এসো গো গোপনে – প্রচেত গুপ্ত
ট্রেন এক ঘণ্টা বারো মিনিট লেট। ঢোকবার কথা আটটায়। ঢুকল ন—টা বারোয়। স্টেশনের বাইরে পা দিয়েই বৈদ্যনাথ চমকে উঠল।
ওটা কনক না? হ্যাঁ, কনকই তো। ওই তো বারবার কেচে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া সবুজ শাড়ি, রং চটা লাল ব্লাউজ। লম্বা বিনুনি পিঠ থেকে গড়িয়ে এক পাশে পড়েছে। বিনুনিতে কি লাল ফিতে বাঁধা? হতে পারে। স্কুল—কলেজের মেয়েদের মতো বিনুনিতে ফিতে বাঁধা কনকের একটা বিচ্ছিরি অভ্যেস। প্রথম প্রথম বৈদ্যনাথ আপত্তি করত।
‘এই বয়েসে কেউ চুলে ফিতে বাঁধে?’
কনক হেসে বলত, ‘কী হয়েছে বাঁধলে? চুলে ফিতে, চোখে কাজল, গালে একটু পাউডার। তাও সস্তার। এই তো আমার সাজগোছের ছিরি। গরিবের বউ, এর বেশি তো মুরোদ নেই। আজকাল সব মেয়ে বিউটি পার্লারে যায়। আমি কি যাই? তোমাকে বলেছি, আমাকে টাকা দাও আমি সাজতে যাব? বলেছি তোমাকে?
এরপর আর কী বলবে বৈদ্যনাথ? সে চুপ করে যেত। সত্যি মেয়েটা নিজের শখ আহ্লাদের জন্য একটা পয়সাও খরচ করতে চায় না। ভালো একটা শাড়ি কেনে না। চটি কেনে না। একজোড়া ছোটো দুল, হাতের একটা বালা, গলায় একটা সরু চেন ছাড়া সোনাদানা বলতে কিছু নেই। তাও গত বছর মে মাসে হাতের বালাটা বাঁধা দিয়েছে। বদ্যিনাথের ব্যাবসায় টাকার দরকার। বদ্যিনাথ জানে, নিজের জন্য খরচ না করাটা কনকের একটা গুণ। সংসারের হাল ভালো নয়। ভালো নয় বললে কম বলা হয়। বেশ খারাপ। বদ্যিনাথের একরত্তি ব্যাবসা আজ ভালো তো কাল মন্দ। সবসময় টলমল। তারপরেও অনেক বাড়িতে বউয়েরা শুনতে চায় না। এটা ওটা আবদার করে। ঘ্যানঘানানি চলতেই থাকে। কনক কখনো এমন করেনি। বরং উলটে দু—পয়সা সাশ্রয়ের জন্য ব্যস্ত থেকেছে। মেয়েটার আরও একটা ব্যাপার আছে। মোটে রাগতে পারে না। এটা গুণ না দোষ? মনে হয় দোষ। বউ না রাগলে বাড়ি কেমন ঝিমোনো মতো লাগে। স্বামী—স্ত্রীর ঝগড়া সংসারে সুলক্ষণ। ঝগড়া ছাড়া সংসার টেকে না।
হ্যাঁ, বিনুনিতে ফিতে আছে। সেই ফিতে আলোতে চকচক করছে। এত দূর থেকেও দেখতে পেল বদ্যিনাথ। বাজারের প্লাস্টিকের ব্যাগটা পায়ের কাছে রাখা। ছেঁড়া হাতলে দড়ি। কনকই বেঁধেছিল। নতুন ব্যাগ কিনবে কেন? যতদিন চালানো যায়। মুখ দেখা যাচ্ছে না কনকের। সে পিছন ফিরে আছে।
ধ্যুস। বদ্যিনাথ নিজেকে মনে মনে ধমক দিল। তোমার মাথাটা কি একেবারে গেছে বদ্যিনাথ? কনক কোথা থেকে আসবে?
স্টেশনের বাইরে সন্ধের পর বাজার বসে। স্টেশন বাজার। নামেই বাজার। গায়ে গতরে একটুখানি। হাতে গোনা কয়েকটা আনাজপাতি, ফলমূলের দোকান, একজন আলু পিঁয়াজ আনে। আগে মাছ—মাংসের ব্যাপার ছিল না। মাস কয়েক হল পানু মাছ নিয়ে বসছে। ছেলেটার পায়ে সমস্যা রয়েছে। খুঁড়িয়ে হাঁটে। তবে মুখে সবসময় হাসি। বদ্যিনাথ এই হাসির দিকে তাকায় না। দোকানির হাসি খদ্দেরের ফাঁসি। ঠকানোর কল। যাক, এইটুকুতেই বাজার শেষ। ওহ, শেষ না। ইদানিং এক কোণায় পানুর বুড়ি মা ফুল নিয়ে বসছে। পুজোর কুচো ফুল। ফুলের সঙ্গে বাড়িতে বানানো ধূপ। টুকটাক বিক্রি হয়।
আনাজপাতির দোকানের ওপর কনক ঝুঁকে পড়েছে।
বদ্যিনাথ নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করল। একটা একটা ভুল। পিছন থেকে দেখলে অনেক সময় একরকম হয়। এই ভুল সে আগেও করেছে। সকলেই করে। চেনা লোক ভেবে অচেনা কাউকে ডেকে ফেলে। তখন অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। আর আজ ফাঁকা কামরা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হু হু হাওয়ায় চোখ দুটো বুজে এসেছিল। তো ভুল দেখার চান্স এককাঠি বেশি। ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বদ্যিনাথের বিশ্বাস তার ‘ট্রেন ভাগ্য’ সবসময়ই ভালো। চার বছর আগে এই ট্রেনেই কনকের সঙ্গে আলাপ। নরমাল আলাপ নয়, গায়ে পড়া আলাপ। ভাবলে আজও হাসি পায়। গাদাখানেক জিনিস নিয়ে হাওড়া থেকে উঠেছিল। হাতে দুটো ঢাউস ব্যাগ ও কাঁধে ঝুলি। আগের দুটোর গাড়ি ক্যানসেল হওয়ায় কামরায় ভিড় ছিল খুব। ঠাসাঠাসি অবস্থা। ওপরের রড ধরাও কঠিন। তার মধ্যেই ডায়ে—বাঁয়ে কোনোরকমে চেপেচুপে দাঁড়িয়েছিল বদ্যিনাথ। বুঝতে পারছিল, একটু ওদিক—ওদিক হলেই কেলেঙ্কারি ঘটবে। লোকের গায়ে পড়তে হবে। হলও তাই। হঠাৎই ট্রেনের সামান্য গা ঝাড়াতে ব্যালান্স হারাল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনে। আর পড়বি তো পড়, পড়ল একেবারে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার গায়ের ওপর। বদ্যিনাথ কুঁকড়ে গেল।
এইসব ক্ষেত্রে মেয়েরা রণমূর্তি ধারণ করে। ধমক, শাসানি, গালিগালাজে মুণ্ডুপাত করে। ভিড়, ঝাঁকুনি বাজে কথা, গায়ে পড়বার, মেয়েছেলের শরীর ছোঁবার ছুঁকছুকানি। বদ্যিনাথ গালি শোনবার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হল। আর তখনই মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে শান্ত গলায় বলে, ‘ও কিছু না। আমাকে একটা ব্যাগ দিন। অত জিনিস নিয়ে দাঁড়ানো যায়? দিন আমাকে।’
বদ্যিনাথ এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে সত্যি সত্যি একটা ব্যাগ মেয়েটার দিকে এগিয়ে দেন। রোগাপাতলা, শ্যামলা তরুণী কচি কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরেছিল। ঘাড়ের পাশ দিয়ে বিনুনি নেমে এসেছিল বুকের ওপর। বিনুনিতে লাল ফিতে বাঁধা।
এই মেয়েই কনক। চারমাস যেতে—না—যেতে বদ্যিনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
