র সমস্তই আমার নিকটে আছে। এখনই আমি তোমাদিগকে উহা প্রদান করিতেছি, তোমরা লইয়া যাও। কিন্তু এই সকল অলঙ্কার প্রত্যর্পণ করিবার পূর্ব্বেই আমি গগনকে দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি।”
গগন। আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা অনায়াসে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।
আমি। পূর্ব্বে তোমাদিগের যে একটু ভয়ের কারণ ছিল, তাহার আর এখন নাই। একথা বোধ হয়, তুমি শুনিয়া থাকিবে।
গগন। সকলই শুনিয়াছি। যখন আমরা কোন দোষে দোষী নয়, তখন আমাদিগের আর ভয়ের কারণ কি?
আমি। এরূপ অবস্থায় তুমি বোধ হয়, আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে?
গগন। মিথ্যা বলিব কেন? আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি যতদূর অবগত আছি, তাহার প্রকৃত উত্তরই প্রদান করিব।
আমি। তুমি বিলাসীকে চেন?
গগন। না চিনিলে, আর উহার সহিত মহাশয়ের নিকট আসিব কেন?
আমি। ও তোমার কে হয়?
গগন। ও আমার কেহই নয়, ও সোণার বেনের মেয়ে। আর আমি গোয়ালা।
আমি। তোমরা এক জাতি নহ, তাহা আমি অবগত আছি। কিন্তু উহার সহিত তোমার কোনরূপ বৈধ বা অবৈধ সংশ্রব আছে কি?
গগন। মহাশয় ত সে কথা পূৰ্ব্বেই জানিতে পারিয়াছেন। আমি আর এখন সে কথার উত্তর প্রদান কি করিব?
আমি। বিলাসীর শাশুড়ী একথা জানিত কি?
গগন। জানিত। অনেক দিবস উহারা উভয়েই একত্র আমার বাড়িতে গিয়া বাস করিয়াছে, এবং বৃদ্ধা স্বচক্ষে সমস্ত দেখিয়াছে।
আমি। তুমি যে সকল অলঙ্কারের নিমিত্ত আমার নিকট আগমন করিয়াছ, সেই সকল অলঙ্কার কাহার?
গগন। সেই সকল অলঙ্কার এখন বিলাসীর।
আমি। সেই সকল অলঙ্কার তোমার নিকট কি প্রকারে গমন করিল?
গগন। উভয়ে মিলিয়া এই সমস্তই আমার নিকট গচ্ছিত রাখিয়াছিল।
আমি। সেই সকল অলঙ্কার যে বিলাসীর, তাহা পূর্ব্বে সে একেবারে অস্বীকার করিয়াছিল কেন, বলিতে পার কি?
গগন। সে স্ত্রীলোক, বোধ হয় ভয় পাইয়াই অস্বীকার করিয়া থাকিবে।
আমি। সে যাহা হউক, বৃদ্ধাকে তুমি সৰ্ব্বশেষ কোন দিবস দেখিয়াছ?
গগন। যে দিবস বৃদ্ধার মৃত্যু হয় শুনিয়াছি, সেইদিবসও আমি তাহাকে দেখিয়াছি।
আমি। সেইদিবস কোন্ সময়ে তুমি তাহাকে দেখিয়াছিলে, মনে হয়?
গগন। বোধ হয়, বেলা দশটা এগারটার সময় আমি বৃদ্ধাকে দেখিয়া থাকিব।
আমি। দিবা দশটা এগারটার সময় তুমি বৃদ্ধাকে কোথায় দেখিয়াছিলে?
গগন। বৃদ্ধার বাড়ীতেই তাহাকে দেখিয়াছিলাম।
আমি। বিলাসী সেই সময় কোথায় ছিল?
