এমন দিনে

এমন দিনে

দিনের পর দিন কাঠ-ফাটা গরম ভোগ করিয়া মানুষ যখন আশা ছাড়িয়া দিয়াছে তখন বৃষ্টি নামিল। শুধু বৃষ্টি নয়, বজ্র বিদ্যুৎ ঝোড়ো-হাওয়া। শহরের তাপদগ্ধ মানুষগুলাকে শীতলতার সুধাসমুদ্রে চুবাইয়া দিল।

বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে বেলা আন্দাজ তিনটার সময়। সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ দরবিগলিত ধারায় ভিজিতে ভিজিতে বাতাসের ঝাপ্‌টা খাইতে খাইতে সমীর গৃহে ফিরিল। শহরের প্রান্তে ছোট্ট একটি বাড়ি; নীচে দুটি ঘর, উপরে একটি। এইখানে সমীর তাহার বৌ ইরাকে লইয়া থাকে। দুটি প্রাণী। মাত্র বছর দেড়েক বিবাহ হইয়াছে। এখনও কপোতকূজন শেষ হয় নাই।

বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ। সমীর দ্বারের পাশে ঘণ্টি টিপিতেই দ্বার খুলিয়া গেল। ইরা দ্বারের কাছেই দাঁড়াইয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল। চকিত ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘খুব ভিজেছ তো?’

সমীর ভিতরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল, তারপর ভিজা জামাকাপড়সুদ্ধ ইরাকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। তাহার কোটপ্যান্টুলুন হইতে নির্গলিত জল ইরার দেহের সম্মুখভাগ ভিজাইয়া দিল। সমীর বলিল, ‘কী মজা! আজ খিচুড়ি খাব।’

ইরার মাথাটা সমীরের চিবুক পর্যন্ত পৌঁছায়। সে সবাঙ্গ দিয়া সমীরের দেহের সরসতা যেন নিজ দেহে টানিয়া লইল, তারপর ডিঙি মারিয়া তাহার চিবুকে অধর স্পর্শ করিয়া বলিল, ‘নিজে ভিজেছ, এবার আমাকেও ভিজিয়ে দিলে। ছাড়ো এবার। শিগ্‌গির জামাকাপড় ছেড়ে ফেললা, বাথরুমে সব রেখেছি। যা তোমার ধাত, এখুনি গলায় ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’

সমীর বলিল, ‘কী, আমার গলার নিন্দে! শোন তবে—’ বলিয়া গান ধরিল, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়—’

সমীরের গলা সুরের ধার দিয়া যায় না। ইরা তাহার বুকে হাত দিয়া নিজেকে মুক্ত করিয়া লইল; বলিল, ‘বাথরুমে গিয়ে গান গেও। কি খাবে—চা না কফি?’

সমীর তান ছাড়িল, ‘চা—চা—চা! যে চা মান্য অতিথিদের জন্যে সঞ্চয় করা আছে, যার দাম সাড়ে সাত টাকা পাউন্ড, আজ সেই চা খাব। সখি রে্‌-এ-এ-এ’—সমীর গিয়া বাথরুমে দ্বার বন্ধ করিল।

ইরা একটু দাঁড়াইয়া ভাবিল। সেও শাড়ি ব্লাউজ ছাড়িয়া ফেলিবে? না থাক, এ জল গায়েই শুকাইয়া যাক।…

বসিবার ঘরে আলো জ্বলিয়াছে। সমীর ও ইরা সামনাসামনি বসিয়া চা খাইতেছে। চায়ের সঙ্গে ডিম-ভাজা।

বাহিরে বর্ষণ চলিয়াছে। কখনও হাওয়ার দাপট বাড়িতেছে, বৃষ্টির বেগ কমিতেছে; কখনও তাহার বিপরীত। মেঘের গর্জন প্রশমিত হইয়া এখন কেবল গলার মধ্যে গুরুগুরু রব। ক্কচিৎ বিদ্যুতের একটু তৃপ্তহাসি।

এবেলা ঝি আসে নাই। বাঁচা গেছে। প্রত্যহ সন্ধ্যার পর সমীরের এক বন্ধু তাহার বাসায় আসিয়া আড্ডা জমায়, সে আজ বৃষ্টিতে বাহির হয় নাই। ভালই হইয়াছে। আজ বাড়িতে শুধু তাহারা দু’জন। এই জনাকীর্ণ নগরীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে থাকিয়াও তাহারা সম্পূর্ণ পৃথক; বৃষ্টি তাহাদের নিঃসঙ্গ করিয়া দিয়াছে। পরস্পরের সঙ্গ-সরস নিবিড় নিঃসঙ্গতা।

আজ সকালে অফিস যাইবার সময় সমীরের সঙ্গে ইরার একটু মনান্তর হইয়াছিল। সমীর মুখ ভার করিয়াছিল, ইরার অধর একটু স্ফুরিত হইয়াছিল। তখন দুঃসহ গরম। তারপর—পৃথিবীর বাতাবরণ বদলাইয়া গেল। কী লইয়া মনান্তর হইয়াছিল? ইরা অলসভাবে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু স্মরণ করিতে পারিল না।

চা শেষ হইলে ইরা ট্রে সরাইয়া রাখিয়া আসিয়া বসিল, সমীর সিগারেট ধরাইল। দু’জনে পরিতৃপ্ত মনে কোনও কথা না বলিয়া মুখোমুখি বসিয়া রহিল।

পৃথিবীর সকল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের মিল হয় না। যেখানে যেখানে মিল হইয়াছে সেখানেও ষোলোআনা মিল না হইতে পারে। দেহের স্তরে, হৃদয়ের স্তরে এবং বুদ্ধির স্তরে মিল কোটিকে গুটিক মিলে। সমীর ও ইরার ভাগ্যক্রমে তাহাদের মধ্যে দেহ-মন ও বুদ্ধির মিল অনেকখানিই হইয়াছিল; তাহাদের দেহ-মন পরস্পরের মধ্যে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তির স্বাদ পাইয়াছিল; বুদ্ধির দিক দিয়াও তাহারা পরস্পরকে সাগ্রহে বুঝিবার চেষ্টা করিত এবং অনেকটা বুঝিয়াছিলও। তবু মাঝে মাঝে কোন্‌ অসমতার ছিদ্রপথে দুঃখ আসিয়া উপস্থিত হইত, দু’জনকেই ব্যাকুল করিয়া তুলিত। বোধকরি দেহ-মন-বুদ্ধির অতীত একটা স্তর আছে, হয়তো তাহা পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের স্তর; সেখানে কেহ উঠিতে পারে না। তাই নিভৃত মনের গোপন করে একটু শূন্যতা থাকিয়া যায়।

কিন্তু আজ, বৰ্ষণ-পরিপ্লুত রাত্রে, সমীর ও ইরার মনে কোনও শূন্যতাবোধ ছিল না। বন্যার জলে যখন দশদিক ভাসিয়া গিয়াছে তখন কূপে কতখানি জল আছে কে তাহা মাপিয়া দেখিতে যায়।

দুইজনে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর সমীর বলিল, ‘অত দূরে কেন, কাছে এসে বোসো।’

ইরা বলিল, ‘তুমি এস।’ বলিয়া সোফা দেখাইল।

দু’জনে উঠিয়া গিয়া বেতের সোফায় পাশাপাশি বসিল। জানালার কাচের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ মুচকি হাসিল, মেঘ চাপা স্বরে গুরুগুরু করিল। সমীর বলিল, ‘কেমন লাগছে?’

সমীরের সিল্কের কিমোনোর কাঁধে গাল রাখিয়া ইরা অর্ধনিমীলিত নেত্রে চুপ করিয়া রহিল, শেষে অস্ফুটস্বরে বলিল, ‘বলা যায় না।’

সমীর বলিল, ‘কিন্তু কবি লিখেছেন বলা যায়।’

‘কবি বলতে পারেন, তাই বলে কি আমরা পারি?’

‘পারি।’ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সমীর ইরাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, ‘আজ বলব তোমাকে। তুমি বলবে?’

অনেকক্ষণ সমীরের বাহুবেষ্টনের মধ্যে পড়িয়া থাকিয়া ইরা চুপিচুপি কহিল, ‘বলব।’

সে-রাত্রে তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া তাহারা দ্বিতলের ঘরে শুইতে গেল।…

রাত্রি এগারোটা। বৃষ্টি মাঝে থামিয়া গিয়াছিল, আবার শুরু হইয়াছে। শিথিল বৃষ্টি, অবসন্ন মেঘের শ্লথ মুষ্টি হইতে অবশে ঝরিয়া পড়িতেছে।

সমীর ও ইরা বিছানায় পাশাপাশি শুইয়া আছে। নীলাভ নৈশ-দীপের মৃদু প্রভায় ঘরটি স্বপ্নবিষ্ট। দু’জনে চোখ বুজিয়া জাগিয়া আছে।

ইরার একটা হাত অলস তৃপ্তিতে সমীরের গায়ে পড়িল; সে কহিল, ‘এবার বল।’

সমীর হাত বাড়াইয়া সুইচ টিপিল, নৈশ-দীপ নিভিয়া গেল। অন্ধকারে ইরা প্রতীক্ষা করিয়া রহিল।

কিছুক্ষণ সমীরের সাড়া না পাইয়া ইরা আঙুল নাড়িয়া তাহার পাঁজরায় সুড়সুড়ি দিল। সমীর তখন ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—

হিসেব করছিলাম কতদিন আগেকার কথা। মাত্র সাত বছর, আমার বয়স তখন কুড়ি। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কবেকার কথা। তখন আমি কলকাতায় থেকে থার্ড ইয়ারে পড়ি আর কলেজের হোস্টেলে থাকি।

লম্বা ছুটিতে বাড়ি যেতাম, কিন্তু ছোটখাটো দু’এক দিনের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া হত না। ডায়মণ্ড হারবার লাইনে আমার এক পিসেমশাই থাকতেন, তাঁর কাছে যেতাম। বেশী দূর নয়, শিয়ালদা থেকে ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা; আধা-শহর আধা-পাড়াগাঁ জায়গাটা। কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকতে বেশ লাগত। গাছের ডাব, পুকুরের মাছ, পিসিমার হাতের রান্না—

পিসেমশায়ের সংসারে ওঁরা দুজন ছাড়া আর একটি মানুষ ছিল, পিসেমশায়ের ভাগ্‌নী সরলা। পিসিমাদের একমাত্র ছেলে অজয়দা নদীয়ার কলেজে প্রফেসারি করতেন, বাড়িতে বড় একটা আসতেন না। এঁদের সংসার ছিল এই তিনজনকে নিয়ে।

সরলা বাপ-মা-মরা মেয়ে, মামার কাছে মানুষ হয়েছিল। বয়সে আমার চেয়ে দু’এক বছরের ছোট; বিয়ে হয়নি। রোগা লম্বা চেহারা, ফ্যাল্‌ফেলে দু’টো চোখ, মেটে-মেটে রঙ। কিন্তু সব মিলিয়ে দেখতে মন্দ নয়। একটু যেন ভীরু প্রকৃতি, সহজভাবে কারুর সঙ্গে মিশতে পারত না। প্রথম প্রথম আমাকে দেখে পালিয়ে বেড়াত। তারপর ‘সমীরদা’ বলে ডাকত, কিন্তু চোখে চোখ মিলিয়ে চাইতে পারত না।

আমার তখন যে বয়স সে-বয়সে সব মেয়েকেই ভাল লাগে। সরলাকেও আমার ভাল লাগত। কিন্তু মনে পাপ ছিল না। তাছাড়া আমি কি রকম আনাড়ি ছিলাম তা তো তুমি জানো। মেয়েদের যতই ভাল লাগুক, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার কায়দা-কানুন জানতাম না।

যাহোক, একদিন পিসিমার বাড়িতে গিয়েছি। সেটা ফাল্গুন কি চৈত্র মাস ঠিক মনে নেই। বিকেলবেলা পৌঁছে দেখি বাড়িতে হৈ-হৈ কাণ্ড। নবদ্বীপ থেকে টেলিগ্রাম এসেছে অজয়দার ভারি অসুখ; পিসেমশাই আর পিসিমা এখনি নবদ্বীপ যাচ্ছেন। আমাকে দেখে পিসিমা বললেন—তুই এসেছিস বাবা, ভালই হল। অজুর অসুখ, আমরা এখুনি নবদ্বীপ যাচ্ছি। ঠাকুরের দয়ায় যদি অজু ভাল থাকে, তোর পিসেমশাই কালই ফিরে আসবেন। তুই ততক্ষণ বাড়ি আগ্‌লাস্। সরলাও রইল।

পিসিমা আর পিসেমশাই প্রায় একবস্ত্রে ইস্টিশানে চলে গেলেন। বাড়িতে রয়ে গেলাম আমি আর সরলা।

ক্রমে সন্ধ্যে হল, সন্ধ্যে থেকে রাত্রি। আমার মনে যেন একটা কাঁটা বিঁধে আছে। সরলা রান্না করতে গেল। খাবার তৈরি হলে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। সরলার সঙ্গে আমার তিনটে কথা হল কিনা সন্দেহ। সে আমার পানে কেমন একরকমভাবে তাকাচ্ছে, আবার তখনি চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। তার চাউনির মানে ধরতে পারছি না, কিন্তু মনটা অশান্ত হয়ে উঠছে। এক বাড়িতে আমি আর একটি যুবতী, আর কেউ নেই। আগুন আর ঘি—

রাত বাড়তে লাগল। আমি বাড়ির দোড়তাড়া বন্ধ করে শুতে গেলাম। আমার শোবার ঘর নীচে, বৈঠকখানার পাশে; সরলা শোয় ওপরে।

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। খাটটা বেশ বড়; হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া যায়। জানালা দিয়ে ঝিরঝিরে বাতাস আসছে। আমার মনটা বেশ শান্ত হয়ে এল। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল একজনের গায়ে হাত ঠেকে। চোখ চেয়ে দেখি সরলা আমার পাশে বিছানায় শুয়ে আছে। …তারপর—তারপর সে-রাত্রির বর্ণনা দিতে পারব না। সারারাত্রি নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কাঠ হয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম। সরলাও বোধ হয় সারারাত জেগে ছিল; ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পরের দিনটা কাটল দুঃস্বপ্নের মতো। একসঙ্গে ওঠা-বসা, সে রাঁধছে আমি খাচ্ছি, অথচ কেউ কারুর মুখের পানে তাকাতে পারছি না। আজ যদি পিসেমশাই ফিরে না আসেন, যদি রাত্রে আবার কালকের মতো ব্যাপার ঘটে, তাহলে—

সরলার মনে কি ছিল জানি না। হয়তো সে ভূতের ভয়েই আমার কাছে এসে শুয়েছিল। কিন্তু আমি নিজের কথা বলতে পারি, ভূতের চেয়েও বড় ভূত আমার কাঁধে ভর করেছিল। সেদিন যদি পিসেমশাই না আসতেন—

ভাগ্যক্রমে পিসেমশাই বিকেলবেলা ফিরে এলেন। অজয়দার পান-বসন্ত হয়েছে, ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমি সেই রাত্রেই কলকাতায় চলে এলাম। তারপর সরলাকে আর দেখিনি; ওদিকেই আর পা বাড়াইনি। তবে শুনেছি সরলার বিয়ে হয়ে গেছে।

সমীর নীরব হইল। ইরাও কথা কহিল না। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিবার পর সমীর জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেমন শুনলে?’

ইরা সমীরের দিকে পাশ ফিরিয়া শুইল। বলিল, ‘আনাড়ি ছিলে বলেই বেঁচে গিয়েছিলে। কিন্তু ভারি রোমান্টিক আর রহস্যময়।’ তাহার কণ্ঠস্বরে একটু তরলতার আভাস পাওয়া গেল।

সমীর প্রশ্ন করিল, ‘আর তোমার?’

‘আমার ভারি সীরিয়স ব্যাপার হয়েছিল।’

ইরা ধীরে ধীরে থামিয়া থামিয়া বলিতে আরম্ভ করিল—

আমার তখন সতের বছর বয়স, বছর চারেক আগেকার কথা। সবে স্কুল থেকে কলেজে ঢুকেছি।

আমার প্রাণের বন্ধু সাধনা একবছর আগে কলেজে ঢুকেছে। একদিন চুপিচুপি আমায় বলল, সে প্রেমে পড়েছে। এক গল্পলেখকের সঙ্গে। তাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখি চলছে। আমাকে চিঠি দেখাল।

দেখেশুনে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। আমি যেন সব-তাতেই পেছিয়ে আছি। কী উপায়? আমার বাপের বাড়িতে মেয়েদের ওপর ভারি কড়া নজর। মেয়ে-কলেজে পড়ি, গাড়ি চড়ে গুড়গুড় করে কলেজে যাই, গুড়গুড় করে ফিরে আসি। ছোঁড়াদের সঙ্গে হুল্লোড় করার সুবিধে নেই। বাবা জানতে পারলে কেটে ফেলবেন।

সাধনার কথাবার্তা থেকে মনে হয় প্রেমে না পড়লে জীবনই বৃথা। শেষ পর্যন্ত মরীয়া হয়ে প্রেমে পড়ে গেলুম। আমাদের কলেজের হিস্ট্রির প্রফেসর দিগম্বরবাবুর সঙ্গে।

তুমি যা ভাবছ তা নয়; দিগম্বরবাবুর নামটাই বুড়ো, তিনি মানুষটা বুড়ো নয়। ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়স, পাতলা ধারালো মুখ, খাঁড়ার মতো নাকের ওপর রিম্‌লেস চশমা। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা চাপা বিদ্রূপ থাকত যে মেয়েরা মনে মনে তাঁকে ভয় করত, তাঁর সঙ্গে প্রেমে পড়ার সাহস কারুর ছিল না। আমিই বোধ হয় প্রথম।

প্রফেসরদের মধ্যে দিগম্বরবাবুই ছিলেন অবিবাহিত। আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা আমার বাবার বয়সী; কারুর তিনটে ছেলে, কারুর পাঁচটা মেয়ে।

দিগম্বরবাবু যখন ক্লাসে আসতেন আমি একদৃষ্টে তাঁর মুখের পানে চেয়ে থাকতাম। তাঁর নাকের ফুটো ছিল ভীষণ বড় বড়, কানে খাড়া খাড়া লোম, মাথার ঠিক মাঝখানে ঘষা পয়সার মতো খানিকটা জায়গায় চুল পাতলা হয়ে গিয়েছিল, মাথা হেঁট করলেই চক্‌চক্‌ করে উঠত। বোধহয় টাকের পূর্বলক্ষণ। কিন্তু তিনি পড়াতেন ভারি চমৎকার, শুনতে শুনতে মগ্ন হয়ে যেতুম।

কিছুদিন এইভাবে দূর থেকে প্রেম-নিবেদন চলল। কিন্তু এভাবে কতদিন চলে? সাধনা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে—প্রেম কতদূর? আমি কিছুই বলতে পারি না। সাধনার প্রেম অনেকদূর এগিয়েছে; তারা এখন লুকিয়ে লুকিয়ে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যায়, পার্কে বসে অনেক রাত্রি পর্যন্ত প্রেমালাপ করে। এদিকে আমার প্রেম যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে, এক পা এগুচ্ছে না। এগুবে কোখেকে? দিগম্বরবাবুর কাছে গিয়ে কথা কইবার নামেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

শেষে এক চিঠি লিখলুম। হৃদয়ের আবেগ-ভরা লম্বা চিঠি। তারপর কলেজের ঠিকানায় প্রফেসর দিগম্বর ঘোষালের নামে পাঠিয়ে দিলুম। চিঠিতে সবই ছিল, কেবল একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। নিজের নাম দস্তখত করিনি।

পরদিন বিকেলবেলা হিস্ট্রির ক্লাস। দিগম্বরবাবু ক্লাসে এলেন। লেক্‌চার আরম্ভ করবার আগে পকেট থেকে আমার চিঠিখানা বার করে বললেন, ‘আমি আজ একটা প্রেমপত্র পেয়েছি, তোমাদের পড়ে শোনাতে চাই।’

দিগম্বরবাবু চিঠি পড়তে লাগলেন। মেয়েরা প্রথমে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর মুখ-তাকাতাকি করতে লাগল। দিগম্বরবাবুও চিঠি পড়তে পড়তে চোখ তুলে আমাদের মুখের ভাব লক্ষ্য করতে লাগলেন।

আমার অবস্থা বুঝতেই পারছ। মনে হল আমার বুকের দুমদুম শব্দ সবাই শুনতে পাচ্ছে। কেন যে তখনই ধরা পড়ে যাইনি তা জানি না। দিগম্বরবাবু কিন্তু চিঠির সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করলেন না, চিঠি শেষ করে একটু মুচকি হেসে লেক্‌চার আরম্ভ করলেন।

কলেজে এই নিয়ে বেশ একটু হৈ-চৈ হল। দিগম্বরবাবু অন্য ক্লাসের মেয়েদেরও চিঠি পড়ে শুনিয়েছেন। সব মেয়েরা উত্তেজিত, কে চিঠি লিখেছে? ভাগ্যিস, চিঠিতে সই করতে ভুলে গিয়েছিলুম, নইলে বিষ খেতে হত।

আমার প্রেম তখন মুমূর্ষু, পুরুষ জাতটা যে কী ভীষণ হৃদয়হীন তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সাধনা আমাকে বোঝাচ্ছে যে, প্রেমের পথ কণ্টকাকীর্ণ, ওতে ভয় পেলে চলবে না। আমি কিন্তু ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। বাবা যদি জানতে পারেন—

দশ-বারো দিন কেটে গেল, তারপর এক নতুন খবর কলেজে ছড়িয়ে পড়ল—দিগম্বরবাবু স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত যাচ্ছেন। আমার খুবই দুঃখ হবার কথা, কিন্তু দুঃখ মোটেই হল না। ভাবলুম এবার বুঝি প্রেমের দায় থেকে নিষ্কৃতি পাব।

কিন্তু নিষ্কৃতি অত সহজ নয়। বিলেত যাবার আগের দিন দিগম্বরবাবু আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে পাঠালেন। কাঁপতে কাঁপতে তাঁর অফিস-ঘরে গেলুম। তিনি টেবিলের সামনে বসে কাগজপত্র সই করছিলেন, ঘরে আর কেউ ছিল না। আমাকে দেখে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘বোসো’।

আমি তাঁর সামনের চেয়ারে বসলুম। তিনি কাগজে সই করতে করতে বললেন, ‘চিঠিখানা তুমি লিখেছিলে?’

আমি কেঁদে ফেললুম।

তিনি উঠে এসে আমার চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন; নরম সুরে বললেন, ‘তুমি সত্যি আমায় ভালবাস?

অত বড় উচ্ছ্বাসময় চিঠির পর আর অস্বীকার করা চলে না। আমি ঘাড় নেড়ে জানালুম, ‘হ্যাঁ, ভালবাসি।’

তিনি তখন বললেন, ‘কিন্তু আমি যে কালই বিলেত চলে যাচ্ছি, বছরখানেক সেখানে থাকতে হবে। তুমি একবছর অপেক্ষা করতে পারবে?’

আমি ঘাড় নাড়লুম—‘হ্যাঁ, পারব।’

তিনি হেসে পিঠ চাপড়ে দিলেন; বললেন, ‘বেশ বেশ। এখন যাও, মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। আমি ফিরে আসি, তারপর দেখা যাবে।’

দিগম্বরবাবু বিলেত চলে গেলেন। প্রথম কিছুদিন খুব আনন্দে কাটল। তারপর ক্রমে দুর্ভাবনা। যতই দিন ফুরিয়ে আসছে ততই ভয় বাড়ছে। এইভাবে একবছর যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন দিগম্বরবাবুর এক চিঠি পেলুম। বোধহয় কলেজ থেকে আমার ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন। এই তাঁর প্রথম এবং শেষ চিঠি। তিনি লিখেছেন—‘কল্যাণীয়াসু, আমি শীঘ্রই দেশে ফিরব। তুমি শুনে সুখী হবে, আমি এখানে এসে একটি ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করেছি। তার নাম নেলি। মিষ্টি নাম নয়? আশা করি, তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করছ। ইতি—’

কি আনন্দ যে হয়েছিল তা আর বলতে পারি না। তারপর আর কি? আর প্রেমে পড়িনি। দু’বছর পরে তোমার সঙ্গে বিয়ে হল।

সমীর হাত বাড়াইয়া নৈশ দীপ জ্বালিল। দুইজনে কিছুক্ষণ মুখোমুখি শুইয়া রহিল। তারপর অতিদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সমীর বলিল, ‘দিগম্বরবাবু ভদ্রলোক ছিলেন তাই বেঁচে গিয়েছিলে। কিন্তু ইরা, সত্যি যদি একটা নোংরা ব্যাপার হত? তুমি আমাকে বলতে পারতে?’

ইরা কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া রহিল। আজ মনকে চোখ ঠারিবার দিন নয়; সে মনের অন্তস্তল পর্যন্ত খুঁজিয়া দেখিল। না, আজিকার রাত্রে সে সমীরের কাছে কোনও কথাই লুকাইতে পারিত না। সে চোখ খুলিয়া বলিল, ‘পারতাম।’

আবার বৃষ্টির জোর বাড়িয়াছে। জানালার বাহিরে একটানা ঝরঝর শব্দ। দুইজনে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে শুইয়া ভাবিতেছে। আজ তাহারা যেমন পরিপূর্ণভাবে পরস্পরকে পাইয়াছে এমন আর পূর্বে কখনও পায় নাই; তাহাদের মাঝখানে যেটুকু ফাঁক ছিল তাহা নিবিড়ভাবে ভরাট হইয়া গিয়াছে।

৩১ আষাঢ় ১৩৬৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *