এসো বসি আহারে
আমি সুদূর মফস্বলের লোক। প্রথম প্রথম খটকা লাগত, রেস্টুরেন্ট না রেস্তোরাঁ? কাফে না কেফ্, তা নিয়েও চিন্তা করেছি।
যতদূর মনে পড়ে, কফিহাউসের বাইরে দরজার মুখে কাঠের বোর্ডে লেখা থাকত, রাইট অব অ্যাডমিশন রিজার্ভড (Right of admission reserved)। এই নোটিশ দেখে চিন্তিত হয়ে কফিহাউসে প্রথম প্রথম প্রবেশ করতে ইতস্তত করেছি; চল্লিশ বছর আগের সেই কথা এখনও অস্পষ্ট মনে আছে।
আমাদের জন্মশহরে চায়ের দোকান যে দু’-চারটে ছিল না তা নয়, সেখানেও লোকেরা সকাল সন্ধেয় আড্ডা দিত, তৃষ্ণা নিবারণ করত। কিন্তু ওই রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ কথাটি তখনও চালু হয়নি; লোকে বলত চায়ের দোকান, একটু মার্জিতরা বলতেন চায়ের স্টল, টি স্টল। তবে ওই পর্যন্তই, কফির দোকান বা কফিখানা যাকে বড় শহরে বলে, কফিহাউস সেসব কিছু ছিল না। প্রত্যন্ত বঙ্গের গহনে তখনও তিক্ত কষায় কফির স্বাদ অনুপ্রবেশ করেনি।
ভুল হয়ে যাচ্ছে।
লিখতে বসেছিলাম ‘এসো বসি আহারে।’ কিন্তু আহার কোথায়, এ তো পানীয়ের কথা হয়ে যাচ্ছে। তাও তেমন তেমন পানীয়— সিদ্ধি বা হুইস্কি, হাঁড়িয়া কিংবা রাম, নিদেনপক্ষে বিয়ার বা ভাঙের শরবত হলে কথা ছিল। ছিঃ ছিঃ তারাপদ, ছিঃ ছিঃ, এতদিনে তুমি চা-কফি দিয়ে মন মজাতে বসেছ? তোমার ডগমগে পাঠিকা এত সহজে সন্তুষ্ট হবেন না।
সুতরাং মেটা গদ্যে যাই।
প্রথমে খাওয়া নয়, খাওয়ার পরের কথা বলি। বহু হোটেলেরই সমস্যা হল লোকেরা খাওয়ার পর কাঁটা চামচ পকেটে ভরে নিয়ে যায়।
হায়দরাবাদে এক খানদানি ভোজনালয় তথা সরাবখানায় দেখেছিলাম, ইংরেজি আর উর্দুতে দুটি নোটিশ হোটেলের ভেতরের সামনের দেওয়ালে ঝলমল করছে।
বাংলা করলে নোটিশটার সাদা ভাষায় মানে দাঁড়ায়ঃ
‘মাননীয় অভ্যাগতবৃন্দ,
আমাদের কাঁটা-চামচগুলো হজমের ওষুধ নয়। ভোজনের পরে ওগুলো গ্রহণের কোনও প্রয়োজন নেই।’
অন্য একটা ভোজনালয়ের গল্প বলি। এটা অবশ্য আমার চোখে-দেখা নয়, বিলিতি বইতে পড়া।
সদা হইচই, সদা-জাগরিত এক জনপ্রিয় মার্কিনি ভোজনালয়ে এক ব্যক্তি ঢুকেছে। যে-কোনো বড় হোটেলে নানা ধরনের উলটোপালটা লোক ঢোকে। হোটেলের ম্যানেজার সহেবের কাজই হল সেদিকে নজর রাখা এবং সম্ভবমতো তার যথাসাধ্য সমাধান করা।
আমাদের আলোচ্য গল্পের এই ভদ্রমহোদয় যিনি ভোজনালয়ে প্রবেশ করেছেন, আপাতদৃষ্টিতে তিনি বেশ শান্ত, ধীর-স্থির প্রকৃতির। কিন্তু তিনি টেবিলে বসে খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর যখন খাবার আনার আগে বেয়ারা প্লেট ছুরি-কাঁটা, ন্যাপকিন এনে দিল, ভদ্রলোক হাত মোছার সেই ন্যাপকিনটা নিয়ে গলায় বাঁধলেন— বাচ্চাদের গলায় যেমন মায়েরা বেঁধে দেয় খাওয়ার আগে, যাতে জামাকাপড়ে তেল-মশলার খাবারের দাগ না লাগে।
কিন্তু নাকউঁচু ভোজনালয়ের খুঁতখুঁতে ম্যানেজার সাহেবের এ ব্যাপারটা পছন্দ নয়, একটা বড় হোটেলের পক্ষে এ ভারী হাস্যকর দৃশ্য।
কী করবেন ভেবে না পেয়ে, অনেকটা চিন্তা করে তিনি তাঁর ভোজনালয়ের সবচেয়ে চতুর বেয়ারাকে ডেকে তাঁর সমস্যার কথা বললেন।
বেয়ারাটি বলল, ‘স্যার, এ কোনো ব্যাপার নয়। আমি এক সেকেন্ডে সব ঠিক করে দিচ্ছি।’
তার পর সে গুটিগুটি সেই সদাশয় গ্রাহকের কাছে গিয়ে সেলুনের নাপিতের মতো খুব নিচুগ্রামে মিহি গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, চুল কাটবেন না দাড়ি কামাবেন?’
স্যার মহাশয় চুল কাটতেও আসেননি, দাড়ি কামাতেও আসেননি। তিনি এসেছেন খেতে, চটপট গলা থেকে ন্যাপকিনটা খুলে নিয়ে বললেন, ‘চুল-দাড়ি নয়, এক প্লেট স্টেক আর এক বাটি সুপ।’
এবার কলকাতার এক বিখ্যাত চিনে দোকানের কথা বলি। সেও অনেককাল আগের কথা।
তখনও আমরা চিনে খাবারের সঙ্গে তেমন পরিচিত হইনি। সব খাবারের নামটাও সড়গড় হয়নি। বেয়ারা যখন খেতে বসার পর আমাদের হাতে ড্রাগন-আঁকা একটা মেনু ধরিয়ে দিল, একটু ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। অধিকাংশ খাবারের নামের মানে আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে ফ্রায়েড-রাইস কিছুটা বুঝতে পারলাম, আর সবশেষে দেখলাম লেখা আসছে চৌ এন চিক। চিনে হোটেলে যখন এসেছি একটু চৌ বা চাও খেতে হবে। মনে হল চিক যখন দেখছি, এটা সম্ভবত চিকেনের চৌ— তাই অর্ডার দিলাম। অর্ডার পেয়ে বেয়ারা বেচারি বিস্মিত হয়ে গেল। সে বলল, ‘স্যার, এটা খাবার জিনিস নয়, এটা আমাদের ম্যানেজারের নাম।’
পুনশ্চঃ
একটি হোটেল নাটিকার অংশঃ
বেয়ারাঃ ও আমাদের বিরিয়ানি কেমন লাগল স্যার আপনার? আসল জাফরান দিয়ে তৈরি।
গ্রাহকঃ: চমৎকার।
বেয়ারাঃ আর আমাদের মাংসের কাবাব? এমন মোগলাই কাবাব এ-শহরে আর কোনো দোকানে পাবেন না। ঠিক যতটুকু সেদ্ধ, যতটুকু ভাজা হওয়া উচিত, একেবারে ততটুকু। তা ছাড়া সব খাঁটি মশলা। আপনার ভাল লাগেনি স্যার?
গ্রাহকঃ চমৎকার, খুব ভাল লেগেছে, খুবই ভাল কাবাব তোমাদের।
বেয়ারাঃ আপনি তো আবার ফিশ তন্দুরি নিয়েছিলেন। এ রকম তাজা মাছ দিয়ে ফিশ তন্দুরি কোথাও বানায় না। যে খায় সেই প্রশংসা করে। আপনার কেমন লাগল স্যার?
গ্রাহকঃ চমৎকার। সচরাচর এমন পাওয়া যায় না। খুব ভাল মাছ খেলাম।
বেয়ারাঃ (একটু ইতস্তত করে, একবার খুব ক্ষীণ একটা গলাখাঁকারি দিয়ে) তাহলে স্যার আপনি এত মনখারাপ করে মুখ কালো করে বসে আছেন কেন? আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।
গ্রাহকঃ অস্বস্তি আমারও হচ্ছে। সে তোমাদের খাবার খেয়ে নয়। সে তোমাদের খাবারের বিল পেয়ে। অত টাকা তো আমার কাছে নেই।