এত দ্রুত বিয়ে হবার পিছনে কারণ দু—জনের শুধু গভীর ভালোবাসা নয়, কারণ কনকের বাড়িতে ঝামেলা। তার বিয়ে পাকা হয়ে গিয়েছিল। পাত্র প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
আড়বেলিয়ায় একতলা বাড়ি। কনকের বাবা একদিন নিজে গিয়ে সেই বাড়ি দেখে এলেন। বাড়িতে টিভি আছে, সাইকেল আছে। জানলায় জানলায় তারে বাঁধা ফুল ছাপ বেঁটে পর্দা। বাড়ির পিছনে কুয়ো। কুয়োর জল ঠান্ডা। বয়স বেশির দিকে হলেও পাত্র দেখতে সুন্দর। কনকের বাবা বাড়ি ফিরে এসে হবু জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
‘পুরুষ মানুষ কেমন দেখতে আসল কথা নয়, আসল কথা তার পারসোনালিটি। এই ছেলের পারসোনালিটি অতি সুন্দর। সারাদিন ছিলাম, তাকে একবারের জন্যও হাসতে দেখলাম না। একেই বলে চরিত্র। লৌহ কঠিন চরিত্র। আমি মুগ্ধ। কনকের মা, বিয়ের দিন ঠিক করো।’
কনকের মা বিয়ের দিন ঠিক করলেন। কনক ঠিক করল, বাবার লৌহ কঠিন পাত্র নয়, সে বিয়ে করবে নার্ভাস টাইপ, হাসিখুশি, গোবেচারা বদ্যিনাথকে। টলমল রোজগারের বদ্যিনাথকে। যার নিজের বাড়ি নেই। কলকাতা থেকে দেড় ঘণ্টা দূরের মফসসলে দেড় কামরা ভাড়া নিয়ে থাকে। জানলা আছে, পর্দা নেই। কুয়ো আছে, তবে শুকনো, বাড়ির বাইরের টিউবওয়েল থেকে জল নিতে হয়। কনক বিয়ে করেও ফেলল। বাড়িতে লুকিয়ে কলকাতায় পালিয়ে রেজিস্ট্রি, মন্দিরে মালা বদল। অবশ্যম্ভাবী যে ঘটনা ঘটবার তাই হল। কনকের বাবা—মা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন।
একে ‘ট্রেন ভাগ্য’ ছাড়া আর কী বলবে বদ্যিনাথ? নইলে এমন মিষ্টি মুখের চমৎকার মেয়ে তার বউ হয়?
আশ্চর্যের কথা, এই ট্রেনেই মানার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বদ্যিনাথের। ঢলঢলে চেহারার মানা। কনকের থেকে কম করে পাঁচ—সাত বছরের বড়ো। লাস্ট ট্রেনের ফাঁকা কামরার এক কোণায় বসেছিল। বুকের অগোছালো কাপড় ঠিক না করে বদ্যিনাথের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলেছিল, ‘ভাগ্যিস আপনি উঠলেন। ফাঁকা কামরায় ভয় লাগে খুব।’ নামবার আগে মানা কলকাতার ঠিকানা বলে।
‘আসেন না একদিন। ঘরে একাই থাকি।’
গা ঝিমঝিম করে উঠেছিল বদ্যিনাথের। এটাও ট্রেন ভাগ্য কি না? যাইহোক, কনককে এখন দেখা মস্ত ভুল। বদ্যিনাথ বুঝতে পারছে, এই ভুলের কারণ আছে।
কাল রাতে ঘুম হয়নি তেমন। কলকাতায় মানার ঘরে থাকলে রাতে ঘুমোনোর জো নেই। মেয়েটা কায়দাকানুন জানে বটে! নতুন নতুন সব রং ঢঙ। পুরোনো, বাসি বলে কোনো ব্যাপারই নেই। আজ একরকম তো কাল আর একরকম। যখনই মানার কাছে রাতে থাকে, ঘুমোতে ঘুমোতে ভোর করে দেয়। কালও দিয়েছে। আজ ট্রেনে উঠে সিট পেয়ে ঘুম দিয়েছিল টেনে। অনেক সময় ঘুমের পর শরীরে সবকিছু ঠিকমতো কাজ করে না। টাল খায়। ঘুম আর জেগে থাকা হল দুটো আলাদা অবস্থা। একটা অবস্থা থেকে আর এক অবস্থায় যেতে গেলে টাল তো খেতেই হবে। এখন নিশ্চয়ই সেরকম কিছুই হয়েছে। নইলে কনককে কেন দেখবে?