গগন। বিলাসীকে আমি দেখিতে পাই নাই। সেই সময় সে কোথায় ছিল, তাহা আমি জানি না। কোন কাৰ্য্যবশতঃ সেইদিবস আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হয়, এই নিমিত্ত সকাল সকাল আহারাদি করিয়া আমি বাটী হইতে বহির্গত হই। ইহার কয়েক দিবস পূর্ব্ব হইতে বৃদ্ধার অতিশয় জ্বর হইয়াছিল বলিয়া, স্থানান্তরে যাইবারকালীন একবার বৃদ্ধাকে দেখিয়া ও বিলাসীকে বলিয়া কহিয়া যাইবার বাসনা করিলাম। কারণ, কয়েক দিবস পরে যে আমি ফিরিতে পারিব, তখন তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না। আমি বৃদ্ধার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াই দেখিতে পাইলাম যে, বৃদ্ধা বিষম জ্বরে একেবারে অস্থির হইয়াছে, ও দাওয়ার উপর যে স্থানে শয়ন করিয়াছিল, সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিবার চেষ্টা করিতেছে; বিলাসী বা অপর কেহই সেই সময়ে বাড়িতে নাই। বৃদ্ধার এই প্রকার অবস্থা দেখিয়া আমি দ্রুতপদে তাহার নিকটে গমন করিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাহার সন্নিকটে উপনীত হইতে না হইতেই, বৃদ্ধা দাওয়ার উপর হইতে একেবারে নিম্নে পড়িয়া গেল। সেইস্থানে সারি সারি কতকগুলি ইট ছিল, তাহার একখানির উপর বৃদ্ধার মস্তক পতিত হওয়ায় সেইস্থানে আঘাত লাগিল, এবং অল্প পরিমাণ রক্তও বাহির হইল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি অতিশয় ভীত হইলাম, ‘বিলাসী’ বলিয়া দুই একবার ডাকিলাম। কিন্তু তাহার কোনরূপ উত্তর না পাইয়া সেই বৃদ্ধাকে আস্তে আস্তে উঠাইলাম, এবং নিম্নে দাঁড়াইয়া তাহাকে দাওয়ার উপর শুয়াইয়া দিলাম। সেই সময় বৃদ্ধা একেবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বুঝিলাম যে, কথা কহিবার ক্ষমতা আর তাহার নাই। ভাবিলাম, ইহার মৃত্যু সমীপবর্তী। এই ভাবিয়া বিলাসীর প্রত্যাশায় আরও কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে অপেক্ষা করিলাম। সেই সময়ে আমার মনে হইল, আমি এইস্থানে আর অপেক্ষা করিতে পারি না। জাহাজের সময় আর তাধিক নাই। অতিশয় বৃদ্ধ হইলে, তাহার মৃত্যু সহজে হয় না। মরিতে মরিতেও দুই চারিদিবস অতিবাহিত হইয়া যায়। এইরূপ ভাবিয়া বিলাসীর জন্য আর অপেক্ষা না করিয়া, আমি সেইস্থান হইতে আপনার গন্তব্যস্থানে প্রস্থান করিলাম। সেইস্থান হইতে কেবলমাত্র কল্য প্রত্যাগমন করিয়াছি। আসিয়া শুনিলাম, বৃদ্ধা মরিয়া গিয়াছে, বিলাসী টানা-টানিতে পড়িয়াছিল, এবং আমার উপরও সন্দেহ হওয়ায় আমারও পর্য্যন্ত খানা-তল্লাসি হইয়াছে। এখন সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া গিয়াছে। আপনাদিগের মনের সন্দেহও দূর হইয়াছে। এখন আমার বাড়ি হইতে আনীত অলঙ্কারগুলি আমাদিগকে প্রত্যর্পণ করুন। আমরা আপন স্থানে প্রস্থান করিব।
এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের কার্য্য পরিত্যাগ করিবার পরও আমার মনে মনে যে বিষয় জানিবার ইচ্ছা নিতান্ত প্রবল ছিল, গগনের কথা শুনিয়া তাহা জানিতে পারিলাম। আমি উহাদিগকে আর কোন কথা না বলিয়া, আমার নিকটস্থিত অলঙ্কার-পত্রগুলি বাহির করিয়া আনিয়া উহাদিগকে প্রদান করিলাম। উহারা সমস্ত দ্রব্য বুঝিয়া লইয়া সন্তুষ্ট হৃদয়ে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও অপর কার্য্যে মনোনিবেশ করিলাম।
পরিশিষ্ট
এ মোকদ্দমার যেরূপ সূচনা হইয়া, পরিশেষে যেরূপে শেষ হইয়াছিল, তাহা পাঠকগণ বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন। কিন্তু বিলাসীর পরিণাম পরিশেষে কিরূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহা আপনারা জানিতে চাহেন কি?
