এলো মোহিনীমায়া

এলো মোহিনীমায়া

‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।’

সে যে মিথ্যা কতদূর

তখন শুনে কি তুমি বোঝোনি ঠাকুর?

রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস কবিতার অমোঘ দুটি লাইন। ইচ্ছে করেই বইয়ের প্রথমেই হালকা সুরে তাদের ব্যবহার করলাম।

এই বইয়ে যে-বিষয়ে আলোচনা এগোবে তা বেশ গভীর এবং গূঢ়। আলোচনাটিকে কিন্তু যতখানি পারি সহজ এবং সাবলীল করে রেখেছি। তার কারণ, আমি আমার বক্তব্য পৌঁছে দিতে চাই সমস্ত ভারতীয়ের কাছে। এ লেখার প্রধান উদ্দেশ্য একটি ক্ষতিকর ভাবনাকে ভেঙে চুরমার করা। অন্তত হাজার বছর ধরে আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে আছে এই ভুল ভাবনা— জগৎ মিথ্যা, জগৎ মায়া। তাকে ভেঙে চুরমার করতে হলে তো প্রচণ্ড আঘাত করতেই হবে। সেই আঘাত যাতে সহনীয় হয়, তাই চেষ্টা করেছি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ভ্রান্ত ভাবনার বিশ্লেষণ।

‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’— এই মিথ্যা ধারণা আজও পেরেকের মতো গেঁথে আছে ভারতীয় চেতনায়। এমনকী অনেক চিন্তাশীল ভারতীয়ের মধ্যেও এই ধারণা বদ্ধমূল যে জগৎ মিথ্যা, জগৎ মায়া। আমি ছেলেবেলায় বাবার মুখে শুনেছি, ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। এ-যুগের বাঙালি ছেলেমেয়েও বাবা-মা’র মুখে একই কথা শুনছে! বাঙালি এত বদলেছে। তার জীবনশৈলী, মূল্যবোধ, সামাজিক প্রেক্ষিত, পারিবারিক পটভূমি, তার রাজনীতি, তার দর্শন সবকিছু বদলেছে, কিন্তু বদলেছে কি এই বদ্ধমূল ধারণা— জগৎ মিথ্যা?

তাকে যদি জিজ্ঞেস করা যায়, ‘জগৎ মিথ্যা’ এ-কথা তুমি বলছ কেন? সে কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে বলতে পারবে না, কেন বলছে। শুধু বলবে, বেদে বা উপনিষদে এই কথাই বলা হয়েছে, এটাই হিন্দু ধর্মের মূল শিক্ষা, সুতরাং সে হিন্দু হিসেবে এ-কথায় বিশ্বাস করে! অধিকাংশ ভারতীয়ের মতে আজও হিন্দু ধর্মের গোড়ার কথা— ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা!

এবার তাকে যদি জিজ্ঞেস করি, বেদ বা উপনিষদের কোথায় বলা হয়েছে এ-জগৎ মিথ্যা, বলতে পারো?

সে খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। হয়তো সামান্য অস্বস্তিতেও ভুগবে। তারপর একটু হেসে কিংবা একটু বিরক্ত হয়ে বলবে, গুরুজনদের কাছে তো ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছি, তাঁরা তো আর ভুল শেখাননি।

সমস্যা হল, এই গুরুজনরাও তাঁদের গুরুজনদের কাছে শিখেছিলেন একই ‘স্লোগান’— ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। এইভাবেই রিলেরেসের লাঠির মতো ধারণাটা চলে আসছে হাজার বছর ধরে, বংশ পরম্পরায়। কেউ একবারের জন্যেও থেমে গিয়ে প্রশ্ন তোলেননি, কেন বলব এ-কথা? এ-কথা কি সত্যি?