তাকাব না ভেবেও সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে যেতে গিয়ে বদ্যিনাথ ফের তাকাল।
আনাজপাতির দোকানের সামনে কনক নীচু হয়ে আছে। মন দিয়ে কিছু বাছছে। বেছে সামনের ছোটো ঝুড়িতে রাখছে। দোকানের ওপর হলদে বালব। আলোয় তেমন জোর নেই। দোকানগুলো সব তক্তাপোষের ওপর। খুঁটির ঠেকনা দিয়ে মাথার ওপর প্লাস্টিক টানা। গোড়াতে প্লাস্টিক ছিল না। বৃষ্টি বাদলায় অসুবিধে হত। তারওপর মাথার ওপর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ রয়েছে। পাখিতে ময়লা ফেলে। খাবার জিনিসে ময়লা পড়লে মানুষ ঘেন্না পায়। তাই প্লাস্টিকের ব্যবস্থা। সেখান থেকে বালব ঝোলে। স্টেশন থেকে চুরি করা কারেন্ট। আলো জোরালো হয় না। ট্রেন থেকে নেমে কেউ কেউ এই বাজার করে। বদ্যিনাথের এই বাজার মোটে পছন্দ নয়। সে বলে, ‘সব বাসি। সকালে মেন বাজারে বিক্রি না হওয়া মাল সব। সেগুলোই গছানোর তাল।’
কনক বলে, ‘বাসি তো কী হয়েছে? সকালে যে আনাজপাতি বিক্রি হয়, সেগুলো সব টাটকা নাকি? বেশিরভাগই আগের দিনের পুরোনো। বেছে নিলেই হল।’
বদ্যিনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কত বাছবে! ওরা তার মধ্যেই চালিয়ে দেবে। হারামজাদাদের চেনো না।’
কনক বলে, ‘খামোকা গাল দিচ্ছ কেন? তোমাকে তো জোর করে নিতে বলছে না। থলিতে ঢুকিয়েও দেয় না। নিজে দেখেশুনে নিলেই হয়।’
জিনিস যে ভালো নয়! কনকও জানে। তবে দাম কম। দরাদরি চলে। দোকানিরা যতটা পারে বেচেবুচে ঝাড়া হাতপায়ে বাড়ি ফিরতে চায়। যত রাতের দিকে এখানে আসা যায় তত সুবিধে। দাম কমে। অভাবের সংসারে সুবিধে হয়। এই সুযোগটাই নেয় কনক। বদ্যিনাথকে কতবার বলেছে, ‘তুমি ন—টার গাড়িতে আসবে। আমি বাজারে থাকব। আমাকে নিয়ে ফিরবে।’
বদ্যিনাথ বিরক্ত হয়। একে তো বাজারটাই পছন্দ নয়, তারওপর কনক থাকলে বেশিরভাগ সময়েই সাইকেলে ওঠা যায় না। রাতে খানাখন্দের রাস্তায় ডবলক্যারি মুশকিলের। একবার টাল খেলে মুশকিল। বাধ্য হয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলের বাজারের থলিটা ঝুলিয়ে দু—জনে মিলে হেঁটে ফিরতে হয়। কনক বকবক করে। বদ্যিনাথ চুপ করে থাকে।
মানা যেদিন তাকে বলেছিল, ‘ডার্লিং, আমায় বিয়ে করবে কবে?’ বদ্যিনাথ আকাশ থেকে পড়েছিল।
‘কনক আছে তো।’
ছিটকে সরে গিয়েছিল মানা। উঠে বসে, খাটের ধারে চলে গিয়েছিল। তারপর বদ্যিনাথের দিকে পিছন ফিরে বসে বলেছিল, ‘তাহলে কনককে নিয়ে থাকো। আমার কাছে আসো কেন? বাসি বউ যদি ভালো লাগে, আমাকে জ্বালাও কেন? আমি কি সস্তা?’
বদ্যিনাথ হাত রেখেছিল মানার কাঁধে। মানা হাত সরিয়ে, গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলেছিল, ‘ঝামেলা কোরো না।’
বদ্যিনাথ কাতর গলায় বলেছিল, ‘মানা বোঝবার চেষ্টা করো।’
মানা ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘কী বুঝব? তোমার বউয়ের কথা? আমি কেন বুঝতে যাব? তুমি আমাকে বোঝো? বউকে ঘরে রাখবে, আর আমি সারাজীবন বাজারে পড়ে থাকব? কেন আমার ঘর—সংসারের শখ আহ্লাদ নেই? রাত পেরোলে ক—টা পয়সা দাও বলে আমার শখ আহ্লাদ সব কিনে নিয়েছ নাকি? লাথি মারি তোমার পয়সার মুখে। বেটাছেলের অভাব আছে আমার?’
বদ্যিনাথ উঠে বসে। অস্থির গলায় বলে, ‘শুধু পয়সা কেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি মানা।’
মানা রাগে গরগর করে বলে, ‘মিথ্যে কথা বোলো না। বউটা বাসি হয়ে গেছে, তাই মাঝে মাঝে এসে…।’
বদ্যিনাথ চুপ করে থাকে। কথাটা মিথ্যে নয়। মানার সঙ্গে মেলামেশার পর থেকেই কনককে মাঝে মাঝে কেমন যেন পুরোনো মনে হয়। বিশেষ করে রাতে। মনে হয় সেই একই শরীর, একই ভঙ্গি, একই আদর। অথচ বিয়ের তো বেশি দিন হয়নি। মোটে চার বছর। না চার নয়, চার বছর এক মাস। গত মাসে কনক ফুল এনে ঘরে রেখেছিল। মুখ থেবড়া একটা ফুলদানি আছে বাড়িতে। কোণা ভাঙা। তাতে ফুল রাখতে কোনো অসুবিধে হয়নি কনকের। রাতে খেতে বসে বদ্যিনাথ বলেছিল, ‘ব্যাপার কী? ফুল সাজিয়েছ দেখছি।’
কনক চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল, ‘কেমন লাগছে?’
বদ্যিনাথ বলেছিল, ‘মন্দ না। আর ক—টা বেশি হলে ভালো হত।’
কনক বলল, ‘বাপরে আরও? এই ক—টারই যা দাম।’
বদ্যিনাথ বলল, ‘ফুল কেন বললে না?’
কনক বদ্যিনাথের পাতে ভাঁজ করে রুটি দিতে দিতে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘আজ আমাদের বিয়ের দিন না? তুমি ভুলে গেছ। চার বছরেই বাসি হয়ে গেলাম?’
সত্যি কি কনক বাসি হয়ে গিয়েছিল? নাকি মানাকে দেখার পর থেকে এমনটা মনে হয়েছিল বদ্যিনাথের? এক ধরনের জাল বিছিয়ে রাখে মানা। মাকড়সা পোকা ধরবার জন্য যেমন জাল বিছিয়ে রাখে। একবার আটকালে বেরনো যায় না। সেদিনও বদ্যিনাথের তাই মনে হচ্ছিল।
মানা রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলেছিল, ‘সত্যি যদি ভালোবাসতে তবে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলতে আমাকে। সঙ্গে একটা বেটাছেলে থাকলে সবদিক থেকে সুবিধে। অনেক জ্বালাতন থেকে বাঁচি। নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারি। তোমার মতো গোবেচারি হলে তো কথাই নেই।’
বদ্যিনাথ কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘কী করব মানা? কনক আছে যে।’
মানা বলে, ‘কী করবে তুমি জানিয়ো।’
বদ্যিনাথ অসহায়ভাবে বলে, ‘তুমি বলে দাও কী করব?’
