এল সেই আতঙ্ক
বর্ষা একসময় আমার প্রিয় ঋতু ছিল। যখন ছাত্রছিলুম। আকাশ কালো হয়ে যখন ছুটে আসত বাদল ধারা তখন তারস্বরে গাইতুম :
মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে
নি:সীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ সংগীতে…
অতীতে চলে যেত মন, কালিদাসের কালে। ডাল পালা নুইয়ে ভিজছে গাছ, ভিজছে অসহায় পাখির দল। জলের ধারা ছোট-ছোট স্রোতস্বতী তৈরি করে ছুটে চলেছে। ভেসে যাচ্ছে খড়কুটো। অদ্ভুত একটা প্রেমিকতা তৈরি হত মনে। মনে হত কোথাও আমার এক প্রেমিকা আছে। নীল শাড়ি সবুজ ব্লাউজ পরে সে ভিজছে। তার কালো চুলে জলের বিন্দু হীরক-দ্যুতিতে ছড়িয়ে আছে। গমের দানার মতো তার গাত্রবর্ণ। আঁখি পল্লব ছায়া। বিশাল এক উদ্যানে নারকেল গাছের পাতার তলায় আশ্রয় নিয়ে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভিজছি দুজনে, এক জোড়া শালিকের মতো। বৃষ্টি ধরে গিয়ে যখন সোনারোদ ঝলসে উঠত, ছুটে যেতুম আমাদের প্রিয় খেলার মাঠে। ঘাসের অগোচরে জমে আছে জল, প্রতিটি পদক্ষেপে কবোষ্ণ অনুভূতি। ভরা পুকুরে ভাসছে ঘন নীল আকাশ। শালুকের পাতায় জলের মতি টলটল করছে। গভীর রাতে বৃষ্টিধারা টিনের চালায় অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছে। মত্ত দাদুরীর কণ্ঠ-সংগীত। ঘুম আসত দূরপথ ধরে অভিসারিণী রাধিকার মতো।
কিন্তু যেই শুরু হল গোলামির জীবন, বর্ষা হয়ে দাঁড়াল আতঙ্কের মতো। বৃষ্টি আর তখন মেঘদূতের লিপি নয়, চাবুক। তখনই জানলুম বৃষ্টির কত ধরন? এক হল, কেরানী-ভেজানো বৃষ্টি। গোলাম-খানায় ছুটির ঘণ্টা বাজামাত্রই তার আগমন। শহরের পথঘাট জলের তলায়। অদৃশ্য যানবাহন। পথের পাশে, গাড়ি বারান্দার তলায়-তলায় অসহায় দাসেদের জটলা। বর্ষা তখন ভয়ঙ্করী, প্রলয়ঙ্করী। শহর তখন কোমল কোনও নগরী নয়, রণভূমি। এক-আধটা যাত্রীবাহী বাস এলেই মানুষের তাণ্ডবনৃত্য। স্থান দখলের রক্তাক্ত লড়াই। কে মরে, কে বাঁচে সে হুঁশ নেই। জলবন্দী গাড়ি, বিশাল যানজট, এগজস্টের কটু ধোঁয়া, নোংরা জল, বিদ্যুৎহীন অন্ধকার যেন এক ভয়াবহ নরক।
সংসার সমরাঙ্গনে আয়ুধহীন দাস বুঝতে শিখল, আকাশ ভেঙে পড়লেও তাকে ছুটতে হবে কর্মস্থলে কাকভেজা হয়ে, জুতো বগলে নিয়ে। টাকার হিসেব নয়, হিসেব একটাই, সঞ্চয়ে কটা ক্যাজুয়েল লিভ আছে। ছাত্র যেদিন থেকে সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে দাস হয়েছে, সেইদিন থেকেই মৃত্যু হয়েছে কবিতার, প্রেমিকতার, অনুভূতির।
এখন বর্ষা এল মানে আতঙ্ক এল। প্যাটন-ট্যাঙ্ক হবার সাধনা করো। খানা-খন্দ, নালা, ডোবা পেরিয়ে, ওয়া গুরুজিকি ফতে বলে ছোট শহরকেন্দ্রের গোলামপীঠে। প্রস্তুত থাকো, হাত বাড়াবে ফ্লু, ডেঙ্গু, ডায়েরিয়া। সবই স্যাঁতসেতে। ফুটো ছাদ বাজনা বাজাচ্ছে পেতে রাখা বালতিতে। জীবন এক ভিজে দেশলাই।