গুরুজনদের অমান্য করা হলেও এই প্রশ্নটি তোলা কিন্তু উচিত। কারণ, বেদ বা উপনিষদ কোথাও বলেনি, এই জগৎ মিথ্যা। বরং উলটো কথাই বলছে— এ-জগৎ মায়া নয়, সত্য! শুধু বেদ বা উপনিষদ নয়, আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে একই কথা। আমরা যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে বুঝি, তা হলে মন থেকে আমরা এই ধারণা উপড়ে ফেলতে বাধ্য হব যে এ-জগৎ মিথ্যা। কারণ, বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, এক উৎস থেকে এই জগতের সবকিছুর সৃষ্টি, সেই ‘উৎস’ যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই জগৎ। বেদ ও উপনিষদের মতেও সমস্ত মহাবিশ্বের কণায় কণায় উপস্থিত সেই ‘উৎস’, বিরাজমান সেই আদিসত্তা। সুতরাং উৎস বা আদিসত্তার মতো এ-জগৎও সত্য। আদিসত্তা সত্য অথচ সেই আদিসত্তা থেকে সৃষ্ট এই জগৎ মিথ্যা— এই ধারণা সত্য হতে পারে না।

আমি হয়তো বহু ভারতীয়ের কাছে এ-কথা বলে তাদের এই ধারণা থেকে টলাতে পারব না যে জগৎ মিথ্যা, জগৎ মায়া। তাঁদের বিশ্বাস জীবনে মোক্ষ লাভ করতে হলে, পুণ্য সঞ্চয় করতে হলে জগৎকে মায়া ও মিথ্যা বলে ত্যাগ করে সত্যোপলব্ধির দিকে এগোতে হবে।

জগৎ সত্য এবং জগৎকে উপভোগ করার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই— এ-কথা আমাদের সমাজে প্রায় বলাই যায় না। বললেই, সমাজের প্রবীণরা চিৎকার করে উঠবেন এই বলে যে, সমাজকে আমি অন্যায় ভোগবাদের লোভ দেখাচ্ছি এবং পাপের পথে নিয়ে যাচ্ছি। অধিকাংশ ভারতীয়ের মনে যেন জগৎকে উপভোগ করার ব্যাপারে একটি গভীর পাপ বা অন্যায়বোধ কাজ করে। এই পাপ বা অন্যায়বোধ তাঁদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, জগৎ হল মায়া। এই মায়া ক্রমাগত আমাদের লোভ দেখাচ্ছে অন্যায় করার জন্য, কিন্তু আমরা যেন সেই মায়ার ফাঁদে না পড়ি। মায়ার প্রলোভনে সাড়া দেওয়া হল পাপ। মায়ার বিচিত্র প্রলোভন থেকে মুখ ফিরিয়ে জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করলেই সত্যের পথে এগোনো যাবে, জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে।

এই পাপবোধ এমনভাবে গেঁথে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় মনে যে বিপরীত চিন্তা করাটাও অন্যায়। কেন পাপ হবে জগৎকে সত্য বলে মেনে তাকে উপভোগ করলে? যদি কেউ কখনও এই প্রশ্ন করেন, তাঁকে গম্ভীর ও কঠোর ভাষায় বলা হয়, ভারতের প্রাচীনতম ধর্মশাস্ত্র বেদ ও উপনিষদকে আপনি ‘চ্যালেঞ্জ’ করছেন? বেদ আর উপনিষদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণীই হল, জগৎ মায়া, জগৎ মিথ্যা। হিন্দুধর্মের সারকথাও তো তা-ই!

আসলে কিন্তু বেদ বা উপনিষদ একবারও বলছে না জগৎ মিথ্যা! আসলে বলছে নিরাসক্ত ভোগের কথা।

এই বইয়ের সূচনার অধ্যায়টির নাম দিয়েছি ‘পুরানো সেই দিনের কথা।’ সেই অধ্যায়ে আমি দেখিয়েছি বেদের বেশ কিছু অংশে এবং উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ডে কীভাবে এই জগৎকে জানবার, বোঝবার জন্য ভারতের প্রাচীন ঋষিরা সৃষ্টিরহস্য নিয়ে নানা গভীর ও জটিল প্রশ্নের সমাধান সূত্র বার করার চেষ্টা করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ছ’হাজার বছর আগে।