মানা তীক্ষ্ন গলায় বলে, ‘অনেক হয়েছে, আর না। এবার বউকে ছাড়তে হবে তোমায়।’
বদ্যিনাথ চমকে উঠে বলে ‘ডিভোর্স? কনককে ডিভোর্স করতে বলছো?’
মানা একটু চুপ করে থাকে। স্থির চোখে তাকায়। এই চোখে যে কী হাতছানি আছে সে জানে কেবল বদ্যিনাথ। আবার মানা খাটে ফিরে আসে। ঝুঁকে পড়ে বদ্যিনাথের গলা জড়িয়ে ধরে দু—হাতে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ওঠে। সে ফিসফিসানিতে আদর ছিল, তার থেকে বেশি ছিল হুমকি।
‘বউকে ডিভোর্স করবে না মেরে ফেলবে সে তুমি জানো বদ্যিনাথ। তোমার ব্যাপার। আমার মাথাব্যথা নেই। মোদ্দা কথা কনককে তোমায় সরাতে হবে। আর না সরালে, আমিই যাব তার কাছে। সব বলব তাকে। তাকে গুছিয়েই বলব কেমন করে তুমি আমার কাছে আসো। এসে কেমন করে…সব। এবার তুমিই ঠিক করো বউকে ছাড়বে না মারবে।’
মেরে ফেলবে! কনককে খুন করবে? মানা এসব কী বলছে? এ কথা শোনাও পাপ। কনক তাকে ভালোবাসে। সেও কি ভালোবাসে না? অবশ্যই কনকের মতো মেয়ে হয়? সব দিয়ে বিশ্বাস করে স্বামীকে। যেটুকু আছে তাই দিয়ে, যা নেই তাই দিয়েও। নইলে ফিরে যাবার দরজা এত সহজে বন্ধ করতে পারে কেউ? কিন্তু বদ্যিনাথের তো আর উপায় নেই। মাকড়সার জালে পা জড়িয়ে ফেলেছে। মানা সব বলে দিলে কনক কী করবে? রেল লাইনে গলা দেবে? দিতেও পারে। কিন্তু সে মৃত্যুও তো সুখের হবে না। তাকে তো সব জেনে মরতে হবে। বদ্যিনাথের বিশ্বাসঘাতকতার সবটা জেনে মরতে হবে।
দু—হাত দিয়ে মুখ ঢাকে বদ্যিনাথ।
মানা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘এখন মুখ ঢাকলে কী হবে? যা কালি লাগবার লেগে গেছে। আর আমার ঘরে বসে থাকলে চলবে না তো বাপু। অন্য লোক আসবে। এবার বউয়ের কাছে ফিরে যাও গুটিগুটি।’
পায়ের কাছে রাখা বাজারের থলিটা হাতে তুলে কনক এবার মুখ ফেরাল। তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বদ্যিনাথ। সেই টলটলে মুখ। সেই কপালে ছোট্ট কালো টিপ। শান্ত দুটো চোখ। বদ্যিনাথের গা হাত পা ঝিমঝিম করে উঠল। পাশে দাঁড়ানো একটা রিকশর আড়ালে চট করে সরে গেল।
কনক! কনক কীভাবে এসেছে?
মানুষ বড়ো আজব। পাপ জানবার পরও কত পাপ কাজই না তাকে করতে হয়। মন চায় না, তারপরও করতে হয়। বোধহয় সেইসব সময়ে শরীরে পাপ ভর করে। শরীর তখন পাপ করে। নাকি অন্য কিছু? কে জানে। বদ্যিনাথের লেখাপড়া বেশি নয়। এত কিছু তার মাথায় ঢোকে না। সে অত বোঝে না। সে শুধু বলল, কনককে মরতে হবে। তার জন্য যেমন মরতে হবে, তার নিজের জন্যেও মরতে হবে।
কনক ফলের দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গণেশ ফল বেচে। নিশ্চয়ই ঠকাবে। পচা ধচা গছিয়ে দেবে। বদ্যিনাথ রিকশর আড়াল থেকে খানিকটা বেরিয়ে এল। কনক ফল কিনল। বাপরে, মেয়েটা বেশ খরচা করছে তো! আচ্ছা কনকের মতো দেখতে কেউ নয় তো? হতেই পারে। একটা মানুষের মতো দেখতে আর একটা মানুষ তো থাকেই। কে আসল, কে নকল গুলিয়ে যায়। যায় না?
বউকে মারতে বেশি বেগ পেতে হয়নি বদ্যিনাথের। বেশি ভাবনাচিন্তাও করেনি। করবে কেন? সে তো আর খুনি নয়। খুনিরা সাত পাঁচ ভাবে। এক শনিবার ভোরে মর মর বাবাকে দেখতে চার বছর পর বাপের বাড়িতে গেল কনক। দু—ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এল কাঁদতে কাঁদতে। বাবা দেখা তো করেইনি, ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়নি। বদ্যিনাথ দেরি করেনি। বিষ কেনাই ছিল। নিজের খাওয়া হলে কনকের খাবারে মিশিয়ে দিল। কনক এখন খাবে না। তার মন খারাপ। খাবার ঢাকা দিয়ে কলকাতার গাড়ি ধরতে বেরিয়ে পড়ল বদ্যিনাথ। বেচারি মেয়ে। বাবা—মায়ের কাছ থেকে খুব ধাক্কা পেয়েছে। রাতে বাড়ি ফিরে, পাড়ার লোক ডেকে দরজা ভাঙতে হয়েছিল বদ্যিনাথকে। দুঃখে, অপমানে কনক যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আহারে! পুলিশ এলে বিষের শিশি হাতে তুলে দিল বদ্যিনাথ। শ্মশানে যাওয়ার সময় পাড়ার মেয়েরা কনককে সবুজ শাড়ি, লাল ব্লাউজ পরিয়েছিল। মাথায় একটা বিনুনিও বেঁধে দিয়েছিল। সেখানে লাল ফিতে। ঠিক আজকের মতো।
কনকের মতো দেখতে মেয়েটি এবার পানুর মাছের দোকানে দাঁড়িয়েছে। বদ্যিনাথ রাস্তায় নেমে এল। হারামজাদা পানু এবার নির্ঘাত বাসি মাছ ধরাবে।
মানার কাছে গিয়ে প্রথম চোটে খুব খানিকটা কেঁদেছিল বদ্যিনাথ। মানা বলেছিল ‘ঢঙ। বউ সুইসাইড করে, আর ধেড়ে বুড়ো কাঁদে। যত্তসব ন্যাকামি। ন্যাকা পুরুষ দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।
সুইসাইডের সময় পেয়ারের বউ তোমাকে মনে রেখেছিল? তবে ভালোই হয়েছে। তুমি এখন থেকে আমার।’
কাল শেষ রাতে মানা বিয়ের কথা তুললে বদ্যিনাথ বলে, ‘দাঁড়াও এখন বিয়ে করলে সবাই সন্দেহ করবে। ক—টাদিন যেতে দাও।’
মানা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘কীসের সন্দেহ করবে?’
মানা ধড়ফড় করে উঠে বসে। গায়ের কাপড় সামলে চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘অ্যাই তুমি বউকে খুন করেছ নাকি মাইরি? উরি বাবা!’
বদ্যিনাথ ঠান্ডা গলায় বলে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর মুচকি হেসে পাশ ফেরে।
সারাদিন ব্যবসার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছে বদ্যিনাথ। তিন মাস হয়ে গেল কনক নেই। এখনও অভ্যেস হয়নি। বাড়ি ফিরে একা লাগে। দুটো নাকে মুখে গুঁজে শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে বাসি বউয়ের জন্য মাঝে মাঝে ভুল করে হাত বাড়ায়।
আজও বদ্যিনাথের ‘ট্রেন ভাগ্য’ ভালো ছিল। গাড়ি ফাঁকা। তারপরেও দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল বদ্যিনাথ। হু হু করে গাড়ি ছুটছিল। ঝড়ের মতো বাতাস এসে লাগছিল চোখে মুখে।
কনকের মতো দেখতে মেয়েটি এখন বুড়ির সামনে। নিশ্চয়ই শুকনো বাসি ফুলগুলো কিনবে। ধূপকাঠিও কি নেবে? মেয়েটি বুড়ির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে।
বাজার ফাঁকা হয়ে আসছে। দোকান গোটানো শুরু হয়েছে। এবার আলো নিভবে।
বদ্যিনাথ আর পারল না। রাস্তায় নেমে কনকের মতো দেখতে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত পায়ে।
বদ্যিনাথ আর কনক এখন পাশাপাশি হাঁটছে। বাড়ি ফিরছে দু—জনে। বদ্যিনাথ স্টেশনের স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়েছে।
সাইকেলের হাতলে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগের ছেঁড়া হাতল দড়ি দিয়ে বাঁধা। রাস্তা শুনশান। এত রাতে কে থাকবে?
কনক বলল, ‘তোমার জন্য রোজ অপেক্ষা করি। তুমি ফিরলে একসঙ্গে বাড়ি যাব বলে। তুমি দেরি করো। আমাকে একা ফিরতে হয়।’
বদ্যিনাথ লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘দেরি হয়ে যায় কনক। আমারও আজকাল খুব একা লাগে। আর দেরি হবে না। আমি ব্যবস্থা করেছি।’
কনক মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল, ‘মনে থাকে যেন। নইলে আমি সারারাত তোমার জন্য স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করব।’
বদ্যিনাথ বলল, ‘আর বাসি পচা জিনিস কিনবে। তাই তো?’
কনক বলল, ‘আর কী করব? গরিব বরের সংসার খরচ বাঁচাতে হবে না?’
বদ্যিনাথ হেসে বলল, ‘আজও আমি আগে আসতাম জানো কনক। গাড়ি লেট করল। হতচ্ছাড়া কোন একটা লোক দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। হাত ফসকে পড়েছে। পড়েছে না নিজেই ঝাঁপ দিয়েছে কে জানে। হয়তো মরবার ইচ্ছে জেগেছিল। ব্যস গাড়ি গেল আটকে। সেই লোককে তুলে হাসপাতালে পাঠিয়ে তবে গাড়ি ছাড়ল। লোকটা মরে যাবে। অত জোরে ট্রেন থেকে পড়েছে…তারওপর পোস্টে ধাক্কা।’
কনক বলল, ‘ইস মাগো। তুমি কিন্তু দরজায় দাঁড়াবে না একদম।’
বদ্যিনাথ চাপা গলায় হাসল।
কনক বলল, ‘এই জানো একটা ভালো খবর আছে।’
বদ্যিনাথ বউয়ের কাছ ঘেঁষে এসে বলল, ‘কী খবর।’
কনক হাত বাড়িয়ে বরের কনুই ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘বলব না।’
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে শুনশান পথঘাট, ভেসে যাচ্ছে লোকালয়। সেই আলো রহস্যময়। রহস্যময় আলোতে বদ্যিনাথ আর কনককে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা কুয়াশা মেখে ধীর পায়ে হাঁটছে। আহারে, বড়ো সুন্দর লাগছে!
একটু আগে ট্রেন থেকে পড়া লোকটার পরিচয় জানতে পেরেছে হাসপাতাল। মরা লোকটার পকেটে কাগজের টুকরো পাওয়া গেছে। তাতে লেখা বদ্যিনাথ। বদ্যিনাথ সামন্ত।