১. বাংলাদেশে পূজা নামের এক মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। পূজার বয়স পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণ করেছে সাইফুল ইসলাম নামের বিয়াল্লিশ বছর বয়সী এক চার বাচ্চার বাবা। এই নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। লোকটিকে শিশুটি ‘বড় বাবা’ বলে ডাকতো। প্রতিবেশী ছিল লোকটি। হয়তো শিশুটি সাইফুল ইসলামের কন্যাদের খেলার সাথী ছিল। যতদূর জানি শিশু-ধর্ষণের সত্তরভাগই ঘটায় পরিবারের পুরুষ, নিকটাত্মীয়, অথবা পাড়াতুতো কাকা-জ্যাঠা-ঠাকুরদা, অথবা চেনা কোনো লোক। সাইফুল ইসলাম পাড়াতুতো জ্যাঠা ছিল পূজার। এই লোকটি, আমার আশঙ্কা, তার কন্যাদেরও ধর্ষণ করেছে, ধর্ষণ করার সুযোগ যদি না পেয়েও থাকে, তাহলে ধর্ষণ করার সুযোগ খুঁজেছে, সুযোগ না পেয়ে মনে মনে প্রতিদিনই ধর্ষণ করেছে। মেয়েদের ‘নিরাপত্তা’ বলতে কিছু আর নেই পৃথিবীতে।
বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়নি এমন শিশুদের প্রতি যদি কারো যৌন আকর্ষণ থাকে, তাহলে তাকে ইংরেজিতে ‘পিডোফাইল’ বলা হয়। পিডোফাইলের কোনো বাংলা আছে কিনা জানি না, আমিই বাংলাটা আপাতত করে নিচ্ছি— শিশুধর্ষণেচ্ছুক। নারীর চেয়ে পুরুষেরাই বেশি শিশুধর্ষণেচ্ছুক।
শুধু পিডোফাইল-ই নয়, সমাজে হেবেফাইল, এফেবোফাইল-ও আছে। হেবেফিলিয়া মানে ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ। এফেবোফিলিয়া মানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ। হেবেফিলিয়াকে না হয় বাংলায় ছোট কিশোরী ধর্ষণেচ্ছা, আর এফেবোফিলিয়াকে বড় কিশোরী ধর্ষণেচ্ছা বলছি। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে পুরুষেরা শিশু কিশোরীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, কেন করে, এবং এরা কারা?
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এরা আমাদের আশেপাশেই, আমাদের সঙ্গেই বাস করে। এরা যে কোনো সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখতে। আমাদেরই বাবা, ভাই, আমাদেরই মামা, কাকা, আমাদেরই বন্ধু, প্রতিবেশী। শিশু কিশোরীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে, এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে অনেক, তবে সবাই যে উদ্যোগ নেয় যৌন ক্রিয়া বা ধর্ষণ করতে তা নয়। অধিকাংশ পুরুষই চেষ্টা করে সমাজের কথা ভেবে নিজেদের সংযত করতে। তারা জানে তাদের কামনা বাসনা মানবতাবিরোধী। কিছু পুরুষ তো রীতিমত ডাক্তারের পরামর্শে নিজেদের অতিরিক্ত বা অবাধ যৌন-ইচ্ছে কমাতে ওষুধ সেবন করে। তারা টেস্টস্টেরন হরমোন শরীর থেকে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। যারা নিজেদের সংযত না করে, তারা সুযোগ পেলে শিশু কিশোরীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু লোক আছে শিশুদের ধর্ষণ করে, শিশু ছাড়া তারা আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না। আবার আরেক দল শিশু ধর্ষণ করে, কারণ শিশু ধর্ষণের সুযোগ পেয়ে যায় বলে, শুধু শিশু নয়, প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিও তাদের সমান যৌন আকর্ষণ। যারা শিশু ছাড়া আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না, তারা, কিছু মনোবিজ্ঞানী বলেন, মানসিক রোগী। তাদের মস্তিষ্ক অন্যান্য মানুষের মস্তিষ্কের মতো নয়। আবার অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, শিশু ছাড়া আর কারও প্রতি যৌন আকর্ষণ না থাকা কোনো মানসিক সমস্যা নয়, এ নিতান্তই রুচির তফাত। এদের মধ্যে যারা সৎ, দায়িত্ববান, তারা নিজেদের যৌনাকাঙ্ক্ষা সংযত করে, আর যারা তা নয় তারা চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করে, অন্যায় করে, তারা ধর্ষণ করে।
এখন যেহেতু মস্তিষ্কের ওপর কারো হাত নেই, যেহেতু তারা জন্মই নেয় শিশুকামী হয়ে, অথবা যে কোনো কারণেই হোক তারা শিশুকামী, আমরা তাদের উপদেশ দেব, শিশু ধর্ষণ বন্ধ করার সব রকম উদ্যোগ নিতে। শিশুদের আঘাত করার, নির্যাতন করার কোনো অধিকার তাদের নেই, শিশুদের ধর্ষণ করার কাজ যেন তারা কখনও না করে। তারা যদি একা সামলাতে না পারে তাদের সমস্যা, যেন শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানিয়ে দেয় যে তারা শিশুকামী, এই কাম দূর করার জন্য সবার সহযোগিতা চায়।
অনেকের ইচ্ছে করে কিছু লোককে খুন করার। কিন্তু তারা খুন করে না। খুন করা ভাল নয় বলে করে না। তেমনি যাদের ইচ্ছে করে ধর্ষণ করতে, তারাও যদি ভেবে নিতো, ধর্ষণ করার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু করব না, কারণ ধর্ষণ করা ভাল নয়।
আমরা তাদের দোষ দিতে পারি না, কেন তাদের ধর্ষণ করার ইচ্ছে হয়? মস্তিষ্ক বড় জটিল, সমাজের ভাল মন্দ বুঝে এ গড়ে ওঠে না, আমরা একে ভাল মন্দের শিক্ষা দিয়ে বড় করি।
২. যে সব দেশে ধর্ষণ সবচেয়ে কম, সেসব দেশে পুরুষাঙ্গ কর্তন বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নেই। তবে সেসব দেশে মেয়েদের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকার সেসব দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, সেসব দেশে মেয়েরা শিক্ষিত, মেয়েরা স্বনির্ভর, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ ছাড়াই সংসদ সদস্যের পঞ্চাশ ভাগই মেয়ে।
নাবালিকা-সাবালিকা সব ধর্ষণই বহাল তবিয়তে চলে সেসব দেশে, যেসব দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের ভোগের বস্তু, দাসী-বাঁদি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন প্রাণী, নিচুজাতের জীব ইত্যাদি হিসেবে বিচার করে; যেসব দেশে পতিতালয় গিজগিজ করছে, শত শত বাচ্চা-মেয়েকে যৌনপাচারের শিকার করা হচ্ছে; যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, স্বামীর অত্যাচার, পণের অত্যাচার, পণ অনাদায়ে খুন— এই দুর্ঘটনাগুলো প্রতিদিন ঘটছে, ঘটেই চলছে।
ধর্ষণের সঙ্গে যৌন সঙ্গমের সম্পর্ক আছে। কিন্তু ধর্ষণ মানেই যৌন সঙ্গম নয়। অধিকাংশ ধর্ষক যৌন-ক্ষুধা মেটানোর জন্য ধর্ষণ করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আরেক নাম ধর্ষণ।
ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে অথবা কী করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নটির সবচেয়ে ভালো উত্তর, ‘যেদিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সেদিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ’। কবে কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। সম্মিলতভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এইসব নির্যাতন তারা আর করবে না।
৩. পূজা হিন্দু পরিবারের মেয়ে। পূজার জীবনে যা ঘটলো, তা দেখে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অনেক হিন্দু পরিবার তাদের কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবে।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