এস্কুইমাউ কুমারীর উপকথা
The Esquimau Maidens Romance
হ্যাঁ মিঃ টোয়েন, আমার জীবনের সব কথাই আপনাকে বলব, কারণ আপনি যে আমাকে ভালবাসেন, আমার কথা জানতে চান এটা আপনার দয়া।
তার নিষ্পাপ চোখের প্রসন্ন দৃষ্টি আমার মুখের উপর ফেলে নরম গলায় মেয়েটি কথাগুলি বলল।
একটা ছোট হাড়ের ছুরি দিয়ে সে অন্যমনস্কভাবে গাল থেকে তিমি মাছের চর্বি চেঁছে তুলছিল, আর সেগুলোকে তার লোমের আস্তিনের মধ্যে রেখে দিচ্ছিল। তার চোখ দুটি ছিল মেরুজ্যোতির দিকে নিবন্ধ মেরুজ্যোতির উজ্জ্বল শিখা গু লি আকাশ থেকে নেমে এসে ছড়িয়ে পড়েছে নির্জন বরফ–ঢাকা প্রান্তরের বুকে, আর নানা বর্ণে রাঙিয়ে তুলেছে ভাসমান বরফ স্কুপের শিখরদেশ; প্রায় দুঃসহ ও ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্যে ভরা সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এতক্ষণে সে-দিবাস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে মেয়েটি তার সাধারণ জীবনের ইতিহাস আমাকে শোনাবার জন্য প্রস্তুত হল।
সে বরফের স্তূপটাকে আমরা সোফার মত ব্যবহার করেছি সেটার উপর সে আরাম করে বসল। আমিও শুনবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
মেয়েটি সুন্দরী। এইমাউদের দৃষ্টিকোণ থেকে কথাটা বলছি। অন্যরা হয় তো তাকে কিছুটা মোটা-সোটা ভাববে। তার বয়স ঠিক কুড়ি বছর; তার জাতির মধ্যে তাকেই সব চাইতে মনোহারিনী মেয়ে বলে মনে করা হয়। এখন এই খোলা জায়গাতে বেখাপ্পা ভারী লোমের কোট, ট্রাউজার, বট ও মস্ত বড় একটা টুপি পরা সত্ত্বেও তার মুখটা সত্যি সুন্দর। যে সমস্ত অতিথিকে তার বাবার খুপরি-ঘরে আসা-যাওয়া করতে দেখলাম তাদের মধ্যে কাউকেই তো তার সমকক্ষ বলা যায় না। তাই বলে সে কিন্তু বখে যায় নি। সে মিষ্টি, সরল, আন্তরিক: সে যে সুন্দরী সে কথা জানলেও তার আচার-আচরণে সেটা বাইরে প্রকাশ পায় না।
আজ এক সপ্তাহ ধরে সে আমার নিত্যসঙ্গী; তাকে যত দেখছি ততই ভাল লাগছে। মেরু অঞ্চলের পক্ষে প্রায় বিরল সুরুচিপূর্ণ। আবহাওয়ার মধ্যেই তাকে আদরে ও যত্নে মানুষ করা হয়েছে, কারণ তার বাবা তাকে তাদের জাতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ও এস্কুইমাউ সভ্যতার শীর্ষস্থানীয় লোক। বরফ–ঢাকা বিরাট প্রান্তরে কুকুর-টানা স্লেজ গাড়িতে চেপে লাস্কা-র (মেয়েটির নাম) সঙ্গে আমি অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি; তার সঙ্গ সব সময়ই সুখকর ও তার কথাবার্তা মনের মত লেগেছে। তার সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছি, কিন্তু তার বিপজ্জনক নৌকোতে চড়ি নিঃ বরফের উপর দিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছি, আর তার মারাত্মক রকমের স্থিরলক্ষ্য বর্শার আঘাতে শিকারকে আঘাত করতে দেখেছি। তার সঙ্গে সিলমাছ ধরতেও গিয়েছি। একবার সে যখন ভালুক শিকারে গিয়েছিল তখন অনেকটা পথ তার সঙ্গে গিয়েছিলাম, কারণ মনে মনে আমি ভালুককে বড় ভয় করি।
যাই হোক, এতক্ষণে সে তার গল্প বলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সে যা বলল তার হল:
অন্য সব উপজাতিদের মতই আমাদের উপজাতির লোকরাও জমাট সমুদ্রের উপর দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতেই অভ্যস্ত; কিন্তু দুবছর আগে এই ঘুরে বেড়ানো আমার বাবার আর ভাল লাগল না; তাই জমাট বরফের চাঁই দিয়ে সে এই বন-বাড়িটা তৈরি করল–তাকিয়ে দেখুন, বাড়িটা সাত ফুট উঁচু এবং অন্য যে কোন বাড়ি থেকে তিন চার গুণ লম্বা-তাকিয়ে দেখুন, বাড়িটা সাত ফুট উঁচু এবং অন্য যে কোন বাড়ি থেকে তিন চার গুণ লম্বা-সেই থেকে আমরা এখানেই আছি। এই বাড়িটার জন্য তার খুব গর্ব আর সেটা খবুই সঙ্গত, কারণ ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন যে সাধারণ বাড়ি অপেক্ষা এ বাড়িটা অনেক বেশী সুন্দর ও সম্পূর্ণ। যদি খেয়াল না করে থাকেন তো অবশ্য করবেন, কারণ এ বাড়িতে আপনি এমন সব বিলাসব্যবস্থা দেখতে পাবেন যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, বাড়িটার ওই প্রান্তে ভোজনের সময় অতিথি ও বাড়ির লোকদের বসবার জন্য যে উঁচু বেদীটা করা। হয়েছে, যাকে আপনি বলেন বেঠকখানা সেটা এত বড় যে এ রকমটা আপনি আর কোন বাড়িতে দেখেন নি-তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ লাস্কা; সত্যি ঘরটা মস্ত বড়: যুক্তরাষ্ট্রের সব চাইতে ভাল বাড়িতেও এ রকমটা দেখা যায় না। এ কথা স্বীকার করায় তার চোখ দুটি গর্বে ও আনন্দে চকমক করে উঠল। সেটা লক্ষ্য করেই একটা ইঙ্গিত আমি পেয়ে গেলাম।
সে বলতে লাগল, আমিও ভেবেছিলাম, এটা দেখে আপনি অবাক হবেন। আর একটা জিনিস: ঘরে খুব পুরু করে লোমওয়ালা চামড়া। বিছানো-সিল, সামুদ্রিক ভোঁদড়, রূপোলি-ধূসর শেয়াল, ভালুক বেজী-সব রকম চামড়া প্রচুর পরিমাণে বিছানো; আর আপনারা যাকে বিছানা বলেন দেওয়াল বরাবর পাতা সেই সব বরফের ঘুমোবার বেঞ্চি গুলোতেও ঐ সব লোম বা চামড়া পুরু করে পাতা। আপনাদের বাড়ির বেদী ও ঘুমোবার বেঞ্চি কি এর চাইতে ভালভাবে সাজানো থাকে?
না লাস্কা, তা থাকেন না। এ কথা শুনে সে খুসি হল। তার রুচি বান বাবার হেপাজতে কতগুলো চামড়া আছে সেই কথাই সে শুধু ভাবছিল, তার দামের কথা সে মোটেই ভাবে নি। আমি বলতে পারতাম যে আমাদের দেশে ঐ ধরনের লোমশ চামড়ার অনেক দাম, কিন্তু সে কথা সে বুঝতে পারত না, কারণ ওরা এসব জিনিসকে মূল্যবান সম্পত্তি হিসাবে দেখে না। আমি তাকে বলতে পারতাম, সে পোশাক সে পরেছে, অথবা তার চার পাশের অতি সাধারণ মানুষরাও প্রাত্যহিক জীবনে যে পোশাক পরে, তার দাম বারো শ থেকে পনেরো শ ডলার; বলতে পারতাম, আমাদের দেশে এ রকম কোন লোককে আমি চিনি না যে বারো শ ডলার দামের পোশাক পরে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু সে কথাও সে বুঝতে পারত না; কাজেই আমি কোন কথাই বললাম না। সেই আবার কথা শুরু করল:
তারপর ধরুন হাত-মুখ ধোবার ময়লা জলের টব। আমাদের বৈঠকখানায় আছে দুটো টব, আর সারা বাড়িতে আছে আরও দুটো। বৈঠকখানায় দুটো কদাচিৎ দেখা যায়। আপনাদের দেশে কি দুটো থাকে?
টুবগুলোর কথা মনে পড়তেই আমার গলা আট কে এল। সে অবস্থা সামলে নিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বললাম, দেখা লাস্কা, দেশের নিন্দা করাটা লজ্জার কথা; তোমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলছি; তাই বলে সেটাকে আর বাড়িও না। তবে এ কথা ঠিক জেনো যে নিউ ইয়র্ক শহরের সব চাইতে ধনীলোকের বসবার ঘরেও দুটো ট ব থাকে না।
নির্দোষ আনন্দে সে হাততালি দিয়ে উঠল; বলল, ওহো, এটা নিশ্চয় আপনার মনের কথা নয়; হতেই পারে না।
কিন্তু আমি সত্য কথাই বলছি সোনা। এই তো ভাণ্ডারবিল্ট আছেন। ভাণ্ডারবিল্ট সারা পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে ধনবান লোক। অথচ তাঁর বসবার ঘরেও দুটো টব থাকে না। তা কেন, সেখানে একটাও নেই। এ কথা যদি সত্য না হয় তাহলে যেন আমার মরণ হয়।
তার সুন্দর চোখ দুটি বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে কণ্ঠ স্বরে একটু ভয়ের ছোঁয়াচ লাগিয়ে সে বলল:
কী আশ্চর্য-কী অবিশ্বাস্য-ঠিক বোঝাই যায় না। লোকটি কি কৃপণ?
না-তাও নয়। খরচের জন্য তিনি চিন্তাই করেন না, তবে-কি জান-এটা কিছুটা টাকার গরম বলে মনে হতে পারে। হ্যাঁ, ব্যাপারটা তাই; তিনি সরল সাদাসিধে মানুষ, জাঁকজমক দেখানোটা পছন্দ করেন না।
লাস্কা বলল, তা-বিনয় খুবই ভাল জিনিস; তবে বাড়াবাড়ি ভাল নয়; তা ছাড়া ঘরটা কেমন দেখাবে সেটাও তো ভাবতে হবে।
তা, ঘরটা অবশ্যই ফাঁকা-ফাঁকা ও অসম্পূর্ণ মনে হবে, কিন্তু-
আমারও তাই মনে হয়! এ রকমটা কখনও শুনি নি। অন্য সব দিক থেকে দেখলে বাড়িটা কি বেশ সুন্দর?
হ্যাঁ, খুবই সুন্দর।
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একটা মোমবাতি দাঁতে কাটতে কাটতে স্বাচ্ছন্নের মত বসে রইল; মনে হল ব্যাপারটাকে পুরোপুরি বুঝতে চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত মাথাটাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল:
দেখুন, আমার মনে হয় এক ধরনের বিনয় আছে যেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে সেটাই লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একটা লোক যখন তার বৈঠকখানায় দুটো টব রাখতে পারে তখন যদি সে একটাও না রাখে, তাহলে সেটা তার সত্যিকারের বিনয়ের প্রকাশও হতে পারে, কিন্তু তার চাইতে একশগুণ বেশী সম্ভাবনা হল সে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছে। আমার বিচারে আপনার মিঃ ভাণ্ডারবিল্ট ভালই জানেন তিনি এর কোষ্টা চাইছেন।
তার ধারণাটা সংশোধন করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোন ফল হল না। সে আবার বলল:
আপনাদের ধনী লোকদের কি আমাদের মত চওড়া বরফের চাই দিয়ে তৈরি এমন সুন্দর শোবার বেঞ্চি আছে?
দেখ, বেশ ভাল ভাল বিছানাই তাদের আছে, তবে সেগুলো বরফের চাই দিয়ে বানানো নয়।
সেটাই তো জানতে চাই! বরফ দিয়ে তৈরি নয় কেন?
অসুবিধার কথাগুলি বললাম। বরফের দামেরও উল্লেখ করলাম। শুনে সে চেঁচিয়ে উঠল:
বলেন কি? আপনারা বরফ কেনেন?
