এসো মা
শীত, শীত, হিমহিম সময়ে মা নেমে এলেন হিমালয়ের হিম মেখে।
মস্ত এক মাঠ। এপাশে-ওপাশে সদ্যপ্রয়াত বর্ষার জলে ভরপুর গোটা-কতক ছলছলে পুকুর। ওপারে, এপারে নিভৃত শান্তিতে প্রস্ফুটিত পদ্মপরিবার। অহংকারী হাঁসের দল সুখসাগরে ভাসছে। ভোরের নরম রোদ কমলালেবুর রসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। পুবের বড় বড় গাছের ছায়া পশ্চিমে রেখা টেনেছে লম্বা লম্বা।
প্রবীণ অক্ষয় কাকা চারপাশ দেখে শুনে আরও ককেয়জন সমবয়সিকে নিশ্চিত জানালেন, ‘না:, আর ভয় নেই। বর্ষা চলে গেছে। আকাশখানার চেহারা দেখেছ! যেন নিকনো উঠোন!’
‘বলছ বটে! কিন্তু শরতের সেই ফাঁপা-ফাঁপা মেঘ দেখছি না তো? হাতি, হাঁস, নৌকো, পালকি!’
‘বৃথাই এত দিন আকাশ দেখলে! ওসব বেরবে বেলা বারোটার পর উত্তর আকাশে। পাখিদের গলা শুনে বুঝতে পারছ না! ঝনঝন করছে।
খঞ্জনা পাখির খঞ্জলি।’
প্যান্ডেল বাঁধা প্রায় শেষ। আর ছ-সাতখানা বাঁশ পড়ে আছে মাত্র। তেরপলের পাট খোলা হচ্ছে। নাদুকাকা দু-কোমরে হাত রেখে তদারকি করতে করতে বলছেন, ‘সেবারের মতো এবারে তেরপলে ফুটোফাটি নেই তো!’
‘একটু ফুটো যে নেই তা কেমন করে বলি! মা কালীর কৃপা।’
‘তার মানে?’
‘কালীপুজোর রাতে হাউই পড়ে। পণ্ড হয়ে যায়।’
শীতের হাওয়া এসেছে। চারপাশ খড়খড়ে শুকনো। উঁচু ডাঙায় কাশফুলের শোভা। মাঠের শেষে বুকুল দিঘির ধারে বাগান ঘেরা বিশাল জমিদার বাড়ি। বছরে একবার এই পুজোর সময় কলকাতা থেকে সবাই আসেন। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। লোকজন। কল কোলাহল। আসছে, যাচ্ছে। দিঘিতে জল নামছে। এই পুজো ওই জমিদার বাবুদের।
মাঠের পথ ধরে ঢাকিরা আসছেন। একটা মাত্র ঢাকে ছাড়া-ছাড়া কাঠি পড়ছে। সঙ্গে আছে সেই ছেলেটি, যার নাম কেষ্ট। কাঁসি বাজায়। এখানও বাজাচ্ছে অন্যমনস্ক বাজনা। জানান দিচ্ছে—আমরা এসে গেছি। ঢাকের বাদ্যে মা আসছেন, ওই আলের পথ ধরে, তাল গাছের সারির ভেতর দিয়ে।
পুকুর ঘাটে মায়েদের বাসন মাজা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ। হাত আলগা পড়ে গেল। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে খুশি খুশি মুখে দেখছেন, ঢাকিদের আগমন। বাচ্চারা পেছন-পেছন ছুটছে। তাদের মুখে ঢাকের বোল, ট্যাং টাটাটা, ট্যাংটা ট্যাং। সবচেয়ে ছোটটা ছাগলছানার মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে।
আশুকাকার চালায় মায়ের মূর্তি তৈরি হচ্ছে। আর তো দেরি সয় না। ‘ও আশুকাকা আর তো দেরি সয় না।’
‘যা:, দিলি তো হাতটা নাড়িয়ে!’
‘আমি তো কত দূরে! হাতটা নাড়ালুম কী করে?’
‘দম বন্ধ করে মায়ের চোখ আঁকছিলুম। মনটা ঘুরে গেল, হাতটা কেঁপে গেল। মায়ের চোখ আঁকা কি সহজ কাজ রে! মায়ের চোখ দুটোই তো সব।’
‘সিংহটা তুমি দেখার মতো করেছ। অসুর এবার একটু রোগা হয়েছে।’
‘হবে না? ম্যালেরিয়ায় ধরেছিল যে। মাকে কেমন দেখছিস?’
‘তোমার মতো এমন মা কে তৈরি করতে পারে!’
সত্যিই তাই। যখন পুজো হয়, মায়ের দিকে তাকালে মনে হয়, মা বুঝি এখনি কথা বলবেন। কত রাতে স্বপ্ন দেখেছি, দিঘির উত্তর পারে যেদিকটা সবচেয়ে নির্জন, কচু আর মানকচুর ঝোপঝাড়, মা সেখানে আলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ভুস ভুস করে শিউলি ঝরে পড়ছে। জিগ্যেস করেছিলুম, ‘মা তুমি এখানে কেন?’
মা বললেন, ‘তুই কে?’
‘মা আমি একটা ছেলে। ওই গোঁসাই পাড়ায় বাড়ি। তারাচাঁদ স্কুলে পড়ি।’
‘শোন, আমি আসলে গাছ। কলাগাছে আমি দেবী ব্রাহ্মণী, কচুগাছে কালিকা, হলুদগাছে দুর্গা, জয়ন্তীগাছে কীর্তিকা, বেলগাছে শিবানী, ডালিমগাছে রক্তদন্তিকা, অশোক গাছে শোকরহিতা, মানকচুতে চামুণ্ডা, ধানগাছে লক্ষ্মী দেবী।’
ভারে ভারে জিনিসপত্র এসে জমিদার বাড়িতে জমা হচ্ছে। সারাটা দিন আমরা সবাই মাঠেই পড়ে আছি। দড়ি বাঁধা হচ্ছে। ঠক ঠক করে পেরেক ঠোকা হচ্ছে। বড়দের কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বসে আছেন। মাঝেমাঝেই নিবারণবাবুর ডাক পড়ছে জমিদার বাড়িতে। তিনিই প্রধান কর্মকর্তা। জমিদার বাবুর সবচেয়ে বিশ্বাসী মানুষ।
যেই তেরপল চাপল, অমনি ছায়া নামল অতবড় মাঠের ওই জায়গাটুকুতে। সবুজ সবুজ ঘাস যেন আরও স্পষ্ট হল। দুটো সুন্দর প্রজাপতি ঘুরে ঘুরে উড়ছে। রব উঠল, ‘মা আসছেন, মা আসছেন।’ জোড়া জোড়া শাঁখের শব্দ কেষ্টা নেচে নেচে কাঁসর বাজাচ্ছে। মা এসে বসলেন মঞ্চে। ভীষণ চেঁচামেঁচি। ওদিকটা তোলো, ওখানে একটা কাঠের টুকরো ঢোকাও। সিংহের লেজটা কি একটু চোট খেল। আরে প্যাঁচাটা গেল কোথায়! গণেশের ইঁদুর! যাত্রার দল এসে গেছে। স্কুল বাড়িতে থাকার জায়গা হয়েছে। মাস্টার মশাইদের বসার ঘরে বাজনার রিহার্সাল হচ্ছে। একা ক্ল্যারিওনেট খুব চড়ায় উঠে সঙ্গী খুঁজে না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। যেখানে টিউবওয়েল, তার সামনের একটা ঘরে হয়েছে দলের রান্নাঘর। ভোঁ ভোঁ শব্দে স্টোভ জ্বলছে। হাণ্ডা কেটলিতে চায়ের সাগর। কিছু সমস্যা তৈরি হতে না হতেই চিৎকার—’চা লাগাও, চা লাগাও’।
নায়ক রকের ধারে দাঁড়িয়ে নুন-জলে গার্গল করছেন। বর্ধমানে পালা করতে গিয়ে এমন চিৎকার করেছেন গলা ক্র্যাক করে গেছে। জিগ্যেস করছেন, ‘কাছাকাছি কোনও হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আছেন?’
নায়িকা, তিনি পুরুষ, ভ্যাঁচ করে হেঁচে বললেন, ‘আমার কাছে বচ আছে প্রাণনাথ।’
বেহালা করুণসুরে ককিয়ে উঠল। বিশাল একটা কুমড়ো রান্নঘরে বসে আছে। পাশে পুঁইশাক। জমিদার বাড়ি থেকে এইমাত্র বিরাট একটা কাতলা মাছ এল। হেড কুক ভুরু কুঁচকে বিড়ি খাচ্ছেন আর ভাবছেন মেনুটা কী হবে!
গার্গলের ফাঁকে একটু সময় করে নিয়ে নায়ক বললেন, ‘মুড়োটা মুগের ডালে ঢুকিয়ে দাও।’
মহিষাসুর দেয়ালের দিকে মুখ করে হাসি প্র্যাকটিস করছেন। মা দুর্গার বিড়ির কৌটো হারিয়ে গেছে। মহিষাসুরকে বলছেন, ‘আবার সরিয়েছিস?’
উত্তরে অসুরের হা হা হাসি। মারামারি হয় আর কি!
সন্ধ্যা নামল। পশ্চিম আকাশে ওই একটি তারা। বোধনের বোলে ঢাক বাজছে। প্রতি বছর আমাদের বাউলদাদা কোথা থেকে কোথা থেকে না চলে আসেন। তিনি নেচে নেচে গাইছেন,
বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়া বোধন,
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন,
ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী,
আসবে কত দণ্ডী জটাজুটধারী।
মায়ের পূজা করবেন আমাদের হেডস্যার। কী তাঁর সংস্কৃত উচ্চারণ, মায়ের হাতের ধারালো অস্ত্রের মতো। তন্ত্রধারক, আমাদের হেড পণ্ডিত। মহাদেবের মতো চেহারা। গরদের জোড় পরে তাঁরা বসেছেন আসনে। মায়েরা কোরা কোরা খড়বড়ে শাড়ি পরে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফুঁ ফুঁ শাক। গাল ফুলছে, গাল কমছে। আলোছায়ায় সব দাঁড়িয়ে, মায়ের যোগিনীরা। দূরে জেনারেটার চলছে বিকট শব্দে। প্রান্তর পেরিয়ে ছুটছে বিদুৎ তৈরির সেই আওয়াজ। কালো আকাশের তলায় কাশের সাদা চামর ঢুলে ঢুলে পড়ছে। টিপ টিপ আলোর মালায় ঘেরা পূজা মণ্ডপটি যেন অন্ধকারে আলোর দ্বীপ।
কোথায় গেল সেই গ্রাম। সদ্ভাব, সদ্ভাবনা! জমিদার বাড়ির একটা পাশ ধ্বসে পড়ে গেল একদিন। সমাজে ধস নামল। মানুষের চেহারা পালটে গেল। বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটল। সন্ধিগ্ধ ‘নতুন’ এসে সব ছারখার করে দিল। আরও জাঁকজমকের বারোয়ারিতে মা সাবধানে পা টিপে টিপে এসে, কটা দিন অস্বস্তিতে কাটিয়ে পা টিপে টিপে চলে যান। জোড়া নীলকণ্ঠ আর আসে না। শহর আর শব্দ, ভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি। মূল হারিয়ে গেল তুমুলে।