এমন যদি হতো

এমন যদি হতো

আমেরিকা দেশটার জ্ঞান-বিজ্ঞান দখলে নিচ্ছে দুটি জাতি। একটা হলো চাইনিজ, অন্যটি ভারতীয়। এই দুই জাতির মানুষ সারা আমেরিকার আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে। চীন-ভারতের শত সহস্র ছেলেমেয়ে আমেরিকার হাজারো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে আছে। এ দেশের এমন কোনো ইউনিভার্সিটি পাওয়া যাবে না, যেখানে চীনের ছেলেমেয়ে নেই। ঢাল-তলোয়ার, কামান, বন্দুক ছাড়া যেভাবে তারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়েছে, পৃথিবীর স্মরণকালে কোনো জাতি এমনভাবে ছড়াতে পারেনি। তারা ছড়িয়েছে মাথা দিয়ে। আমেরিকায় আমি কোনো চাইনিজ ছেলেমেয়েকে শ্রমনির্ভর কাজ করতে দেখি না। তাদের জায়গা হলো আমেরিকার বিদ্যালয়গুলো। এই একই দৃশ্য আমি ইউরোপেও দেখেছি।

চীনের তরুণ গং ওয়াং এসেছে আমার ল্যাবে ইন্টারভিউ দিতে। তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। ছেলেটা স্নাতক করেছে পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে। পিকিং ইউনিভার্সিটি হলো চীনের নাম্বার ওয়ান ইউনিভার্সিটি। পিকিং থেকে স্নাতক করে সে এসেছে। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-অস্টিনে (UT at Austin) পিএইচডি করতে। ইন্টারভিউর সময় সে আমাকে বলল, মাত্র চার বছরে সে এইচডি শেষ করেছে। যেখানে, আমেরিকায় গড়ে পাঁচ-ছয়। বছরের আগে পিএইচডি শেষ করা যায় না। গং ওয়াং হলো। আমেরিকার লাখো চীনা তরুণের মাত্র একজন। চীন তার দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। সে পরিবর্তনের ফসল। হিসেবে সারা দুনিয়াতে তাদের ছেলেমেয়েরা অনায়াসে ঢুকে। পড়ছে। তাদের প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই। গত শিক্ষাবর্ষে প্রায় সাড়ে তিন লাখ চীনা ছেলেমেয়ে ঢুকেছে শুধু আমেরিকায়! এতে করে কিন্তু চীনের লোকসান হচ্ছে না, বরং লাভ হচ্ছে বহুগুণ। কারণ এই লাখো তরুণের মধ্য থেকে কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চীন তার দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেয়। বিদেশে দক্ষ হওয়া একটা তরুণকে চীন ঠিকই তার দেশের জন্য কাজে লাগাতে পারছে।

একবার ভেবে দেখুন, আমাদের দেশের শিক্ষায় একটা অভাবনীয় পরিবর্তন করা হলো। দেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে শুধু মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলো। শিক্ষকদের বেতন, প্রমোশন শুধু শিক্ষকতা ও গবেষণার ভিত্তিতে বাড়ানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হবেন বিদগ্ধজন। তাদের ক্যারিয়ার থাকবে ঝকঝকে ও তীক্ষ্ণ। জ্ঞান গবেষণায় তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড হবে ঈর্ষণীয়। গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলোর চেয়ারম্যান, মেম্বাররা হবেন সত্যিকারের গবেষক। সচিবালয় থেকে একজন আমলাকে নিয়ে সেখানে। বসানো হবে না। রাজনৈতিক দলের একজন গোলামকে বসানো। হবে না ইউজিসির চেয়ারম্যান কিংবা ইউনিভার্সিটির ভিসি হিসেবে। তাহলে আজ হাজারো ছেলেমেয়ে দেশ থেকে পড়াশোনা করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ত। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বিদেশে এসে তরুণেরা শ্রমজীবী হতেন না। তারা হতেন পৃথিবীর বিদ্যাপীঠগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। দুনিয়ার মানুষজন বাংলাদেশটাকে আরও ভালো করে। চিনতেন। দেশে বেকারত্ব হাস পেত। সারা দুনিয়ার জ্ঞান গবেষণার বহু শাখায় দেশের দক্ষ ছেলেমেয়ে তৈরি হতো। তাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উপকৃত হতো দেশ। আর সেসব মেধাবী ও দক্ষদের মধ্য থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে আবার নিয়োগ হতো, তাহলে বাংলাদেশটা মূল থেকে বদলে যেত। মেধার লড়াইয়ের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠত। জ্ঞান-গবেষণায় সত্যি সত্যি আমরা আজ চীন-ভারতের সমান্তরালে চলতাম।

সারা দুনিয়া থেকে আমরা খাবার সংস্কৃতি নেই, পোশাক সংস্কৃতি নেই, বাংলিশে কথা বলার ঢঙ ধার করি, ইংরেজিতে কথা বলার ভাব ধার করি, নাটক-মুভি অনুসরণ করি কিন্তু সারা। দুনিয়ার শিক্ষা ও গবেষণার সংস্কৃতিটা কেন যে আমরা ধার করি না, অনুসরণ করি না, সেটা আজও বুঝি না। এমন যদি হতো, আমরা সারা দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুধু ভালোগুলো বেছে বেছে নিয়েছি, তাহলে দুনিয়া থেকে আর কিছু না নিলেও এত দিনে আমরা স্বনির্ভর, সুষম, সুন্দর একটা সমাজ গড়তে পারতাম।

এমনটি কী হবে?