এই ঘটনার কয়েক মাস পরই অন্য কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে যে স্থানে বিলাসী ছিল, সেইস্থানেই গমন করিতে হয়। যে স্থানে পূর্ব্বে বিলাসীর বাড়ী ছিল, এবার সেইস্থানে গিয়া আর সে বাড়ী দেখিতে পাইলাম না। এই ব্যাপার দেখিয়া উহার বাড়ী ঘর কিরূপে নষ্ট হইয়া গেল, জানিবার নিমিত্ত আমার মনে অতিশয় কৌতূহল জন্মিল, ও অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, পাপীয়সী বিলাসী গগন ঘোষের পরামর্শানুযায়ী বৃদ্ধার পরিত্যক্ত সমস্ত বিষয় বিক্রয় করিয়া ফেলে। তাহার সেই সময়ের প্রিয়বন্ধু গগন ঘোষের নিকট সেই অর্থও জমা করিয়া রাখে। বিলাসীর অলঙ্কার—পত্র পূর্ব্বেই তাহার হস্তগত হইয়াছিল, এখন বিষয় বিক্রয়-লব্ধ অর্থও হস্তগত হইল। প্রথম প্রথম গগন বিলাসীকে বিশেষ যত্নের সহিত আপনার বাড়িতে লইয়া গিয়া সেইস্থানে তাহার থাকিবার স্থান প্রদান করিল, এবং আপন পরিবারবর্গের অপেক্ষাও তাহাকে বিশেষরূপ ভালবাসা দেখাইতে লাগিল।
গগনের এ ভালবাসা অধিক দিবস থাকিল না। বিলাসী যেরূপ মহাপাপে লিপ্ত হইয়া আপনার প্রধান রত্ন অকপটচিত্তে গগন ঘোষকে প্রদান করিয়াছিল; এখন হইতেই সেই মহাপাপের মহাপ্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হইল। কোনরূপ ছল বল অবলম্বন করিয়া প্রথমেই গগন বিলাসীকে তাহার বাটী হইতে বহির্গত করিয়া দিল। পরিশেষে প্রচার করিল যে, বিলাসীর অলঙ্কার-পত্র ও টাকাকড়ি যাহা গগনের নিকট ছিল, তাহার সমস্তই বিলাসী লইয়া গিয়াছে। গগন এই কথা প্রকাশ করিল সত্য; কিন্তু কেহই তাহার কথা বিশ্বাস করিল না। অথচ সেই সকল বিষয় যাহাতে বিলাসী পুনঃপ্রাপ্ত হয়, তাহার চেষ্টাও কেহ করিল না। তখন বিলাসী কাঁদিয়া কাঁদিয়া দ্বারে দ্বারে বেড়াইতে লাগিল, গগনের পায় ধরিয়া কত তোষামোদ করিল; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। বিলাসী তাহার সঞ্চিত অর্থের কপৰ্দ্দকমাত্রও প্রাপ্ত হইল না। এইরূপ অবস্থায় দুই চারিদিবস উপবাস করিয়া পরিশেষে পরের দাস্যবৃত্তি করিতে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু যে কোন ভদ্রলোক তাহার চরিত্রের কথা শ্রবণ করিল, সে-ই তাহাকে আপন বাড়ী হইতে বহির্গত করিয়া দিল। যে যৌবনের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া বিলাসী এই মহাপাপে লিপ্ত হইয়াছিল, এখন তাহার আর সে যৌবন নাই, এবং তাহার পূর্ব্ব—চরিত্রের নিমিত্ত কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে তাহার স্থানও হইতেছে না। এরূপ অবস্থায় পতিত হইলে স্ত্রীলোকদিগের প্রায়ই যাহা হইয়া থাকে, ইহারও তাহাই হইয়াছে। পেটের জ্বালায় মুষ্টিভিক্ষা করিয়া এখন ইহাকে দিনপাত করিতে হইতেছে।
[জ্যৈষ্ঠ, ১৩০২]