এমন বাদল দিনে
হাওয়া-অফিস যাই বলুন, তাঁদের ভবিষ্যৎবাণী নস্যাৎ করে পালিয়ে যাওয়া হুলো বেড়ালের মতো বর্ষা নিঃশব্দে ফিরে এসেছে।
এবং এখন অন্তত মাস তিনেক সে থাকবে। তার বিদায় নিতে নিতে শরৎকাল গড়িয়ে যাবে।
ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি কী কী দিনে অবশ্যই বৃষ্টি হবে তা নিয়ে সাধারণ বঙ্গবাসীর একটা সংস্কার আছে। এর মধ্যে প্রথমেই আছে আষাঢ়ের প্রথমভাগে হিন্দুর অম্বুবাচী তদুপরি পয়লা আষাঢ়।
সেই কতকাল আগে মহাকবি কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’র কথা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও কবিতায় সেই বক্তব্যে ডিটু দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা এ বছর উপগ্রহ বলেছিল, মৌসুমি বৃষ্টি এসে যাচ্ছে ৮ জুন। তারপর পিছোতে, পিছোতে, আকাশে মেঘ করে, মেঘ ভেসে যায় বৃষ্টি আর আসে না। চটচটে ঘাম, গরম চল্লিশ ডিগ্রি ছোঁয় ছোঁয়, প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
অধীর প্রতীক্ষা করতে করতে অবশেষে বৃষ্টির ভরসা যখন প্রায় সবাই ছেড়ে দিয়েছে ঠিক তখনই পয়লা আষাঢ়ে বৃষ্টি নামল। জ্যৈষ্ঠশেষের স্বেদসিক্ত, গ্রীষ্ম জর্জরিত নিশাবসানে জানালায় দেখি বৃষ্টির মেঘ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। তারপরে তুমুল বৃষ্টি।
মধ্যে কয়েকদিন বৃষ্টির খামতি হয়েছিল। দু’-একদিন হল বর্ষা রাজরানির মতো ফিরে এসেছে।
সে যা হোক, বাঙালির চিরাচরিত ভাবনায় সারা বছরে অবশ্যম্ভাবী বৃষ্টির কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট আছে। পয়লা আষাঢ়, অম্বুবাচীর পরে রথযাত্রার দিন, সোজা রথ আর উলটো রথ দু’দিনই নিশ্চয়ই বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিভেজা নয় এমন রথের দিন কল্পনাই করা যায় না। তা হলে তো পাঁপড় ভাজার স্বাদই পাওয়া যাবে না।
রথের পর বৃষ্টিবহ তিথি হল ঝুলন পূর্ণিমা। তারপরে মনসা পুজো। অবশেষে বিজয়া দশমী। এক বছরের মতো বৃষ্টির পালা শেষ। তবে পূর্ববঙ্গে কার্তিক মাসের গোড়ায় কাটতান নামে একটা ধারাবাহিক বৃষ্টি আমরা ছোটবেলায় দেখেছি।
তবে সেই সব পঞ্জিকাসিদ্ধ বৃষ্টির বাইরে আধুনিক যুগে দুটি নতুন বৃষ্টির দিন যুক্ত হয়েছে।
এর একটি হল পঁচিশ বৈশাখ। কোথাও কিছু নেই। কোথা থেকে ঝড়বৃষ্টি এসে প্যান্ডেল ভাসাবেই। ভেজা বাঁয়া তবলায় তবলচির হাতের তালু বারবার পিছলিয়ে যাবে।
আর আছে ভরা বর্ষায় আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বৃষ্টিসিক্ত পনেরোই আগাস্ট। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসে অঝোরে ভেজে।
আষাঢ় মাসের এই বৃষ্টির দিনে দু’-একটা আষাঢ়ে গল্প স্মরণ করি। প্রথম গল্পটি বহু কথিত, বহু পঠিত গোপাল ভাঁড়ের। গল্পটি আমিও মাঝে মধ্যে লিখে থাকি, সেই সুবাদে আবারও লিখছি।
প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে পরপর কয়েকদিন। কৃষ্ণনগরের পথঘাট অতিশয় কর্দমাক্ত, ভয়াবহ পিচ্ছিল। গোপাল ভাঁড়ের, এই রকম দুর্যোগের দিনে রাজসভায় আসতে দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র খুবই কড়া প্রশাসক। গোপাল ভাঁড় আসতে তিনি দেরি করার কৈফিয়ত চাইলেন।
গোপাল বললেন, ‘রাস্তা যা পিছল হাঁটতে গেলে এক পা এগোলে দু’ পা পিছিয়ে যেতে হয়।’
রাজা বললেন, ‘তা হলে এলে কী করে?’
গোপাল বললেন, ‘বুদ্ধি করে উলটো দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগলাম, তাই এসে পৌঁছাতে পারলাম।’
বৃষ্টির প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলির গল্পটি একটু অন্যরকম। ইহুদিদের নাকি বৃষ্টিতে ছাতা দরকার পড়ে না। তারা বৃষ্টির ধারার ফাঁকের মধ্য দিয়ে গলে শুকনো বেরিয়ে আসে।
তবে ভয়াবহ গল্প লিখেছিলেন হিমানীশ গোস্বামী। সেই গল্পের বিষয়বস্তু হল, জোর বৃষ্টিতে রাইটার্স বিলডিংসের সামনে রাস্তায় প্রচুর জল জমেছে। একেবারে থই থই জল। আর সেই জলে ডুবে সেচ দপ্তরের বড়বাবু মারা গিয়েছেন। সেই জন্যে রাইটার্স ছুটি হয়ে গেছে।
এমন আষাঢ়ে গল্প শুধু এমন বাদল দিনে বলা যায়।