নিশ্চয় সোনা।
নির্দোষ হাসিতে ফেটে পড়ে সে বলল:
এ রকম অর্থহীন কথা আগে কখনও শুনি নি! আমাদের এখানে তো প্রচুর বরফ–বরফের কোন দামই নেই। যতদূর চোখ যায় মাইলের পর মাইল শুধু বরফ আর বরফ। এই সবটা বরফের বিনিময়ে একটা মাছের ফুসফুস দিতেও তো আমি রাজী নই।
তার কারণ মফস্বলের সরল মানুষ তোমরা বরফের মূল্য বোঝ না। মধ্য গ্রীষ্মের নিউ উয়র্ক-এ যদি এ বরফ তোমার হাতে থাকে তো তা দিয়ে তুমি বাজারের সব তিমি মাছ কিনে নিতে পার।
সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল:
সত্যি বলছেন?
সম্পূর্ণ সত্যি। দিব্যি করে বলতে পারি।
সে খুব ভাবনায় পড়ে গেল। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল:
আহা, সেখানে গিয়ে যদি থাকতে পারতাম!
আমি বললাম, কিন্তু সেখানে থাকলে তো তুমি তিমির মাংস খেতে চাইতে না।
কি বললেন?
সত্যি তারা কেউ খায় না।
কেন খায় না?
মানে-তা-তা ঠিক জানি না। হয় তো কোন সংর। হ্যাঁ, তাই-শুধুই সংর। হয় তা কোন এক সময় কোন না কোন কারণে কেউ এটা খেত না, আর তুমি তো জান এ রকম একটা খেয়াল একবার চালু হলে সেটা আর কোন দিন বন্ধ হল না।
মেয়েটি চিন্তিতভাবে বলল, এটা ঠিক-সম্পূর্ণ ঠিক কথা। এখানে যেমন আমাদের সংস্কার আছে সাবানের বিরুদ্ধে।
সত্যি সত্যিই কথাটা সে মন থেকে বলছে কিনা বুঝবার জন্য তার দিকে তাকালাম। না, আন্তরিকভাবেই সে কথাটা বলেছে। একটু ইতস্তত করে বেশ সাবধানে বললাম:
মাফ কর। সত্যি কি সাবান সম্পর্কে তোমার কোন সংস্কার আছে? মানে কোন দিন ছিল কি?
হ্যাঁ-কিন্তু সেটা গোড়ায়; কেউ এটা খেত না।
ওঃ-বুঝেছি। আগে ঠিক ধরতে পারি নি।
সে বলতে লাগল।
সংস্কার আর কি। প্রথম যখন বিদেশীদের কাছ থেকে এখানে সাবান এল, কেউ তা পছন্দ করত না; কিন্তু ক্রমে সেটাই যখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াল, তখন সকলেই পছন্দ করতে লাগল; আর এখন তো ক্ষমতায় কুলোলেই লোকে সেটা রাখে। আপনার বুঝি খুব পছন্দ?
দারুণ। বিশেষ করে এখানে ওটা না পেলে তো আমি মরে যেতাম। তুমি পছন্দ কর?
আমি তো ওর জন্য পাগল! আপনি মোমবাতি পছন্দ করেন?
ওটাকে তো অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। তোমার খুব পছন্দ বুঝি?
তার চোখে দুটো নেচে উঠল। জোর গলায় বলে উঠল;
আঃ! বলবেন না! মোমবাতি!-আর সাবান!-
আর মাছের নাড়িভুড়ি-
আর ট্রেনের তেল!
আর গলা বরফ!-
আর তিমির তেল!-
আর পচা মাংস! মৌমাছির মোম! আলকাতরা! আর তাপিন! আর ঝোলা গুড়! আর-
বলবেন না-বলবেন না-খুসিতে আমি মরে যাব!
তাহলে একটা বরফের বালতিতে এ সব কিছু ভরে নাও, প্রতিবেশীদের নেমন্তন্ন কর, তারপর পাল তুলে দাও!
কিন্তু এত বড় একটি আদর্শ ভোজের স্বপ্ন মেয়েটি সহ্য করতে পারল না, মূর্ছা গেল। আহা বেচারি। মুখে বরফ ঘসে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনলাম। ধীরে ধীরে তার উত্তেজনা শান্ত হয়ে এল। ক্রমে ক্রমে আবার তার কাহিনী শুরু করল:
যা হোক, এই সুন্দর বাড়িটাতে আমার বাস করতে লাগলাম। আমি কিন্তু সুখী হলাম না। তার কারণ হল: ভালবাসার জন্যই আমার জন্ম; ভালবাসা ছাড়া আমি সত্যিকারের সুখ পাই না। আমি চাই, আমার জন্যই কেউ আমাকে ভালবাসুক। আমি চাইলাম একটি প্রাণের দেবতা, চাইলাম সেই দেবতার দেবী হয়ে থাকতে; পারস্পরিক পূজা ছাড়া আমার মন খুসি হবে না। প্রেমিক ছিল প্রচুর-আসলে অতিমাত্রায় প্রচুর-কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি মারাত্মক ক্রটি ছিল; আগে হোক পরে হোক, সে ত্রুটি আমি ধরে ফেলতাম-কেউ সেটা চেপে রাখতে পারে নি-তারা আমাকে চাইত না, চাইত আমার সম্পত্তি।
তোমার সম্পত্তি?
হ্যাঁ, এই জাতির মধ্যে, এমন কি এই অঞ্চলের যে কোন জাতির মধ্যেই আমার বাবা সব চাইতে ধনী লোক।
তার বাবার সম্পত্তিটা কি ভেবে অবাক হলাম। এই বাড়িটা হতে পারে না-কারণ এ রকম আর একটা বাড়ি তো যে কেউ বানাতে পারে। এটা লোমের চামড়া হতে পারে না-এখানে তার কোন মূল্যই নেই। স্লেজ, কুকুর, হারপুন, নৌকো, হাড়ের বড়শি ও সুচ–না, এ সবও সম্পত্তি নয়। তাহলে কি সেই বস্তু যা এই লোকটিকে এত ধনী করেছে, আর যার টানে এই প্রেমিকের দল এ বাড়িতে এসে ভিড় জমিয়েছে? শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, কথাটা জিজ্ঞাসা করি। তাই করলাম। মেয়েটি ভয়ানক খুসি হয়ে উঠল। আমার আরও কাছে ঘেঁসে সে বলল:
ভাবুন তো তার কত সম্পত্তি আছে-পারবেন না!
অনেক ভেবেচিন্তেও আমি যখন কোন কূল-কিনারা করতে পারলাম না, তখন আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে সে বলল:
বাইশটি মাছ-মারা বড়শি-হাড়ের নয়, বিদেশী-খাঁটি লোহার তৈরি!
তারপরই সে নাটকীয়ভাবে পিছনে সরে গিয়ে তার কথার ফলাফল লক্ষ্য করতে লাগল। সে যাতে হতাশ না হয় সে জন্য আমি সাধ্যমত চেষ্টা করলাম।
বিবর্ণ মুখে বলে উঠলাম;
মহান স্কট! বল কি!
ঠিক আপনি যেমন সত্যি মিঃ টোয়েন, এ কথাও তেমনই সত্যি!
লাস্কা, তুমি আমাকে ঠ কাচ্ছ-এটা তোমার আসল কথা নয়।
সে ভয় পেল। বিচলিত বোধ করল। বলল:
মিঃ টোয়েন, এর প্রতিটি কথা সত্য-প্রতিটি কথা। বিশ্বাস করুন-বিশ্বাস করলেন তো? বলুন না, বিশ্বাস করেছেন!
আমি-মানে, হ্যাঁ, বিশ্বাস করেছি-করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি এত হঠাৎ কথাটা বলেছে। এ রকম কথা এভাবে হঠাৎ বলা উচিত। নয়। তাতে-
ওহো, আমি দুঃখিত! ভেবেছিলাম-
তা তো ঠিকই। তুমি তো ছেলেমানুষ, অত কথা বুঝতে পার নি। তাছাড়া, এর ফলাফল কি হতে পারে তাও তুমি আগে থেকে বুঝতে পার নি।
না, না, সত্যি, আমার বোঝা উচিত ছিল।
দেখ লাস্কা, তুমি যদি প্রথমে বলতে পাঁচ টা কি ছটা বড়শি, আর তারপর ধীরে ধীরে-
বুঝেছি, বুঝেছি-তারপর ধীরে ধীরে একটা, দুটো, তিনটে করে যোগ করতাম, আর তার পরে-আসলে কথাটা আমি ভাবিই নি।
কিছু মনে করো না মেয়ে, ঠিক আছে-এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি-একটু পরেই এ ভাবটা কেটে যাবে। কিন্তু একটি অপ্রস্তুত ও দুর্বল মানুষের ঘাড়ে হঠাৎ একেবারে বাইশটার বোঝা-
আহা, সত্যি অপরাধ হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করুন-বলুন ক্ষমা করেছেন। বলুন!
তার কাছ থেকে অনেক অনুনয়-বিনয়, অনেক অনুরোধ-উপরোধ আদায় করে তবে তাকে ক্ষমা করলাম, আর সেও খুসি হয়ে আবার তার কাহিনী বলতে শুরু করল। কথা প্রসঙ্গেই বুঝতে পারলাম, তাদের পারিবারিক সম্পদের মধ্যে আরও একটা বস্তু আছে-কোন রকমের একটা মণি-মুক্তোই হবে হয় তা; কিন্তু পাছে আবার আমি মূৰ্ছা-টুর্ছা যাই সেই ভয়ে বলি-বলি করেও সে কথাটা বলতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু আমি পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম, তাকে বোঝাতে লাগলাম যে এবার তৈরিই আছি, তাই এবার আর বড় রকমের ধাক্কা খাব না। তখন সে স্বীকার করল যে সেই মূল্যবান বস্তুটি তার সঙ্গেই আছে, এবং আমার মুখের দিকে সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রেখে বুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে একটা দোমড়ানো চৌকো পেতলের চাকতি বের করে আমাকে দেখাল। তাই না দেখে আমি মূৰ্ছিত হবার ভান করে তার শরীরের উপর ঢলে পড়লাম; এতে সে যুগপৎ খুসিও হল, আবার ভয়ও পেল। মূর্ছা ভেঙে আমি একটু সুস্থ হলে সে জানতে চাইল, জিনিসটা সম্পর্কে আমার কি ধারণা।
এটার বিষয়ে আমার কি ধারণা? আমি তো মনে করি, আজ পর্যন্ত যত জিনিস আমি দেখেছি এটাই তার মধ্যে সব চাইতে সুন্দর।
সত্যি নাকি? আপনার কথা শুনে কী ভাল যে লাগছে! এটা তো একটা পরম আদরের বস্তু, তাই নয় কি?
তা তো বটেই। আমি হলে বিষুবরেখার বদলে ও এটা চাইতাম।
সে বলল, আমি জানতাম এটা আপনার ভাল লাগবে। সত্যি, জিনিসটা কী সুন্দর। এ অঞ্চলে এ রকম জিনিস আর একটাও নেই। সুদূর মেরু সাগর থেকে অনেক পথ পেরিয়ে লোকে এটা দেখতে এসেছে। আপনি আর কখনও এ রকম জিনিস দেখেছেন?
বললাম, না, এই প্রথম দেখলাম। এই ডাহা মিথ্যে কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হল, কারণ এ জিনিস আমি লাখ লাখ দেখেছি; তার এই মূল্যবান মানিকটি নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল রেল-এর মাল চিহ্নিত করার একটা পিতলের চাকতি মাত্র।
মুখে বললাম, কী আশ্চর্য! একাকী, কোন রক্ষী সঙ্গে নেই, একটা কুকুর পর্যন্ত না, আর তুমি এই জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘুরছ?
স্-স্, চেঁচাবেন না, সে বলল। এটা যে আমার সঙ্গে আছে তা কেউ জানে না। সকলে মনে করে, বাবার রত্ন-ভাণ্ডারেই এটা আছে। সাধারণত সেখানেই তো থাকবার কথা।
রত্ন-ভাণ্ডারটা কোথায়?
প্রশ্নটা বড়ই বোকার মত করে ফেলেছি। তাকে দেখে কিছুটা বিচলিত, কিছুটা সন্দিগ্ধ মনে হল। কিন্তু আমি বললাম:
আরে না, আমাকে ভয় করো না। আমাদের দেশে সাত কোটি মানুষের বাস, তবু-আমার কথা বিশ্বাস করো-তাদের মধ্যে এমন একজনকেও খুঁজে পাবে না যে অগণিত সংখ্যক বড়শির ব্যাপারেও আমাকে বিশ্বাস না করে।
এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে সে আমাকে বাড়ির রত্ন-ভাণ্ডারের কথা বলে দিল। বড়শিগুলো সেখানেই রাখা আছে। তখন আমিও তার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে উঠলাম।
আহা, লাস্কা, তুমি বড়ই ভাগ্যবতী!-এই সুন্দর বাড়ি, এই সুদৃশ্য মানিক, ঐ মূল্যবান সম্পদ, এমন সুন্দর শোভন বরফ, প্রচুর ভাসমান বরফ সুপ, সীমাহীন অনুর্বর প্রান্তর, কত ভালুক ও সিন্ধুঘোটক, কত স্বাধীনতা ও মুক্তি, সকলের সপ্রশংস দৃষ্টি, না চাইতেই সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মান তোমার অপেক্ষায়; যুবতী, ধনবতী, সুন্দরী, সকলের বাঞ্ছি তা, সকলের আকাঙিক্ষতা, সকলের ঈর্ষার পাত্রী; তোমার কোন প্রয়োজন অপূর্ণ নেই, কোন বাসনা অতৃপ্ত নেই, এমন কিছু নেই যা তুমি কিন্তু আর কারও সম্পর্কেই যথার্থভাবে এই কথাগুলি বলা চলে না। আর তুমি-তুমিই যে এ সব কথার উপযুক্ত পাত্রী লাস্কা-অ আমি অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করি।
আমার কথা শুনে তার গর্বের শেষ নেই, সুখের অবধি নেই। বার বার সে আমাকে শেষের কথাগুলির জন্য ধন্যবাদ জানাল। তারপর বলতে লাগল:
তবু, সবটাই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন নয়-মেঘের ছায়াও আছে। সম্পত্তির বোঝা আমাকে চেপে ধরেছে। অনেক সময়ই মনে হয়েছে, এর চাইতে বুঝি গরীব হওয়াই ভাল ছিল-অন্তত এত অত্যধিক ধনী কোন মতেই নয়। প্রতিবেশী উপজাতীয় লোকেরা যেতে যেতে হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে; মাঝে মাঝে সসমে বলে, দেখ-ঐ যে সে-লাখপতির মেয়ে! আবার কখনও সখেদে বলে, সে বড়শির। মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর আমার-আমার একটাও নেই! এ সব দেখলে, এ সব কথা শুনলে বড় খারাপ লাগে। আমার শিশু কালে আমরা গরীব ছিলাম, তখন আমরা ইচ্ছা হলে দরজা খুলে রেখেও শুতে পারতাম, কিন্তু এখন-এখন আমাদের একজন রাতের পাহারাওলা রাখতে হয়েছে। সেকালে আমার বাবা সকালে প্রতিই সদয় ও ভদ্র ছিল; কিন্তু এখন সে গম্ভীর হয়েছে, উদ্ধত হয়েছে; সকলের সঙ্গে মেলামেশাও করতে পারে না। একসময় পরিবারই ছিল তার একমাত্র চিন্তা, কিন্তু দুঃখের কথা না বলাই ভাল। আগেই তো বলেছি, আমার জন্যই কেউ আমাকে ভালবাসুক এই ছিল আমার স্বপ্ন।
অবশেষে সেই স্বপ্ন সফল হবার লগ্ন এল। একদা একটি অপরিচিত লোক এল তার নাম কালুলা। আমার নাম বলতেই সে বলল, সে আমাকে ভালবাসে। কৃতজ্ঞতায় ও আনন্দে আমার অন্তর লাফিয়ে উঠল, কারণ প্রথম দর্শনেই তাকে আমি ভালবেসেছিলাম। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, এই মুহূর্তের চাইতে অধিকতর সুখী হতে সে চায় না। বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেক দূরে চলে গেলাম, দুজনে দুজনের কথা বললাম আর শুনলাম, আর মধুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে লাগলাম! অবশেষে শান্ত হয়ে কথা থামিয়ে খেতে বসলাম। তার সঙ্গে ছিল সাবান আর মোমবাতি, আমার সঙ্গে ছিল বরফ। ক্ষিধেও খুব পেয়েছিল। এমন ভাল খাবার আর কখনও খাই নি।
সে যে উপজাতির মানুষ তাদের বাস উত্তর দিকে অনেক দূরে। যখন শুনলাম যে আমার বাবার নাম কখনও শোনে নি তখন আমার খুব ফুর্তি হল। আমি বলতে চাই, সে তখন একজন লাখপতির কথা শুনেছে, কিন্তু তার নামটা শোনে নি-কাজেই বুঝতেই তো পারছেন-আমিই যে বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী সে কথা সে তখনও জানত না। নিশ্চয় জানবেন, আমিও তাকে সে কথা জানাবই না। শেষ পর্যন্ত একজন আমার জন্যই আমাকে ভালবেসেছে, আর তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তখন আমি যে কত সুখী-সে আপনি ভাবতেও পারবেন না!
ইতিমধ্যে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই সে অবাক হয়ে গেল; চেঁচিয়ে বলল:
কী চমৎকার! ওটাই কি তোমার বাবার বাড়ি?।
তার কথার সেই সুর, তার চোখের সেই সপ্রশংস দৃষ্টি আমাকে ব্যথিত করল, কিন্তু সে ভাব শীঘ্রই দূর হয়ে গেল, কারণ আমি তো তাকে বড়ই ভালবেসেছিলাম, আর সে ছিল কত সুন্দর আর উদার। আমার পরিবারের কাকীমারা, কাকারা, ভাই-বোনেরা সকলেই তাকে নিয়ে খুব খুসি হল, অনেক অতিথিকে ডাকা হল, তারপর দরজা বন্ধ করে সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল; সব কিছু যখন বেশ গরম আর আরামদায়ক হয়ে উঠল তখন আমার বাকদান অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে একটা সুন্দর ভোজের আয়োজন করা হল।
ভোজ-পর্ব সমাধা হতেই অহংকার আমার বাবাকে পেয়ে বসল; কালুলা হঠাৎ কী সৌভাগ্যের অধিকারী হতে চলেছে সে কথা তাকে বোঝাবার জন্য বাবা তার সব সম্পত্তি কালুলাকে দেখাবার লোভ সম্বরণ করতে পারল না-বিশেষ করে এই গরীব মানুষটির বিস্ময়টুকু বাবা উপভোগ করতে চাইল। আমি চেঁচিয়ে বাধা দিতে পারতাম,-কিন্তু বাবাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। তাই কোন কথা না বলে বসে বসে যন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলাম।
সকলের চোখের সামনেই বাবা সোজা সেই গুপ্তস্থানে ঢুকে গেল এবং বড়শিগুলো বের করে এনে এমনভাবে আমার মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল যে সেগুলো মঞ্চের উপরে আমার প্রেমিকের হাঁটুর কাছে ছড়িয়ে পড়ে চক্ চক্ করতে লাগল।
এটা ঠিক যে এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখে সে গরীব বেচারির দম বন্ধ হবার উপক্রম। বোকার মত বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে সে শুধু ভাবতে লাগল, একটি মানুষের এত অবিশ্বাস্য রকমের সম্পদ কী করে থাকতে পারে। তার পরেই উজ্জ্বল চোখ তুলে সে চেঁচিয়ে। বলে উঠল:
ও হো, তাহলে আপনিই সেই বিখ্যাত লাখপতি!
আমার বাবা ও অন্য সকলেই খুসিতে হো-হো করে হেসে উঠল। কিন্তু জিনিসগুলো যেন নেহাৎই খোলামকুচি এমনই অযত্নের সঙ্গে বাবা যখন তার সম্পত্তিগুলো কুড়িয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিল তখন বেচারি কালুলার অবাক হওয়াটা একটা দেখবার মত দৃশ্যই বটে। সে বলল:
এও কি সম্ভব যে না শু নেই আপনি এ রকম বস্তু তুলে রাখলেন?
আমার বাবা সগর্ব অট্টহাসি হেসে বলল:
বটে ই তো, দুএকটা বড়শিই যখন তোমার চোখে এত বড় মনে হচ্ছে তাতেই বোঝা যায় তুমি কোন দিন ধনী ছিল না।
কালুলা বিমূঢ়ভাবে মাথা নীচু করে বলল: সত্যি বলেছেন স্যার, ঐ সব বহুমূল্য বস্তুর একটা আঁকড়ির মত দামী জিনিসও কোন দিন আমার ছিল না, আর আজ পর্যন্ত এমন কোন লোককেও আমি দেখি নি যার ধন-দৌলত এক বেশী যে সেগুলো গুণবার প্রয়োজন সে বোধ করে না, কারণ আজ পর্যন্ত সব চাইতে ধনীলোক যাকে আমি দেখেছি তার সম্পত্তি বলতে শুধু তিনটি বড়শি।
আমার নির্বোধ বাবা পুনরায় উল্লসিত আনন্দে ফেটে পড়ল; এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন বড়শিগুলো গোণার বা সেগুলোর উপর কড়া নজর রাখার অভ্যাস তার নেই। আসলে তার সব ভাবটাই লোক দেখানো। আর বড়শিগুলো গোণার ব্যাপার? আসলে বাবা তো প্রতিদিনই একবার করে গোণে।
আমার প্রিয়তমের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়েছিল ভোরে; তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম ঠিক যখন অন্ধকার হয়-হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল ভোজের উৎসবে; অবশেষে অতিথিরা একে একে চলে গেল, আর আমরা বাকিরা দেয়াল বরাবর পাতা ঘুমোবার বেঞ্চি গুলোতে যার যার মত শুয়ে পড়লাম। দেখতে দেখতে সকলেই স্বপ্নের মধ্যে ডুবে গেল। শুধু আমি ছাড়া। সুখে ও উত্তেজনায় আমার ঘুম এল না। অনেক-অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরে দেখতে পেলাম, একটা আবছা মূর্তি আমার পাশ দিয়ে গিয়ে বাড়িটার একেবারে শেষ প্রান্তে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সে যে কে, পুরুষ বা নারী, কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণের। মধ্যেই সেই মূর্তিটি, অথবা অন্য কোন মূর্তিও হতে পারে, আমার পাশ দিয়েই উল্টো দিকে চলে গেল। ভাবলাম, এ সবের অর্থ কি, কিন্তু ভেবে কোন ফল হল না; ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না; কিন্তু হঠাৎ পুরোপুরি ঘুম ভাঙতেই শুনলাম আমার বাবা তারস্বরে বলছে: মহান তুষার-দেবতার দিব্যি, একটা বড়শি চুরি গেছে। কে যেন বলে দিল, এটাই আমার দুঃখের সূচনা, আর আমার শিরায়-শিরায় রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল। এই অমঙ্গলের পূর্বাভাষ দৃঢ়তর হল যখন বাবা চীৎকার করে বলল, যে যেখানে আছ জাগো, অপরিচিতকে পাকড়াও কর! তারপরই চরিদিকে শুরু হয়ে গেল চীৎকার, হৈ-হল্লা, আর অভিশাপ। অন্ধকারের মধ্যে নানা আবছা মূর্তির ছুটাছুটি। প্রিয়তমকে সাহায্য করতে ছুটে গেলাম, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত মোচড়ানো ছাড়া আর কি আমি করতে পারি?-একটা মানুষের দেয়াল তখন। তাকে আমার কাছ থেকে বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছে? তার হাত-পা শক্ত করে বাঁধছে। ভাল ভাবে বাঁধা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাকে তার কাছে যেতে দেবে না। বেচারির অপমানিত দেহের উপর আছড়ে পড়লাম; তার বুকের উপর পড়ে আমার সব কান্নাকে উজাড় করে দিলাম। ওদিকে বাবা ও পরিবারের জন্য সকলে আমার নিন্দা করতে লাগল। আর তাকে বার বার ভয় দেখাতে লাগল ও লজ্জাজনক ভাষায় গালাগালি করতে লাগল। শান্ত মর্যাদার সঙ্গে সব কিছু সে সহ্য করল; তাতেই সে আমার কাছে প্রিয়তর হয়ে উঠল; তার জন্য তারই সঙ্গে নির্যাতন ভোগ করতে আমার সুখের ও গর্বের আর সীমা রইল না। বাবা হুকুম দিল, এখনই প্রধানদের সভা ডাকা হোক যাতে তারা আমার কালুলার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করতে পারে।
আমি বললাম, সে কি? হারানো বড়শির জন্য তালাসী না করেই বিচার হবে?
হারানো বড়শি! সকলে বিদ্রুপের স্বরে হেসে উঠল; আমার বাবা ঠাট্টা করে আরও বলল, সকলে সরে এস; ভাল করে তাকিয়ে দেখ-মেয়ে আমার হারানো বড়শি খুঁজতে যাচ্ছে; আরে, খুঁজে যে পাবেই তাতে আর সন্দেহ কি! সকলে আবার হেসে উঠল।
আমি বিচলিত হলাম না-আমার মনে কোন রকম ভয় ছিল না। বললাম, এখন তোমরা হাস, তোমাদেরই হাসার পালা। কিন্তু আমাদের পালাও আসছে। অপেক্ষা কর, দেখতে পাবে।
একটা মশাল হাতে নিলাম। ভেবেছিলাম, এক মুহূর্তের মধ্যেই জিনিসটা পেয়ে যাব; তাই এক ভরসা নিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম যে উপস্থিত সকলে খুব গম্ভীর হয়ে গেল; হয় তো তারাও ভাবতে লাগল যে বড় বেশী তাড়াতাড়ি তারা সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু, হায়রে হায়!–সে খোঁজের কী তিক্ত অভিজ্ঞতা! আঙুলে দশ থেকে বারো গুণতে যতটা সময় লাগে ততক্ষণ সকলেই একেবারে চুপচাপ; তারপর থেকেই আমি যেন ডুবে যেতে লাগলাম; চারদিকে ঠাট্টার রোল উঠল; সে ঠাট্টা উচ্চ থেকে উচ্চতর, নিশ্চিত থেকে নিশ্চিততর হতে লাগল; এবং শেষ পর্যন্ত আমি যখন খোঁজ করা ছেড়ে দিলাম, তখন সকলে নিষ্ঠুর হাসির দমকে বারবার ফেটে পড়তে লাগল।
আমার তখনকার সেই যন্ত্রণার কথা কেউ কোন দিন জানবে না। কিন্তু প্রেমই ছিল আমার ভরসা ও শক্তি কালুলার পাশে দিয়ে আমার যোগ্যস্থানে দাঁড়ালাম; তার গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললাম:
তুমি নির্দোষ প্রাণাধিক-আমি তো জানি; কিন্তু আমার সান্ত্বনার জন্য নিজের মুখে সে কথা আমাকে বল; তাহলেই ভাগ্যে যা আছে সব আমি সইতে পারব।
সে জবাব দিল;
এই মুহূর্তে আমি মৃত্যুর তীরে এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে আমি নির্দোষ। হে আহত হৃয়, তাই জেনে তুমি সান্ত্বনা লাভ কর, শান্ত হও। তুমি আমার নাকের নিঃশ্বাস, জীবনের জীবন!
এবার তাহলে প্রধানরা আসুক!-আমি কথাগুলি বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে বরফের উপর মচ মচ শব্দ শোনা গেল, আর পর মুহূর্তেই দরজায় দেখা দিল অবনতদেহ একসারি মুর্তি-প্রবীণের দল।
আমার বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্দীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করল এবং রাতের সব ঘটনা বিবৃত করল। সে আরও বলল, পাহারাওলা দরজার বাইরেই ছিল, আর বাড়ির ভিতর পরিবারের লোকরা ও অপরিচিত লোকটি ছাড়া আর কেউ ছিল না। পরিবারের লোকরা কি তাদের নিজের সম্পত্তি চুরি করবে?
বাবা থামল। প্রবীণরা কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে রইল। শেষ পর্যন্ত একের পর এক প্রতিবেশীকে বলল, অপরিচিত লোকটির। উপরেই তো সন্দেহটা পড়ে-কথাগুলি আমার কানে বড়ই কষ্টদায়ক শোনাল। তখন আমার বাবা বসল। হায়, দুর্ভাগিনী আমি! সেই মুহূর্তে আমার প্রিয়তমের নির্দোষিতা আমি প্রমাণ করতে পারতাম, কিন্তু আমি তা জানতাম না!
বিচার-সভার প্রধান জিজ্ঞাসা করল:
বন্দীর পক্ষ সমর্থন করবার মত কেউ কি এখানে আছে?
আমি দাঁড়িয়ে বললাম:
কেন সে ঐ বড়শিটা, বা অন্য যে কোন বড়শি, বা সবগুলো বড়শি চুরি করবে? একদিন পরেই তো সে সব কিছুর মালিক হত!
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। চারদিককার অনেক মানুষের নিঃশ্বাসের বাষ্প যেন কুয়াসার মত আমাকে ঘিরে ফেলল। অবশেষে একের পর এক প্রবীণরা বারকয়েক ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই মেয়েটির কথার মধ্যেও যুক্তি আছে। আঃ, আমার বুকটা যেন ভরে উঠল!-কী পষ্ট অথচ মূল্যবান কথা। আমি বসে পড়লাম।
বিচার-সভার প্রধান বলল, যদি কারও কিছু বলার থাকে, এই বেলা বলুন; পরে যেন গোলমাল করবেন না।
আমার বাবা উঠে বললঃ
রাতের অন্ধকারে একটি মূর্তি আমার পাশ দিয়ে রত্ন-ভাণ্ডারের দিকে গিয়েছিল ও একটু পরেই ফিরে এসেছিল। আমি মনে করি, সে এই অপরিচিত।
ওঃ, আমার তখন মূৰ্ছা যাবার মত অবস্থা! আমি ভেবেছিলাম, এ গোপনে কথা শুধু আমিই জানতাম। মহান তুষার-দেবতাও আমার মনের এ কথা টেনে বের করতে পারত না।
বিচার-সভার প্রধান কঠোর স্বরে বেচারি কালুলাকে বলল:
কথা বল!
কালুলা প্রথমে ইতস্তত করে পরে বলল:
সে আমি। সুন্দর বড়শিগুলোর চিন্তায় আমর ঘুম আসছিল না। আমি সেখানে গেলাম, মনকে শান্ত করে নির্দোষ আনন্দে তাকে ভরে তুলতে সেগুলোকে চুমো খেলাম, আদর করলাম, এবং তারপর যথাস্থানে রেখে দিলাম। সেই সময় একটা পড়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আমি একটাও চুরি করি নি।
ওঃ, এই পরিস্থিতিতে এ রকম স্বীকৃতি যে মারাত্মক! সকলেই ভয়ংকর চুপচাপ। আমি জানতাম, নিজমুখে সে নিজের মৃত্যুদণ্ড উচ্চারণ করেছে; সব শেষ হয়ে গেছে। প্রতিটি মুখের উপর যেন এই কথা গুলিই স্পষ্টাক্ষরে ফুটে উঠেছে: এই তো স্বীকারোক্তি!-নগন্য, পঙ্গু ও অশক্ত।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে গম্ভীর কথাগুলো কানে এল; আসবে তা তো জানতামই; প্রতিটি শব্দ যেন ছুরির মত আমার বুকের মধ্যে কেটে বসে গেল:
বিচার-সভার এই হুকুম যে অপরাধীকে জলে ফেলে বিচার করা হোক।
হায়, মানুষ এই জলে ফেলে বিচারের প্রথা আমাদের দেশে চালু করেছিল তার মাথায় অভিশাপ নেমে আসুক! কেউ জানে না কোথায় সেই সুদূর দেশ যেখান থেকে যুগ যুগ আগে এ প্রথা এদেশে এসেছিল। তার আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভবিষ্যদ্বাণী এবং অন্য কোন অনিশ্চিত বিচার-ব্যবস্থার আশ্রয় নিত, আর তার ফলে কখনও কখনও কিছু কিছু নির্দোষ মানুষ প্রাণে বেঁচে ও যেত; কিন্তু এই জলে ডুবিয়ে বিচারের প্রথা আমাদের মত অশিক্ষিত বর্বরদের চাইতে বিজ্ঞতর কোন মানুষের মাথা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় যে নির্দোষ তার নির্দোষিতা নিঃসন্দেহে তর্কাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়, কারণ তারা জলে ডুবে যায়, আর যারা দোষী তাদের দোষও। নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, কারণ তারা জলে ডোবে না। আমার বুকের ভিতরটা ভেঙে যাচ্ছিল; আমি বললাম, সে তো নির্দোষ, সে তো ঢেউয়ের নীচে তলিয়ে যাবে, আর আমি তাকে কোনদিন দেখতে পাব না।
তারপর থেকে কখনও তার সঙ্গ ছাড়লাম না। তার বাহুলগ্না হয়েই মূল্যবান সময়টুকু কাটিয়ে দিলাম। সেও ভালবাসার অশ্রুজলে আমাকে স্নান করিয়ে দিল। আঃ, সে যে কী দুঃখ, আর সে যে কী সুখ! অবশেষে সকলে আমার কাছে থেকে তাকে ছিনিয়ে নিল; আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিছু নিলাম। দেখলাম, তারা তাকে সমুদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল-দুই হাতে আমি মুখ ঢাকলাম। যন্ত্রণা? ওঃ, ও কথাটার গম্ভীর হতে গভীরতম অর্থ আমি জানি!
পরমুহূর্তে লোকজনরা সব হিংস্র আনন্দে চীৎকার করে উঠল। চমকে আমি চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। ওঃ, কী তিক্ত দৃশ্য-সে সাঁতার কাটছে!
সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদয় পাথরে পরিণত হল-বরফ হয়ে গেল। বললাম, সে তাহলে দোষী: সে আমাকে মিথ্যা বলেছে!
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে আমি বাড়ি ফিরে গেলাম।
সকলে তাকে দূর সমুদ্রে নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের বুকে দক্ষিণমুখে ধাবমান একটি ভাসমান বরফ–স্যুপের উপর ছেড়ে দিয়ে এল। তারপর আমার পরিবারের লোকরা বাড়ি ফিরল। বাবা আমাকে বলল:
তোমার চোর তোমার প্রতি তার মৃত্যুকালীন বাণীতে বলে গেছে: তাকে বলবেন আমি নির্দোষ; যত দিন, যত ঘণ্টা, যত মিনিট ধরে আমি না খেতে পেয়ে তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করব আমি তাকে ভালবাসব, তার কথা চিন্তা করব, আর যে দিনটিতে তার সুন্দর মুখখানি আমি দেখেছিলাম সেই দিনটি কে আশীর্বাদ করব। কথাগুলি ভারী সুন্দর, এমন কী কাব্যময়!
আমি বললাম, সে নোংরা-তার কথা আর কখনও শুনতে চাই না। হায়, ভাবুন তো-সে তো সত্যি নির্দোষ ছিল!
নটি মাস-নটি একঘেয়ে বিষণ্ণ মাস-পার হয়ে গেল। অবশেষে এল সেই মহান বাৎসরিক বলিদান দিবস যখন আমাদের জাতির সব কুমারী মেয়েরা ভাল করে মুখ ধোয়, চুল আঁচড়ায়। প্রথমবার চিরুনী চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এল সেই নরঘাতী বড়শী-এতগুলো মাস ধরে সেটা আমার চুলের মধ্যেই বাসা বেঁধে ছিল। আমার অনুতপ্ত বাবার কোলের মধ্যেই আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়লাম। আর্তকণ্ঠে বাবা বলে উঠল, তাকে আমরা খুন করেছি; আর কোন দিন আমি হাসব না! বাবা তার কথা রেখেছিল। শুনুন: সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি মাসে আমি চুলে চিরুনী চালাই। কিন্তু হায়, আজ আর তাতে কি লাভ!
বেচারি ছোট মেয়েটির ছোট কাহিনী এখানেই শেষ হল-আর আমরা জানলাম, যেহেতু নিউ ইয়র্ক শহরের এক কোটি ডলার এবং মেরু অঞ্চলের সীমান্তের বাইশটি বড়শির আর্থিক প্রভুত্ব সমপর্যায়ের, তখন আর্থিক দুরবস্থায় পড়লে যে মানুষ ইচ্ছা করলে দশ সেন্ট দামের কতকগুলি বড়শি কিনে সে দেশে পাড়ি জমাতে পারে অথচ নিউ ইয়র্কেই থেকে যায়, সে তো মুর্খ।
[১৮৯৩]