অবশ্যই বিজ্ঞানের ঘুম ভাঙেনি তখনও। তখনও ফোটেনি পরীক্ষামূলক আবিষ্কারের আলো। সেই অন্ধকার যুগে সত্যের আলোর সন্ধান করেছিলেন ঋষিরা, জগৎকে মায়া বলে ত্যাগ করে নয়, জগৎকে বাস্তব এবং সত্য বলে স্বীকার করে। প্রায় সমস্ত উপনিষদই নানাভাবে, বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে জানবার, তার সৃষ্টি রহস্য ভেদ করবার একাগ্র প্রচেষ্টা। তাই তো উপনিষদকে ‘জ্ঞানকাণ্ড’ নামে বেদ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আমরা ভুলে গেছি বা আমাদের ছেলেবেলার ভুল শিক্ষা আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে যে, বেদের দুটি ধারা পাশাপাশি প্রবাহিত ছিল। আগেই বলেছি, একটি ধারার নাম কর্মকাণ্ড। সেই অংশে শুধুই বৈদিক দেব-দেবীর স্তুতি, মন্ত্র ইত্যাদি। অন্য ধারাটি হল দার্শনিক জ্ঞানের। বিশ্বের রহস্য সন্ধানের। তাই এই ধারার নাম ‘জ্ঞানকাণ্ড’। ঋষিরা অরণ্যের নিভৃতে জ্ঞানচর্চা করতেন, জগৎ সম্পর্কে তাঁদের অদম্য জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতেন। সেই প্রাচীন আরণ্যক যুগের দার্শনিক জ্ঞানের সন্ধানই ক্রমে পরিণতি পেল, রচিত হল উপনিষদ।

প্রথমেই আমাদের যে অত্যন্ত জরুরি কথাটা মনে রাখতে হবে, তা হল, যদি ভারতের প্রাচীন ঋষিরা জগৎকে মায়া ও মিথ্যা বলে ত্যাগ করতেন, তা হলে উপনিষদ রচিত হত না। অথচ আমাদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা, এই উপনিষদে নাকি বলা হয়েছে জগৎ মিথ্যা! আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, উপনিষদ জগতের আদিসত্তা ব্রহ্মকে উপলব্ধি করবার এবং ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে জগৎ থেকে আলাদা করে নয়, জগতের মধ্যেই বিস্তৃত আদিসত্তা হিসেবে।

উপনিষদ ক্রমশ এই সত্যের সন্ধান পেয়েছিল যে ব্রহ্ম বা জগতের আদিসত্তা এক এবং অদ্বিতীয় হয়েও স্বইচ্ছায় দ্বিতীয় অর্থাৎ বহু হয়েছেন। কেন এই বহু হওয়া? মায়ার ফাঁদ পেতে আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে?

না, তা নয়, উপনিষদও বলছে, ব্রহ্ম বহু হলেন তাঁর একা লাগছিল বলে— তিনি সৃষ্টির রস আস্বাদন করতে চাইলেন। ব্রহ্মের এই বিচিত্র প্রকাশই জগৎ। তাই ব্রহ্মই জগৎরূপে প্রকাশিত হলেন। জগতের সর্বত্র সেই আদিসত্তা বিরাজ করছেন।

যে-জগৎ ব্রহ্মেরই বিচিত্র রূপ, সে-জগৎ মিথ্যা হবে কেমন করে? ব্রহ্ম যদি সত্য হয়, তা হলে জগৎও সত্য হতে বাধ্য।

ভাবলে বিস্ময়ের শেষ থাকে না যে কেমন করে জগৎ সম্পর্কে এই পরম সত্যে উপনীত হয়েছিলেন হাজার হাজার বছর আগে ভারতের ঋষিরা! কারণ আজ বোঝা যাচ্ছে, এই সত্য শুধু দার্শনিক অনুমান নয়, এই সত্যের অনেকটাই বিজ্ঞান প্রমাণিত। বিজ্ঞান স্পষ্টই বলছে— এই জগতের উৎস জগতের প্রতি অণু-পরমাণুতে উপস্থিত। সুতরাং জগৎ মায়া নয়, মিথ্যা নয়, বিশুদ্ধ বাস্তব।

অথচ, আমরা উপনিষদ, বিজ্ঞান কারও কথাই না শুনে শুধু আমাদের গুরুজনদের ভুল ধারণা ‘জগৎ মিথ্যা’কে সেই ছোটবেলা থেকে হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছি, যেমন করে পেরেকের মাথায় হাতুড়ি মেরে মেরে দেওয়ালে গাঁথা হয়। এমনই শক্ত সেই গাঁথুনি যে উপড়ে ফেলাই মুশকিল।

আমাদের মন থেকে এই ধারণাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন রামমোহন রায়। তিনিই বাঙালিদের মধ্যে নতুন করে উপনিষদ-চর্চার প্রবর্তন করেন। যাঁরা সংস্কৃত জানেন না সেই বাঙালিদের জন্যে তিনি পাঁচটি উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন। রামমোহন কি এই কাজ করেছিলেন বাঙালিকে জগৎ ত্যাগ করতে শেখাতে? রামমোহন ছিলেন বাঙালির নবজাগরণের প্রথম পুরুষ। কর্ম ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। জগৎ থেকে তিনি কোনওদিনই মুখ ফিরিয়ে নেননি। যদি জগৎকে মিথ্যা বা মায়া বলে তিনি উদাসীন হয়ে যেতেন, তা হলে তাঁর পক্ষে অন্তত সতীদাহ রোধ করা সম্ভব হত না। তিনি তাঁর কর্মপ্রেরণা, জীবন-উৎসাহন পেয়েছিলেন উপনিষদ থেকে। সেই উপনিষদকে তিনি সাধারণ বাঙালির মধ্যে কর্মপ্রেরণার এবং সত্যসন্ধানের প্রাণনরূপে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। উপনিষদ যদি বলত জগৎ মিথ্যা, জগৎকে ত্যাগ করো, তা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় কর্মবীর রামমোহন উপনিষদে উৎসাহী হতেন না, সেই উপনিষদের বাংলা অনুবাদ বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়েও দিতেন না। বাঙালিকে জগৎ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন রামমোহন।

উপনিষদের আর এক সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সারা বিশ্বে হিন্দুধর্মের ও উপনিষদের বাণী প্রচার করেছিলেন। তাঁর সেই প্রচারে কোথাও তিনি বলেননি জগৎকে মিথ্যা বলে ত্যাগ করার কথা। বিবেকানন্দ ছিলেন কর্মপ্রাণ। তিনি সন্ন্যাসী হয়েও জগৎ থেকে পালিয়ে যাননি। বরং আজীবন জগতের জন্যে, ভারতবাসীর জন্যে কাজ করেছেন। বলেছেন জগতের সেবাই মানুষের পরম ধর্ম। বিবেকানন্দের তেজস্বিতার দিকে তাকিয়ে অনেকের এই ধারণা হয়েছিল তিনিই যেন উপনিষদের বাণীমূর্তি। উপনিষদ যদি বলত জগৎ মিথ্যা ও মায়া, তা হলে বিবেকানন্দ উপনিষদে পেতেন না তাঁর প্রবল কর্মপ্রেরণার উৎস।

তবু, আমি লক্ষ করেছি, আজও যদি শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাঙালির কাছে কেউ বলেন, ‘ব্রহ্ম সত্য’, সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা শুনলেন এই দুটি শব্দ তাঁদের জিভের ডগায় অন্য দুটি শব্দও এসে যাবে— ‘জগৎ মিথ্যা’। ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই স্লোগানটি এমনভাবেই তাঁদের মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে। রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কেউ আমাদের জগৎ-ত্যাগের দীক্ষা দেননি। তবুও জগৎ-ত্যাগের মন্ত্রটি আমরা ভুলতে পারিনি। কেন এমন হল?

এমন হওয়ার প্রধান কারণ, সারা ভারত জুড়ে আদি শংকরাচার্যের প্রচার— হাজার বছর আগে শংকরাচার্যই প্রচার করেছিলেন এই ধর্মীয় স্লোগান— ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’। আগেই জেনেছি, শংকরাচার্য যে দর্শন প্রচার করেছিলেন তার একটি নাম অদ্বৈতবাদ। অন্য নাম মায়াবাদ।

অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য হল, ব্রহ্ম অর্থাৎ জগতের আদিসত্তা, তিনিই হলেন পরম ও অপরিবর্তনীয় সত্য। মহাপণ্ডিত, শাস্ত্রবিদ শংকরাচার্য নতুন ব্যাখ্যা লিখলেন উপনিষদের। এবং প্রচার করলেন এই অদ্বৈতবাদ যে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য— তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোনও দ্বিতীয় হয় না।

অদ্বৈতবাদের এই মূল বক্তব্য— ব্রহ্মের কোনও দ্বিতীয় হয় না, ব্রহ্ম একমেবাদ্বিতীয়ম্— এইখানে এসে সংকটে পড়লেন মহাপণ্ডিত শংকরাচার্য। তিনি প্রচার করছেন অদ্বৈতবাদ— অর্থাৎ এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মের কথা— তিনিই পরম সত্য। এ-কথা উঠে এসেছে উপনিষদ থেকেই। অদ্বৈতবাদ উপনিষদেরই অঙ্গ।

কিন্তু উপনিষদ ব্রহ্মকে অদ্বিতীয় সত্য বলেও জগৎকে মিথ্যা বলছে না। কারণ উপনিষদ বলছে, ব্রহ্মই স্বইচ্ছায় এক থেকে বহু হয়েছেন। এই জগৎ ব্রহ্মেরই বহুপ্রকাশ। সেই ‘বহু’-র মধ্যে বিরাজ করছে ‘এক’। অতএব ব্রহ্মকে সত্যজ্ঞান করলে জগৎকে মিথ্যা বা মায়া বলার কোনও প্রয়োজন নেই। উপনিষদের মতে তাই ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য। এই দুই সত্যের মধ্যে কোনও অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই। নেই কোনও বিরোধাভাস। ব্রহ্ম সত্য। সেই সত্য থেকেই আর এক সত্যের প্রকাশ। সেই সত্যের নাম জগৎ। কারণ সত্য থেকে কখনও মিথ্যার সৃষ্টি হতে পারে না। সত্য থেকে সত্যেরই সৃষ্টি হয়।

তবে উপনিষদ এই দুই সত্যকে দু’ভাবে চিহ্নিত করছে। অমূর্ত আর মূর্ত। ব্রহ্ম হল অমূর্ত সত্য বা জগতের অমূর্ত আদিসত্তা। অমূর্ত ব্রহ্মের বর্ণনা দিয়ে উপনিষদ বলছে, ব্রহ্ম অশব্দ, অস্পর্শ, অরূপ, অব্যয়, অনাস্বাদেয়, নিত্য ও অগন্ধ। এই হচ্ছে ব্রহ্মের অদ্বৈতরূপ। শংকরাচার্যও মেনে নিয়েছেন এই বর্ণনা।

একইসঙ্গে উপনিষদ বলছে এই স্পর্শময়, ঘ্রাণময়, বর্ণময়, অনিত্য, পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ হল অমূর্ত ব্রহ্মেরই মূর্ত প্রকাশ— অমূর্ত ইচ্ছে করেই মূর্ত হয়ে জন্মেছেন। ব্রহ্মের দুই প্রকার। মূর্ত ও অমূর্ত। দুই-ই সত্য।

উপনিষদ এ-কথাও বলছে, যে এই দুই সত্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। অমূর্ত ব্রহ্মের কোনও পরিবর্তন নেই, কোনও বিনাশ নেই। মূর্ত ব্রহ্ম অর্থাৎ জগৎ কিন্তু সদা পরিবর্তনশীল এবং অনিত্য। অথচ এই দুইয়ের মধ্যে কোনও বিরোধাভাস নেই। উপনিষদ বলছে, যে ব্রহ্ম অমূর্ত সত্য হয়ে চিরন্তন ও পরিবর্তনহীন আদিসত্তা, সেই ব্রহ্মই মূর্ত সত্য হয়ে পরিবর্তনশীল ও অনিত্য। একই সত্যের দুই দ্বন্দ্বহীন প্রকাশ।

উপনিষদের ঋষিরা হাজার হাজার বছর আগে অমূর্ত ও মূর্ত সত্যকে একই আদিসত্তার দুই প্রকাশ বলে ভেবে বিশ্বরহস্যের যে সমাধান করেছিলেন, তাই সঠিক। এ-যুগের বিজ্ঞানও যথেষ্ট প্রমাণ দিয়ে সেই কথাই বলছে।

অথচ হাজার বছর আগে শংকরাচার্য উপনিষদের নতুন ব্যাখ্যায় বললেন, ব্রহ্মের অমূর্ত রূপই সত্য, ব্রহ্মের মূর্তরূপ, অর্থাৎ এই জগৎ হল মায়া, মিথ্যা। ব্রহ্মের অমূর্তরূপকে সত্য বলে মেনে নিলে আমরা তাঁর মায়ারূপকে ত্যাগ করতে বাধ্য। এই হল শংকরাচার্য প্রচারিত অদ্বৈতবাদের সার কথা। তাই অদ্বৈতবাদের অন্য নাম মায়াবাদ।

কঠোর সন্ন্যাসী শংকরাচার্য এই জগতের বর্ণময়, গন্ধময়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুন্দর রূপকে মেনে নিতে পারেননি। মেনে নিতে পারেননি এই আপাত বিরোধাভাস যে সত্যও হতে পারে পরিবর্তনশীল, যেমন এই জগৎ। তিনি বললেন, এই সুন্দর জগৎ ব্রহ্মেরই সৃষ্ট মায়া। এই মায়ার ফাঁদে আটকে গেলে আমরা আদিসত্তা, চিরন্তন সত্য ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে পারব না। তাই জগৎকে ত্যাগ করো।

আগেও বলেছি এ-কথা, জগৎকে ত্যাগ করে আমরা যদি সবাই শংকরাচার্যের মতো সন্ন্যাসী হয়ে যাই তা হলে তো সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।

শংকরাচার্য যে উপনিষদের ব্যাখ্যা নিজের মনের মতো করতে গিয়ে ভুল করেছিলেন, তা প্রথম বলেছিলেন চৈতন্যদেব। তিনি অদ্বৈতবাদ থেকে ভক্তিবাদে সরে এসে বলেছিলেন, উপনিষদের অদ্বৈততত্ত্বের যে-ব্যাখ্যা শংকর করেছেন তা উপনিষদের মূল ভাবধারার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করতে পারেনি। চৈতন্যদেবের ভাষায় ‘গৌণার্থ করিল মুখ্য অর্থ আচ্ছাদিয়া।’ সামঞ্জস্য রক্ষা করতে না পেরে উপনিষদের যে-ব্যাখ্যা শংকর করলেন তার অর্থ পরিণতি পেল এই ভারতজোড়া প্রচারিত স্লোগানে— ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা।

শংকরাচার্যের মতো মেধাবী শাস্ত্রজ্ঞ মানুষ যদি আজকের বিজ্ঞানের সাহায্য পেতেন তা হলে হয়তো উপনিষদের নতুন ব্যাখ্যায় সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা তাঁর পক্ষে অনেক সহজ হত। কারণ আধুনিক বিজ্ঞান মূর্ত ও অমূর্ত সত্যকে সমানভাবে স্বীকৃতি জানাচ্ছে, যে-স্বীকৃতি কোয়ান্টাম তথ্যের প্রমাণিত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

একসময়ে বিজ্ঞান বলত, মৌলকণাই সবচেয়ে আদি। কিন্তু এই আধুনিককালে কোয়ান্টাম ফিল্ড দেখাল, মৌলকণা সবচেয়ে আদি নয়। সবচেয়ে আদি হল অন্তর্নিহিত ক্ষেত্র— উপনিষদে ব্রহ্মের বা আদি উৎসের বর্ণনার সঙ্গে এই অন্তর্নিহিত ক্ষেত্রের বর্ণনা আশ্চর্যভাবে মিলে যায়।

উপনিষদের ব্রহ্মের মতো এই অন্তর্নিহিত ক্ষেত্র বা ফিল্ড সমগ্র মহাশূন্য ও মহাকাল পরিব্যাপ্ত করে বিরাজমান। ক্রমান্বিত তার এই ব্যাপ্তি। এবং এই অন্তর্নিহিত ক্ষেত্র চিরন্তন সত্য। মহাশূন্য ও মহাকাশ ছেয়ে থাকা এই ক্ষেত্র ব্রহ্মেরই মতো ‘অব্যক্ত’।

দেখা গেল উপনিষদের একটি মূল মন্ত্রকে সমর্থন করছে এ-যুগের বিজ্ঞান। দেখা গেল উপনিষদের মূল মন্ত্রটি বলছে, ব্রহ্মের দুটি প্রকাশ, অমূর্ত ও মূর্ত। এ-যুগের বিজ্ঞানও বলছে, একই ক্ষেত্রের দুটি রূপ, অমূর্ত ও মূর্ত। বিজ্ঞানের এই প্রমাণিত সত্যটি যদি শংকরাচার্য জানতেন, তা হলে হয়তো তাঁর মনের মধ্যে মূর্ত আর অমূর্ত সত্যের দ্বন্দ্ব-সমাধান খুঁজে পেতেন। তিনি উপনিষদের নব ব্যাখ্যায় সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারতেন। তাঁকে বলতে হত না ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা।

প্রাচীন উপনিষদ ও আধুনিক বিজ্ঞানের হৃদয়কথা আশ্চর্য মধুর সাবলীলতায় প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়:

যে ছিল অমূর্ত, অসীম, অব্যক্ত তারই প্রকাশ ঘটেছে সীমার মধ্যে— সীমার মধ্যে অসীম, অর্থাৎ এই জগৎ, তাই এত সুন্দর—

সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর—

আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর॥

যে আদিসত্তা অমূর্ত, অর্থাৎ রূপহীন, সেই আদিসত্তাই বিশ্বজুড়ে প্রকাশ করল নিজেকে কত গন্ধে বর্ণে ছন্দে। লিখলেন রবীন্দ্রনাথ—

কত বর্ণে কত গন্ধে কত গানে কত ছন্দে

অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর।

এই অমূর্ত এবং মূর্তকেই যখন একই আদিসত্তার এপিঠ-ওপিঠ করে দেখতে পাই আমরা তখনই উন্মোচিত হয় আমাদের চেতনায় মহাবিশ্বের অন্তরসত্য—

তোমায় আমার মিলন হলে সকলই যায় খুলে,

বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।

সমসময়ে রবীন্দ্রনাথই প্রথম সাহসের সঙ্গে প্রবল প্রত্যয়ে উচ্চারণ করলেন প্রাচীন ঔপনিষদিক উপলব্ধি— ব্রহ্ম সত্য জগৎ সত্য।

সেই কথাটাই অসীম সাহসে, আমাদের এতদিনের ধারণাকে একেবারে ওলটপালট করে দিয়ে, কবিতায় বললেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র চারটি লাইনে তিনি যেন বিপ্লব ঘটালেন—

রূপনারানের কূলে

জেগে উঠিলাম;

জানিলাম এ জগৎ

স্বপ্ন নয়।

আমার জন্ম তমলুকে, রূপনারায়ণ নদীর কূলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘রূপনারান’ বোধহয় আমার চেনা সেই নদী নয়। তাঁর ‘রূপনারান’ অরূপের রূপমূর্তি। অমূর্তের মূর্ত প্রকাশের প্রতীক রূপনারানের কূল।

সেই অরূপ-রূপের কূলে উন্মোচিত হল রবীন্দ্রনাথের সত্যোপলব্ধি: বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।

জগৎ মিথ্যা— এই ভুল ভেঙে দিলেন তিনি। বললেন কুণ্ঠাহীনভাবে— ‘অরূপ’ যেমন সত্য তেমনই সত্য ‘রূপ’। এ জগৎ সত্য সত্য সত্য। এ জগৎ স্বপ্ন নয়।

জগৎ জুড়ে এনেছিলেন মোহিনীমায়া শংকরাচার্য। আচ্ছাদিত হয়ে ছিল সত্য। আমরা শংকরাচার্যের ভুল ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করে জগৎকে মিথ্যা বলতে শিখেছি, মায়া বলতে শিখেছি ছেলেবেলা থেকে। গুরুজনেরা যা বলেছেন তাই শিখেছি। নিজেরা কোনওদিন ভেবে দেখিনি। ভাবালেন আমাদের নতুন করে রবীন্দ্রনাথ। আমাদের চোখ থেকে শংকরাচার্য-প্রচারিত মায়ার ছায়া সরিয়ে দিলেন তিনি। আমাদের দিলেন নতুন যুগের মন্ত্র, শোনালেন নতুন সত্যের আহ্বান—

রক্ত আমার বিশ্বতালে নাচবে যে,

হৃদয় আমার বিপুল প্রাণে বাঁচবে যে।

কাঁপবে তোমার আলো বীণার তারে সে,

দুলবে তোমার তারামণির হারে সে,

বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে।

.

১. দ্বে বাব ব্ৰহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং চ। (বৃহদারণ্যক, ২।৩।১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *