এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট

এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট

সব ব্যাপারেই আজকাল: স্পেশালিস্ট। সেদিন মার্কিন মুলুকে এক স্পেশালিস্টই আবিষ্কার করেন যে শোভাযাত্রা, বয়কট বা ধর্মঘটে যারা কালো ঝাণ্ডা তুলে হই হই করে, তাদের অনেকেই ভাড়াটে। এ তত্ত্ব আমাদের কাছে নতুন নয়; দিল্লিতে থাকাকালীন স্বর্গত অশ্বিনী গুপ্ত আমাকে দিল্লিতে যে ‘হাঙার স্ট্রাইকে’র জন্য প্রতিষ্ঠান আছে, যিনি হাঙার স্ট্রাইক করবেন তার জন্য শামিয়ানা, তাকিয়া-বালিশ, নির্জলা না হলে নিম্বুপানি– তদভাবে জিন্ (যদি তিনি মদ্যপ হন), কারণ বলতে গেলে একমাত্র জিনই সহজলভ্য কড়া ড্রিঙ্কের ভিতর জলের রঙ ধরে, আহারাদি, হ্যাঁ, আহারাদিই বলছি কারণ লুকিয়ে লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইকার যদি খেতে চান তবে গভীর রাত্রে তার সুব্যবস্থা– সেদিকে আমার ভোঁতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এবং যিনি আজও এ-প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি মার্কিনি স্পেশালিস্ট নন, নিতান্ত দিশি মাল– এবং সর্বোপরি তিনি ‘এমেচার’!

এসব তো মস্করার কথা– যদিও দুটোই ডাহা ইমানসে সত্য। তবে দিল্লির প্রতিষ্ঠানটি নাকি ‘সদাচার কদাচারে’র উৎপাতে ইদানীং বড়ই উৎপীড়িত (‘তংগ আ গয়ে’); তার অর্থ অবশ্য এ-নয় যে ‘হাঙার স্ট্রাইক’ করার কারণের কিংবা/এবং অকারণের অজুহাত অছিলার অভাব ঘটেছে কিংবা ‘হাঙার’-এর হাঙরদের ক্ষুধানিবৃত্তি ঘটেছে– আসল কারণ ওটা নাকি রেশন্ড হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ ‘লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইক’, ‘ফাস্ট আনটু ডেথ’ এসব করতে হলে সেগুলো এখন করবেন সরকার স্বয়ং! আনাড়ি এমেচারদের হাতে আর এসব টপ প্রায়োরিটির বস্তু ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেশ-বিদেশে বড্ড বেইজ্জতি হয়। আইরল্যান্ডের কে যেন ম্যাকসুইনি না কী যেন নাম, সে নাকি বাষট্টি বা বিরানব্বই দিন নাগাড়ে উপোস মেরেছিল– এমতাবস্থায় ভারত যদি বাহান্ন দিনের রেকর্ড দেখায় তবে সেটা হবে সত্যই ‘শরমকি’ ঘুড়ি ‘লজ্জাকি, ঔর আফসোস–’ থুড়ি পশ্চাত্তাপকি বাৎ!

তৎসত্ত্বেও এমেচারকে ঠেকানো যায় না– বারট্রান্ড রাসূলের মতো নিরহঙ্কার লোক পর্যন্তও চেষ্টা দিয়ে হার মেনেছেন।(১) স্বয়ং রবি ঠাকুর এই এমেচারি কর্মে বড়ই সুখ পেতেন। আমি তামা-তুলসী স্পর্শ করে একশ’বার কিরে কাটতে রাজি আছি, তাঁকে মধ্যমশ্রেণির হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বললে তিনি সেটাকে কবিতায় নোবেল প্রাইজ পাওয়ার চেয়ে লক্ষণে শ্রাঘনীয় বলে মনে করতেন। ঠিক তেমনি স্পেশালিস্ট সত্যেন বোস তাঁকে দিলেন টুইয়ে– বিজ্ঞান শিখতে হয়, সে-ও না হয় বুঝি শেখাতে! অর্থাৎ ‘মেস্টারি’ করতে। তা হলে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন। বাজারে যেগুলো মেলে সেগুলো লিখেছেন বটে বিশেষজ্ঞরা– একশ’বার মানি– কিন্তু যে বাংলাভাষায় লিখেছেন সেটা, ওই যে ফরাসিতে বলে, ‘ইলজ এক্ৰিভ ফ্রাঁসে কমলে ভাশ এস্পানিয়োল’–তেনারা ফরাসি লেখেন স্প্যানিশ গাইয়ের মতো।(২) রবি ঠাকুর আর যা করুন, তাঁর বাংলাটা অন্তত বোধগম্য হবে। থাক না দু-পাঁচটা ভুল এদিক ওদিক। সেগুলো মেরামত করার জন্য তো ওই হোথায় সত্যেন বোস বসে।

যৌবনে রবীন্দ্রনাথ একদিন শব্দতত্ত্ব নিয়ে তর্কাতর্কির দায়ে মজে যান। বৃদ্ধ বয়সে বোধ হয় সুনীতিবাবু এবং/কিংবা গোসাঁইজির প্ররোচনায়– তাবৎ বাংলাভাষাটা নিয়ে খুব একচোট তলওয়ার খেলা দেখিয়ে দিলেন। আহা সে কী স্বচ্ছ সুন্দর তরল ভাষা– যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে। কে বলবে, বিষয়বস্তু নিরস শব্দতত্ত্ব– হুস হুস করে পাতার পর পাতা সিনেমার ডেলি ক্যালেন্ডারের পাতার পর পাতা ওড়ার মতো পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দুম করে সম্বিতে ফিরে আসবেন। এমেচার আর্টিস্ট যেন লাজুক হাসি হেসে ঘন ঘন করতালির মধ্যিখানে শেষ বক্তব্য নিবেদন করছেন। কী বলছেন? বলছেন, তিনি শব্দতাত্ত্বিক নন– নিতান্ত এমেচার– তাই খুব সম্ভব হেথা হোথা বিস্তর গলদ থেকে যাবে।

তার পর তিনি যে মুষ্টিযোগের শরণ নিয়েছেন সেইটে তিনি কালিদাসের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেটা তার শক্তি (fort)-ও বটে, দুর্বলতাও যদি অপরাধ না নেন– বটে, কিন্তু এস্থলেও তিনি যে-তুলনাটি ব্যবহার করেছেন সেটি উপমা কালিদাসস্যকেও হার মানায়। তিনি বলছেন, ‘কোনও কোনও বিখ্যাত রূপশিল্পী শরীরতত্ত্বের যথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন (যেমন সেজানের ওয়েস্ট কোট-পরা ছোকরাটির হাত আজানুলম্বিত না বলে আগুলফ-লম্বিত বললেই ঠিক হয় কিন্তু তৎসত্ত্বেও ছবিটি রসে ভর্তি যাকে আজকের দিনে রসোত্তীর্ণ’ বলা হয়, ঠিক তেমনি কবির ভাষা সম্বন্ধে এ-বইয়ে দুই-পাঁচটি ভুল বা অর্ধসত্য পরিবেশিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এসব ভুল মেনে নিয়েও দেখা যায় এরকম তুলনাহীন প্রবন্ধ হয় না।’ কারণ তথ্য-পরিবেশনে অসম্পূর্ণতা থাক আর না-ই থাক, সবসুদ্ধ মিলিয়ে প্রবন্ধটি বাংলা ব্যাকরণ (খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ– বাংলার ছদ্মবেশ পরে সংস্কৃত ব্যাকরণ নয়।) এবং খাঁটি বাংলা অলঙ্কার নিয়ে এক অভূতপূর্ব রচনা। যেমন তিনি বলছেন, চলতি বাংলাতে শুরুচণ্ডালী এখন আর দোষের মধ্যে গণ্য নয়।

ঠিক এই জিনিসটেই আমরা অন্যান্য সাহিত্যিকের কাছে প্রত্যাশা করি। কারণ সাহিত্যিকের সঙ্গে ভাষার যে-পরিচয় হয় সেটা আদৌ শব্দতাত্ত্বিক বা ভাষাতাত্ত্বিকের মতো নয়। সে-ভাষা ব্যবহার করে নতুন নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে। তাই তার ভাষা সদা পরিবর্তনশীল। অত্যুত্তম গ্রন্থ লিখে ভাষাবাবদে আপামর জনসাধারণ তথা বৈয়াকরণিকের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেলেও লেখক তার পরবর্তী পুস্তকে সেই অনুমোদিত ভাষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না, রবীন্দ্রনাথের তুলনায়, আপনার মালের রিসিভার অব স্টোলেন প্রপার্টি হতে চায় না। তাই তাকে প্রতিদিন নিত্য নবীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং সেখানে সে কোনও বৈয়াকরণিক, কোনও শব্দতাত্ত্বিকের সাহায্য পায় না। তাই, প্রাচীন লেখক যখন নতুন শব্দভাণ্ডার বচনভঙ্গি নিয়ে পুনরায় একখানা সার্থক গ্রন্থ লেখেন, তখন সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি হয়। এ কর্ম শব্দতাত্ত্বিক করতে পারেন না– অবশ্য তিনি যদি সাহিত্যিকও হন ও তার তত্ত্বগ্রন্থখানি সাহিত্যের পর্যায়ে তুলতে পারেন তবে অন্য কথা।

তাই ভাষার নব নব রূপ দেখাবার জন্য সাহিত্যিককেও এমেচারি শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়।

এবং শুধু সাহিত্যিকই না, যে-ব্যক্তিই জ্ঞান-বিজ্ঞান বা অন্য যে-কোনও চিন্ময় বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন, আলোচনা করেন, তাঁকেই কিছু-না-কিছু শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এই তত্ত্বটি হঠাৎ আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল, মুসলমানদের সন্ত ইমাম আবু হানিফার বিরাট ন’ভল্যুমি গ্রন্থের একটি জায়গা পড়ে।

ইমাম আবু হানিফা শিষ্যসমাবৃত হয়ে প্রতি প্রাতে বসতেন মুসলিমধর্ম আলোচনায়। তার রায় লিখে রাখা হত তো বটেই, তাঁর প্রধান শিষ্যদের কেউ ভিন্ন রায় (মিনিট অব ডিসেন্ট) প্রকাশ করলে সেটিও সযত্নে পাশাপাশি লিখে রাখা হত।

একদা প্রশ্ন উঠল, ‘নগরে জুমার নমাজ অবশ্য পালনীয়; কিন্তু গ্রামে জুমার নমাজ হয় না’– এ-আদেশ শিরোধার্য করব কি না? ইমাম সাহেব, বললেন, ‘শিরোধার্য করা,–করার পূর্বে প্রথম দেখতে হবে “নগর” বলে কাকে, আর “গ্রাম” বলে কাকে?’ জনৈক শিষ্য বললেন, ‘অভিধান দেখলেই হয়।’ এবারে ইমাম যা বললেন, সেটি মোক্ষম তত্ত্বকথা– সর্বভাষাতে সর্বকালে প্রযোজ্য। তিনি বললেন, ‘কোষকার দেবে সাধারণ প্রচলিত অর্থ। পক্ষান্তরে আমরা ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন করে জনসাধারণের জন্য অনুশাসন প্রচার করি (অর্থাৎ আমরা theologians); থিয়োলজিয়ানের দৃষ্টিবিন্দু থেকে কোটা শহর– যেখানে জুম্মার নমাজ সিদ্ধ– এবং কোনটা গ্রাম যেখানে জুমার নমাজ অসিদ্ধ– তার শেষ বিচার তো আমাদের হাতে।’  

অত্যন্ত খাঁটি কথা। যেমন ধরুন গরুর বাথান, যেখানে রাখালরা শীতকালে থাকে। সেটাকে হয়তো গ্রামের পর্যায়েও ফেলা যাবে না। কিংবা উত্তম মরূদ্যান পেয়ে হাজার লোকের কাফেলা (ক্যারাভান) কয়েক দিন বিশ্রাম করল। সেখানে জুম্মার নামাজ সিদ্ধ না অসিদ্ধ?

ইমাম সাহেব বলছেন, থিয়োলজিক্যাল অর্থে কোনটা গ্রাম, আর কোনটা শহর, তার সংজ্ঞার (definition-এর) জন্য কোষকার তো আসবে আমাদেরই কাছে।

ঠিক তেমনি আইনজ্ঞ পণ্ডিতরা সংজ্ঞা দেন কোনটা crime, আর কোনটাই-বা tort; তবে তো কোষকার সেটা তার অভিধানে লিপিবদ্ধ করে। সে তো আর বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটিতে বিশেষজ্ঞ নয় যে, নিছক আপন বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শব্দের সংজ্ঞা দেবে, বর্ণনা দেবে, প্রতিশব্দ দেবে।

ঠিক এই জিনিসটি বাংলা দেশে এখনও আরম্ভ হয়নি।

সবাই তাকিয়ে আছেন কোষকারের দিকে। সে পরিভাষা বানিয়ে দেবে। আর সে বেচারি তাকিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদির পণ্ডিতদের দিকে। তাঁরা সংজ্ঞা দেবেন এবং তাঁদের অধিকাংশই শব্দ বা ভাষাতাত্ত্বিক নন, সে বাবদে নিতান্তই এমেচার–তবে তো কোষকার সেগুলো লিপিবদ্ধ করবে–
২৬।২।৬৬

———

১. এ বাবদে তাঁর বিদকুটে রায়; সর্ব পণ্ডিত যখন কোনো তত্ত্ব একবাক্যে স্বীকার করে নেন, তখন তুমি এমেচার সেখানে ফপরদালালি করতে যেয়ো না। আর যেখানে তারাই একমত হতে পারছেন না সেখানে তুমি নাক গলাতে যাও কোন দুঃসাহসে? এর বিগলিতাৰ্থ : তুমি এমেচার ঠোঁট দুটি সেলাই করে বসে থাকো। এমনকি কেউ যদি বলে, Fine Weathereh? তুমি হ্যাঁ না। বলতে পারবে না। তুমি ওয়েদারের জানো কী? প্রথম গ্রিনিজকে শুধোবে আবহাওয়ার দফতরে। তারা যদি বলে ফাউল’ তবে ফাউল– তা তুমি যেখান থেকে কথা বলছ সেখানে থাক না মলয় পবন আর সূর্যাস্তের লালিমায় রঙিন গোলাপি আকাশ! এস্তেক তোমার নাম যদি অতুল’ হয় তবে তোমার বিপদ প্রত্যাসন্ন। শিশির ভাদুড়ী বলতেন অ (ঘর-এ যে অ’ উচ্চারণ), আর রবি ঠাকুর বলতেন ‘ওতুল’– কিন্তু তিনিও আবার ‘ওতুলনীয়’ না বলে বলতেন ‘অতুলনীয়’। অর্থাৎ বারট্রান্ড রাসলের অনুশাসন মানলে তোমাকে নাম বদলে ‘মাকাল-টাকাল’ কিছু একটা ‘দশদিশি নিরদ্বন্দ্বা’ নাম রাখতে হবে।

২. আমার টায়-টায় মনে নেই তবে রাজশেখর লেখেন, ‘নেত্রজনের উপস্থিতিতে অসিতলীনের উপর কুলহরনীর প্রতিক্রিয়া’ শুনে মনে হয় সক্কলের সজাগ দৃষ্টির সামনে (এখানে পাঠক আমার তরফ থেকে একটা ভদ্রজনোচিত গলাখাকারি অনুমান করে নেবেন। ধন্যবাদ!) কোনো বেহেড় বেলেল্লাপনা। উঁহু, আপনার পাপ মন, পাঠক, আপনার পাপ মতি। এর অর্থ হচ্ছে আবার বলছি টায়-টায় মনে নেই– The reaction of chlorine (কুলহরনীর) on actylene (অসিতলীন) where nitrogen (নেত্রজন) is present.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *